হেযবুত তওহীদের কাছে উলামায়ে কেরাম হলো ‘ধর্মব্যবসায়ী’। এর কারণ হিসাবে তারা উল্লেখ্য করেছেন, দ্বীনের কাজ করে অর্থকড়ি গ্রহণ করা। অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, ইমামতি করে, ওয়াজ করে, কুরআন পড়িয়ে এক কথায় দীনের সকল কাজে আলেমরা টাকা নেন একারণে আলেমরা ধর্মব্যবসায়ি। মূলত তাদের কাছে ধর্মের যেকোনো কাজের বিনিময় নেওয়া হারাম। চলুন তারা কী দাবি করেছে, তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
১. যেকোনো ধর্মীয় কাজে অর্থগ্রহণ করা হারাম।
২. ধর্মীয় কাজে বিনিময় নিলে ধর্ম বিকৃত হয়ে যায়।
৩. যারা ধর্মীয় কাজ করে অর্থ নেয়, তারা পথভ্রষ্ট আলেম।
৪. নবিজি সাঃ এর যামানায় ধর্মীয় কাজে লেনদেন হতো না।
৫. মাদরাসায় পড়িয়ে, ইমামতি করে, ওয়াজ করে অর্থগ্রহণ বৈধ নয়।
৬. ইমামদের বেতন দেওয়া জায়েয নয়।
৭. ইমামতি করে বেতন নেওয়া দূর্ণিতীর অন্তর্ভুক্ত।
৮. আযান দিয়ে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ নয়।
৯. যারা ইমামতি করে টাকা নেন, তাদের পেছনে নামাজ পড়া যাবে না।
১০. ধর্মীয় কাজে অর্থগ্রহণ যারা জায়েয করেছে, তারা মুসলিম নয়।
চলুন, প্রত্যেকটি বিষয়ে এবার প্রমাণসহ আলোচনা করা যাক।
ধর্মের বিনিময় গ্রহণ করা কী হারাম?
তাদের দাবি হলো, দীনের যেকোনো কাজ করে মূল্য গ্রহণ করা হারাম। দেখুন তারা কী বলে-
ধর্মের কাজ করে কেউ কোন অর্থ গ্রহণ করবেন না। কারণ আল্লাহ তা হারাম করেছেন। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ১৭৬
ধর্মের কোন কাজ করে নবী ও রসূলরা কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না। সুতরাং তাদের অনুসারী উম্মতের জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ নয়। -প্রিয় দেশবাসী, পৃ. ৮৫
অনন্যপায় হলেও দীনের বিনিময় গ্রহণ করে খাওয়া বৈধ নয়। এমনকি মরে গেলেও আল্লাহর দ্বীনের বিনিময়ের স্বার্থ হাসিল করা, অর্থ রোজগার করে একে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে, পৃ. ২৭
ধর্মের কাজ করে কেউ কোন অর্থ গ্রহণ করবেন না। কারণ আল্লাহ তা হারাম করেছেন। ধর্মের বিনিময় নিলে সেটা বিকৃত হয়, ফলে ধর্মের নামে অধর্ম প্রচলিত হয়। ধর্ম মানুষের কল্যাণে চেয়েও অকল্যাণে বেশি ব্যবহৃত হয়। ধর্ম দ্বারা স্বার্থ সিদ্ধি করা জন্যই ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে ভুল পথে পরিচালিত করার সুযোগ পায় যার পরিণামে সৃষ্ট হয় সহিংসতা ও বিদ্বেষ। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১৭৬
অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, ইসলামের কোনো কাজ করে অর্থ গ্রহণ করা হারাম।
ইসলাম কী বলে?
শরীয়তে কুরআন শিক্ষা দিয়ে, ইমামতি করে, আযান দিয়ে, দ্বীনী তা‘লীম দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা এবং অন্যের নিকট দ্বীন প্রচার অর্থাৎ ওয়াজ মাহফিল করা ইত্যাদির মাধ্যমে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েজ আছে তবে খেয়াল রাখতে হবে উক্ত অর্থ গ্রহণ যেন উদ্দেশ্য না হয়, বরং উদ্দেশ্য হতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আর উপরোক্ত কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বা কমিটি যথাযথ সম্মানীর ব্যবস্থা করলে বা সেটা গ্রহণ করলে হারাম হবে না। বরঞ্চ জিহাদ হেযবুত তওহীদের কাছে ইসলামের প্রধান কাজ বলে স্বীকৃত। হেযবুত তওহীদ বলে থাকে, ‘নামাজ, রোযা, হজ্ব বা যাকাত ইত্যাদী কোনো ইবাদত নয়, বরং মূল ইবাদত হলো, জিহাদ করা এবং এ জিহাদকে তারা মুসলমানদের প্রধান কর্তব্য হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। তারা লিখেছে-
আল্লাহর জীবনব্যবস্থাকে সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে মুসলিমদের সর্বপ্রথম এবং সর্ব প্রধান কর্তব্য।-শোষণের হাতিয়ার, পৃ. ৯২
বুঝা গেলো, হেযবুত তওহীদের কাছে তাদের ধর্মীয় প্রধান কাজ হলো, জিহাদ।
জিহাদ করে গনীমতের মাল নেওয়া যাবে?
হেযবুত তওহীদের কাছে ইসলামের মুল কাজ বলে বিবেচ্য জিহাদ করে মুজাহিদদের জন্য গনীমতের মাল গ্রহণ করাকে কুরআন-সুন্নাহ’য় জায়েয বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সরাসরি পবিত্র কুরআনের দু’টি আয়াত দেখুন-
فَكُلُواْ مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلاَلاً طَيِّبًا وَاتَّقُواْ اللّهَ إِنَّ اللّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
সুতরাং তোমরা খাও গনীমত হিসাবে তোমরা যে পরিচ্ছন্ন ও হালাল বস্তু অর্জন করেছ তা থেকে। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, মেহেরবান। [সুরা আনফাল : ৬৯]
وَاعْلَمُواْ أَنَّمَا غَنِمْتُم مِّن شَيْءٍ فَأَنَّ لِلّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ
আর এ কথাও জেনে রাখ যে, কোন বস্তু-সামগ্রীর মধ্য থেকে যা কিছু তোমরা গনীমত হিসাবে পাবে, তার এক পঞ্চমাংশ হল আল্লাহর জন্য, রসূলের জন্য, তাঁর নিকটাত্নীয়-স্বজনের জন্য এবং এতীম-অসহায় ও মুসাফিরদের জন্য। [সূরা আনফাল : ৪১]
উক্ত আয়াতে মুজাহিদদের জন্য এমনকি নবিজির সাঃ জন্য গণীমতের মালকে হালাল ঘোষণা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। সুতরাং বুঝা গেলো, পবিত্র কুরআনের আয়াতে জিহাদ থেকে অর্জিত গণীমতের মাল খোদ রাসুলুল্লাহ সাঃ এর জন্যও হালাল করা হয়েছে। এটা শুধু আমাদের কুরআন শরীফ থেকে নয়, বরং হেযবুত তওহীদের বই থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায়। তারা লিখেছে,
প্রত্যেক নবীরই নিজ নিজ পেশা ছিল আবার উপার্জনের পথ হচ্ছে জেহাদ। -ধরব্যবসার ফাঁদে, পৃ. ৬৯
নবীজি বলেছেন আমি যুদ্ধের নবী, আমি দয়ার নবী, আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগের জন্য তলোয়ার দিয়ে পাঠানো হয়েছে, আর আমার রেযেক রাখা হয়েছে বল্লমের ছায়ার নিচে। -বিকৃত সুফিবাদ, পৃ. ৫৬
সুতরাং বুঝা গেলো, গণীমতের মাল মুজাহিদদের জন্য হালাল। এ কথা আমরা মুসলমানরা যেমন মানি, ঠিক তেমনি হেযবুত তওহীদরাও স্বীকার করে। তাহলে হেযবুত তওহীদের কাছে সর্বশ্রেষ্ট দ্বীনি কাজ বলে বিবেচিত জিহাদ করার পর অর্জিত গণীমতের মাল গ্রহণ করা কী ধর্মের বিনিময় নেওয়ার শামিল নয়? সেটা কিভাবে তারা জায়েয হলো বলেন তো? এটা কী মূর্খতা নয়?
