Home > হিজবুত তাওহীদ > কিতাবুল্লাহ নিয়ে মন্তব্য:

কিতাবুল্লাহ নিয়ে মন্তব্য:

আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদের তাঁর বিধানমত চালানোর জন্য যুগে যুগে কিতাব পাঠিয়েছেন। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে সর্বমোট আসমানী কিতাব পাঠানো হয়েছে ১০৪টি। তার মধ্যে ৪টি হলো প্রধান আসমানী কিতাব। পবিত্র তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল ও কুরআন। আর বাকি ১০০টি সহীফা। এর বাহিরে কোনো কিতাব আল্লাহ পাঠাননি। কিন্তু সকল কিতাব বিকৃত করে ফেলেছে তার অনুসারীরা। কিন্তু একমাত্র কুরআন অবিকৃত অবস্থায় আজও আমাদের মাঝে বিদ্যমান। কারণ কুরআন হিফাযতের দায়িত্ব খোদ আল্লাহ তা’আলা নিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে হেযবুত তওহীদ বেশ কয়েকটা মিথ্যাচার করেছে। তার সারসংক্ষেপ হলো-
১. কুরআনের কপি তৈরি হয়েছে উসমান রা. এর পর।
২. কুরআনের আত্মা হারিয়ে গেছে।
৩. হালাল-হারামের মানদণ্ড শুধু কুরআন।
৪. কুরআন রাষ্ট্রে কায়েম না হলে এর কোনো দাম নেই।
৫. কুরআনের আইন কার্যকর না হলে তিলাওয়াত ও শোনার মধ্যে কোনো ফায়দা নেই।
৬. আল্লাহর কিতাব থেকেও মুমিনের দাম বেশি।
৭. কুরআনের তাফসীর পড়া যাবে না।
৮. সকল ধর্মগ্রন্থ আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব।
৯. বেদ মুহাম্মাদ সা. এর উপর অবতীর্ণ।

চলুন এ ব্যাপারে প্রমাণসহ আলোচনা করা যাক।

কুরআনের কপি কী তৈরি হয়েছে উসমান রা. এর পরে?
পবিত্র কুরআন একটি সার্বজনীন স্বীকৃত সহিহ গ্রন্থ। যাঁর ব্যাপারে পৃথিবীর কোনো মুসলমানের সন্দেহ থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার অনেক ষড়যন্ত্র ইতিপূর্বেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এমনই একটি ষড়যন্ত্র করে চলেছে হেযবুত তওহীদ। অত্যান্ত কৌশলে তারা পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে সংশয় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চলুন হেযবুত তওহীদের বক্তব্যটা আগে দেখে নেওয়া যাক।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা লিখেছে, ‘ঐ জাতির কাছে আল্লাহর দেয়া সংবিধান কোর’আনের মাত্র কয়েকটি হাতেলেখা কপি ছিল, তাও খলিফা ওসমান রাযি.- এর সময়ের পরে। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা, পৃ. ১৪ মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ১৭-১৮ যুগসন্ধিক্ষণে আমরা, পৃ. ৮ এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব, পৃ. ৬৪ এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ১৩-১৪

উক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে তারা বুঝাতে চায়, পবিত্র কুরআনের লিপিবদ্ধ সংকলন নবীজির সা. যুগে ছিলো না, বরং উসমান রা. এর পর এটার সংকলন করা হয়েছে। এ কথাটা দিয়ে তারা কৌশলে বুঝাতে চায় যে, যে কুরআন নবীজির সা. ইন্তেকালের দীর্ঘ কয়েক বছর পর একত্রিত করা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে কিভাবে সন্দেহমুক্ত থাকা যায়?

ইসলাম কী বলে?

পবিত্র কুরআন ইসলামের মৌলিক ধর্মগ্রন্থ ও সত্য গ্রন্থ। আর পুরো কুরআনের ব্যাখ্যা করেছেন নবীজির সা.। যা হাদিসসমূহে মওজুদ রয়েছে। এই পবিত্র কুরআন মজীদ আল্লাহর নিকটে লাওহে মাহফুজে এক নির্দিষ্ট নিয়মে সাজানো ছিলো আগ থেকেই। সেখান থেকে সুদীর্ঘ তেইশ বৎসরে আবশ্যক ও প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে হযরত মুহাম্মদ সা. এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। কখনো একটি আয়াত কখনও একটি সূরা এভাবে। যখনই যে আয়াত বা আয়াতসমূহ নাযিল হয়েছে, তখনই হযরত জিব্রাইল আ. তা লাওহে মাহফুজের তারতীব (ক্রমে) অনুসারে কোন সুরায় কোন আয়াতের পরে বা আগে স্থান পাবে তা স্পষ্টভাবে বলে দিতেন এবং তদনুসারে হযরত সা. সাথে সাথে মুখস্থ করে নিতেন এবং কাতেবে ওহীকে সেভাবেই লেখার নির্দেশ দিতেন। খোদ নবীজি সা. বলে দিতেন, এই আয়াতটিতে অমুক সুরার অমুক আয়াতের পরে লিখে রাখো। কাতেবে ওহীগণও সেভাবে লিখে রাখতেন।

কাতেবে ওহীগণের নাম:

অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সা. এর উপরে নাযিলকৃত কোরআনের আয়াত লিখতেন, তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন সাহাবীর নাম হলো-
হযরত আবু বকর রা. হযরত ওমর রা. হযরত উসমান রা. হযরত আলী রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবি সারাহ রা. হযরত জুবায়ের ইবনে আওয়াম রা. হযরত খালেদ ইবনে সাঈদ ইবনে আস রা. হযরত আবান ইবনে সাঈদ ইবনে আস রা. হযরত হানজালা ইবনে রবি রা. হযরত মুআইকিব বিন আবি ফাতিমা রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আরকাম আজ জহুরী রা. হযরত শুরাহবিল ইবনে হাসানা রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রা. হজরত আমির ইবনে ফুহায়রা রা. হযরত আমের ইবনে আস রা. হযরত সাবেত ইবনে কায়েস রা. হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা রা. হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ রা. হযরত আবু সুফিয়ান ইবনে মুয়াবিয়া রা. হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রা. প্রমুখ।

নবিজি সাঃ-এর যুগে পবিত্র কুরআনের কপি ছিলো?
রাসুলুল্লাহ সাঃ এর জীবদ্দশায় পূর্ণ কুরআন একত্রিতভাবে মুসহাফ বা গ্রন্থ আকারে ছিলো না। যেহেতু হুজুরের অন্তর্ধানপূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত কুরআন অবতীর্ণ হচ্ছিল। তাই এ ধরণের গ্রন্থ আকারে রূপ দেওয়া বা একত্র করা সম্ভবপর হয়নি। তবে ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে অনেকে ঐ সময় পর্যন্ত নাজিলকৃত আয়াতসমূহ একস্থানে লিখে নিয়েছিলেন তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে। কারণ পবিত্র কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম রা. সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিতেন যেন কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি না হয়। তাঁরা শুধু মুখস্ত করেই ক্ষ্যান্ত হতেন না, বরং সামর্থ অনুযায়ী হাড়, পাথর, চামড়া ও খেজুরডালা ইত্যাদির উপর লিখে রাখতেন। শুধু সাহাবায়ে কেরাম রা. নন, বরং রাসুলুল্লাহ সা. ও  হযরত জিবরাইল আ. যখন কোন আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হতেন তখন তা পাঠ করার সময় রাসুল সা. সাথে সাথে পাঠ করে নিতেন এবং জিহবা নেড়ে নেড়ে এত দ্রুত আবৃত্তি করতেন যা রাসুলুল্লাহ সা. এর জন্যে কষ্টকর হয়ে যেত। ফলে আল্লাহ তা’আলা নবীজিকে সা. আশ্বস্ত করার নিমিত্তে ঘোষণা করেন,
لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ
তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্যে আপনি দ্রুত ওহী আবৃত্তি করবেন না। এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমারই দায়িত্ব। [সুরা ক্বিয়ামাহ : ১৬-১৭]

উপরন্তু বহুসংখ্যক সাহাবা রা. এমনও ছিলেন যে, যখন কোনো আয়াত অবতীর্ণ হতো, তখন তা হিফজ করে নিতেন। ফলে সাহাবায়ে কেরামদের রা. বড় একটি দল পূর্ণ কুরআনের হাফেজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর যারা পূর্ণ কুরআন হিফজ করতে সক্ষম হননি। তারা আংশিক হলেও হিফজ করে নিতেন।

এ ছাড়াও রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগে সাহাবায়ে কেরামের রা. কাছে পূর্ণ বা অপূর্ণ কুরআন শরীফের নুসখা থাকার প্রমাণ কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে নিন্মে দু’টি হাদিস বর্ণনা করছি। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم نَهَى أَنْ يُسَافَرَ بِالْقُرْآنِ إِلَى أَرْضِ الْعَدُوِّ
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন সঙ্গে নিয়ে শত্রু-দেশে সফর করতে নিষেধ করেছেন। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ২৯৯০]

নোট: উক্ত হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, যেহেতু রাসুলুল্লাহ সা. কুরআন শরীফ সঙ্গে নিয়ে শত্রুদের দেশে সফর করতে নিষেধ করেছেন, সেহেতু কুরআন শরীফের কপি সাহাবায়ে কেরামের রা. কাছে না থাকলে, তিনি এমনটা কেন বলবেন?

হযরত উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনু আওস আস্ সাকাফী রহি. তাঁর দাদা আওস রা. হতে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
قِرَاءَةُ الرَّجُلِ الْقُرْآنَ فِي غَيْرِ الْمُصْحَفِ أَلْفُ دَرَجَةٍ وَقِرَاءَتُهُ فِي الْمُصحف تضعف عل ذَلِك إِلَى ألفي دَرَجَة
কোন ব্যক্তির মাসহাফ ছাড়া (অর্থাৎ- কুরআন দেখা ছাড়া) মুখস্থ কুরআন পড়া এক হাজার গুণ মর্যাদা সম্পন্ন। আর কুরআন মাসহাফে পড়া (অর্থাৎ- কুরআন খুলে দেখে দেখে পড়া) মুখস্থ পড়ার দু’ গুণ থেকে দু’ হাজার গুণ পর্যন্ত মর্যাদা রাখে। [মু‘জামুল কাবীর (ত্ববারানী) হাদিস নং : ৬০১]

নোট: উপরোক্ত হাদিসটি থেকে বুঝা যায়, রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগেই সাহাবায়ে কেরামের রা. কাছে পবিত্র কুরআনের কপি ছিলো। না থাকলে  নবীজি সা. এটা কেন বলবেন? সুতরাং ধারণা করা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগেও কিছু সাহাবায়ে কেরামের কাছে কুরআন শরীফের কপি বিদ্যমান ছিল। যদিও সেটা কিতাবের আকারে না থাকলেও শীট আকারে ছিলো।

