Home > হিজবুত তাওহীদ > আত্মশুদ্ধির বিরুদ্ধে অবস্থান:

আত্মশুদ্ধির বিরুদ্ধে অবস্থান:

নফস হলো মানব জিবনের এক ভয়ঙ্কর ফিৎনার কেন্দ্রস্থল। কারণ নফস বেশিরভাগ সময়েই মানুষকে খারাপ কর্মের নির্দেশনা দেয়। যার প্রমাণ কুরআন শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ইউসুফ আ. বলেন,
وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلاَّ مَا رَحِمَ رَبِّيَ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ
আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না। নিশ্চয় মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ কিন্তু সে নয়-আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয় আমার পালনকর্তা ক্ষমাশীল, দয়ালু। [সুরা ইউসুফ : ৫৩[

সুতরাং বুঝা গেলো, নফসে আম্মারা ও বিতাড়িত ইবলিস শয়তান সর্বদা মানুষকে কুকর্মের দিকে আহ্বান করে। আর মানুষ যখন নফসের অনুসারী হয়ে যায়, তখন তার সকল কিছুই তার নিজের ও আম জনতার জন্য বড় ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য নফসকে পরিচ্ছন্ন রাখা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। যাকে পরিভাষায় ‘তাযকিয়াতুন নাফস’ বলে আখ্যায়ীত করা হয়। কিন্তু সময়ের দুর্ধর্ষ ঈমান ডাকাত হেযবুত তওহীদ এই তাযকিয়ার বিরুদ্ধে চরম পর্যায়ের আঘাত করেছে। চলুন আগে তাদের দাবিগুলো দেখে নেওয়া যাক।
১. আত্মশুদ্ধি ইসলামের আসল উদ্দেশ্য নয়।
২. আত্মশুদ্ধি নবিজি সাঃ-এর মিশন নয়।
৩. আত্মশুদ্ধির তরীকাগুলো বিদ’আত।
৪. নফসের জিহাদ ইসলামে প্রমাণিত নয়।
৫. পীর দেবতা একই অবস্থানে উপনীত।
৬. সুফিরা ইসলামের সবচে বেশি ক্ষতি করেছে।
৭. অমুসলিমরাও কারামাত দেখাতে পারে।
৮. হালকায়ে জিকিরের কোনো ভিত্তি নেই।
৯. আত্মশুদ্ধি তুচ্ছ বিষয়।
১০. এখন আত্মশুদ্ধির চিন্তা করা যাবে না।
১১. আত্মশুদ্ধি আগে নয়, বরং জিহাদ আগে।
১২. তাসবিহ দানা খ্রিস্টান ও হিন্দুদের জপমালা থেকে আবিস্কার।
১৩. আত্মশুদ্ধি খ্রিষ্টানদের আবিস্কার।
১৪. জান্নাতে যেতে আমল শর্ত নয়।
১৫. মাক্কী জীবনে নবিজি সাঃ কী কোনো আমলের দাওয়াত দেন নি।
১৬. ব্যক্তিকেন্দ্রিক আমলে জান্নাত নেই।
১৭. সওয়াব অর্জন করতে কী ইসলাম আসে নি।
১৮. সওয়াব অর্জনের তাকিদে ইসলাম ধ্বংস হয়েছে।
১৯. ব্যক্তিগত তাক্বওয়া কী মূল্যহীন?
২০. দুআ ও কান্নাকাটি করে জান্নাত পাওয়া যাবে না।
২১. পরকালের বিষয়টা মূল বিষয় নয়।
২২. আখেরাতের থেকে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে হবে।
চলুন প্রত্যেকটা বিষয়ে প্রমাণসহ আলোচনা দেখা যাক।

এক. আত্মশুদ্ধি কী ইসলামের আসল উদ্দেশ্য নয়?

একজন মুসলমানের জন্য তার নফসের সংশোধন করা অন্যান্ত গুরুত্ববহ ও ফরজ বিধান। যা অস্বীকার করা বা তার বিরোধিতা করা প্রকাশ্য কুফরি।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, আত্মশুদ্ধি ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। নিন্মে তাদের কিছু বক্তব্য তাদের বই থেকে হুবহু তুলে ধরা হলো,
আধ্যাত্মিকতা ইসলামের আসল উদ্দেশ্য নয়। [শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ.  ৫৭]

জেহাদ করার পর যদি সময় থাকে তবে তাসাউফের সাধনা করুন, কোন আপত্তি নেই। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৪৩]

এই সামরিক দীন পৃথিবীর অন্যান্য অসামরিক দীনের পর্যায়ে পর্যবসিত হলো অর্থাৎ খ্রিষ্টান,বৌদ্ধ,হিন্দু,ইহুদি,জৈন ইত্যাদি বহু দীনের(ধর্মের) মত আরেকটি ধর্মে পরিণত হলো যেটার উদ্দেশ্য এবাদত,পূজা,উপাসনা করে আত্মার চর্চা করা। [ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ২০]

নির্জনে বা হুজরায় বসে ব্যক্তিগতভাবে আত্মিক উন্নতি করতে পারে এবং ব্যক্তিগতভাবে তার ফল ভোগ করতে পারে। কিন্তু তাতে জাতি উপকৃত হবে না। পারলেও তা অতি সামান্য। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ১৭]

একজন মোজাহেদ জেহাদ করে প্রথমত মানবজাতির কল্যানের জন্য আল্লাহকে বিজয়ী করার জন্য। পক্ষান্তরে সাধু ফকির দরবেশ জুহদ বা আত্মিক সাধনা করে একান্তই নিজের জন্য স্বীয় আত্মিক পরিতৃপ্তি ও পরিশুদ্ধির জন্য। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ২৭]

ইসলাম কী বলে?
তাযকিয়া হচ্ছে আত্মোন্নতির নিমিত্তে এমন একটি মানবীয় কাজ এবং অর্জিত প্রচেষ্টা যা অসৎকাজের পরিহার এবং সৎকাজের বাস্তবায়নে সহযোগীতা করে। এর অপর নাম নফসের সাথে জিহাদ কিংবা নফসের যাকাত। এটি একটি বাস্তবমুখী,প্রযোজ্য,এবং ভারসাম্যপূর্ণ প্রক্রিয়া। এটি কুরআন সুন্নাহ্ এবং সাহাবাদের জীবন পদ্ধতি থেকে উৎকলিত। এই আত্মশুদ্ধির বিষয়টি সর্বপ্রথম আবিস্কার করেছেন মহান আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসুল সা.। শয়তান ও নফসকে কন্ট্রোল করার একমাত্র মাধ্যম হিসাবে পরিচয় করানো হয়েছে, ‘নফসের পরিচর্যা’ বা তাযকিয়াতুন নাফস’ নামে। যে ব্যক্তি তার নফসকে পরিশুদ্ধ করবে, সে নফস সফল। আর যে নফসকে পরিশোধন করবে না, সে ব্যর্থ ও হতভাগা। মহান রব বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّى
নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয়। [সুরা আ’লা : ১৪]

এজন্য মানব জিবনের বিফলতা ও সফলতার একমাত্র কেন্দ্রস্থল এই নফসকে পরিচ্ছন্ন রাখতে উম্মাহকে উৎসাহ দিয়েছেন খোদ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলে আরাবী সা.। আল্লাহ পাক বলেন,
يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ
যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না। কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে (সেই সুস্থ অন্তরই উপকারে আসবে)। [সুরা শু’আরা : ৮৮-৮৯]

সুতরাং বুঝা গেলো, অন্তর সুস্থ করে না নিয়ে গেলে সবই বিফল। এজন্য আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের নফসকে পরিশুদ্ধ করার জন্য যুগে যুগে নবী-রাসুলগণকে পাঠিয়েছেন। এমনকি আমাদের নবীজিকে সা. যে কয়েকটি মিশন দিয়ে প্রেরণ করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিলো তাযকিয়া।

দুই. আত্মশুদ্ধি কী নবিজি সাঃ-এর মিশন নয়?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ‘তাসাউফের মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে তাঁর নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া শিক্ষা দেওয়া মোহাম্মদের স: লক্ষ্য নয়। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন আইন, নতুন সমাজ ব্যবস্থা স্থাপন করা, একটা সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ১৭]

ইসলাম কী বলে?
মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল সা. কে কয়েকটি মিশন দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো, ‘তাযকিয়া’ বা আত্মশুদ্ধি করা। মহান আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ
তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র (তাযকিয়া) করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত। [সুরা জুমআ : ২]

لَقَدْ مَنَّ اللّهُ عَلَى الْمُؤمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُّبِينٍ
আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন। তাদেরকে পরিশোধন (তাযকিয়া) করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও কাজের কথা শিক্ষা দেন। বস্তুতঃ তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট। [সুরা আলে ইমরান : ১৬৪]

বুঝা গেলো, রাসুলুল্লাহ সা. এর মিশনের অন্য অন্যতম মিশন ছিলো মানুষের আত্মার পরিচর্চা করা। যেহেতু মানবজাতির এ আত্মা শুদ্ধ করার জন্য মহান রব তাঁর রাসুল সা. কে পাঠিয়েছেন, এজন্য রাসুল সা. সে দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করে গেছেন। আত্মাশুদ্ধির জন্য রাসুল সা. এক ঐতিহাসিক কথা বলেন,
أَلاَ وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ‏ أَلاَ وَهِيَ الْقَلْبُ
জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে গোশতের টুকরোটি হল নফস বা অন্তর। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৫২]

তাহলে বুঝতে পারলাম, আত্মাশুদ্ধ করাও নবিজি সাঃ-এর মিশন ছিলো। এটা তারাও ভুলবশত এক জায়গায় লিখে ফেলেছে,
বিশ্বনবীর দায়িত্ব ছিল মানুষের বাহ্যিক ও আত্মিক পরিবর্তন ঘটানো। [ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে : পৃ. ৪৮]

সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ ও তাদের বক্তব্য থেকেও প্রমাণ হলো, আত্মশুদ্ধি করাটাও নবিজি সাঃ-এর মিশন ছিলো। অথচ হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, তাযকিয়া নবিজি সাঃ-এর মিশন নয়। এখন আপনিই বলুন, হেযবুত তওহীদের দাবি আর কুরআন শরীফ ও হাদিসে নববি সাঃ-এর দাবি কী কখনই এক না ভিন্ন? নিশ্চয় ভিন্ন। শুধু ভিন্নই নয়, বরং তারা নবীজির সা. মিশনের উপর হস্তক্ষেপ করেছে এ দাবি করে।

তিন. আত্মশুদ্ধির তরীকাগুলো কী বিদ’আত?
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম, তাযকিয়া সরাসরি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাঃ থেকেই প্রমাণিত ও আবশ্যকীয় একটি বিষয়।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের একটা দাবি হলো, তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি খ্রিষ্টানদের আবিস্কার এবং প্রচলিত ত্বরীকাগুলো বিদ’আত। তারা লিখেছে,
সুফি সাধক দরবেশ বুযুর্গদের উদ্ভাবিত মারেফাতী তৈরিকার অনুসরণ করতে গিয়ে জাতি কাদেরিয়া চিশতিয়া নকশবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া এমন শত শত তরীকায় বিভক্ত হয়ে গেল। ফলে এক দেহ এক প্রাণ হয়ে এক নেতার নেতৃত্বে এই জাতি পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে গিয়ে সেখানকার অসহায় মানুষের রক্ষা করার প্রেরণা, লক্ষ্য (আকিদাহ) সামর্থ্য সবই হারিয়ে ফেলল। [ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ১১৬]

বর্তমানে আধ্যাত্মিকতা নামের যে সুফিবাদ চালু আছে, সেটা আল্লাহ ও রাসূলের নয়। মোমেনদের  মধ্যে যিনি আল্লাহর হুকুমের ব্যাপারে যত সচেতন যত বেশি মুত্তাকী তিনি কত বড় আধ্যাত্মিক  সাধক। গাছের নিচে ঝোপঝাড়ে বসে গুহায় খানকায় বসে আধ্যাত্ম অর্জন শেষ ইসলামের আধ্যাত্ম নয়। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ২৬]

বিকৃত সুফীবাদের তরীকাগুলোও বেদাত। কারণ বিশ্বনবীর সময় কোনো তরীকা ছিলো না। [প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ১১৪]

ইসলাম কী বলে.
অথচ সকল ত্বরীকাগুলোতে কয়েকটি বিষয়ে বায়’আত করানো হয়। যেমন শিরক না করা, চুরি না করা, যিনা না করা, হত্যা না করা, কাউকে মিথ্যা অপবাদ না দেওয়া, গুনাহ না করা ইত্যাদী। চলুন এ বিষয়টি নতুন আবিস্কার নাকি রাসুলুল্লাহ সা. থেকে এর কোনো অস্তিত্ব প্রমাণিত আছে কি না দেখা যাক। সহিহ বুখারীর একটি হাদিসে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সাহাবায়ে কেরামকে রা. রাসুলুল্লাহ সা. দুই বার বায়’আত করান। প্রথম বায়’আত ছিলো ঈমানের বায়’আত, আর দ্বিতীয় বায়’আত ছিলো তাযকিয়ার বায়’আত। উবাদাহ ইবনু সামিত রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
بَايَعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِي رَهْطٍ فَقَالَ أُبَايِعُكُمْ عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللهِ شَيْئًا وَلاَ تَسْرِقُوا وَلاَ تَزْنُوا وَلاَ تَقْتُلُوا أَوْلاَدَكُمْ وَلاَ تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ وَلاَ تَعْصُونِي فِي مَعْرُوفٍ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَأُخِذَ بِهِ فِي الدُّنْيَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَطَهُورٌ وَمَنْ سَتَرَهُ اللهُ فَذَلِكَ إِلَى اللهِ إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ وَإِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ
আমি একটি দলের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বায়’আত করেছি। তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের এ মর্মে বায়’আত করছি যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, তোমাদের সন্তান হত্যা করবে না, সামনে বা পিছনে কারো অপবাদ দিবে না, শারীয়াত সম্মত কাজে আমার অবাধ্যতা করবে না, তোমাদের মধ্যে যে আপন ওয়াদাগুলো মেনে চলবে তার বিনিময় আল্লাহর নিকট। আর যে এগুলো থেকে কিছু করে ফেলবে আর সে জন্য দুনিয়াতে যদি তার শাস্তি হয়ে যায়, তাহলে এটি হবে তার জন্য গুনাহর কাফ্ফারা এবং গুনাহর পবিত্রতা। আর যার (দোষ) আল্লাহ্ গোপন রেখেছেন তার ব্যাপারটি আল্লাহর উপর। (আল্লাহ্) ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দিতে পারেন। আবার ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৬৮০১]

প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত হাদিস থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, নবিজি সাঃ সাহাবায়ে কেরামকে দ্বিতীয়বার বায়’আত করিয়েছিলেন শিরক, চুরি, হত্যা না করতে, অপবাদ না দিতে, ওয়াদা রক্ষা করতে, দোষ গোপন রাখতে ইত্যাদী। আর আপনারা যারা প্রচলিত ত্বরীকাগুলোর বায়’আতে উচ্চারিত বিষয়গুলো সম্পর্কে জানেন, তারা নিশ্চয় জানেন যে, উপরোক্ত বিষয়গুলো উচ্চারণ করেই বায়’আত হতে হয়। তাহলে আপনারাই বলুন, প্রচলিত তাযকিয়ার বিষয়টি কী খ্রিষ্টানদের আবিস্কার? এগুলো কী বিদ’আত? এগুলো কী কোনো ধর্মব্যবসায়ীদের আবিস্কার? নাকি রাসুলুল্লাহ সা. এর আবিস্কার? যারা নবীজির সা. আবিস্কৃত বিষয়গুলোকে খ্রিষ্টান, ধর্মব্যবসায়ীদের আবিস্কার বলে চালিয়ে দিতে চায় তারা কী মুসলিম হতে পারে?

চার. নফসের জিহাদ কী প্রমাণিত নয়?