ধর্মের বিনিময় নিলে কী ধর্ম বিকৃত হয়ে যায়?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ধর্মের যেকোনো কাজ করে অর্থ উপার্জন করলে ধর্ম বিকৃত হয়ে যায়। তারা লিখেছে-
ধর্মের বিনিময় নিলে সেটা বিকৃত হয়, ফলে ধর্মের নামে অধর্ম প্রচলিত হয়। ধর্ম মানুষের কল্যাণে চেয়েও অকল্যাণে বেশি ব্যবহৃত হয়। ধর্ম দ্বারা স্বার্থ সিদ্ধি করার জন্যই ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে ভুল পথে পরিচালিত করার সুযোগ পায় যার পরিণামে সৃষ্ট হয় সহিংসতা ও বিদ্বেষ। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ১৭৬
ইসলাম বিক্রি করেন অর্থ সালাতের (নামাজ) ইমামতি করে, জুমার ঈদের ইমামতি করে, তারাবি পড়িয়ে, মিলাদ পড়িয়ে, জানাজা পড়িয়ে, ধর্মের ওয়াজ করে, ফতোয়া দিয়ে আরও নানাভাবে টাকা-পয়সা আদান করেন। -মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ১২
ধর্ম যেন বিকৃত না হতে পারে সে জন্য আল্লাহ সর্বকালেই ধর্মের বিনিময় গ্রহণকে হারাম করেছেন। -সবার ঊর্ধ্বে মানবতা পৃষ্ঠা-৭
ধর্ম ব্যবসা নির্মল হলেই ধর্মান্ধতা, ধর্মের অপব্যবহার, কুসংস্কার, জঙ্গিবাদ সবকিছু নির্মূল হবে। কারণ এটাই ধর্মের নামে প্রচলিত যাবতীয় বিকৃতির মূলউৎস। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ১৬৬
অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, ধর্মের কাজ করে বিনিময় নিলে ধর্ম বিকৃত হয়ে যায়।
ইসলাম কী বলে?
এ ব্যাপারে জানার আগে জানতে হবে হেযবুত তওহীদের কাছে ধর্ম আসলে কী? মূলত হেযবুত তওহীদের কাছে ধর্ম হলো, ‘মানবসেবা’। অর্থাৎ হেযবুত তওহীদের কাছে ইসলাম আসল ধর্ম নয়, বরং মানবতার সেবা করাই হলো ধর্ম। এ ব্যাপারে তারা লিখেছে-
মানুষের ধর্ম কি? মানুষের ধর্ম হচ্ছে মানবতা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি অন্যের দুঃখ কষ্ট হৃদয়ে অনুভব করে এবং সেটা দূর করার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায় সে-ই ধার্মিক। অথচ প্রচলিত ধারণা হচ্ছে যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট লেবাস ধারণ করে সুরা কালাম, শাস্ত্র মুখস্থ বলতে পারে, নামাজ-রোযা,পূজা, প্রার্থনা করে সে-ই ধার্মিক। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ৪৫
বুঝা গেলো হেযবুত তওহীদের কাছে ধর্ম হলো ‘মানবতা’ অর্থাৎ ইসলাম নয়, বরং মানবসেবাই প্রকৃত ধর্ম।
মানবসেবা করে কী অর্থ নেওয়া যায়?
চলুন এ ব্যাপারে প্রথমেই একটি হাদিস দেখা যাক। হযরত আবূ সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
انْطَلَقَ نَفَرٌ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي سَفْرَةٍ سَافَرُوهَا حَتَّى نَزَلُوا عَلَى حَىٍّ مِنْ أَحْيَاءِ الْعَرَبِ فَاسْتَضَافُوهُمْ، فَأَبَوْا أَنْ يُضَيِّفُوهُمْ، فَلُدِغَ سَيِّدُ ذَلِكَ الْحَىِّ، فَسَعَوْا لَهُ بِكُلِّ شَىْءٍ لاَ يَنْفَعُهُ شَىْءٌ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ لَوْ أَتَيْتُمْ هَؤُلاَءِ الرَّهْطَ الَّذِينَ نَزَلُوا لَعَلَّهُ أَنْ يَكُونَ عِنْدَ بَعْضِهِمْ شَىْءٌ، فَأَتَوْهُمْ، فَقَالُوا يَا أَيُّهَا الرَّهْطُ، إِنَّ سَيِّدَنَا لُدِغَ، وَسَعَيْنَا لَهُ بِكُلِّ شَىْءٍ لاَ يَنْفَعُهُ، فَهَلْ عِنْدَ أَحَدٍ مِنْكُمْ مِنْ شَىْءٍ فَقَالَ بَعْضُهُمْ نَعَمْ وَاللَّهِ إِنِّي لأَرْقِي، وَلَكِنْ وَاللَّهِ لَقَدِ اسْتَضَفْنَاكُمْ فَلَمْ تُضِيِّفُونَا، فَمَا أَنَا بِرَاقٍ لَكُمْ حَتَّى تَجْعَلُوا لَنَا جُعْلاً. فَصَالَحُوهُمْ عَلَى قَطِيعٍ مِنَ الْغَنَمِ، فَانْطَلَقَ يَتْفِلُ عَلَيْهِ وَيَقْرَأُ (الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ) فَكَأَنَّمَا نُشِطَ مِنْ عِقَالٍ، فَانْطَلَقَ يَمْشِي وَمَا بِهِ قَلَبَةٌ، قَالَ فَأَوْفَوْهُمْ جُعْلَهُمُ الَّذِي صَالَحُوهُمْ عَلَيْهِ، فَقَالَ بَعْضُهُمُ اقْسِمُوا. فَقَالَ الَّذِي رَقَى لاَ تَفْعَلُوا، حَتَّى نَأْتِيَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَنَذْكُرَ لَهُ الَّذِي كَانَ، فَنَنْظُرَ مَا يَأْمُرُنَا. فَقَدِمُوا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرُوا لَهُ، فَقَالَ ” وَمَا يُدْرِيكَ أَنَّهَا رُقْيَةٌ ـ ثُمَّ قَالَ ـ قَدْ أَصَبْتُمُ اقْسِمُوا وَاضْرِبُوا لِي مَعَكُمْ سَهْمًا
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একদল সাহাবী কোন এক সফরে যাত্রা করেন। তারা এক আরব গোত্রে পৌঁছে তাদের মেহমান হতে চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। সে গোত্রের সরদার বিচ্ছু দ্বারা দংশিত হল। লোকেরা তার (আরোগ্যের) জন্য সব ধরনের চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই কোন উপকার হল না। তখন তাদের কেউ বলল, এ কাফেলা যারা এখানে অবতরন করেছে তাদের কাছে তোমরা গেলে ভাল হত। সম্ভবত, তাদের কারো কাছে কিছু থাকতে পারে। ওরা তাদের নিকট গেল এবং বলল, হে যাত্রীদল। আমাদের সরদারকে বিচ্ছু দংশন করেছে, আমরা সব রকমের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই উপকার হচ্ছে না। তোমাদের কারো কাছে কিছু আছে কি? তাদের (সাহাবীদের) একজন বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম আমি ঝাড়-ফুঁক করতে পারি। আমরা তোমাদের মেহমানদারী কামনা করেছিলাম, কিন্তু তোমরা আমাদের জন্য মেহমানদারী করনি। কাজেই আমি তোমাদের ঝাড়-ফুঁক করবো না, যে পর্যন্ত না তোমরা আমাদের জন্য পারিশ্রমিক নির্ধারণ কর। তখন তারা এক পাল বকরীর শর্তে তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হল।
তারপর তিনি গিয়ে আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন (সূরা ফাতিহা) পড়ে তার উপর ফুঁ দিতে লাগলেন। ফলে সে (এমন ভাবে নিরাময় হল) যেন বন্ধন থেকে মুক্ত হল এবং সে এমনভাবে চলতে ফিরতে লাগল যেন তার কোন কষ্টই ছিল না। (বর্ণনাকারী বলেন) তারপর তারা তাদের স্বীকৃত পারিশ্রমিক পুরোপুরি দিয়ে দিল। সাহাবীদের কেউ কেউ বলেন, এগুলো বণ্টন কর। কিন্তু যিনি ঝাড়- ফুঁক করেছিলেন, তিনি বললেন এটা করবো না, যে পর্যন্ত না আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট গিয়ে তাঁকে এই ঘটনা জানাই এবং লক্ষ্য করি তিনি আমাদের কি হুকুম দেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে ঘটনা বর্ণনা করলেন। তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তুমি কিভাবে জানলে যে, সূরা ফাতিহা একটি দূয়া? তারপর বলেন, তোমরা ঠিকই করেছ। বণ্টন কর এবং তোমাদের সাথে আমার জন্যও একটা অংশ রাখ। এ বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসলেন। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ২২৭৬
অপর বর্ণানায় আছে, সাহাবায়ে কেরাম রা. নবিজি সাঃ কে বললেন,
يا رَسولَ اللَّهِ أخَذَ على كِتابِ اللَّهِ أجْرًا
হে আল্লাহর রাসূল, তিনি আল্লাহর কিতাবের উপর পারিশ্রমিক গ্রহণ করেছেন। তখন রাসুলুল্লাহ বললেন,
إنَّ أحَقَّ ما أخَذْتُمْ عليه أجْرًا كِتابُ اللَّهِ
যে সকল জিনিসের উপর তোমরা বিনিময় গ্রহণ করে থাক, তন্মধ্যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করার সবচেয়ে বেশি হক রয়েছে আল্লাহর কিতাবের। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং-৫৭৩৭
এ হাদিসটি দলিল হিশাবে প্রথমেই আনার কারণ হলো, এই হাদিসটিতে এমন একটি বিষয় রয়েছে, যাকে হেযবুত তওহীদ ধর্ম বলে আখ্যায়িত করে অর্থাৎ মানবসেবা করে অর্থ গ্রহণ করা। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের রা. একটি দল জনৈক দংশিত ব্যক্তিকে চিকিৎসা করে বিনিময়ে বকরী গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ মানবসেবা করে বিনিময় গ্রহণ করেছিলেন। প্রশ্ন হলো, সাহাবায়ে কেরামের রা. এ কাজটি কী সঠিক ছিলো? জবাব হেযবুত তওহীদই দিচ্ছে-
ঝাড়ফুঁক করে সাহাবীদের অর্জিত সেই খাদ্য থেকে নবীজী বললেন তাদের নিকট থেকে তা নিয়ে নাও এবং তোমাদের সঙ্গে আমার জন্যও একটা অংশ রেখো। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে, পৃ. ৮২
চিকিৎসা কার্যের বিনিময় গ্রহণ করা আল্লাহ বৈধ করেছেন। এক সাহাবী সূরা ফাতিহা পড়ে ফু দিয়ে অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসা করেছিলেন এবং বিনিময়ে নিয়েছিলেন। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে পৃ:৮১
তাহলে হেযবুত তওহীদের কাছে ধর্ম বলে স্বীকৃত ‘মানবসেবা’ করে বিনিময় গ্রহণ করা যদি জায়েয হয়, তাহলে মুসলমানদের কাছে ধর্ম হিশাবে স্বীকৃত ইসলামের কাজ করে বিনিময় নিলে সে ধর্ম বিকৃত হয় কীভাবে?
