Home > হিজবুত তাওহীদ > অধ্যায়: ইসলামের পাঁচ স্তম্ভ:

অধ্যায়: ইসলামের পাঁচ স্তম্ভ:

তাওহীদ প্রসঙ্গ:

প্রিয় পাঠক, কালেমায়ে তাওহীদ হলো, ইসলামের মূল পাঁচ স্তম্ভের প্রধান স্তম্ভ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ  وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَان
ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল,নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া, হজ্জ আদায় করা এবং রমজান মাসে রোজা পালন করা। -সহীহ বুখারী, হাদিস : ৮

কালেমায়ে তাওহীদ যে ইসলামের মূল স্তম্ভের অন্তুর্ভূক্ত এটা হেযবুত তওহীদও লিখেছে-
ইসলামের বুনিয়াদ পাঁচটি কালেমা, সালাত, যাকাত, হজ্ব সওম। এখানে প্রথমটি হচ্ছে ঈমান, আর বাকি চারটি হচ্ছে আমল। -সম্মানিত আলেমদের প্রতি, পৃ. ১০

এই কালেমা নিয়ে তারা বেশ বিকৃতি করেছে। চলুন এক নজরে আগে দেখে নেওয়া যাক।
১. কালেমার প্রচলিত অর্থ খ্রিস্টানদের বানানো।
২. ব্যক্তিগত জীবনের তাওহীদ শিরক।
৩. যুক্তির আলোকে ঈমান আনতে হবে।
৪. ঈমান না থাকলেও জান্নাতে যাওয়া যাবে।
৫. হেযবুত তওহীদ আসল কালেমার দিকে ডাকছে।

চলুন প্রত্যেকটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

কালেমার প্রচলিত অর্থ কী খ্রিস্টানদের বানানো?
এই কালিমায়ে তওহীদ তথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ হচ্ছে- আল্লাহ ব্যতীত ইবাদাতের উপযুক্ত আর কেউ নেই। এ অর্থটাই ১৪০০ বছর ধরে উম্মহ’র মাঝে চলে আসছে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ‘পৃথিবীর ১৫০ কোটি মুসলমান কাফের। কেন কাফের? সে প্রশ্নের জবাবে তারা বলে থাকেন যে, যে কালেমা পড়ে মুসলিম হতে হয়, এদের সেই কালেমাই তো ঠিক নেই। কারণ যে কথার প্রতি ঈমান আনতে হবে, সে কথায় তারা ঈমান আনয়ন করতে পারেননি। কারণ কালেমার সঠিক অর্থ খৃষ্টানরা বিকৃত করে দিয়েছে অনেক আগেই। আর বর্তমানের নামধারী মুসলিমরা সেই খৃষ্টানদের করা অর্থ গ্রহণ করে নিয়েছে। ফলে বর্তমানের মুসলিমরা বাস্তবে মুসলিম হতে পারেনি। দেখুন তারা কী বলে-
তাওহীদের মূল কথা হচ্ছে, এক আল্লাহ ব্যতীত আর কারো হুকুম না মানা। -গঠনতন্ত্র, পৃ. ১৫

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ, বিধানদাতা নেই, উপাস্য নেই, প্রভু নেই। আজ আর কোনো আদেশ নিষেধ না মানা জীবনের কোন ক্ষেত্রে আর কারো আইন-কানুন না মানা অর্থাৎ প্রকৃত তওহীদ। -তাকওয়া ও হেদায়াহ, পৃ. ৫

তারা আরও বলে থাকেন, কালেমার অর্থ পরিবর্তন করে দিয়েছে খ্রিস্টানরা। তারা লিখেছে,

(ইংরেজদের থেকে কালেমার অর্থ) বদলিয়ে করা হোল আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই। যেটাকে আরবিতে ভাষান্তর কোরলে হয়-লা মা’বুদ এল্লাল্লাহ। এটা করা হোল এই জন্য যে, আল্লাহকে একমাত্র আদেশদাতা হিসাবে নিলে এ জাতিতো ব্রিটিশদের আদেশ মানবে না, মুসলিম থাকতে হোলে আল্লাহর আদেশ মানতে হবে। আর কালেমার মধ্যে “এলাহ” শব্দের অর্থ বদলিয়ে যদি উপাস্য বা মাবুদ শেখানো যায়, তবে এ জাতির লোকজন ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর উপাসনা, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, দান-খয়রাত ইত্যাদি নানা উপাসনা কোরতে থাকবে এবং জাতীয় জীবনে ব্রিটিশ প্রভুদের আদেশ পালন কোরতে থাকবে; তাদের অধিকার ও শাসন দৃঢ় ও স্থায়ী হবে। এই উদ্দেশ্যে ঐ বিকৃত এসলামে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, আত্মার পরিচ্ছন্নতার জন্য নানারকম ঘষামাজা, আধ্যাত্মিক উন্নতির ওপর গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেয়া হোল। কারণ এরা ঐ এবাদত, উপসনা নিয়ে যত বেশী ব্যস্ত থাকবে ব্রিটিশরা তত নিরাপদ হবে। -যামানার এমামের পত্রাবলী, পৃ. ১০

আলিয়া মাদ্রাসার মাধ্যমে সর্বপ্রথম কালেমার অর্থ বিকৃত করা হল। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র প্রকৃত অর্থ আল্লাহ ছাড়া আদেশদাতা নেই বদলিয়ে করা হলো আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে, পৃ. ৫৮

তাদের উক্ত বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারলাম এ কথা যে, হেযবুত তওহীদের দাবি হলো,
১. ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’এর অর্থ হলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো বিধানদাতা নেই।
২. ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই’ এটা খ্রিস্টানদের বানানো ভুল অর্থ।

ইসলাম কী বলে?
প্রিয় পাঠক, ‘ইলাহ’ শব্দের আসল অর্থ কি এ ব্যাপারে জানার আগে হেযবুত তওহীদের মিথ্যা দাবির বিষয়ে সর্বপ্রথম খোলাসা হওয়া দরকার। তাদের দাবি হলো, ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ মা’বুদ বা উপাস্য বলে প্রচার করেছে বৃটিশরা উপমহাদেশে এসে। অথচ এ দাবিটা কতবড় হাস্যকর তা, নিন্মের বিষয়টি খেয়াল করলেই বুঝে আসবে।
আমরা জানি বৃটিশরা উপমহাদেশে ‘ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’র মাধ্যমে এসেছিলো। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইংল‍্যান্ডের ততকালীন রাণী প্রথম এলিজাবেথ এই কোম্পানিকে ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার রাজকীয় সনদ প্রদান করেছিলেন। -উইকিপিডিয়া।

অর্থাৎ ১৭০০ সালের শুরুতে ব্রিটিশরা উপমহাদেশে আগমন করে। অথচ অসংখ্য মুসলিমদের ইমামগণ যারা ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ করেছেন ‘মা’বুদ ববা উপাস্য’ তাঁরা উপমাহাদেশে ব্রিটিশরা আসার কয়েক’শ বছর পূর্বেই ইন্তেকাল করেছিলেন। নিন্মে কয়েকজনের নাম উল্লেখ্য করা হলো।

ইমাম কুরতুবী রহি.
ইমাম কুরতুবী রহ. ৬৭১ হিজরী বা ১২৭৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আর ব্রিটিশরা উপমাহাদেশে আসে ১৭০০ সালে। অর্থাৎ ব্রিটিশরা উপমহাদেশে আসার ৪২৯ বছর আগে ইমাম কুরতুবী রহ. ইন্তেকাল করেন। এখন দেখার বিষয় হলো, ইমাম কুরতুবী রহ. ব্রিটিশদের ইন্ডিয়া আগমনের ৪২৯ বছর আগে ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ কি করে গেছেন। এটা দেখার জন্য নিন্মের আয়াতের তাফসীর দেখুন। মহান রব বলেন,
وَإِلَـهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ
আর তোমাদের উপাস্য একইমাত্র উপাস্য। তিনি ছাড়া মহা করুণাময় দয়ালু কেউ নেই। [সুরা বাকারা : ১৬৩]

উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন,
وَمَعْنَاهُ لَا مَعْبُودَ إِلَّا اللَّهُ
অর্থাৎ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ এর অর্থ হলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ বা উপাস্য নেই। -তাফসীরে কুরতুবী খ. ২ পৃ. ১৮০

তাহলে হেযবুত তওহীদের দাবি ‘ব্রিটিশরা ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ পরিবর্তন করেছে’ এ দাবিটা কি চুড়ান্ত মিথ্যাচার নয়?

ইমাম তাবারী রহ.
আরো আগের কোনো মুফাসসীরের করা অর্থ যদি দেখতে হয়, তাহলে ইমাম তাবারী রহ. এর তাফসীর দেখা যাক। ইমাম তাবারী রহ. ইন্তেকাল করেছেন, সোমবার, ২৮ শাওয়াল ৩১০ হিজরি বা ১৭ ফেব্রুয়ারি ৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে। আর উপমহাদেশে ব্রিটিশদের আগমন ছিলো ১৭০০ সালে। তাহলে ব্রিটিশদের ইন্ডিয়া আগমনের ৭৭৭ বছর আগে ইমাম তাবারী রহ. ইন্তেকাল করেছেন। অথচ তিনিও উক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে লেখেন,
معبودٌ واحدٌ وربٌّ واحد فلا تعبدوا غيرَه ولا تشركوا معه سواه
অর্থাৎ (لاَّ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ এর অর্থ হলো) এক উপাস্য, এক পালনকর্তা। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত বা উপাসনা করো না এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। -তাফসীরে তাবারী খ. ২ পৃ. ৭৪

যে ইমাম তাবারী ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ করেছেন ‘মাবুদ বা উপাস্য’ যিনি উপমাহাদেশে খ্রিস্টানদের আগমনেরও ৭৭৭ বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। তাহলে ‘ব্রিটিশরা ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ পরিবর্তন করেছে’ এ দাবিটা কি চুড়ান্ত মিথ্যাচার নয়? সুতরাং প্রমাণ হলো, ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ ব্রিটিশরা পরিবর্তন করে ‘মা’বুদ’ বা উপাস্য করেছেন, এ দাবিটা মিথ্যা এবং হাস্যকর। এখন দেখা দরকার ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ আরবী অভিধান, কুরআন ও হাদিস কী বলে।

আরবী অভিধানে ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ:
প্রিয় পাঠক, ইলাহ إله এর ধাতুমূল أ-ل-ه (আলিফ-লাম-হা)। পৃথিবীর সমস্ত আরবী ও বাংলা অভিধানে ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘মাবুদ’ তথা ইবাদতের উপযুক্ত বা উপাস্য। এ প্রসঙ্গে আরবী সাহিত্যিক ও ভাষাবিদ আল্লামা রাগিব ইস্পাহানি রহ. যিনি ৫০২ হিজরী বা ১১০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেছেন, তিনি ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ করেছেন, মা’বুদ বা উপাস্য। তিনি বলেছেন,
وإله جعلوه اسما لكل معبود لهم وكذا اللات وسمّوا الشمس إِلَاهَة لاتخاذهم إياها معبودا
তারা (কাফেররা) তাদের সব ‘উপাস্যকে ‘ইলাহ’ নামকরণ করেছে। আর এমনিভাবে লাতকে (দেবতা)। সূর্যকেও তারা ইলাহ নামকরণ করেছিল। কারণ, তারা সেটাকেও উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিল। -আল মুফরাদাত, পৃ. ৮২

আরবী ভাষাবিদ ইবনে মানযুর আফ্রিকী মিসরী রহ. (যিনি ৭১১ হিজরী বা ১৩১২ সালে ইন্তেকাল করেন) তিনি বলেন,
الإله الله عز وجل وكل ما اتخذ من دونه معبودا
‘ইলাহ’ হলেন ‘আল্লাহ’ এবং আল্লাহ ছাড়া মানুষ যাঁদেরকে উপাসনা করে থাকে। -লিসানুল আরব, খ. ১ পৃ. ১৪৯

সুতরাং উপরোক্ত দুটি রেফারেন্স থেকে এটা ক্লিয়ার হলাম যে, আরবী অভিধানে ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘মা’বুদ’ বা উপাস্য।

কুরআন কী বলে?
চলুন এবার দেখি, অভিধানের এ অর্থটি সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিস কি বলে। হযরত মুসা আ. কে আল্লাহ তা’আলা বললেন,
إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
আমিই আল্লাহ আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম করো। [সূরা ত্ব-হা : ১৪]

এখানে একটু সুক্ষভাকে চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন, মুসা আ. কে আল্লাহ বলছেন, ‘আমিই ইলাহ সুতরাং আমার ইবাদত করো’। অর্থাৎ ‘আমি যেহেতু ‘ইলাহ বা উপাস্য’ সুতরাং আমার ইবাদত করো’।
এখানে আল্লাহ তাঁর ইবাদত করার কারণ বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ইলাহ তথা মা’বুদ বা উপাস্য। যদি ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ ‘হুকুমদাতা’হতো, তাহলে আল্লাহপাক এভাবে বলতেন, ‘আমি যেহেতু ‘ইলাহ বা হুকুমদাতা’ সুতরাং আমার হুকুম মানো। কিন্তু তিনি বলেছেন, আমার ইবাদত করো। বুঝা গেলো, ‘ইলাহ মানে মাবুদ বা উপাস্য’। এটা যেকোনো সুস্থ মানুষই বুঝবেন।

উপরন্তু আমরা জানি, সমস্ত নবী-রাসুলদের দাওয়াতের কালিমা একটি ছিলো তথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। এ দাওয়াত দিয়েই সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামকে আ. পাঠিয়েছিলেন আল্লাহ তা’আলা। কালেমার ভেতরে থাকা এই ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ মূলত আল্লাহ কি বুঝিয়েছেন একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। এ বিষয়টি বুঝতে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। সকলের জানা কথা যে, আগের যুগে ঢালাওভাবে লোকজন মূর্তি পুজা করতো যেমন আজও করে। তবে যারা মুর্তি পুজা করে, তারা কিন্তু মূর্তিকে শুধুমাত্র পুজাই করে থাকে, মুর্তির হুকুম বা বিধান কিন্তু তারা কেউ মানে না। কারণ তারাও জানে মুর্তি কোন কথা বলতে পারে না বা মূর্তির নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। মহান আল্লাহ বলেন,
وَاتَّخَذُوا مِن دُونِهِ آلِهَةً لَّا يَخْلُقُونَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ وَلَا يَمْلِكُونَ لِأَنفُسِهِمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا وَلَا يَمْلِكُونَ مَوْتًا وَلَا حَيَاةً وَلَا نُشُورًا
তারা তাঁর পরিবর্তে কত উপাস্য গ্রহণ করেছে, যারা কিছুই সৃষ্টি করে না এবং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং নিজেদের ভালও করতে পারে না, মন্দও করতে পারে না এবং জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনের ও তারা মালিক নয়। [সুরা ফুরক্বান : ৩]

সুতরাং যে মুর্তি কথাই বলতে পারে না, সে অবলা মূর্তি বিধান জারি করবে কিভাবে? কাফেররা যে মূর্তির উপাসনা করতো, বাধার মানতে না এটা হেযবুত তওহীদও বিশ্বাস করে। দেখুন তারা লিখেছে,

আল্লাহর রাসুল যখন নবুওয়াত লাভ করলেন তখন আরবের অবস্থা ছিল এই যে, জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত পশ্চাদপদ একটি জনসংখ্যা, যারা সর্বদা নিজেরা নিজেরা অনৈক্য-সংঘাতে লিপ্ত থাকত, কাঠ পাথরের মূর্তি বানিয়ে পূজা করত,আর হুকুম মান্য করত ঐসব দেব-দেবীর পুরোহিত তথা ধর্মব্যবসায়ী কোরাইশ নেতাদের। -প্রিয় দেশবাসী, পৃ. ১১০

তখনকার দিনের রাজা-বাদশাহরা ছিলেন সর্বসর্বা,তাদের হুকুমই ছিলো আইন।মানুষের প্রাণের মালিক ছিলেন রাজা-বাদশাহরা। -এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ৬০

আরবের মোশরেক অধিবাসীরা আল্লাহকে খুবই বিশ্বাস করত, আজ যেমন আমরা করি, কিন্তু আল্লাহর দেয়া দীন জীবন-বিধান মোতাবেক তাদের সমষ্ঠিগত জাতীয় জীবন পরিচালনা করত না। তাদের সামাজিক, জাতীয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, দন্ডবিধি এ সমস্তই পরিচালিত হতো হাবল, লা’ত মানাত ওজ্জা কোরায়েশ পুরোহিতদের তৈরি করা আইন-কানুন ও নিয়ম দিয়ে। -এসলামের প্রকৃত রুপরেখা, পৃ. ৫৭

সুতরাং প্রমাণ হলো, মানুষ মূর্তির পূজা বা উপাসনা করতো, আর বিধান মানতে তাদের নেতাদের। সেই মূর্তির পুজা থেকেই উম্মতকে ফিরিয়ে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করার জন্যই মূলত সমস্ত নবিরা আ. আল্লাহর তরফ থেকে দুনিয়ায় এসেছিলেন। সে কথা খোদ আল্লাহ তা’আলাই বলেছেন-
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
আর আমি প্রত্যেক জাতির কাছে একজন রাসুল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাগুতকে পরিহার করো। [সুরা নাহাল : ৩৬]

উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, সমস্ত নবিগণ আ. স্বীয় গোত্রকে মূর্তির ইবাদত থেকে বিরত থাকতে বলতেন। প্রশ্ন হলো, কি বলে দাওয়াত দিতেন তাঁরা ? সে জবাবও আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
আর আপনার পূর্বে আমি যে রাসুলই প্রেরণ করেছি, তার ওপর এই প্রত্যাদেশই করেছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদাত করো। [সুরা আম্বিয়া : ২৫]

যখন হযরত হুদ আঃ তার কওমকে বলেছিলেন-
وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُونَ
আর আমি আ‘দ জাতির নিকট তাদের ভাই হুদ আ. কে পাঠিয়েছিলাম। সে বললো, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো। আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ তথা মাবুদ নেই। তোমরা এখনো সাবধান হবে না? [সুরা আরাফ : ৬৫]