আত্মার পরিচর্যাকে জিহাদের অন্তুর্ভূক্ত করেছেন খোদা রাসুলুল্লাহ সাঃ। যা সহিহ হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
কিন্তু হেযবুত তওহীদ দাবি করেছে, নফসের পরিচর্যাকে জিহাদ বলে আখ্যায়িত করেছে ধর্মব্যবসায়ি আলেমরা। চলুন তারা কী বলে আগে দেখে নেওয়া যাক। তারা লিখেছে,
আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদের কথা আল্লাহ বলেননি,আল্লাহ বলেছেন কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ কর আর এটিই হোল বড় জেহাদ অর্থাৎ জেহাদান কাবীর। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৫৮]

এই আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদ বের করেছে পলায়নপর,ভীরু-কাপুরুষ ধর্মজীবী আলেম মোল্লারা নিজেদেরকে সকল প্রকার বিপদ-আপদ থেকে বাঁচিয়ে ধর্মব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৫৮]

সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে নফসের সংঙ্গে সংগ্রামের আশ্রয় গ্রহণ করার ও তার প্রিয় নবীর এমন চরম অবমূল্যায়নোর জন্য আল্লাহ এই জাতিকে চরম শাস্তি দিতেও ছাড়েননি। [এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব : পৃ. ৮০]

যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ অর্থাৎ আদর্শিক লড়াই করার হিম্মত, সাহস, যোগ্যতা জাতির মধ্য থেকে লুপ্ত হয়ে গেল, তখন ভারসাম্যহীন সুফিবাদীরা বিকল্প হিসেবে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ কে আবিষ্কার করলেন। [ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৪১]

এই জাতির পথভ্রষ্ট লোকেরা যখন নীতি হিসাবে জেহাদ ত্যাগ করলেন তখন তাঁরা বুঝলেন না যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দৃষ্টিতে আর তারা মো’মেন রইলেন না। তাদের ঐ দুর্ভাগ্যজনক কাজের ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টায় তারা হাদিস উদ্ভাবন করলেন নফসের সঙ্গে জেহাদই হচ্ছে জেহাদে আকবর, বড় জেহাদ। এই হাদীসের সংকলক ইমাম বায়হাকী নিজেই স্বীকার করেছেন যে এই হাদীসের সনদ ত্রুটিযুক্ত এবং এই দয়িফ হাদিস সম্বন্ধে হাফেজ ইবনে হাজ্জার প্রমুখ মোহাদ্দেসরা বলেছেন এটা কোন হাদিসই না, এটা একটা আরবি প্রবাদ বাক্য মাত্র।[এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৯-১০]

প্রিয় পাঠক, তাদের লেখনি থেকে বুঝতে পারলাম যে, তাদের দাবি হলো-
১. নফসের জেহাদ সংক্রান্ত হাদিসটি জাল।
২. নফসের পরিচর্যাকে জিহাদ বলে আখ্যায়িত করেছে ধর্মব্যবসায়ি আলেম-উলামারা।

ইসলাম কী বলে?
নফসের পরিচর্যাকে রাসুলুল্লাহ সাঃ জিহাদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কিন্তু মূর্খতা ও দাজ্জালের মতো এক চোখা হওয়ার কারণে হেযবুত তওহীদ তা দেখতে পাচ্ছে না।

নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের হাদিসটি কী জাল?
নফসের জিহাদকে বড় জিহাদ বলে আখ্যায়িত করার হাদিসটি সহিহ সনদে প্রমাণিত। হযরত আবু যার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قلت يا رسول الله أي الجهاد أفضل قال أن يجاهد الرجل نفسه وهواه
আমি রাসূল সাঃ-কে জিজ্ঞাসা করলাম-কোন জিহাদ সর্বোত্তম? তিনি বললেন-নফস ও কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদই উত্তম জিহাদ। [জামিউল আহাদীস : হাদীস নং : ৩৯৭৭; হিলইয়াতুল আউলিয়া : খ. ২ পৃ. ২৪৯]

অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে
وأفضل الجهاد من جاهد نفسه فى ذات الله عز وجل
সর্বত্তোম জিহাদ হলো আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে অন্তরের সাথে জিহাদ করা। [কানযুল উম্মাল : হাদিস নং : ৪৩৪২৭]

উক্ত হাদসিটিকে পৃথিবীর কোনো মুহাদ্দিস জাল বলেছেন বলে আমার জানা নেই। উপরন্তু তারা ইবনে হাজার আসকালানী রহি. এর ব্যাপারেও একটা মিথ্যা তোহমত দিয়েছে। এ সংক্রান্ত হাদিসটিকে নাকি ইবনে হাজার আসকালানী রহি. জাল বলেছেন। অথচ ইবনে হাজার আসকালানী রহি. নিজে এ সংক্রান্ত একটি হাদিস বর্ণনা করেন, নবিজি সাঃ বলেছেন,
والمجاهدُ من جاهدَ نفسَهُ في طاعةِ اللهِ تعالى
আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে অন্তরের সাথে যে ব্যক্তি জিহাদ করে সে মমুজাহিদ। [মুখতাসারুল বাযযার : খ. ১ পৃ. ৪৬৪]

এ হাদিসটি উল্লেখ্য করে খোদ ইবনে হাজার আসকালানী রহি. বলেন, إسناده صحيح  অর্থাৎ হাদিসটির সনদ সহিহ। [মুখতাসারুল বাযযার : খ. ১ পৃ. ৪৬৪]

সুতরাং প্রমাণ হলো, হেযবুত তওহীদ মূলত কুরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত ও নির্দেশিত আত্মশুদ্ধির পথ থেকে সরিয়ে মানবজাতিকে নফস ও শয়তানের অনুগামি বানাতে বড় বড় ইসলামিক স্কলারদের নামেও মিথ্যাচার ছড়াতে বদ্ধপরিকর।

স্ববিরোধী বক্তব্য:
দ্বীন ইসলাম এমন এক চুড়ান্ত বিজয়ী ধর্ম যার সততার প্রমাণ অনেক সময় বাতিলদের থেকেও প্রমাণিত হয়। এমনটি হয়েছে হেযবুত তওহীদের থেকেও। তারা তাযকিয়ার বিরুদ্ধে শত শত পৃষ্ঠা লিখলেও তাদের যবান থেকে আল্লাহ পাক এই চুড়ান্ত বিষয়ের সততা বের করিয়ে দিয়েছেন। চলুন তার কয়েকটি নমুনা নিচে দেখে নেওয়া যাক। তারা লিখেছে,
মানুষের জন্য উপযোগী ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থা হতে হবে এমন, যেটা শরিয়া ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে ভারসাম্যপূর্ণ। [প্রস্তাবনা : পৃ. ১ ]

জাতির ভাগ্য পরিবর্তন এর চেয়েও আত্মিক পরিবর্তন বেশি জরুরী এটা আল্লাহ রাসুল ভালোভাবে জানতেন। [ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে : পৃ. ৪৬]

আত্মাই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মানুষকে যদি আত্মিক শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করা হয়, তাদেরকে যদি নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তবে সে নিজেই আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে অপরাধ সংগঠন থেকে নিবৃত্ত থাকবে। অপরাধ প্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য এটাই সর্বোত্তম পন্থা। [ধর্ম বিশ্বাস : পৃ. ১৩]

বাইরের জেহাদ হবে প্রচার করে, মানুষকে যুক্তির মাধ্যমে বুঝিয়ে, বক্তৃতা করে, লিখে এবং অস্ত্র নিয়ে। ভেতরে জেহাদ হবে শয়তানের প্রচারণার বিরুদ্ধে লোভ,অহংকার, হিংসা, ঈর্ষা ক্রোধ ও কামের  বিরুদ্ধে। এই দুই রকম জেহাদের যে কোনোটাকে বাদ দিলেই সেই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সেই এক পাওয়ালা মানুষের মতো জাতীযও চলার শক্তি হারিয়ে স্থবির হয়ে যাবে।  [বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৩৩]

মহান আল্লাহর নবী মুহাম্মদের স: উপরে শেষ জীবন বিধান হিসেবে যে জীবন ব্যবস্থাকে পাঠিয়েছেন, সেটা ভারসাম্যযুক্ত জীবনব্যবস্থা। কিসের ভারসাম্য? দুনিয়া ও আখেরাতের ভারসাম্য,দেহ ও আত্মার, শরীয়ত এবং মারফত এর ভারসাম্য। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ২৮]

মানুষ এক পায়ে হাঁটতে পারে না। তাকে দু পায়ে ভারসাম্য করতে হয়। দীনের ও দুটি পা। এক পা শরিয়া অন্য পা মারেফত। এই দুই পায়ের সহযোগিতায় একটা মানুষ ভারসাম্য রেখে হাঁটতে পারে। একটা জাতির বেলায়ও তাই। ঐ দুই পায়ের একটা বাদ দিলে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে ঐ জাতি আর হাটতে পারবে না তা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না।[বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ১৬]

প্রত্যেকটিতে (ধর্মে) একদিকে যেমন মানুষের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থ সামাজিক বিধান রয়েছে, তেমনি তার আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়াও রয়েছে। দুদিকেই সমান এবং একটাকে বাদ দিয়ে অন্য টা একেবারে অচল। মানুষ যেমন দু’পায়ে চলে, এক পায়ে চলতে পারে। দীনও একটাকে বাদ দিয়ে অন্য টা একা চলতে পারে না। [বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ২৫]

বুঝা গেলো, তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধির আবশ্যকীয়তা সম্পর্কে তারাও ওয়াকেফহাল। কিন্তু শুধুমাত্র বিরোধিতাই তাদের মূল কাজ। যেমন শয়তান আল্লাহপাকের অস্তীত্ব সম্পর্কে জানার পরও মানুষকে নাস্তিকতার সবক দেয়। ঠিক একই পথে হেযবুত তওহীদও।
অথচ এরাই আবার অন্যত্র বলে বসলেন,
আধ্যাত্মিকতা ইসলামের আসল উদ্দেশ্য নয়। [শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৫৭]

তাসাউফের মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে তাঁর নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া শিক্ষা দেওয়া মোহাম্মদের স: লক্ষ্য নয়। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ১৭]

আপনারাই বলুন, যারা নিজেরাই নিজেদের কথার বিরোধীতা করে, তারা কি সুস্থ না অসুস্থ? কী আশ্চর্য দ্বিমুখী আচরণ! এরপরও কী জাতি বুঝবে না তাদের ষড়যন্ত্রের রুপরেখা?

পাঁচ. পীর দেবতা কী একই অবস্থানে উপনীত?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা পীরতন্ত্রকে কটুক্তি করতে করতে কোনো ধাপ বাকি রাখেনি। অবশেষে এটাও বলেছে যে,
দেবদেবি ও পীরদের প্রতি তার অনুসারিদের ধারণা একই। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৭]

অথচ যারা সত্যিকারের পীর তাঁদের প্রতি তাঁদের অনুসারিদের ধারণা হলো, পীর মানে জান্নাতের পথপ্রদর্শক। তাঁরা শুধু কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক তাঁদের অনুসারিদের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন, সুন্নাতের রাস্তা বাতলে দেন, গুনাহমুক্ত জিবন গঠণে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। অথচ দেবদেবীদের প্রতি তাদের অনুসারিদের ধারণা হলো, দেবদেবিরা প্রভু, তারাই স্বর্গ-নরকের মালিক। ইত্যাদী। তাহলে আপনারাই বলুন, বাস্তবতার নিরিখে হেযবুত তওহীদ কী সত্যবাদি না মিথ্যুক?

পীরদের  বেলায় তো এরা দেবদেবীর সাথে শুধু তুলনা করেই ক্ষ্যান্ত হয়েছে, অথচ ফিরিস্তাদের বেলায় আরো জঘণ্যভাবে উল্লেখ্য করেছে। দেখুন কী বলে,
ভারতীয়, রোমান এবং গ্রীকরা যে দেব-দেবী God goddess বিশ্বাস করে সেগুলো এবং মালায়েক বা ফেরেশতা একই জিনিষ। [এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ.  ১৬]

নাউযুবিল্লাহ। যারা ফিরিস্তাদের শানে এমন জঘণ্য মন্তব্য করতে জানে, তারা পীরদের ব্যাপারে যা বলেছে তা অতি সামান্য বটে।

ছয়. সুফিরা কী ইসলামের সবচে বেশি ক্ষতি করেছে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ‘লক্ষ শত্রু বিশ্বনবীর স: জীবনের যে ব্রতকে যে ক্ষতি করতে পারেনি, পন্ডিত  ও সুফিরা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ক্ষতি করলেন। মহানবী স: তার উম্মাহকে যেদিকে চালনা করলেন, সুফিরা চালনা করলেন তার উল্টো দিকে। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৩৫]

দুর্দান্ত টর্নেডোর মত গতিশীল উম্মতে মোহাম্মদীকে নিঃসাড়, নির্জীব করে অন্তর্মুখিতায় বুঁদ করে দেয় ভারসাম্যহীন সুফিবাদ। যোদ্ধা জাতি অস্ত্র ছেড়ে তসবিজ নেয়, যুদ্ধ ছেড়ে ওজিফা পাঠ করে রিপুজীয় পীর বুজুর্গ হওয়ার সাধনায় আত্মনিয়োগ করে। পরিণতিতে জাতির ভাগ্যে নেমে আসে করুন দাসত্ব। যার ঘানি আমরা আজও টেনে যাচ্ছি।[বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৫৩]

অন্যদিকে জাতির মধ্যে জন্ম নিল একটি বিকৃত সুফীবাদী গোষ্ঠী। তারা উম্মতে মোহাম্মদীর সংগ্রামী জীবনটাকে উল্টিয়ে একেবারে অন্তর্মুখী করে দিল। যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী,প্রতিবাদী দুর্দান্ত গতিশীল ইসলামকে তারা সংসারত্যাগী, বৈরাগী সাধু -সন্ন্যাসীর ধর্মে পরিণত করল। সমাজে নিরাপত্তা, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত আছে কি না সে বিষয়ে উদাসীন হয়ে তারা নিজেদের আত্মার উন্নতিকেই জীবনের মূল কাজ বানিয়ে নিল। আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায় নির্দেশ করতে গিয়ে এই আধ্যাত্মিক সাধকগণ শত শত তরিকা সৃষ্টি করলেন। আর বিরাট সংখ্যক সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ হাজারো মতভেদের উপর গড়ে ওঠা ফেরকা-মাযহাব-তরিকায় বিভক্ত হয়ে গেল। [হলি আর্টিজেনের পর : পৃ. ১৩]

অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, সুফিরাই ইসলামের সবচে বেশি ক্ষতি করেছে।

ইসলাম কী বলে?
অথচ এই দেশে ইসলাম এসেছে সুফিদের মাধ্যমে। শাহজালাল ইয়ামানী রহি. শাহ পরান রহি. প্রমুখদের মাধ্যমেই ইসলাম এসেছে। যারা সবাই সুফি ছিলেন। এ কথা হেযবুত তওহীদও লিখেছে,
এই দেশে শেষ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বখতিয়ার খিলজি র: শাহজালাল র: খানজাহান আলী র: সুলতান মাহমুদ মাহী সরওয়ার র: শাহ সফি উদ্দিন র: শাহ সোলায়মান র: সৈয়দ দেওয়ান চন্দন র: এদের তরবারির জোরে। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৪০]

এখন আপনারাই বলুন, তারা সুফি-সাধকদের বিরুদ্ধে যে অপবাদ দিলো, তা কী সত্য না মিথ্যা?

সাত. অমুসলিমরাও কারামাত দেখাতে পারে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতা অমুসলিম সাধকদেরও আছে। দেখুন তারা কী বলে,
আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়া পূর্ববর্তি সমস্ত দীনেই ছিল, বিকৃত অবস্থায় আজও আছে এবং ওই পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর প্রক্রিয়ায় সাধনা করলে আজও ফল পাওয়া যায়। আজও অন্যান্য ধর্মে অতি শক্তিশালী মহাসাধকরা আছেন যাদের কেরামত অলৌকিক ক্ষমতা মুসলিম অলি-আউলিয়াদের চেয়ে কম নয়। যে কেউ নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সাধনা করলে তার ফল পাবে, তার আত্মার শক্তি বৃদ্ধি পাবে, অদৃশ্যের গায়েবের অনেক খবর তার কাছে আসবে, সাধারণ মানুষ যা পারে না তেমন কাজ করার ক্ষমতা জন্মাবে এককথায় তাসাউফের বই-কেতাবে যেসব উন্নতির কথা লেখা আছে সবই হবে। কিন্তু এগুলো শেখাতে বিশ্বনবী সা: আসেননি। [বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ২৫]

অন্য ধর্মের সাধকরাও কেরামত দেখাতে পারেন। [শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৬৯]

অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, অমুসলিমদের থেকেও কারামাত প্রকাশ পায়।

ইসলাম কী বলে?
পন্নী সাহেব ছিলেন মূলত একজর জেনারেল শিক্ষিত এবং আরবী জ্ঞান সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নিরক্ষর। যা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। [আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা : পৃ. ৫৫]

আর এ কারণেই কোনটা মু’জেযা, কোনটা কারামাত আর কোনটা ইসতিদরাজ এটা তিনি ঠাহর করতে পারেন নি। চলুন এ ব্যাপারে আগে মু’জিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজের সংজ্ঞা জেনে নেওয়া যাক।
الكرامة هو ظهور امر خارق للعادة من قبل شخص صالح لا يدعي النبوة
واذا كان الامر الخارق للعادة مقرونا بدعوى النبوة يكون معجزة واذا ظهر الامر الخارق للعادة علي يد رجل غير مؤمن و صالح فيكون استدراجا
কোনো নেককার ব্যক্তি থেকে অলৌকিকভাবে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কোনো কিছু প্রকাশ পাওয়াকে কারামাত বলে যদি নবুওয়াতের দাবি না থাকে, আর যদি এমন বিষয়ের সাথে নবওয়াতের দাবি থাকে, তাহলে সেটাকে মু’জিযা বলে। আর যদি কোনো অমুসলিম বা ফাসেক ব্যক্তি থেকে এমন বিষয় প্রকাশ পায়, তাহলে সেটাকে ইসতিদরাজ বলে। [আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : খ. ২ পৃ. ২৭৪]

সুতরাং বুঝতে পারলাম, মুমিন বা মুত্তাকী নয়; বরং কাফের অথবা প্রকাশ্য ফাসেক কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে অলৌকিকভাবে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিস্ময়কর কিছু প্রকাশ পাওয়াকে ইসতিদরাজ বলে, যা তার দাবির অনুকূলে হয়। এরূপ বিষয়কে এজন্য ইসতিদরাজ বলা হয় যে, এটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। অতএব অমুসলিমদের থেকে অলৌকিক কোনো কিছু যদি প্রকাশও পায়, তবুও সেটাকে কারামাত বলে না। অথচ পন্নীরা কাছে সেগুলোও কারামাত। হায় মূর্খতা!

কারামাত নিজের ইচ্ছেধীন?
পন্নী সাহেবের দাবি হলো, ‘আধ্যাত্মিক সাধকরা বিশেষ প্রক্রিয়ার (তরীকা) মাধ্যমে বহুদিন কঠের সাধনা কোরে আত্মার ঘষামাজা কোরে অসাধারণ শক্তি অর্জন কোরে পানির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন,ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারেন ইত্যাদী অনেক রকম অলৈকিক কাজ করেন বা করান তার নাম হোল কেরামত। [আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা : পৃ. ১৫[

অথচ কোন কারামাত বা অলৌকিক বিষয় বুজুর্গদের ইচ্ছেধীন নয়। সম্পূর্ণ আল্লাহ তাআলার ক্ষমতাধীন। কোন বুজুর্গ ইচ্ছে করে কোন কারামত প্রকাশ করতে পারেন না, বরং আল্লাহ তাআলা ইচ্ছে করলেই কেবল তা প্রকাশিত হয়।

আট. হালকায়ে জিকিরের কী কোনো ভিত্তি নেই?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, মসজিদে হালকায়ে জিকির নবীজির জামানায় ছিল বলে কোন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৬০]

ইসলাম কী বলে?
সমবেতভাবে জিকির করার প্রমাণ হাদিস শরীফে ভুরিভুরি রয়েছে। নিন্মে দু’টি হাদিস দেখুন। হযরত আবু হুরাইরাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
يَقُولُ اللهُ تَعَالَى أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلاَ ذَكَرْتُهُ فِي مَلاَ خَيْرٍ مِنْهُمْ
আল্লাহ্ ঘোষণা করেন, আমি সে রকমই, যে রকম বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সঙ্গে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে; আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি। আর যদি সে জন-সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৭৪০৫]

হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
ما من قومٍ اجتمعوا يذكرون اللهَ لا يريدون بذلك إلّا وجهَه إلّا ناداهم منادٍ من السَّماءِ أن قوموا مغفورًا لكم قد بُدِّلتْ سيِّئاتُكم حسناتٍ
কোন সম্প্রদায় যখন আল্লাহকে রাজি-খুশী করার উদ্দেশ্যে যিকরের জন্য জমায়েত হয় তখন আকাশ থেকে জনৈক ঘোষণাকারী ঘোষণা করেন যে, তোমরা সকলে (প্রভুর) ক্ষমা নিয়ে প্রত্যাবর্তন করো আর তোমাদের সকল গোনাহ নেকীতে পরিণত করে দেওয়া হয়েছে। [মুসনাদে আহমাদ : হাদিস নং : ১২৪৫৩]

এ সম্পর্কে প্রমাণ দিতে গেলে অসংখ্য দলীল দেওয়া যাবে। কিন্তু যামানার এমাম নাম দিয়ে এতো সুস্পষ্ট হাদিসগুলোও যারা জানে না, তাদের ইসলামেে ব্যাপারে কথা বলার কোনো অনুমতি আছে কী?