যারা দ্বীনের বিনিময় নেয়, তারা কী পথভ্রষ্ট আলেম, ও জাহান্নামী?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, যে সকল আলেমগণ ধর্মের কাজের বিনিময় অর্থ স্বার্থ গ্রহণ করে তারা নিজেরাই পথচ্যুত। একজন পথ ভ্রষ্ট মানুষ কি করে আরেক ব্যক্তিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে? একি সম্ভব? সুতরাং ধর্মজীবী পেশাদার আলেমদের কাছে যারা মুক্তি পথের সন্ধান করবে, তারাও পথভ্রষ্ট হবে, তারাও জাহান্নামে যাবে। -প্রিয় দেশবাসী, পৃ. ৮১
সবচেয়ে ঘৃণ্য অবস্থা এই মুসলিম বোলে পরিচিত জনসংখ্যার আলেমদের। নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য ক্ষমতাসীন অথবা বিরোধী শক্তির সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তারা মুহূর্তে মুহূর্তে ধর্মীয় সিদ্ধান্ত বা ফতোয়া পরিবর্তন করেন। ধর্মকে বিক্রি কোরে টাকা উপার্জন করেন, অথচ ধর্মব্যবসা সকল ধর্মে নিষিদ্ধ। টাকার জন্য হালালকে হারাম- হারামকে হালাল কোরতে এইসব ধর্মজীবি আলেম ওলামাদের এক মূহুর্তও দেরি হয় না। -আসুন সিস্টেমটাকেই পাল্টাই : পৃ. ৯
এ জাতির আলেমদের যে অংশটি দীনের বিনিময় নিতে শুরু করলো, তাঁরা আর ন্যায়ের উপর দন্ডায়মান থাকতে পারলেন না। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৪১
ধর্মব্যবসা এমন এক জঘন্য অপরাধ যার দ্বারা বিশ্বাসী মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাদের এত নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত জিকির-আজকার কোনো কিছুরই কোন প্রতিদান তারা আল্লাহর কাছ থেকে পাবে না। কেননা বিকৃত ধর্মটি জাল নোটের মত, দেখতে একই রকম হলেও বিনিময় যোগ্য নয়। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৬৫
যারা ধর্মকে রুটি-রুজির মাধ্যম বানাবে তারা এতই ঘৃণিত প্রাণী যে আখেরাতে তাদের দিকে আল্লাহ দৃষ্টিপাতও করবেন না। -মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ৩১
পবিত্র কোরআনে ধর্মের কাজ করে বিনিময় গ্রহণ করাকে পথভ্রষ্টতা ও জাহান্নামের কারণ বলা হয়েছে। -হলি আর্টিজেনের পর : পৃ. ৮
অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, ধর্মের কাজ করে বিনিময় নিলে সে আর সত্যনিষ্ঠ আলেম থাকে না, তারা পথভ্রষ্ট, তাদের দুনিয়া-আখেরাত বরবাদ, তাদের দিকে কিয়ামতে আল্লাহপাক তাকাবেন না এবং তাদেরকে জাহান্নামে দেবেন।
ইসলাম কী বলে?
আগেই প্রমাণ করেছি যে, দ্বীনের কাজ করে বিনিময় গ্রহণ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম রা. এমনকি সে বিনিময়ে অর্জিত সম্পদ থেকে নবিজি সাঃ নিজেও গ্রহণ করেছেন এবং হেযবুত তওহীদ নিজেরাও সেটাকে বৈধ বলে স্বীকারও করেছে। তাহলে শুধু আলেমরা নিলেই কেন ধর্মব্যবসায়ি হবেন? যদি দ্বীনের বিনিময় নিলেই আলেমরা ধর্মব্যবসায়ি হয়ে যায়, তাহলে বায়াজীদ খান পন্নী নিজেই চরমভাবে ধর্মব্যবসা করে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। কারণ পন্নী সাহেব ছিলেন একজন হোমিও ডাক্তার, আর তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই চিকিৎসা করেই তার সংসার চালাতেন। এটা তারা তাদের বইয়ে লিখেছে-
ইন্তেকালের সময় পন্নীর বয়স ছিল ৮৬ বছর। তখনও তিনি নিয়মিত রোগী দেখছেন এবং সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। -প্রিয় দেশবাসী, পৃ. ১২৫
তাহলে বুঝা গেলো, সবচে বড় ধর্মব্যবসায়ী ছিলেন পন্নী সাহেব। এ জবাবটা শুনেই তারা বলবেন যে, চিকিৎসা করে টাকা নেওয়া জায়েয। হ্যাঁ, এমনটাই তারা দাবি করে আবার দলীলও পেশ করেছেন। কি বলছে আবার দেখুন-
চিকিৎসা কার্যের বিনিময় গ্রহণ করা আল্লাহ বৈধ করেছেন। এক সাহাবী সূরা ফাতিহা পড়ে ফু দিয়ে অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসা করেছিলেন এবং বিনিময়ে নিয়েছিলেন। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে পৃ:৮১
পাঠক, এখানে একটু গভীর ভাবে পড়ুন। এখানে তারা নিজেদের গুরুকে বাঁচাতে মূহুর্তেই নিজেদের ফাতাওয়া পাল্টে দিলো। অথচ এরাই আবার দাবি করেছিলো, ধর্ম হলো, ‘মানবসেবা’। আবার দাবি করেছিলো, ‘ধর্মের বিনিময় নেওয়া হারাম’। অথচ তাদের আত্মার পিতা পন্নী সাহেব যখন মানবসেবা নামক ধর্মের কাজ করে বিনিময় নিতেন, সে ক্ষেত্রে ফাতাওয়া পাল্টে দিয়ে বলে দিলেন চিকিৎসা নামক মানবসেবা করে টাকা নেওয়া জায়েয। তাহলে ধর্মের বিনিময় আলেমরা নিলে জায়েয হবে না কেন? যদি ধর্মের বিনিময় আলেমরা নিলে ধর্মব্যবসায়ি ও জাহান্নামি হয়ে যায়, তবে পন্নীও ধর্মব্যবসায়ি ও জাহান্নামি।
উপরন্তু তারা আরও লিখেছে-
এখন আপনারাই বলুন, যারা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উপায়ে দীনের বিনিময় নিচ্ছেন তারা কি প্রকৃত আলেম হোতে পারেন? অসম্ভব। -এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ২৩
যারা দ্বীনের বিনিময় নেন, তারা যদি আলেম না হতে পারেন, তাহলে পন্নী সাহেব এমাম হোন কীভাবে? তারা আরও লিখেছে-
যে সকল আলেমগণ ধর্মের কাজের বিনিময় অর্থ স্বার্থ গ্রহণ করে তারা নিজেরাই পথচ্যুত। একজন পথ ভ্রষ্ট মানুষ কি করে আরেক ব্যক্তিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে? একি সম্ভব? সুতরাং ধর্মজীবী পেশাদার আলেমদের কাছে যারা মুক্তি পথের সন্ধান করবে, তারাও পথভ্রষ্ট হবে, তারাও জাহান্নামে যাবে। -প্রিয় দেশবাসী, পৃ. ৮১
ধর্মের বিনিময় সংক্রান্ত আয়াতের অপব্যাখ্যা করে ধর্মব্যবসায়ীরা তাদের এ অবৈধ ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন, হাজারো অপব্যাখ্যা,মিথ্যা ফতোয়া দেন।তাদের এই সত্য গোপনের ফলে মুসলিম জাতি বহু আগেই পথ হারিয়ে ফেলেছে। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে, পৃ. ৩৩
দ্বীনের বিনিময় নিলে যদি তারা পথভ্রষ্ট হয়ে যান, তাহলে পন্নী সাহেবও কী পথভ্রষ্ট নন? যদি বলেন না, তাহলে বিষয়টি এমন নয়, যে কৃষ্ণ করলে কুরুকুরু, হুজুর করলেই মাকরুহ?
