নফসের প্রকারভেদ ও পরিচর্যা।

আলোচক:
হযরতুল আল্লাম শাহ মুফতী আব্দুল ওয়াহীদ কাসেমী দা.বা.।
মুহতামিম: জামিয়া ইমদাদিয়া দারুল উলূম মুসলিম বাজার মাদরাসা মিরপুর-১২ ঢাকা।

الحمد لله الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفره ونؤمن به ونتوكل عليه ونعوذ بالله من شرور انفسنا ومن سيأت اعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلله فلا هادي له ونشهد الا اله الا الله وحده لا شريك له ونشهد ان سيدنا وسندنا وحبيبنا ومولانا محمدا عبده ورسوله اما بعد فاعوذ بالله من الشيطان الرجيم بسم الله الرحمن الرحيم
يا ايها الذين امنوا اتقوا الله حق تقاته ولا تموتن الا وانتم مسلمون
وقال رسول الله صلي الله تعالي عليه وسلم الناس علي دين خليله فلينظر احدكم من يخالل او كما قال عليه الصلوة والسلام سبحانك لا علم لنا الا ما علمتنا انك انت العليم الحكيم سبحان الله وبحمده سبحان الله العظيم لا اله الا الله الحليم الكريم سبحان الله رب العرش العظيم

আল্লাহ জাল্লা জালালুহু ওয়া তা’আলা শানুহু আমাদের সকলকে মাফ করে দেন। আমাদের অন্তরাত্মার মধ্যে তাঁর মারিফাত ও মহব্বত দান করেন। আমীন!

আমার ভাই, সুরা ইউসুফের মধ্যে হযরত ইউসুফ আ. এর একটি কথা আল্লাহ তা’আলা উল্লেখ্য করেছেন। একজন পায়গম্বর হয়ে এমন কথা বলতে পারবেন। যাঁদের ব্যাপারে আমাদের আক্বীদা হলো, তাঁরা নিস্পাপ, তাঁদের কোনো গুনাহ নেই। আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে নিস্পাপ করে বানিয়েছেন। নিস্পাপ করে এজন্য বানিয়েছেন, কারণ তাঁরা হলেন আল্লাহর সমস্ত বান্দাদের মুক্তাদায়ে কওম তথা হিদায়াতের রাস্তা দেখানোর পথিক বা রাহবার। আল্লাহ পাকের বান্দারা যাঁদেরকে অনুসরণ করবে। যাঁদেরকে দেখে দেখে শিখবে, আল্লাহ পাককে চিনবে। উনারা আল্লাহ পাকের সিফাতগুলিকে দুনিয়ার মানুষের সামনে এগুলো প্রকাশ করবেন যে, আল্লাহ পাকের কত গুনাবলী রয়েছে।

আমাদের দেশে যখন কোনো ক্যান্ডিডেট বা প্রার্থী ইলেকশনে দাঁড়ায়, সে প্রার্থীর পক্ষ থেকে তার লোকেরা তার কি বৈশিষ্ট্য, যোগ্যতা বা কার্যক্রম, সামনে তিনি কি কি উন্নয়ন সমাজকে উপার দেবেন, উনার লোকেরা সবার সামনে এগুলো পেশ করে। সামনে করুক বা পেছনে করুক। মানুষও শুনতে চায়, জানতে চায় যে, আমাদের যিনি প্রতিনিধিত্ব করবেন, উনার পরিকল্পনা কি? উনি কি বাস্তবায়ণ করবেন, উনার সামনের কার্যত্রম কি হবে। এগুলো তার লোকেরা বলে, জনগণ শোনে এবং তার আগের পরের সব ইতিহাস বিচার বিশ্লেষণ করে যদি তার সব কিছু মানুষের কাছে ভালো লাগে, মনপুত হয় তখন তাকে সমর্থন করে, ভোট দেয়, আসার সুযোহই করে দেয়। প্রার্থীও বলে, একবার একটু সুযোগ দেন আমাকে। দিয়ে দেখেন, আমি আপনাতের জন্য কিছু করি কি না?

একজন মেম্বার, চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য এমন করে। আরও উঁচু পর্যায়ে যেতে কত লবিং করে, তার পক্ষ থেকে লোকেরাও গিয়ে তার সম্পর্কে বলে। এমনও বলে, অমুকের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র। এগুলো কেন বলে? এজন্যই বলে, মানুষের যেন আস্থা বা বিশ্বাস করে।

আমাদের দেশীয় নিয়মেও ইন্টারন্যশনাল ল’ হিসাবে কোনো প্রার্থী যদি কোনো ক্রাইম করে এবং দেশীয় আইনে ফৌজদারী মামলায় আদালতে যদি সে দোষী সাব্যম্ত হয়, তাহলে সেই প্রার্থী তার সদস্য পদের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। এমনকি সে রানিং কোনো পদে থাকলেও সেখান থেকেও তাকে বহিস্কার করা হয়। কারণ যার জিবনে কালি বা দাগ রয়েছে সে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এটা দুনিয়ার ল’ বা দুনিয়ার নিয়ম। অথচ সামান্য এক দুনিয়ার। যার ব্যাপারে আল্লামা আলুসী রহ. বলেন,
এই دنیا শব্দটা دنو থেকে  مشتاق আর دنیا بوزن فعلي অর্থাৎ دنیا মানে القرب (কাছে)। কিসের কাছে? اي قريب عن زوال অর্থাৎ দুনিয়া হলো, যেটা খুব শিগগিরি ধ্বংশ হয়ে যাবে। এটা অস্তিত্ব একবারেই শেষ হয়ে যাবে। কখন? যখন ইসরাফিল আ. শিঙ্গায় ফুঁ দেবেন। তখন কিয়ামত কায়েম হবে, কিচ্ছু থাকবে না। তবে

كل شيئ هالك الا وجهه

অর্থাৎ সব কিছু শেষ হয়ে শুধুমাত্র মাওলায়ে পাকের অস্তিত্ব বাকি থাকবে।

ما عندكم ينفذ وما عند الله باق

অর্থাৎ তোমাদের কাছে যা কিছু আছে, সব শেষ হয়ে যাবে। শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে যা আছে, সেগুলোই বাকি থাকবে।

সেই আল্লাহ পাকের জাতের বর্ণনা যারা দেবেন, যেই আল্লাহ আসমান-যমীনের স্রষ্টা, যিনি রাত-দিনের স্রষ্টা, সূর্য-চন্দ্রের স্রষ্টা, গাছ-পালা,তরুলতা সব কিছুর স্রষ্টা, যিনি ছিলেন, আছেন, সব সময় থাকবেন, حي لا يموت যিনি সব সময় আছেন, কখনও মৃত্যুবরণ করবেন না, لا تاخذه سنة ولا نام যাঁর কোনো ঘুম বা তন্দ্রাও আসে না। যিনি এত সুন্দর করে নির্ভুলভাবে পৃথিবীকে বানিয়েছেন চ্যালেঞ্জ করেছেন, ما تري في خلق الرحمن অর্থাৎ আমি আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে কোনো খুঁত দেখাতে পারবে? নিশ্চয় না। فارحع البصر هل تري আবার দেখো, আবার দেখো কোনো ত্রুটি দেখাতে পারবে? বরং, যত দেখবে তত আমার সৃষ্টি তোমার কাছে সুন্দর লাগতে থাকবে। এজন্যই এক কবি বলেছেন, তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর, না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর! অর্থাৎ আল্লাহ, আপনার চাঁদ-সুর্য, আসমান-যমীন, এই আকাশের নীলিমা, সমুদ্র, সমুদ্রের ঢেউ, সমুদ্রের পাড়ের দৃশ্য যদি এত মনোরম হয়, এই পাহাড় ও পাহাড়ের সমুজ শ্যামলীমা যদি এত সুন্দর হয়, পাহাড়ের উচ্চতা যদি এত সুন্দর হয়, পাহাড়ের উপরটা বরফ দিয়ে ঢেকে দেওয়াটা যদি এত সুন্দর হয়, হে আল্লাহ তাহলে আপনি নাজানি কত সুন্দর! সুবহানাল্লাহ!