নয়. আত্মশুদ্ধি কী তুচ্ছ বিষয়?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা লিখেছে, ‘সংগ্রাম করে সারা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার বদলে ধর্মের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মার উন্নয়ন এবং জীবনের ব্যক্তিগত অঙ্গনের ছোটখাটো বিষয় মাসলা-মাসায়েল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করা। [ধর্ম বিশ্বাস : পৃ. ১৯]

অর্থাৎ তাদের বক্তব্যমতে আত্মশুদ্ধির বিষয়টা ছোটোখাটো।

ইসলাম কী বলে?
অথচ পবিত্র কুরআনে সাত সাতটি কসম করে মহান রব বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا
যে নিজেকে পরিশুদ্ধ (তাযকিয়া) করবে, সে অবশ্যই সফলকাম হবে। আর যে নিজেকে কলুষিত করবে, সে নিশ্চয়ই ব্যর্থ-মনোরথ হবে। [সুরা শামস : ৯-১০]

অথচ হেযবুত তওহীদের কাছে আত্মশুদ্ধির বিষয়টি একেবারেই তুচ্ছ বিষয়। জেনে রাখুন, তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নফসে আম্মারা উন্নতি হতে হতে যখন পূর্ণতা পায়, তখন সেটা নফসে মুতমায়িন্না হয়ে যায়। আর এ মুতমায়িন্না নফসটা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। এই পরিশুদ্ধ নফসের ঠিকানাই জান্নাত। এই নফসকে তাঁর মৃত্যুর সময় সু-সংবাদ দিয়ে বলা হবে,
يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً فَادْخُلِي فِي عِبَادِي وَادْخُلِي جَنَّتِي
হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি প্রশান্তচিত্তে তোমার পালনকর্তার দিকে ফিরে চলো। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো। [সূরা ফাজর : ২৭-৩০]

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে নফসকে নিবৃত্ত রাখে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত। [সূরা নাযি‘আত : ৪০-৪১]

সুতরাং চলুন আমরা সকলেই আত্মার পরিশোধনে এবং আল্লাহর আনুগত্যে নিবিষ্ট হ’তে সর্বদা সচেষ্ট থাকি।

দশ. এখন আত্মশুদ্ধির চিন্তা করা যাবে না:

তারা আরো লিখেছে, এই ঘোর সংকটমুহূর্তে স্বার্থপরের মত শুধু নিজেদের আত্মশুদ্ধি, নিজেদের পরকাল নিয়ে চিন্তা করলে হবে না। পরকালের মুক্তির শর্ত হচ্ছে দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। [মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ৭৪]

অথচ ইতপূর্বে আমরা জানতে পারলাম, আত্মশুদ্ধি ইসলামে একটি ফরজ বিধান। অথচ তারা এ বিষয় থেকে মানুষকে গাফেল করার মিশনে নেমেছে।

এগারো. আত্মশুদ্ধি আগে না জিহাদ আগে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ‘জেহাদ করার পর যদি সময় থাকে তবে তাসাউফের সাধনা করুন, কোন আপত্তি নেই। [বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৪৩]

অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, জিহাদই হলো, মূল কাজ, এই জিহাদের পরে আত্মশুদ্ধি করা যায়।

ইসলাম কী বলে?
নিজের নফস ঠিক করার আহে জিহাদ করে এক চুল পরিমাণ ফায়দা নেই, বরং নফসের ধোকায় পড়লে জিহাদ করার কারণেও মানুষ জাহান্নামে যাবে বলে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. সূত্রে বর্ণিত, তিনি বললেন,
يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَخْبِرْنِي عَنِ الْجِهَادِ وَالْغَزْوِ؟ فَقَالَ: يَا عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرٍو، إِنْ قَاتَلْتَ صَابِرًا مُحْتَسِبًا، بَعَثَكَ اللَّهُ صَابِرًا مُحْتَسِبًا، وَإِنْ قَاتَلْتَ مُرَائِيًا مُكَاثِرًا بَعَثَكَ اللَّهُ مُرَائِيًا مُكَاثِرًا، يَا عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرٍو، عَلَى أَيِّ حَالٍ قَاتَلْتَ، أَوْ قُتِلْتَ بَعَثَكَ اللَّهُ عَلَى تِلْكَ الْحَالِ
হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে জিহাদ ও যুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করুন। তিনি বলেন, হে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর! তুমি ধৈর্য ও নেকির আশায় যুদ্ধ করলে আল্লাহ তোমাকে এ দু’টি গুণে করে কিয়ামতের দিন উপস্থিত করবেন। আর যদি তুমি লোক দেখানো ও সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করো, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তোমাকে রিয়াকারী ও সম্পদলোভী করে উপস্থিত করাবেন। হে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর! তুমি যে মানসিকতা নিয়ে যুদ্ধ করবে কিংবা নিহত হবে, আল্লাহ তোমাকে উক্ত অবস্থায়ই উত্থিত করবেন। [সুনানে আবু দাউদ : হাদিস নং : ২৫১৯]

এমন আরো হাদিস রয়েছে যেগুলো থেকে বুঝা যায়, আল্লাহপাকের ওপর ভরসা না রেখে সংখ্যাধিক্যতা ও পার্থিব শক্তিবলে জিহাদ করা বা লোক দেখানো জিহাদ মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। অতএব জিহাদের আগেই আত্মশুদ্ধি জরুরি।

বারো. তাসবিহ দানা কী খ্রিস্টান ও হিন্দুদের জপমালা থেকে আবিস্কার?

হেযবুত তাওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, সাহাবায়ে কেরাম তসবিহ কি জিনিস জানতেন না, তসবিহ বহু বছর পর আধ্যাত্ত্ববাদের অনুপ্রবেশের পর খ্রিস্টানদের ও হিন্দুদের জপমালা থেকে নেওয়া হয়েছে। [শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম পৃ : ৬৯]

ইসলাম কী বলে?
তাসবিহের দানা ব্যবহার করা হয় মূলত যিকির গননা সহজ করার জন্য। উপরন্তু এই তাসবিহ দানা হাতে থাকলে যিকিরে যবান তাজা থাকে। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু এটাকে কেউ ব্যাবহার করা সুন্নাত বা ওয়াজিব বলে না। আর এই তাসবিহ দানা এসেছে মূলত রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কঙ্করদানা বা খেজুরের বিচি দিয়ে গননা করে যিকির করার ইতিহাস থেকে, হিন্দু বা খ্রিস্টানদের জপমালা থেকে নয়। চলুন এ ব্যাপারে হাদিসের সেই ইতিহাসটা আগে একটু দেখে নেওয়া যাক। উম্মুল মুমিনীন হযরত  সাফিয়্যা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
دَخَلَ عَلَىَّ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَبَيْنَ يَدَىَّ أَرْبَعَةُ آلاَفِ نَوَاةٍ أُسَبِّحُ بِهَا فَقُلْتُ لَقَدْ سَبَّحْتُ بِهَذِهِ ‏فَقَالَ أَلاَ أُعَلِّمُكِ بِأَكْثَرَ مِمَّا سَبَّحْتِ بِهِ فَقُلْتُ بَلَى عَلِّمْنِي’ ‏فَقَالَ قُولِي سُبْحَانَ اللَّهِ عَدَدَ خَلْقِهِ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকটে এলেন, তখন আমার নিকট চার হাজার খেজুরের বিচি ছিল, যা দিয়ে আমি তাসবীহ পাঠ করে থাকি। তিনি বললেনঃ তুমি কি এগুলো দিয়ে তাসবীহ গণনা করেছ? আমি কি তোমাকে এমন তাসবীহ শিখাব না যা সাওয়াবের দিক হতে এর চেয়ে বেশি হবে? আমি বললাম, হ্যাঁ আমাকে শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, তুমি বলো,
হسُبْحَانَ اللَّهِ عَدَدَ خَلْقِهِ
আল্লাহ তা’আলা তার সৃষ্টিকুলের সমপরিমাণ পবিত্র। [জামে তিরমিযি : হাদিস নং :  ৩৫৫৪]

হযরত আবু নাদরাহ রহি. সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন,
حَدَّثَنِي شَيْخٌ مِنْ طُفَاوَةَ قَالَ: تَثَوَّيْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ بِالْمَدِينَةِ فَلَمْ أَرَ رَجُلًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَشَدَّ تَشْمِيرًا، وَلَا أَقْوَمَ عَلى ضَيْفٍ مِنْهُ، فَبَيْنَمَا أَنَا عِنْدَهُ يَوْمًا، وَهُوَ عَلَى سَرِيرٍ لَهُ، وَمَعَهُ كِيسٌ فِيهِ حَصًى أَوْ نَوًى، وَأَسْفَلَ مِنْهُ جَارِيَةٌ لَهُ سَوْدَاءُ وَهُوَ يُسَبِّحُ بِهَا، حَتَّى إِذَا أَنْفَدَ مَا فِي الْكِيسِ أَلْقَاهُ إِلَيْهَا، فَجَمَعَتْهُ فَأَعَادَتْهُ فِي الْكِيسِ، فَدَفَعَتْهُ إِلَيْهِ
ত্বোফাওয়াত স্থানের এক বৃদ্ধ আমাকে বলেছেন, একদা আমি মদীনায় মেহমান হিসেবে আবু হুরায়রা রা. এর নিকট অবস্থান করি। এ সময় আমি নবি সাঃ-এর সাহাবীদের মধ্যে কাউকে তার চেয়ে অধিক ইবাদাতকারী ও নিষ্ঠাবান অতিথি পরায়ণ দেখিনি। একবার আমি তার কাছে ছিলাম, তখন তিনি খাটের উপর বসা ছিলেন। তার সাথে পাথর বা খেজুরের আঁটির একটি থলি। এ সময় খাটের নিচে মেঝের ওপর তার একটি কৃষ্ণবর্ণ দাসি বসা ছিলো। তিনি ঐ গুটিগুলো দিয়ে তাসবিহ পাঠ করতে থাকেন। থলির গুটি শেষ হলে তিনি থলিটি দাসির কাছে অর্পন করেন, আর তিনি তা ভর্তি করে পুনরায় তাঁকে প্রদান করেন। [সুনান আবু দাউদ : হাদিস নং : ২১৭৪]

হযরত আয়েশাহ বিনতে সা‘দ রা. তাঁর পিতার সুত্রে বর্ণনা করেন,
أَنَّهُ دَخَلَ مَعَ رَسُولِ اللهِ صلي الله عليه وسلم عَلَى امْرَأَةٍ وَبَيْنَ يَدَيْهَا نَوًى أَوْ حَصًى تُسَبِّحُ بِهِ فَقَالَ أُخْبِرُكِ بِمَا هُوَ أَيْسَرُ عَلَيْكِ مِنْ هَذَا أَوْ أَفْضَلُ ‏فَقَالَ سُبْحَانَ اللهِ عَدَدَ مَا خَلَقَ فِي السَّمَاءِ وَسُبْحَانَ اللهِ عَدَدَ مَا خَلَقَ فِي الأَرْضِ وَسُبْحَانَ اللهِ عَدَدَ مَا خَلَقَ بَيْنَ ذَلِكَ وَسُبْحَانَ اللهِ عَدَدَ مَا هُوَ خَالِقٌ وَاللهُ أَكْبَرُ مِثْلُ ذَلِكَ وَالْحَمْدُ للهِ مِثْلُ ذَلِكَ وَلَا إِلَهَ إِلَا اللهُ مِثْلُ ذَلِكَ ‏وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَا بِاللهِ مِثْلُ ذَلِكَ
একদা তিনি রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর সাথে এক মহিলার কাছে গিয়ে তার সম্মুখে খেজুর বিচি অথবা কংকর দেখতে পেলেন। মহিলাটি ওগুলোর সাহায্যে তাসবীহ পাঠ করছিলো। নবি সাঃ বললেন, আমি কী তোমাকে এর চাইতে অধিক সহজ ও উত্তম পদ্ধতি জানাবো না! আকাশের সমস্ত সৃষ্টির সংখ্যা পরিমাণ সুবহানাল্লাহ এবং যমীনের সমস্ত সৃষ্টির সংখ্যা পরিমাণ সুবহানাল্লাহ। আকাশ ও যমিনের মাঝে যা কিছু রয়েছে সে পরিমাণ সুবহানাল্লাহ এবং অনুরূপ সংখ্যক আল্লাহু আকবার, আলহামদু লিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। [সুনান আবু দাউদ :  হাদিস নং : ১৫০০]

ইবন নুজাইম আল হানাফি রহি. বলেন,
فلم ينهها عن ذلك وإنما أرشدها إلى هو أيسر وأفضل ولو كان مكروها لبين لها ذلك ، ثم هذا الحديث ونحوه مما يشهد بأنه لا بأس باتخاذ السبحة المعروفة لإحصاء عدد الأذكار
রাসুলুল্লাহ সাঃ উক্ত মহিলাকে নিষেধ করেন নি। তিনি কেবল এর চেয়ে উত্তম ও সহজটা বলে দিয়েছেন। যদি এটি নিষিদ্ধ হতো, তাহলে তিনি বলে দিতেন। অতপর এই হাদিস ও অনুরূপ আরো হাদিস একথার দলিল যে, জিকিরের গণনার জন্য প্রচলিত তাসবিহ-দানা ব্যবহারে কোনো অসুবিধা নেই। [রদ্দুল মুহতার : খ. ২ পৃ. ৪২১]

আল্লামা মানাবি রহি. বলেন
لم ينقل عن أحد من السلف ولا الخلف كراهتها
পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কোনো ফকিহ একে মাকরুহ বলেননি।  [ফয়যুল কাদির : খ: ৪ পৃ: ৩৫৫]

সুতরাং বুঝতে পারলাম, তাসহিব দানা কোনো নাজায়েয বিষয় নয়। কিন্তু মানুষকে যিকির-আযকার থেকে দূরে রাখতে তাসবিহ দানা থেকে জাতিকে আলাদা করার ষড়যন্ত্রই করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ।

তেরো. আত্মশুদ্ধি কী খ্রিষ্টানদের আবিস্কার?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, খ্রিষ্টানরা মানুষকে তসবিহ ধরিয়ে হুজরায় বসিয়ে গোলামির জিঞ্জির পরিয়ে দিয়েছে। দেখুন তারা কী লিখেছে,
আধ্যাতিক ঘষামাজা খ্রিষ্টানদের শেখানো। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ১১২]

বিকৃত এসলামে নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত আত্মার পরিচ্ছন্নতার জন্য নানারকম ঘষামাজা আধ্যাত্মিক উন্নতির উপর গুরুত্ব প্রাধান্য দেওয়া হলো। কারণ এরা ঐ এবাদত উপাসনা নিয়ে যত বেশি ব্যস্ত থাকবে ব্রিটিশরা তত নিরাপদ থাকবে। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ১১২ ]

ইসলাম কী বলে?
আগেই আয়াত ও হাদিস থেকে প্রমাণ দিয়েছি যে, তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি আল্লাহপাক ও তাঁর রাসুল সাঃ-এর আবিস্কৃত নির্দেশনা। এটা ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে সবচে বড় শক্তিও বটে। আর এ আত্মাধিক পরিচর্যা করা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ এটা ইসলাম বিদ্বেষীরা ভালোভাবেই জানে। এজন্য ভারতের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ ভারতের প্রথম শিক্ষা প্রবর্তক টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলে ১৮১৩ সালে এক ধ্বংসাত্মক শিক্ষানীতি তৈরি করেন। যা ভারতের দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংস ডেকে এনেছিল। [উইকিপিডিয়া]

এই ম্যাকলে ভারতের মূল মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে আরেকটি প্রস্তাব করেন, তা হলো, আধ্যাত্মিত ও সংস্কৃতিবান মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলা। এটা শুধু আমি নই হেযবুত তওহীদও জানে। চলুন তাদের বই থেকে আগে প্রমাণ দেখা যাক। তারা লিখেছে,
ভারতকে পদানত করার জন্য যে বিষয়টি লর্ড ম্যাকেল লিখেছিল।তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এটা যে তাদের আধ্যাত্মিক ও সংস্কৃতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেলা। [গণমাধ্যমের করনীয় : পৃ. ৩৫]

প্রিয় পাঠক, এখন আপনারাই বলুন, আত্মাধিকতা কী খ্রিষ্টানদের তৈরি নাকি এই আধ্যাতিকতা বিনষ্ট করা তাদের মিশন ছিলো? নিশ্চয় আধ্যাতিকতা বিনষ্ট করাই তাদের লক্ষ ছিলো। তাহলে হেযবুত তওহীদ কিভাকে দাবি করলো যে, আধ্যাতিক ঘষামাজা খ্রিষ্টানদের তৈরি। সম্পূর্ণ উল্টো দাবি কিভাবে একজন সুস্থ মানুষ করতে পারে? বরং এটাই বুঝা যাচ্ছে, খ্রিষ্টানরা যে আধ্যাতিকতা নষ্ট করার মিশনে নেমেছিলো, সেই একই মিশনে নেমেছে হেযবুত তওহীদ। তাহলে আমরা কি এটা বুঝবো না যে, এরা সেই খ্রিষ্টানদের পা চাটা গোলাম এবং চামচা? মহান আল্লাহ আমাদের হেযবুত তওহীদের ষড়যন্ত্র থেকে হিফাযত করেন। আমীন!