তখন প্রতিউত্তরে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজন বলল-
قَالُوا أَجِئْتَنَا لِنَعْبُدَ اللَّهَ وَحْدَهُ وَنَذَرَ مَا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا
তারা বললো, তুমি কি আমাদের নিকট এ জন্য এসেছো যে, আমরা এক আল্লাহর ইবাদাত করি এবং ত্যাগ করি আমাদের পিতৃপুরুষগণ যার ইবাদাত করতো? [সুরা আরাফ : ৭০]

মূর্তির এ ইবাদত বা উপাসনা থেকে ফিরানোর ধারবাহিকতায় রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কার কাফিরদের “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”র দাওয়াত দিয়েছিলেন, তখন তারা বলেছিলো:
أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ
সে কি সকল উপাস্যকে এক উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? নিশ্চয় এ তো এক আশ্চর্য বিষয়। [সুরা সোয়াদ : ৫]

প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আয়াত গুলো থেকে আমরা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম যে, সমস্ত নবিগণ আ. মূর্তি পূজায় নিমজ্জিত তাঁদের উম্মাতকে মূর্তির ইবাদত থেকে ফিরাতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র দাওয়াত দিয়েছেন। কারণ প্রত্যেক নবির আ. উম্মাতেরা মূর্তির বিধান মানতো না, বরং মূর্তির উপাসনা করতো। এখানে ‘ইলাহ’ এর অর্থ যদি করা হয়, “আল্লাহ ছাড়া কোন বিধানদাতা নেই” তাহলে এটা কি কোন সঠিক অর্থ হবে? নিশ্চয় না। কারণ তারা তো করতো মূর্তির ইবাদত, তারা তো মুর্তির বিধান মানতো না। যেহেতু তারা মূর্তি ইবাদত করতো,সেহেতু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ তখনও করা হতো আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ বা উপাস্য নাই। পক্ষান্তরে যদি তখনকার কাফেররা মূর্তির হুকুম মানতো তাহলে, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ “আল্লাহ ছাড়া কোন বিধানদাতা নেই” করা যুক্তিসঙ্গত ছিল।

আরও ক্লিয়ার করে যদি দেখেন যে, হযরত মুসা আ. যখন আল্লাহর সাথে কথা বলার জন্য ত্বুর পাহাড়ের গেলেন, তখন তাঁর উম্মতসহ তাঁর ভাই হযরত হারুণ আ. কে রেখে গেলেন। কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন যে, মুসা আ. এর উম্মতরা গো-বৎসের পুজা করছে। যেটা সামেরী নামক এক ব্যক্তি বিশেষ পদ্ধিতে বানিয়েছিলি। তখন মুসা আ. সামেরীকে বললেন,
وَانظُرْ إِلَى إِلَهِكَ الَّذِي ظَلْتَ عَلَيْهِ عَاكِفًا لَّنُحَرِّقَنَّهُ ثُمَّ لَنَنسِفَنَّهُ فِي الْيَمِّ نَسْفًا
তুই তোর সেই ইলাহের প্রতি লক্ষ্য কর, যাকে তুই ঘিরে থাকতি। আমরা সেটি জালিয়ে দেবই। অতঃপর একে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে ছড়িয়ে দেবই। [সুরা ত্ব-হা : ৯৭]

এখানে তো এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, উম্মতরা তখন গো-বৎসের পুজা বা ইবাদত করছিলো, গো-বৎসের হুকুম মানছিলো না। সেটাকে হযরত মুসা আ. ‘ইলাহ’ বলে সম্বোধন করলেন। সুতরাং এ আয়াত থেকেও প্রমাণ হলো যে, ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ আগের যুগেও ‘মা’বুদ’ বা উপাস্য করা হতো।

উপরন্তু হযরত ইবরাহীম আ. এর যুগে সকল মুশরিকরা মূর্তিকে পূজা করতো। একদিন সবাই মেলায় চলে গেলে ইবরাহীম আ. মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেললেন। তারা এসে মূর্তিগুলোর করুণ দশা দেখে বললো,
قَالُوا مَن فَعَلَ هَذَا بِآلِهَتِنَا إِنَّهُ لَمِنَ الظَّالِمِينَ
তারা বললঃ আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ ব্যবহার কে করল? সে তো নিশ্চয়ই কোন জালিম। [সুরা আম্বিয়া : ৫৯]

এক পর্যায়ে হযরত ইবরাহীম আ. কে ডেকে এনে প্রশ্ন করলো,
قَالُوا أَأَنتَ فَعَلْتَ هَذَا بِآلِهَتِنَا يَا إِبْرَاهِيمُ
তারা বললঃ হে ইব্রাহীম তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ ব্যবহার করেছ। [সুরা আম্বিয়া : ৬২]

এ আয়াত দু’টিতে মুশরিকরা তাদের মূর্তিকে ‘ইলাহ’ বলে সম্বোধন করেছিলো। অথচ তারা তাদের মূর্তিকে শুধু উপাসনা করতো, মূর্তির আইন মানতো না। সুতরাং এ আয়াত থেকেও বুঝা গেলো ‘ইলাহ’ অর্থ সে যুগেও করা হতো ‘মা’বুদ’ বা ‘উপাস্য’।

যখন হযরত ইয়াকুবের আ. ইন্তেকালের সময় তাঁর সন্তানদেরকে বলেন,
إِذْ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعْبُدُونَ مِن بَعْدِي قَالُواْ نَعْبُدُ إِلَـهَكَ وَإِلَـهَ آبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَقَ إِلَـهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ
যখন সে সন্তানদের বললঃ আমার পর তোমরা কার এবাদত করবে? তারা বললো, আমরা তোমার পিতৃ-পুরুষ ইব্রাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের উপাস্যের এবাদত করব। তিনি একক উপাস্য। [সুরা বাকারা : ১৩৩

সুতরাং উক্ত চারটি আয়াত থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিয়মান যে, ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ ‘মাবুদ’ বা ‘উপাস্য’ এটাই ঠিক।

তাফসীরে ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ কী?
সকল তাফসীরেও ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘মা’বুদ’ বা উপাস্য। নিন্মে কয়েকটি তাফসীরের প্রমাণ দিচ্ছি।

তাফসীরে তাবারী:
আল্লামা ইবনে জারীর তবারী রহ. উক্ত আয়াতের তাফসীর করেছেন এভাবে যে, হযরত ইয়াকুব আ. যখন স্বীয় সন্তানদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা আমার মৃত্যুর পর কার ইবাদত করবে?

قالوا نعبد إلهك يعني به قال بنوه له نعبد معبودك الذي تعبده ومعبود آبائك إبراهيم وإسماعيل وإسحاق، إلها واحدا
তখন তাঁরা উত্তর দিল, আমরা আপনার উপাস্য, আপনার পিতা-পিতামহ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক আ. এর উপাস্যের ইবাদত করব। যিনি একমাত্র ইলাহ। -তাফসীরে তাবারী খ. ৩ পৃ. ৯৯

আল্লামা ইবনে জারীর তবারী রহ. এখানে ইলাহের অর্থ উপাস্য করেছেন।

তাফসীরে রাযী:
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহ. স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেন,
أما كفار قريش كانوا يطلقونه في حق الأصنام

অর্থাৎ কুরাইশের কাফেররা ‘ইলাহ’ শব্দটি মূর্তির উপাস্য অর্থে ব্যবহার করত। -তাফসীরে রাযী খ. ১ পৃ. ১৪৯

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অভিমত:
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন,
الإله هو المعبود المطاع
‘ইলাহ’ সেই উপাস্য, যার অনুসরণ করা হয়। -ফাতহুল মাজীদ, পৃ. ৪৬

হাদীস শরীফে ‘ইলাহ’ এর অর্থ:
পবিত্র কুরআনের ন্যায় হাদীস শরীফেও ইলাহ শব্দটি ‘মা’বুদ’ বা ‘উপাস্য’ অর্থে বুঝানো হয়েছে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
يُنَادِي مُنَادٍ: لِيَذْهَبْ كُلُّ قَوْمٍ إلى ما كَانُوا يَعْبُدُونَ، فَيَذْهَبُ أصْحَابُ الصَّلِيبِ مع صَلِيبِهِمْ، وأَصْحَابُ الأوْثَانِ مع أوْثَانِهِمْ، وأَصْحَابُ كُلِّ آلِهَةٍ مع آلِهَتِهِمْ، حتَّى يَبْقَى مَن كانَ يَعْبُدُ اللَّهَ، مِن بَرٍّ أوْ فَاجِرٍ
সেদিন (কিয়ামতে) একজন ঘোষক ঘোষণা করবেন, যারা যে জিনিসের ইবাদাত করতে, তারা সে জিনিসের কাছে গমন কর। এরপর যারা ক্রুশপুজারী ছিল, তারা যাবে তাদের ক্রুশের কাছে। মূর্তিপুজারীরা যাবে তাদের মূর্তির সঙ্গে। সকলেই তাদের উপাস্যের সঙ্গে যাবে। বাকী থাকবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতকারীরা। -সহিহ বুখারী, হাদিস :  ৭৪৩৯

অবশ্য কালেমার অর্থের দাবি এটাও রয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন বিধানদাতা নেই। কিন্তু মূল অর্থ হলো, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। এটা আরবীতে নিরক্ষর যারা তারা কিন্তু বুঝাবে না। জেনে রাখা ভালো পন্নী সাহেব কিন্তু আরবীতে নিরক্ষর ছিলেন। এটা আমার কথা নয়, বরং পন্নী সাহেব নিজেই দাবি করে লিখেছেন,

আমি বাংলা জানি,যেটুকু জানা দরকার মানুষের,ইংলিশ জানি, যতটুকু মানুষের জানা দরকার,আমি আরবী জানি না,আরবীতে আমি নিরক্ষর। ঠিক আক্ষরিকভাবে নয়,কিন্তু আমি আরবী জানি না। আর যে এসলাম নিয়ে কথা সেই এসলাম রোয়েছে কোর’আন-হাদীসে আর সেটার ভাষা আরবী। ওখানে আমি বাস্তবিক অর্থে নিরক্ষর। -আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৫৫

সুতরাং পন্নী সাহেব আরবীতে মুর্খতার চরমসীমায় উপনীত থেকে ‘কালেমার অর্থ বদলে গেছে’ এসব কথা বলে জাতির কাছে নিজেকে হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলেছেন।

কালেমার দ্বিতীয় বিকৃতি:
কুফরী মতবাদ এই হেযবুত তওহীদ কালেমার অর্থকে বিকৃত করে ‘আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নাই’ কথাটির তীব্র সমালোচনা করে তারা মূলত মানুষকে সুকৌশলে বেঈমান বানাতে গভীর ষড়যন্ত্রের ছক একেছেন। তাদের মূল টার্গেট হলো, সব ধর্মের লোকদের জান্নাতি সার্টিফিকেট দেয়া। কারণ তাদের কথা হলো, কে কিসের পূজা করছে সেটা ঈমানের মূল বিষয় নয়, বরং আল্লাহকে বিধানদতা  মানলেই সে মুমিন। ইবাদত মূখ্য বিষয় নয়। অবশেষে এ বিকৃতি কোন পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, তাদের নিচের লেখাটা দেখলে আরো স্পষ্ট বুঝবেন। তারা কালেমার অর্থ বিকৃত করতে করতে অবশেষে লিখছেন,
আমরা নামাজ পড়ছি, মসজিদ নির্মাণ করছি। আমরা হজ্ব করছি, যাকাত দিচ্ছি। এগুলি সব আমল। আমলে পূর্ব শর্ত হচ্ছে। ঈমান কি? লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানবো না। এর অর্থ কি? এর অর্থ হচ্ছে, যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যারা ঐক্যবদ্ধ হবেন, তারা হবেন মোমেন। এই মোমেনের নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত আল্লাহর কাছে কবুল হবে। -সূত্রাপুরে এমামের ভাষণ, পৃ. ৯

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানেই হচ্ছে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। যারা এই অঙ্গীকার করবে তাদের চরিত্র অর্জনের জন্য আল্লাহ নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত এর হুকুম দিয়েছেন। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ১০৯

প্রিয় পাঠক! কালেমার অর্থ যদি করা হয়, “যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া” তাহলে যেসব নাস্তিকরা ন্যায়ের পক্ষে সারা জিবন সংগ্রাম করে গেছেন, তারাও কী তাহলে মুমিন? তারাও কী তওহীদে বিশ্বাসী? তারাও কী ধার্মিক?  তারাও কী মুত্তাকি? আজব হলেও গুজব নয়, এক্ষেত্রে হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, হ্যাঁ! নাস্তিকরাও ধার্মিক ও মুত্তাকি! তারা লিখেছেন-
আল্লাহকে অবিশ্বাসকারী নাস্তিক কমিউনিস্টদের মধ্যেও বহু মানুষ আছেন যারা ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-অঠিক দেখে জীবনের পথ চলতে চেষ্টা করেন। তারা মিথ্যা বলেন না, মানুষকে ঠকান না, অন্যের ক্ষতি করেন না, যতটুকু পারেন অন্যের ভালো করেন, গরিবকে সাহায্য করেন ইত্যাদি। তারা মুত্তাকী। -তাকওয়া ও হেদায়াহ, পৃ. ৭

তাদেরকে যে যা-ই বলুক, আমরা তাদেরকে ধর্মহীন মনে করি না। কারণ মানুষের পরম ধর্ম ‘মানবতা’ তাদের মধ্যে পুরোমাত্রায়ই আছে। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ১১

প্রিয় পাঠক, একটু গভীরভাবে খেয়াল করুন, তাদের দাবি হচ্ছে, যেসব নাস্তিকরা ন্যায়-অন্যায় খেয়াল করে চলেন, তারাও নাকি ধার্মিক ও  মুত্তাকি। অথচ এরা বিশ্বের সকল মুসলমানকে কাফের-মুশরিক বলে আখ্যায়িত করেছে। আমার প্রশ্ন হলো, তাদের দাবি অনুযায়ী কালেমার অর্থ বিকৃত হওয়ার কারণে যদি সকল মুসলমান কাফের-মুশরিক হয়, তাহলে যে কালেমার কোনো অংশের বিশ্বাসই নাস্তিকদের নেই, তারা ধার্মিক এবং মুত্তাকি হলো কিভাবে? এবং মানবতার পাশে থাকলেই যদি সে মুত্তাকি হয়, তাহলে মুসলিমদের মধ্যে যারা আত্মমানবতার কাজ করে থাকেন, তারাও কাফের-মুশরিক হয় কিভাবে?

তাওহীদে বিশ্বাস থাকলে কোনো গুনাহের কী হিসাব লাগবে না?
প্রিয় পাঠক, হেযবুত তওহীদ নামক এ কুফরী সংগঠন কুরআন-হাদিস বিরুধী মনগড়া বক্তব্য দিয়েই চলেছে। কিয়ামতের ময়দানে এমন ভয়নক পরিস্থিতি তৈরি হবে যখন অন্যান্য নবীগণ পর্যন্ত ইয়া নাফসী ইয়া নাফসী করতে থাকবেন। কোনো নবীর উম্মত নিজের ছোট বড় সকল গুনাহের জন্য জবাবদীহি করা ছাড়া কেউ নিস্তার পাবে না।

হেযবুত তওহীদ কী বল?
হেযবুত তওহীদ নামক এ কুৃফরী সংগঠণের দাবী হলো, তাওহীদে অবিচল থাকলে যে গুনাহই করুক না কেন, কোনো সমস্যা নেই, সে জান্নাতে চলে যাবে। এমনকি কবীরা গুনাহ করলেও সে জাহান্নামে যাবে না, বরং সেও হিসাব ছাড়াই যাবে জান্নাতে চলে যাবে। তাদের দাবীগুলো তাদের বই থেকেই দেখুন। তারা লিখেছে,

তওহীদে থাকলে গুনাহ করলেও জান্নাতে যাবে:
এই একটি শর্ত (তওহীদ) পালন করলে কোনো গুনাহই তাকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না। [আকিদা : পৃ. ৭]

তওহীদে থাকলেই ব্যক্তিগত সকল গুনাহ মাফ:
মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনে ভুল-ভ্রান্তি ও গুনাহ করবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু যদি তারা তওহীদের স্বীকৃতি দিয়ে হেদায়েতে অটল থাকে তাহলে তাদের ভয় নেই, ব্যক্তিগত কোন গুনাহই তাদেরকে জান্নাত থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। [তওহীদ জান্নাতের চাবি : পৃ. ১১]

তওহীদ থাকলেই পৃথিবী ভর্তি গুনাহও মাফ:
সেরাতুল মুস্তাকীমে অর্থাৎ তওহিদের যে ব্যক্তি অটল থাকবে, বিচ্যুত হবে না, পৃথিবী ভর্তি গোনাহও তাকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না। [তওহীদ জান্নাতের চাবি : পৃ. ১৩]

তওহীদ থাকলে কবিরা গুনাহও মাফ:
তওহীদে যিনি অবিচলরতার মহাপাপও (গুনাহে কবীরা) হিসাবে ধরা হবে না। [আকিদা : পৃ. ৭]

এমনকি চুরি ও ব্যভিচারের মত কবিরা গুনাহকারীও জান্নাতে যাবে যদি সে সাচ্চা, সত্য সত্যই বিশ্বাস করে যে এলাহ,বিধানদাতা, আল্লাহর ছাড়া আর কেউ নেই। [শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ ও প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৭১]

চুরি,ডাকাতি, ব্যাভিচারের গুনাহও মাফ:
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেন তওহীদের গুরুত্ব প্রচার করছি? এই যে কোর’আনের আয়াত ও হাদীসগুলো উল্লেখ করা হলো, যেগুলোতে দেখা যাচ্ছে কেবল তওহীদের স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে ছোট ছোট অপরাধ তো বটেই, এমনকি চুরি, ব্যভিচার, হত্যা সমস্ত অপরাধকেই ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। [তওহীদ জান্নাতের চাবি : পৃ. ১৫]