আবু বকর রা. এর যুগে কুরআনের কপির অস্তীত্ব:
নবিজি সাঃ-এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. ইসলামের প্রথম খলীফা হন। তাঁর খেলাফতের সূচনালগ্নেই অভিশপ্ত মিথ্যা নবী দাবীদার মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের সাথে যুদ্ধের জন্য সাহাবায়ে কেরামের রা. বড় একটি জামাত প্রস্তুত করেন সিদ্দিকে আকবার রা.। অবশেষে উভয়পক্ষই যুদ্ধের জন্যে ‘ইয়ামামা’ নামক স্থানে যুদ্ধ করেন। সেজন্য এ যুদ্ধকে ‘ইয়ামামা যুদ্ধ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এ যুদ্ধে সত্তর জন হাফেজে কুরআন সাহাবী শহীদ হন। উমদাতুল ক্বারীতে এসেছে, ৭০০ হাফেজ সাহাবী শহীদ হন। ফলে হযরত উমর রা. মারত্মক ভাবে মর্মাহত হন এবং ভবিষ্যতে কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে ওমর রা. খুব চিন্তিত এবং শংকিত হয়ে পড়েন। অতপর তিনি বিষয়টি খলীফা আবু বকর রা. এর সাথে পরামর্শ করেন। যার বিস্তারিত ঘটনা সহিহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। কাতেবে ওহী হযরত যায়দ ইবনে সাবেত রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَرْسَلَ إِلَيَّ أَبُوْ بَكْرٍ مَقْتَلَ أَهْلِ الْيَمَامَةِ وَعِنْدَهُ عُمَرُ فَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ إِنَّ عُمَرَ أَتَانِيْ فَقَالَ إِنَّ الْقَتْلَ قَدْ اسْتَحَرَّ يَوْمَ الْيَمَامَةِ بِالنَّاسِ وَإِنِّيْ أَخْشَى أَنْ يَسْتَحِرَّ الْقَتْلُ بِالْقُرَّاءِ فِي الْمَوَاطِنِ فَيَذْهَبَ كَثِيْرٌ مِنَ الْقُرْآنِ إِلَّا أَنْ تَجْمَعُوْهُ وَإِنِّيْ لَأَرَى أَنْ تَجْمَعَ الْقُرْآنَ قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ قُلْتُ لِعُمَرَ كَيْفَ أَفْعَلُ شَيْئًا لَمْ يَفْعَلْهُ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ عُمَرُ هُوَ وَاللهِ خَيْرٌ فَلَمْ يَزَلْ عُمَرُ يُرَاجِعُنِيْ فِيْهِ حَتَّى شَرَحَ اللهُ لِذَلِكَ صَدْرِيْ وَرَأَيْتُ الَّذِيْ رَأَى عُمَرُ قَالَ زَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ وَعُمَرُ عِنْدَهُ جَالِسٌ لَا يَتَكَلَّمُ فَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ إِنَّكَ رَجُلٌ شَابٌّ عَاقِلٌ وَلَا نَتَّهِمُكَ كُنْتَ تَكْتُبُ الْوَحْيَ لِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَتَتَبَّعُ الْقُرْآنَ فَاجْمَعْهُ فَوَاللهِ لَوْ كَلَّفَنِيْ نَقْلَ جَبَلٍ مِنَ الْجِبَالِ مَا كَانَ أَثْقَلَ عَلَيَّ مِمَّا أَمَرَنِيْ بِهِ مِنْ جَمْعِ الْقُرْآنِ قُلْتُ كَيْفَ تَفْعَلَانِ شَيْئًا لَمْ يَفْعَلْهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ هُوَ وَاللهِ خَيْرٌ فَلَمْ أَزَلْ أُرَاجِعُهُ حَتَّى شَرَحَ اللهُ صَدْرِيْ لِلَّذِيْ شَرَحَ اللهُ لَهُ صَدْرَ أَبِيْ بَكْرٍ وَعُمَرَ فَقُمْتُ فَتَتَبَّعْتُ الْقُرْآنَ أَجْمَعُهُ مِنْ الرِّقَاعِ وَالأَكْتَافِ وَالْعُسُبِ وَصُدُوْرِ الرِّجَالِ حَتَّى وَجَدْتُ مِنْ سُوْرَةِ التَّوْبَةِ آيَتَيْنِ مَعَ خُزَيْمَةَ الْأَنْصَارِيِّ لَمْ أَجِدْهُمَا مَعَ أَحَدٍ غَيْرِهِ (لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيْزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيْصٌ) إِلَى آخِرِهِمَا وَكَانَتْ الصُّحُفُ الَّتِيْ جُمِعَ فِيْهَا الْقُرْآنُ عِنْدَ أَبِيْ بَكْرٍ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللهُ
হযরত আবূ বকর রা. (তার খিলাফাতের সময়) এক ব্যক্তিকে আমার কাছে ইয়ামামার যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করলেন। (আমি তার কাছে চলে আসলাম) তখন তার কাছে ’উমার রা. বসা ছিলেন। আবু বকর রা. আমাকে বললেন, ’উমার রা. আমার কাছে এসে বললেন যে, ইয়ামামার যুদ্ধ তীব্র গতিতে চলছে, আমার ভয় হচ্ছে, কুরআনের অভিজ্ঞগণ (হাফিযগণ) ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হয়ে যান নাকি! যদি আপনারা তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করেন তবে কুরআনের অনেক অংশ চলে যেতে পারে এবং কুরআনকে একত্রিত সংরক্ষণ করা ভাল মনে করি। আবু বকর রা. বলেন, আমি ’উমার রা. কে বললাম, আমি এ কাজ কীভাবে করতে পারি, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম করে যাননি। কিন্তু ’উমার রা. বললেন, আল্লাহর কসম! এটা কল্যাণকর। ’উমার রা. তাঁর এ কথার পুনরুক্তি করতে থাকেন, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা এ কাজ করার জন্য আমার অন্তর খুলে দিলেন এবং আমিও ’উমার রা. এর মতোই মতামত পেশ করলাম। যায়দ ইবনু সাবিত রা. বলেন, ’উমার রা.  সেখানে নীরবে বসা ছিলেন, কোন কথা বলছিলেন না। এরপর আবূ বকর রা. আমাকে বললেন, দেখ, তুমি যুবক এবং জ্ঞানী ব্যক্তি। আমরা তোমার প্রতি কোনরূপ খারাপ ধারণা রাখি না। কেননা, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে ওয়াহী লিপিবদ্ধ করতে।

সুতরাং তুমি কুরআনের আয়াত সংগ্রহ করে একত্রিত কর। আল্লাহর কসম! তিনি কুরআন একত্রিত করার যে নির্দেশ আমাকে দিলেন, সেটি আমার কাছে এত ভারী মনে হলো যে, তিনি যদি কোন একটি পর্বত স্থানান্তর করার আদেশ দিতেন তাও আমার কাছে এমন ভারী মনে হতো না। আমি বললাম, যে কাজটি নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম করে যাননি, সে কাজটি আপনারা কীভাবে করবেন? তখন আবূ বকর রা. বললেন, আল্লাহর কসম! এটাই কল্যাণকর। এরপর আমিও আমার কথার উপর বারবার জোর দিতে লাগলাম।

শেষে আল্লাহ যেটা বুঝার জন্য আবূ বকর রা. ও ’উমার রা. এর অন্তর খুলে দিয়েছিলেন, আমার অন্তরকেও তা বুঝার জন্য খুলে দিলেন। এরপর আমি কুরআন সংগ্রহে লেগে গেলাম এবং হাড়, চামড়া, খেজুর ডাল ও বাকল এবং মানুষের স্মৃতি থেকে তা সংগ্রহ করলাম। অবশেষে খুযাইমাহ আনসারীর কাছে সূরায়ে তাওবার দু’টি আয়াত পেয়ে গেলাম, যা অন্য কারও নিকট হতে সংগ্রহ করতে পারিনি। لَقَدْ جَاءَكُمْ থেকে শেষ পর্যন্ত। এরপর এ একত্রিত কুরআন আবূ বকর রা. এর ওফাত পর্যন্ত তাঁর কাছেই জমা ছিল। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৪৬৭৯]

সুতরাং উক্ত বর্ণনায় এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, পবিত্র কুরআনের কপি আকারে সর্বপ্রথম তৈরি করা হয়েছিলো আবু বকর রা. এর যুগেই। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এ সম্পর্কে যথেষ্ট মুর্খ বলেই দাবি করেছেন, ‘উসমান রা. এর পরে কপি তৈরি করা হয়েছিলো’।

হযরত ওমর রা. এর যুগে কুরআনের কপি:
হযরত আবু বকর রা. এর ইন্তেকালের পর সেই কপিটি হযরত ওমর রা. এর কাছে সংরক্ষিত ছিলো। যা বুখারী শরীফের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়।
ثُمَّ عِنْدَ عُمَرَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللهُ ثُمَّ عِنْدَ حَفْصَةَ بِنْتِ عُمَرَ تَابَعَهُ عُثْمَانُ بْنُ عُمَرَ
তারপর (আবু বকর রা. এর ইন্তেকালের পর কুরআনের কপাটি) হযরত ’উমার রা. এর কাছে সংরক্ষিত ছিলো। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এটি তার কাছেই ছিল। তারপর ছিল হাফসাহ বিনত ’উমার রা. এর কাছে। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৪৬৭৯]

উসমান রা. এর যুগে কুরআনের কপি:
বর্তমান সারাবিশ্বে যে প্রকারের গ্রন্থ আকারে কুরআন শরীফ বিদ্যমান তাকে মাসহাফে উসমানিয়া বলা হয়। এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলো, খলীফা হযরত উসমান রা. এর খেলাফতের শুরু দিকে আর্মেনিয়া ও আজরবাইযানে মুসলমানদের সংগে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সে যুদ্ধে হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রা. ও ছিলেন। তিনি সে জিহাদের সফরে হেজায ও শামের বিভিন্ন গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে কুরআনের বিভিন্ন পাঠ দেখতে পান। হুজাইফা রা. একজন দূরদর্শী বিচক্ষণ, অভিন্ন এবং গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। যাঁর। উপাধী ছিলো, ছিররুন নবী বা নবী সা. এর গোপন রহস্যজ্ঞানী। নবী সা. সমস্ত গোপন কথা যা কেয়ামত পর্যন্ত সংগঠিত হবে হযরত হুজাইফা রা. কে বলে গেছেন। তিনি এসব বিভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠ দেখে ভীত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। অতপর উসমান রা. কে বিষয়টি অবহিত করলে খলীফা উসমান রা. মক্কা-মাদীনার আশপাশের সকল সাহাবায়ে কেরাম রা. কে আহ্বান করলে ৫০ হাজার সাহাবীর সম্মতিতে আমাদের সামনে থাকা এই কুরআনের সংকলন করা হয়। এ সম্পর্কে হযরত আনাস রা. বলেন,
أَنَّ حُذَيْفَةَ بْنَ الْيَمَانِ قَدِمَ عَلَى عُثْمَانَ وَكَانَ يُغَازِيْ أَهْلَ الشَّأْمِ فِيْ فَتْحِ إِرْمِيْنِيَةَ وَأَذْرَبِيْجَانَ مَعَ أَهْلِ الْعِرَاقِ فَأَفْزَعَ حُذَيْفَةَ اخْتِلَافُهُمْ فِي الْقِرَاءَةِ فَقَالَ حُذَيْفَةُ لِعُثْمَانَ يَا أَمِيْرَ الْمُؤْمِنِيْنَ أَدْرِكْ هَذِهِ الْأُمَّةَ قَبْلَ أَنْ يَخْتَلِفُوْا فِي الْكِتَابِ اخْتِلَافَ الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارَى فَأَرْسَلَ عُثْمَانُ إِلَى حَفْصَةَ أَنْ أَرْسِلِيْ إِلَيْنَا بِالصُّحُفِ نَنْسَخُهَا فِي الْمَصَاحِفِ ثُمَّ نَرُدُّهَا إِلَيْكِ فَأَرْسَلَتْ بِهَا حَفْصَةُ إِلَى عُثْمَانَ فَأَمَرَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ وَعَبْدَ اللهِ بْنَ الزُّبَيْرِ وَسَعِيْدَ بْنَ الْعَاصِ وَعَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ الْحَارِثِ بْنِ هِشَامٍ فَنَسَخُوْهَا فِي الْمَصَاحِفِ وَقَالَ عُثْمَانُ لِلرَّهْطِ الْقُرَشِيِّيْنَ الثَلَاثَةِ إِذَا اخْتَلَفْتُمْ أَنْتُمْ وَزَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ فِيْ شَيْءٍ مِنَ الْقُرْآنِ فَاكْتُبُوْهُ بِلِسَانِ قُرَيْشٍ فَإِنَّمَا نَزَلَ بِلِسَانِهِمْ فَفَعَلُوْا حَتَّى إِذَا نَسَخُوا الصُّحُفَ فِي الْمَصَاحِفِ رَدَّ عُثْمَانُ الصُّحُفَ إِلَى حَفْصَةَ وَأَرْسَلَ إِلَى كُلِّ أُفُقٍ بِمُصْحَفٍ مِمَّا نَسَخُوْا وَأَمَرَ بِمَا سِوَاهُ مِنَ الْقُرْآنِ فِيْ كُلِّ صَحِيْفَةٍ أَوْ مُصْحَفٍ أَنْ يُحْرَقَ
হযরত হুযাইফাহ ইবনুল ইয়ামান রা. একবার ’উসমান রা. এর কাছে এলেন। এ সময় তিনি আরমিনিয়া ও আযারবাইজান বিজয়ের ব্যাপারে সিরীয় ও ইরাকী যোদ্ধাদের জন্য যুদ্ধ-প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কুরআন পাঠে তাঁদের মতবিরোধ হুযাইফাহ্কে ভীষণ চিন্তিত করল। সুতরাং তিনি ’উসমান রা. কে বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! কিতাব সম্পর্কে ইয়াহূদী ও নাসারাদের মত মতপার্থক্যে লিপ্ত হবার পূর্বে এই উষ্মতকে রক্ষা করুন। তারপর ’উসমান রা. হাফসাহ রা. এর কাছে এক ব্যক্তিকে এ বলে পাঠালেন যে, আপনার কাছে সংরক্ষিত কুরআনের সহীফাসমূহ আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন, যাতে আমরা সেগুলোকে পরিপূর্ণ মাসহাফসমূহে লিপিবদ্ধ করতে পারি। এরপর আমরা তা আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব। হাফসাহ (রাঃ) তখন সেগুলো ’উসমান রা. এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