জান্নাতে যেতে শুধু ঈমান কী যথেষ্ট: আমল নয়।
আল্লাহপাকের প্রতি বিশ্বাস তথা তাওহীদে ঈমান আনয়ণ করা ইমলামের প্রথম কাজ। কিন্তু তাওহীদে ঈমান আনলেই যথেষ্ট হবে বিষয়টা ভুল। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এ কথাটাই দাবি করছে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ‘যদি প্রশ্ন করা হয় জাহান্নামের কোন প্রকারের আজাবের স্পর্শ ব্যতিরেকে একজন মানুষ খুব সহজেই জান্নাতে যাবে কি করে? এর উত্তর হবে একমাত্র তাওহীদ গ্রহণের মাধ্যমে। [প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৬৪]

অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, শুধু আল্লাহপাকের প্রতি ঈমান আনলেই জান্নাতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।

ইসলাম কী বলে?
তাওহীদে বিশ্বাস থাকলেই জান্নাত নিশ্চিত’ কথাটা সঠিক নয়, বরং আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমানের পাশাপাশি তাঁর নবী-রাসুলগণ, কুরআনে কারীমসহ সকল আসামানী কিতাবসমূহ, ফিরিস্তাকুল, আখেরাত, তাকদীর ইত্যাদি বিষয়ের উপর ঈমান রাখা জরুরী। যা পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে এসেছে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ آمِنُواْ بِاللّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِيَ أَنزَلَ مِن قَبْلُ وَمَن يَكْفُرْ بِاللّهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً بَعِيدًا
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন কর এবং বিশ্বাস স্থাপন কর তাঁর রসূলও তাঁর কিতাবের উপর, যা তিনি নাযিল করেছেন স্বীয় রসূলের উপর এবং সেসমস্ত কিতাবের উপর, যেগুলো নাযিল করা হয়েছিল ইতিপূর্বে। যে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের উপর, তাঁর কিতাব সমূহের উপর এবং রসূলগণের উপর ও কিয়ামতদিনের উপর বিশ্বাস করবে না, সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহু দূরে গিয়ে পড়বে। [সুরা নিসা : ১৩৬]

এ আয়াত থেকে জানা গেলো, আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের উপর, তাঁর কিতাব সমূহের উপর এবং রসূলগণের উপর ও কিয়ামতদিনের উপর বিশ্বাস করতে হবে।

রিসালাতের ওপর ঈমান আনা : মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাঃ দুনিয়াতে আগমন করার পর তাঁর উপর ঈমান আনয়ন ও অনুসরণ করাও বাধ্যতামূলক। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি অবস্থা ব্যক্তকারীরূপে, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীরূপে। যাতে তোমরা আল্লাহ ও রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তাঁকে সাহায্য ও সম্মান কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা কর। -সুরা ফাতহ, আয়াত : ৮-৯

এ আয়াতেও নবীজি সা. এর উপর ঈমান আনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উপরন্তু সাহাবাদের রা. মতো ঈমার আনার নির্দেশ খোদ আল্লাহপাকই দিয়েছেন,
آمِنُواْ كَمَا آمَنَ النَّاسُ
অন্যান্যরা (সাহাবায়ে কেরাম রা.) যেভাবে ঈমান এনেছে, তোমরাও সেভাবে ঈমান আনো। [সুরা বাকারা : ১৩]

প্রিয় পাঠক,!এখানে ভেবে দেখুন, সাহাবায়ে কেরাম রা. যে ঈমান এনেছিলেন সেটা কেমন ঈমান ছিলো? শুধু তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন? নাকি নবিজি সাঃ-এর উপরও ঈমান এনেছিলেন? নিশ্চয় রিসালাতের উপরও তাদের পূর্ণাঙ্গ ঈমান ছিলো। সুতরাং প্রকৃত মুমিন হতে গেলে নবিজি সাঃ-এর উপরও ঈমান আনতে হবে।

কুরআন মাজীদকেও মানা: আল্লাহপাক ও তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ সাঃ কে বিশ্বাস করার পাশাপাশি কুরআন শরীফের বিধিবিধানও মানতে হবে, নইলে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ বলেন,
وَاتَّبِعْ مَا يُوحَى إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়, আপনি তার অনুসরণ করুন। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন। [সুরা আহযাব : ২]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللّهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَيَقْتُلُونَ الِّذِينَ يَأْمُرُونَ بِالْقِسْطِ مِنَ النَّاسِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ أُولَـئِكَ الَّذِينَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَا لَهُم مِّن نَّاصِرِينَ
যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে এবং পয়গম্বরগণকে হত্যা করে অন্যায়ভাবে, আর সেসব লোককে হত্যা করে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। এরাই হলো সে লোক যাদের সমগ্র আমল দুনিয়া ও আখেরাত উভয়লোকেই বিনষ্ট হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই। [সুরা আলে ইমরান : ২১-২২]

সুতরাং বুঝা গেলো, শুধু তাওহীদে বিশ্বাস থাকলেই জান্নাত কনফার্ম নয়, বরং কুরআনের উপরও ঈমান আনা ও মান্য করা বাধ্যতামূলক।

মুহাম্মাদ সাঃ কে মানা : শুধু তাওহীদে ঈমান আনলেই যথেষ্ট নয়, বরং রাসুলুল্লাহ সাঃ কে অনুসরণ ও আনুগত্যের বিষয়টিও ফরজ করা হয়েছে। নিন্মে কয়েকটি আয়াতে কারীমা পেশ করছি। মহান রব বলেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا
রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক। [সূরা হাশর : ৭]

قُلْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ فإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ
বলুন, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য প্রকাশ কর। বস্তুতঃ যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদিগকে ভালবাসেন না। [সুরা আলে ইমরান : ৩২]

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। [সুরা আলে ইমরান : ৩১]

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। [সূরা আহযাব : ২১]

এ আয়াতগুলোতে রাসুলুল্লাহ সাঃ কে অনুসরণ করার কথা জোর তাকীদ দিয়ে বলা হয়েছে। পাশাপাশি হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন, সাঃ বলেছেন,
تركتُ فيكم أمريْنِ لن تَضِلُّوا ما تمسكتم بهما كتابَ اللهِ وسُنَّةَ رسولِهِ
আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিষ রেখে যাচ্ছি, সে দুটি জিনিস তোমরা আঁকড়ে ধরলে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না, (এক) কিতাবুল্লাহ (দুই) এবং তাঁর রাসূলের সা. সুন্নাত। [আত তামহীদ : খ. ২৪ পৃ.৩৩১]

সুতরাং উপরিউক্ত আয়াত ও হাদিসগগুলো থেকে বুঝা গেলো, শুধু আল্লাহর ওপর ঈমান থাকা যথেষ্ট নয়, বরং পবিত্র কুরআনে বিশ্বাস ও মান্য করা এবং পাশাপাশি নবিজি সাঃ-এর রিসালাতের ওপর ঈমান আনা এবং মান্য করাও জরুরী।

সাহাবায়ে কেরাম রা. মানা : জান্নাতে যেতে হলে শুধু আল্লাহ এবং রাসুল সা. কে মানলেই যথেষ্ট নয়, বরং সাহাবায়ে কেরামকেও মানতে হবে। মহান রব বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর অনুগত হও এবং রসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের মধ্যকার কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের। [সূরা নিসা : ৫৯]

উক্ত আয়াতের তাফসীরে বিশিষ্ট তাবেয়ী মুজাহিদ রহ. বলেন,
كان مجاهد يقول أصحاب محمد
অর্থাৎ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ তথা কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ বলতে নবিজি সাঃ-এর সাহাবায়ে কেরামকে বুঝানো হয়েছে। [তাফসীরে তাবারী : খ. ৮ পৃ. ৫০১]

বিষয়টি হাদিস শরীফে আরও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নবিজি সাঃ বলেন,
إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي
বনী ইসরাঈল যে অবস্থায় পতিত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে আমার উম্মাতও সেই অবস্থার সম্মুখীন হবে, যেমন একজোড়া জুতার একটি আরেকটির মতো হয়ে থাকে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ যদি প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করে থাকে, তবে আমার উন্মাতের মধ্যেও কেউ তাই করবে। আর বনী ইসরাঈল ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আমার উন্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া তাদের সবাই জাহান্নামী হবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে দল কোনটি? তিনি বললেনঃ আমি ও আমার সাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত। [জামে তিরমিযি : ২৬৪১]

বুঝা গেলো, জান্নাতে যেতে শুধু তাওহীদে বিশ্বাস করলেই হবে না, বরং সাহাবায়ে কেরামকেও রা. মানতে হবে।

আলেমদেরকেও মানা : হযরত মুজাহিদ রহ. এরও আরেকটি অভিমত এবং বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত আতা রহ. বলেন,
عن عطاء وأولي الأمر منكم قال الفقهاء والعلماء
অর্থাৎ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ তথা কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ বলতে ফুকাহায়ে কেরাম ও উলামায়ে কেরামকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। [তাফসীরে তাবারী ; খ. ৮ পৃ. ৫০১]

যাহোক, উক্ত আয়াতে ঈমানদারদেরকে ঈমান আনার পর যথেষ্ট মনে করা হয়নি, বরং আল্লাহ তাআলা নিজে তাঁকে এবং তাঁর রাসুল এবং সাহাবায়ে কেরাম রা. বা ফুকাহায়ে কেরাম ও উলামায়ে কেরামকেও মানতে বলা হয়েছে। সুতরাং বুঝা গেলো, শুধু তাওহীদের ঈমান আনয়ন করাই জান্নাতে য্ওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, বরং আল্লাহ তাআলা, তাঁর রাসুল, সাহাবায়ে কেরাম রা. ও আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা’আতের যোগ্য উলামায়ে কেরামের কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক আদেশ-নিষেধ মানতে হবে। এক কথায় পূর্ণাঙ্গভাবে মুসলমান হতে হবে। মহান রব বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ ادْخُلُواْ فِي السِّلْمِ كَآفَّةً وَلاَ تَتَّبِعُواْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
হে ঈমানদার গন! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চিত রূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। [সূরা বাকারা : ২০৮]

প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেলো, শুধু তাওহীদের উপর ঈমান আনলে জান্নাতে যাওয়া যাবে না, বরং ইসলামের পুর্ণ কনসেপ্ট মানতে হবে। যেমন তাওহীদ, রিসালাত, আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. আসমানী সকল কিতাব, আখেরাত, তাকদীর ইত্যাদীর উপর ঈমান না আনলে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। উপরন্তু আল্লাহপাক, তাঁর রাসুল, সাহাবায়ে কেরাম ও উলামায়ে কেরামকেও মানতে হবে।

এ কথার পেছনে আসল রহস্য কী?
এখানে মূলত তারা সুক্ষ্মভাবে আন্তঃধর্মীয় মতবাদ অর্থাৎ সকল ধর্ম সমান এ বিষয়টি বাস্তবায়ণ করার হীন ষড়যন্ত্রের ছক একেছে। মূলত এ কথাটি দিয়ে তারা নবীজির সা. রিসালাত তথা আখেরী নবী মুহাম্মাদ সা. কে মেনে নেওয়ার বিষয়টি বাদ দিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো, তাওহীদে বিশ্বাস থাকলেই জান্নাত কনফার্ম। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, শুধু আল্লাহর উপর ঈমান থাকলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে, নবীজির সা. রিসালাতের উপর ঈমানের প্রয়োজন নেই। এমনকি ইসলাম ও ঈমানের অন্য কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। আর এজন্যই দেখা যায়, তাদের সদস্যদের মধ্যে আমলের প্রতি কোনো মনোনিবেশ নেই। নিন্মোক্ত পর্বটি পড়লে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। ইনশাআল্লাহ।

জান্নাতে যেতে আমল কী শর্ত নয়?
প্রিয় পাঠক! এ কথাটি সুস্পষ্ট যে, ইসলামের মূল বিষয় হলো ঈমান। অর্থাৎ তাওহীদ, রিসালাত, আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. আসমানী সকল কিতাব, আখেরাত, তাকদীর ইত্যাদীর উপর ঈমান আনা।  ইসলামের পুরো কনসেপ্টের ভেতর কোনো একটি অস্বীকার করলে, তার ঈমান থাকে না। জানার বিষয় হলো- শুধু এ তওহীদে বিস্বাস থাকলেই কি জান্নাতে যাওয়া যাবে? নাকি  আমলও করতে হবে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
কুফরী সংগঠন হেযবুত তাওহীদের দাবি হলো, শুধু তাওহীদে বিশ্বাস থাকলেই জান্নাত নিশ্চিত, আমলের প্রয়োজন নেই। চলুন তাদের দাবিগুলো দেখা যাক। তারা লিখেছে,
বিশ্বনবী এ কথাটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন এই বলে যে, আল্লাহর সাথে তাঁর বান্দার চুক্তি (Contract) এই যে, বান্দা তাঁর পক্ষ থেকে যদি এই শর্ত পালন করে যে, সে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহ অর্থাৎ বিধাতা বলে স্বীকার করবে না-তবে আল্লাহও তাঁর পক্ষ থেকে শর্ত পালন করবেন যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। [হাদিস-মুয়াজ (রা.) থেকে বোখারী, মুসলিম, মেশকাত]। এখানে অন্য কোন কাজের (আমলের) শর্ত নেই’। -আকিদা : পৃ. ৭

আল্লাহ ঘোষণা দিয়ে দিলেন- আমার তাওহীদকে, আমার সার্বভৌমত্বকে যে বা যারা স্বীকার কোরে নেবে, তা থেকে বিচ্যুত হবে না তারা কত এবাদত কোরেছে, তারা কত গোনাহ কোরেছে, কিছুই আমি দেখবো না, তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবো, তারা ব্যভিচার ও চুরি করলেও। -দাজ্জাল : পৃ. ১৫

শত নির্যাতন নিপীড়ন বিদ্রূপ অপমান উপেক্ষা করে, খেয়ে না খেয়ে, গাছের লতা-পাতা খেয়ে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। এই সময় যেসব সাহাবী ইন্তেকাল করেন তারা ইসলাম বলতে কি পেয়েছিলেন? তার নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত ঈদ কোরবানি কিছুই পেয়েছিলেন কি? তারা পেয়েছেন শুধুমাত্র তাওহীদ এবং বলার অপেক্ষা রাখেনা তাওহীদই তাদের সফলকাম হয়ে জান্নাতে প্রবেশের জন্য যথেষ্ট ছিল’। *তওহীদ জান্নাতের চাবি : পৃ. ১০

অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, শুধু ঈমান আনলেই চলবে, আমলের প্রয়োজন নেই।

ইসলাম কী বলে?
মনে রাখতে হবে, ‘শুধু আল্লাহ তা’আলার উপর ঈমান আনলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে’ এ কথা পবিত্র কুরআন ও হাদিস বিরোধী কথা। কারণ মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন শরিফে এবং নবিজি সাঃ পবিত্র হাদিসে যেখানেই ঈমানের কথা বলেছেন, সাথে সাথে আমলের কথাও বলেছেন। সুতরাং আমলকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা বা ‘আমল না করলেও জান্নাতে যাবে’ এমন দাবী করা প্রকাশ্য কুফরী। জান্নাতে যাওয়ার জন্য যে ঈমানের সাথে আমলও যে শর্ত, এর কয়েকটি আয়াত এখানে উল্লেখ্য করা হলো। মহান রব বলেন,
وَبَشِّرِ الَّذِين آمَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الأَنْهَارُ
আর হে নবী, সা. যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজসমূহ করেছে, আপনি তাদেরকে এমন বেহেশতের সুসংবাদ দিন। [সুরা বাকারা : ২৫]

وَالَّذِينَ آمَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّالِحَاتِ أُولَـئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তারাই জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে। [সুরা বাকারা : ৮২]

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ
নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকাজ করেছে, নামায প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং যাকাত দান করেছে, তাদের জন্যে তাদের পুরষ্কার তাদের পালনকর্তার কছে রয়েছে। তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। [সুরা বাকারা : ২৭৭]

وَالْعَصْرِ إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
কসম যুগের (সময়ের), নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের। [সুরা আছর : ১-৩]

এ সম্পর্কে আরও প্রমাণ চাইলে দেখুন,
সুরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৫৭ সুরা নিসা: ৫৭/১২২/১৭৩ সুরা মায়িদা, আয়াত: ৯/৯৩ সুরা আ’রাফ, আয়াত: ৪২ সুরা ইউনুস, আয়াত: ৪/৯ সুরা হুদ, আয়াত: ২৩ সুরা রা’দ, আয়াত: ২৩ সুরা ইবরাহীম, আয়াত: ২৩ সুরা কাহাফ, আয়াত: ৩০/১০৭ সুরা ইারাহীম, আয়াত: ৯৬ সুরা হাজ্জ্ব, আয়াত: ১৪/২৩/৫০/৫৬ সুরা শুআরা, আয়াত: ২২৭ সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৭/৯/৫৮ সুরা রুম, আয়াত: ১৫/৪৫ সুরা লোকমান, আয়াত: ৮ সুরা আলিফ লাম মিম সিজদা, , আয়াত: ১৯ সুরা সাবা, আয়াত: ৪ সুরা ফাতির, আয়াত: ৭ সুরা ছোয়াদ, আয়াত: ২৪/২৮ সুরা মুমিন, আয়াত: ৫৮ সুরা হা-মি-ম সিজদা, আয়াত: ৮ সুরা শু’রা, আয়াত: ২২/২৩/২৬ সুরা জাসিয়া, আয়াত: ২১/৩০ সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ২/১২ সুরা ফাত্হ, আয়াত: ২৯ সুরা ত্বলাক, আয়াত: ১১ সুরা ইনশিক্বাক, আয়াত: ২৫ সুরা বুরূজ, আয়াত: ১১ সুরা ত্বীন, আয়াত: ৬ সুরা বায়্যিনাহ, আয়াত: ৭