নবিজি সাঃ কী ধর্মীয় কাজে পারিশ্রমিক দেননি?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ‘ধর্মের কোন কাজ করে নবী ও রসূলরা কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না। সুতরাং তাদের অনুসারী উম্মতের জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ নয়। -প্রিয় দেশবাসী, পৃ. ৮৫
নবীজির জামানায় কোন একটি ধর্মীয় কাজেও অর্থের লেনদেন হতো না। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে, পৃ. ৮৬
ইসলাম কী বলে?
হেযবুত তওহীদের কাছে ইসলামের মূল ইবাদত হলো, ‘খিলাফতের কাজ করা’। যা তারা অসংখ্য জায়গায় লিখেছে,
এবাদত হচ্ছে আল্লাহ খেলাফত করা। কিন্তু ভুল করে নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত ইত্যাদিকে এবাদত বলে মনে করা হচ্ছে। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ৯
হেযবুত তওহীদের উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে বুঝা গেলো, তাদের দাবি হচ্ছে, ‘খেলাফতের কাজ করাই হলো ধর্মের মূল ইবাদত’। তাহলে দেখতে হবে এই খিলাফত বা রাষ্ট্রপরিচালনার কাজ করার কারণে রাসুলুল্লাহ সা. অর্থ প্রদান করেছেন কী না? নবিজি সাঃ নিজে হামিলিনে যাকাত বা যাকাত উত্তোলনকারীদের বাইতুল মাল থেকে পারিশ্রমিক দিতেন। কারণ পবিত্র কুরআনে মহান রব বলেন,
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاء وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ اللّهِ وَاللّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
যাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদে হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। [সুরা তাওবা, আয়াত : ৬০]
উক্ত আয়াতে কারীমায় যাকাত উত্তোলনকারীদেরকে পারিশ্রমিক দেওয়ার বৈধতা খোদ আল্লাহ পাক দিয়েছেন। উপরন্তু হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত বুরায়দাহ্ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি সাঃ বলেন,
مَنِ اسْتَعْمَلْنَاهُ عَلَى عَمَلٍ فَرَزَقْنَاهُ رِزْقًا فَمَا أَخَذَ بَعْدَ ذَلِكَ فَهُوَ غُلُولٌ
কোনো লোককে যদি আমরা কোনো কাজে নিযুক্ত করি এবং তাকে সে কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেই। অতঃপর যদি সে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করে, তবে তা হলো খিয়ানাত। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ২৯৪৩
ইবনুস সাঈদী রহি. সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন,
اسْتَعْمَلَنِي عُمَرُ رضى الله عنه عَلَى الصَّدَقَةِ فَلَمَّا فَرَغْتُ مِنْهَا وَأَدَّيْتُهَا إِلَيْهِ أَمَرَ لِي بِعُمَالَةٍ فَقُلْتُ إِنَّمَا عَمِلْتُ للهِ وَأَجْرِي عَلَى اللهِ . قَالَ خُذْ مَا أُعْطِيتَ فَإِنِّي قَدْ عَمِلْتُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صلي الله عليه وسلم فَعَمَّلَنِي فَقُلْتُ مِثْلَ قَوْلِكَ فَقَالَ لِي رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ” إِذَا أُعْطِيتَ شَيْئًا مِنْ غَيْرِ أَنْ تَسْأَلَهُ فَكُلْ وَتَصَدَّقْ
উমার (রাঃ) আমাকে যাকাত আদায়ের জন্য নিযুক্ত করেন। আমি তা আদায়ের পর তার নিকট পৌঁছিয়ে দিলে তিনি আমার কাজের পারিশ্রমিক প্রদানের নিদের্শ দেন। আমি বললাম, আমি এ কাজ আল্লাহর ওয়াস্তে করেছি, তাই এর বিনিময় আল্লাহর কাছেই চাই। তিনি বললেন, তোমাকে যা দেয়া হয় গ্রহণ করো। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় এ কাজ করেছিলাম। তিনি আমাকে পারিশ্রমিক দিলে আমিও তোমার মত বলেছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ চাওয়া ছাড়াই তোমাকে যা কিছু দেয়া হয় তা খাও এবং সাদাকা করো। +সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ১৬৪৭
উপরোক্ত আয়াত ও হাদিস দুটোর মাধ্যমে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, যাকাত উত্তোলন করার কারণে তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসুল সা. এবং সাহাবায়ে কেরামের রা. থেকে প্রমাণিত ছিলো। এ কথা খোদ হেযবুত তওহীদই স্বীকার করে লিখেছে,
আল্লাহর রাসুল স্বয়ং প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য বায়তুলমাল থেকে বেতন নির্ধারণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন তিনি আরাফাতের ময়দানে বিদায় হজের ভাষণের সমাবেত সাহাবাীদের উদ্দেশ্যে বলেন, যাকে আমরা শাসনকার্যে নিযুক্ত করি আমরা তার ভরণ পোষণ করি। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭৪
বুঝা গেলো, রাসুলুল্লাহ সাঃ খিলাফতের কাজে যারা নিযুক্ত ছিলেন তাদেরকে তিনি ভাতা দিয়েছেন।
প্রশাসনিক কাজ করে ভাতা নেয়া যেকোন জীবন ব্যবস্থাতেই এই নিয়ম থাকা যুক্তিযুক্ত। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে, পৃ. ৭৪
ওমর রা: বিভিন্ন দেশের প্রশাসক সাহাবীদের বেতন নির্ধারণ করেছিলেন। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭৬
একবার খলিফা ওমর কে জিজ্ঞেস করা হলো আল্লাহর মাল থেকে আপনি কতটুকু গ্রহণ করা নিজের পক্ষে বৈধ মনে করেন? তিনি উত্তরে বলেন শীত-গ্রীষ্মের জন্য দুখানা কাপড় হজ্ব ওমর্ করার জন্য সাওয়ারি জন্তু এবং আমার পরিবারের জন্য কোরেশদের কোন মাঝারি পরিবারের সমমানের খাদ্য। এরপর আমি সাধারন মুসলমানদের মতই একজন মুসলমান। তারা যা পাবে আমিও তাই পাবো। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭৫
ওমরের হাদিসের মধ্যে মুসলিমদের জাতীয় কর্মকাণ্ডে প্রশাসক কর্তৃক নিয়োজিত ব্যক্তি তার ঐ কর্মের পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারবে এটা স্পষ্ট বলা হয়েছে। যেমন শাসক, বিচারক, কর বা ট্যাক্স আদায়কারী, যাকাত আদায়কারী ইত্যাদি। কারণে রসুল স: উমরকে রা: তার এতদসংক্রান্ত কর্মের মজুরি প্রদান করেছিলেন। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭৬
সুতরাং প্রমাণ হলো, রাসুলুল্লাহ সা. এর যামানায় দ্বীনের কাজ করে অর্থ প্রদান স্বয়ং নবিজি সাঃ করেছেন। কিন্তু হেযবুত তওহীদ কিভাবে দাবি করতে পারে যে, ‘নবীজির জামানায় কোন একটি ধর্মীয় কাজেও অর্থের লেনদেন হতো না’ এটা কী মিথ্যাচার নয়?
সাহাবায়ে কেরাম রা. কী নেন নি?