এই একটি শর্ত (তওহীদ) পালন করলে কোনো গুনাহই তাকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না;এমনকি মহানবীর উল্লেখিত ব্যভিচার ও চুরির মত কবিরা গোনাহও না। [আকীদা : পৃ. ৭]

আল্লাহ ঘোষণা দিয়ে দিলেন- আমার তাওহীদকে, আমার সার্বভৌমত্বকে যে বা যারা স্বীকার কোরে নেবে, তা থেকে বিচ্যুত হবে না তারা কত এবাদত কোরেছে, তারা কত গোনাহ কোরেছে, কিছুই আমি দেখবো না, তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবো, তারা ব্যভিচার ও চুরি করলেও। [দাজ্জাল : পৃষ্ঠা-১৫]

মৃত্যুদণ্ডের পরে ইসলামের সবচেয়ে কঠিন দন্ড হচ্ছে চুরি আর ব্যভিচারের যারা এই দুটো জঘন্য অপরাধও করবে তাদেরকেও আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন না, যদি সে একমাত্র আল্লাহকেই তার হুকুমদাতা হিসাবে বিশ্বাস ও মান্য করে। [প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৬৫]

প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত কথা দ্বারা তারা দাবী করে বসেছেন যে, তাওহীদে থাকলে ছগিরা-কবিরা গুনাহ, এমনকি হত্যা, যিনা, চুরির মত গুনাহের কারণেও সে জাহান্নামে যাবে না। চলুন দেখি ইসলাম কি বলে।

ইসলাম কী বলে?
তাওহীদে বিশ্বাসী হওয়ার পরও গুনাহগারদেরকে কিয়ামতের ময়দানে হিসাবের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। এমনকি সগীরা গুনাহেরও হিসাব দিতে হবে। এ সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত এবং হাদিস রয়েছে। কয়েকটি দলিল নিন্মে তুলে ধরলাম। মহান আল্লাহ বলেন,
وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا
আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবেঃ হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি-সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না। [সুরা কাহাফ : ৪৯]

يَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَاتًا لِّيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
সেদিন মানুষ বিভিন্ন দলে প্রকাশ পাবে, যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো হয়। অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে। [সুরা যিলযাল : ৬-৮]

উপরন্তু হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ আমাকে বললেন,
يا عائشةُ إِيّاكِ و مُحقَّراتِ الذُّنوبِ فإنَّ لها مِنَ اللهِ طالِبًا
হে আয়েশা, ক্ষুদ্র গুনাহ থেকেও সাবধান হও। কারণ সেগুলোর জন্যও আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। [জামে সগীর, হাদিস নং : ২৯০১]

প্রিয় পাঠক! একবার ভেবে দেখুন তো, হযরত আয়েশা রা. কী তাওহীদে অবিচল ছিলেন না? নিশ্চয় ছিলেন। তারপরও নবিজি সাঃ তাঁকে কেন ছোট ছোট গোনাহ থেকেও বাঁচতে বলেছেন? যেখানে নবিজি সাঃ দাবি করছেন, সগীরা বা ছোট গুনাহেরও হিসাব দিতে হবে, সেখানে হেযবুত তওহীদ দাবি করে বসেছে ‘কবিরা গুনাহেরও হিসাব দিতে হবে না’। এটা কত্তবড় গোমরাহি এবং কুফরী বক্তব্য একটু ভাবুন তো। সুতরাং উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসগুলো থেকে স্পষ্ট হলো যে, ছোট-বড় যেকোনো গুনাহই হোক না কেন কিয়ামতে তার হিসাব দিতেই হবে।

কোন্ সগীরা গুনাহের হিসাব দেওয়া লাগবে না?
অবশ্য যাদের কবীরা গুনাহ নেই, তাদের সগীরা গুনাহ কিয়ামতে মাফ করে দেয়া হবে। মহান রব বলেন-
إِن تَجْتَنِبُواْ كَبَآئِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُم مُّدْخَلاً كَرِيمًا
যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, যদি তোমরা সেসব বড় গোনাহ গুলো থেকে বেঁচে থাকতে পার। তবে আমি তোমাদের ক্রটি-বিচ্যুতিগুলো ক্ষমা করে দেব এবং সম্মান জনক স্থানে তোমাদের প্রবেশ করার। [সুরা নিসা : ৩১]

সুতরাং বুঝা গেলো, কবীরা গুনাহ না থাকলে সগীরা গুনাহ ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু কবীরা গুনাহ তওবা ছাড়া ক্ষমা করা হবে না, বরং কবীরাগুনাহ নিয়ে কবরে গেলে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। যার প্রমাণ অসংখ্য আয়াতে এবং হাদিসে এসেছে। চলুন এখানে কয়েকটি আয়াত এবং হাদিস দেখা যাক।

কিয়ামতে কবীরা গুনাহের হিসাব দিতেই হবে:
পবিত্র কুরআন শরীফে মহান রব বলেন-
وَٱلَّذِینَ لَا یَدۡعُونَ مَعَ ٱللَّهِ إِلَـٰهًا ءَاخَرَ وَلَا یَقۡتُلُونَ ٱلنَّفۡسَ ٱلَّتِی حَرَّمَ ٱللَّهُ إِلَّا بِٱلۡحَقِّ وَلَا یَزۡنُونَۚ وَمَن یَفۡعَلۡ ذَ ٰ⁠لِكَ یَلۡقَ أَثَامࣰا یُضَـٰعَفۡ لَهُ ٱلۡعَذَابُ یَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ وَیَخۡلُدۡ فِیهِۦ مُهَانًا
এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুন হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে। [সুরা ফুরকান : ৬৮-৬৯]

কিন্তু এ জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য কি করতে হবে সে কথাও আল্লাহ তাআলা বলেছেন সাথে সাথেই।
إِلَّا مَن تَابَ وَءَامَنَ وَعَمِلَ عَمَلࣰا صَـٰلِحࣰا فَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ یُبَدِّلُ ٱللَّهُ سَیِّـَٔاتِهِمۡ حَسَنَـٰتࣲۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورࣰا رَّحِیمࣰا
কিন্তু যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পুন্য দ্বারা পরিবর্তত করে এবং দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সুরা ফুরকান : ৭০]

পাঠক! দেখুন উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা পাওয়ার জন্য ৩ টি শর্ত দিয়েছেন। ১. তওবা ২.ঈমান ৩. সৎকর্ম। তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম শুধু তওহীদে বিস্বাস থাকলেই জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়, বরং তওহীদের প্রতি ঈমান আনার পাশাপাশি আরো দু’টি কাজ করতে হবে। ১. গুনাহ থেকে তওবা ২. সৎকাজ করা। উপরন্তু অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
مَا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে। [সুরা ক্ব-ফ : ১৮]

يَوْمَ تَجِدُ كُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ مِنْ خَيْرٍ مُّحْضَرًا وَمَا عَمِلَتْ مِن سُوَءٍ تَوَدُّ لَوْ أَنَّ بَيْنَهَا وَبَيْنَهُ أَمَدًا بَعِيدًا وَيُحَذِّرُكُمُ اللّهُ نَفْسَهُ وَاللّهُ رَؤُوفُ بِالْعِبَادِ
সেদিন প্রত্যেকেই যা কিছু সে ভাল কাজ করেছে; চোখের সামনে দেখতে পাবে এবং যা কিছু মন্দ কাজ করেছে তাও, ওরা তখন কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের মধ্যে ব্যবধান দুরের হতো! আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। [সুরা আলে ইমরান : ৩০]

يُنَبَّأُ الْإِنسَانُ يَوْمَئِذٍ بِمَا قَدَّمَ وَأَخَّرَ بَلِ الْإِنسَانُ عَلَى نَفْسِهِ بَصِيرَةٌ وَلَوْ أَلْقَى مَعَاذِيرَهُ
সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে সে যা সামনে প্রেরণ করেছে ও পশ্চাতে ছেড়ে দিয়েছে। বরং মানুষ নিজেই তার নিজের সম্পর্কে চক্ষুমান। যদিও সে তার অজুহাত পেশ করতে চাইবে। [সুরা কিয়ামাহ : ১৩-১৫]

শয়তানেরর কী ঈমান ছিলো ?
প্রিয় পাঠক, এ বিষয়ে বলার আগে চলুন ইবলিসের পরিচয় জেনে নেয়া যাক। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
كَانَ إِبْلِيسُ اسْمُهُ عَزَازِيلُ وَكَانَ مِنْ أَشْرَافِ الْمَلَائِكَةِ

অর্থাৎ  ইবলিসের নাম ছিলো ‘আযাযিল’ এবং সে ফিরিস্তাদের মধ্যে সবচে সম্মানিত ছিলো। [তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ১ পৃ. ৩৫৮]

কিন্তু এতদ্বসত্বেও আযাযিল ইবলিসে পরিনত হলো কেন? চলুন সেটার প্রমাণ পবিত্র কুরআন থেকে দেখে নেওয়া যাক। মহান রব বলেন,
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ
যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললামঃ আদমকে সেজদা কর, তখন সবাই সেজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে ছিল জিনদের একজন। সে তার পালনকর্তার আদেশ অমান্য করল। [সুরা কাহাফ : ৫০]

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلاَئِكَةِ اسْجُدُواْ لآدَمَ فَسَجَدُواْ إِلاَّ إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ
এবং যখন আমি হযরত আদম (আঃ)-কে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করলো। সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। [সুরা বাকারা : ৩৪]

প্রিয় দ্বীনি ভাই! এখানে একটি বিষয় খুব ভাবুন, ইবলিসের আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাস নিশ্চয় ছিলো।  শুধু বিশ্বাসই ছিলো না, বরং ফিরিস্তাদের মধ্যে সবচে সম্মানিত ছিলো। কিন্তু সে আল্লাহর কাছ থেকে বিতাড়িত হলো কেন? শুধু আল্লাহর বিধানের লঙ্ঘন ও অহংকারের কারণে। আর আল্লাহর বিধান অমান্য করা বা অহংকার করা উভয়টি কিন্তু কবীরা গুনাহ। আর এ কবীরাগুনাহের কারণে কিন্তু ইবলিস বিতাড়িত হয়েছিলো। আর সে পরবর্তিতে মানুষের মাঝে শিরক-কুফর চালু করার কারণে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। সুতরাং বুঝা গেলো, কবীরা গুনাহের কারণে মানুষকে বিচারের আওতায় আনা হবে।

গুনাহের খারাবি:
শুধু কিয়ামতে নয়, বরং দুনিয়াতেও গুনাহের শাস্তি রয়েছে। ১. গুনাহগারকে দুনিয়াতেও শাস্তি দেয়া হয়। মহান রব বলেন,
فَلَمَّا نَسُواْ مَا ذُكِّرُواْ بِهِ أَنجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُواْ بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُواْ يَفْسُقُونَ
অতঃপর যখন তারা (আয়লাবাসী) সেসব বিষয় ভুলে গেল, যা তাদেরকে বোঝানো হয়েছিল, তখন আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম, গোনাহগারদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের না-ফরমানীর দরুন। [সুরা আ’রাফ : ১৬৫]

২. গুনাহের কারণেই দুনিয়াতে গজব নামে। মহান রব বলেন,
ظَهَرَ ٱلۡفَسَادُ فِی ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ بِمَا كَسَبَتۡ أَیۡدِی ٱلنَّاسِ لِیُذِیقَهُم بَعۡضَ ٱلَّذِی عَمِلُوا۟ لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُونَ
স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে। [সুরা রুম : ৪১]

হত্যা, চুরি ও ব্যাভিচারেে গুনাহ:
হেযবুত তওহীদের দাবি ছিলো, ‘কেবল তওহীদের স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে ছোট ছোট অপরাধ তো বটেই, এমনকি চুরি, ব্যভিচার, হত্যা সমস্ত অপরাধকেই ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। [তওহীদ জান্নাতের চাবি : পৃ. ১৫]

ইসলামে হত্যার শাস্তি:
অথচ হত্যাকারীদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا
যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্যে ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। [সুরা নিসা : ৯৩]

চুরির কারণে দুনিয়ার শাস্তি:
চোরদের ব্যাপারে মহান রব বলেন,
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالًا مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
চোর পুরুষ হোক বা স্ত্রী হোক উভয়ের হাত কেটে দাও। এটা তাঁদের কর্মফল এবং আল্লাহর নিকট থেকে শিক্ষামূলক শাস্তিবিধান। আর আমার সর্বজয়ী ও প্রজ্ঞাময়। [সূরা আল-মায়িদা : ৩৮]

চোরদের উপর নবিজি সাঃ-এর অভিশাপ:
হযরত আবু হুরাইরাহ রা. সূত্রে নবি সাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
لَعَنَ اللهُ السَّارِقَ يَسْرِقُ البَيْضَةَ فَتُقْطَعُ يَدُهُ وَيَسْرِقُ الحَبْلَ فَتُقْطَعُ يَدُهُ
চোরের উপর আল্লাহর লা‘নত হোক, যখন সে একটি হেলমেট চুরি করে এবং এ জন্য তার হাত কাটা হয় এবং সে একটি রশি চুরি করে এ জন্য তার হাত কাটা হয়। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৬৭৮৩]

নবিজি সাঃ  হত্যা, চুরিকে হারাম ঘোষণা করেছেন। হযরত আবু বাকরা রা: থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأمْوَالَكُمْ وَأعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ
তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-মাল ও তোমাদের ইজ্জত-সম্মানে হস্তক্ষেপ তোমাদের উপর হারাম। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৪০৬]

যিনা-ব্যভিচারের গুনাহ:
ব্যাভিচার একটা জঘন্য অপরাধ ও কবীরা গুনাহ। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফে মহান রব বলেন-
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ। [সুরা ইসরা : ৩২]

وَٱلَّذِینَ لَا یَدۡعُونَ مَعَ ٱللَّهِ إِلَـٰهًا ءَاخَرَ وَلَا یَقۡتُلُونَ ٱلنَّفۡسَ ٱلَّتِی حَرَّمَ ٱللَّهُ إِلَّا بِٱلۡحَقِّ وَلَا یَزۡنُونَۚ وَمَن یَفۡعَلۡ ذَ ٰ⁠لِكَ یَلۡقَ أَثَامࣰا یُضَـٰعَفۡ لَهُ ٱلۡعَذَابُ یَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ وَیَخۡلُدۡ فِیهِۦ مُهَانًا
এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুন হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে। [সুরা ফুরকান : ৬৮-৬৯]

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُواْ بِاللّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُواْ عَلَى اللّهِ مَا لاَ تَعْلَمُونَ
আপনি বলে দিনঃ আমার পালনকর্তা অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এবং হারাম করেছেন গোনাহ, অন্যায়-অত্যাচার আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার কোন, সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জান না। [সুরা আরাফ : ৩৩]

যিনা, মদ্যপান, চুরি, ডাকাতির সময় ঈমান থাকে না:
হযরত আবূ হুরাইরাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি সাঃ বলেছেন,
لا يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلا يَشْرَبُ الخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلا يَسْرِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلا يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيهَا أبْصَارَهُمْ حِينَ يَنْتَهِبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ
কোন ব্যভিচারী মু’মিন অবস্থায় ব্যভিচার করে না এবং কোন মদ্যপায়ী মু’মিন অবস্থায় মদ পান করে না। কোন চোর মু’মিন অবস্থায় চুরি করে না। কোন লুটতরাজকারী মু’মিন অবস্থায় এরূপ লুটতরাজ করে না যে, যখন সে লুটতরাজ করে তখন তার প্রতি লোকজন চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে। [সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ২৪৭৫]

প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আয়াত এবং হাদিসগুলো থেকে প্রমাণ হলো যে, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, ব্যাভিচার, সুদ, মদপান ইত্যাদীকে ইসলামে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং যারা এসব কাজে লিপ্ত হবে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ
যে কেউ আল্লাহ ও রসূলের অবাধ্যতা করে এবং তার সীমা অতিক্রম করে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সে সেখানে চিরকাল থাকবে। তার জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। [সুরা নিসা : ১৪]

উপরোক্ত আয়াত এবং হাদিসগুলো থাকার পরও কী এ কথা বলার সুযোগ আছে যে, ঈমান থাকলেই আর কোন গুনাহই তাকে জান্নাত থেকে ফিরাতে পারবে না? এরপরও যারা বলেন, ‘তাওহীদে থাকলে চুরি, যিনা, হত্যা ইত্যাদী করলেও জান্নাত নিশ্চিত’ তারা কি আদৌ মুসলিম থাকতে পারে?