যেই পাখি এত সুন্দর করে বানিৃযেছেন, একেক পাখির একেক রং,  পাখির ডানার এক রং, পাখির, মাথার এক রং, পাখির পিছন এক রং, পাখির ডাক একেক রকম, একেক পাখির কণ্ঠের মধুরতা একেত রকম, আয়ে আল্লাহ, নাজানি আপনার কণ্ঠ কত সুন্দর!

এমনিতেই আল্লাহ বলেননি ما تري في خلق الرحمن الخ
াববার দেখো আবার দেখো।

আমাদের কাছে মানুষের বানানো এক জিনিষ বারবার ভালো লাগে না, মা বোনেরা দোকানে গিয়ে ব্যবসায়ীকে বলে, নতুন কোনো ডিজাইন এসেছে? নতুন কোনো কাপড় এসেছে? খাট মিস্ত্রিকে বলে মিস্ত্রি সাহেব, খাটের নতুন কোনো ডিজাইন আছে? নতুন খাট বানিয়ে দিন, নতুন আলমারী বানিয়ে দিন, নতুন পোশাক বানিয়ে দিন।
পাশের বিল্ডিং হয়েছে,  ইঞ্জিনিয়ারকে বলা হয়, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, এই ডিজাইন যেন না হয়, নতুন ডিজাইন করে বানিয়ে দিন।

কিন্তু আমার ভাই, দুনিয়ার যতবড় ইঞ্জিনিয়ার যত সুন্দর করে বানাক না কেন, একবার না একবার অস্বস্তি লাগে, কিন্তু আমার আল্লাহ যা কিছু বানিয়েছেন, যেভাবে বানিয়েছেন, যতবার ব্যবহার করেন, যেভাবে ব্যবহার করেন, যত কোটি বার ব্যবহার করেন সেটাকে কোনো বিরক্তি আসবে না।

এই চাল তো কতবার খেয়েছি, কই একবারও তো বিরক্ত লাগলো না। কারণ এই চালে এমন এক জাতের ছোঁয়া লেগেছে لا مثل له ولا  مثيل له
ولم يكن له كفوا احد

যাঁর সমকক্ষ কেউ নেই, যাঁর তুলনা কেউ নেই, যাঁর মত করে কেউ কিছু করতে পারে না। সেই হাতের ছোঁয়া যার ভেতর লেগেছে, সেই জিনিষ আপনি আমি যতবার ব্যবহার করি না কেন, ততই আসক্তি বাড়তে থাকবে। শুনেছেন আজ পর্যন্ত, সাধারণ এক পানি, আপনান যত পিপাসা আসবে ততই পানির প্রতি আসক্তি বাড়বে। কারণ এটা কার সৃষ্টি? আল্লাহর। তাঁর সৃষ্টি যিনি حي قيوم এমন এক জাত الذي يعطي بدون الاستحقاق والمنة
الذي يتفضل علينا بلا مسئلة ولا وسيلة
الذي يتفضل علينا فوق ما نتمني به

আল্লাহ তো সেই জাত, যিনি আমাদের জন্মের আগ থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো যোগ্যতা ছাড়া কোনো ইহসান ছাড়া শুধু দিয়েই যাচ্ছেন। উনি কে? তিনিই আল্লাহ। কেন দেন? রাসুলুল্লাহ সা. এক হাদিসে বলেছেন। ওয়াহ সুবহানআল্লাহ!

لولا رجال خشع  وشيوخٌ رُكَّعٌ وأطفالٌ رُضَّعٌ وبهائمُ رُتَّعٌ لصُبَّ عليكم العذابُ صبًّا

অর্থাৎ আল্লাহ যমীনে যদি এমন কিছু বান্দা না থাকতো, যাঁদের চোখ দিয়ে পানি বের হয়।

ওহ্হো! কান্নাকাটি বড় আজীব জিনিষ, দুআ বড় আজীব জিনিষ।

ইমাম বুখারী রাহি. ছোট্র বেলায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, উনার মা একদিন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছিলেন। স্বপ্নে হযরত ইবরাহীম আ. কে দেখলেন তিনি বলছেন,

يا هذه قد رد الله على ابنك بصره لكثرة بكائك – أو كثرة دعائك

অর্থাৎ হে মহিলা, শোনো, তোমার অধিক কান্নাকাটি ও দুআর ফলে আল্লাহ তা’আলা তোমার বাচ্চার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন।
সূত্র: তারিখে দিমাশক খ. ৫২ পৃ. ৫৬

সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখেন সত্যিই ইমাম বুখারী রাহি. এর দৃষ্টি আল্লাহ তা’আলা ফিরিয়ে দিয়েছেন।

হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.

٣- [عن عامر بن سعد:] عَنْ أبِيهِ، قالَ: لقَدْ رَأَيْتُنِي وأنا ثُلُثُ الإسْلامِ.
البخاري (ت ٢٥٦)، صحيح البخاري ٣٧٢٦  •  [صحيح]  •  شرح رواية أخرى

আমি ইসলামের তৃতীয় ব্যক্তি। ফাতেহে ইরান বা পারস্যের বিজয়ী তিনি বলেন,

ابْكُوا، فإنْ لم تَبْكوا فتَباكَوا

কাঁদো, কাঁদো, কাঁদো। কান্না আসে না? কান্নার ভান করো। কেন?

فإنَّ الدُّعاءَ ينفعُ ممّا نزل وممّا لم ينزِلْ

কারণ, মসিবত যা অতিতে এসেছে এবং সামনে আসবে দুআ-কান্নাকাটির কারণে আল্লাহ পাক সব মিটিয়ে দেন।

এজন্য হাদিসে কুতসীতে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ বলেন,

لولا رجال خشع  وشيوخٌ رُكَّعٌ وأطفالٌ رُضَّعٌ وبهائمُ رُتَّعٌ لصُبَّ عليكم العذابُ صبًّا

অর্থাৎ চার প্রকার বিষয় যদি না থাকতো আমি আল্লাহ এ দুনিৃযাতে ভেনিস করে দিতাম।
১. যারা আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে। আল্লাহ এ পানিকে বড় যত্ন করে রাখেন। এজন্য রাসুলুল্লাহ সা. একটি দুআ শিখিয়েছেন,

٢- [عن عبدالله بن عمر:] اللَّهُمَّ ارزُقْني عينَينِ هطّالتَينِ، تَشفيانِ القلبَ بذُرُوفِ الدموعِ مِن خشيتِك قبل أن تكونَ الدموعُ دَمًا، والأضراسُ جمرًا.
الصنعاني (ت ١١٨٢)، التنوير شرح الجامع الصغير ٣‏/١٦١  •  إسناده حسن

অর্থাৎ হে আল্লাহ, এমন দুই চোখ দেন আমাকে, যা এত কান্নাকাটি করবে যে, চোখের অশ্রু দিয়ে আমার অন্তরকে শিতল করে দেয়।

নবীজি সা. নিজে এ দুআ করেছেন যে, এমন চোখ দেন যে, সেটা অশ্রু ঝরাবে যে, তার পানি দিয়ে আমার অন্তর প্রশান্তি লাভ করবে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে, দীলের মধ্যে প্রশান্তি লাভ হয়।

আমার ভাই, কুতুবে আলম, আরেফ বিল্লাহ শাহ হাকিম মুহাম্মাদ আখতার রাহি. বলেন,

‘যারা বিচক্ষণ তারা বিদ্যুতের বিকল্প হিসাবে জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখে, যেন বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেট চালু করে সাময়ীক বিদ্যুতের কাজ নিতে পারে।’ করাচী হযরত বলেন, ভাই, আমাদের এ জিবন নামক বিদ্যুৎ যেকোনো সময় চলে যেতে পারে। এই বিদ্যুৎ যাওয়ার আগেই যদি আমরা কবর ও আখেরাতের আলোর জন্য কিছু জেনারেটর ব্যবস্থা করে যেতে পারি, তাহলে যিন্দেগীর এই নিয়মিত বিদ্যুৎ চলে গেলে আমলের জেনারেটর দিয়ে আমাদের কবর ও আখেরাতের যিন্দেগীর আলো জ্বলবে। কিন্তু প্রস্তুত তো আগে করতে হবে। না হলে কিভাবে চলবে?