এরপর ’উসমান রা. যায়দ ইবনু সাবিত রা. ’আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র রা. সা’ঈদ ইবনু আস রা. এবং ’আবদুর রহমান ইবনু হারিস ইবনু হিশাম রা. কে নির্দেশ দিলেন। তাঁরা মাসহাফে তা লিপিবদ্ধ করলেন। এ সময় ’উসমান রা. তিনজন কুরাইশী ব্যক্তিকে বললেন, কুরআনের কোন ব্যাপারে যদি যায়দ ইবনু সাবিতের সঙ্গে তোমাদের মতভেদ দেখা দেয়, তাহলে তোমরা তা কুরাইশদের ভাষায় লিপিবদ্ধ করবে। কারণ, কুরআন তাদের ভাষায় নাযিল হয়েছে। সুতরাং তাঁরা তাই করলেন। যখন মূল লিপিগুলো থেকে কয়েকটি পরিপূর্ণ গ্রন্থ লেখা হয়ে গেল, তখন ’উসমান রা. মূল লিপিগুলো হাফসাহ রা. এর কাছে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর তিনি কুরআনের লিখিত মাসহাফ-সমূহের এক একখানা মাসহাফ এক এক প্রদেশে পাঠিয়ে দিলেন এবং এছাড়া আলাদা আলাদা বা একত্রিত কুরআনের যে কপিসমূহ রয়েছে তা জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৪৯৮৭]

সুতরাং বুঝা গেলো, পবিত্র কুরআনের এ সংকলন রাসুলুল্লাহ সা. এর সাহাবায়ে কেরামের রা. অব্যহত ও অবিচ্ছিন্ন ধারায় সংকলিত। যেসকল সাহাবায়ে কেরাম রা. এই মহান কাজে অংশগগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন,

হযরত আবু বকর রা. হযরত ওমর রা. হযরত উসমান রা. হযরত আলী রা. হযরত তালহা রা. হযরত সা’দ রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. হযরত হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা. হযরত আবু হুরায়রা রা. হযরত সালেম রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হযরত আমর ইবনে আস রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব রা. হযরত মুয়াবিয়া রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. হযরত আয়েশা রা. হযরত হাফসা রা. হযরত হযরত উম্মে সালামা রা. হযরত উম্মে ওয়ারাকা রা. হযরত উবাই ইবনে কাব রা. হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. হযরত আবু হালিমা মুয়াজ রা. হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত রা. হযরত আবু দাহদাহ রা. হযরত মুজাম্মে ইবনে জারিয়া রা. হযরত মাসলামা ইবনে মুখাল্লাদ রা. হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. হযরত উকবা ইবনে আমের রা. হযরত তামীম আদ দারী রা. হযরত আবু মুসা আশআরী রা. হযরত আবু যায়েদ রা. প্রমুখ। এ ব্যাপারে আল্লামা তাক্বী উসমানী সাহেবের ‘উলূমুল কুরআন’ কিতাবটি পড়লে বিস্তারিত জানা যাবে বলে আশা করি।

সুতরাং ‘শুধু উসমান রা. এর পরে এই কুরআনের কপি এসেছে’ বলে হেযবুত তওহীদের দাবিকৃত বক্তব্যটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট এবং পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে সংশয় ঢুকাবার এক গভীর ষড়যন্ত্র। আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের ঈমানকে হিফাযত করেন। আমীন!

কুরআনের আত্মা কী হারিয়ে গেছে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
প্রত্যেকটি জিনিষের মূল হলো তার আত্মা। এই আত্মা হারিয়ে গেলে সেটা মূল্যহীন হয়ে যায়। যেমন মানুষের আত্মা চলে গেলে সে লাশ হয়ে যায়। তখন তা দিয়ে আর উপকৃত হওয়া যায় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে জঘন্য কথার আবিস্কারক এই হেযবুত তওহীদ। তাদের দাবি হলো, ‘কুরআনের আত্মা হারিয়ে গেছে’। তাদের দাবি হলো,
কোরআনের শিক্ষা নেই কোথাও। কোরআনের আত্মা আজ হারিয়ে গেছে, তা কেবল অক্ষরই রয়ে গেছে। [সূত্রাপুরে এমামের ভাষণ : পৃ. ১৯]

অর্থাৎ তারা কুরআনের চলমান মৌলিক শিক্ষা থেকে জাতিকে দূরে সরাতেই এমনটা লিখেছে। এর দ্বারা তারা বুঝাতে চায়, বর্তমানে কুরআনের যে শিক্ষাটা আছে, সেটা আসল শিক্ষা নয়, বরং এর আত্মা নষ্ট হয়ে গেছে।

ইসলাম কী বলে?
পবিত্র কুরআন এমন একটা জিবন্ত গ্রন্থ যার চুল পরিমান ক্ষতি করার সাধ্য পৃথিবীর কারও নেই। কারণ এ পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে খোদ মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ
আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক। [সুরা হিজর : ৯]

উপরন্তু মহান রব আরও বলেন,
وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنزِيلٌ مِّنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ
এটা অবশ্যই এক সম্মানিত গ্রন্থ। বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না, না সামনে থেকে, না পিছন থেকে। এটি প্রজ্ঞাময়, সপ্রশংসিতের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। [সুরা হা-মীম : ৪১-৪২]

মহান রব আরও বড় চ্যালেঞ্জ করে বলেন,
يُرِيدُونَ لِيُطْفِؤُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
তারা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে। [সুরা সফ : ৮]

উপরোক্ত তিনটি আয়াত থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, পবিত্র কুরআনের সংরক্ষণ বা হেফাযতের মূল দায়িত্ব মহান আল্লাহ’র কুদরতি হাতে। হাজারও চেষ্টা করেও এ কুরআনের বিন্দু পরিমান ক্ষতি করা সম্ভব না। এটা শুধু আমাদের কথা নয়, খোদ হেযবুত তওহীদের বইয়েও এ কথার প্রমাণ রয়েছে। তারা লিখেছেন,
এই যে কোর’আন চৌদ্দশ’ বছর আগে যা ছিল আজও ঠিক তাই -ই আছে, এর একটা শব্দ নয় একটা অক্ষরও কেউ বদলাতে বা বাদ দিতে পারে নাই, কারণ এর রক্ষা ব্যবস্থা আল্লাহ তার নিজের হাতে রেখেছেন। [ধর্ম ব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৫৯]

সুতরাং প্রমাণ হলো, পবিত্র কুরআন, যাঁর দায়িত্ব খোদ মহান রবের কাছে। তাঁর বিকৃতি কেউ ঘটাতে পারেনি, পারবে না। অথচ হেযবুত তওহীদ পবিত্র কুরআনের মূল আত্মা নষ্ট হয়ে গেছে দাবি করে, এটাই প্রমাণ করলো যে, মহান আল্লাহ তার চ্যালেঞ্জে ব্যর্থ হয়েছেন! নাউযুবিল্লাহ।

হালাল-হারামের মানদণ্ড কি শুধু কুরআন?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদের জঘন্য মতবাদের একটি হলো- কুরআনে যেটা হালাল, সেটাই হালাল, আর কুরআনে যা হারাম করা হয়েছে, সেটাই হারাম। এর বাহিরে আর কোনো হালাল বা হারাম নেই। তারা লিখেছে,
এসলামের সরল নীতি হোল, বৈধ-অবৈধ নির্ধারণের বেলায় মানদন্ড হোচ্ছে আল্লাহর আদেশ এবং নিষেধ অর্থাৎ আল-কোরআন। [আসুন সিস্টেমটাকেই পাল্টাই : পৃ. ১২]

দীনের মূলনীতিগুলো বিধৃত হয়েছে কোরআনে। [গঠনতন্ত্র : পৃ. ৫২]

কোর’আনে যা আল্লাহ বৈধ কোরেছেন, তাই বৈধ,কোর’আনে যা অবৈধ কোরেছেন তাই অবৈধ। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ১৩৪]

যে কোন জিনিস হারাম কিনা তা জানার জন্য আমাদেরকে আল্লাহর কেতাব দেখতে হবে। কোরআনে যা কিছু নিষিদ্ধ করা হোয়েছে সেগুলি ছাড়া আর সবই বৈধ। [আসুন সিস্টেমটাকেই পাল্টাই : পৃ. ১২]

যে বিষয়ে কোর’আনে সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকে সে বিষয়ে ভিন্ন কোন মত হাদিসে থাকলেও সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। [ধর্ম ব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৮৩]

অর্থাৎ হেযবুত তওহীদ  বলতে চায়, হালাল-হারামের মানদণ্ড একমাত্র পবিত্র কুরআন। কুরআন ছাড়া কোনো হাদিসের কথাও গ্রহণযোগ্য নয়।

ইসলাম কী বলে?
প্রথমে আমাদের জেনে রাখা দরকার যে উপরোল্লিখিত মতবাদটি ‘আহলে কোরআন’ নামক একটি কুফরী সংগঠণের। যাদের মূলনীতির ভেতর এ মতবাদটি সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে হেযবুত তওহীদ এ মতবাদটিও গ্রহণ করেছে তাদের নিতিমালায়। হেযবুত তওহীদ উপরোক্ত কথাটি বলে মূলত ইসলামের অগণিত হারাম বিষয়কে হালাল করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন। অথচ তাদের জানা উচিৎ পবিত্র কুরআন মানতে হলে অবশ্যই নবীজির সা. সমস্ত বিধিনিষেধ মানতে হবে। কারণ পবিত্র কুরআন শরিফে আল্লাহ তা’আলাকে মানার পাশাপাশি নবীজি সা. কেও মানার আদেশ করা হয়েছে। পাকিস্তানের আল্লামা ইউসুফ বান্নুরী রহ. পুরো কুরআন মাজিদকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন এবং এ ব্যাপারে ১১০ টি আয়াত বের করতে সক্ষম হয়েছেন। এসব আয়াতে কুরআনের পাশাপাশি রাসুল তথা রাসুলের হাদিসও মানার কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআন থেকে কয়েকটি আয়াত এখানে পেশ করছি-