একটি অভিযোগ:
‘তওহীদে থাকলেই জাহান্নাম হারাম বা জান্নাতে চলে যাবে’ এ কথাটি বলতে গিয়ে তারা যে দলীল পেশ করে থাকে তা হলো। হযরত আবু যর গিফারী রা. বলেন,
أَتَيْتُ النبيَّ ﷺ وعليه ثَوْبٌ أبْيَضُ وهو نائِمٌ ثُمَّ أتَيْتُهُ وقَدِ اسْتَيْقَظَ فَقالَ ما مِن عَبْدٍ قالَ لا إلَهَ إلّا اللَّهُ ثُمَّ ماتَ على ذلكَ إلّا دَخَلَ الجَنَّةَ قلت وإنْ زَنى وإنْ سَرَقَ؟ قالَ وإنْ زَنى وإنْ سَرَقَ قلت وإنْ زَنى وإنْ سَرَقَ قال وإنْ زَنى وإنْ سَرَقَ قُلتُ وإنْ زَنى وإنْ سَرَقَ قال وإنْ زَنى وإنْ سَرَقَ
আমি নবীজি সা. এর কাছে আসলাম। দেখলাম, তিনি সাদা কাপড় শরীর মোবারকের উপরে দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। পরে আবার এসে জাগ্রত দেখলাম। নবীজি সা. বললেন, যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে সে মৃত্যুর পর জান্নাতে যাবে। আবু যর রা. তখন বললেন, যদি সে যিনা ব্যভিচার করে তবুও? নবীজি সা. বললেন, হ্যাঁ, যদি যিনা ব্যাভিচার করে তবও। আবু যর রা. বললেন, যদি সে যিনা ব্যভিচার করে তবুও? নবী সা. বললেন, হ্যাঁ, যদি যিনা ব্যাভিচার করে তবও। আবু যর রা. বললেন, যদি সে যিনা ব্যভিচার করে তবুও? নবীজি সা. বললেন, হ্যাঁ, যদি যিনা ব্যাভিচার করে তবুও। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৫৮২৭]

উক্ত হাদিস দ্বারা তো বুঝা যাচ্ছে, শুধু তওহীদে থাকলেই কবীরা গুনাহ হলেও জান্নাত নিশ্চিত।

জবাব:
এটা হলো হেযবুত তওহীদের বড় ভ্রষ্টতা ও মুর্খতা যে, তারা একটি হাদিস দেখেই ফতাওয়া দিয়ে দেয়। অথচ তাদের জানা থাকা দরকার, নবিজি সাঃ-এর থেকে প্রায় ১০ লাখ হাদিস রয়েছে। এই একটি হাদিস দেখেই ফতাওয়া দিলে উপরোল্লিখিত আয়াত-হাদিসসহ আরো অগণিত আয়াত হাদিস যে বাদ দিতে হবে, সেটার কিন্তু খেয়াল তারা করলেন না। এ ক্ষেত্রে তিনটি জবাব লক্ষনীয়।

এক. কোনো মুমিন কবীরা গুনাহ করে, দুনিয়া থেকেই যদি তওবা করে যায়, তাহলে আখেরাতে ক্ষমা পাবে। মহান আল্লাহ বলেন,
إِلَّا مَن تَابَ وَءَامَنَ وَعَمِلَ عَمَلࣰا صَـٰلِحࣰا فَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ یُبَدِّلُ ٱللَّهُ سَیِّـَٔاتِهِمۡ حَسَنَـٰتࣲۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورࣰا رَّحِیمࣰا
কিন্তু যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পুন্য দ্বারা পরিবর্তত করে এবং দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সুরা ফুরকান : ৭০]

দুই. তওবা করে না গেলেও আল্লাহ ইচ্ছা করলে মুমিনদের কাউকে শুরুতেই মাফ করতে পারেন। কারণ কুরআন শরীফে এসেছে,
أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَـٰوَ ٰ⁠تِ وَٱلۡأَرۡضِ یُعَذِّبُ مَن یَشَاۤءُ وَیَغۡفِرُ لِمَن یَشَاۤءُۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَیۡءࣲ قَدِیرࣱ
তুমি কি জান না যে আল্লাহর নিমিত্তেই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের আধিপত্য। তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন এবং যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। [সুরা মায়িদা : ৪০]

তিন. উপরোক্ত হাদিসটি ব্যখ্যা সাপেক্ষ। অর্থাৎ হাদিসে যে বলা হচ্ছে- যিনা ব্যাভিচার করলেও জান্নাতে যাবে। এর অর্থ হলো ‘গুনাহের কারণে জাহান্নামে যাবে। আর তওহীদের কারণে একদিন সে আবার জান্নাতে ফিরে আসবে। আর এ কথাটি আমার বানানো জবাব নয়, বরং নবিজি সাঃ এর আরেকটি হাদিসেই প্রমাণ রয়েছে। হযরত আনাস রা. নবিজি সাঃ থেকে বর্ণনা করেন,
يَخْرُجُ مِنَ النّارِ مَن قالَ لا إلَهَ إلّا اللَّهُ، وفي قَلْبِهِ وزْنُ شَعِيرَةٍ مِن خَيْرٍ، ويَخْرُجُ مِنَ النّارِ مَن قالَ لا إلَهَ إلّا اللَّهُ، وفي قَلْبِهِ وزْنُ بُرَّةٍ مِن خَيْرٍ، ويَخْرُجُ مِنَ النّارِ مَن قالَ لا إلَهَ إلّا اللَّهُ، وفي قَلْبِهِ وزْنُ ذَرَّةٍ مِن خَيْرٍ
যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাহ বলেছে এবং অন্তরে যব পরিমান নেকি থাকবে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং তাকেও বের করা হবে যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে এবং আমল নামায় গম পরিমান নেক রয়েছে এবং তাকেও বের করা হবে যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে এবং অন্তরে অনুপরিমান নেকি রয়েছে। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৪]

প্রিয় পাঠক! উক্ত হাদিসে বলা হলো তওহীদ থাকলেও জাহান্নামে যাবে। কিন্তু শাস্তি ভোগ করে একদিন ঈমানের কারণে সে আবার বের করা হয়ে জান্নাতে যাবে। কারণ বেঈমানদের কোন মুক্তি নেই। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবিজি সাঃ বলেছেন,
يَلْقى إبْراهِيمُ أباهُ فيَقولُ يا رَبِّ إنَّكَ وعَدْتَنِي أنْ لا تُخْزِيَنِي يَومَ يُبْعَثُونَ، فيَقولُ اللَّهُ: إنِّي حَرَّمْتُ الجَنَّةَ على الكافِرِينَ
(কিয়ামতের দিন) ইবরাহীম আঃ তাঁর বাবা (আযরের) সাথে দেখা করবেন। অতঃপর আল্লাহ তা’য়ালাকে বলবেন হে আল্লাহ! আপনি কি আমার সাথে ওয়াদা করেননি যে, আমাকে কেয়ামতের দিন অপমানিত করবেন না? (অর্থাত বাবাকে আসামী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার মত অপমান আমাকে করবেন না।)তখন আল্লাহ তা’য়ালা বলবেন আমি কাফেরদের জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৭৬৯]

অর্থাৎ বেঈমানদের কোন মুক্তি হবে না। তবে ঈমানদারগণ শাস্তি ভোগ করে একদিন জাহান্নাম থেকে মুক্ত হয়ে জান্নাতে যাবে। আর এ কথাই নবিজি সাঃ বলেছেন যে, যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লালাহ বলবে সে জান্নাতে যাবে। সে যিনা করুক বা চুরি করুক। একদিন না একদিন জান্নাতে যাবে।

হেযবুত তওহীদের এ অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্য কী?
এ হাদিসটি নিয়ে অপব্যখ্যা করে হেযবুত তওহীদে তাদের সদস্যদের অন্তরে কৌশলে গুনাহের ভয় উঠিয়ে সবাইকে জাহান্নামের দিকে ধাক্কা দিচ্ছে। আর মানুষ কো সহজ ইসলাম খুঁজে। ফলে দাজ্জালের এ ফাঁদে পা দিয়ে তারা মূলত জাহান্নামের পথিকই হচ্ছে।

স্ববিরোধী বক্তব্য:
তবে চোর চুরি করলেও নিশানা রেখে যায়। এমনটিই করেছে এ কুফরী সংগঠন হেযবুত তওহীদ। কারণ তারা এক জায়গায় তাদের অজান্তেই তাদের মতবাদ বিরোধী কথা লিখেই ফেলেছেন,
যারা তাঁর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার কোরে নিয়ে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে পাঠানো আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধকে তাদের সমষ্ঠিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ কোরবে, তাদের তিনি গ্রহণ কোরবেন, ব্যক্তিগত সমস্ত অপরাধ, গোনাহ মাফ কোরে তাদের জান্নাতে স্থান দেবেন। [দাজ্জাল : পৃ. ১২]

মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব নয়, সে দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে গঠিত একটি সামাজিক জীব। শুধু ইহকাল নয়, তার পরকালও আছে। মানুষের আত্মারই তার পরিচালক, তাই তাকে অবশ্যই এই শিক্ষা দিতে হবে যে তার প্রত্যেকটি কাজ ও চিন্তা প্রত্যক্ষ করছেন এবং হিসাব রাখছেন একজন সর্বশ্রেষ্ঠ, ক্ষমতাবান স্রষ্টা। প্রতিটি মানুষকে একদিন যাবতীয় কর্মের হিসাব দিতে হবে এবং জবাবদিহি করতে হবে, তার জন্য পুরস্কার ও কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে’। [গণমাধ্যমের করণীয় : পৃ. ৪১]

সুতরাং প্রমাণ হলো, কিয়ামতে শুধু তাওহীদে ঈমান থাকলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে না। অবশ্যই গুনাহের জন্য জাহান্নামে যেতে হবে। তবে আল্লাহ যদি কাউকে দয়া করে ক্ষমা করে দেন, সেটা তাঁর দয়া। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়ম হলো, গুনাহগারকে অবশ্যই জাহান্নামে যেতে হবে। শাস্তি শেষে বা আল্লাহ যখন চান তখন মুমিনদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। সুতরাং বুঝা গেলো, প্রত্যেকটা গুনাহের হিসাব দিতে সবাইকে তৈরি থাকতে হবে। কিন্তু হেযবুত তওহীদ যে দাবি করেছে, তা নিতান্তই গোমরাহি ও ভ্রষ্টতা। মহান রব আমাদেরকে তাদের ষড়যন্ত্রের কবল থেকে হিফাযত করেন। আমীন।

ব্যক্তিগত জীবনে তাওহীদ মানা কী শিরক?
প্রিয় পাঠক, ইসলামের মূল স্তম্ভ হলো, ‘তাওহীদ’ তথা আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাস করা। এই বিশ্বাস দায়েমি তথা সর্বক্ষণের জন্য ফরজ। এক মূহুর্তের জন্য তাওহীদ থেকে বিচ্যূৎ হওয়ার সুযোগ নেই। মুমিন হতে গেলে  সর্বপ্রথম নিজের ব্যক্তিগত জিবনে ওয়াহদানিয়াত বা তাওহীদের বিশ্বাস করতে হবে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ব্যক্তিগত জিবনে তাওহীদ মানা শিরক। দেখুন তারা কী লিখেছে-

রসূলাল্লাহ আগমনের আসল উদ্দেশ্য সারা পৃথিবীতে সর্বাত্বক সংগ্রামের মাধ্যমে আল্লাহর তাওহীদভিত্তিক সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করা। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ৫৩

আরবের মোশরেক অধিবাসীরা আল্লাহকে খুবই বিশ্বাস করত, আজ যেমন আমরা করি, কিন্তু আল্লাহর দেয়া দীন জীবন-বিধান মোতাবেক তাদের সমষ্ঠিগত জাতীয় জীবন পরিচালনা করত না। তাদের সামাজিক, জাতীয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, দন্ডবিধি এ সমস্তই পরিচালিত হতো হাবল, লা’ত মানাত ওজ্জা কোরায়েশ পুরোহিতদের তৈরি করা আইন-কানুন ও নিয়ম দিয়ে। তারা বুঝত না যে আল্লাহকে যতই বিশ্বাস করা হোক, ব্যক্তিগতভাবে যতই কঠিন এবাদত করা হোক, যতই তাক্ওয়া করা হোক, জাতীয় জীবন আল্লাহর দেওয়া দীন আইন-কানুন, দন্ডবিধি অর্থনীতি দিয়ে পরিচালিত না হলে সেটা আল্লাহর তওহীদ হবে না, সেটা হবে শেরক ও কুফর। -এসলামের প্রকৃত রুপরেখা, পৃ. ৫৭

আজকের ব্যক্তিগত জীবনের ওয়াহদানিয়াত নয়, পূর্ণ জীবনের ওয়াহদানিয়াত, ব্যক্তিগত ও জাতীয় উভয় জীবনের ওয়াহদানিয়াত। শুধু ব্যক্তিগত জীবনের ওয়াহদানিয়াত হোচ্ছে শেরেক। আজ পৃথিবীর অতি মুসলিমরা নামাজে,রোজায়, হজ্বে, তাহাজ্জুদে, তারাবিতে, দাড়িতে, টুপি-পাগড়িতে, পায়জামায়, কোর্তায় নিখুঁত। শুধু একটি মাত্র ব্যাপারে তারা নেই, সেটা হলো, তাওহীদ, ওয়াহদানিয়াত। যে আংশিক অর্থাৎ ব্যক্তিগত ওয়াহদানিয়াত ঐ অতি মুসলিমদের মধ্যে আছে, তা আল্লাহ আজও যেমন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান কোরে রেখেছেন, হাশরের দিনও তেমনই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান কোরবেন। -এ ইসলাম ইসলামই নয়, পৃ. ১৮৬-১৮৭

অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর একাত্ববাদ তথা তাওহীদে বিশ্বাস করা শিরক।

ইসলাম কী বলে?
সামষ্টিকজিবনে ওয়াহদানিয়্যাত প্রতিষ্ঠা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে। কিন্তু একজন মানুষ ঈমান আনতে গেলে সর্বপ্রথম নিজের মধ্যে তাওহীদের বিশ্বাস আনতে হবে। সেটাও যদি শিরক হয়, তাহলে মানুষের জন্য মুসলমান হওয়ার কোনো সুযোগ কী করে থাকে? কী হাস্যকর কথা! কোনো সুস্থ মানুষ কী এসব বলতে পারে? ব্যক্তিগতজীবনে যারা ওয়াহদানিয়্যাত বা তাওহীদে বিশ্বাস আনে, তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
بَلَى مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِندَ رَبِّهِ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ
হাঁ, যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সমর্পন করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও বটে তার জন্য তার পালনকর্তার কাছে পুরস্কার বয়েছে। তাদের ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। [সূরা বাকারা : ১১২]

এ আয়াতে ব্যক্তিজিবনে তাওহীদের বিশ্বাস ও নেক আমলের কথা বলা হয়েছে এবং এমন লোকদের জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। যদি ব্যক্তিজিবনে তাওহীদের বিশ্বাস শিরক হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ কী?অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন,
أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা করো। [সূরা তাহরীম : ৬]

এ আয়াতে প্রথমত নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে বলা হয়েছে। উপরন্তু হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবি সাঃ হযরত মুয়াজ রা. কে বলেন,
مَا مِنْ أَحَدٍ يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ صِدْقًا مِنْ قَلْبِهِ إِلاَّ حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ ‏
যে কোন বান্দা আন্তরিকতার সাথে এ সাক্ষ্য দেবে যে, ’আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ তার জন্য আল্লাহ তা’আলা জাহান্নাম হারাম করে দেবেন। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১২

এ হাদিসেও ব্যক্তিগত জিবনে তাওহীদের বিশ্বাসের কথা বলে জাহান্নাম হারাম হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আরেকটি হাদিসে এসেছে, হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন,
سَتَكُونُ فِتَنٌ الْقَاعِدُ فِيهَا خَيْرٌ مِنْ الْقَائِمِ وَالْقَائِمُ خَيْرٌ مِنْ الْمَاشِي وَالْمَاشِي فِيهَا خَيْرٌ مِنْ السَّاعِي مَنْ تَشَرَّفَ لَهَا تَسْتَشْرِفْهُ فَمَنْ وَجَدَ مَلْجَأً أَوْ مَعَاذًا فَلْيَعُذْ بِهِ
শীঘ্রই ফিতনা দেখা দেবে। তখন উপবিষ্ট ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তির চেয়ে ভাল (ফিতনামুক্ত) থাকবে, দাঁড়ানো ব্যক্তি চলমান ব্যক্তির চেয়ে ভাল থাকবে, চলমান ব্যক্তি ধাবমান ব্যক্তির চেয়ে ভাল থাকবে। যে ব্যক্তি সে ফিতনার দিকে তাকাবে, ফিতনা তাকে ঘিরে ধরবে। কাজেই তখন কেউ যদি কোথাও কোন নিরাপদ আশ্রয়স্থল কিংবা আত্মরক্ষার ঠিকানা পায়, তাহলে সে যেন সেখানে আশ্রয় নেয়। [সহিহ বুখারী, হাদিস : ৭০৮২]

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ থেকে বর্ণিত, নবি সাঃ বলেন,
يُوشِكُ أَنْ يَكُونَ خَيْرَ مَالِ الْمُسْلِمِ غَنَمٌ يَتْبَعُ بِهَا شَعَفَ الْجِبَالِ وَمَوَاقِعَ الْقَطْرِ، يَفِرُّ بِدِينِهِ مِنَ الْفِتَنِ
সেদিন দূরে নয়, যেদিন মুসলিমের উত্তম সম্পদ হবে কয়েকটি বকরী, যা নিয়ে সে পাহাড়ের চুড়ায় অথবা বৃষ্টিপাতের স্থানে চলে যাবে। ফিতনা থেকে বাঁচতে সে তার দ্বীন নিয়ে পালিয়ে যাবে। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১৯

এ দু’টি হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণ হলো যে, সামষ্টিকজিবনে যখন অনৈসলামিক কার্যক্রম ব্যাপক হবে, তখন ঈমানদাররা তাঁদের ঈমান নিয়ে কোনো নিরাপত আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ নবীজি সা. নিজে দিয়েছেন। এখন এ লোকটার তাওহীদের বিশ্বাসও কি শিরক হবে? কতবড় বিভ্রান্তি! উপরন্তু সাহাবাদের ব্যাপারে হেযবুত তওহীদ নিজেরাই লিখেছে-
শত নির্যাতন নিপীড়ন বিদ্রূপ অপমান উপেক্ষা করে, খেয়ে না খেয়ে, গাছের লতা-পাতা খেয়ে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। এই সময় যেসব সাহাবী ইন্তেকাল করেন তারা ইসলাম বলতে কি পেয়েছিলেন? তার নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত ঈদ কোরবানি কিছুই পেয়েছিলেন কি? তারা পেয়েছেন শুধুমাত্র তাওহীদ এবং বলার অপেক্ষা রাখেনা তাওহীদই তাদের সফলকাম হয়ে জান্নাতে প্রবেশের জন্য যথেষ্ট ছিল। -তওহীদ জান্নাতের চাবি, পৃ. ১০

সুতরাং বুঝা গেলো, নবি সাঃ ও সাহাবায়ে কেরামরা. প্রথমত ব্যক্তি জিবনেই তাওহীদের বিশ্বাসী ছিলেন। হেযবুত তওহীদের ফাতাওয়ায় তাহলে আল্লাহর রাসুল সা. এবং সাহাবায়ে কেরামও মুশরিক? নাউযুবিল্লাহ। কতবড় জাহালাত!