এজন্য নামাজ, তিলাওয়া, জিকির, গুনাহ থেকে বাঁচান ফলে যে নূর তৈরি হয় এই আমলী জেনারেটরগুলো এখন থেকেই যদি প্রস্তুত করতে পারি, তাহলে মৃত্যুর সাথে সাথেই ঐ জেনারেটরগুলো আল্লাহ চালু করে দেবেন।

এজন্য হাদিস শরীফে, কুরআন তিলাওয়াতের ব্যাপারে এসেছে, নামাজের ব্যাপারে এসেছে, জিকিরের ব্যাপারেও এসেছে। (যে এগুলো কবরে, হাশরে নূর হয়ে সামনে আসবে।)

২. وشيوخٌ رُكَّعٌ  অর্থাৎ বৃদ্ধ নামাজী।
৩. وأطفالٌ رُضَّعٌ অর্থাৎ দুধের বাচ্চা।
৪. وبهائمُ رُتَّعٌ অর্থাৎ বেজান জীবজন্তু।

এ চারটি বিষয় না থাকলে আল্লাহ সব তছনছ করে দিতেন। যমীনের মানুষ রক্ষা পাচ্ছে এগুলোর মাধ্যমে। আল্লাহ আমাদেরকে রিজালুল্লাহ হওয়ার তাওফীক দান করেন।وشيوخٌ رُكَّعٌ  অর্থাৎ বৃদ্ধ নামাজী হওয়ার তাওফীক দান করেন। আমীন!

বলছিলাম যে কথা। দুনিয়াতে আল্লাহ পাক যে আম্বীয়ায়ে কেরামকে আ. পাঠিয়েছেন, তাঁরা নিস্পাপ। কারণ দুনিয়ার প্রতিনিধিত্ব যারা করে তারা যদি অপরাধী হলে প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে, তাহলে নবীরা নিস্পাপ হওয়া লাগবে না? অবশ্যই লাগবে। এমন একজন নিস্পাপ নবী হলেন, হযরত ইউসুফ আ.।

আল্লাহ যে সুন্দর মানুষ পাঠিয়েছেন।
কিছু সুন্দর দেখা জায়েয আর কিছু সুন্দর দেখা হারাম। تلك حدود الله فلا تقربوها
এগুলো আল্লাহর সীমা, এগুলোর কাছেও যাওয়া যাবে না। গেলে তোমরা বাঁচতে পারবে না। কারণ রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন,

اعدي اعداءك بين جنبيك

তোমাদের দুই পাশে শত্রু আছে। শত্রুটা কি? ম্যাগনেট। চম্বুক। টানবে না টানবে না? সর্বনাশ! টানবে। এক দুশমন নফস, আরেক দুশমন শয়তান। বলেই যেহেতু দিয়েছেন দুশমন, সুতরাং আমাদের উচিত সেই দুশমন থেকে দূরত্ব অবলম্বন করা।

নবীরা মাসুম (নিস্পাপ)। এমনই একজন নবী হযরত ইউসুফ আ.  এর কথাই আল্লাহ পাক উল্লেখ্য করেছেন যে, ইউসুফ আ. নিজে বলছেন,

وما ابرئ الخ

অর্থাৎ আমি আমার নফসের পবিত্রতা বর্ণনা করতে পারিনা।
এক নবীর কথা এটা।

كچھ ہونا میرا ذلت و خواری کا سبب ہے

উক্ত আয়াতে ان النفس لامارة بالسوء  এখানে ان শব্দটা حرف مشبه بالفعل কেন আনা হলো? অর্থাৎ جملة اسمية কেন আনা হলো? এর জবাব দিয়েছেন আল্লামা সাইয়েদ মাহমুদ আলুসী আল বাগদাদী রহি.। যেহেতু جملة اسمية টা دوام و استمرار তথা সর্বদার অর্থ প্রকাশ করে। সুতরাং  ان النفس لامارة بالسوء বাক্যটা اسمية হয়ে এ কথায় বুঝাচ্ছে যে, আমার আপনার বয়স যদি ১০০ বছরও হয়ে যায়, তখনও এই নফস মানুষকে খারাপ কাজের নির্দেশ দিবে। এমন না যে যৌবনকালে নির্দেশ দেবে কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে দেবে না। এমন না।

রাসুলুল্লাহ সা. এজন্য হাদিস শরীফে বলেন,
মানুষের বয়স বাড়ে কিন্তু চাহিদা সব সময় যৌবন কালের মতই থাকে। কিন্তু পার্থক্য হলো যৌবন কালে সক্ষম থাকে, আর বৃদ্ধকালে অক্ষম থাকে। এ কথা রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন। সত্য না মিথ্যা? সত্য।

এ কথা আল্লাহ পাক পায়গম্বর হযরত ইউসুফ আ. এর মাধ্যমে বলিয়েছেন।

الا من رحم ربي

অর্থাৎ যদি আল্লাহ রহম করেন।

রহমের অর্থ কি? আল্লামা আলুসী রহ. বলেন,

المراد بالرحمة الانعام المخصوص التوفيق للثبات علي الحق

অর্থাৎ রহমত হলো, এমন এক বিশেষ নিয়ামত যার মাধ্যমে আল্লাক পাকের বান্দাকে হক্বের উপরে বা দ্বীনের উপরে অটল এবং অবিচল থাকার সুযোগ দেওয়া হয়।

এর অর্থ হলো, আল্লাহ পাক তাঁর কোনো বান্দাকে যদি সেই হক্বের উপরে থাকার সুযোগ দান করেন, সেই একমাত্র নফসের হাত থেকে বাঁচতে পারে।

বড় আজীব বিষয় হচ্ছে। নফসের এ কথা শুনে কোনো বান্দা যেন হয়রাণ না হয়ে যায়, এজন্য কুরআনে কারীমে আল্লাহ পাক পাঁচ প্রকার নফসের কথা বয়ান করেছেন। কারণ আল্লাহ হলেন, ارحم الراحمين আল্লাহ বলেন,

لا تقنطوا من رحمة الله

অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ হয়ো না।

وَلاَ تَيْأَسُواْ مِن رَّوْحِ اللّهِ إِنَّهُ لاَ يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللّهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ

অর্থ: এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায়, ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না।
সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৮৭

অর্থাৎ আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ হয় একমাত্র কাফেররা।

অনেকে দোহাই দেয় যে, গুনাহ থেকে বাঁচতে চাই, কিন্তু নফসের কারণে বাঁচতে পারি না। অথচ আল্লাহ তা’আলা নিষেধ করেছেন, ‘নফসের দোহাই দিও না।’ এই ছোট বাচ্চাটা বড় হয় না? দুর্বল সবল হয় না? তো যেই নফসে আম্মারার কারণে আপনি আমি গুনাহ থেকে বাঁচতে পারছি না, যে নফসের আম্মারা আপনাকে আমাকে সব সময় গুনাহের নির্দেশে দেয়, আল্লাহ সে নফসের পাঁচ প্রকার বয়ান করেছেন।