প্রিয় দ্বীনি ভাই, উক্ত আয়াতগুলো থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, জান্নাতে যাওয়ার জন্য আমল বাধ্যতামূলক। আমল ছাড়া যদি জান্নাতে যাওয়া যেতো, তাহলে মহান আল্লাহ ঈমানের সাথে সাথেই (حرف عطف (واو অর্থাৎ ‘এবং’ শব্দ দিয়ে আমলকেও শর্তযুক্ত করতেন না। যদি او তথা ‘অথবা’ শব্দ ব্যবহার করতেন, তাহলে বুঝা যেতো শুধু ঈমান হলেও চলবে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা (حرف عطف (واو অর্থাৎ ‘এবং’ শব্দ দিয়ে আমলকেও শর্তযুক্ত করে এটাই বুঝালেন যে, আমল ছাড়া শুধু ঈমান দিয়ে জান্নাত নিশ্চিত করা যাবে না। জান্নাত নিশ্চিত করতে আমলও লাগবে।

মাক্কী জীবনে নবিজি সাঃ কী কোনো আমলের দাওয়াত দেন নি?
নবিজি সাঃ আজীবন সাহাবায়ে কেরাম রা. কে আমলের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন হাতে কলমে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা মানুষকে আমল থেকে বঞ্চিত রাখার লক্ষ্যে খোদ নবিজি সাঃ-এর উপরেও এক চরম মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে। তাদের দাবি হলো, নবিজি সাঃ কোন আমলের দাওয়াত দেন নি। দেখুন তারা কী লিখেছে,

নবীজি কোন আমলের দাওয়াত দেন নি। [প্রিয় দেশবাস : পৃ. ৬৬]

রাসুলুল্লাহ নবুয়াতী জীবনে ২৩ বছরের ১৩ বছর কেটেছে তাওহীদের ডাক দিয়ে। প্রথমে তিনি কোন আমলের দাবিই করেন নি। [প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৬৫]

ইসলাম কী বলে?
এ বিষয়ে জানার আগে প্রথমে জানতে হবে আমল কী? এটা তাদের বই থেকেই দেখে নেওয়া যাক। তারা লিখেছেন, ‘ইসলামের আমল কি? অবশ্যই নামায, যাকাত হজ্ব,রোজা ইত্যাদি, আরও বহুবিধ ফরজ ওয়াজিব সুন্নত নফল ইত্যাদি’। -তাকওয়া ও হেদায়াহ, পৃ. ৯

সুতরাং তাদের কথা থেকেই বুঝা গেলো, ইসলামের আমল বলতে নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাতসহ সকল ফরজ ও সুন্নাহসমূহকে আমল বলে। এই আমলগুলো রাসুলাল্লাহ সাঃ সাহাবায়ে কেরামকে রা. হাতেনাতে সমস্ত আমল শিখিয়েছেন। এমনকি বাথরুমে কিভাবে যেতে হবে, কিভাবে পানাহার করতে হবে, কাপড়-চোপড় কিভাবে পরিধান করতে হবে সেগুলো পর্যন্ত তিনি সাহাবায়ে কেরামকে রা. শিখিয়েছেন। যার প্রমাণ হাদিসের গ্রন্থসমূহে ভরপুর রয়েছে। এখানে ইসলামের ৫ টি স্তম্ভ সংক্রান্ত প্রশিদ্ধ সেই হাদিসটির দিকে খেয়াল করুন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসুলে কারিম সাঃ ইরশাদ করেছেন,
بُنِيَ الإسْلامُ على خَمْسٍ،شَهادَةِ أنْ لا إلَهَ إلّا اللَّهُ وأنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ ورَسولُهُ وإقامِ الصَّلاةِ وإيتاءِ الزَّكاةِ وحَجِّ البَيْتِ وصَوْمِ رَمَضانَ
ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তথা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ তথা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার রাসুল—এই কথার সাক্ষ্য প্রদান করা। নামায কায়েম করা। যাকাত দেয়া, হজ পালন করা এবং রমাযান মাসের রোযা রাখা। [সহিহ বুখারি : হাদিস নং : ৮]

এই হাদিসের দিকে গভীর মনোযোগ দিলে বুঝতে পারবেন যে, হাদিসে বর্ণিত ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির মাত্র ১টি হলো ‘তাওহিদ’, বাকি চারটি হলো ইবাদত বা আমল সংক্রান্ত। সুতরাং যদি শুধু তাওহীদের স্বীকৃতিদানের দ্বারাই মানুষ জান্নাতে যেতে পারতো, তবে আমল সংক্রান্ত চার চারটি ইবাদত ইসলামের ভিত্তি হতো না। উপরন্তু আরেকটি হাদিসের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। হযরত জাবের রা: থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাঃ বলেন,
بين العَبْدِ وبين الكُفْرِ تَرْكُ الصَّلاةِ
যে ঈমানদার এবং কাফেরদের মধ্যে পার্থক্যকারী আমল হল নামায। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ৪৬৭৮]

হযরত উমার রা. আরও কঠিন ভাষায় বলেন,
لقد هممتُ أن أبعثَ رجالًا إلى هذِهِ الأمصارِ فلينظُروا كلَّ من كان له جِدَةٌ ولم يَحُجَّ فيضربوا عليهِمُ الجزيَةَ ما هم بِمسلِمينَ ما هم بِمسلِمينَ
আমার ইচ্ছে হয়, বিভিন্ন শহরে আমি লোক পাঠাই, তারা যেন দেখে সামর্থ্যবান হওয়ার পরেও কে হজ্ব করেনি, তাকের উপর যেন তারা জিযিয়া আরোপ করে দেয়। কারণ, তারা মুসলিম নয়, তারা মুসলিম নয়’। [দুররে মানসুর : খ. ৩ পৃ. ৬৯৩]

এ হাদিস দুটিতে ঈমান এবং কুফরীর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী বিষয় হিসাবে নামাজ এবং হজ্বকে উল্লেখ্য করা হয়েছে। আর নামাজ ও হজ্ব যে আমল এটা তো তারাই লিখেছে। সুতরাং উপরিউক্ত আয়াত-হাদিসগুলো দিয়ে আমরা বুঝতে পারলাম যে, গতানুগতিক শুধু তাওহীদের স্বীকৃতি দিলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে না, বরং আমলও করতে হবে।

মাক্কী জিবনে আমলের দাওয়াত দেন নি?
তাদের দাবি হলো, মাক্কী জিবনের প্রথম ১৩ বছর তিনি আমলের দাওয়াত দেন নি। অথচ নামাজের আইন চালু হয়েছিলো মক্কায় থাকাকালীন সময়ে। এটা সবাই জানেন যে, মি’রাজের রাতেই নামাজ ফরজ করা হয়েছিলো। যার প্রমাণ সহিহ মুসলিমের মি’রাজের লম্বা হাদিস, নবিজি সাঃ বলেন
فَلَمْ أَزَلْ أَرْجِعُ بَيْنَ رَبِّي تَبَارَكَ وَتَعَالَى وَبَيْنَ مُوسَى عَلَيْهِ السَّلاَمُ حَتَّى قَالَ يَا مُحَمَّدُ إِنَّهُنَّ خَمْسُ صَلَوَاتٍ كُلَّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ
এভাবে আমি একবার মূসা আ. ও একবার আল্লাহর মাঝে আসা-যাওয়া করতে থাকলাম। শেষে আল্লাহ তাআলা বললেন, হে মুহাম্মাদ! যাও দিন ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নির্ধারণ করা হল। সূত্র: সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬২

সুতরাং বুঝা গেলো, নামাজের আইন এসেছিলো মি’রাজের রাতে। আর মি’রাজ হিজরতের আগেই যে সংগঠিত হয়েছিলো, এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।  সুতরাং নবিজি সাঃ আমল শিখান নি বলে যে দাবি হেযবুত তওহীদ করেছে, এটা কি নবিজির সা. নামে চরম মিথ্যাচার নয়? আর এ সকল মিথ্যুকদের ব্যাপারে হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত যে, নবিজি সাঃ বলেছেন,
مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যা আরোপ করে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৩৪৬১]

আমল না করলে জাহান্নামে যাবে:
প্রিয় পাঠক! আমল না করার ফলে যে মানুষ জাহান্নামে যাবে এর দু’টি আয়াত আগে দেখুন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَهُمْ يَصْطَرِخُونَ فِيهَا رَبَّنَا أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُم مَّا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَن تَذَكَّرَ وَجَاءكُمُ النَّذِيرُ فَذُوقُوا فَمَا لِلظَّالِمِينَ مِن نَّصِيرٍ
সেখানে তারা (জাহান্নামীরা) আর্ত চিৎকার করে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, বের করুন আমাদেরকে, আমরা সৎকাজ করব, পূর্বে যা করতাম, তা করব না। (আল্লাহ বলবেন) আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি, যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। অতএব আস্বাদন কর। জালেমদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই। [সুরা ফাত্বির : ৩৭]

هَلْ يَنظُرُونَ إِلاَّ تَأْوِيلَهُ يَوْمَ يَأْتِي تَأْوِيلُهُ يَقُولُ الَّذِينَ نَسُوهُ مِن قَبْلُ قَدْ جَاءتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ فَهَل لَّنَا مِن شُفَعَاء فَيَشْفَعُواْ لَنَا أَوْ نُرَدُّ فَنَعْمَلَ غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ قَدْ خَسِرُواْ أَنفُسَهُمْ وَضَلَّ عَنْهُم مَّا كَانُواْ يَفْتَرُونَ
তারা কি এখন এ অপেক্ষায়ই আছে যে, এর বিষয়বস্তু প্রকাশিত হোক? যেদিন এর বিষয়বস্তু প্রকাশিত হবে, সেদিন পূর্বে যারা একে ভূলে গিয়েছিল, তারা বলবেঃ বাস্তবিকই আমাদের প্রতিপালকের পয়গম্বরগণ সত্যসহ আগমন করেছিলেন। অতএব, আমাদের জন্যে কোন সুপারিশকারী আছে কি যে, সুপারিশ করবে অথবা আমাদেরকে পুনঃ প্রেরণ করা হলে আমরা পূর্বে যা করতাম তার বিপরীত কাজ করে আসতাম। নিশ্চয় তারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তারা মনগড়া যা বলত, তা উধাও হয়ে যাবে। [সুরা আ’রাফ : ৫৩]

উপরোক্ত দু’টি আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, জাহান্নামে যারা যাবে, তারা চিৎকার দিয়ে বলবে, হে রব, আমাদেরকে এ জাহান্নাম থেকে বের করুন, আমল করার জন্য আরেকবার সুযোগ দিন। তাহলে এর দ্বারা বুঝা যায় যে, জাহান্নামীরা কিয়ামতে বুঝবে যে, আমল না করার কারণেই তারা জাহান্নামে গেছে। এটা তো পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণীত মহাসত্য। আরও স্পষ্টরুপে অন্য আয়াতে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে যে, জাহান্নামীদেরকে যখন জিজ্ঞাসা করা হবে,
مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّين
তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নীত করেছে? তারা বলবে, আমরা নামায পড়তাম না। অভাবগ্রস্তকে আহার্য্য দিতাম না। আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করতাম এবং আমরা প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করতাম। [সুরা মুদ্দাসসির : ৪২-৪৩]

উপরন্তু যারা যাকাত দেয়না, তারাও জাহান্নামী। মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِنَّ كَثِيرًا مِّنَ الأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللّهِ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَ يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَـذَا مَا كَنَزْتُمْ لأَنفُسِكُمْ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمْ تَكْنِزُونَ
হে ঈমানদারগণ! পন্ডিত ও সংসারবিরাগীদের অনেকে লোকদের মালামাল অন্যায়ভাবে ভোগ করে চলছে এবং আল্লাহর পথ থেকে লোকদের নিবৃত রাখছে। আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার। [সুরা তাওবা  : ৩৪-৩৫]

নবিজি সাঃ-এর সুন্নাত না মানলেও জাহান্নামী:
হযরত আবূ হুরাইরাহ রা. হতে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلاَّ مَنْ أَبَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى
আমার সকল উম্মাতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করবে। তারা বললেন, কে অস্বীকার করবে। তিনি বললেনঃ যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সে-ই অস্বীকার করবে। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৭২৮০

প্রিয় পাঠক, এভাবে করে ইসলামের প্রত্যেকটি বিষয় প্রমাণ আনলে কিতাবটি অনেক দীর্ঘ হতে পারে। এজন্য আমল ছাড়ার পরিনাম যে জাহান্নাম, এটা প্রমাণ করতে শুধু কয়েকটি উদহরণ পেশ করলাম। এখন আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন, ‘শুধু ঈমান থাকলেই কি জান্নাতে যাওয়া যাবে? নিশ্চয় না। আমলও আবশ্যম্ভাবি। তবে আল্লাহ যদি কারো উপর বিশেষ রহম করেন, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু ইসলামের চুড়ান্ত বিধান হলো, জান্নাতে যেতে গেলে অবশ্যই আমলও লাগবে।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক আমলে কী জান্নাত নেই?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবী হলো, সকল আমল হতে হবে জাতিগত। ব্যক্তিকেন্দ্রিক আমলে জান্নাত নেই। তারা লিখেছে,
সমাজের অশান্তি দূর করার জন্য প্রচেষ্টা না করে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আমল করলে, এই স্বার্থপরতা আত্মকেন্দ্রিক ভালো মানুষের কোন জান্নাত নেই। -তাকওয়া ও হেদায়া : পৃ. ১০-১১

কাজেই আল্লাহর তওহীদ, সার্বভৌমত্ব যেখানে নেই,আল্লাহর রসুলের বর্ণনা মোতাবেক সেখানে তাহাজ্জুদ,সওমের মতো একনিষ্ঠ আমলও বৃথা যাবে,সেখানে দাড়ি, টুপি, পাগড়ী, জোব্বার মতো আমল গৃহীত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। -ইসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ১৩৯

ইসলাম কী বলে?
যে যা উপার্জন করবে, তাকে তার বিনিময় মহান রব নিজে দেবেন। চাই তা জাতিগত হোক বা ব্যক্তিগত। এ সম্পর্কে নিন্মে কয়েকটি আয়াত পেশ করা হলো। মহান রব বলেন,
مَن جَاء بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا وَمَن جَاء بِالسَّيِّئَةِ فَلاَ يُجْزَى إِلاَّ مِثْلَهَا وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ
যে একটি সৎকর্ম করবে, সে তার দশগুণ পাবে এবং যে, একটি মন্দ কাজ করবে, সে তার সমান শাস্তিই পাবে। বস্তুতঃ তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।  -সুরা আন’আম : ১৬০

وَاتَّقُواْ يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللّهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ
ঐ দিনকে ভয় কর, যে দিন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোন রূপ অবিচার করা হবে না। -সুরা বাকারা : ২৮১

مَنْ عَمِلَ سَيِّئَةً فَلَا يُجْزَى إِلَّا مِثْلَهَا وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُوْلَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ يُرْزَقُونَ فِيهَا بِغَيْرِ حِسَابٍ
যে মন্দ কর্ম করে, সে কেবল তার অনুরূপ প্রতিফল পাবে, আর যে, পুরুষ অথবা নারী মুমিন অবস্থায় সৎকর্ম করে তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তথায় তাদেরকে বে-হিসাব রিযিক দেয়া হবে। -সূরা গাফের : ৪০

হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
يقولُ اللهُ تَعالى: أنا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بي، وأنا معهُ إذا ذَكَرَنِي، فإنْ ذَكَرَنِي في نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ في نَفْسِي، وإنْ ذَكَرَنِي في مَلَإٍ ذَكَرْتُهُ في مَلَإٍ خَيْرٍ منهمْ
আমি তাঁর সাথে থাকি যখন সে আমার যিকির করে। যদি সে মনে মনে যিকির করে তাহলে আমি তাঁকে মনে মনে স্মরণ করি। আর যদি সে কোন মজলিসে সমবেত হয়ে যিকির করে তাহলে আমি তাঁদের থেকে উত্তম সমবেত মজলিসে তার কথা আলোচনা করি। -সহিহ বুখারী, হাদীস নং : ৭৪০৫

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসুল সাঃ বলেছেন,
سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمْ اللهُ تَعَالَى فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ إِمَامٌ عَدْلٌ وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللهِ وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ
যে দিন আল্লাহর (আরশের) ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না সে দিন আল্লাহ তা‘আলা সাত প্রকার মানুষকে সে ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক। ২. যে যুবক আল্লাহর ইবাদতের ভিতর গড়ে উঠেছে। ৩. যার অন্তরের সম্পর্ক সর্বদা মসজিদের সাথে থাকে। ৪. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে যে দু’ব্যক্তি পরস্পর মহববত রাখে, উভয়ে একত্রিত হয় সেই মহববতের উপর আর পৃথক হয় সেই মহববতের উপর। ৫. এমন ব্যক্তি যাকে সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী (অবৈধ মিলনের জন্য) আহবান জানিয়েছে। তখন সে বলেছে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। ৬. যে ব্যক্তি গোপনে এমনভাবে সাদাকা করে যে, তার ডান হাত যা দান করে বাম হাত তা জানতে পারে না। ৭. যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাতে আল্লাহর ভয়ে তার চোখ হতে অশ্রু বের হয়ে পড়ে। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ১৪২৩

উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসসমূহ থেকে প্রমাণিত হলো, ব্যক্তিকেন্দ্রিক আমলের কারণেও কিয়ামতের ময়দানে জান্নাত পাওয়া যাবে। উপরন্তু ফিৎনার যুগে একাকী আমল করাই হলো নবিজি সাঃ-এর নির্দেশনা। হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সাঃ বলেছেন,
يُوشِكُ أَنْ يَكُونَ خَيْرَ مَالِ الْمُسْلِمِ غَنَمٌ يَتْبَعُ بِهَا شَعَفَ الْجِبَالِ وَمَوَاقِعَ الْقَطْرِ، يَفِرُّ بِدِينِهِ مِنَ الْفِتَنِ
সেদিন দূরে নয়, যেদিন মুসলিমের উত্তম সম্পদ হবে কয়েকটি বকরী, যা নিয়ে সে পাহাড়ের চূড়ায় অথবা বৃষ্টিপাতের স্থানে চলে যাবে। ফিতনা হতে সে তার ধর্ম সহকারে পলায়ন করবে। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ১৯

সুতরাং ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক আমল কররেও জান্নাত পাওয়া যাবে না’ এমন কথা যারা বলে, তারা কী কুরআন-হাদিস সম্পর্কে মূর্খ নাকি বিদ্বেষ লালনকারী?