যুক্তির আলোকে কী ঈমান আনতে হবে?
ইসলামের পুর্ণ কন্সেপ্টাই নির্ভর করে ওহীর জ্ঞানের উপর। যুক্তির উপর ইসলাম নির্ভর করে না, বরং আল্লাহ’র উপর ঈমান ও তাঁর বিধান পালনে যুক্তির পথে চলা, শয়তানের পদ্ধতি।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের ঈমান বিধ্বংসী আক্বীদা হলো, আল্লাহ তা’আলার উপর ঈমান আনতে হবে যুক্তির ভিত্তিতে। দেখুন তারা কী বলে-
আমরা মনে করি, আল্লাহ যদি চাইতেন সবাই আল্লাহর উপর ঈমান রাখবে সেটা আল্লাহ এক মুহূর্তেই করতে পারতেন।কিন্তু আল্লাহ চান মানুষ তার যুক্তি-বিচার দিয়ে আল্লাহকে জেনে নিক।মানুষের আসল পরীক্ষাটাই হল তার স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি( Free will)’। -চলমান সংকট নিরসনে আদর্শিক লড়াইয়ের অপরিহার্যতা, পৃ. ১৩

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে বিশ্বাস করার বেলায় কোথাও বলেননি অন্ধের মত শুধু আমাকে বিশ্বাস করো। তিনি বলেছেন দৃষ্টি নিক্ষেপ করো দেখো আমার সৃষ্টির কোথাও কোন খুঁত পাও কিনা? কাজেই আমি বলব, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো দিকে ছোটার আগে বিচার করুন, বিশ্লেষণ করুন, কেন সেদিকে যাবেন? কি জন্য যাবেন তাতে আপনার কি উপকার? আপনার জাতির কি উপকার? মানবজাতির কি উপকার’? -সূত্রাপুরে এমামের ভাষন, পৃ. ৫

অর্থাৎ তাদের মতমতবাদ হলো, যুক্তি দিয়েই আল্লাহ’কে বিশ্বাস করতে হবে।

ইসলাম কী বলে?
আল্লাহ তা’আলার উপর ঈমান আনয়নের মূল ভিত্তি যুক্তি নয়, বরং ওহী। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ والَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ أُوْلَـئِكَ عَلَى هُدًى مِّن رَّبِّهِمْ وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে। এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সেসব বিষয়ের উপর যা কিছু তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের উপর যা তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর আখেরাতকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে। তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম। [সুরা বাক্বারা : ৩-৫]

উক্ত আয়াতে মুত্তাকীদের কয়েকটি গুণের উল্লেখ করা হয়েছে। অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন, নামায প্রতিষ্ঠা করা, স্বীয় জীবিকা থেকে সৎপথে ব্যয় করা, আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় ও আখেরাতের উ ঈমান রাখা। এ আয়াতগুলোর মধ্যে কতগুলো জরুরি বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো, ‘অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন করা।’ এই অদৃশ্যের প্রতি ঈমানের সাথে যুক্তি সম্পৃক্ত করলে কারোর পক্ষেই ঈমান আনা সম্ভব নয়। কারণ পুরোটাই তো অদৃশ্যে থাকে। অদৃশ্যমান বিষয়কে কিভাবে যুক্তি দিয়ে মান্য করা সম্ভব?

সুতরাং ঈমানের মূল ভিত্তি ‘গায়েব’ বা অদৃশ্য বিষয়াদির উপর। স্রষ্টার অস্তিত্ব, তাঁর গুণাবলী, ফিরিশতা,সৃষ্টিজগতের সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক, পরকালীন জীবন ইত্যাদি সবই মূলত অদৃশ্য বিষয়। পঞ্চ-ইন্দ্রিয় বা মানবীয় জ্ঞান, বুদ্ধি বা বিবেক দিয়ে এগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না।মানবীয় জ্ঞান, বুদ্ধি বা বিবেক এগুলোর বাস্তবতা ও সম্ভাব্যতা অনুভব ও স্বীকার করে। কিন্তু এগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। এ বিষয়ে যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে অনেক বিতর্ক করা সম্ভব, তবে কোনো সুনির্ধারিত ঐকমত্যে পৌঁছানো যায় না। এজন্যই মূলত ঈমানের বিষয় পুরোটিই ওহীর উপর নির্ভর করতে হয়, যুক্তির উপরে নয়। এজন্য আল্লাহ তা’আলা ঈমান আনয়ণ করতে বলেছেন অদৃশ্যের উপর। উপরন্তু কুরআনুল কারীমে ঈমানের মডেল হিসাবে সাহাবায়ে কেরাম রা. কে উপস্থাপন করে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
اٰمِنُوۡا کَمَاۤ اٰمَنَ النَّاسُ
মানুষেরা (সাহাবীরা) যেভাবে ঈমান এনেছে, তোমরাও সেভাবে ঈমান আনো। [সুরা বাক্বারা : ১৩]

সাহাবায়ে কেরাম রা. কিভাবে ঈমান এনেছিলেন?
সাহাবায়ে কেরামের রা. নীতি ছিলো, কুরআনুল কারীমে বা রাসূলুল্লাহ সা. এর মুখে যা কিছু তাঁরা শুনেছেন বা জেনেছেন, সেগুলোকে বিনা বাক্যে ও নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেছেন। এগুলোর বিষয়ে অকারণ যুক্তি তালাশ করেননি। তাঁদের কর্মপদ্ধতি কী ছিলো, তা মহান রব পবিত্র কুরআনে উল্লেখ্য করেছেন, তাঁরা বলতেন,
سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا
আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। [সূরা নূর : ৫১]

সুতরাং প্রমাণ হলো, ঈমান মূল থিম হলো, ওহীর আলোকে কোনো যুক্তি তালাশে না গিয়ে সাথে সাথেই মেনে নেওয়া।

ঈমান না থাকলেও কী জান্নাতে যাওয়া যাবে?
জান্নাতে যাওয়ার প্রথম ও পূর্ব শর্ত হলো, ঈমান আনয়ন করা। কিন্তু হেযবুত তওহীদ বেঈমানদেরও জান্নাতের টিকেট ধরিয়ে দিচ্ছে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদ মূলত তওহীদের স্লোগানে মানুষকে তওহীদ থেকেই আলাদা করতে চায়। তারা ঘুরিয়ে পেচিয়ে ঠিক এ মতবাদটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে, জান্নাতে যাওয়ার জন্য তাওহীদ, ঈমান বা ইসলামের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। যদিও তারা প্রকাশ্যভাবে এ দাবিটা করে না। তবে তাদের নিন্মোক্ত বক্তব্যগুলো পড়লেই বুঝবেন তারা কী বলতে চায়। চলুন তাদের মতবাদটা বুঝে নেওয়া যাক। তারা বলে-

এক. ধর্ম পরিবর্তন করানো ইসলামের কাজ না:
‘মানুষের ব্যক্তিগত ধর্ম পরিবর্তন করা এসলামের উদ্দেশ্য নয়, এসলামের মূল উদ্দেশ্য সামষ্টিক জীবনে ন্যায়-সুবিচার শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। -আসুন সিস্টেমটাকেই পাল্টাই, পৃ. ১৮।

দুই. ঈমান ও ইসলাম হেযবুত তওহীদের মিশন নয়:
‘আমরা কাউকে ইসলাম হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বা ইহুদী ইত্যাদি কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করছি না। আমাদের কথা হচ্ছে যার যার ধর্ম বিশ্বাস তার তার কাছে’। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ১০৫

‘আমরা কাউকে কোন বিশেষ ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না’। -সবার উর্ধ্বে মানবতা, পৃ. ১০

তিন. ঈমান আনানো হেযবুত তওহীদের কাজ নয়:
ডান-বাম যা-ই হোন না কেন, মানুষের অশ্রুতে যার হৃদয় সিক্ত হয়, ঘুঁনে ধরা সমাজটিকে যারা পুনঃ নির্মাণ করতে চান, সর্বপ্রকার অবিচার অত্যাচার ও শোষণের প্রতিবাদে যার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ওঠে, সেই মানবধর্মের অনুসারীদের প্রতি আমাদের আহ্বান- আসুন পাওয়া গেছে’। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ১২

‘আমরা বলি না যে, আপনারা আল্লাহ বিশ্বাসী হয়ে যান, মো’মেন হয়ে যান, পরকালে বিশ্বাসী হয়ে যান, আল্লাহর প্রতি কে ঈমান আনবে না আনবে সেটা তারা আল্লাহ সঙ্গে বুঝবে। সুতরাং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করানো আমাদের কাজ নয়’। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ৫২

প্রিয় পাঠক, হেযবুত তওহীদের উপরোক্ত তিনটা দাবি থেকে বুঝা গেলো, হেযবুত তওহীদের মূল মিশন ঈমান বা ইসলাম নয়। অথচ তারাই আবার বলছে-

এক. হেযবুত তওহীদে থাকলে নিশ্চিত জান্নাত:
‘হেযবুত তওহীদে যারা সত্যিকার ভাবে এসেছ তাদের জন্য জান্নাত তো নিশ্চিত।এইখানেও যেন কারো মনে কোন সন্দেহ না থাকে যে জান্নাত নিশ্চিত’। -আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা, পৃ. ৬৩

দুই. হেযবুত তওহীদে না আসলে জান্নাত নেই:
‘মানবজাতিকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার সমাধান আল্লাহ হেযবুত তওহীদর কাছেই দিয়েছেন। তাই এই মহাসত্যকে যারা গ্রহন করবে না, তাদের মুক্তির উপায় নাই’। -এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব, পৃ. ৫১

‘যতই অপপ্রচার করা হোক আল্লাহ সমস্ত মানবজাতির উদ্ধারকর্তা হিসেবে হিজবুত তাওহীদকে মনোনীত করেছেন। মানবজাতিকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার সমাধান আল্লাহ হেযবুত তওহীদর কাছেই দিয়েছেন। তাই এই মহাসত্যকে যারা গ্রহন করবে না, তাদের মুক্তির উপায় নাই’। -এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব, পৃ. ৫১

অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, হেযবুত তওহীদ গ্রহণ করলেই জান্নাত, আর না করলে তার মুক্তি নেই, মানে জাহান্নামী। তাহলে ফলাফল কী দাঁড়ালো? তারা আগে বলেছেন,
১. ইসলাম হেযবুত তওহীদের মিশন নয়।
২. ঈমান আনানো হেযবুত তওহীদের কাজ নয়।

আবার পরে বললেন,
১. হেযবুত তওহীদে থাকলে নিশ্চিত জান্নাত।
২. হেযবুত তওহীদে না আসলে জান্নাত নেই।

তার মানে দাঁড়ালো, এই ইসলাম ও ঈমান না থাকলেও শুধু হেযবুত তওহীদের মতবাদ গ্রহণ করলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে। জি হ্যাঁ, এটাই তাদের মতবাদ। তবে তারা একটা শর্ত করেছে জান্নাতে যাওয়ার। সেটা হলো, মানুষের কষ্ট অনুভব করা তথা মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা। এজন্য তারা আরও লিখেছে,

‘ ওহে কথিত ধার্মিকরা, ওহে মোসলমান ভায়েরা, ওহে হিন্দু ভায়েরা, ওহে বৌদ্ধ ভায়েরা, ওহে খ্রিস্টান ভায়েরা,…..আজ সারা দুনিয়াময় মানবতা বিপর্যস্ত। এই মানুষকে রক্ষার জন্য আপনারা এগিয়ে আসুন। তাহলে আপনারা হবেন ধার্মিক, আপনার হবেন মো’মেন। আপনারা হবেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা, আপনাদের জন্য জান্নাত -স্বর্গ রয়েছে। -সূত্রাপুরে এমামের ভাষণ, পৃ. ২১

কাজেই এই আদর্শের লড়াইয়ে বা আদর্শের সৈনিকদের কেউ এগিয়ে আসতে হবে আমরা বলছি না যে আপনাকে বিশেষ কোন ধর্মে বিশ্বাসী হতে হবে সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানুষকে বাঁচানোর জন্য জঙ্গিবাদ ধর্মব্যবসা স্বার্থের রাজনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার মোটিভেশন করা দরকার সেটা ত্যাগী মানুষদেরকে দিয়েই। আমাদের ইহকালের সমস্যা তাই সমাধানটাও ইহকালের হিসেবেই করতে চাই। পবিত্র কোর’আনে আছে যার ইহকাল ভালো তার পরকালও ভালো’। -আদর্শিক লড়াই, পৃ. ১৪

‘ডান-বাম যা-ই হোন না কেন, মানুষের অশ্রুতে যার হৃদয় সিক্ত হয়, ঘুঁনে ধরা সমাজটিকে যারা পুনঃ নির্মাণ করতে চান, সর্বপ্রকার অবিচার অত্যাচার ও শোষণের প্রতিবাদে যার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ওঠে, সেই মানবধর্মের অনুসারীদের প্রতি আমাদের আহ্বান- আসুন পাওয়া গেছে’। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ১২

‘মানুষ যদি বুঝতে সক্ষম হতো যে মানুষের উপকার করাই ধর্মের শিক্ষা, এটাই তার জান্নাতে যাওয়ার পথ, তাহলে মানবসমাজ কি এত দুঃখ দারিদ্র্য, বৈষম্য, অবিচার আর অশান্তিতে পূর্ণ হতো’? -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ৩৭

‘এক কথায় মানুষকে সুখ-শান্তি নিরপত্তার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোই মানুষের প্রকৃত এবাদত। এই এবাদত করলে সে পরকালে জান্নাত পাবে’। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ৫১

অর্থাৎ উপরোক্ত তাদের সকল দাবীগুলো একত্রিত করলে যে ফলাফল বের হবে তা হলো, হেযবুত তওহীদ গ্রহণ করে মানবসেবা করলেই জান্নাত সুনিশ্চিত। এ ক্ষেত্রে ইসলাম ও ঈমান গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক নয়।

অভিযোগ:
হয়তো অনেকে বলতে পারেন, তারা তো তাওহীদের কথা বলে তাহলে এটা কিভাবে মানতে পারি যে তারা ঈমানের শর্ত দেয় না?

জবাব:
এক. উপরে তারা নিজেরাই বলেছে ঈমান তাদের কাজ নয়। তাহলে ঈমান যাদের মিশনই নয়, তাদের তাওহীদ প্রচারের অর্থ কী?

দুই. ‘কালেমার অর্থ তাওহীদ বা ঈমান আনয়ণ করা’ এটা তো তারা মনেই করে না। দেখুন তারা কালেমার অর্থ বিকৃত করে কী অর্থ নিয়েছেন। তারা লিখেছেন,
ঈমান কি? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানবো না। এর অর্থ কি? এর অর্থ হচ্ছে, যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যারা ঐক্যবদ্ধ হবেন, তারা হবেন মোমেন। -সূত্রাপুরে এমামের ভাষণ, পৃ. ৯

তার মানে কালেমার মধ্যেও তারা আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমানের বিষয়টি উঠিয়ে দিয়েছে। এক কথায় তাদের কাছে জান্নাতে যাওয়ার জন্য ঈমান-ইসলাম শর্ত নয়। চলুন ইসলাম কী বলে দেখে যাক-

ইসলাম কী বলে?
ঈমান হলো একজন মানুষের সবচে বড় অর্জন। কিয়ামতের দিন  কোনো বেঈমানের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। মহান রব বলেন,
اللّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُواْ يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوُرِ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ أَوْلِيَآؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে আসেন। আর যারা কুফর অবলম্বন করেছে তাদের অভিভাবক শয়তান, যারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারা সকলে অগ্নিবাসী। তারা সর্বদা তাতেই থাকবে। [সুরা বাকারা : ২৫৭]

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ لَن تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلاَ أَوْلاَدُهُم مِّنَ اللّهِ شَيْئًا وَأُولَـئِكَ هُمْ وَقُودُ النَّارِ
নিশ্চয়ই যারা কুফর অবলম্বন করেছে, আল্লাহর বিপরীতে তাদের সম্পদও তাদের কোন কাজে আসবে না এবং তাদের সন্তান-সন্ততিও নয়। আর তারাই জাহান্নামের ইন্ধন। [সুরা আলে ইমরান : ১০]

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ لَعْنَةُ اللّهِ وَالْمَلآئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
নিশ্চয় যারা কুফরী করে এবং কাফের অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে, সে সমস্ত লোকের প্রতি আল্লাহর ফেরেশতাগনের এবং সমগ্র মানুষের লা’নত। [সুরা বাকারা : ১৬১]

وَالَّذِينَ كَفَرواْ وَكَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا أُولَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
আর যারা কুফরীতে লিপ্ত হবে এবং আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করবে, তারা জাহান্নামবাসী। তারা সেখানে সর্বদা থাকবে। [সুরা বাকারা : ৩৯

وَمَن يَرْتَدِدْ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُوْلَـئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَأُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
যদি তোমাদের মধ্যে কেউ নিজ দীন পরিত্যাগ করে, তারপর কাফির অবস্থায় মারা যায়, তবে এরূপ লোকের কর্ম দুনিয়া ও আখিরাতে বৃথা যাবে। তারাই জাহান্নামী। তারা সেখানেই সর্বদা থাকবে। [সুরা বাকারা : ২১৭]

উপরন্তু হযরত আবূ হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাঃ বলেন, কিয়ামতের দিন হযরত ইবরাহীম আ. কে তাঁর বাবার সুপারিশকালে জানিয়ে দেবেন,
فَيَقُوْلُ اللهُ إِنِّيْ حَرَّمْتُ الْجَنَّةَ عَلَى الْكَافِرِيْنَ.
আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন, আমি কাফিরদের উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ৪৭৬৯

উপরোক্ত আয়াত এবং হাদিস থেকে জানতে পারলাম, কিয়ামতের দিন অস্বীকারকারী কোনো বেঈমান কাফেরকে জান্নাতে যাওয়া সুদূর পরাহত। যদিও সে শ্রেষ্ট মানবতাবাদীও হোক না কেন। অবশ্য যারা মানবতার সেবা বা কোনো ভালো কাজ করবে, তাদের প্রতিদান দুনিয়াতেই মিটিয়ে দেওয়া হবে। শরীফে এসেছে, হযরত আনাস বিন মালেক রা: থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
إنَّ الكافِرَ إذا عَمِلَ حَسَنَةً أُطْعِمَ بها طُعْمَةً مِنَ الدُّنْيا وأَمّا المُؤْمِنُ فإنَّ اللَّهَ يَدَّخِرُ له حَسَناتِهِ في الآخِرَةِ ويُعْقِبُهُ رِزْقًا في الدُّنْيا على طاعَتِهِ
যে কাফের যদি দুনিয়াতে কোন নেক আমল করে তবে এর প্রতিদান স্বরূপ দুনিয়াতেই তাকে জীবনোপকরণ প্রদান করা হয়ে থাকে। আর মুমিনদের নেকী আল্লাহ তা’আলা আখিরাতের জন্য জমা করে রেখে দেন এবং আনুগত্যের প্রতিফল স্বরূপ আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে পৃথিবীতেও জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। -সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৮০৮

সুতরাং বুঝা গেলো,কাফেরদের জন্য কস্মিনকালেও জান্নাতে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। এটা কুরআন-সুন্নাহ’র দাবি। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এ বিষয়টি চরমভাবে অস্বীকার করে দাবি করে যাচ্ছে যে, যদি কেউ হেযবুত তওহীদ গ্রহণ করে মানবতার পক্ষে কাজ করে সে বেঈমান হলেও জান্নাতে যাবে। এরচে বড় মিথ্যাচার আর কুফরী মন্তব্য কী হতে পারে?