বুলাগাদের এসতেলাহ হলো,

الترقي من الادني الي الاعلي

অর্থাৎ নিচের থেকে ওপরে ওঠা।

এক সময় একটা ছেলে কুরআন শরীফ পড়তে পারতো না। এখন এত সুন্দর কুরআন শিখেছে যে, পুরো পৃথিবীতে এক নাম্বার হয়েছে হিফজুল কুরআনে। হয় না?
এক সময় একটা ছেলে মাদরাসায় পড়াকালীন সময়ে কথাই বলতে পারতো না। এখন এমন বলা শিখেছে যে, বাংলাদেশের এক নাম্বার বক্তা হয়ে গেছে। অথচ শুরুতে সে কোনো কথাই বলতে পারতো না। এজন্য আল্লাহ পাক তো বলেছেন,

وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى ثُمَّ يُجْزَاهُ الْجَزَاء الْأَوْفَى
অর্থ: তার কর্ম শীঘ্রই দেখা হবে। অতঃপর তাকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে।
সুরা নাজম, আয়াত: ৪০-৪১

وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَى

অর্থ: এবং মানুষ তাই পায়, যা সে করে,
সুরা নাজম, আয়াত: ৩৯

অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন, মেহনতের ফলাফল মানুষ নিজের চোখে দেখতে পায়। আমাদের মুসলিম বাজার মাদরাসার এক তালেবে ইলম। এক সময় পড়াই পারতো না। সিরিয়াল তো দুরের কথা। কিন্তু এখন শত শত ছেলে আদীব হওয়ার জন্য তার কাছে পড়তে যায়। কিসের মাধ্যমে হলো এটা? চেষ্টা ও মেহনতের মাধ্যমে।

পৃথিবীতে এখন যে অংকেও পড়ানো হয়, যাকে ম্যাথ বলে। এটার আবিস্কারক যিনি, তিনি তো যোগ-বিয়োগও বুঝতেন না। কিন্তু সেই তিনিই বীজগণিত-পাটিগণিতের সূত্র লিখেছে। মানুষ মেহনত করলে কি না পারে?

এজন্য আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে আমার বান্দা, নফসকে আমি আল্লাহই বানিয়েছি। নফসের সঙ্গা দিতে গিয়ে হাকিমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লত শাহ আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেছেন,

مرغوبة طبعية غير شرعية

অর্থাৎ মানুষের তবীয়তগত (স্বভাবগত) এমন কাজ শরীয়তসম্মত না। অর্থাৎ মানুষের স্বভাব একটা চায়, কিন্তু শরীয়ত চায় না। এক কথায় শরীয়ত যেটা চায় না, মেজাজ সেটা চায়। এটার নামই নফস।

আর আল্লামা আলুসী আল বাগদাদী রহ. নফসের সঙগা দিতে গিয়ে বলেন,

النفس كلها ظلمة وسراجها التوفيق

অর্থাৎ নফসের পুরোটাই অন্ধকার। কিন্তু তার চেরাগ (আলো) হলো, ‘তাওফীক।’

তাওফীক কি জিনিষ? এটার সঙগাও তিনি লিখেছেন,

توجيه الاسباب نحو الخير المطلوب

অর্থাৎ তাওফীক হলো, আমাদের জন্য ভালো কাজ করার যা আল্লাহ কর্তৃক উদ্দেশ্যিত সে গন্তব্যে পৌঁছার সামানের ব্যবস্থা সামনে এনে দেওয়া।
সুতরাং নফস পুরাটাই অন্ধকার, কিন্তু তার আলো হলো, তাওফীক। সেই আল্লাহর তাওফীক (রহমত) যখন অন্তরে জ্বলবে, তখন আর নফস কোনও কাজই করতে পারবে না। অর্থাৎ নফস হলো, মন্দ কাজের প্রতি আসক্ত হওয়া, আর তাওফীক এর অর্থ হলো সেই মন্দ কাজ রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া। যেমন শাহ্‌ আবরারুল হক রহ. বলেন, যদি কেউ রাস্তায় বের হয়। বের হওয়ার পর দুটি অবস্থা। ১. রাস্তায় মহিলা থাকতেও পারে, ২. নাও থাকতে পারে। যদি না থাকে তাহলে এটাই তাওফীক।

আমার শায়খ পীর ও মুরশিদ কুতুবে আলম, আরেফ বিল্লাহ, রুমীয়ে যামানা শাহ আব্দুল মতিন বিন হুসাইন দা.বা. থেকে শুনেছি এবং আমার উস্তায আব্দুল হাই পাহাড়পুরী দা.বা. থেকে শুনেছি, হাফেজ্জী হুজুর রহ. যখন তাওয়াক করতেন, তখন সামনে যত যেতেন সামনের জায়গা খালি হয়ে যেতো। এটাই তাওফীক। কারণ এই ভীড়ে সামনে বেগানা নারী থাকলে কুদৃষ্টি হতে পারতো। এটাই হলো তাওফীক।

এমনিভাবে মনে করুন, কেউ মার্কেটে যাবে। মার্কেটে তো বেগানা নারী থাকে। তো এখানে তাওফীক হলো, এই অন্ধকারে যারা থাকলে গুনাহ হতে পারতো, আল্লাহ তাদেরকে সরিয়ে দেবেন। এটাই তাওফীক।

তো নফসের পরিচয় হলো,

النفس كلها ظلمة وسراجها التوفيق

অর্থাৎ নফসের পুরোটাই অন্ধকার। কিন্তু তার চেরাগ (আলো) হলো, ‘তাওফীক।’

আর তাওফীক হলো,

توجيه الاسباب نحو الخير المطلوب

অর্থাৎ তাওফীক হলো, আমাদের জন্য ভালো কাজ করার যা আল্লাহ কর্তৃক উদ্দেশ্যিত সে গন্তব্যে পৌঁছার সামানের ব্যবস্থা সামনে এনে দেওয়া।

আমার ভাই, আল্লাহ পাকের কাছে দুআ করি, আল্লাহ আমাদেরকে বাঁচার তাওফীক দান করেন। আমাদেরকে বুঝার তাওফীক দান করেন।

নফস বানিয়েছেন কে? আল্লাহ। এই চাহিদা বানিয়েছেন কে? আল্লাহ। নফস মানেই শরীয়ত বিরোধী চাহিদা। এটা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে, মৃত্যু পর্যন্ত থাকবে। কিন্তু আল্লাহ পাক বলেছেন, এটার দোহাই দিয়ে তুমি বলো না যে, আমি পারি না। মেহনত করতে হবে।

নফসে আম্মারার কাজ হলো,

لامارة بالسوء

অর্থাৎ খারাপ কাজের নির্দেশ দেয়। কিন্তু এই নফসের আম্মারা আবার لامارة بالخير হয়ে যাবে। অর্থাৎ তখন এই নফস ভালো কাজের নির্দেশ দেবে। এজন্য কুরআনুল কারীমে একটা হলো, নফসে আম্মারা আরেকটি হলো নফসের লাওয়ামা।

নফসে লাওয়ামা হলো, যে নফস তাঁর অতীতের খারাপ কাজের জন্য তিরস্কার করতে থাকে। কুরআনে কারীমে আল্লাহ পাক বলেন,

فلا اقسم بالنفس اللوامة

তো নফসটা যখন আম্মারা ছিলো, কিন্তু আল্লাহ পাকের বান্দারা মেহনত করে তওবা করে, তওবা করে, তওবা করে এমন পর্যায়ে চলে গেছে, ঐ নফসটাই এখন বান্দার পূর্বের কর্মের জন্য নিজেকেই মালামাত (তিরস্কার) করতে থাকে। ঐ নফসটা এত দামী যে, খোদ আল্লাহ ঐ নফসের কসম করেছেন।