এক. নবিজি সাঃ-এর সকল বিধিনিষেধ মান্য করা আবশ্যক:
আল্লাহপাক বলেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّه إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
রাসুল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন,তা থেকে বিরত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। [সুরা হাশর আয়াত : ৭]

প্রিয় পাঠক! এই আয়াতের শুরুতে ما একটি শব্দ রয়েছে। একে الما للموصولة বলে। যা আয়াতের ব্যাপক অর্থ বোঝানোর জন্য এসেছে। অর্থাৎ রাসুল যা দেন বা নিষেধ করেন তা সব মেনে চলো। কুরআন এবং হাদিস দু’টোই এখানে শামিল। কেননা এই ما দ্বারা ওহির কথা বলা হয়েছে। আর অহি দুই প্রকার।
১. ‘ওহিয়ে মাতলু’ অর্থাৎ যে ওহির শব্দ এবং অর্থ সবই আল্লাহর নির্ধারণকৃত। রাসুল সা. তা শুধু তিলাওয়াত করে শুনিয়ে দেন এবং বুঝিয়ে দেন। আর সেটা হলো কুরআন।

২. ওহিয়ে গাইরে মাতলু’। অর্থাৎ যে ওহির অর্থ ও মর্ম আল্লাহ পাক নির্ধারণ করে দেন। তবে রাসু্র স: এর জন্য শব্দ নির্ধারণের এখতিয়ার থাকে।আর সেটাই হলো ‘হাদিস’।

সুতরাং উল্লেখিত আয়াতে ما ব্যাপক অর্থে হওয়ায় উভয় ওহিই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআনের পাশাপাশি হাদিসকেও মানতে হবে। এটা কুরআনেরই একটি হুকুম।

দুই. আল্লাহকে পেতে নবিজি সাঃ কে অনুসরণ করা আবশ্যক:
মহান রব বলেন,
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
হে নবী, বলে দিন- যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। [সুরা আলে ইমরান : ৩১]

উক্ত আয়াতে স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর ভালোবাসা পেতে নবীজি স: এর অনুস্বরণকে বাধ্যতামূলক করেছেন। তাহলে নবিজি স: এর আদেশ নিষেধ কি অমান্য করে আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব? নিশ্চয় না।

তিন. আল্লাহকে পেতে নবিজি সাঃ-এর আদর্শ মানা আবশ্যক:
মহান রব বলেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে রয়েছে উত্তম, অনুপম, আদর্শ। যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং অধিক পরিমাণ আল্লাহকে স্মরণ করে।! (সুরা আহযাব : ২১]

নবিজি সাঃ অনুসরনযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে এরচে সুস্পষ্ট আয়াত আর কি হতে পারে?

চার. নবিজি সাঃ-এর বাণী মূলত ওহি:
নবিজি সাঃ-এর কোন কথা যে তাঁর নিজের কথা নয়,বরং আল্লাহরই কথা, সেটাও পবিত্র কুরআনে এসেছে। মহান রব বলেন,
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোন কথা বলেন না, বরং তিনি তাই বলেন, যা আল্লাহ তা’আলা অহির মাধ্যমে জানাতে বলেন। [সুরা নাজম : ৩-৪]

পাঁচ. হাদিস হলো কুরআনের প্রথম ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত। বস্তুত পূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত। [সুরা জুমু’আ : ২]

এই আয়াতে বর্ণিত হিকমাতের অর্থ সম্পর্কে হযরত হাসান বসরী, কাতাদাহ, মুকাতিল ইবনে হায়্যান, আবু মালেক রহি. বলেন,
والحكمة يعني السنة
হিকমাহ হলো নবীর সুন্নাহ। [মুসনাদে আহমাদ : খ. ১ পৃ. ১২]

এ ছাড়াও অসংখ্য তাফসিরের কিতাবে হিকমাহ এর তাফসির করা হয়েছে নবিজি সাঃ-এর সুন্নাহকে।

উপরন্তু আয়াতের দিকে লক্ষ করে দেখুন, এখানে নবিজি সাঃ-এর চারটি দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। ১. উম্মাতকে কুরআন পড়ে শোনানো, ২. আত্মশুদ্ধ করানো, ৩. তাদেরকে কুরআন শেখাবেন, ৪. নবীজি সা. উম্মতকে সুন্নাহ বা হাদিস শিক্ষা দেবেন। এই চার দায়িত্বের কথা কুরআনের আরো কয়েক স্থানে এসেছে। সুতরাং হাদিস বা সুন্নাহকে অস্বীকার করার মানে হল, কুরআনে প্রদত্ব নবীর চার যিম্মাদারীর একটিকে অস্বীকার করা। যা স্পষ্টত কুরআনকে অস্বীকার করা।

ছয়. নবিজি সাঃ-এর সিদ্ধান্ত অমান্যকারী বেঈমান:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا
অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোকেরা ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে। [সুরা নিসা : ৬৫]

এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে নবিজি স: এর ফায়সালাকে মেনে নেয়াকে ঈমানদারের পরিচয় বলা হয়েছে। যারা নবীজি সা. এর ফায়সালা মানবে না, তারা কাফের।

সাত. নবিজি সাঃ-এর অনুসরণ আল্লাহরই অনুসরণ:
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন,
مَّنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللّهَ وَمَن تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا
যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহরই আনুগত্য করলো৷ আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিলো, যাই হোক, তাদের ওপর তো আমি তোমাকে পাহারাদার বানিয়ে পাঠাইনি৷ [সুরা নিসা : ৮০]

আট. রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর আনুগত্য করা ফরজ।
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন:
وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ
তোমরা যদি মু’মিন হয়ে থাক তবে তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর। [সুরা আনফাল : ১]

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন,
يَـٰٓأَيُّہَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ ۥ وَلَا تَوَلَّوۡاْ عَنۡهُ وَأَنتُمۡ تَسۡمَعُونَ
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং হুকুম শোনার পর তা অমান্য করো না৷ [সুরা আনফাল : ২০]

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন:
وَأَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَاحْذَرُواْ فَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُواْ أَنَّمَا عَلَى رَسُولِنَا الْبَلاَغُ الْمُبِينُ
আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কথা মেনে চলো এবং (নিষিদ্ধ কাজ থেকে ) বিরত থাকো৷ কিন্তু যদি তোমরা আদেশ অমান্য করো, তাহলে জেনে রাখো, আমার রসূলের প্রতি শুধুমাত্র সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ পৌঁছিয়ে দেবারই দায়িত্ব ছিল৷ [সুরা মায়েদা : ৯২]

উপরিউক্ত আয়াতগুলো থেকে বুঝা গেলো, কুরআনের পাশাপাশি নবিজি সাঃ-কেও মানা ফরজ।

হাদীসের সহিহ প্রমাণের কষ্টি পাথর কী কুরআন?
হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, ‘কোন হাদিস সহি কিনা তা যাচাই করার প্রথম কষ্টিপাথর কোরআন’। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৯]

অথচ সমস্ত মুহাদ্দিসিনে কেরামের কাছে সহিহ হাদিসের পারিভাষিক সংজ্ঞা হলো,
هو ما نقله العدل تام الضبط متصل السند غيرمعلل ولا شاذ
যে হাদিস মুত্তাসিল সনদ তথা অবিচ্ছিন্ন সনদ পরম্পরায় বর্ণিত হয়, রাবী বা বর্ণনাকারী আদিল ও পূর্ণ আয়ত্বশক্তির অধিকারী হয়, এবং সনদটি শায কিংবা মুআল্লাল নয়; এমন হাদিস কে সহিহ বলে। [নুখবাতুল ফিকর : পৃ. ২২০]

কোর’আনে সুস্পষ্ট বক্তব্য বিপরীত হাদিস গ্রহনযোগ্য নয়:
হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, ‘যে বিষয়ে কোর’আনে সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকে সে বিষয়ে ভিন্ন কোন মত হাদিসে থাকলেও তো সেটা গ্রহণযোগ্য নয়’। [ধর্ম ব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৮৩]

অথচ অগণিত হাদিস এমন রয়েছে যা পবিত্র কুরআনের প্রকাশ্য বিরোধি মনে হয়। অথচ তার প্রকৃত ব্যাখ্যা জানলে সেগুলো অগ্রহণযোগ্য নয়, বরং অবশ্যপালনীয়।

হাদিসের উৎস কি?
কুরআন এবং হাদিস উভয়টির মূল উৎস হলো ‘ওহী’। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ সাঃ-এর নিকট জিবরাঈল আঃ-এর মাধ্যমে অথবা ইলহাম এর মাধ্যমে দ্বীর্ঘ ২৩ বছর ধরে নাজিল করেছেন। তার মধ্যে তিনি নিজের কোন কথা সংযোজন বা বিয়োজন করেন নি, করতে পারেন না। কারণ মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَوۡ تَقَوَّلَ عَلَيۡنَا بَعۡضَ ٱلۡأَقَاوِيلِ لَأَخَذۡنَا مِنۡهُ بِٱلۡيَمِينِ ثُمَّ لَقَطَعۡنَا مِنۡهُ ٱلۡوَتِينَ فَمَا مِنكُم مِّنۡ أَحَدٍ عَنۡهُ حَاجِزِينَ
যদি নবী নিজে কোন কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিতেেন, তাহলে আমি তাঁর ডান হাত ধরে ফেলতাম। এবং ঘাড়ের রগ কেটে দিতাম৷ তোমাদের কেউ-ই (আমাকে ) এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারতো না৷ [সুরা হাক্কাহ : ৪৪-৪৭]

প্রিয় পাঠক! একবার ভেবে দেখুন। নবিজি সাঃ দ্বীনের ব্যাপারে কী কোন কিছু নিজ থেকে বলেছেন? নিশ্চয় না। যদি বলতেন, তাহলে নবিজিকে সে ওয়াদাকৃত শাস্তি আল্লাহ দিতেন। যেহেতু আল্লাহ তা’আলা তাঁকে শাস্তি দেননি, সেহেতু আমরা দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, নবীজি সা. কোন কিছুই নিজ থেকে বলেননি। অতএব বোঝা গেল- হাদিস-কুরআনের যত কথা রয়েছে সব কথা আল্লাহ তা’আলারই কথা।

ألا هل عسى رجلٌ يبلُغُه الحديثُ عني وهو مُتَّكِئٌ على أريكَتِهِ، فيقولُ: بينَنا وبينَكم كتابُ اللهِ، فما وجدْنا فيه حلالًا استحلَلْناه، وما وجدْنا فيه حرامًا حرَّمناه، وإِنَّ ما حرَّمَ رسولُ اللهِ صلّى اللهُ عليه وسلَّمَ كما حرمَ اللهَ
الراوي: المقدام بن معدي كرب • الترمذي، سنن الترمذي (٢٦٦٤)