হেযবুত তওহীদ কী আসল কালেমার দিকে ডাকছে?
তারা দাবি করছে, পৃথিবীর সব মুসলমার কালেমা থেকে সরে গেছে, আসল কালেমার শিক্ষা ও মিশন একমাত্র হেযবুত তওহীদের কাছেই আছে। এজন্য তারা দাবি করে-

মাননীয় এমামুযযামান ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবজাতিকে এই শেরেক কুফর থেকে মুক্ত হয়ে পুনরায় সেই কালেমায়ে ফিরে আসার ডাক দিয়েছেন। -শিক্ষাব্যবস্থা, পৃ. ৯০

অথচ তারা বলে থাকে,
আমরা কাউকে ইসলাম হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বা ইহুদী ইত্যাদি কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করছি না। আমাদের কথা হচ্ছে যার যার ধর্ম বিশ্বাস তার তার কাছে’। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ১০৫

আমরা বলি না যে, আপনারা আল্লাহ বিশ্বাসী হয়ে যান, মো’মেন হয়ে যান, পরকালে বিশ্বাসী হয়ে যান, আল্লাহর প্রতি কে ঈমান আনবে না আনবে সেটা তারা আল্লাহ সঙ্গে বুঝবে। সুতরাং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করানো আমাদের কাজ নয়’। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃ. ৫২

এখন আপনারই বলুন, তাদের আহ্বান কী কালেমা ও ঈমানের দিকে? যাদের মিশনে ঈমান ও ইসলামই নেই, তারাই আপনাকে আসল কালেমার দিকে নিয়ে যাবে এটা কল্পনা করাও কী ঠিক?

নামাজ প্রসঙ্গ:
ইসলামে নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এই নামাজকে বিভিন্নভাবে অবজ্ঞা করেছে হেযবুত তওহীদ। নামাজের ব্যাপারে তাদের দাসি হলো-
১. নামাজ কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
২. নামাজ না পড়লে আল্লাহ জাহান্নামে দেবেন না।
৩. নামাজ কোনো ইবাদত নয়।
৪. নামাজ যুদ্ধের ট্রেনিং।
৫. নামাজের উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে।
৬. জিহাদ ছাড়া নামাজের দাম নেই।
৭. নামাজ আত্মশুদ্ধির জন্য নয়।
৮. আলেমদের নামায হয় না।
৯. নামাজে আল্লাহ’র ধ্যান করা যাবে না।
১০. নামাজ জান্নাতের চাবি নয়।
১১. তারাবিহ বাধ্যতামূলক নয়।
১২. বর্তমানে জুম’আ পড়া যাবে না।

প্রিয় পাঠক, উক্ত দাবিগুলো হেযবুত তওহীদ তাদের বইগুলোতে লিখেছে। চলুন প্রত্যেকটা বিষয়ে আলোচনা করা যাক।

নামাজ কী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, নামাজকে গুরুত্ব দেওয়া বিকৃত ধর্মের কাজ। তারা লিখেছে,

এই ধর্মের পণ্ডিতদের আলেমদের কাছে দীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নামাজ-রোজা দাড়ি, তারাবি, টুপি,টাখনু, মিলাদ মেসওয়াক ইত্যাদি। আর জেহাদ একেবারে নিষ্প্রয়োজন। এজন্য তাদের এ ইসলাম একটি মৃত, আল্লাহর রাসুলের ইসলামের বিপরীতমুখী ধর্ম। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ১৩

বিকৃত এসলামে নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত আত্মার পরিচ্ছন্নতার জন্য নানারকম ঘষামাজা আধ্যাত্মিক উন্নতির উপর গুরুত্ব প্রাধান্য দেওয়া হলো। কারণ এরা ঐ এবাদত উপাসনা নিয়ে যত বেশি ব্যস্ত থাকবে ব্রিটিশরা তত নিরাপদ থাকবে। -এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ১১২

ইসলাম কী বলে?
ইসলামের মূল স্তম্ভের মধ্যে তাওহীদের পরেই নামাজের কথা বলেছেন রাসুলুল্লাহ সাঃ। একজন মুসলমানের জন্য প্রতিদিন ৫ বার নামাজ আদায় করা ফরজ। মি’রাজে আরশে নিয়ে এই নামাজকে মহান রব নবিজিকে সাঃ হাদিয়াস্বরুপ ফরজ করেছেন। মাক্কী জিবনে জিহাদের আগেই নামাজকে ফরজ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে অসংখ্যবার নামাজের কথা বলা হয়েছে। এমনকি রাসুলুল্লাহ সা. ইন্তেকালের আগে শেষ শব্দ উচ্চারণ করেন নামাজের বাপেরে যত্নবান হতে। নবিজির সাঃ-সহধর্মিনী হযরত উম্মে সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم كَانَ يَقُولُ فِي مَرَضِهِ الَّذِي تُوُفِّيَ فِيهِ الصَّلَاةَ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ فَمَا زَالَ يَقُولُهَا حَتَّى مَا يَفِيضُ بِهَا لِسَانُهُ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থায় বলছিলেন, নামাজ এবং তোমাদের অধীনস্থ দাস-দাসী (অর্থাৎ তাদের ব্যাপারে যত্নবান থেকো)। বারবার একথা বলতে বলতে শেষে তাঁর যবান মুবারক জড়িয়ে যায়। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬২৫

এরপরও যারা বলে থাকে যে,  নামাজকে গুরুত্ব দেওয়া বিকৃত ইসলামের কাজ তারা কী মুসলমান হতে পারে?

নামাজ না পড়লে আল্লাহ জাহান্নামে দেবেন না?

নামাজ জান্নাতে যাওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম। কিয়ামতে সর্বপ্রথম নামাজের হিশাব নেওয়া হবে। এমন অসংখ্য বিষয় কুরআন-সুন্নাহ’য় বর্ণিত হয়েছে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, একমাত্র জিহাদ না করলেই সে জাহান্নামে যাবে এবং দ্বীন থেকে বহিস্কৃত হয়ে যাবে। এ ছাড়া আল্লাহ কোথাও বলেননি যে নামাজ, রোযা, হজ্ব ইত্যাদী ত্যাগ করলে জাহান্নামে দেবেন। দেখুন তারা কী বলে-
আল্লাহ কোথাও বলেন নাই যে, সালাত (নামাজ) ত্যাগ করলে বা সওম (রোজা) ত্যাগ করলে বা হজ্ব ত্যাগ করলে বা অন্য যে কোন এবাদত ত্যাগ করলে কঠিন শাস্তি দিয়ে এই দীন থেকেই বহিস্কৃত করবেন শুধু জেহাদ (সংগ্রাম) এবং আল্লাহর রাস্তায় (জেহাদে) ব্যয় ছাড়া। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ১৫

ইসলাম কী বলে?
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে, জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করা হবে। প্রশ্ন করা হবে-
مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ
তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নীত করেছে? তখন জাহান্নামীরা জবাব দেবে,
قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّين حَتَّى أَتَانَا الْيَقِينُ
তারা বলবেঃ আমরা নামায পড়তাম না, অভাবগ্রস্তকে আহার্য্য দিতাম না, আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করতাম এবং আমরা প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করতাম, আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত। [সুরা মুদ্দিসসির : ৪২-৪৭]

উক্ত আয়াতে জাহান্নামে যাওয়ার প্রথম কারণ হিসাবে নামাজ না পড়ার অপরাধ বলা হয়েছে। সুতরাং আয়াত দ্বারা বুঝতে পারলাম, নামাজ না পড়ার কারণে জাহান্নামে যেতে হবে।  উপরন্তু হাদিস শরীফে সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
أَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِياَمَةِ الصَّلاَةُ يُنْظَرُ فِيْ صَلاَتِهِ فَإنْ صَلَحَتْ فَقَدْ أفْلَحَ وإنْ فَسَدَتْ خاَبَ وَخَسِرَ
কিয়ামতের দিন বান্দা সর্বপ্রথম যে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে, তা হচ্ছে নামায। তার নামাযের দিকে দৃষ্টিপাত করা হবে। যদি তার নামায সংশোধন বা বিশুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে সে মুক্তি পেয়ে যাবে। আর তার নামায যদি বরবাদ থাকে, তাহলে সে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাবে।’ -আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খ. ১ পৃ. ১৩০

সুতরাং নামাজের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন মূর্খতাসুলভ মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়।

নামাজ কী কোনো ইবাদত নয়?
নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ ও ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও ফরজ বিধান। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এ ফরজ বিধানটিকে ইবাদত হিসাবেই মানতে চায় না।

হেযবুত তাওহীদ কী বলে?
তারা তাদের বইয়ে নামাজ সম্পর্কে বেশ কিছু উদ্ভট আলোচনা করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো-
নামাজ রোজা হজ্ব পূজা প্রার্থনা তীর্থযাত্রা মানুষের মূল এবাদত নয়। মানবজাতী যেন সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে এ লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম, প্রকৃত এবাদত। -জঙ্গিবাদ সংকট, পৃ. ৫৬

তারা তাদের ওয়াজে নসিহতে মানুষকে কেবল নামাজ রোজা হজ্ব ইত্যাদি করার জন্য উপদেশ দেন। এগুলোকে তারা এবাদত ধর্মকর্ম মনে করেন। -শিক্ষাব্যবস্থা, পৃ. ৯

এবাদত ও সালাহ (নামাজ) আলাদা বিষয়। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ৪৫

এখন মোসলেম দাবিদার জাতির সামনে থেকে দীনের এই উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে, তারা কেবল নামাজ, রোজা, হজ্বব করাকেই এবাদত হিসাবে ধোরে নিয়ে ভালো মানুষ সবার জন্য জোর প্রচেষ্টা কোরছে। -এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ৮৯

এবাদত হচ্ছে আল্লাহ খেলাফত করা। কিন্তু ভুল করে নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত ইত্যাদিকে এবাদত বলে মনে করা হচ্ছে। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ৯

উক্ত বক্তব্যে তারা তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে। তারা সুস্পষ্টভাবে দাবি করলো, নামাজ কোনো ইবাদত নয়।

ইসলাম কী বলে?
ইসলামে নামাজ একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। এ কথা খোদ রাসুৃলুল্লাহ সাঃ এর বক্তব্য থেকেই পাওয়া যায়। হজরত আয়েশা রা. বলেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ সা. আমার ঘরে এসে আমার সঙ্গে শয়ন করলেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে বললেন,
يا عائشةُ ذَرِيني أتعبَّدِ اللَّيلةَ لربِّي قُلْتُ واللهِ إنِّي لَأُحِبُّ قُرْبَك وأُحِبُّ ما سرَّك قالت فقام فتطهَّر ثمَّ قام يُصَلِّي
হে আয়েশা, আমি আমার রবের ইবাদত করতে চাই। আমাকে যেতে দাও।’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি আপনার একান্ত কাছে থাকতে চাই। আবার এও চাই যে, আপনি মহান আল্লাহর ইবাদত করবেন। তিনি বিছানা থেকে উঠে পবিত্র হয়ে সালাতে দাঁড়ালেন। -সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৬২০

উক্ত হাদিসে রাসুৃলুল্লাহ সাঃ নামাজকে ইবাদত বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং যিনি ইসলামের নবী তিনি নামাজকে ইবাদত বলছেন, অথচ হেযবুত তওহীদ সে নামাজকে ইবাদত বলতে নারাজ। তাহলে কী হেযবুত তওহীদ ইসলামকে নবিজির সাঃ থেকেও বেশি বোঝে? স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাঃ যে নামাজকে ইবাদত হিসাবে আখ্যায়িত করলেন, সেখানে নামাজকে ইবাদাত থেকে পৃথক করার অধিকার হিযবুত তাওহীদেকে কে দিয়েছে? এটা কী ইসলামের নামে বিকৃতি নয়?

নামাজ কী যুদ্ধের ট্রেনিং?
দ্বীন-ইসলাম পরিপূর্ণ। দ্বীনের ভেতর নতুন কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করা দ্বীনের বিকৃতি করার শামিল। আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কোন নতুন বিষয় সংযুক্ত করবে যা তার অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে (অর্থাৎ তা গ্রহণযোগ্য হবে না)। -সহীহ বুখারী, হাদিস : ২৬৯৭

দ্বীনের প্রত্যেকটি বিধান রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রা. কে হাতে, কলমে, প্যাক্টিকালি সব শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, রাসূলুল্লহ সা. হতে যুগ পরম্পরায় উম্মতে মুসলিমার আদায়কৃত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজকে ভুল আখ্যা দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ বলে ঘোষণা দিয়ে হিযবুত তাওহীদ নতুন এক বিদআতী সালাতের সূচনা করেছে। যা ইসলামের নামে এক চরম বিকৃতি। চলুন আগে তাদের ভ্রান্ত বক্তব্য দেখে নেওয়া যাক।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তাওহীদের দাবি হলো, সালাত হলো সামরিক প্রশিক্ষণ, তাই সালাতকে তারা আর্মি ট্রেনিং এর মতো আদায় করে। তারা লিখেছে-

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানবো না। এর অর্থ কি? এর অর্থ হচ্ছে, যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যারা ঐক্যবদ্ধ হবেন, তারা হবেন মোমেন। এই মোমেনের নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত আল্লাহর কাছে কবুল হবে। -সূত্রাপুরে এমামের ভাষণ, পৃ. ৯

ঐ জেহাদ ও কেতাল করে জয়ী হওয়ার মত চরিত্র গঠণের জন্য, প্রশিক্ষণেরর জন্য ফরদ করে দিলেন সালাহ্। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ পৃ. ৫৫

সালাতের মুখ্য ও মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সুশৃঙ্খল,নেতার আদেশ পালনে আগুনে ঝাঁপ দিতে তৈরি দুর্ধর্ষ,অপারেজেয় যোদ্ধার চরিত্র সৃষ্টি। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ পৃ. ২৯

ঐক্য-শৃঙ্খ্যলা-এতায়াত (আদেশ পালন) ও হেজরত, এই সামরিক গুনগুলো অর্জনই সালাতের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। -সলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৪১

ঐক্যবদ্ধ,সুশৃঙ্খল ও সুশিক্ষিত জাতি ও বাহিনী ছাড়া কোন সংগ্রাম,সশস্ত্র সংগ্রাম সম্ভব নয় তাই ঐক্য ও শৃঙ্খলা শিক্ষার প্রক্রিয়া হলো সালাত (নাময)।কিন্তু (সালাত)নামায উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া মাত্র। -আকিদা, পৃ. ৮

সেই সত্য দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্ব উপায়ে প্রচেষ্টা চালানো প্রত্যেক মো’মিনের অবশ্য কর্তব্য, ফরদ। এই দীন প্রতিষ্ঠা করতে হলে মো’মেনের অবশ্যই কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুন লাগবে। সেই চারিত্রিক, মানসিক আত্মিক গুণ বৈশিষ্ট্য (Attributes) এটা যে সে অর্জন করবে কোথেকে অর্জন করবে? সেটার জন্য আল্লাহ তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছেন। সেটা হলো সালাহ সওম, হজ্ব, যাকাত এগুলো। এগুলোর মাধ্যমে তার চরিত্রে কিছু গুন অর্জিত হবে। তারপর সে আল্লাহর সত্যদীন পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করে মানবসমাজ থেকে অন্যায় অশান্তি দূর করতে পারবে যেটা উম্মতে মুহাম্মদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ৪/৫/৮

অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায় নামাজ কোনো ইবাদত নয়, বরং জিহাদের ট্রেনিং।

ইসলাম কী বলে?
উপরন্তু নামাজকে জিহাদের ট্রেনিং বলা পবিত্র কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যার শামিল। কারণ আল্লাহপাক ও তাঁর রাসুল সাঃ কোথাও বলেননি যে নামাজ জিহাদের ট্রেনিং। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَأَقِيمُواْ الصَّلاَةَ وَآتُواْ الزَّكَاةَ
তোমরা সালাত কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান কর। [সূরা বাকারা : ১১০

اِنَّ الصَّلٰوۃَ کَانَتۡ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ کِتٰبًا مَّوۡقُوۡتًا
নিশ্চয় সালাত মুমিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ। [সূরা নিসা : ১০৩]