فلا اقسم بالنفس اللوامة

এক কথায় যে নফসটা এক সময় খারাপ কাজের নির্দেশ দিতো, সেই নফসটাই এখন অতীত কর্মের জন্য তিরস্কার করতে থাকে। মানুষ কিন্তু এক সময় অতীতের জন্য আফসোস করে। যেমন হাদিসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ পাক বলেন,

لانين المذنبين احب الي من زجل المسبحين

অর্থাৎ যারা আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করতে থাকে, তাদের চেয়ে ঐ সকল লোকজন আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়, যারা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। তো যখন আল্লাহর বান্দারা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন, তখন ওই নফসে আম্মারা নফসে লাওয়ামা হয়ে যায়। এজন্য ইউসুফ আ. বলেছেন,

الا من رحم ربي

অর্থাৎ আল্লাহর রহম যখন বান্দা পেয়ে যায়, তখন সে নফসটা আর খারাপের দিকে নিতে পারে না।

নফসে আম্মারাকে লাওয়ামা বানানোর কিছু আমল:

নফসে আম্মারা কে নফসে লাওয়ামা বানানোর কিছু আমল নবীজি সা. বাতলে দিয়েছেন,

এক.

اللهم باعد بيني وبين خطايا

অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাকে এবং আমার গুনাহের মাঝে পূর্ব থেকে পশ্চিমে দূরত্বের মত দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। কারণ বান্দা যখন গুনাহ থেকে দূরে সরে যায় তখন গুনাহ থেকে বাঁচবে না গুনাহ করবে? নিশ্চয় বাঁচবে। অবশই বাঁচবে।

দুই.

اللهم ارحمني بترك المعاصي

তিন.

اللهم لا تشقني بمعصيتك

আচ্ছা, আল্লাহ যদি এমন কাউকে দূরে সরিয়ে দেন, যার সাথে গুনাহ হতো। মদ খাওয়ার কথা ছিলো মদের থেকে সরিয়ে দিলেন। মেয়েদের সাথে গুনাহ হতো, তাকে সরিয়ে দিলেন, যেই ছেলেদের সাথে গুনাহ হতো, তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিলেন। আল্লাহ পারেন? না পারেন না? অবশ্যই পারেন। আল্লাহ যদি দূরে সরিয়ে দেন, তাহলে গুনাহ হবে? হবে না। কিন্তু হ্যাঁ। আল্লাহ বলেছেন,

تلك حدود الله فلا تقربوها

অর্থাৎ হারাম জিনিষের আসবাব সামনে রাখলে গুনাহ হবে না, এটা হবে না। কারণ দুই পাশে দুই চুম্বুক আছে। নফস আর শয়তান। এই দুই চুম্বুক যদি এদিক সেদিক করি তাহলে গুনাহের দিকে আমাদেরকে টেনে নিয়ে যাবে। এর থেকে বাঁচার জন্য الا من رحم ربي রহমত লাগবে। আর রহমত পাওয়ার জন্য এই দুআগুলো লাগবে।

চার.
ربنا لا تزغ قلوبما

পাঁচ.
يا حي يا قيوم …طرفة عين

মাঝে একটা কথা ভুলে গেছিলাম। জুলাইখাকে ইউসুফ আ. এর উপর আসক্ত হয়েছিলো। মিশরের মহিলারা তাঁকে তিরস্কার করতে লাগলো, ধিক্কার দিতে লাগলো যে, ইউসুফ এমন কি হলো যে তোমার তার প্রতি এত আসক্ত হতে হবে? মনে রাখবেন সৌন্দর্যের একটা আকর্ষণ আছে কিন্তু। এটা অস্বীকার করা যাবে না। কেউ যদি বলে, আরে, কিচ্ছু হবে না, একটু দেখি না। আল্লাহ পাক বলেছেন,

قل للمؤمنين يغضوا من ابصارهم

রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, মিশকাতের কিতাবুন নিকাহের প্রথম হাদিস

يا معشر الشباب من استطاع منكم الباءة الخ
اغض للبصر و احفظ للفرج

অর্থাৎ হে যুবকেরা, তোমরা সামর্থ্যবান হলে বিবাহ করে নাও। কারণ এটা তোমাদের চোখ অবনমিত রাখবে এবং লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আরেকটা রেওয়াতে এসেছে,

রাস্তায় চলার সময় যদি কোনো নারীর উপর হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যায়, আর যদি তার কাছে তাকে ভালো লাগে, তাহলে সে যেন সাথে সাথেই ঘরে চলে যায়। কারণ সে যখন তার স্ত্রীর সাথে বিশেষ কাজটা করবে তখন তার ভেতরে সে চাহিদা ছিলো সেটা আল্লাহ দূর করে দেবেন। রাসুলুল্লাহ সা. এটা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য শরীয়াতের যে বিধান, আমরা যদি বাঁচতে চাই, তাহলে সেগুলো অবলম্বন করা লাগবে। এখন যদি কেউ বলে যে, না, সুন্দরের কোন আকর্ষণ নাই, তো যাই একটু দেখি।

اتحوظ عليهم الشيطان فانساهم ذكر الله

নবীজি সা. হযরত আলী রা. কে বললেন,
يا علي …وليست لك الآخرة

অর্থাৎ হে আলী, কোনো নারীর উপর যদি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যায়, তাহলে সেটা ক্ষমা করা হবে। কিন্তু ২য় বার আর তাকাবে না। কারণ প্রথম দৃষ্টিপাত অনিচ্ছায় হয়,কিন্তু ২ য় দৃষ্টিপাত ইচ্ছাকৃত হয়। কারো দিকে হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে গেলো বা মোবাইলের স্ক্রীনে কোনো মেয়ের ছবি চলে আসলো তো সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নেবে। আর তাকাবে না। কারণ এ ২য় বার দেখলে কি হবে তা শাহ আবরারুল হক রহ. বলেন, সে আর বাঁচতে পারবে না,বরং সামনে আরও যতগুলো স্টেপ আসবে সে দেখতেই থাকবে, দেখতেই থাকবে। এজন্য আল্লাহর হুকুম হলো, তুমি তোমার দৃষ্টি অবনত রাখো, দেখো না। কারণ আল্লাহ জানেন যে, সে যদি একবার দেখে, তাহলে দেখতেই থাকবে।

والله خبير بما يصنعون

তো সায়্যিদুনা হযরত ইউসুফ আ. অনেক সুন্দর ছিলেন। কিন্তু মিশরের ঐ মহিলারা বিশ্বাস করেননি

فلما سمعت بكرهن …فلما راينه الخ

এখানে মুফাসসিরিনে কেরাম লিখেছেছেন যদি فلما راينه না হতো, তাহলে হাত কাটা লাগতো না।

…ما هذا بشرا

তাদের হাতে ছুরি আর কমলা লেবু ছিলো।  তো কমলা কি কাটবে তারা হাত কেটে ফেলেছিলো।

এই আয়াতের তাফসীরে মুফাসসিরিনে কেরাম লিখেছেন, সুন্দরের একটা আকর্ষণ রয়েছে। এটা কেউ অবিশ্বাস করতে পারবে না। কেউ যদি বলে, আচ্ছা একটু দেখি, মন ভালো তো সব ভালো, মনের পর্দা বড় পর্দা চোখের আবার কিসের পর্দা! না না না। বরং চোখের পর্দা আসল পর্দা, চোখের পর্দা হবে তো আসল পর্দা হবে। চোখের পর্দা যদি না করে, তাহলে মনের পর্দাও হবে না। কারও যদি চোখ হেফাযত না থাকে, তার লজ্জাস্থানের হেফাযত হবে না।