দীনের কাজ তথা খিলাফতের দায়িত্ব পালন করে সাহাবায়ে কেরাম রা. অর্থ আদান-প্রদান করেছেন কী না? খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. সম্পর্কে বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত আতা ইবনে সায়িব রহি. বলেন,
لمّا استخلِفَ أبو بَكرٍ أصبحَ غاديًا إلى السُّوقِ على رأسِهِ أثوابٌ يتَّجرُ بِها فلقيَهُ عمرُ بنُ الخطّابِ وأبو عبيدةَ بنُ الجرّاحِ فقالَ كيفَ تصنعُ هذا وقد وُلِّيتَ أمرَ المسلمينَ قالَ فمن أينَ أطعِمُ عيالي قالوا نفرِضُ لَك ففرضوا لَهُ كلَّ يومٍ شطرَ شاةٍ
হযরত আবু বকর রা. খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যথারীতি মাথায় করে কাপড় নিয়ে ব্যবসার জন্য বাজারে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় হযরত ওমর রা. ও উবায়দা ইবনে জাররাহ রা. এর সঙ্গে দেখা হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিভাবে করছেন, অথচ আপনি মুসলিমদের খিলাফতের কাজে নিয়োজিত। জবাবে হযরত আবু বকর রা. বললেন, ‘তাহলে কিভাবে আমার পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা হবে? তখন তাঁরা উভয়ে বললেন, আমরা আপনার জন্য ভাতা নির্ধারণ করবো। -ফাতহুল বারী (ইবনে হাজার আসকালানী রহি.) খ. ৪ পৃ. ৩৫৭
হযরত আয়েশা রা. বলেন,
لَمَّا اسْتُخْلِفَ أَبُو بَكْرٍ الصِّدِّيقُ قَالَ لَقَدْ عَلِمَ قَوْمِي أَنَّ حِرْفَتِي لَمْ تَكُنْ تَعْجِزُ عَنْ مَئُونَةِ أَهْلِي وَشُغِلْتُ بِأَمْرِ الْمُسْلِمِينَ فَسَيَأْكُلُ آلُ أَبِي بَكْرٍ مِنْ هَذَا الْمَالِ وَيَحْتَرِفُ لِلْمُسْلِمِينَ فِيهِ
যখন আবূ বকর সিদ্দীক রা. কে খলীফা বানানো হল, তখন তিনি বললেন, আমার জাতি জানে যে, আমার উপার্জন আমার পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য অপর্যাপ্ত ছিল না। কিন্তু এখন আমি মুসলিম জনগণের কাজে সার্বক্ষণিক ব্যাপৃত হয়ে গেছি। অতএব আবূ বকরের পরিবার এই রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে খাদ্য গ্রহণ করবে এবং আবূ বকর রা. মুসলিম জনগণের সম্পদের তত্ত্বাবধান করবেন। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ২০৭০
বুঝা গেলো, হযরত আবু বকর রা. খিলাফতের কাজ করে পারিশ্রমিক নিয়েছেন। এটা নেওয়া যদি হারাম হতো, তাহলে তিনি কখনই তা নিতেন না। কারণ তিনিই দ্বীনের প্রকৃত মর্মবানী সবচে বেশি জানতেন ও বুঝতেন বলে হেযবুত তওহীদ এটা স্বীকার করে লিখেছে,
আবু বকর রা: বিশ্বনবীর ঘনিষ্ঠ সাহাবাদের একজন হিসাবে এই দীনের প্রকৃত মর্মবাণী হাকিকত তাঁর নেতার কাছ থেকে জেনেছিলেন। -বিকৃত সুফিবাদ, পৃ. ৪৭
সুতরাং যে আবু বকর রা. দীনের জ্ঞান সবচে বেশি বুঝতেন, সেই আবু বকর রা. দ্বীনের কাজ করে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ জানতেন বলে ভাতা নিয়েছেন। তাহলে হেযবুত তওহীদের হারাম ফাতাওয়া কী দীনের বিকৃতি নয়?
উপরন্তু খিলাফতের কাজ পরিচালনা করে হযরত সিদ্দিকে আকবর রা. ওমর রা. সহ সকল খলীফারা ভাতা গ্রহণ করতেন। এ প্রসঙ্গে খোদ হেযবুত তওহীদের দাবিটাও জেনে নেওয়া যাক। তাহলে তাদের কাছে বিষয়টি আরও মজবুত ভাবে প্রমাণিত হবে। তারা লিখেছে,
ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা (ভৌগোলিক রাষ্ট্র নয়) রাষ্ট্রপ্রধান অর্থাৎ খলিফা রাষ্ট্র থেকে ভাতা পাবেন একজন সাধারন মানুষের প্রয়োজন মোতাবেক। অর্থাৎ জীবনের মৌলিক প্রয়োজন, খাবার, কাপড়, বাসস্থান ইত্যাদি। কোনো বিলাসিতা,আড়ম্বর, কোনো জাঁকজমকের জন্য রাস্ট্র খরচ বহন করবে না। প্রকৃত ইসলামের খলিফারা এর বেশি পান নি। -শিক্ষাব্যবস্থা : পৃ. ৬১
ওমরের হাদিসের মধ্যে মুসলিমদের জাতীয় কর্মকাণ্ডে প্রশাসক কর্তৃক নিয়োজিত ব্যক্তি তার ঐ কর্মের পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারবে এটা স্পষ্ট বলা হয়েছে। যেমন শাসক, বিচারক, কর বা ট্যাক্স আদায়কারী, যাকাত আদায়কারী ইত্যাদি। কারণে রসুল স: উমরকে রা: তার এতদসংক্রান্ত কর্মের মজুরি প্রদান করেছিলেন। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭৬
ওমর রা: বিভিন্ন দেশের প্রশাসক সাহাবীদের বেতন নির্ধারণ করেছিলেন। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭৬
হেযবুত তওহীদের এসব বক্তব্য থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, খিলাফত বা ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করার বিনিময়ে যদি কেউ নির্ধারিত অর্থ গ্রহণ করে, তাহলে সেটা জায়েয বলেই হযরত আবু বকর রা. হযরত ওমর রা. সহ সকল খলীফারা তা গ্রহণ করেছেন।
হেযবুত তওহীদের কাছে আমার প্রশ্ন:
এক. আপনাদের কাছে তো খিলাফতই হলো ধর্মের মূল বিষয়ের অন্তুর্ভূক্ত। আর আপনারাই বললেন, এই খিলাফতের কাজ নবীজির সা. যুগে যারা করেছেন, তাঁদেরকে রাসুলুল্লাহ সা. পারিশ্রমিক দিতেন। তাহলে ধর্মের বিনিময় বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা যদি ধর্মব্যাবসায়ীদের কাজ হয়, তাহলে সেই কাজ রাসুলুল্লাহ সা. কিভাবে তা সাহাবাদের দিয়ে করাতেন?
দুই. আপনারা বলেছেন, যারা ধর্মের বিনিময় নেয় তারা ধর্মব্যবসায়ী এবং জাহান্নামী। তাহলে এই ধর্মীয় কাজ করে বিনিময় গ্রহণ করেছেন খোদ রাসুলুল্লাহ সাঃ এবং প্রথম সারির সাহাবারা রা.। তাহলে তাঁরাও কী ধর্মব্যবসায়ী ও জাহান্নামী ছিলেন? আশা করি হেযবুত তওহীদরা আমার এ প্রশ্নের জবাব দেবেন। যদিও তা সুদূর পরাহত।
কুরআন শিখিয়ে টাকা নেওয়া:
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
পবিত্র কুরআস শিখিয়ে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে হেযবুত তওহীদের বক্তব্য হলো,
প্রশাসনিক কাজ করে ভাতা নেয়া যেকোন জীবন ব্যবস্থাতেই এই নিয়ম থাকা যুক্তিযুক্ত। আল্লাহর কালাম শিক্ষা দেওয়া, মানুষকে জান্নাতের পথ প্রদর্শন করা, সালাতে ইমামতি করা ইত্যাদি তো প্রশাসনিক কাজ নয়।মোমেনদের এ সকল কাজের বিনিময় আল্লাহ দিবেন।’ -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭৪
এটা ইতিহাস যে ইসলামের প্রাথমিক যুগে শিক্ষকগণ বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান করতেন। পরবর্তীতে ইসলাম কিছুটা বিকৃত হয়ে গেলে শিক্ষকগণকে তাদের সাংসারিক খরচ বাবদ বায়তুল মাল থেকে ভাতা দেওয়া হতো। -শিক্ষাব্যবস্থা : পৃ. ৬
রাসুলুল্লাহ সাহাবীরা কখোনই কোরআন পাঠ বা শিক্ষাদানের বিনিময় গ্রহণ করতে না। একে আগুনের মত ভয় করতেন। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ১০৪
অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, পবিত্র কুরআন শিখিয়ে টাকা নেওয়া যাবে না।
ইসলাম কী বলে?
অথচ পবিত্র কুরআন শিখিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ। যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। নিন্মের হাদিসটি খেয়াল করুন- হযরত সাহল রাঃ হতে বর্ণিত যে,
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ أَنَّ امْرَأَةً أَتَتْ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَعَرَضَتْ عَلَيْهِ نَفْسَهَا فَقَالَ مَا لِي الْيَوْمَ فِي النِّسَاءِ مِنْ حَاجَةٍ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ زَوِّجْنِيهَا قَالَ مَا عِنْدَكَ قَالَ مَا عِنْدِي شَيْءٌ قَالَ أَعْطِهَا وَلَوْ خَاتَمًا مِنْ حَدِيدٍ قَالَ مَا عِنْدِي شَيْءٌ قَالَ فَمَا عِنْدَكَ مِنَ الْقُرْآنِ قَالَ كَذَا وَكَذَا قَالَ فَقَدْ مَلَّكْتُكَهَا بِمَا مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ.