সওয়াব অর্জন করতে কী ইসলাম আসে নি:
ইসলামের নেকির কাজ করার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ কিয়ামতের ময়দানে এই নেকী মিযানের পাল্লায় ওযন দেওয়া হবে। যার নেকীর পাল্লা হালকা হবে, তার জন্য মহাবিপদ। আর যার নেকীর পাল্লা ভারি হবে, তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম হবে। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এই নেকী বা সওয়াব সম্পর্কে এমন এমন জঘণ্য উক্তি করেছে, যা কোনো মুসলিমের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। চলুন আগে তাদের বক্তব্যগুলো দেখে নেওয়া যাক।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
সাওয়াব অর্জন করতে ইসলাম আসে নি:
মহাসত্য হচ্ছে শেষ দীন ইসলাম যা বিশ্বের সমগ্র মানবজাতির মধ্যে একটা বিপ্লব সৃষ্টি করে দেওয়ার মত আদর্শ, মানুষকে মুক্তি দেওয়ার মতো একমাত্র দর্শন তা কস্মিনকালেও বসে বসে সওয়াব কামানোর জন্য আসেনি। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ১১৮

আলেমরা ইসলামটাকে শুধু ব্যক্তিগত সওয়াবের ধর্মে পরিণত করে গিয়ে মসজিদে খানকায় ঢুকেছেন এবং সেখানে বসে ধর্ম বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছেন, মানুষকেও মসজিদ-মাদ্রাসা কেন্দ্রিক বানিয়ে রেখেছেন। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ১১৭

সাওয়াব অর্জন ইসলামের মূল টার্গেট নয়:
মানুষের তথা মানবজাতির উপকার হয় বা কল্যাণ হয় এমন কথা কাজ বা চিন্তা সবই সওয়াবের কাজ। -হলি আর্টিজেনের পর : পৃ. ২৩

আজ দীনের উদ্দেশ্য করা হয়েছে আখিরাতের পুঁজি হিসেবে সওয়াব অর্জন করা। যেন মিজানের পরিমাপে এর পাল্লা ভারী হয়, আর পদ্ধতি করা হয়েছে উপাসনা। অথচ আল্লাহ দেওয়া ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। -ইসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৮৯

সওয়াব অর্জনের তাকিদে ইসলাম ধ্বংস হয়েছে:
ওমুক কাজ করলে অত হাজার সওয়াব লেখা হয়, ওমুক দোয়া পড়লে অত লক্ষ সওয়াব হয় থেকেও ইসলামের আসল উদ্দেশ্য বোঝা যাবে না, অনেকটা এই ভাবেই এই শেষ জীবন ব্যবস্থা শেষ ইসলামের প্রকৃত আকিদা লুপ্ত হয়ে গেছে। [আকীদা : পৃ. ২]

সওয়াবের আশায় সাহাবারা আমল করেন নি:
‘রাসুলুল্লাহর নিকট থেকে সরাসরি ইসলাম শিক্ষার ফলে তাদের আকীদা অর্থাৎ লক্ষ্য ছিল সঠিক, এক ও অভিন্ন। তারা ইসলামের কোন কাজই উদ্দেশ্য না বুঝে কেবল সওয়াবের আশায় করতেন না, সবকিছুর উদ্দেশ্য তাদের কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট ছিল। [মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ৫৮]

সওয়াব মানুষের সমস্যা দূর করতে ব্যার্থ:
সওয়াব মানুষকে বাস্তব সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারছে না’। [ধর্ম ব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ১১৭]

সওয়াব দিয়ে কারো জান্নাত জাহান্নাম নির্ধারণ হয় না:
সওয়াব দিয়ে কারো জান্নাত জাহান্নাম নির্ধারণ হয় না, জান্নাত জাহান্নাম নির্ধারিত হয় ঈমান দিয়ে। [তওহীদ জান্নাতের চাবি : পৃ. ২৪]

অর্থাৎ তাদের কাছ সওয়াব বা নেকী অর্জন করার বিষয়টা একবারেই অহেতুক।

ইসলাম কী বলে?
দুনিয়ায় সম্পদ উপার্জন করলে তার জিবনটা যত সহজ, কিয়ামতে ঠিক তেমনিভাবে নেকি অর্জনকারীদের পথ সুগম হবে। আর এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে। নিন্মে কয়েকটি আয়াত ও হাদিস উল্লেখ্য করছি।

মহান আল্লাহ নিজে নেক কাজে প্রতিযোগীতা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
فَاسْتَبِقُواْ الْخَيْرَاتِ
কাজেই নেক কাজে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এগিয়ে যাও। [সুরা বাকারা : ১৪৮]

উপরোক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ পাক নেকী অর্জন করার কাজে প্রতিযোগীতা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ নেকির কাজ গুনাহকে মিটিয়ে দেয়। মহান আল্লাহ পাক বলেন,
إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّـيِّئَاتِ ذَلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ
নেকি অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়, যারা স্মরণ রাখে তাদের জন্য এটি এক মহা স্মারক। [সুরা হুদ : ১১৪]

আয়াত দু’টি থেকে বুঝা গেলো, সবচে বড় সমস্যা গুনাহকে মিটিয়ে দিতে পারে নেকি। সুতরাং হেযবুত তওহীদের ভ্রান্ত দাবি ‘সওয়াব মানুষকে বাস্তব সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারছে না’ বক্তব্যটা নিছক বাস্তবতা বিবর্জিত ও চরম ভ্রান্ত। এ ছাড়াও দুনিয়াতে নেকির প্রভাব রয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
إن للحسنة ضياءً في الوجه ونوراً في القلب وسعةً في الرزق  وقوةً في البدن ومحبةً في قلوب الخلق وإن للسيئة سواداً في الوجه وظلمةً في القلب  ووهناً في البدن ونقصاً في الرزق وبغضةً في قلوب الخلق
নেকীর কারণে চেহারা উজ্জ্বলতা, অন্তরের আলো, রিযিকের প্রশস্তি, শরীরের শক্তি এবং মানুষের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। আর গুনাহের কারণে  চেহারার কলুষতা, অন্তরের অন্ধকার, শরীরের দুর্বলতা, রিযিকের সংকট ও মানুষের অন্তরে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। [আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : খ. ৩৮ পৃ. ২০৯]

উপরন্তু মহান আল্লাহ কিয়ামতের ময়দানে মানুষের নেকির পুরস্কার নিজে দেবেন। যা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ لِيَجْزِيَ الَّذِينَ أَسَاؤُوا بِمَا عَمِلُوا وَيَجْزِيَ الَّذِينَ أَحْسَنُوا بِالْحُسْنَى
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর, যাতে তিনি মন্দকর্মীদেরকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেন এবং সৎকর্মীদেরকে দেন ভাল ফল। [সূরা নাজম : ৩১]

কিয়ামতের ময়দানে নেকি নিয়ে গেলে আল্লাহপাক উত্তম প্রতিদান ও কিয়ামতের ভয়াবহতা থেকে মুক্তির আশ্বাস দিয়েছেন। পক্ষান্তরে গুনাহ নিয়ে গেলে জাহান্নামে নিক্ষেপ হওয়ার কথা বলেছেন। মহান রব বলেন,
مَن جَاء بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ خَيْرٌ مِّنْهَا وَهُم مِّن فَزَعٍ يَوْمَئِذٍ آمِنُونَ وَمَن جَاء بِالسَّيِّئَةِ فَكُبَّتْ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ هَلْ تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
যে কেউ নেকী নিয়ে আসবে, সে উৎকৃষ্টতর প্রতিদান পাবে এবং সেদিন তারা গুরুতর অস্থিরতা থেকে নিরাপদ থাকবে। এবং যে মন্দ কাজ নিয়ে আসবে, তাকে অগ্নিতে অধঃমূখে নিক্ষেপ করা হবে। তোমরা যা করছিলে, তারই প্রতিফল তোমরা পাবে। [সূরা নামল : ৮৯-৯০]

এ ছাড়াও আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ পাক বলেন,
أُوْلَئِكَ يُؤْتَوْنَ أَجْرَهُم مَّرَّتَيْنِ بِمَا صَبَرُوا وَيَدْرَؤُونَ بِالْحَسَنَةِ السَّيِّئَةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
তারা দুইবার পুরস্কৃত হবে তাদের সবরের কারণে। তারা মন্দের জওয়াবে ভাল করে এবং আমি তাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। [সূরা কাসাস : ৫৪]

উক্ত আয়াতে গুনাহের পরিবর্তে নেকী অর্জন করার কারণে আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম কবুল করেছিলেন, তাদের পুরস্কারের কথা আল্লাহ নিজে বলেছেন। এছাড়াও কিয়ামতের ময়দানে মানুষের নেকি ও গুনাহ মিজানের পাল্লায় ওজন দেওয়া হবে। যাদের নেকির পাল্লা ভারি হবে, তাদের জন্য সফলতা পাবে, জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর পক্ষান্তরে যাদের গুনাহের পাল্লা ভারি হবে, তাদের জন্য জাহান্নাম রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
فَمَن ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُوْلَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ تَلْفَحُ وُجُوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ
যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবে সফলকাম, এবং যাদের পাল্লা হাল্কা হবে তারাই নিজেদের ক্ষতিসাধন করেছে, তারা দোযখেই চিরকাল বসবাস করবে। আগুন তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে এবং তারা তাতে বীভৎস আকার ধারন করবে। [সূরা মুমিনুন : ১০২-১০৪]

فَأَمَّا مَن ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَّاضِيَةٍ وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ
অতএব যার পাল্লা ভারী হবে, সে সুখীজীবন যাপন করবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে হাবিয়া। [সুরা ক্বারিয়া : ৬-৯]

উক্ত আয়াতদ্বয় থেকে প্রমাণিত হলো যে, মিযানের পাল্লা দিয়ে মানুষের নেকি ও গুনাহের হিসাব করা হবে। সুতরাং নেকি যদি কম হয়, তাহলে এর বিনিময় জাহান্নাম। আর বেশি হলে জান্নাত। উপরন্তু যাদের নেকি বেশি হবে, তাদের আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে। কিন্তু যাদের নেকি কম হবে তাদের আমলনামা বাম হাতে দেওয়া হবে। পবিত্র কালামে পাকে আল্লাহ পাক বলেন,
فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا وَيَنقَلِبُ إِلَى أَهْلِهِ مَسْرُورًا وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ وَرَاء ظَهْرِهِ فَسَوْفَ يَدْعُو ثُبُورًا وَيَصْلَى سَعِيرًا
যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তার হিসাব-নিকাশ সহজে হয়ে যাবে এবং সে তার পরিবার-পরিজনের কাছে হৃষ্টচিত্তে ফিরে যাবে এবং যাকে তার আমলনামা পিঠের পশ্চাদ্দিক থেকে দেয়া, হবে, সে মৃত্যুকে আহবান করবে, এবং জাহান্নামে প্রবেশ করবে। [সুরা হাক্কাহ : ৭-১২]

সুতরাং উপরোক্ত আয়াত থেকে বুঝা গেলো, যে আমলনামায় নেকি কম হবে তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত। অতএব কিয়ামতের ময়দানে নেকি হলো সফলতা ও বিফলতার জন্য বিরাট বড় ভূমিকা রাখবে।

একটি নেকির যত পুরস্কার:
একটি নেকীর পুরস্কার কত হবে তা পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বিভিন্নভাবে উল্লেখ্য করা হয়েছে। চলুন সে সম্পর্কে দেখে নেওয়া যাক।

১ নেকি সমান ১০ নেকি:
মহান রব পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দিয়ে বলেন,
مَن جَاء بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا وَمَن جَاء بِالسَّيِّئَةِ فَلاَ يُجْزَى إِلاَّ مِثْلَهَا وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ
যে একটি সৎকর্ম করবে, সে তার দশগুণ পাবে এবং যে, একটি মন্দ কাজ করবে, সে তার সমান শাস্তিই পাবে। বস্তুতঃ তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না। [সূরা আন’আম : ১৬০]

১ নেকি সমান ৭০০ নেকি:
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
يَقُولُ اللهُ إِذَا أَرَادَ عَبْدِي أَنْ يَعْمَلَ سَيِّئَةً فَلاَ تَكْتُبُوهَا عَلَيْهِ حَتَّى يَعْمَلَهَا فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا بِمِثْلِهَا وَإِنْ تَرَكَهَا مِنْ أَجْلِي فَاكْتُبُوهَا لَهُ حَسَنَةً وَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَعْمَلَ حَسَنَةً فَلَمْ يَعْمَلْهَا فَاكْتُبُوهَا لَهُ حَسَنَةً فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا لَهُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ
আল্লাহ্ বলেন, আমার বান্দা কোন গুনাহর কাজ করতে চাইলে তা না করা পর্যন্ত তার গুনাহ্ লেখো না। আর যদি তা করেই ফেলে, তাহলে তা সমপরিমাণ লেখো। আর যদি আমার (মাহাত্ম্যের) কারণে তা ত্যাগ করে, তাহলে তার পক্ষে একটি নেকী লেখো এবং যদি বান্দা কোন ভাল কাজের ইচ্ছা করল কিন্তু তা না করে, তবুও তোমরা তার জন্য একটি নেকী লেখো। তারপর যদি তা করে, তবে তোমরা তার জন্য কাজটির দশ গুণ থেকে সাত’শ গুণ পর্যন্ত লেখো। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৭৫০১]

১ নেকি সমান ১০ লাখ নেকি:
হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার কাছে এ মর্মে খবর পৌঁছেছে

أنّ اللهَ يُعْطي عبدَه بالحسنةِ الواحدةِ ألفَ ألفِ حسنةٍ

অর্থাৎ  যে আল্লাহ পাক বান্দাকে একটি নেকীর বিনিময় ১০ লক্ষ নেকী দান করেন। [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ১০৭০৭

১ নেকি সমান ২০ লাখ নেকি:
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাঃ থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
إنّ اللهَ يُعْطيه ألفَي ألفِ حسنةٍ
নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাকে একটি নেকীর বিনিময় ২০ লক্ষ নেকী দান করেন। [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ১০৭০৭]

১ নেকি সমান সীমাহীন নেকি:
আল্লাহ তাআলা একটি নেকির বিনিময় বিপুল নেকি দান করেন। মহান রব বলেন,
إِنَّ اللّهَ لاَ يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِن تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا وَيُؤْتِ مِن لَّدُنْهُ أَجْرًا عَظِيمًا
নিশ্চয়ই আল্লাহ কারো প্রাপ্য হক বিন্দু-বিসর্গও রাখেন না; আর যদি তা নেকী হয়, তবে তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে বিপুল সওয়াব দান করেন। [সূরা নিসা, আয়াত নং : ৪০]

কিয়ামতের দিন একটি নেকির প্রয়োজনীয়তা:
বর্ণিত আছে,
أنه يؤتى برجل يوم القيامة، فما يجد له حسنة ترجح ميزانه، وقد اعتدلت بالسوية، فيقول الله تعالى رحمة منه: اذهب في الناس فالتمس من يعطيك حسنة أدخلك بها الجنة، فيصير يجوس خلال العالمين، فما يجد أحداً يكلمه في ذلك الأمر إلا يقول له خفت أن يخف ميزاني، فأنا أحوج منك إليها، فييأس، فيقول له رجل: ما الذي تطلب؟ فيقول: حسنة واحدة، فلقد مررت بقوم لهم منها الألف، فبخلوا علي، فيقول له الرجل: لقد لقيت الله تعالى فما وجدت في صحيفتي إلا حسنة واحدة، وما أظنها تغني عني شيئاً، خذها هبة مني إليك، فينطلق فرحاً مسروراً فيقول الله له: ما بالك؟ -وهو أعلم- فيقول: رب اتفق من أمري كيت وكيت، ثم ينادي سبحانه بصاحبه الذي وهبه الحسنة فيقول له سبحانه: كرمي أوسع من كرمك، خذ بيد أخيك وانطلقا إلى الجنة
কিয়ামতের ময়দানে এমন একজনকে উপস্থিত করা হবে, যার গুনাহ আর নেকি সমান হবে। কিন্তু সে একটা নেকি পেলে মিজানের পাল্লা ভারি হয়ে যেতো। অতপর মহান আল্লাহ তা’আলা বলবেন, তুমি মানুষের কাছে গিয়ে একটা নেকি তালাশ করে নিয়ে আসো, যেন তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারি। অতপর লোকটি দুনিয়ার তার আপন মানুষদের কাছে যাবে, কিন্তু এমন কাউকে পাবে না, যে এ বিষয়ে কথা বলবে, বরং সবাই বলবে, ‘আমি তো আমার মিজানের নেকির পাল্লা হালকা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছি। আমি তোমার থেকে নেকির বেশি মুখাপেক্ষী’। ফলে লোকটি সবার কাছ থেকে নৈরাশ হয়ে যাবে। হঠাৎ একজন বলবে, ‘আপনি কী অন্বেষণ করছেন’? বলবে, একটি নেকি খুজছি, কিন্তু এমন লোকের পাশ দিয়েও অতিক্রম করেছি যারা অজস্র নেকির মালিক, কিন্তু তারা কৃপনতা করেছে। (কেউ দেয়নি)। অতপর লোকটি বলবে, আমি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে আমার আমলনামায় মাত্র একটি নেকি ছাড়া কিছুই পাইনি। আমার ধারণা এটা আমার কোনো উপকারে আসবে না। যাও এটা তোমাকে দান করে দিলাম। ফলে লোকটি নেকি নিয়ে খুশি খুশি আল্লাহর সামনে হাজির হবে। আল্লাহ পাক, তাকে প্রশ্ন করবেন, তোমার কী অবস্থা?  যদিও আল্লাহ জানেন। লোকটি বলবেন, হে আল্লাহ আমার সাথে এমন এমন ঘটনা ঘটেছে। অতপর আল্লাহ তা’আলা ঐ নেকি দানকারী লোকটিকে ডাক দিয়ে বলবেন, তোমার দেয়ার চেয়ে আমার দয়া প্রশস্ত। সুতরাং তুমি তোমার ভাইয়ের হাত ধরে উভয়ে জান্নাতে চলে যাও। [আত তাযকিরা (কুরতুবী) : খ. ১ পৃ. ৭৩৩-৭৩৪]

প্রিয় পাঠক, নেকি ও সওয়াব নিয়ে এত এত আয়াত ও হাদিস থাকার পরও হেযবুত তওহীদ এই নেকি-সওয়াব নিয়ে যে বিরুপ মন্তব্য করেছেন, তা কী কোনো মুসলমানের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব?