আমার ভাই, কম্পিউটারে কেউ যদি কিছু লেখে, সেটা ডিলেট করা যায়, ব্লাকবোর্ডে কিছু লিখলে মুছা যায়, খাতার মধ্যে কলম দিয়ে কিছু লিখলে ফ্লুইট দিয়ে মোছা যায়, কিন্তু এই চোখ দিয়ে কেউ যদি কিছু দেখে ওটা আর ডিলেট হয় না, মোছে না। বরং দেখা ছবিটা কলবের মধে বসে যাবে। ওটা একমাত্র আল্লাহই মিটাতে পারেন। এজন্য বেশি বেশি যখন কেউ এস্তেগফার করে, ঐ দুআগুলো পড়ে তখন নফসটা আম্মারা থেকে লাওয়ামা হয়, আর যখন নিজেকে তুচ্ছ ভাবতে শুরু করে, অতীত জিবনের পাপের জন্য কান্নাকাটি করতে থাকে, তখন ঐ নফসটা লাওয়ামা থেকে মুতমায়িন্না হয়ে যায়।

الا بذكر الله تطمين القلب القلوب

আজ কাফিয়ার সবক নিলো ছাত্ররা। কাফিয়ার শুরুতে যে ইবারতগুলো আসছে, এখানে শারিহীনে কেরাম লিখেছেন, ছাত্র তিন প্রকার। ১. গবী অর্থাৎ যার যে একেবারেই দুর্বল মেধা তেমন কিছুই নেই। ২. আওসাদ বা মুতাওয়াসসিত অর্থাৎ মধ্যম মেধাবী ৩. যকী অর্থাৎ খুব মেধাবী।

কিন্তু যে ছেলেটার একদম মেধা নেই, সেই ছেলেটাও মেহনত করতে করতে এক সময় ভালো হয়ে যায়। যেমন আমাদের এমরান। মানুষের মেধা নারিকেলের মত। নারিকেলের ভেতর যে সাদা অংশটা থাকে, যেটা আমরা খাই, তার উপর একটা শক্ত আবরণ থাকে। ওটা ফাটালেই ভেতরের সাদা অংশটা বেরিয়ে আসে। তো প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহ তা’আলা মেধা দিয়ে পাঠান। কিন্তু সে মেধাটাকে মেহনত করে বের করে আনতে হয়। ঠিক তেমনি নফসে আম্মারা مرغوبة طبعية غير شرعيه টাও এক সময় شرعية হয়ে যায়। অর্থাৎ শরীয়া বিরোধী মনের চাহিদাে উপর মেহনত করলে এক সময় সে চাহিদাটাও শরীয়াসম্মত হয়ে যায়।
কখন? যখন ঐ দুআগুলো পড়া হয়, দুআ-ইস্তেগফার করা হয়, আহলুল্লাদের সোহবত উঠানো হয়।

এজন্য রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ. কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, হযরত, হাজী সাহেবের কাছে আসার পর আপনার কি ফায়দা হয়েছে? তিনি জবাবে বলেছিলেন, طبیعت شریعت بن گئی অর্থাৎ আমার তবীয়ত তথা স্বভাব এখন শরীয়ত সম্মত হয়ে গেছে।
আমার معلومات (জানা বিষয়গুলো) এখন  معمولات (আমলে পরিনত) হয়ে গেছে.। অর্থাৎ আগে যা জানতাম তা এখন আমলে পরিনত হয়ে গেছে, আহে শরীয়তের যে বিষয়গুলো কষ্টসাধ্য ছিলো তা এখন অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে।

তো নফস এক সময় আম্মারা ছিলো, যখন মেহনত করতে থাকে আর নিজেকে তিরস্কার করতে থাকে, তখন সেটা লাওয়ামা হয়ে যায়, আর যখন দুআ-কান্নাকাটি করতে থাকে তখন মুতমায়িন্না হয়ে যায়। জেনারেটর যেমন বিদ্যুতের কাজ দেয়, তেমনই দুনিয়ার যিন্দেগীতে আলো সঞ্চয় করে নেওয়া। এজন্য এক বুযুর্গ বলেছেন,

جاگنا ہے جاگ لو افلاک کے

মিয়া, এখন এত ঘুমিয়ো না, একটু জাগো, একটু কান্নাকাটি করো।

বুখারী শরীফের ২য় খন্ডে একটি হাদিস এসেছে,

١- [عن أبي مسعود:] مَن قَرَأَ بالآيَتَيْنِ [يعني: مَن قَرَأَ بالآيَتَيْنِ مِن آخِرِ سُورَةِ البَقَرَةِ في لَيْلَةٍ كَفَتاهُ] البخاري (ت ٢٥٦)، صحيح البخاري ٥٠٠٨  •  [صحيح]

কি যথেষ্ট হবে? আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, কয়েকটি জিনিষের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।
এক.
সারা রাত তাহাজজুদ পড়ার সওয়াব অর্জিত হবে।
দুই.
প্রথম রাকাতে প্রথম আয়াত ২য় রাকাতে শেষ আয়াত পড়লে তার নামাজ হয়ে যাবে। (প্রথম রাকাতে সুরা বাকারা পড়ার সওয়াব ২য় রাকাতে সুরা আলে ইমরান পড়ার নেকী)
তিন.
সুরা কাহাফ পড়লে / আয়াতুল কুরসী পড়ার সওয়াব অর্জিত হয়।
চার.
রাতের সকল অনিষ্ঠতা (চুরি-ডাকাতী বা আগুন লাগা ইত্যাদী) থেকে আল্লাহ হিফাযত করবেন।

তাহলে আপনার আমার জন্য এই দুনিয়া ঘুমিয়ে থাকার জায়গা না, এখানে মেহনত করার জায়গা। সুতরাং দুর্বল ছাত্র মেহনত করে যেমন মেধাবী হয়ে যায়, ঠিক তেমনি নসফের উপর যখন মেহনত করা হয়, তখন সেটা আম্মারা থেকে ওয়াওয়ামা হয়ে যায়, এরপর লাওয়ামা থেকে মুতমাইন্না হয়ে যায়। এই মুতমায়িন্না নফসটি যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে তখন জান্নাতে যাওয়ার আগে আল্লাহ তা’আলা বলবেন,

يا ايتها النفس المطمئنة الخ

সুবহানাল্লাহ! মুতমায়িন্না নফসকে আল্লাহ বলবেন আমি আর তুমি তোমার রবের কাছে পৌঁছো খুশি খুশি পৌঁছো। আগে ছিলো আম্মারা পরে হলো লাওয়ামা পরে হলো মুতমাইন্না এখন হলো রাদিয়া। রাদিয়া আগে না মারদিয়্যাহ আগে? কুতুবে আলম আরিফ বিল্লাহ শাহ আব্দুল গনি ফুলপুরী রহ. বলেন আল্লাহ এখানে বান্দার খুশিকে নিজের খুশির আগে এনেছেন। এর মানে হলো, দুনিয়াতে বান্দা যখন নিজের খুশির চেয়ে আল্লাহর খুশি কে প্রাধান্য দেবেন, তো কিয়ামতেও আল্লাহ নিজের খুশির আগে বান্দার খুশিকে প্রাধান্য দিবেন। কারণ কোনো বাবা যখন বাচ্চাকে কোন খেলনা এনে দেয়, তো জিজ্ঞেস করে, বাবা; তুমি কি খুশি?বাচ্চা যদি বলে যে, জি বাবা আমি খুশি। তখন বাবা বলেন, তুমি যেহেতু খুশি তো আমিও খুশি। ঠিক আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতে বান্দাকে বলবেন, তুমি কি খুশি? বান্দা যখন বলবেন যে, হে আল্লাহ, আমি খুশি। তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার খুশিতে আমিও খুশি। তোমার খুশিতে আমিও খুশি। তুমি যা চাও, আমি সব তোমাকে দিয়ে দিলাম।