এক মহিলা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এলো এবং বিয়ের জন্য নিজেকে তাঁর কাছে পেশ করল। তিনি বললেন, এখন আমার কোন মহিলার প্রয়োজন নেই। এরপর উপস্থিত একজন লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী আছে? লোকটি বলল, আমার কিছু নেই। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে একটি লোহার আংটি হলেও দাও। লোকটি বলল, আমার কাছে কিছুই নেই। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার কাছে কী পরিমাণ কুরআন আছে? লোকটি বলল, এই এই পরিমাণ। নাবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবললেন, তুমি কুরআনের যা জান, তার বিনিময়ে এই মহিলাকে তোমার মালিকানায় দিয়ে দিলাম। -সহিহ বুখারী হাদিস নং : ৫১৪১
সুনানে আবু দাউদের বর্ণানায় বলা আছে, নবিজি সাঃ জনৈক সাহাবীকে প্রশ্ন করলেন
مَا تَحْفَظُ مِنَ الْقُرْآنِ؟ قَالَ سُورَةَ الْبَقَرَةِ أَوِ الَّتِي تَلِيهَا، قَالَ: فَقُمْ فَعَلِّمْهَا عِشْرِينَ آيَةً، وَهِيَ امْرَأَتُكَ
তুমি কুরআনের কতটুকু মুখস্থ জানো? সে বললো, সূরা আল-বাকারাহ অথবা তার পরবর্তী সূরা। নবীজি সা. বললেন, তুমি তাকে বিশটি আয়াত শিক্ষা দাও এবং এর বিনিময়ে সে তোমার স্ত্রী। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ২১১২
এ হাদিসটির ব্যাপারে খোদ হেযবুত তওহীদের লেখাটা হলো,
একজন সাহাবীর বিয়ের প্রশ্ন উঠলে রসূলুল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, দেন মোহর দেওয়ার মত তোমার কি আছে? সাহাবী বললেন আমার কিছুই তো নেই। রসুলুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কোরআনের কোন আয়াত জানো?সাহাবী বললেন হ্যাঁ। আমি কোরআনের এতগুলি আয়াত জানি। রাসূলুল্লাহ বললেন-তোমার দেনমোহর হচ্ছে, এই আয়াতগুলি তোমার স্ত্রীকে শিক্ষা দিবে তখন এভাবেই বিয়ে হল। -এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব : পৃ. ৮৫
উক্ত হাদিস থেকে প্রমাণ হলো, মোহরের টাকার পরিবর্তে কুরআন শিক্ষা দেওয়ার বৈধতা খোদ নবীজি সা. সা. দিয়েছেন। তাহলে কুরআন মাজীদ শিক্ষা দিয়ে টাকা নেওয়া যদি জায়েয না হতো, তাহলে নবীজি সা. কেন এটা করতে বললেন? যদি এ কাজটি বিকৃতির প্রমাণ হয়, তবে কী নবিজি সাঃ সে বিকৃতি করেছিলেন? আশা করি হেযবুত তওহীদ মরণের আগ পর্যন্ত জবাব দিতে পারবে না।
কুরআন পড়ে টাকা নেওয়া:
অবশ্য মৃত ব্যক্তির ঈসালে সওয়াবের জন্য কুরআন মজীদ খতম করে বা কুরআন মজীদের কোনো সূরা তিলাওয়াত করে কোনো ধরনের বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয নেই। হযরত আব্দুর রহমান বিন শিব্ল রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
اقْرَءُوا الْقُرْآنَ وَلَا تَغْلُوا فِيهِ وَلَا تَجْفُوا عَنْهُ وَلَا تَأْكُلُوا بِهِ وَلَا تَسْتَكْثِرُوا بِهِ
তোমরা কুরআন পাঠ কর এবং তার নির্দেশ পালন কর, তার ব্যাপারে অবজ্ঞা প্রদর্শন ও অতিরঞ্জন করো না এবং তার মাধ্যমে উদরপূর্তি ও ধনবৃদ্ধি করো না। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং : ১৫৫২৯
সুতরাং কুরআন তিলাওয়াত করে টাকা নেওয়া নিষেধ। কিন্তু কুআরান শিক্ষা দিয়ে টাকা নেওয়া নিষেধ নয়। দু’টি আলাদা বিষয়কে এক করে ফাতাওয়া দেওয়া বোকামী ছাড়া কিছু নয়।
ওয়াজের বিনিময় নেওয়া:
হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, ওয়াজ নসিহতের সাথে স্বার্থের মিশ্রণ থাকলে তাদের ওয়াজ-নসিহতের কোন প্রভাব মানুষের আত্মায় পড়ে না অর্থাৎ কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসে না এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। -আক্রান্ত দেশ আক্রান্ত ইসলাম : পৃ. ৮
অর্থাৎ তাদের বক্তব্য হলো, ওয়াজ করে টাকা নেওয়া যাবে না। টাকার বিনিময়ে যদি কুরআন শরীফ শিখানো জায়েয হয়, তাহলে ওয়াজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ হবে না কেন? যদি জায়েয নাই হয়, তাহলে হেযবুত তওহীদ তাদের লিখিত যে বইগুলো বিক্রি করে, যে বইয়ের ভেতর পবিত্র কুরআনের আয়াত ও হাদিসের বাণীও থাকে। তাহলে এই বই বিক্রি করে টাকা নেওয়া কীভাবে তারা বৈধ বলতে পারে? হয়তো বলবে, টাকা না নিলে তাদের সাংগঠনিক সংসার চলবে কেমনে? তাহলে তারা এটা কেন ভাবেন না যে, একজন বক্তা সকল কাজ ফেলে, দূর থেকে দূরান্তর গিয়ে, রাত দিন পরিশ্রম করে, হাজার হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে টাকা না নিলে তাদের সংসার চলবে কেমনে? নিজেদেরটা আরাম আর আলেমদেরটা হারাম? কৃষ্ণ করলে কুরু কুরু, আলেমরা করলে মাকরুহ? এটা কেমন ইনসাফ?
উপরন্তু হেযবুত তওহীদের দ্বিতীয় এমাম সেলিম সাহেব পুরো বাংলাদেশের প্রত্যান্ত অঞ্চলে ভিআইপি গাড়ি নিয়ে সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে বেড়ান। তিনি কী তাদের ফান্ড থেকে কোনো টাকা গ্রহণ করেন না? যদি না করেন, তাহলে তিনি সাধারণ এক ফ্যামিলির লোক হয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা কিভাবে খরচ করেন? জাতি জানতে চায়।
ইমামতির বিনিময় নেওয়া:
সমাজে প্রায় প্রত্যেকটি মসজিদে নির্দিষ্ট ইমাম সাহেব নিযুক্ত রয়েছেন। যাঁদেরকে কর্তৃপক্ষ সম্মানী পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের বক্তব্য হলো, ইমামতি করে টাকা নেওয়া যাবে না। যারা নেয়, তাদের পেছনে নামাজ হবে না। তারা লিখেছে,
আল্লাহর পরিষ্কার ঘোষণা অনুযায়ী যারা ধর্মের বিনিময় নেন, তাদের পেছনে নামাজও হয় না। আল্লাহ মুমিনদেরকে তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন, যাতে কোনোভাবেই এই দীনে কোন পুরোহিত শ্রেণীর আবির্ভাব হোতে না পারে। (ইয়াসিন-২১) সুতরাং যারা তাদের পেছনে নামাজে দাঁড়াবেন তারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করছেন। -এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৪২
পরনির্ভরশীল ব্যক্তি ইমামতি করবেন না। মোমেনও পরনির্ভরশীল হতে পারবে না। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭১
আল্লাহর সমস্ত হুকুম অমান্য করে নিজেরা চাঁদা দিয়ে পেশাদার ইমাম নিয়োগ করা কখন ইসলামসম্মত নয়। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭১
বিনিময় নিলে দোয়া কবুল হয় না। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭০
নিষেধাজ্ঞা সত্বেও যদি কোন ব্যক্তি বিনিময় গ্রহণকারীর, বিনিময় কামনাকরীর পেছনে উপাসনায় অংশ নেয় তাহলে সে আল্লাহরই নাফরমানী করলো। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৮১
সেদিন আল্লাহর রাসূল ও তাঁর আসহাবরা যেমন দীনের ব্যাপারে ঐ সমাজ থেকে হেজরত করেছিলেন, তাদের সাথে এবাদত করা ছেড়ে দিয়েছিলেন, আজ ঠিক তেমনিভাবে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী হবার প্রচেষ্টারত হেযবুত তওহীদকেও বর্তমান মুসলিম সমাজ থেকে হেজরত করতে হবে। -এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৫৯
এখানে হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, ইমামতি করে টাকা নেওয়া জায়েয নেই। যারা বেতনভুক ইমামের পেছনে নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং যারা তাদের পেছনে নামাজ পড়বে, তাদের নামাজ হবে না, বরং তারা নাফরমান হয়ে যাবে।
ইসলাম কী বলে?