উক্ত আয়াত দু’টিসহ অসংখ্য আয়াতে মহান রব বলেছেন, নামাজ কায়েম করতে বা নামাজ ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো আয়াত বা হাদিসে নামাজকে জিহাদের ট্রেণিং বলা হয়নি। সুতরাং কুরআনের শর্তহীন আয়াতকে শর্তযুক্ত করা অপব্যাখ্যার শামিল। অতএব কোনো আয়াতের মনগড়া উক্তি করা এক জঘন্যতম অন্যায়। যার কারণে হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন,
مَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِرَأْيِهِ فَأَصَابَ فَقَدْ أَخْطَأَ
যে ব্যক্তি নিজের মত অনুযায়ী কুরআন প্রসঙ্গে কথা বলে, সে সঠিক বললেও অপরাধ করলো (এবং সঠিক ব্যাখ্যা করলো-সেও ভুল করলো)। -জামে তিরমিযি, হাদিস : ২৯৫২

অপর একটি হাদিসে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন,
مَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
যে ব্যক্তি সঠিক ইলম ব্যতীত কুরআন প্রসঙ্গে কোন কথা বলে, সে যেন জাহান্নামকে নিজের জন্য বাসস্থান বানিয়ে নিল। -জামে তিরমিযি, হাদিস : ২৯৫০

সুতরাং চলুন হেযবুত তওহীদের মনগড়া অপব্যাখ্যা থেকে সবাই সতর্ক হয়ে নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা করি।

নামাজের উদ্দেশ্য কী হারিয়ে গেছে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা লিখেছে, বর্তমানের নামাজের উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে। অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, নামাজের মূল উদ্দেশ্য হলো, জিহাদের ট্রেনিং। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে কেউ যেহেতু ট্রেনিংয়ের জন্য নামাজ পড়ে না, সেহেতু নামাজের উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে। দেখুন তারা কী বলে-

ঐ সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের সালাহ আজ নুজ্ব,বাকা লাইনের; বাঁকা পিঠের মুসল্লি ও এমামদের মরা সালাহ। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৩২

ইবলিসের প্ররোচনায় সঠিক,প্রকৃত ইসলামের আকীদা বিকৃত ও বিপরীতমুখী হয়ে যাওয়ার ফলে ইসলামের প্রকৃত সালাহ ও তার উদ্দেশ্যও বিপরিত হয়ে গেছে। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৫৪

এখন বর্তমান সমস্ত মুসলিম দুনিয়াতে এই প্রাণহীন নামায পড়া হয়, সালাহ কায়েম করা হয় না। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৫৬

আল্লাহর এবং রসুলের কথার কষ্ঠিপাথরে বিচার করলে আজ সমস্ত পৃথিবীর সালাহ্ হতভাগ্য,অভিশপ্তদের সালাতের মত। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৫৬

অর্থাৎ তারা বলতে চায়, নামাজের উদ্দেশ্য হলো, জিহাদের ট্রেনিং। এটা যেহেতু মুসলমানরা করছে না, সেহেুত তাদের নামাজের উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে।

ইসলাম কী বলে?
নামাজের উদ্দেশ্য জিহাদের ট্রেনিং নয়, বরং আল্লাহপাকের স্বরণই মূল। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহপাক হযরত মুসা আ. কে বলেছিলেন,
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম কর। [সুরা ত্ব-হা : ১৪]

বুঝা গেলো, ইসলামে নামাজের মূল উদ্দেশ্য জিহাদের ট্রেনিং নয়, বরং আল্লাহপাকের স্বরণই মূল। কিন্তু নামাজের অপব্যাখ্যা করেই তারা মুসলমানদের নামাজ নিয়ে সমালোচনা করে যাচ্ছে।

জিহাদ ছাড়া নামাজের দাম নেই?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, নামাজ যেহেতু জিহাদের ট্রেনিং। সুতরাং জিহাদ ছাড়া নামাজের কোনো মূল্য নেই। তারা লিখেছে,

কাজেই জেহাদ,প্রচেষ্টা,সংগ্রাম যদি বাদ দেয়া হয় তবে সালাহ অর্থহীন,অপ্রয়োজনীয়; যেমন যেকোন সামরিক বাহিনী যদি যুদ্ধ করা ছেড়ে দেয় তবে প্যারেড,কুচকাওয়াজ করা যেমন অর্থহীন, যেমন ছাদ তৈরি করা না হলে থাম,খুঁটি অর্থহীন। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ পৃ. ৩০/৬৬

আল্লাহর লা’নতের নির্মম শাস্তি সত্ত্বেও এই জাতি তওবা করে তওহীদে, সিরাতুল মুস্তাকিমে, দ্বীন কায়েমায় ফিরে না এসে, নির্বোধের মত নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত হাজার রকমের নফল ইবাদত করে যাচ্ছে আর ভাবছে তাদের জন্য জান্নাতের দরজায় লাল কার্পেট বিছিয়ে রাখা হয়েছে। -ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে? পৃ. ৬

নামাজ রোযা, হজ্ব, পূজা, প্রার্থনা, তীর্থযাত্রা মানুষের মূল এবাদত নয়। মানবজাতি যেন সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারে এ লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম, প্রকৃত এবাদত। -জঙ্গিবাদ সংকট, পৃ. ৫৬

প্রকৃত ইসলামের জীবনব্যবস্থার উদ্দেশ্য মানব জীবনের নিরাপত্তা সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি, আর বর্তমান ইসলামের উদ্দেশ্য ওসব কিছুই না বরং সময়মত নামাজ পড়া, যাকাত দেওয়া, হজ্ব করা, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, লম্বা পোশাক ও খাটো পায়জামা পরা ইত্যাদি।  -হেযবুত তওহীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, পৃ. ৭

মানবতার পাশে না দাড়িয়ে নামাজ পড়ে কোনো ফায়দা নেই।
আল্লাহ সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষকে অশান্তির আগুনে জ্বলতে দেখেও যারা কাপুরুষের মতো করে লুকায় আর এবাদত মনে পড়ে রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ে, রোজা রাখে, হজ্ব করে, নানা উপাসনায় মশগুল থাকে তাদেরকে আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। -ধর্মবিশ্বাস, পৃ. ৩

কেউ যদি নামাজ রোজা হজ্ব পূজা-অর্চনা উপাসনা ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত ব্যপৃত থাকে, কিন্তু তার ভিতরে মানবতার গুণাবলী না থাকে তাহলে সে প্রকৃত ধার্মিক নয়, আল্লাহর প্রকৃত উপাসক নয়। -ধর্মবিশ্বাস, পৃ. ১৪

আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষকে অশান্তির আগুনে জ্বলতে দেখেও যারা কাপুরুষের মতো ঘরে লুকায় আর এবাদত মনে করে রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ে, রোজা রাখে, হজ্ব করে, নানা উপাসনায় মশগুল থাকে তাদেরকে আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। -ধর্মবিশ্বাস, পৃ. ৩

নিজেদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে সংগ্রাম করার মধ্যে দিয়েই মোমেন হতে হবে, অন্য কোন পন্থা আল্লাহ দেননি। এই মুমিনের জন্য নামাজ রোজা, হজ্ব, যাকাতসহ ইসলামের অন্যান্য সব আমল। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ১১৩

অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, সালাত মূল উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হলো জিহাদ। আর নামাজ হলো ঐ জিহাদেরর প্রশিক্ষণ তথা উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া। সেহেতু জিহাদ ছাড়া নামাজের কোনো মূল্য নেই।

ইসলাম কী বলে?
তাদের এ জঘণ্য অপব্যাখ্যার পেছনে মূল কারণ হলো, তাদের দাবি হলো খিলাফত প্রতিষ্ঠাই হলো ইসলাম ও মানবজাতির মূল কাজ। আর সকল বিধিবিধান হলো এ কাজের সহায়ক। সে হিসাবে নামাজও খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তথা জিহাদের একটি ট্রেণিং মাত্র। অথচ খিলাফত প্রতিষ্ঠার মূল কারণ কি তা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভূক্ত। [সূরা হজ্ব : ৪১]

প্রিয় পাঠক, এখানে দেখুন, আল্লাহ তা’আলা জিহাদ করে খিলাফত প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর খলীফাদের নামাজ,যাকাত ইত্যাদী প্রতিষ্ঠার কথা বললেন, তাহলে নামাজ কত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সেই নামাজকে বলা হচ্ছে জিহাদের ট্রেণিং! এটা ছেলেকে বাপ মনে করার মত নয় কি? কতবড় হাস্যকর কথা!

সুতরাং ‘জিহাদ ছেড়ে দিলে নামাজের কোনো মূল্য নেই’ এগুলো নিতান্তই ধর্মবিরোধী বক্তব্য। উপরন্তু নামাজ হলো ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ  وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَان
ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল,নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া, হজ্জ আদায় করা এবং রমজান মাসে রোজা পালন করা। -সহীহ বুখারী, হাদিস : ৮

এ হাদিসে ইসলামের স্তম্ভ করা হয়েছে ৫ টি। এর মধ্যে কিন্তু জিহাদ নেই। অবশ্যই ইসলামে জিহাদও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কিন্তু নামাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ জিহাদ ইসলামের স্তম্ভ নয়। সুতরাং যে নামাজ ইসলামের স্তম্ভ, সেটাকে নন স্তম্ভ জিহাদের ট্রেণিং বলা কতবড় আহাম্মকী!

নামাজ আত্মশুদ্ধির জন্য নয়?
পবিত্র কুরআনেই উল্লেখ্য রয়েছে যে, ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানের মূল টার্গেট হলো, আল্লাহকে স্বরণ করা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকা। আর আত্মশুদ্ধির মূল টার্গেটও কিন্তু এটাই।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
কিন্তু হেযবুত তওহীদের দাবি আবার ভিন্ন কথা। তারা লিখেছে,

‘আকিদার বিকৃতির কারণে সালাহ-কে শুধু একটি এবাদত,একটি আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া হিসাবে নেয়া যে কতখানি আহম্মকী তার কয়েকটি কারণ পেশ করছি। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ২২/২১/৫৬/৬২

সালাহ চরিত্র গঠণের মুখ্যত দুর্ধর্ষ,অপরাজেয় যোদ্ধার চরিত্র গঠণের প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া; এই আকীদা বদলে একে অন্যান্য ধর্মের মতো এবাদতের,উপাসনার শুধু আত্মিক উন্নতির প্রক্রিয়া বলে মনে করার ফলে আজ সেই যোদ্ধার চরিত্র গঠণ তো হয়ই না এমন কি সালাতের বাহ্যিক চেহারা পর্যন্ত বদলে গেছে। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৩২/৪২/৪৩

অর্থাৎ তারা বলতে চায়, নামাজ আত্মশুদ্ধির জন্য মনে করা বোকামী।

ইসলাম কী বলে?
অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, নামাজ আত্মা পবিত্র রাখে। মহান রব বলেন,
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاء وَالْمُنكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ
এবং আপনি নামায কায়েম করুন। নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা করো। [সূরা আনকাবুত : ৪৫]

উক্ত আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নামাজ মানুষের গুনাহ থেকে পবিত্র রাখে। আর গুনাহ থেকে পবিত্র থাকাই তো আত্মশুদ্ধি। তাহলে নামাজকে যদি আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া বলা আহাম্মকী হয়, তাহলে আল্লাহ তা’আলাও কি সে সংজ্ঞায় পড়ে যাবেন না? নাউযুবিল্লাহ।

আলেমদের নামায হয় না:

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, নামাজ হলো জিহাদের ট্রেণিং, যেহেুত আলেমরা তা মনে করেন না, সেহেতু তাদের নামাজই হয় না। দেখুন তারা কী বলে-

সবচে বড় কথা হচ্ছে,বর্তমান মুসলিম বলে পরিচিত এ জনগোষ্ঠীর পণ্ডিতগণ সালাহকে সামরিক প্রশিক্ষণ হিসাবে তো মানেই না বরং তারা সালাহকে যে ধ্যান বলে প্রচার করে তারা সেই ধ্যানও করে না অর্থাৎ ওরা ট্রেনিংও করে না আবার ধ্যানও করে না। তাদের কোনটাই হয় না। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৩৫

ইসলাম কী বলে?
নিজেরা অন্ধত্বের মধ্যে ডুবে থেকে নামাজেরের বিকৃত উদ্দেশ্যকে আসল উদ্দেশ্য মনে করে নিজেদের নামাজই নষ্ট করে দায় চাপাচ্ছে আলেমদের উপর। আসলে অজ্ঞলোক তার অজ্ঞতা সম্পর্কে নিজেই অজ্ঞ থেকে অন্যকে ভুল ধরে।

নামাজে আল্লাহ’র ধ্যান করা যাবে না?
আল্লাহকে স্বরণ করতেই নামাজ আদায় করতে হয়। যা পবিত্র কুরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু নামাজে খুশুখুজু বা ধ্যান করার বিপক্ষে পরিস্কার অবস্থান নিয়েছে হেযবুত তওহীদ নামক এ কুফরী দল।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, নামাজে কোনো ধ্যান করা যাবে না, বরং প্রশিক্ষণের মতো সবকিছুই হতে হবে দ্রুতগতিতে। দেখুন তারা লিখেছে-

এই মরা প্রাণহীন সালাতের পক্ষে বলা হয়- খুশুখুজুর সাথে নামাজ পড়া উচিত। এই খুশু-খুজু কি? বর্তমানে বলা হয় সমস্ত কিছু থেকে মন সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা হচ্ছে খুশু-খুজু; অর্থাৎ এক কথায় ধ্যান করা। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৩২

এমাম যদি রুকু বা সাজদায় যেয়ে একঘন্টা থাকেন তবে প্রত্যেক মোকতাদীকে তাই থাকতে হবে, নইলে তার সালাহ হবে না। এটা কী শেখায়? এটি কি ধ্যান করা শেখায়? অবশ্যই নয়। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ২৮

সালাতে আল্লাহকে ধ্যান করাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে আল্লাহ সালাতের যে প্রক্রিয়া, নিয়ম,কানুন এমন করে দিলেন কেন যাতে ধ্যান করা অসম্ভব। খুশু-খুজু অর্থাৎ ধ্যান করাই আল্লাহর উদ্দেশ্য হলে সালাতের নিয়ম হতো পাহাড়-পর্বতের গুহায়,কিম্বা খানকা বা হুজরায় অথবা অন্ততপক্ষে কোন নির্জন স্থানে ধীর-স্থীরভাবে একাকি বসে চোখ বন্ধ করে মন নিবিষ্ট করে আল্লাহর ধ্যান করা। সালাহ কি তাই? অবশ্যই নয়। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৩২

যদি কাউকে বলা হয় তুমি জনাকীর্ণ রাজপথে দৌঁড়াবে আর সেই সঙ্গে ধ্যান করবে তাহলে ব্যাপারটা কীর রকম হবে? এটি যেমন হাস্যকর তেমনি হাস্যকর কাউকে বলা যে তুমি সালাহ কায়েম করবে এবং সেই সঙ্গে ধ্যানও করবে। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ.

পূর্ণভাবে সালাহ কায়েম করতে গেলে ১০০ টিরও বেশি ছোট বড় নিয়ম পদ্ধতি পালন করতে হয়।সব গুলো না করলেও অন্তত চৌদ্দটি ফরদ,চৌদ্দটি ওয়ায়েব,সাতাশটি সুন্নত আর বারটি মুস্তাহাব খেয়াল রেখে, সেগুলো সঠিক ও পূর্ণভাবে পালন করে সালাহ কায়েম করতে গেলে বর্তমানে সালাতে যে ধ্যানের কথা বলা হয় তা কতখানি সম্ভব? -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ২৬-২৭

দ্রুত গতিতে রুকুতে যাবে,সিজদায় যাবে,সিজদা থেকে উঠে বসবে,সেজদা শেষ করে উঠে দাঁড়াবে।’
সূত্র: ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ২৫-২৬

দৌড়ানোর সময় যেমন চোখ কান খোলা রেখে,কোথায়য় পা ফেলছে তা দেখে দেখে, রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া দেখে দৌড়াতে হবে,তখন ধ্যান অসম্ভব,তেমনি সালাতের সময়ও সালাতের ১১৪ টি নিয়ম কানুন মনে রেখে, রাকাতের হিসাব রেখে সেগুলো পালন করার সাথে ধ্যান করাও অসম্ভব। সুতরাং সালাহ ও ধ্যান বিপরীতমুখী দুটি কাজ যা একত্রে অসম্ভব। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৩৫

অর্থাৎ তাদের দাবি হলো-
১. রুকু, সিজদায় দ্রুত গতিতে যেতে হবে এবং উঠা-নামাও করতে হবে দ্রুত গতিতে।
২. আল্লাহর ধ্যানসহ নামাজ আদায় করা সম্ভব নয়।

ইসলাম কী বলে?
নবিজি সাঃ যে নামাজ শিখিয়েছেন, সেদিকে তাকালে বুঝা যায় ধীরস্থিরভাবে, শান্তহয়ে রুকু-সিজদায় যেতে হবে। মহান রব বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ
মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র। [সুরা মুমিনুন : ১-২]

উক্ত আয়াতের خاشِعُونَ এর তাফসীরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
خائِفُونَ ساكِنُونَ
যারা ভীতসন্ত্রস্ত ও স্থীর। -তাফসীরে রুহুল মা’আনী, খ. ৭ পৃ. ২০৬

খুশুখুজু’র সংজ্ঞা করতে গিয়ে ইমাম মাহমুদ বাগদাদী আলুসী রহি. বলেন,
والخُشُوعُ التَّذَلُّلُ مَعَ خَوْفٍ وسُكُونٍ لِلْجَوارِحِ
খুশু বলা হয়, আল্লাহর ভয়ে বিনয়ের সাথে শারীরিক ধীরস্থীরতার সাথে (নামাজ আদায়) করা। -তাফসীরে রুহুল মা’আনী, খ. ৭ পৃ. ২০৬

উক্ত আয়াত থেকে বুঝা গেলো, নামাজ হতে হবে ধীরস্থীরতার সাথে। পাশাপাশি নিন্মোক্ত হাদিসটি দেখুন। নবিজি সাঃ বলেছেন,
إذا قُمْتَ إلى الصَّلاةِ فَكَبِّرْ، ثُمَّ اقْرَأْ ما تَيَسَّرَ معكَ مِنَ القُرْآنِ، ثُمَّ ارْكَعْ حتّى تَطْمَئِنَّ راكِعًا، ثُمَّ ارْفَعْ حتّى تَعْدِلَ قائِمًا، ثُمَّ اسْجُدْ حتّى تَطْمَئِنَّ ساجِدًا، ثُمَّ ارْفَعْ حتّى تَطْمَئِنَّ جالِسًا، وافْعَلْ ذلكَ في صَلاتِكَ كُلِّها..
তুমি সলাতে দাঁড়ানোর সময় সর্বপ্রথম তাকবীরে তাহরীমা বলবে। তারপর তোমার সুবিধানুযায়ী কুরআনের আয়াত পাঠ করবে, অতঃপর শান্ত ও স্থিরতার সাথে রুকূ‘ করবে, অতঃপর রুকূ‘ হতে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। অতঃপর ধীরস্থিরভাবে সাজদাহ্ করবে। এরপর প্রশান্তির সাথে উঠে বসবে। এভাবেই তোমার পুরো সলাত আদায় করবে। -সহীহ বুখারী, হাদিস : ৭৫৭

উক্ত হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, নামাজ ধীরস্থীরভাবে আদায় করতে হবে। কিন্তু হেযবুত তওহীদের নামাজ রাসুলুল্লাহ সাঃ এর শিখানো পদ্ধতির বিপরীত। মূলত পন্নী সাহেব উদ্ভট এ কথা লিখেছেন মূলত তার নিজস্ব মতবাদ- ‘সালাত হচ্ছে সামরিক প্রশিক্ষণ’ -এর গ্রহণযোগ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য।প্রশ্ন জাগে-যেখানে পৃথিবীর কোথাও এমন আজব রীতিতে সালাত পড়া হয় না,ইসলামের ইতিহাসে যার নজির নেই,সেখানে হুট করে তিনি কোথা হতে সঠিক পদ্ধতির নব আবিষ্কৃত এই সালাত পেলেন? তার উপর ওহী নাজিল হয়নি তো?(নাউযুবিল্লাহ)।

যেখানে হাদীসের বর্ণনা হচ্ছে, ‘সকল উম্মত একত্রে ভ্রান্তিতে নিপতিত হবে না’। সেখানে গোটা উম্মতের সালাতকে বিকৃত বলা মানে হাদীসের বক্তব্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের নামান্তর নয় কী?