আমার ভাই, এখন আপনি বলুন, আমরা কি সেই নফসে আম্মারার দোহাই দেবো? নাকি একটু মেহনত করব? সুযোগ দিয়েছেন কিনা? সুতরাং ঐ নফসে আম্মারাটা লাওয়ামা, মুতমাইন্না, রাদীয়া, মারদিয়া হতে পারে কিনা? যদি হতে পারে তাহলে একটু মেহনত করি। কিভাবে মেহনত করব? আল্লাহপাক শিখিয়ে দিয়েছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ

অর্থ: হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক।
সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০২

শেষে একটা মজার কথা বলবো। মাসিক মহিলাদের হয় না পুরুষের? মহিলাদের। যদি বলেন যে, হুজুর, এ আলোচনা এ মজলিসে কেন? বলতে হবে তো গুরুত্বপূর্ণ কথা। আল্লামা রুমী রহ. বলেছেন, পুরুষদেরও মাসিক আছে। কি এক আজিব কথা না! এখন তো কওমি মাদরাসায় ফার্সি উঠিয়ে দিয়েছে! কি আফসোস! কত উলূম যে ফার্সি ভাষায় রয়েছে। আমাদের আকাবিরদের কিতাবের মধ্যে আছে। সব কি আরবিতে আছে? ওয়াহব সুবহানাল্লাহ! ফার্সীর কুরআন বলা হয় মসনবীকে। আল্লাহ পাকের মহব্বতের এক আটলান্টিক মহাসাগর। অথচ ফার্সি পড়ায় না। তাহলে আমাদের ছেলেরা এগুলো কোত্থেকে পাবে। এরা খোঁড়া আলেম হবে।  শুধু আরবী শিখে, আরবি বলে। কিন্তু রুহ নেই। আমাদের বড়দের ওই ফার্সীর মধ্যে রুহ ছিল। তো আল্লামা রুমী রহ. বলেন, মেয়েদের যেমন মাসিক রয়েছে, ছেলেদেরও তেমন মাসিক রয়েছে। উনি এটার এবারত বা দলিল বলেছেন,

فاتقوا فان الهوا حيض الرجال

অর্থাৎ মহিলাদের মাসিকের সময় রক্ত বের হয়, হঠাৎ যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বুঝে নিতে হবে যে, পেটে কোন বাচ্চা জন্ম নিচ্ছে। অর্থাৎ পেটে যখন বাচ্চা আসে তখন রক্ত বন্ধ হয়। তো আল্লামা রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন যে, ভাই, আল্লাহকে ভয় করো। কারণ মানুষের যে খায়েশাত বা নসফের চাহিদা রয়েছে, এটা পুরুষের হায়েয বা মাসিক। যখন কারো থেকে এই চাহিদা বন্ধ হয়ে যাবে, তখন বুঝতে তার মধ্যেও রুহ পয়দা হচ্ছে। অর্থাৎ যার খারাপ চাহিদা তাকে খারাপের দিকে নেয় না, যার খারাপ চাহিদা তাকে পস কোয়াটারের দিকে নেয় না, যার চাহিদা তাকে বান্ধবীদের কাছে নেয় না। যার খারাপ চাহিদা তাকে নারী-পুরুষের হারাম কাজের দিকে নেয় না, মদের বারের দিকে নেয় না , কোনো হারাম জিনিষ দেখার দিকে নেয় না, বুঝতে হবে তার মাসিক (খারাপ চাহিদা) বন্ধ হয়ে গেছে, তার মধ্যে রুহ পয়দা হয়ে গেছে, তা’য়াল্লুক মাআল্লাহ তথা আল্লাহ পাকের সাথে তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে, আর এ জাতীয় বান্দাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা. শুধু নন, হাদীসে কুদসীতেও এসেছে,

سبق المفردون الذين لا لذة لهم بغير ذكره ولا نعمة لهم الا بشكره

মফাররিদুন ঐ সমস্ত লোকদেরকে বলা হয়, যাঁদের আল্লাহর যিকির বা স্বরণ করা ছাড়া কিছু ভালো লাগে না,

دل مضطرب كا يه حال ہے تیرے بے سکون ہے نہ آرام ہے

অর্থাৎ আয়ে আল্লাহ, আমারে ব্যথিত দিলের এ অবস্থা আপনাকে ছাড়া আর কোন শান্তি লাগেনা, ভিতরে কিছু ভালো লাগে না। এজন্য আল্লামা রুমী রহ. বলেছেন, একজন হলো আলেমে মানযিল আরেকজন হলো বালেগে মানযিল অর্থাৎ এক হচ্ছে যে, জায়গাতে চিনে ঘরকে চিনে, আরেক হচ্ছে যে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। শাহ আব্দুল গণী ফুলপুরী রহ. বলেছেন যে, মিয়া মাদারেসে পড়ার দ্বারা আলেমে মানযিল হওয়া যায়, আর আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবতের দ্বারা বালেগে মানযিল হওয়া যায় তথা মানযিল পর্যন্ত পৌঁছা যায়। কিতাব পড়ার দ্বারা আলেমে মানযিলে মাওয়ায়ে পাক হওয়া যায়, আর আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবতে গেলে বালেগে মানযিলে খোদাওয়ান্দী হওয়া যায় অর্থাৎ আল্লাহ পাক পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। যেমন কোন ডিম লক্ষ বছর পড়ে থাকলেও বাচ্চা হবে না, যতক্ষন না ২১ দিন পর্যন্ত মুরগির তাও না পায়। কোন মানুষ যতবড় আলেম হোক, যতবড় শাইখুল হাদিস হোক, মুফতি-মুহাদ্দিস হোক, যদি কোনো আহলুল্লাহ’র সহবত উঠাতে না পারে আমার ভাই, খোদাে কসম ঐ বান্দর রুহ বালেগ হবে না কখনও। ওই বান্দার রুহ আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না। আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছানোর একমাত্র রাস্তা হলো, যাঁরা বড়দের সোহবত উঠিয়ে আল্লাহ তা’আলা পর্যন্ত পৌঁছেছেন, তিনি যেই হোন না কেন বড় শাইখুল হাদিসও না কিন্তু তার তা’আল্লুক মাআল্লাহ নসীব হয়েছে, মুফাররিদুরদের তবকায় পৌঁছে গেছে, এরকম কোনো আহলুল্লাদের  সোহবত যদি কেউ উঠায়, তাহলে ডিম যেমন মুরগীর নিচে তাও নিয়ে বাচ্চা ফোটে তেমনি এই সোহবত নেওয়া বান্দাগুলোর রুহও বালেগে হয়ে যাবে, মাওলা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। এজন্য ডক্টর আব্দুল হাই রহ. বলেছেন,

اسے ملنے کی ہے یہی یک راہ کہ ملنے والوں سے راہ پیدا کر

অর্থাৎ আল্লাহ ওয়ালা যদি হতে চাও, তাহলে আল্লাহওয়ালাদের সোহবত উঠাও, ফলে এক মুহূর্তে তুমি আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। এরা কারা? যারা সকাল-বিকাল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র যরব লাগায়। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ কোন জিনিস? রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,

ولا إلهَ إلّا اللهُ ليس لها دونَ اللهِ حجابٌ

অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তো এমন এক অস্ত্র, এই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ কোন বান্দা যবান থেকে বের হয়ে সরাসরি এটা আরশে আজীম ভেদ করে আরো উপরে চলে যায়। আল্লাহর কাছ থেকে রহমত এনে ওই বান্দর দীলের উপরে পৌঁছে দেয়।