এজন্য হযরত মিকদাম ইবনু মা’দীকারিব রা. সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
أَلَا إِنِّي أُوتِيتُ الْكِتَابَ، وَمِثْلَهُ مَعَهُ أَلَا يُوشِكُ رَجُلٌ شَبْعَانُ عَلَى أَرِيكَتِهِ يَقُولُ عَلَيْكُمْ بِهَذَا الْقُرْآنِ فَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَلَالٍ فَأَحِلُّوهُ، وَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَرَامٍ فَحَرِّمُوهُ، أَلَا لَا يَحِلُّ لَكُمْ لَحْمُ الْحِمَارِ الْأَهْلِيِّ، وَلَا كُلُّ ذِي نَابٍ مِنَ السَّبُعِ، وَلَا لُقَطَةُ مُعَاهِدٍ، إِلَّا أَنْ يَسْتَغْنِيَ عَنْهَا صَاحِبُهَا
জেনে রাখো! আমাকে কিতাব এবং তার সঙ্গে অনুরূপ কিছু দেয়া হয়েছে। জেনে রাখো! এমন এক সময় আসবে যখন কোনো প্রাচুর্যবান লোক তার আসনে বসে বলবে, তোমরা শুধু এ কুরআনকেই গ্রহণ করো, তাতে যা হালাল পাবে তা হালাল এবং যা হারাম পাবে তা হারাম মেনে নিবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জেনে রাখো! গৃহপালিত গাধা তোমাদের জন্য হালাল নয় এবং ছেদন দাঁতবিশিষ্ট হিংস্র পশুও নয়। অনুরূপ সন্ধিবদ্ধ অমুসলিম গোত্রের হারানো বস্তু তোমাদের জন্য হালাল নয়, অবশ্য যদি সে এর মুখাপেক্ষী না হয়। [সুনানে আবু দাউদ : ৪৬০৪]

উক্ত হাদিসে যারা হালাল-হারামের মানদণ্ডে শুধু কুরআন মানতে চায়, নবীজির সা. হাদিসকে মানে না, তাদের চপেটাঘাত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনেও আল্লাহ পাক নবীজির সা. হারাম করা বিষয়গুলো না মানলে তাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ করতে বলেছেন
قَاتِلُوا الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ لَا بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ لَا یُحَرِّمُوۡنَ مَا حَرَّمَ اللّٰهُ وَ رَسُوۡلُهٗ وَ لَا یَدِیۡنُوۡنَ دِیۡنَ الۡحَقِّ مِنَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ حَتّٰی یُعۡطُوا الۡجِزۡیَۃَ عَنۡ ‌یَّدٍ وَّ هُمۡ صٰغِرُوۡنَ
কিতাবীদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না এবং পরকালেও নয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূল যা-কিছু হারাম করেছেন তাকে হারাম মনে করে না এবং সত্য দ্বীনকে নিজের দ্বীন বলে স্বীকার করে না, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, যাবৎ না তারা হেয় হয়ে নিজ হাতে জিযিয়া আদায় করে। [সুরা তাওবা : ২৯]

প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা গুলোে পড়ার পর কোন মুসলমান কি বলতে পারেন একথা যে, হালাল-হারামের ব্যাপারে মানদন্ড শুধুমাত্র কুরআন? কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে হেযবুত তওহীদ সে দাবি করে বসেছে। এরপরও কি তাদের মুসলিম বলার সুযোগ রয়েছে? চিন্তাশীল পাঠক মহল বিষয়টি একটু ভেবে দেখবেন বলে আশা করছি।

কুরআন রাষ্ট্রে কায়েম না হলে এর কোনো দাম নেই:
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের কাছে রাষ্ট্র কায়েমই হলো ইসলামের মূল উদ্দেশ্য। এজন্য তারা লিখেছে,
দীনুল হকের সংবিধান কোরআনকে মানব জীবনের সর্বস্তরে কার্যকর না করতে পারলে তা অর্থহীন। [এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব : পৃ. ২৩]

ইসলাম কী বলে?
রাষ্ট্রে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করাও ইসলামের েকটকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। কিন্তু এই হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলাম বা কুরআনের আগমন নয়। কুরআন সর্বাবস্থায় হিদায়াহ। মহান রব বলেন,
هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی
এটা মানুষের জন্য হিদায়াত ও সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। [সূরা বাকারা : ১৮৫]

ইরশাদ হয়েছে
اِنْ هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعٰلَمِیْنَ۠
এটা তো আর কিছুই নয়; সারা জাহানের জন্য উপদেশবাণী। [সুরা ইউসুফ : ১০৪]

উপরন্তু রাসুলুল্লাহ সা. কে কুরআনের দায়িত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِیۡ بَعَثَ فِی الۡاُمِّیّٖنَ رَسُوۡلًا مِّنۡهُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَکِّیۡهِمۡ وَ یُعَلِّمُهُمُ الۡکِتٰبَ وَالۡحِكۡمَةَ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
তিনিই উম্মীদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, যে তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হেকমতের শিক্ষা দেবে, যদিও তারা এর আগে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিপতিত ছিল। [সুরা জুমআহ : ২]

উক্ত আয়াতে বলা হয়নি যে, কুরআন প্রতিষ্ঠা করা নবীর সা. দায়িত্ব এবং না করলে এর কোনো মূল্য নেই। অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন,
اِنَّ الَّذِیْنَ یَتْلُوْنَ كِتٰبَ اللهِ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً یَّرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّنْ تَبُوْرَ، لِیُوَفِّیَهُمْ اُجُوْرَهُمْ وَ یَزِیْدَهُمْ مِّنْ فَضْلِهٖ  اِنَّهٗ غَفُوْرٌ شَكُوْرٌ
যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে গোপনে ও প্রকাশ্যে, তারা এমন ব্যবসার আশাবাদী, যা কখনও লোকসান হয় না, যাতে আল্লাহ তাদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিফল দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও বেশি দান করেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল, অত্যন্ত গুণগ্রাহী। [সুরা ফাতির : ২৯-৩০]

উক্ত আয়াত থেকে প্রতিয়মান হলো, যে যারা তিলাওয়াত করবে তাদেরকে মহান আল্লাহ প্রতিদান দেবেন। সুতরাং ‘কুরআন প্রতিষ্ঠিত না হলে তা অর্থহীন’ হেযবুত তওহীদের এ মতবাদ সরাসরি কুরআন অবমাননার শামিল।

হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত ইবনু আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‏
যে ব্যক্তি সঠিক ইলম ব্যতীত কুরআন প্রসঙ্গে কোন কথা বলে, সে যেন জাহান্নামকে নিজের জন্য বাসস্থান বানিয়ে নিলো। [জামে তিরমিযি : হাদিস নং : ২৯৫০]

কুরআনের আইন কার্যকর না হলে তিলাওয়াত ও শোনার মধ্যে কোনো ফায়দা নেই?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
কোর’আন শরীফ আল্লাহর আদেশ-নিষেধের একটি গ্রন্থ। সেই আদেশ-নিষেধকে সমাজে প্রতিষ্ঠা না করে, পশ্চিমা সভ্যতার আইন-কানুন মেনে নিয়ে রোজার মাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করা আর শোনার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। এই কাজে সওয়াব হবে তখনই যখন তা মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং মানুষ এ থেকে উপকৃত হবে। [সওমের উদ্দেশ্য : পৃ. ১৫]

ইসলাম কী বলে?
পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা ও শোনার ব্যাপারে প্রচুর ফযিলতের কথা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মানবজিবনে প্রতিষ্ঠিত না হলে তিলাওয়াত করে ও শ্রবণ করে কোনো সওয়াব হবে না এমন কোনো কথা কুরআন বা সুন্নাহ’য় বর্ণিত হয়নি।

কুরআন তিলাওয়াত করার ফযিলত:
নিন্মে কুরআন তিলাওয়াত করার ফযিলত সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত ও হাদিস পেশ করা হলো-
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لاَ أَقُولُ الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ ‏
আল্লাহ তা’আলার কিতাবের একটি হরফ যে ব্যক্তি পাঠ করবে তার জন্য এর সাওয়াব আছে। আর সাওয়াব হয় তার দশ গুণ হিসেবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। [জামে তিরমিযি :  হাদিস নং : ২৯১০

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেছেন-
الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ، وَالّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ، وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقّ، لَهُ أَجْرَانِ.
যারা উত্তমরূপে কুরআন পড়বে তারা থাকবে অনুগত সম্মানিত ফিরিশতাদের সাথে। আর যে কুরআন পড়তে গিয়ে আটকে আটকে যায় এবং কষ্ট হয়, তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। [সহীহ মুসলিম : হাদীস নং : ৭৯৮]

হযরত আবু উমামা বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেছেন-
اقْرَؤُوا الْقُرْآنَ فَإِنّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ
তোমরা কুরআন পড়ো। কেননা কিয়ামতের দিন কুরআন তার ‘ছাহিবের’ জন্য সুপারিশ করবে। [সহীহ মুসলিম : হাদীস নং : ৮০৪]

উক্ত হাদিসগুলো থেকে এ কথা প্রতিয়মান হলো যে, কুরআন তিলাওয়াত করার ফযিলত অপরিসীম। কিন্তু এই তিলাওয়াত করার ব্যাপারে মানবজিবনের প্রতিষ্ঠিত করার শর্ত আল্লাহ তা’আলা বা রাসুলুল্লাহ সা. দেননি। এটা হেযবুত তওহীদ কর্তৃক একটা অপব্যখ্যা ও বিকৃতি।

কুরআন তিলাওয়াত শোনার ফযিলত:
পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত শোনাতে রয়েছে বিশাল সওয়াব, অসীম কল্যাণ ও অতুলনীয় উপকারিতা। নিন্মে কয়েকটি আয়াত ও হাদিস পেশ করা হলো-

তিলাওয়াত শুনলে রহমত পাওয়া যায়:
পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত শুনলেও সওয়াব রয়েছে। কারণ তা একটি ইবাদত। আল্লাহ পাক মনোযোগ সহকারে কুরআন তিলাওয়াত শোনার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো এবং নীরবতা অবলম্বন করো যাতে তোমরা রহমত (দয়া) প্রাপ্ত হও। [সূরা আরাফ : ২০৪]

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ، إِلّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرّحْمَةُ وَحَفّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ
যারা আল্লাহর ঘরে একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পারস্পরিক কুরআনের চর্চা করে, তাদের প্রতি ‘সাকীনা’ তথা এক প্রকার বিশেষ প্রশান্তি বর্ষিত হয়, রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেয় এবং আল্লাহ তাঁর কাছের ফিরিশতাদের মাঝে তাদের আলোচনা করেন। [সহীহ মুসলিম : হাদীস নং : ২৬৯৯]

তিলাওয়াত শুনলে ঈমান বৃদ্ধি পায়।
মহান রব বলেন,
اِذَا تُلِیَتْ عَلَیْهِمْ اٰیٰتُهٗ زَادَتْهُمْ اِیْمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّهِمْ یَتَوَكَّلُوْنَ
যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয় তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে। [সুরা আনফাল : আয়াত নং : ২]

এ ছাড়াও কুরআন তিলাওয়াত শুনলে যেসব ফযিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে তা হলো- ১. সীমাহীন সওয়াব ২. হেদায়েত (সঠিক পথের নির্দেশনা) লাভ, ৩. নূর অর্জন, ৪. সত্যকে চেনার উপলব্ধি সৃষ্টি, ৫. জ্ঞানার্জন, ৬. আল্লাহর সহজ ইবাদত, ৭. কুরআন তিলাওয়াত শোনা সুন্নত, ৮. মনে অনাবিল প্রশান্তি ও স্বস্তি লাভ। সুতরাং কুরআন তিলাওয়াত করা ও শোনার মধ্যে এত এত ফযিলত থাকার পরও হেযবুত তওহীদ কিভাবে এমন কথা বলে যে, ‘কুরআনের আইন কার্যকর না হলে তিলাওয়াত ও শোনার মধ্যে কোনো ফায়দা নেই’। মূলত এটা তারা প্রচার করছে জাতিকে কুরআন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যই।