ব্যক্তিগত তাক্বওয়া কী মূল্যহীন?
তাক্বওয়া বা খোদাভিতি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিধানের অন্তুর্ভূক্ত। যে বা যারা তাক্বওয়ার পথে চলবে তাদের জন্য রয়েছে রবের কাছে মহান পুরস্কার।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবী হলো, ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি আল্লাহ’র ভয় তথা তাক্বওয়ার পথে চলে, তাহলে সেটা মূল্যহীন। দেখুন তারা কী লিখেছেন,
ব্যক্তি ভালোমানুষি দিয়ে কেউ জান্নাতে যাবে না, কারণ জান্নাত সামষ্টিক। ইসলাম মানে শান্তি, তাই সমাজে শান্তনা প্রতিষ্ঠার কাজ করলে জান্নাতে ঠাঁই পাওয়া যাবে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা একটি সামষ্টিক কাজ। সুতরাং জান্নাতও একটি সামষ্টিক ফল।…. ব্যক্তি তাকওয়ার কোনো মূল্য নেই। সামষ্টিক তাকওয়াই হলো জান্নাতে যাবার পূর্বশর্ত। [তাকওয়া ও হেদায়েত : পৃ. ৯]

অর্থাৎ তারা বলতে চায়-
১. ব্যক্তি তাক্বওয়ার কোনো মূল্য নেই।
২. আগে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পরে তাক্বওয়া।

ইসলাম কী বলে?
এক. ‘ইসলামে ব্যক্তি তাক্বওয়ার কোনো মূল্য নেই’ এটা পবিত্র কুরআন বিরোধী মন্তব্য। কারণ মহান আল্লাহ পাক বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। [সূরা আলে ইমরান : ১০২]

وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا
যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পাপ মোচন করেন এবং তাকে মহাপুরস্কার দেবেন। [সূরা ত্বালাক : ৫]

অপর আয়াতে মহান রব বলেন,
وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ
যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে পেশ হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্যে রয়েছে দু’টি উদ্যান। [সূরা রহমান : ৪৬]

উপরোক্ত দু’টি আয়াতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক তাক্বওয়ার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়কে শর্তারোপ করা হয়নি। সুতরাং শর্তহীন আয়াতকে শর্তযুক্ত করা কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যার শামিল। তবে হ্যাঁ, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার মেহনত করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তবে তাক্বওয়ার পুরস্কারের ব্যাপারে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নির্ভরশীল নয়।

দুই. আগে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পরে তাক্বওয়া।
তারা দাবী করেছেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করে তাক্বওয়ার পথে চলা মূল্যহীন বিষয়। অথচ বাবা আদম আ. এর যুগ থেকে নিয়ে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাঃ পর্যন্ত যতো নবি-রাসুল পৃথিবীতে এসেছিলেন, এর মধ্যে ২/৩ জন ছাড়া কেউ রাষ্ট্রপতি ছিলেন না। তাহলে তারা কী তাক্বওয়া অর্জণ করে যান নি? আমাদের নবি সাঃ রাষ্ট্রগঠণ করার আগে কী তাক্বওয়ার পথে চলেন নি? সাহাবায়ে কেরামের রা. মধ্যে যারা মক্কা বা মাদীনায় রাষ্ট্রগঠণ করার আগে ইন্তেকাল করেছেন, তারা কী তাক্বওয়া অর্জন না করেই ইন্তেকাল করেছেন? অথচ মাক্কী জিবনেও নবি সাঃ তাঁর সাহাবাদেরকে তাক্বওয়ার শিক্ষা দিয়েই তাঁদেরকে সোনার মানুষে পরিনত করেছিলেন। আসলে হেযবুত তওহীদ না থাকলে হয়তো চিড়িয়াখানার ইতিহাস লিপিবদ্ধ হতো না।

দুআ ও কান্নাকাটি করে জান্নাত পাওয়া যাবে না:
দু’আ ও কান্নাকাটি একটি মহৎ কাজ ও আল্লাহ পাকের একান্ত চাওয়া। যার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা পুরস্কার স্বরুপ জান্নাত রেখেছেন। কিন্তু হেযবুত তওহীদ বলছে এক ভিন্ন কথা।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, জান্নাত একমাত্র জিহাদ করেই পাওয়া যাবে। দু’আ বা কান্নাকাটি করে পাওয়া যাবে না। দেখুন তারা লিখেছে,
জান্নাত কান্নাকাটি করে দোয়া করে পাওয়ার বিষয় নয়। এটি একটি লেনদেনের বিষয়। মোমেন নিজের জীবন ও সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে বিনিময় আল্লাহ তাকে জান্নাত দেবেন’। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে, পৃ. ৭

অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, দু’আ ও কান্নাকাটি করে জান্নাত পাওয়া যাবে না।

ইসলাম কী বলে?
জান্নাত পেতে হলে দু’আ ও কান্নাকাটি আবশ্যক। এ বিষয়ে নিন্মে আলোচনা করা হলো।

দুআ: মহান রবের কাছে দু’আ করা এতটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। যা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ। কিন্তু হেযবুত তওহীদের দাবি করছে, জান্নাত দুআ কান্নাকাটি করে পাওয়ার বিষয় নয়। অথচ মহান রব বলেন,
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكم
তোমরা আমার নিকট দু’আ করো, আমি তোমাদের দু’আ কবূল করবো। -সূরা গাফির : ৬০

এমনকি রাসুলুল্লাহ সাঃ কে মহান আল্লাহ দুআকারীদের সাথে থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُم بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَن ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا
আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে, নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্য কলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার অনুগত্য করবেন না। -সূরা কাহাফ, আয়াত : ২৮

উপরন্তু দু’আ করা সম্পর্কে আরও বর্ণিত আছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
أفضلُ العبادةِ الدعاءُ
সর্বোত্তম ইবাদত হলো, দু’আ। -জামে সগীর, হাদিস : ১২৭৫

হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
لا تعجِزوا في الدُّعاءِ فإنّه لنْ يهلِكَ مع الدُّعاءِ أحَدٌ
তোমরা দোআতে অপারগ হয়ে যেও না। কারণ দো’আর সাথে কোন ব্যক্তি ধ্বংস হয় না। -সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৮৭১

হযরত সালমান ফারেসী রা. কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসুল সাঃ বলেন,
لاَ يَرُدُّ الْقَضَاءَ إِلاَّ الدُّعَاءُ
দুআ ছাড়া অন্য কিছু তাকদীর রদ্দ্ (খণ্ডন) করতে পারে না। -জামে তিরমিযী, হাদিস : ২১৩৯

সুতরাং প্রমাণ হলো, আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। যারা দুআ করে না, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ পাক রাগান্বিত হন। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
مَن لم يسألِ اللهَ يغضبْ عليه.
যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট দুআ করে না, আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত হন। -জামে তিরমিযী, হাদিস : ৩৩৭৩

এই দুআ করার মাধ্যমে জান্নাত পাওয়া যায়। হযরত ইবন উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
مَنْ فُتِحَ لَهُ مِنْكُمْ بَابُ الدُّعَاءِ فُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ
তোমাদের মাঝে যার জন্য দু’আর দ্বার উন্মোচিত হয়, তার জন্য জান্নাতের দ্বারসমূহও উন্মোচিত হয়। -জামে তিরমিযি, হাদিস : ৩৫৪৮

আর এজন্যই রাসুলুল্লাহ সাঃ আল্লাহ পাকের কাছে জান্নাতুল ফিরদাউস পাওয়ার জন্য দু’আ করার নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
فإذا سأَلْتُم اللهَ فسَلُوه الفِرْدَوْسَ
যখন তোমরা আল্লাহ’র কাছে চাও, তখন তাঁর কাছে ফিরদাউস জান্নাত চাও। -সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৯৫৮

সুতরাং বুঝা গেলো, দু’আর মাধ্যমে আল্লাহ পাক জান্নাত দেবেন বলে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।

কান্নাকাটি: আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারীর জন্য পরকালে মর্যাদাপূর্ণ স্থান ও সুখময় জান্নাত রয়েছে। যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য দু’টি জান্নাতের ঘোষণা দিয়ে মহান রব বলেন,
وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ
যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে পেশ হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্যে রয়েছে দু’টি উদ্যান। সূরা রহমান, আয়াত : ৪৬

শুধু ভয় পেলেই যদি দু’টি জান্নাত পাওয়া যায়। তাহলে যারা আল্লাহ পাকের ভয়ে কাঁদে তাদের কী পাওয়া উচিৎ? যারা আল্লাহ’র ভয়ে কাঁদে তাদেরকে জাহান্নামে না দেওয়ার নিশ্চয়তা খোদ রাসুলুল্লাহ সা. দিয়েছেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
لاَ يَلِجُ النَّارَ رَجُلٌ بَكَى مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ حَتَّى يَعُودَ اللَّبَنُ فِي الضَّرْعِ
আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারীর জাহান্নামে যাওয়া এরূপ অসম্ভব যেরূপ দোহনকৃত দুধ পুনরায় পালানে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। -জামে তিরমিযি, হাদিস : ১৬৩৩

আরেকটি হাদীছে এসেছে, ইবনে আববাস রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাঃ কে বলতে শুনেছি,
عَيْنَانِ لاَ تَمَسُّهُمَا النَّارُ عَيْنٌ بَكَتْ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ وَعَيْنٌ بَاتَتْ تَحْرُسُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ
জাহান্নামের আগুন দু’টি চোখকে স্পর্শ করবে না। এক- আল্লাহর ভয়ে যে চোখ ক্রন্দন করে এবং দুই- আল্লাহর রাস্তায় যে চোখ পাহারা দিয়ে বিনিদ্র রাত অতিবাহিত করে। -জামে তিরমিযি, হাদিস : ১৬৩৯

উক্ত হাদিস দু’টিতে আল্লাহ পাকের ভয়ে ক্রন্দনকারীদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, তারা জাহান্নামে যাবে না। তাহলে হেযবুত তওহীদের দাবি সত্য না নবিজি সাঃ-এর কথা সত্য?

উপরন্তু হাশরের ময়দান এমন এক স্থান, যেখানে পৃথিবীর যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে মানুষ নতুন এক ময়দানে উত্থিত হবে এবং ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
يَعْرَقُ النَّاسُ يَوْمَ القِيَامَةِ حَتَّى يَذْهَبَ عَرَقُهُمْ فِي الأَرْضِ سَبْعِينَ ذِرَاعًا وَيُلْجِمُهُمْ حَتَّى يَبْلُغَ آذَانَهُم
কেয়ামতের দিন মানুষের ঘাম ঝরবে। এমনকি তাদের ঘাম যমীনে সত্তর হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে এবং তাদের মুখ পর্যন্ত ঘামে ডুবে যাবে, এমনকি কান পর্যন্ত। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ৬৫৩২

সে পরিস্থিতিতেও আল্লাহ তা’আলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে (কিয়ামতের দিন) তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না। সেই সাত ব্যক্তির মধ্যে এক প্রকার হলো,
وَرَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِياً فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ
আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ৬৬০

কান্নার কারণে জান্নাত:
হাদিস শরীফে এসেছে, কিয়ামতের দিন এক বান্দা অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকবে। যার আমল নামায় তেমন নেকী থাকবে না। তার সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গও তার বিরুদ্ধে সাক্ষি দেবে। হঠাৎ তার চোখের পাতা থেকে একটা পাপড়ি আলাদা হয়ে উড়তে থাকবে। আর আল্লাহ পাকের কাছে অনুমতি চাইবে একটা সুপারিশ করার। তখন আল্লাহ পাক বলবেন,
تكلمي يا شعرة جفن عين عبدي واحتجي عن عبدي فتشهد له بالبكاء من خوفه فيغفر له وينادى مناد هذا عتيق الله بشعره
হে আমার বান্দার চোখের পাপড়ি কথা বলো এবং আমার বান্দার ব্যাপারে সাক্ষ প্রদান করো। অতপর তার আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনের ব্যাপারে সাক্ষি দেবে।ফলে আল্লাহ পাক তার ক্ষমা করে দেবেন এবং একজন ঘোষক ঘোষণা দেবেন, এই লোকটা পাপড়ির কারণে মুক্ত। – আনওয়ারুল কুরআন ও আসরারুল ফুরকান খ. ৪ পৃ. ২৮৩

সুতরাং বুঝা গেলো, আল্লাহ তাআলার ভয়ে কান্নার কারণে জান্নাত পাওয়া যাবে বলে কুরআন-হাদিস সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও হেযবুত তওহীদ কিভাবে বলে, ‘জান্নাত কান্নাকাটি করে দোয়া করে পাওয়ার বিষয় নয়’? এটা কোনো মুসলমানের বক্তব্য হতে পারে?

আখেরাতের থেকে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে হবে।

প্রতিটি মানুষের জিবনের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য হওয়া দরকার আখেরাতকে কেন্দ্র করে। আখেরাত দিবসের প্রতিদান ও শাস্তির চিস্তা যদি মানুষের মধ্যে থাকতো, তাহলে কোনো মানুষের পক্ষে অন্যায়, অপরাধ, গুনাহ হতো না। যে কারণে কুরআন-হাদিসে বারবার মানুষকে আখেরাতের কথা স্বরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য দুনিয়ার ফিকিরও মানুষকে করতে হবে, কিন্তু মূল হিসাবে নয়, বরং আখেরাতের পূ্ঁজি সঞ্চয়ের জন্য দুনিয়াকে ওসিলা হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু হেযবুত তওহীদের দাবি হলো,
১. আখেরাতের থেকে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে হবে।
২. দুনিয়া সুন্দর হলেই আখেরাত সুন্দর।
৩. দুনিয়ার সফল ব্যক্তিরাই প্রকৃত সফল।
৪. আত্মশুদ্ধি সফলতার পথ নয়।
৫. পরকালের বিষয়টা মূল বিষয় নয়।

এক. আখেরাতের থেকে দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে ?
ইসলামে দুনিয়ার চেয়ে আখেরাতকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে এবং আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া অতিনগণ্য বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা দুনিয়াকেই আসল ও মূল হিশাবে জানান দিতে চায়। তাদের দাবি হলো,
ইসলামের মূল লক্ষ্য শুধু পরকালীন সওয়াব কামাই নয়, পৃথিবীর মানুষের জীবনে ন্যায় শান্তি নিরাপত্তা সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। এই শান্তি প্রতিষ্ঠার ফলই হলো পরকালীন শান্তি। [ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে : পৃ. ৪১]

আজ দীনের উদ্দেশ্য করা হয়েছে আখিরাতের পুঁজি হিসেবে সওয়াব অর্জন করা। যেন মিজানের পরিমাপে এর পাল্লা ভারী হয়, আর পদ্ধতি করা হয়েছে উপাসনা। অথচ আল্লাহ দেওয়া ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। [ইসলাম শুধু নাম থাকে : পৃ. ৮৯ ]

তাদের এই সত্য বুঝার মত সেই চিন্তা শক্তি নেই যে, যে ধর্মচর্চা তাদেরকে দুনিয়ার লাঞ্ছনা অপমান থেকে রক্ষা করতে পারছে না, সেই ধর্ম পালন করে পরকালীন মুক্তির আশা পোষণ করা সুদূর পরাহত। [ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে : পৃ. ৫১]

(কুরআনের) আয়াতে আগে দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর করার কথা বলা হচ্ছে। [ধর্মবিশ্বাস : পৃ. ১১]

অর্থাৎ তারা বলতে চায়, দুনিয়াই হলো মানুষের মূল। তাই সব কিছু হতে হবে দুনিয়াকে কেন্দ্র করে।

ইসলাম কী বলে?
অথচ পবিত্র কুরআনে আখিরাতকেই সেরা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহান রব বলেন,
انْظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَلَلْآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلاً
লক্ষ্য করো, আমি কিভাবে তাদের কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। ১৪ নিশ্চিত জেন, আখেরাত মর্যাদার দিক থেকেও মহত্তর এবং মাহাত্ম্যের দিক থেকেও শ্রেষ্ঠতর। [সুরা ইসরা : ২১]

উপরন্তু দুনিয়াদারদের চরম ধিকৃতি জানিয়ে মহান রব ঘোষণা দেন,
مَّن كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاء لِمَن نُّرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلاهَا مَذْمُومًا مَّدْحُورًا وَمَنْ أَرَادَ الآخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُم مَّشْكُورًا
কেহ পার্থিব সুখ সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা সত্ত্বর দিয়ে থাকি; পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি যেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত অবস্থায়। যারা বিশ্বাসী হয়ে পরকাল কামনা করে এবং ওর জন্য যথাযথ চেষ্টা করে তাদের প্রচেষ্টাসমূহ আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে। [সূরা বনী ইসরাঈল : ১৮-১৯]

مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ
যে কেউ পরকালের ফসল কামনা করে, আমরা তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি ইহকালের ফসল কামনা করে, আমরা তাকে সেখান থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু পরকালে তার কোনই অংশ থাকবে না। [সুরা শূরা : ২০]

উক্ত আয়াত থেকে জানা গেলো, যারা দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগ কামনা করে তারা কেয়ামতে জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। পক্ষান্তরে আখেরাত কামনাকারীরা কেয়ামতে রবের কাছে প্রসংশিত হবে।

তাহলে কী দুনিয়া কামনা করা যাবে না?
দুনিয়া কামনা করতে অসুবিধা নেই, তবে শুধুমাত্র দুনিয়া লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বানানো যাবে না। মূল টার্গেট হতে হবে আখেরাতের সফলতাকে কেন্দ্র করে। যারা দুনিয়াকেই মূল মনে করে এবং কামনা করে মহান রব তাদের ব্যাপারে বলেন,
فَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الآخِرَةِ مِنْ خَلاَقٍ
তারপর অনেকে তো বলে যে পরওয়াদেগার! আমাদিগকে দুনিয়াতে দান কর। অথচ তার জন্যে পরকালে কোন অংশ নেই। [সূরা বাকারা : ২০০]