এ ব্যাপারে নতুন করে জবাব দেওয়ার কোরো প্রয়োজন নেই। কারণ উপরেই লেখা হয়েছে যে, ইসলামের খলীফারা বাইতুল মাল থেকে ভাতা গ্রহণ করতেন এবং ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করে ভাতা দেওয়া বা নেওয়া আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাঃ এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে একটি স্বীকৃত বিষয়। এজন্য খলীফারা খিলাফতের কাজও করতেন, ইমামতিও করতেন, পারিশ্রমিক হিসাবে ভাতাও নিতেন। এ কথাটা খোদ হেযবুত তওহীদই লিখেছে,
ওমর রা: এবং মুসলমানদের পিড়াপীড়ির কারণেই বাইতুলমাল থেকে আবু বকর সিদ্দিক রা: বায়তুল মাল থেকে ভাতা গ্রহণ করেছেন। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭৪
সুতরাং ‘ইমামতি করে পারিশ্রমিক নেওয়া যাবে না’ কথাটা সত্য নয়।
আযানের বিনিময় নেয়া:
আযানের মাধ্যমে পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয। রাসুলুল্লাহ সাঃ জনৈক সাহাবীকে আযানের পপর হাদিয়া দিয়েছেন।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ‘আযানের বিনিময় যদি মজুরি নেওয়া নিষিদ্ধ হয়, নামাজের এমামতির বিনিময় কিভাবে সিদ্ধ হোতে পারে’? -এসলাম শুধু নাম থাকবে পৃ. ৪৭
বুঝা গেলো, হেযবুত তওহীদের বক্তব্য হলো, আযানের বিনিময় নেওয়া জায়েয নেই।
ইসলাম কী বলে?
হযরত আবু মাহযুরা রা. কে রাসুলুল্লাহ সাঃ একবার আযান দিতে বললে তিনি আযান দিলেন। দীর্ঘ সে হাদিসে তিনি বলেন,
ثُمَّ دَعَانِي حِينَ قَضَيْتُ التَّأْذِينَ فَأَعْطَانِي صُرَّةً فِيهَا شَىْءٌ مِنْ فِضَّةٍ ثُمَّ وَضَعَ يَدَهُ عَلَى نَاصِيَةِ أَبِي مَحْذُورَةَ ثُمَّ أَمَرَّهَا عَلَى وَجْهِهِ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ ثُمَّ عَلَى كَبِدِهِ ثُمَّ بَلَغَتْ يَدُ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ سُرَّةَ أَبِي مَحْذُورَةَ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم بَارَكَ اللَّهُ لَكَ وَبَارَكَ عَلَيْكَ
আমি আযান শেষ করলে তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন এবং কিছু রূপার মুদ্রা ভর্তি একটি থলে দান করেন। অতঃপর নবী সাঃ তাঁর হাত আবু মাহযুরা রা. এর কপালের অগ্রভাগে রাখেন, অতঃপর তা তাঁর মুখমন্ডলে বুলিয়ে দেন, অতঃপর তাঁর হাত তার বুকে বুলিয়ে দেন, এমনকি তাঁর হাত আবূ মাহযূরা রা. এর নাভিমূল পর্যন্ত পৌঁছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাঃ বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাকে বরকত দান করুন এবং তোমার উপর বরকত নাযিল করুন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং :৭০৮
উক্ত হাদিস থেকে প্রমাণিত হলো, কেউ আযান দিলে তাকে হাদিয়া দেওয়া ও নেওয়া খোদ নবিজি সাঃ থেকেই স্বীকৃত। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাঃ নিজে সেটা করেছেন। সুতরাং আযানের বিনিময় নেওয়া হারাম কথাটা কতটুকু সত্য আশা করি আমার বলা লাগবে না।
একটি অনর্থক যুক্তি:
হেযবুত তওহীদ তাদের দাবি প্রমাণ করতে একটি অসাড় যুক্তি পেশ করে থাকেন। তারা বলেন,
এক বস্তু যেমন দুইজনের কাছে বিক্রি করা দুর্নীতি, তেমনি ধর্মীয় কাজের বিনিময় মুসল্লিদের কাছ থেকে নেওয়া আবার আল্লাহর কাছেও আশা করা দুর্নীতি। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭৪
উদহরণ দিতে গিয়ে তারা বলে থাকে, ‘প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ হাদিয়া কবুল করলে চুরি বলে গণ্য হবে অর্থাৎ হারাম। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭৯
জবাব:
এই যুক্তি যদি সত্য বলে আমাদেরকে মেনেই নিতে হয়, তাহলে আমার দু’টি প্রশ্নের জবাব চাই-
এক. জিহাদ করার পর গণীমতের মাল রাসুলুল্লাহ সা. এবং সাহাবায়ে কেরামও রা. নিয়েছেন। তাহলে তাঁরা কী কিয়ামতে এটার প্রতিদান দ্বিতীয়বার আর পাবেন না? যদি বলেন, ‘অবশ্যই পাবেন’, তাহলে আপনাদের যুক্তি কী অযৌক্তিক নয়?
দুই. সকল খুলাফায়ে রাশেদা রা. খিলাফতের কাজ করে ভাতা নিয়েছেন, তাঁরা কী কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তাআলার কাছে দ্বিতীয়বার আর প্রতিদান পাবেন না?
আশা করি হেযবুত তওহীদ মরার আগ পর্যন্ত আমার এ দু’টি প্রশ্নের জবাব দেবে না।
মনে রাখা চাই:
তবে মনে রাখতে হবে, শুধু দুনিয়া উপার্জন করার উদ্দেশ্যে কোনো আমল করা উচিৎ নয়। আল্লাহ পাক বলেন,
فَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الآخِرَةِ مِنْ خَلاَقٍ
যেসব লোকেরা বলে, হে পরওয়াদেগার, আমাদিগকে দুনিয়াতে দান কর। অথচ তার জন্যে পরকালে কোন অংশ নেই। [সুরা বাকারা, আয়াত নং : ২০০]
এজন্য আখেরাতের প্রতিদানের বিষয়টি অন্তরে রেখেই যেকোনো আমল করলে সেটার প্রতিদান মহান আল্লাহ উভয় জগতেই দান করেন। আর এজন্যই তো আল্লাহপাক উভয় জগতের কল্যান কামনা করতে বলেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وِمِنْهُم مَّن يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ أُولَـئِكَ لَهُمْ نَصِيبٌ مِّمَّا كَسَبُواْ وَاللّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ
আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে-হে পরওয়ারদেগার! আমাদিগকে দুনয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান কর এবং আমাদিগকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা কর। এদেরই জন্য অংশ রয়েছে নিজেদের উপার্জিত সম্পদের। আর আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। [সুরা বাকারা, আয়াত নং : ২০০-২০২]
বুঝা গেলো, অসীম দয়ালু আল্লাহর কাছে উভয় জগতের প্রতিদান কামনা করা উচিৎ। কারণ তাঁর কাছে দয়ার ভাণ্ডার রয়েছে। সুতরাং যারা দুনিয়ায় একবার পাবে, তারা কিয়ামতে আর পাবে না, বরং সেটা দূর্ণীতি হবে, এমন দাবি করা সর্বৈব মিথ্যা।
অভিযোগ:
মৌলিকভাবে হেযবুত তওহীদ পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতকে সামনে রেখেই ধর্মীয় কাজের বিনিময় গ্রহণ করাকে হারাম বলে প্রচারও করে থাকে। চলুন সে আয়াত কোনটা তা আগে দেখে নেওয়া যাক। তারা লিখেছে,
আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৭৪ নাম্বার আয়াতে বলেছেন, “যারা আমার আয়াত গোপন করে এবং তার বিনিময় গ্রহণ করে তারা তাদের পেটে আগুন খায়, আগুন। আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের সঙ্গে কথা বলবে না। তাদের জন্য রয়েছে হেদায়েতের পরিবর্তে গোমরাহী। তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি। -সূত্রাপুরে এমামের ভাষন : পৃষ্ঠা. ২১
জবাব:
চলুন হেযবুত তওহীদ কর্তৃক উল্লেখিত আয়াত সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক। মহান রব বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلَ اللّهُ مِنَ الْكِتَابِ وَيَشْتَرُونَ بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً أُولَـئِكَ مَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ إِلاَّ النَّارَ وَلاَ يُكَلِّمُهُمُ اللّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবকে গোপন করে এবং তার বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া কিছুই ভরে না। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না, আর তাদের জন্য আছে মর্মন্তুদ শাস্তি। [সুরা বাকারা, আয়াত নং : ১৭৪
উক্ত আয়াতের কারণেই হেযবুত তওহীদের দাবি হলো,
পবিত্র কোরআনে ধর্মের কাজ করে বিনিময় গ্রহণ করাকে পথভ্রষ্টতা ও জাহান্নামের কারণ বলা হয়েছে। -হলি আর্টিজেনের পর : পৃ. ৮
ধর্মের বিনিময় সংক্রান্ত আয়াতের অপব্যাখ্যা করে ধর্মব্যবসায়ীরা তাদের এ অবৈধ ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন, হাজারো অপব্যাখ্যা,মিথ্যা ফতোয়া দেন। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৩৩