আল্লাহর কিতাব দামি না মুমিন?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো আল্লাহর কিতাবের চেয়েও মুমিনের সম্মান বেশি। তারা লিখেছে,
সকল ধর্মগ্রন্থ, কাবাসমেত সকল উপসনালয় মানুষের কল্যাণের জন্য এসেছে, মানবতার জন্য এসেছে। তাদের কারো সম্মান মোমেনের ঊর্ধ্বে নয়। [শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১১২]

ইসলাম কী বলে?
পবিত্র কা’বার চেয়ে মুমিনের সম্মান বেশি। এ কথার প্রমাণ হাদিস শরীফে পাওয়া যায়। কিন্তু আল্লাহর নাযিলকৃত কোনো কিতাব বা গ্রন্থ সাধারণ মুমিন তো দূরের কথা নবীদের চেয়েও দামি। কারণ সকল নবি আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি, কিন্তু আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব আল্লাহর সৃষ্টি নয়, বরং আল্লাহর কালাম এবং তাঁর সিফাত বা গুনাবলীর অন্তুর্ভূক্ত। আল্লাহর সিফাত কখনও মাখলুক থেকে ছোট হতে পারে না। সুতরাং আল্লাহর নাযিলকৃত কোনো কিতাবের চেয়ে মোমেন দামি হতে পারে এমন দাবি নিছক মূর্খতা ও বিকৃতি।

কুরআনের তাফসীর পড়া যাবে না?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদ মুসলিম জাতির পবিত্র কুরআনের প্রতি যে অগাধ বিশ্বাস সেটা নষ্ট করতে বদ্ধাপরিকর। তারা দাবি করেছেন যে, পবিত্র কুরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যা পড়া যাবে না। তারা লিখেছে,
পূর্ববর্তী কেতাবগুলো ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, এবং শেষ ইসলামও তাদের অতি বিশ্লেষণের ভারে বিকৃত হতে হতে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। কেবল অক্ষত আছে কোরআনের বর্ণগুলো। তার ব্যাখ্যা পাল্টে বহু রকম হয়ে গেছে। [ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে : পৃ. ৬]

ফকীহ মুফাসসিরদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ফলে জাতির মধ্যে ভয়াবহ বিভেদ সৃষ্টি হোয়ে বিভিন্ন মাযহাব ও ফিরকা সৃষ্টি হয়ে যে অনৈক্য সৃষ্টি হলো তার ফলে পুনরায় একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ২৮]

যখন রাজা-বাদশারা ভোগবিলাসে মত্ত হল, মুফাসসির ও ফকিহরা অতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মত্ত হল এবং সুফিগন জাতির সংগ্রামী বহির্মুখী চরিত্রকে অন্তর্মুখী করে দিল তখন দীনের ভারসাম্য নষ্ট হল। এভাবে জাতিকে পঙ্গুত্ব পেয়ে বসল। তারা অন্তর্মুখী জড়ো হয়ে গেল। তারপর থেকে তাদের উপর আবার গজব শুরু হলো যা এখনো চলছে। [ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে : পৃ. ৩২; শিক্ষাব্যবস্থা : পৃ. ১৩]

কোরআনের আয়াতের অর্থ নিয়ে যে কোনরকম মতভেদ কুফর…তবুও ইতিহাস এই যে, যে কাজকে রসূলুল্লাহ কুফর বলে আখ্যায়িত করেছেন, সেই কাজকে মহা সওয়াবের কাজ মনে করে করা হয়েছে এবং হচ্ছে অতি উৎসাহের সাথে এবং ফলে বিভিন্ন মাযহাব ও ফিরকা সৃষ্টি হয়ে জাতির ঐক্য নষ্ট হয়ে গেছে এবং জাতি শত্রুর কাছে পুরো শুধু পরাজিত ইহয়নি তাদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৯৩]

এ ছাড়াও হেযবুত তওহীদের দ্বিতীয় এমাম হুসাইন সেলিম অসংখ্য জায়গায় বক্তব্য দিয়ে চলেছেন যে, ‘তাফসীর পড়বেন না।’ ইউটিউবে এ সম্পর্কে তার অনেক ভিডিও বক্তব্য পাবেন। উপরন্তু তারা তাফসীরকারকদের কাফের বলতেও দ্বিধা করেনি। এ লিংকে কিছু পাবেন- https://youtu.be/Shz1-jtd2KU

ইসলাম কী বলে?
পবিত্র কুরআন তাফসীর ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়। এজন্য মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল সা. কে পবিত্র কুরআনের তাফসীর করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
وَمَا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلاَّ لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُواْ فِيهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
আমি আপনার প্রতি এ জন্যেই গ্রন্থ নাযিল করেছি, যাতে আপনি সরল পথ প্রদর্শনের জন্যে তাদের কে পরিষ্কার বর্ণনা করে দেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছে এবং ঈমানদারকে ক্ষমা করার জন্যে। [সুরা নাহাল : ৬৪]

সুতরাং বুঝা গেলো, তাফসীরের জ্ঞান আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক স্বীকৃত ও নির্দেশিত। ফলে নবীজি সা. হাদিসের মাধ্যমে কুরআনের তাফসীর করেছেন। যা সাহাবায়ে কেরাম রা. আমাদের জানিয়ে, বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তাফসীর অস্বীকার করা মানেই পবিত্র কুরআন অস্বীকার করা।

পবিত্র কুরআনের তাফসীরের জ্ঞানের জন্য নবিজি সাঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে দুআ করেছিলেন। যা হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর ব্যাপারে বলেন,
اللَّهمَّ علِّمْهُ الحِكمةَ وتأويلَ القرآنِ
হে আল্লাহ, ইবনে আব্বাসকে রা. তুমি হিকমাহ এবয় কুরআনের তাফসীরের জ্ঞান দান করো। [আল ইসতিআব : খ. ৩ পৃ. ৬৭]

উপরন্তু ইবনে আব্বাস রা. এর পবিত্র কুরআনের তাফসীরের জ্ঞানের প্রশংসায় বলতেন,
نِعمَ تُرجَمانُ القرآنِ ابنُ عبّاسٍ
কুরআনের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস কতইনা পারদর্শী! [ফাতহুল বারী (ইবনে হাজার) খ. ৭ পৃ. ১২৬]

সুতরাং বুঝা গেলো, তাফসীরের ইলম এটা রাসুলুল্লাহ সা. এর থেকে স্বীকৃত। অথচ নবীজি সা. কর্তৃক স্বীকৃত এ জ্ঞানকে বাদ দেওয়া মানেই রাসুলুল্লাহ সা. এর আনীত দ্বীনকে ছুঁড়ে ফেলার নামান্তর। উপরন্তু মনে রাখতে হবে, অতীত তাফসীর ছাড়া পবিত্র কুরআন বুঝা কারও পক্ষেই সম্ভবপর নয়।

তাফসীর ছাড়া নাসেখ-মানসুখ বুঝা সম্ভব নয়।
একটি উদহরণ দিচ্ছি, মনে করুন, আপনি কোনো দোকানে গিয়ে দু’টি পন্য ক্রয় করলেন। একটার দাম ৫৫ টাকা, অপরটার দাম ৪৫ টাকা।  দোকানদার যখন আপনাকে দু’টি পন্যের টাকার হিসাব ক্যালকুলেটরে তুলবেন, তখন তিনি যোগ করবেন এভাবে, ৫৫+৪৫=১০০/-। এখন দোকানদার হিসাব করে আপনাকে বললেন, দুটি পন্য একটার দাম ৫৫ টাকা এবং আরেকটার দাম ৪৫ টাকা। মোট ১০০ টাকা দিন। কিন্তু আপনি তো পন্ডিত মানুষ। আপনি + তথা ‘এবং’ শব্দটা না মেনে তাকে শুধু প্রথম পন্যের ৫৫ টাকা দিয়ে চলে আসলেন। কিন্তু দোকানদার ‘এবং ৪৫ টাকা’ শব্দটা বলে তিনি আরও বাকি ৪৫ টাকা চাইলেন। কিন্তু আপনি তো ‘এবং’ শব্দের মাধ্যমে আলাদা কিছু মানতে চান না।

ফলে আপনি তাকে বললেন, আমি যেহেতু প্রথম পন্যের টাকা আপনাকে দিয়েছি, সুতরাং পরের ‘এবং ৪৫ টাকা’ আপনি চাইতে পারেন না। কারণ আমি ‘এবং’ শব্দের মাধ্যমে একটাই বুঝি, আলাদা কিছু বুঝি না। এখন আপনিই বলুন, পিঠ বাঁচবে? নিশ্চয় না। কেন? কারণ ‘এবং’ শব্দের উপর আপনি আমল করেননি। সুতরাং যদি দুনিয়ার আদালতে ‘এবং’ শব্দ না মানার কারণে পিঠ না বাঁচে, তাহলে অতীত কালের তাফসীর না দেখে রহিত বিধানগুলোর উপরও যখন আমল করতে যাবেন, তখন ঈমানের পিঠ বাঁচবে কী? নিন্মে কয়েকটি আয়াত ও হাদিসের দিকে লক্ষ করুন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَالَّذِينَ هَادُواْ وَالنَّصَارَى وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحاً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ
নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী, নাসারা ও সাবেঈন, (তাদের মধ্য থেকে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি এবং সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না। [সুরা বাকারা : ৬২]

উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, যারা ঈমানদার ইহুদী বা নাসারা তারাও জান্নাতে যাবে। আবার অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللّهِ الإِسْلاَمُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوْتُواْ الْكِتَابَ إِلاَّ مِن بَعْدِ مَا جَاءهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَن يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللّهِ فَإِنَّ اللّهِ سَرِيعُ الْحِسَابِ
নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম। এবং যাদের প্রতি কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞান আসার পরও ওরা মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে, শুধুমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ, যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি কুফরী করে তাদের জানা উচিত যে, নিশ্চিতরূপে আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত দ্রুত। [সুরা আলে ইমরান : ১৯]

অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না, এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। [সুরা আলে ইমরান : ৮৫]

উক্ত আয়াতত্রয় থেকে বুঝা যাচ্ছে ১. বর্তমানের ইহুদী-খ্রিষ্টানরাও জান্নাতে যাবে। ২. বর্তমানের ইহুদী-খ্রিষ্টানরা ইসলাম না মানলে জাহান্নামে যাবে। এখন তাফসীর ব্যাতিত এর সমাধান কী? যখন তাফসীর বাদ দেওয়া হবে, তখন তো এ ধারণা নিয়েই বসে থাকতে হবে যে ইহুদী-খ্রিষ্টানরাও জান্নাতি। আর এটাই হয়েছে বাস্তবে। হেযবুত তওহীদ লিখেছে,
স্বর্গে যাবার জন্য আল্লাহ যে বিষয়গুলি বিশ্বাস করতে বলেছেন সেগুলি বিশ্বাস করতে হবে। এখানেই প্রশ্ন, ইসলামের শেষ সংস্করণ এসে যাওয়ার পরও ইসলাম গ্রহণ না করে, পূর্ববর্তী ধর্মবিশ্বাসে স্থির থেকে কেউ কি স্বর্গে যেতে পারবেন? এর জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ, অবশ্যই তাদেরও জান্নাতে যাওয়ার পথ খোলা আছে। এক্ষেত্রে শর্ত হলো, তাদেরকে শেষ নবী ও শেষ গ্রন্থ কোর’আনকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। [হেযবুত তওহীদের ওয়েবসাইটে ‘আল্লাহর পছন্দনীয় ধর্ম কোনটি’? শিরোনামে লেখা প্রবন্ধ।]