পক্ষান্তরে যারা আখেরাতের সফলতার পাশাপাশি দুনিয়াও চায়, তাদের সে চাওয়াটা অপরাধ নয়। মহান রব বলেন,
وِمِنْهُم مَّن يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ أُولَـئِكَ لَهُمْ نَصِيبٌ مِّمَّا كَسَبُواْ وَاللّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ
আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে-হে পরওয়ারদেগার! আমাদিগকে দুনয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান কর এবং আমাদিগকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা কর। এদেরই জন্য অংশ রয়েছে নিজেদের উপার্জিত সম্পদের। আর আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। [সূরা বাকারা : ২০১-২০২]

সুতরাং পবিত্র কুরআনের আয়াত থেকেই বুঝা গেলো, আখিরাতই হলো মানুষের মূল। আখিরাত কামনার পাশাপাশি দুনিয়াও কামনা করা যাবে, তবে দুনিয়াকে মূল মনে করা নিন্দনীয়। আর এজন্যই শুধুমাত্র দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগ কামনা করা নিন্দনীয়, চরম অন্যায় ও জাহান্নামী হওয়ার কারণ বলে পবিত্র কুরআনের আয়াত থেকে জানতে পারলাম। তাছাড়া হযরত হযরত কা‘ব বিন মালেক আনসারী রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেছেন,
مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلاَ فِى غَنَمٍ بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ وَالشَّرَفِ لِدِينِهِ
দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগপালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া অত বেশী ধ্বংসকর নয়, যত না বেশী মাল ও মর্যাদার লোভ মানুষের দ্বীনের জন্য ধ্বংসকর। [জামে তিরমিযি : হাদিস নং : ২৩৭৬]

হযরত আবু মুসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেন,
مَنْ أَحَبَّ دُنْيَاهُ أَضَرَّ بِآخِرَتِهِ وَمَنْ أَحَبَّ آخِرَتَهُ أَضَرَّ بِدُنْيَاهُ فَآثِرُوا مَا يَبْقَى عَلَى مَا يَفْنَى
যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবাসবে, সে তার আখেরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর যে ব্যক্তি আখেরাতকে ভালবাসবে, সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অতএব তোমরা ধ্বংসশীল বস্ত্তর উপরে চিরস্থায়ী বস্ত্তকে অগ্রাধিকার দাও। [জামে সগীর : হাদিস নং : ৮২৯৪]

দুই. দুনিয়া সুন্দর হলেই কী আখেরাত সুন্দর হবে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, যার দুনিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই হলো মূল। অর্থাৎ দুনিয়াতে যে সুখি, কেয়ামতেও সে জান্নাত পাবে। আর দুনিয়াতে যে কষ্টে থাকবে, কেয়ামতেও সে জাহান্নাম পাবে। এক কথায় আখেরাতের ভালোমন্দ নির্ভর করে দুনিয়ার ভালোমন্দের উপর। দেখুন তারা কী বলে-

আমাদের ইহকালের সমস্যা তাই সমাধানটাও ইহকালের হিসেবেই করতে চাই। পবিত্র কোর’আনে আছে যার ইহকাল ভালো তার পরকালও ভালো। [আদর্শিক লড়াই : পৃ. ১৪]

আমাদের মাদ্রাসা থেকে লক্ষ লক্ষ আলেম তৈরি হচ্ছে, মুফতি মুহাদ্দিস তৈরি হচ্ছে, আইনজ্ঞ বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তা কি লাভ হচ্ছে? আমার ধর্ম বাঁচাতে পারছি না, জাতি বাঁচাতে পারছি না,কি মূল্য রইলো আমার আমলের? কি মূল্য রইলো আমার শিক্ষা-দীক্ষার?  আমরা দুনিয়াতে চরম অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত, অপমানিত ও পরাজিত একটি জনগোষ্ঠি। অথচ আমরা বোকার স্বর্গে বাস করি এই ভেবে যে দুনিয়াতে যাই হোক পরকালে আমাদের জন্য জান্নাত অপেক্ষা করছে। আশা ভুলে যান ভায়েরা। যাদের দুনিয়ায় অসুন্দর, তাদের পরকালে হবে অসুন্দর। [প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ২০]

যার দুনিয়া সুন্দর, তার আখেরাত সুন্দর। [সূত্রাপুরে এমামের ভাষন : পৃ. ২২]

অর্থাৎ তারা বলতে চায়, যার দুনিয়া যত সুন্দর, তার আখেরাতও তত সুন্দর।

ইসলাম কী বলে?
দুনিয়া হলো প্রত্যেক মুমিনের জন্য পরীক্ষার হল স্বরুপ। মহান রব বলেন,
أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না। আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে। [সুরা আনকাবুত : ২-৩]

উক্ত আয়াত থেকে বুঝা গেলো, মুমিনদেরকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করা হবে। এ কথা নিন্মের আয়াতে আরও সুস্পষ্ট করে বলা হচ্ছে-
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُواْ إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ أُولَـئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَـئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত। [সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭]

সুতরাং বুঝা গেলো, মুমিনদেরকে বিভিন্নভাব মহান রব পরীক্ষা করবেন। এজন্য দুনিয়াতে সবচে বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছে রাসুলুল্লাহ সা. কে। হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لَقَدْ أُخِفْتُ فِي اللَّهِ وَمَا يُخَافُ أَحَدٌ وَلَقَدْ أُوذِيتُ فِي اللَّهِ وَمَا يُؤْذَى أَحَدٌ وَلَقَدْ أَتَتْ عَلَىَّ ثَلاَثُونَ مِنْ بَيْنِ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ وَمَا لِي وَلِبِلاَلٍ طَعَامٌ يَأْكُلُهُ ذُو كَبِدٍ إِلاَّ شَيْءٌ يُوَارِيهِ إِبْطُ بِلاَلٍ ‏
আমাকে আল্লাহর পথে যেভাবে ভয় দেখানো হয়েছে, আর কাউকে ঐভাবে ভয় দেখানো হয়নি। আমাকে আল্লাহ্ তা’আলার উদ্দেশ্যে যেভাবে যন্ত্রণা দেয়া হয়েছে আর কোন ব্যক্তিকে সেইভাবে যন্ত্রণা প্রদান করা হয়নি। আমার উপর দিয়ে ত্রিশটি দিবারাত্রি এমনভাবে অতিবাহিত হয়েছে যে, বিলালের বগলের মধ্যে রক্ষিত সামান্য খাদ্য ছিল আমার ও বিলালের সম্বল। তা ছাড়া এতটুকু আহারও ছিল না যা কোন প্রাণধারী প্রাণী খেয়ে বাঁচতে পারে। [জামে তিরমিযি, হাদিস নং : ২৪৭২]

উক্ত হাদিসটি থেকে জানা গেলো, রাসুলুল্লাহ সাঃ কে দুনিয়ায় সবচে বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছে, তাহলে হেযবুত তওহীদের দাবি অনুযায়ী কেয়ামতেও কী নবিজি সাঃ কে কষ্ট দেওয়া হবে? নাউযুবিল্লাহ। তাহলে হেযবুত তওহীদের বক্তব্য ‘যার দুনিয়া যত সুন্দর, তার আখেরাতও তত সুন্দর’ দাবীটা কী ডাহা মিথ্যাচার নয়?

উপরন্তু হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা থেকেই বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الكَافِرِ
দুনিয়া মু’মিনের জন্য জেলখানা এবং কাফেরের জন্য জান্নাত। [সহিহ মুসলিম : হাদিস নং : ২৯৫৬]

হযরত আবু মালেক আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
حلاوةُ الدنيا مُرَّةٌ الآخِرَةُ، ومُرَّةٌ الدنيا حَلاوةُ الآخِرَةُ
দুনিয়ার স্বাদ আখেরাতের তিক্ততা, আর দুনিয়ার তিক্ততা আখেরাতের স্বাদ। [মুসতাদরাকে হাকেম : হাদিস নং : ৭৯৩১]

হযরত আবু মূসা রা. হতে বর্ণিত,  রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
أُمَّتِىْ هَذِهِ أُمَّةٌ مَرْحُوْمَةٌ لَيْسَ عَلَيْهَا عَذَابٌ فِى الآخِرَةِ عَذَابُهَا فِى الدُّنْيَا الْفِتَنُ وَالزَّلاَزِلُ وَالْقَتْلُ
আমার এ উম্মত দয়াপ্রাপ্ত, পরকালে এদের কোন শাস্তি হবে না, আর ইহকালে তাদের শাস্তি হ’ল ফিৎনাসমূহ, ভূমিকম্প ও যুদ্ধ বিগ্রহ। [সুনানে আবু দাউদ : হাদিস নং : ৪৩৭৮]

সুতরাং বুঝা গেলো, দুনিয়াতে কষ্ট, দুঃখ হলেই তার আখেরাত অসুন্দর হবে এটা সর্বৈব মিথ্যা ও ইসলামের চরম অপব্যাখ্যা।

তিন. দুনিয়ার সফল ব্যক্তিরাই কী প্রকৃত সফল?
মানুষের সফলতা বা ব্যার্থতা নির্ভর করে তার আখেরাতোর ফলাফলের ওপর। যে আখেরাতে বিফল তার দুনিয়ার সফলতা কোনোই কাজে আসবে না।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ‘যাদের দুনিয়ার জীবন সফলতাপূর্ণ, আখেরাতে তারাই সফল। দুনিয়ার জীবনে যারা লাঞ্ছিত অপমানিত, আখেরাতের জীবনে তারা আরও অধিক লাঞ্ছিত অপমানিত হবে’। [ধর্ম ব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৪৪]

অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, দুনিয়ার সফলতাই আখিরাতের সফলতার মানদণ্ড।

ইসলাম কী বলে?
হেযবুত তওহীদের এ দাবিটা সর্বৈব মিথ্যাচার এবং পবিত্র কুরআর বিরোধি মন্তব্য। দুনিয়ার সফলতা কোনোক্রমেই আখিরাতের সফলতা নয়। এ সম্পর্কে মহান রব বলেন,
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ كَلَّا لَيُنبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ
বহু দুঃখ আছে প্রত্যেক এমন ব্যক্তির, যে পেছনে অন্যের বদনাম করে (এবং) মুখের উপরও নিন্দা করে। যে অর্থ সঞ্চয় করে ও তা বারবার গুণে দেখে। সে মনে করে তার সম্পদ তাকে চিরজীবি করে রাখবে। কক্ষণও নয়। তাকে তো এমন স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, যা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে। [সুরা হুমাযাহ : ১-৪]

মহান আল্লাহ আরও বলেন,
يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ
যে দিন কোন অর্থ-সম্পদ কাজে আসবে না এবং সন্তান-সন্ততিও না। তবে যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে সুস্থ মন (পরিশুদ্ধ  অন্তর) নিয়ে (সে মুক্তি পাবে)। [সুরা শু’আরা : ৮৮-৮৯]

সম্পদ ও নেতৃত্ব লোভীদের পরকালীন পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِشِمَالِهِ فَيَقُولُ يَالَيْتَنِي لَمْ أُوتَ كِتَابِيَهْ- وَلَمْ أَدْرِ مَا حِسَابِيَهْ- يَالَيْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِيَةَ- مَا أَغْنَى عَنِّي مَالِيَهْ- هَلَكَ عَنِّي سُلْطَانِيَهْ- অতঃপর(কিয়ামতের দিন) যার বাম হাতে আমলনামা দেওয়া হবে, সে বলবে, হায়! যদি আমি আমার আমলনামা না পেতাম এবং আমি আমার হিসাব না জানতাম। হায়! যদি মৃত্যুই আমার জন্য চূড়ান্ত হতো। আজ আমার সম্পদ কোন কাজে আসল না। আমার ক্ষমতা আজ ধ্বংস হয়ে গেলো। [সুরা আল হা-ক্কাহ : ২৫-২৯]

সুতরাং বুঝা গেলো, পার্থিব সফলতা আখেরাতের সফলতা নয়, বরং পরিশুদ্ধ অন্তরই একমাত্র কেয়ামতের সফলতা। এজন্য আলেম-উলামারা সব সময় মানুষকে আখেরাতমুখী বানাতে চান। তবে দুনিয়াদারীর সব কিছু ছেড়ে দিতে হবে এ কথা তারা কখনও বলেন না। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এই মিথ্যা দাবি করে বলে-
সকল ধর্মের অবতার ও মহামানবদের জীবনে রয়েছে শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস অথচ আজকের সমাজের মানুষের ধর্মীয় জীবনের নেতৃত্ব প্রদানকারী ধর্মব্যবসা আলেম পুরোহিতরা মানুষকে কেবল পরকালমুখী হতে শিক্ষা দেন। [মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ৪৬] আলেমরা কখনই মানুষকে শুধু পরকালীন শিক্ষা দেন না, বরং তারা মানুষের হালাল পন্থায় দুনিয়া উপার্জনেও উদ্ভুদ্ধ করে থাকে। কিন্তু এটা ঠিক যে আলেমরা মানুষকে আখেরাতমুখী হতে বেশি উদ্ভুদ্ধ করেন। কারণ মানুষের আখেরাতের সম্বলই বড় সম্বল।

উপরন্তু আলেমরা নবিজি সাঃ-এর ওয়ারিশ। আর নবিজি সাঃ আদর্শ শুধুমাত্র আখেরাতমুখি লোকদের। মহান রব বলেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيهِمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَمَن يَتَوَلَّ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা কর, তোমাদের জন্য তাদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জানা উচিত যে, আল্লাহ বেপরওয়া, প্রশংসার মালিক। [সুরা মুমতাহিনা : ৬]

এজন্য রাসুলুল্লাহ সাঃ দুনিয়ার জ্ঞান অর্জনে অগ্রগামী ব্যক্তিদের সমালোচনা করে বলেছেন,
إنّ اللهَ يُبغِضُ كلَّ جَعْظَريٍّ جوّاظٍ سخّابٍ بالأسواقِ جِيفةٍ باللَّيلِ حِمارٍ بالنَّهارِ عالِمٍ بأمرِ الدُّنيا جاهلٍ بأمرِ الآخِرةِ.
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক কর্কশভাষী, অহংকারী, বাজারে চিৎকারকারী, রাতের বেলায় অলস, দিনের বেলায় কর্মঠ, দুনিয়ার বিষয়ে অভিজ্ঞ ও পরকাল বিষয়ে অজ্ঞদের ঘৃণা করেন। [সহিহ ইবনে হিব্বান : ৭২]

সেহেতু আলেমরা মানুষকে আখেরাতমুখী করে নিজেদের দায়িত্ব পালনে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের এ কাজের সমালোচনা করে তারা মূলত চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণ হলো, দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগ ও সফলতা মূল নয়, মূল হলো, আখেরাতের সফলতার প্রচেষ্টা করা। এ প্রচেষ্টায় বহু পরীক্ষা আসবে, সেটাকেও নিয়ামত মনে করে ধৈর্য ধারণা করে ঈমানের উপর অটল থাকা। এটাই ইসলাম। কিন্তু এটার স্ম্পূর্ণ বিপরীতমুখী কথা বলে হেযবুত তওহীদ মূলত অমুসলিম সেটারই প্রমাণ দিয়েছে।

চার. আত্মশুদ্ধি কী সফলতার পথ নয়?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, এই ঘোর সংকটমুহূর্তে স্বার্থপরের মত শুধু নিজেদের আত্মশুদ্ধি, নিজেদের পরকাল নিয়ে চিন্তা করলে হবে না। পরকালের মুক্তির শর্ত হচ্ছে দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। [মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ৭৪; জঙ্গিবাদ সংকট : পৃ. ৭৫]

সমাজের অশান্তি দূর করার জন্য প্রচেষ্টা না করে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আমল করলে, এই স্বার্থপরতা আত্মকেন্দ্রিক ভালো মানুষের কোন জান্নাত নেই। [তাকওয়া ও হেদায়া : পৃ. ১০-১১]

অর্থাৎ তারা বলতে চায়, দুনিয়ার সফলতার দিকে ফিকির না করে আত্মশুদ্ধি করে আখিরাতে সফল হওয়া যাবে না।

ইসলাম কী বলে?
অথচ আখিরাতে সফল একমাত্র তারাই, যারা নিজেকে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে রবের সামনে দাঁড়াবে। আত্মশুদ্ধ না করে দুনিয়ার সকল সফলতা উপস্থিত করলেও কিয়ামতে সে ধিকৃত হবে। মহান রব বলেন,
يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ
যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না। কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে। [সুরা শু’আরা : ৮৮-৮৯]

قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّى
নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে আত্মশুদ্ধ হয়। [সুরা আ’লা : ১৪]

قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا
যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। [সুরা শামস : ৯-১০]

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন,
إِنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদ দেখেন না। তিনি দেখেন তোমাদের হৃদয় ও কর্ম। [সহিহ মুসলিম : হাদিস নং : ২৫৬৪]

সুতরাং উপরিউক্ত তিনটি আয়াত ও হাদিস থেকে জানতে পারলাম, সফলতার মূল কেন্দ্র হলো মানুষের পরিশুদ্ধ অন্তর। কিন্তু হেযবুত তওহীদের কাছে সফলতার মূল কেন্দ্র দুনিয়াবি সফলতা। এখন আপনারাই বলুন হেযবুত তওহীদ কী আল্লাহপাকের দল না শয়তানের দল?

পাঁচ. পরকালের বিষয়টা কী মূল কাজ নয়?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম, তাদের বিশ্বাস হলো, দুনিয়ায়ই সব। আর এজন্যই তারা আখিরাতের বিষয়টি একেবারেই তাচ্ছিল্যের নজরে দেখে। দেখুন তারা কী বলে?
আমরা বলি না যে, আপনারা আল্লাহ বিশ্বাসী হয়ে যান, মো’মেন হয়ে যান, পরকালে বিশ্বাসী হয়ে যান, আল্লাহর প্রতি কে ঈমান আনবে কে আনবে না আনবে সেটা তারা আল্লাহর সঙ্গে বুঝবে। সুতরাং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করানো আমাদের কাজ নয়। [শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৫২]

প্রিয় পাঠক, আল্লাহপাকের প্রতি ঈমানই যাদের মিশন নয়, তাদের আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসস্থাপন করানোর মিশন না হওয়ারই কথা। কারণ তারা তো আর মুসলিম নয়।

Check Also

মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা:

আল্লাহ’র দ্বীনের একমাত্র হিফাযতকারী শিক্ষাব্যবস্থা হলো, মাদরাসা। যেখানে দিবানিশি আল্লাহ তাআলার কুরআন ও তাঁর রাসুল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.