অথচ যে সুরা বাকারার ১৭৪ নং আয়াতের মাধ্যমে তারা ধর্মের বিনিময় নেওয়াকে হারাম ঘোষণা করেছে, সে আয়াতে কিন্তু ‘কুরআনের বিনিময় নিলেই জাহান্নামে যেতে হবে’ এ কথা আল্লাহপাক বলেন নি। এজন্য আতে আমাদেরকে আয়াতের প্রকৃত মর্মবানী বুঝতে হবে। চলুন আয়াতটির ব্যাপারে নবিজির সাঃ কাছের সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কী বলেন দেখা যাক। ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
نَزَلَتْ هَذِهِ الآيَةُ في رُؤَساءِ اليَهُودِ؛ كَعْبِ بْنِ الأشْرَفِ، وكَعْبِ بْنِ أسَدٍ، ومالِكِ بْنِ الصَّيْفِ، وحُيَيِّ بْنِ أخْطَبَ، وأبِي ياسِرِ بْنِ أخْطَبَ، كانُوا يَأْخُذُونَ مِن أتْباعِهِمُ الهَدايا، فَلَمّا بُعِثَ مُحَمَّدٌ عَلَيْهِ السَّلامُ خافُوا انْقِطاعَ تِلْكَ المَنافِعِ، فَكَتَمُوا أمْرَ مُحَمَّدٍ عَلَيْهِ السَّلامُ وأمْرَ شَرائِعِهِ فَنَزَلَتْ هَذِهِ الآيَةُ
এই আয়াতটি নাযিল হয়েছে ইহুদী পণ্ডিতদের ব্যাপারে। তারা হলো কা’ব বিন আশরাফ, কা’ব বিন আসাদ, মালেক বিন সাঈফ, হুয়াই বিন আখতাব, আবু ইয়াসির বিন আখতাব প্রমুখ। কারণ তারা তাদের অনুসারীদের থেকে হাদিয়া নিতো। অতপর যখন হযরত মুহাম্মাদ সা. কে প্রেরণ করা হলো, তখন তারা ঐ হাদিয়ার পথটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মুহাম্মাদ সা. এর বিষয় ও তাঁর ধর্মের বিষয়টি গোপন করে রাখতো। অতপর এ আয়াত নাযিল হয়েছিলো। -মাফাতীহুল গাইব (রাযী) : খ. ৫ পৃ. ২৮
তাহলে বুঝা গেলো, সুরা বাকারার ১৭৪ নং আয়াতটি মূল ঐ সকল ইহুদী পণ্ডিতদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যারা তাওরাতের ভেতরে থাকা নবিজি সাঃ কে নিয়ে সত্য বিষয়গুলো গোপন করে এর বিনিময়েে অর্থ উপার্জন করতো। আর মূলত এই সত্য গোপন করে অর্থ উপার্জন করাকেই আল্লাহ তাআলা নিন্দা করেছেন। এজন্য ইমাম কুরতুবী রহি. বলেন,
وَيَشْتَرُونَ بِهِ أَيْ بِالْمَكْتُومِ ثَمَناً قَلِيلًا يَعْنِي أَخْذَ الرِّشَاءِ
আল্লাহর কিতাব বিক্রি করে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করার অর্থ হলো, সত্য গোপন করে ঘুষ নেওয়া। -আল কানযুল আকবার : পৃ. ১৩৭
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহি. বলেন,
وبِالجُمْلَةِ فَكانَ غَرَضُهم مِن ذَلِكَ الكِتْمانِ أخْذَ الأمْوالِ بِسَبَبِ ذَلِكَ
মোটকথা তাদের উদ্দেশ্যই ছিলো এই সত্য গোপন করে এর বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করা। -মাফাতীহুল গাইব (রাযী) খ. ৫ পৃ. ২৮
এ ব্যাপারে সহিহ হাদিসেও এসেছে, হযরত আবু হুরাইরা রা. সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ فَكَتَمَهُ أَلْجَمَهُ اللَّهُ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে ব্যক্তি জানা ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে তা গোপন করলো, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তাকে আগুনের লাগাম পরিয়ে দিবেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ৩৬৫৮
উপরন্তু পবিত্র কুরআনে আরও বলা হয়েছে,
فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَـذَا مِنْ عِندِ اللّهِ لِيَشْتَرُواْ بِهِ ثَمَناً قَلِيلاً فَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا يَكْسِبُونَ
অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ তাদের উপার্জনের জন্যে। [সূরা বাকারা : ৭৯]
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হলো যে, মূলত আল্লাহর কিতাবের কোনো অংশ অর্থ উপার্জনের নিমিত্তে গোপন করার অপরাধেই আল্লাহ তা’আলা সুরা বাকারার ১৭৪ নং আয়াত নাযিল করেছেন। সত্য প্রচার করে অর্থ উপার্জন করার অপরাধে নয়। হয়তো হেযবুত তওহীদের সদস্যরা আমার এ দাবি মানবেন না, তাহলে চলুন হেযবুত তওহীদের বই থেকেই এ বিষয়ের প্রমাণ দেখে নেওয়া যাক। তারা লিখেছে,
আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৭৪ নাম্বার আয়াতে বলেছেন, “যারা আমার আয়াত গোপন করে এবং তার বিনিময় গ্রহণ করে তারা তাদের পেটে আগুন খায়, আগুন। আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের সঙ্গে কথা বলবে না। তাদের জন্য রয়েছে হেদায়েতের পরিবর্তে গোমরাহী। তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি। -সূত্রাপুরে এমামের ভাষন : পৃ. ২১,
‘সত্য গোপন করাই হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। সত্যই হচ্ছে শান্তির উৎস। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৩৭
যারা আল্লাহ কেতাবে যা অবতীর্ণ করেছেন তা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া কিছুই ঢুকায় না। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ১৬৯
সুতরাং প্রমাণ হলো, হেযবুত তওহীদ সূরা বাকারার যে আয়াত দিয়ে ধর্মের বিনিময় গ্রহণ করাকে আগুন খাওয়া ও জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসাবে দলীল পেশ করে থাকেন, সে দলীল আসলে ধন্মের বিনিময় নেওয়ার ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়নি, বরং ধর্ম গোপন করে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আয়াতের অপব্যাখ্যা করেই মূলত তারা উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে মুখ ও কলম চালাচ্ছে।
ধর্মের বিনিময় কারা জায়েয করেছেন?
প্রিয় পাঠক, উপরোল্লিখিত বিস্তারিত আলোচনা দ্বারা আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে, ইসলামের কাজ করে পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয। যা পবিত্র কুরআনের আয়াত, হাদিস শরীফ, সাহাবায়ে কেরামের রা. আমল দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু হেযবুত তওহীদের দাবি হলো,
‘পরবর্তীকালে দীনের বিনিময় নেয়া জায়েজ বলে যারা ফতোয়া দিয়েছেন তারা আল্লাহর আয়াত মোতাবেক অবশ্যই মোমেন পুরুষ এবং নারী নন। আল্লাহ ও রসূলের অবাধ্যতা করে তারা স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত।’
সূত্র: ধর্মব্যবসার ফাঁদে, পৃ. ৮১
এ কথাটা যদি সত্য হিসাবে ধরতে হয়, তাহলে তাদের ফাতাওয়ার কারণে আল্লাহ, তাঁর রাসুল সা. এবং সাহাবায়ে কেরামও রা. কী এই ফাতাওয়ার আওতায় পড়ে যাবেন না? শুধু কী তাই? তাদের এ ফাতাওয়ার কারণে তাদের প্রতিষ্ঠাতা ও তাদের আত্মার পিতা বায়াজীদ খান পন্নীও কী পথভ্রষ্ট হিসাবে বিবেচিত হয়ে যাবেন না?
সুতরাং দ্বীনের যেকোনো কাজ করে বিনিমিয় নেয়া হারাম বা জাহান্নামে যাওয়ার কারন এমন কথা বলা পরিস্কার বিভ্রান্তিকর। কারণ নবি সাঃ ও সাহাবায়ে কেরাম রা. নিজে জিহাদে অর্জিত মালে গণীমত গ্রহণ করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামও গণীমতের মাল এবং খিলাফতের ভাতা গ্রহণ করেছেন। সুতরাং এমন বিভ্রান্তিকর, বানোয়াট কথা এবং আয়াতের অপব্যখ্যা থেকে জাতিকে মহান আল্লাহ হেফাযত করেন।
শেষ কথা:
তবে মনে রাখা চাই, মূলত اجرة (পারিশ্রমিক) নেয়া জায়েজ, কেবল ঐ সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে, যেগুলো ضروريات دين তথা দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত। যেমন দ্বীন শিখানো, ইমামতি, মুয়াজ্জিনী, ওয়াজ করা ইত্যাদী। কিন্তু কুরআন পড়ে, ঈসালে সওয়াব করে, তারাবীহ পড়িয়ে, ই’তেকাফ করে পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয নেই। কেননা এসব দ্বারা পবিত্র কুরআনের আয়াতকে বিক্রি করা হচ্ছে যা জায়েজ নেই। আর এগুলো ضروريات دين এর অন্তর্ভূক্তও নয়, যে এগুলো না হলে দ্বীনের মস্ত বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবে। সুতরাং দীনের আবশ্যকীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত এমন কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করা জায়েয।