প্রকৃত সত্য হলো- স্রষ্টা প্রদত্ত সকল ধর্মই সত্যধর্ম। এগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর যে কোনোটি মানুষ মেনে চলতে পারে। তবে মানতে হবে পূর্ণাঙ্গভাবে। [দৈনিক বজ্রশক্তি ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ ঈসায়ী।]

এখানে তারা সুস্পষ্টভাবে বুঝাতে চায়, সব ধর্মের লোকেরা পূর্ণভাবে তাদের ধর্ম মানলে জান্নাতে যাবে। অথচ নবীজি সা. বলেন,
وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ‏
সে সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! ইয়াহুদী হোক আর খৃস্টান হোক, যে ব্যক্তিই আমার এ রিসালাতের খবর শুনেছে অথচ আমার রিসালাতের উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করবে, অবশ্যই সে জাহান্নামী হবে। [সহিহ মুসলিম : হাদিস নং : ১৫৩]

সুতরাং বুঝা গেলো, এ ক্ষেত্রে তাফসীরের সাহায্য লাগবেই। তাফসীরের সাহায্য ছাড়া এটার সমাধান কী দেবে হেযবুত তওহীদ? চলুন তাফসীরে কী বলা হচ্ছে দেখে নেওয়া যাক। তাফসীরে কুরতুবীতে এসেছে,

رُوِيَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ قَوْلَهُ إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هادُوا الآية منسوخ بقوله تعالى وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ

অর্থাৎ সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত,
‘إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَالَّذِينَ هَادُواْ
নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী(…তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে) আয়াতটি পরবর্তিতে নাযিলকৃত আয়াত وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না। আয়াতের মাধ্যমে রহিত হয়ে গেছে। [তাফসীরে কুরতুবী : খ.১ পৃ. ২৯৬]

আয়াতটি মানসুখ বা রহিত হওয়ার কারণ হিসাবে ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
قَوْلِهِ إنَّ الَّذِينَ آمَنُوا والَّذِينَ هادُوا قالَ فَأنْزَلَ اللَّهُ بَعْدَ هَذا ومَن يَبْتَغِ غَيْرَ الإسْلامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنهُ وهو في الآخِرَةِ مِنَ الخاسِرِينَ

অর্থাৎ ‘إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَالَّذِينَ هَادُواْ ‘অর্থ: নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী(,…তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে) আয়াতটি  وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না। আয়াতটি পরবর্তিতে নাযিল হয়েছে। [তাফসীরে শাওকানী : খ. ১ পৃ. ৮০]

সুতরাং বুঝা গেলো তাফসীর বাদ দিয়ে বঙ্গানুবাদ পড়ে পবিত্র কুরআন বুঝা সম্ভবপর নয়। আরো একটি নমুনা দেখুন। আল্লাহ পাক বলেন,
وَلِلّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّواْ فَثَمَّ وَجْهُ اللّهِ إِنَّ اللّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
পূর্ব ও পশ্চিম আল্লারই। অতএব, তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই আল্লাহ।  নিশ্চয় আল্লাহ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ। [সুরা বাকারা : ১১৫]

উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণ হয়, যেকোনো দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা যাবে। যেহেতু আল্লাহ পাক সবদিকেই আছেন। অথচ অপর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,
قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاء فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّواْ وُجُوِهَكُمْ شَطْرَهُ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوْتُواْ الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ وَمَا اللّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ
(হে নবী,) নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল-হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর। যারা আহলে-কিতাব, তারা অবশ্যই জানে যে, এটাই ঠিক পালনকর্তার পক্ষ থেকে। আল্লাহ বেখবর নন, সে সমস্ত কর্ম সম্পর্কে যা তারা করে। [সুরা বাকারা : ১৪৪]

উপরোক্ত দু’টি আয়াতের প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে, যেকোনো দিকে ফিরেই নামাজ পড়া যাবে। আর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হচ্ছে, শুধু কা’বা শরীফের দিকে ফিরে নামাজ পড়া আল্লাহর নির্দেশ। এখন বলুন এটার সমাধান কী? তাফসীর ছাড়া কী এটার সমাধান হেযবুত তওহীদ দিতে পারবে? নিশ্চয় না। চলুন তাফসীর কী বলা হচ্ছে। এ সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রা. তাফসীর করে বলেন,
كان أول ما نسخ من القرآن القبلة
কুরআনের সর্বপ্রথম রহিত আয়াত হলো, কিবলার আয়াত। [তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ২ পৃ. ২৯]

অর্থাৎ প্রথমত তো নবিজি সাঃ বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন, কিন্তু পরবর্তিতে রাসুলুল্লাহ সা. এর পছন্দমত আল্লাহ পাক কিবলার আয়াত রহিত করে কা’বার দিকে নির্দেশ দিলেন। [উমদাতুত তাফসীর : খ. ১ পৃ. ১৯৪]

তাহলে বলুন, তাফসীর না দেখলে কী এ সমাধান পাওয়া যেতো? এমন প্রমাণ দিলে ভুরিভুরি প্রমাণ দেওয়া যাবে যে, তাফসীর ছাড়া কুরআন মাজীদ বুঝা সম্ভব না।

পবিত্র কুরআনের তো অসংখ্য আয়াত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে। যাকে শানে নুযুল বলা হয়। যে প্রেক্ষাপটগুলো না জানলে আয়াতের প্রকৃত অর্থ বুঝে আসে না। অথচ এ প্রেক্ষাপটগুলো লেখা আছে বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে। সুতরাং যদি তাফসীর বাদ দিতে হয়, তাহলে কুরআন শরীফের অর্থ কিভাবে বুঝবেন আমার জানা নেই।

একটা গভীর ষড়যন্ত্রের রূপরেখা বলছি, মুলত ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের বর্তমান ষড়যন্ত্রের একটি গভীর ধারা আমাদের অগোচরে। তারা শতশত বছর ধরে গবেষণা করে দেখেছে যে, মুসলমানরা মূলত কুরআনের মাধ্যমেই প্রভাবিত হয়। সেহেতু তারা কুরআন শরীফকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য ভারত উপমহাদেশেই কুরআন শরীফের লক্ষ লক্ষ কপি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো, হাফেজদের ধরে ধরে যবাই করেছিলো। যা ইতিহাসের পাতায় এখনও লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু এত কিছু করার পরও তারা কুরআন মাজীদকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে দিতে পারেনি। তখন তারা ষড়যন্ত্রের রুপরেখা পরিবর্তন করলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো,  ‘যেহেতু আমরা কুরআন উঠিয়ে দিতে পারলাম না এবং মুসলিমদের জাগরণ থামাতে পারছি না, সুতরাং প্রমাণ হচ্ছে কুরআন শরীফের কপি জ্বালিয়ে আমরা সফলতা পাবো না। অতএব এখন থেকে ভিন্ন কাজ করতে হবে।’ সেটা কিভাবে? তারা সিদ্ধান্ত নিলো, কুরআনের কপি থাকবে, তবে কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে পরিবর্তণ করতে হবে। এজন্য তারা সকল তাফসীরকে সমাজ থেকে উঠিয়ে দিতে কিছু নামধারী মুসলিমদের কাজে লাগালো। তাদের টার্গেট হলো, যখন পুরাতন তাফসীরকে সমাজ থেকে বয়কট করা হবে, তখন সবাই নিজ ইচ্ছামত তাফসীর করবে ও তাদের সেই দালালরা যে ব্যাখ্যা দেবে সেটাই তাদের অনুসারিরা মেনে আমল করবে। ফলে কুরআন থাকলেও কুরআনের সঠিক রুপ হারিয়ে যাবে। তারা তাদের মিশনে সফল হবে। বাংলাদেশে তাদের মূখপাত্র হিসাবে কাজ করছে কয়েকটি সংগঠন যার একটা হলো, হেযবুত তওহীদ। এরা পরিচয়ে মুসলিম হলেও আদতে ইসলাম বিদ্বেষীদের গোপন দালাল।

সুতরাং প্রিয় পাঠক, ইসলামের স্বীকৃত একটি জ্ঞানের নাম ‘ইলমুত তাফসীর’ বা তাফসীরের জ্ঞান। যে জ্ঞানের চর্চা আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ সা. করে গেছেন, এরপর সাহাবায়ে কেরাম রা. করে গেছেন, এরপর তাবেয়ীগণ করেছেন, এরপর যুগে যুগে তাদের তাফসীরের উপর ভিত্তি করে অসংখ্য তাফসীরের কিতাব রচিত হয়েছে। অথচ এই তাফসীরের কিতাবগুলো বাদ দিতে হেযবুত তওহীদ যেন আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের উদ্দেশ্য কী তা উপরে বর্ণনা করেছি। সুতরাং হেযবুত তওহীদের এহেন জঘন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ থেকে আমাদের বিরত থাকা ঈমানী দায়িত্ব।

সকল ধর্মগ্রন্থ কী আল্লাহর কিতাব?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
বর্তমানে হেযবুত তওহীদ সকল ধর্মকে এক করে সম্রাট আকবরের দ্বীনে এলাহীর রুপ দান করে মূলত ইমলামকে ধ্বংশ করতে চায়। আর এজন্য তারা পবিত্র কুরআনের মত সকল ধর্মগ্রন্থ যেমন বেদ, গীতা, ত্রিপিটক, রামায়ন, বাইবেলসহ সকল ধর্মগ্রন্থকে আল্লাহর কিতাব বলে দাবি করেছে। নিন্মে তাদের কয়েকটা দাবি তুলে ধরা হলো-
স্রষ্টার দেওয়া সম্ভবত প্রাচীনতম গ্রন্থ হচ্ছে বেদ। আমাদের বিশ্বাস মতে মহর্ষিম মনু, রাজা রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, ধর্মরাজ যুঠিষ্ঠির, মহাবীর জৈন, মহামতি বুদ্ধ এঁরা সবাই ছিলেন ভারত বর্ষে আগত আল্লাহর নবী। অনেক গবেষক মনে করেন বৈবস্বতঃ মনুই হচ্ছেন বৈদিক ধর্মের মূল প্রবর্তন, যাঁকে কোরানেও বাইবেলে বলা হয়েছে নূহ আ., ভবিষ্যপুরাণে বলা হয়েছে রাজা ন্যূহ। তাঁর উপরই নাযেল হয় বেদের মূল অংশ।… এভাবে সকল যুগে, সকল জাতি গোষ্ঠীর কাছে তাদের মাতৃভাষায় আল্লাহ নবী-রসুল ও গ্রন্থ পাঠিয়েছেন। [সকল ধর্মের মর্ম কথা সবার উর্ধ্বে মানবতা : পৃ. ৫]

শেষ প্রেরিত গ্রন্থ আল-কোরআনকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন ছন্দ বদ্ধ করে। কেবল কোর’আন নয়, যবুর, গিতা,বেদ, ত্রিপিটক ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থও আল্লাহ পাঠিয়েছেন কাব্যময় করে? [গনমাধ্যমের করণীয় : পৃ. ৫৯]

আমাদের স্রষ্টা এক,নবী-অবতারগণও এসেছেন একই স্রষ্টার পক্ষ হতে তাদের আনীত গ্রন্থাবলীকেও আল্লাহর কেতাব বলে জানতে হবে’। [মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ১০৫]

অর্থাৎ তারা বলতে চায়, পৃথিবীতে যত ধর্মগ্রন্থ আছে, সব আল্লাহ নাযিলকৃত। এ সব ধর্মগ্রন্থের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে।