گردانے رحمت تو

আল্লামা রুমী রহমতুল্লাহি বলেছেন

گفت پیغمبر کے چو

আল্লাহ পাক আমাদেরকে ঐ রকম হওয়ার তাওফিক দান করেন। আমার ভাই, সকাল-বিকাল নফী-ইসবাতের যিকির না ছাড়া। কারণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ আল্লাহর কাছ থেকে রহমত এনে দীনের উপর নাযিল করে। এজন্য ওই সমস্ত আহলুল্লাহদের কাছে যেতে হয়। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র যরব দ্বারা যাঁদের অন্তর সবসময় গরম থাকে। ওই গরম অন্তর ওয়ালাদের সোহবতে যারা যাবে, অতি অল্প সময়ে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে নেবেন।

قریب جلتے ہوئے دل کو

অনেক মানুষ আবার বলেন, হুজুর, এটা কি বলেন? দীলের তাওয়াজ্জুহ আবার পৌঁছে? কোথায় পেলেন আপনারা দীলের তাওয়াজ্জুহ? কোথায় আল্লাহওয়ালাদের দীল, তার শরীর কোথায় আর আল্লাহ তাআলার অন্য বান্দাদের শরীর কোথায়? হযরত আব্দুল গনি ফুলপুরী রহ. বলেছেন, মিয়া, বোঝো না? শরীর আলাদা থাকতে পারে, ক্বলব আলাদা থাকতে পারে, কিন্তু

একজনের আলো আরেকজন পর্যন্ত পৌঁছায়। কেমনে? যেমন দুটি বাতি জালানো হয়েছে। কোনোটার আলো কম, আর কোনোটার বেশী। কারণ সব টিউব লাইটের আলো সমান না। হযরত বলেন, পাশাপাশি যদি ২ টি লাইট জ্বালানো হয়, তো যে বাতির আলো কম হয়, সেই বাতির আলোর বেশি আলোওয়ালা বাতি মেকাপ করে দেয়। তো ঠিক আল্লাহ তা’আলার যে বান্দার অন্তরের মধ্যে আনোয়ারাত যত বেশি হবে, কম নুর ওয়ালা লোক যদি তার কাছে পৌঁছে, তাহলে সেই নূরের কমতি বেশি নুরওয়ালা মেকআপ করে দেবে।

সুতরাং আল্লাহ তাআলা বলেছেন

يا ايها الذين امنوا اتقوا الله حق تقاته الخ

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,

٢- [عن أبي هريرة:] المرءُ على دينِ خليلِه فلينظرِ المرءُ مَن يُخالُّ
ابن عدي (ت ٣٦٥)، الكامل في الضعفاء ٤‏/١٧٨  •  فيه بعض النكرة [فيه] زهير بن محمد أرجو أنه لا بأس به  •  أخرجه أبو داود (٤٨٣٣)، والترمذي (٢٣٧٨)، وأحمد (٨٣٩٨) باختلاف يسير، وابن عدي في «الكامل في الضعفاء» (٣/٢١٨) واللفظ له

মানুষ যাদের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

আমার ভাই, তাহলে গুনাহ ছাড়বো তো ইনশাআল্লাহ? নাকি নফসের অজুহাত দেবো? নফসে আম্মারা কি হবে? লাওয়ামা, তারপর মুতমায়িন্না, মুতমায়িন্না যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে? প্রথমে রাদিয়া, তারপর মারযিয়্যাহ। আর ঐ দোয়াগুলো করব বেশি বেশি। আর গুনাহের কাছেও যাব না। গুনাহের কাছে গেলে? ওই দুই শয়তান আছে তো, চুম্বক দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে। গুনাহ করিয়ে দেবে। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

تلط حدود الله

আল্লাহ তাআলা সীমারেখা বলে দিয়েছেন গুনাহের কাছেও যাওয়া যাবে না। গেলে আপনি আমি আর বাঁচতে পারবো না। যেমন বাঁচতে পারেনি মিশরের ঐ মহিলাগুলো। যদি না আসতো, না দেখতো তাহলে হাত কাটতো না। আপনার-আমার দ্বারা গুনাহ হবে না, নফসও দাঁড়াতে পারবে না, শয়তানও  করাতে পারবে না, যদি আপনি আমি আল্লাহর কথা মানি। সেটা কি? এই চোখ দিয়ে দেখবো না। দেখলেই আল্লাহর রাসূলের সা. বদদোয়া লেগে যাবে,

لعن الله الناظر

ঐ বদ দু’আ যদি লেগে যায়, যেখানে আল্লাহ রাসুলের সা. বদদোয়া আছে সেটা লাগবে নানা লাগবেনা? আর মনে চায়, লা’নত যখন আসবে, রহমত তখন আসতে পারবে না। কারণ

اجتماع ضدين محال

সুতরাং লানত থেকে বাঁচার জন্য এই চোখ দিয়ে দেখা যাবে না। চোখ থেকে বাঁচতে গেলে কষ্ট হবে একটু। কি কষ্ট? নফসের উপরে যে চোট লাগে হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, নফসের উপরে যত বেশি চোট লাগে, ঐ পরিমান রুহের তারাক্কী হয়। নফসের উপরে যদি এক মন প্রেসার পড়ে, তাহলে রুহ এক মন উপরে ওঠে। ১ মনের বাটখারা যদি এক পাল্লায় রাখা হয়, আর অন্য পাল্লায় যদি কিছুই না থাকে তাহলে সেটা উপরে ওঠে না ওঠে না?  ওঠে। হযরত হাকীমুল উম্মত থানবী রহ. বলেন, তোমার নফসের উপরে গুনাহ না করার বাটখারা চাপিয়ে দাও। বদনেগাহী বা খারাপ দৃষ্টি থেকে বিরত থাকার কষ্ট চাপিয়ে দাও, মন কে মন যত কষ্টের পাথর চাপিয়ে দেবে এটার উপরে, তোমার রুহ কমবেশি তারাক্কী করে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। সুবহানাল্লাহ। কারণ এক পাল্লা খালি থাকলে আরেক পাল্লা উপরে উঠবেই। থানবঅ রহ. এর কথা এটা ভাই।

গুনার না করলে অন্তরের উপরে কষ্ট কিন্তু একটা লাগেই। ঐ কষ্টটা কিন্তু নফসের উপরে অনেক ভারি হয়ে যায়। পাহাড়ের চেয়েও ভারি হয়ে যায়। নফসের উপরে বোঝা যত পড়বে, তার রুহ তত শক্তিশালী হতে থাকবে, তত দ্রুত আল্লাহর কাছে চলে যাবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে এ কথাগুলো বুঝে পুরাপুরি আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

واخر دعونا ان الحمد لله رب العالمين صلي الله علي النبي الكريم

বয়ানের স্থান:
ইসহাকিয়া কারিমিয়া মুহিউস সুন্নাহ মাদরাসা
বোর্ডবাজার, গাজীপুর সদর।
০২ ই যিলকদ ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক ০৩ ই জুন ২০২২ ঈসায়ী।
মাধ্যম: মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ।

Check Also

বয়ান নাম্বার (১)*** ২৪-১০২০১৯ বৃহস্পতিবার। আলোচক: হযরতুল আল্লাম শাহ মুফতী আব্দুল ওয়াহীদ কাসেমী দা.বা.। মুহতামিম: …

One comment

  1. চমৎকার আলোচানা। খুবই ভালো লাগলো । অনেক উপকারী কথা। আল্লাহ শায়খের হায়াতে বারাকাহ দান করুন। আমীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.