ইসলাম কী বলে?
আমরা জানি, বেদ, গীতা, ত্রিপিটক, রামায়ন ইত্যাদী ধর্মগ্রন্থগুলো আল্লাহর কিতাব নয়। কারণ এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ’য় কোনো প্রমাণ নেই, এমনকি এই ধর্মগ্রন্থগুলোর অনুসারীরাও এগুলোকে আল্লাহর কিতাব কলে দাবি করেননি। উপরন্তু তওরাত, যবুর, ইঞ্জিল যদিও আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব। কিন্তু বর্তমানে এ তিনটি কিতাবের সমষ্টি ও পূর্ণরুপ বাইবেল বলে ইহুদী-খ্রিষ্টানরা দাবি করে থাকে। কিন্তু তা পুরোটাই মানবরচিত। চলুন এগুলোর প্রত্যেকটির বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা দেখা যাক।

মহাভারত, গীতা, পুরান:
মহাভারত, গীতা, বেদ, পুরান এগুলো আল্লাহর কিতাব নয়, বরং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস হলেন মহাভারত, গীতা, বেদ এবং পুরাণের লেখক। [উইকিপিডিয়া]

বেদ সম্পর্কে আরও বলা আছে, ‘বেদ ব্রহ্মার নিশ্বাস হতে নিসৃত। [পৌরাণিক অভিধান : পৃ. ৩৬৯]

ত্রিপিটক:
ত্রিপিটকও আল্লাহর কিতাব নয়, বরং গৌতম বুদ্ধ থের’র সিংহলদ্বীপ গিয়ে ত্রিপিটক লিখন এবং অট্ঠকথা সংকলন করেন। [উইকিপিডিয়া]

তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল:
প্রথমত এ কথা জেনে রাখা দরকার যে, তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল ও কুরআনসহ নবীদের প্রতি নাযিলকৃত সকল কিতাব ওহী। সবই আল্লাহ তাআলার কালাম। তবে ধর্মীয় ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণে একথা সুস্পষ্ট যে, কুরআনে কারীম ছাড়া অন্য সকল আসমানি কিতাব চরমভাবে বিকৃতির শিকার হয়েছে। কোনোটিই তার মূল অবস্থায় বাকি থাকেনি, বরং বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত, যবুর বা ইঞ্জিল সবই মানুষের লেখা। এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে গেলে কিতাবটি দীর্ঘ হবে। এ জন্য সংক্ষেপে এতটুকু জেনে রাখুন যে আসমানি কিতাব তাওরাত বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের পুরনো নিয়মের প্রথম পাঁচ পুস্তক (আদিপুস্তক, যাত্রাপুস্তক, গণনাপুস্তক, লেবীয় পুস্তক ও দ্বিতীয় বিবরণ অথবা অন্য শব্দে পয়দায়েশ, হিজরত, লেবীয়, শুমারী ও দ্বিতীয় বিবরণ) নয়; বরং তাওরাত হচ্ছে সেই কিতাব, যা ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে দান করেছেন।

যবুর কিতাবও বাইবেলের পুরনো নিয়মের ‘সামসঙ্গীত’ বা ‘গীতসংহিতা’ নয়; বরং আল্লাহ তা’আলা হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের উপর যে কিতাব নাযিল করেছেন তা হচ্ছে যবুর শরীফ। তেমনি আসমানি কিতাব ইঞ্জিল বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের নতুন নিয়ম কিংবা নতুন নিয়মের প্রথম চারটি কিতাব (মথি সুসমাচার, মার্ক সুসমাচার, লূক সুসমাচার ও যোহন সুসমাচার) নয়; বরং ইঞ্জিল সেই কিতাব, যা আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা ইবনে র্মাইয়ামকে ওহীর মাধ্যমে দান করেছেন এবং ঈসা আলাইহিস সালাম তা বনী ইসরাঈলের মাঝে প্রচার করেছেন। মূলকথা, বাইবেলের পুরনো নিয়ম ও নতুন নিয়ম (প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফ)-এর কোনো গ্রন্থই ওহীর মাধ্যমে নাযিলকৃত গ্রন্থ নয়। এগুলো পরবর্তীদের রচনা। কিন্তু এ রচনাগুলোর মূলকপিও খ্রিস্টানদের কাছে সংরক্ষিত নেই। এগুলোর রচয়িতা কে বা কারা, তাও নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।

তবে তাওরাত, যবুর বা ইঞ্জিল শরীফের পূর্ণরুপ বাইবেল নামে যে বইটা সমাজে প্রচলিত রয়েছে, সে বাইবেলটা খ্রিস্টধর্ম মতে ১৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ৪০জন লেখক লিপিবদ্ধ করেছিলেন। [উইকিপিডিয়া]

এবং যারা এই বাইবেলের লেখক, তারা নিজেরাই বলেছেন যে, এগুলো তাদের হাতের লেখা। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখতে পারেন-
বাইবেল, নতুন নিয়ম, ইউহোন্না/যোজন ২১:২৫, লূতা ১:১-৩ প্রেরিত ১:১-২ কলসীয় ৪:১৮ ২ তীমথিয় ২:৮ কলসীয় ১:২৩-২৬ রোমীয় ১:১-৩, ১ করিন্থীয় ১৫:১-১১ গালাতীয় ১:১-২০, থিষলনীকীয় ৫:১ মথা ২৮:২-৭ লূক ২৪:৩৬-৪৪ যোজন ২১:৪-১২

এ কিতাবগুলো সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
يَا مَعْشَرَ الْمُسْلِمِينَ، كَيْفَ تَسْأَلُونَ أَهْلَ الْكِتَابِ، وَكِتَابُكُمُ الَّذِي أُنْزِلَ عَلَى نَبِيِّهِ صلى الله عليه وسلم أَحْدَثُ الأَخْبَارِ بِاللَّهِ، تَقْرَءُونَهُ لَمْ يُشَبْ، وَقَدْ حَدَّثَكُمُ اللَّهُ أَنَّ أَهْلَ الْكِتَابِ بَدَّلُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ وَغَيَّرُوا بِأَيْدِيهِمُ الْكِتَابَ فَقَالُوا هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ، لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً
হে মুসলিম সমাজ! কী করে তোমরা আহলে কিতাবদের নিকট জিজ্ঞেস কর? অথচ আল্লাহ তাঁর নবীর উপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, তা আল্লাহর সম্পর্কিত নবতর তথ্য সম্বলিত, যা তোমরা তিলাওয়াত করছ এবং যার মধ্যে মিথ্যার কোন সংমিশ্রণ নেই। তদুপরি আল্লাহ তোমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, আহলে কিতাবরা আল্লাহ যা লিখে দিয়েছিলেন, তা পরিবর্তন করে ফেলেছে এবং নিজ হাতে সেই কিতাবের বিকৃতি সাধন করে তা দিয়ে তুচ্ছ মূল্যের উদ্দেশে প্রচার করেছে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকেই অবতীর্ণ। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ২৬৮৫]

সুতরাং প্রমাণ হলো, মহাভারত, গীতা, বেদ, পুরান, ত্রিপিটক, বাইবেল তথা বর্তমানের তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল এ সব মানবরচিত ধর্মগ্রন্থ। এগুলোকে আল্লাহর কিতাব বলা মারাত্মক অন্যায়।

এসব ধর্মগ্রন্থকে যারা আল্লাহর কিতাব বলে তারা মিথ্যাবাদী:
মানবরচিত এসব ধর্মগ্রন্থগুলোকে যারা আল্লাহর কিতাব বলে দাবি করে মহান রব তাদের ব্যাপারে বলেন,
وَإِنَّ مِنْهُمْ لَفَرِيقًا يَلْوُونَ أَلْسِنَتَهُم بِالْكِتَابِ لِتَحْسَبُوهُ مِنَ الْكِتَابِ وَمَا هُوَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَقُولُونَ هُوَ مِنْ عِندِ اللّهِ وَمَا هُوَ مِنْ عِندِ اللّهِ وَيَقُولُونَ عَلَى اللّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
তাদেরই মধ্যে একদল লোক এমন আছে, যারা কিতাব (তাওরাত) পড়ার সময় নিজেদের জিহ্বাকে পেঁচায়, যাতে তোমরা (তাদের পেঁচিয়ে তৈরি করা) সে কথাকে কিতাবের অংশ মনে কর, অথচ তা কিতাবের অংশ নয় এবং তারা বলে, এটা আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ, অথচ তা আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ নয় এবং (এভাবে) তারা জেনে শুনে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে। [সুরা আলে ইমরান : ৭৮]

তারা জাহান্নামী:
অপর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,
فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ يَكْتُبُونَ ٱلْكِتَٰبَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنْ عِندِ ٱللَّهِ لِيَشْتَرُوا۟ بِهِۦ ثَمَنًا قَلِيلًاۖ فَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا يَكْسِبُونَ
সুতরাং তাদের জন্য দুর্ভোগ (ওয়াইল দোযখ), যারা নিজ হাতে গ্রন্থ রচনা করে এবং অল্প মূল্য পাবার জন্য বলে, ‘এটি আল্লাহর নিকট হতে এসেছে।’ তাদের হাত যা রচনা করেছে, তার জন্য তাদের শাস্তি এবং যা তারা উপার্জন করেছে তার জন্যও তাদের শাস্তি (রয়েছে)। [সুরা বাকারা : ৭৯]

প্রিয় পাঠক, আশা করি উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে, পৃথিবীতে কুরআন শরীফ ছাড়া অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলো সবই মানবরচিত। এগুলোকে আল্লাহর কিতাব বলে দাবি করা নিতান্তই কুফরী মতবাদ।

বেদ কী মুহাম্মাদ সা. এর উপর অবতীর্ণ?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, বেদ যাদের উপর নাযিল হয়েছিলো, তাদের মধ্যে অন্যতম হলে আমাদের নবী মুহাম্মাদ সা.। তারা লিখেছে,
সামাজিক দণ্ডবিধি দিয়ে যাদেরকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যে আদম আ., নূহ আ. (মনু), বিভিন্ন বেদ যাদের ওপর অবতীর্ণ হোয়েছিলো, মুসা আ. ও মোহম্মদ সাঃ। [এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ. ১৩৯-১৪০]

ইসলাম কী বলে?
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সা. এর উপর অবতীর্ণ কিতাবের নাম পবিত্র কুরআন। মহান রব বলেন,
وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ
সূরা হিজর, আয়াত নং- ৮৭

পবিত্র কুরআনে আরও এসেছে, আল্লাহ পাক তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ সা. কে বলতে আদেশ করেছেন, বলুন-
وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَذَا الْقُرْآنُ لأُنذِرَكُم بِهِ
আমার প্রতি এ কোরআন অবর্তীর্ণ হয়েছে-যাতে আমি তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে এ কোরআন পৌঁছে সবাইকে ভীতি প্রদর্শন করি। [সুরা আনআম : ১৯]

সুতরাং প্রমাণ হলো, মুহাম্মাদ সা. এর উপর অবতীর্ণ কিতাবের নাম পবিত্র কুরআন। কিন্তু হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, ‘বেদ’ও মুহাম্মাদ সা. এর উপর নাযিল করা হয়েছে। এরচে বড় মিথ্যাচার আর কী হতে পারে? এরপরও কী হেযবুত তওহীদকে মুসলমান হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়?

 

Check Also

মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা:

আল্লাহ’র দ্বীনের একমাত্র হিফাযতকারী শিক্ষাব্যবস্থা হলো, মাদরাসা। যেখানে দিবানিশি আল্লাহ তাআলার কুরআন ও তাঁর রাসুল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.