আল্লাহকে ধ্যাণ করার জন্যই নামাজ:
নামাজ হলো মূলত আল্লাহকে স্বরণ করার জন্যই। মহান আল্লাহ হযরত মুসা আ. কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, হে মুসা,
إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
আমিই আল্লাহ আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম করো। [সুরা ত্ব-হা : ১৪]

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা নামাজ আদায় করতে বলেছেন, তাঁকে স্বরণ বা ধ্যান করতে। উপরন্তু হাদিসে জিবরাঈলে এসেছে, হযরত জিবরাঈল আ. নবীজিকে ইহসান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার পর নবিজি সাঃ বললেন,
أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ
আপনি এমনভাবে আল্লাহর ‘ইবাদাত করবেন যেন আপনি তাঁকে দেখছেন, আর যদি আপনি তাঁকে দেখতে না পান তবে (মনে করবেন) তিনি আপনাকে দেখছেন। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ৫০

উক্ত হাদিসে সুস্পষ্টভাবে সকল ইবাদতে আল্লাহকে ধ্যান করার কথা বলেছেন খোদ রাসুলুল্লাহ সাঃ নিজেই। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ إِلَى الصَّلاَةِ فَلاَ يَبْصُقْ أَمَامَهُ فَإِنَّمَا يُنَاجِي اللهَ مَا دَامَ فِي مُصَلاَّهُ وَلاَ عَنْ يَمِينِهِ فَإِنَّ عَنْ يَمِينِهِ مَلَكًا وَلْيَبْصُقْ عَنْ يَسَارِهِ أَوْ تَحْتَ قَدَمِهِ فَيَدْفِنُهَا
তোমাদের কেউ সালাতে দাঁড়ালে সে তার সামনের দিকে থুথু ফেলবে না। কেননা সে যতক্ষণ তার মুসল্লায় থাকে, ততক্ষণ মহান আল্লাহর সাথে চুপে চুপে কথা বলে। আর ডান দিকেও ফেলবে না। তার ডান দিকে থাকেন ফেরেশতা। সে যেন তার বাম দিকে অথবা পায়ের নীচে থুথু ফেলে এবং পরে তা দাবিয়ে দেয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪১৬

উক্ত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, নামাজ হলো আল্লাহর সাথে গোপর কথোপকথন। এটাও তো ধ্যান। সুতরাং খুশুখুজুর সাথে নামাজ আদায় করার অর্থ হলো, আল্লাহর স্বরণ করা, ভয় করা, বিনয় ও নম্রতার সাথে, প্রতিটি শব্দের অর্থের দিকে খেয়াল রাখা, এদিক সেদিক না তাকানো, ফরজ-ওয়াজীব-সুন্নাহ’র দিকে খেয়াল করে নামাজ আদায় করা। সুতরাং নামাজে আল্লাহর ধ্যান করা যাবে না বলে হেযবুত তওহীদ যে দাবি করেছেন, তা নিতান্তই কুরআন-হাদিস বিরোধী। তারা আরও বলেছেন,

‘সালাতের প্রায় ১১৪ টি নিয়ম-পদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য রেখে,সেগুলো যথাযথভাবে পালন করে ঐ খুশু-খুজুর সাথে অর্থাৎ ধ্যানের সাথে সালাহ সম্পাদন করা যে অসম্ভব তা সাধারণ জ্ঞানেই (Common sense) বোঝা যায়। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৩৩

সাধারণ জ্ঞানেই (Commo sense) বোঝা যায় যে, সালাতের এতগুলো নিয়ম কানুন পালন করে যে ধ্যান বর্তমানের ইসলাম দাবি করে তা সম্পূর্ণ অসম্ভব।আমার একথায় যিনি একমত হবেন না তিনি মেহেরবানী করে ঐ নিবিষ্টতা অর্থাৎ ধ্যান নিয়ে চার রাকাত সালাহ পড়তে চেষ্টা করে দেখতে পারেন- দেখবেন সালাতে ভুল হয়ে যাবে। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ২৭

অথচ প্রকৃত মুসলিমরা ১৪০০ বছর যাবৎ এ অসম্ভব কাজটি সহজেই করে আসছেন। আলহামদুলিল্লাহ। মুসলিমদের জন্য এটা মোটেই কষ্টকর বিষয় নয়। এজন্য আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
وَاسْتَعِينُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلاَّ عَلَى الْخَاشِعِينَ
ধৈর্য্যর সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব। [সূরা বাকারা :  ৪৫

সুতরাং যাঁদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, শয়তানি রয়েছে, ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে, তাদের পক্ষে খুশুখুজুর সাথে নামাজ আসলেই অসম্ভব। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর স্বরণ ও ভয় রেখে ধীরস্থীরভাবে নামাজ আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

নামাজ কী জান্নাতের চাবি নয়?
নামাজ হলো, জান্নাতে যাওয়ার একটি মাধ্যম।  যে কারণে হাদিস শরীফে নামাজকেও জান্নাতের চাবি বলা হয়েছে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাসি হলো, নামাজ জান্নাতের চাবি নয়। তারা লিখেছে,

নামাজ জান্নাতের চাবি নয়। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৫৭

ইসলাম কী বলে?
এক. হযরত জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
مِفْتَاحُ الْجَنَّةِ الصَّلاَةُ وَمِفْتَاحُ الصَّلاَةِ الْوُضُوءُ
জান্নাতের চাবি হচ্ছে নামায, আর নামাযের চাবি হচ্ছে ওযু। -জামে তিরমিযি, হাদিস: ৪

হাদিসটির মান:
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহি. বলেন,
قال ابن حجر بسند حسن
ইবনে হাজার আসকালানী রহি. বলেন, হাদিসটির সনদ হাসান। -মিরকাত খ. ১ পৃ. ৩৫৩

আল্লামা জালালুদ্দীন সুূয়ূতী রহি. হাদিসটির সনদ ‘হাসান’ বলেছেন
-জামে সগীর হাদিস নং- ৮১৭৩

আল্লামা জারুল্লাহ সাদী রহি. সনদটিকে হাসান বলেছেন। -আন নাওয়াফেহুল আত্বরাহ, হাদিস নং- ৩৩৫

সুতরাং প্রমাণ হলো, হাদিসটি জাল তো দূরের কথা যয়ীফও নয়, বরং হাদিসটি হাসান সনদে বর্ণিত। উপরন্তু যদি হাদিসটি যয়ীফও হয়, তবুও কোনো অসুবিধা নেই। কারণ যয়ীফ মানে দূর্বল, জাল নয়। সুতরাং এ হাদিসটি অস্বীকার করে হেযবুত তওহীদ নামাজের প্রতি এক ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে।

দুই. হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি,
فَمَنْ كَانَ مِنْ أَهْلِ الصَّلاَةِ دُعِيَ مِنْ باب الصَّلاَةِ
নামাজীদেরকে জান্নাতের নামাজের দরজা দিয়ে প্রবেশের আহবান জানানো হবে। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ৩৬৬৬

সহিহ বুখারীর এ হাদিস থেকে জানতে পারলাম, তালাবদ্ধ জান্নাতের নামাজের দরজার দিকে নামাজীদেরকে ডাকা হবে। এর অর্থ কী? নামাজ যদি জান্নাতের চাবি না হয়, তাহলে তালাবদ্ধ জান্নাতের দরজার দিকে ডাকলে কিভাবে প্রবেশ করবে? সুতরাং যারা হাদিসটিকে অজ্ঞতার কারণে জাল বলে দাবি করছেন, তাদের থেকে সতর্ক থাকা উচিৎ।

অভিযোগ:
হেযবুতি সেলিম সাহেবের দাবি হলো, হাদিসে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তথা তাওহীদকে জান্নাতের চাবি বলা হয়েছে’। সুতরাং নামাজ জান্নাতের চাবি হতে পারে না। কারণ’নবীজি সা. এক মুখে দুই কথা বলতে পারেন না।’

জবাব:
নবিজি সাঃ এক মুখে দুই কথা বলেননি, বরং মুর্খতার কারণেই সেলিমরা বোঝেনি। কেননা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ হলো, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই’ আর নামাজ তো আল্লাহর সেই ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বরং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র বাস্তবসম্মত আমল হয় নামাজের মাধ্যমে। উপরন্তু নামাজের মধ্যে এ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অসংখ্য বার বলা হয়। সুতরাং কালেমা এবং নামাজ দু’টো আলাদা মনে করা কোনো শিক্ষিত মানুষের কাজ নয়, বরং দুটোর বিষয়বস্তু এক ও অভিন্ন। একথার স্বপক্ষে ইবনুল আরাবী রহি. এর বক্তব্য নকল করা যায়। তিনি বলেন,
مفتاح الجنة الصلاة لأن أبواب الجنة مغلقة يفتحها الطاعات وركن الطاعات الصلاة
নামাজ জান্নাতের চাবি। কারণ জান্নাতের দরজাগুলো বন্ধ। সেই দরজাগুলো খোলা যাবে একমাত্র আল্লাহ তা’আলার অনুগত্যের মাধ্যমে। আর (ঈমান আনার পর) আল্লাহ তা’আলার আনুগত্যের সর্বোচ্চ মাধ্যম হচ্ছে নামাজ। -তুহফাতুল আহওয়াযী খ. ১ পৃ. ৩৮

সুতরাং প্রমাণ হলো, নামাজও কালেমার একটি অংশ, যার প্রমাণ নিন্মের দুটি বক্তব্য থেকে পাওয়া যায়।

উপরন্তু ইমাম বুখারী রহি. তাঁর সহিহুল বুখারীতে ترجمة الباب (শিরোনাম হিসেবে) تعليقا সনদ ছাড়াই এনেছেন,
عَن وهب بن مُنَبّه قِيلَ لَهُ: أَلَيْسَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مِفْتَاحُ الْجَنَّةِ قَالَ بَلَى وَلَكِنْ لَيْسَ مِفْتَاحٌ إِلَّا لَهُ أَسْنَانٌ فَإِنْ جِئْتَ بِمِفْتَاحٍ لَهُ أَسْنَانٌ فَتَحَ لَكَ وَإِلَّا لَمْ يَفْتَحْ لَكَ
ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ রহি. কে বলা হলো, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ কি জান্নাতের চাবি নয়? তিনি বললেন, অবশ্যই। তবে প্রত্যেক চাবিরই দাঁত থাকে। যদি তুমি দাঁতওয়ালা চাবি নিয়ে যাও, তবে তোমার জন্য জান্নাত খোলা হবে। অন্যথায় তা তোমার জন্য খোলা হবে না’ (কালেমার দাঁত হ’ল নেক আমল)। -মিশকাত, বর্ণনা : ৪৩

সুতরাং সহিহ সনদে বর্ণিত একটি হাদিসকে জাল প্রমাণ করে হেযবুত তওহীদের উদ্দেশ্য কী? সেটা যেকোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিই বুঝবেন।

তারাবিহ বাধ্যতামূলক নয়:
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো তারাবীহের নামাজ বাধ্যতামূলক মনে করা যাবে না  তারা লিখেছে,
সুতরাং সুন্নত হিসাবে মো’মেনরা তারাবি পড়তে পারেন, কিন্তু একে বাধ্যতামূলক বানিয়ে নেওয়াটা বাড়াবাড়ি। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ১৬

ইসলাম কী বলে?
রমাযান মাসের তারাবিহ নামাজ ২০ রাকাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ’র মর্যাদা প্রায় ওয়াজিবের মতো। যে কারণে সকল সাহাবায়ে কেরাম তারাবীহ’র নামায আদায় করতেন। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত সাইব ইবনে ইয়াযীদ রহি. বলেছেন,
كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً
উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর যামানায় রমযান মাসে সাহাবায়ে কেরাম বিশ রাকাত তারাবী পড়তেন। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী, বর্ণনা : ৪৮০১

যেহেতু তারাবীহ’র নামাজ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, সেহেতু কোনো ওযর ছাড়া তা পরিত্যাগ করলে সে গুনাহগার হবে। ইবন নুজাইম রহি. বলেন,
والذي يظهر من كلام أهل المذهب أن الإثم منوط بترك الواجب أو السنة المؤكدة على الصحيح
মাযহাবের ইমামদের কথা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ওয়াজিব অথবা সুসুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ত্যাগ করলে বিশুদ্ধ মতানুযায়ী গুনাহ হয়। -আল বাহরুর রায়েক, খ. ১ পৃ. ৩১৯

সুতরাং তারাবীহের নামাজকে এভাবে অপ্রয়োজনীয় প্রমাণ করার প্রচেষ্টা অন্যায় নয় কী?

বর্তমানে জুম’আ পড়া যাবে না?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
জুম’আর সালাত ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কিন্তু হেযবুত তওহীদ তাদের দল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে প্রথম ১৫ বছর জুমআ পড়েনি বলে সেলিম সাহেব বক্তব্য দিয়েছেন। এবং তিনি জোর গলায় ববলে বেড়াচ্ছেন, ‘যেখানে আল্লাহর আইন চলে না, সেখানে জুমআ পড়া জায়েয নয়। আর তাদের যুক্তি হলো, বাংলাদেশ যেহেতু দারুল ইসলাম নয়, সেহেতু এখানে জুমআ পড়া যাবে না। চলুন তারা তাদের বইয়ের ভেতর কী বলেছে একটু দেখে নেওয়া যাক।

জুমা একটি স্বাধীন মোসলেম জাতির জাতীয় এবং রাষ্ট্রীয় এবাদত। যে অঞ্চলে সামগ্রিকভাবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং একজন কেন্দ্রীয় এমাম বা নেতা থাকবেন যিনি এসলামের শরিয়াহ দ্বারা আইন কানুন অর্থনীতি দন্ডবিধি, সমাজ বিধি শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি পরিচালনা কোরবেন, শুধু ঐ অঞ্চলে জুমা জায়েজ হবে এমন এলাকাকে এসলামের পরিভাষায় বলা হয় দারুল এসলাম। আর যেখানে আল্লাহ শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত নেই সে এলাকাকে বলা হয় দারুল হারব। দারুল হারবে জুমা কায়েম না-জায়েজ। -বিশ্বনবী মোহাম্মাদ (দ:) এর ভাষণ, পৃ. ১৯০

বর্তমানে দুনিয়ার কোথাও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নেই, আল্লাহর দীনের হুকুম কার্যকরী নেই, আল্লাহর খেলাফত নেই, তাই সারা দুনিয়াযই এখন দারুল হারব। তাই পৃথিবীতে কোথাও এখন জুমার সালাত কায়েম করা বিধিসম্মত নয়। -বিশ্বনবী মোহাম্মাদ (দ:) এর ভাষণ, পৃ. ১৯০

জুমার সালাতে এসলামী রাষ্ট্রের খলিফা অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান অথবা তার প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। খলিফা অথবা খলীফার প্রতিনিধির নেতৃত্ব ব্যতিত জুমা কায়েম করা না জায়ে। -বিশ্বনবী মোহাম্মাদ (দ:) এর ভাষণ, পৃ. ১৯১

রসূল মক্কায় থাকতে কোনদিন জুমা কায়েম করেন নি। কারণ ঐ স্থানটি তখনও “দারুল হারর” ছিল অর্থাৎ  এসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় নাই’। -বিশ্বনবী মোহাম্মাদ (দ:) এর ভাষণ, পৃ. ১৯১

এ ছাড়াও হেযবুত তওহীদের ২য় এমাম সেলিম সাহেব এক ভিডিওতে বলেন, ‘ আমরা হেযবুত তওহীদ দল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে প্রথম ১৫ বছর জুম’আ পড়িনি। অর্থাৎ তাদের দাবী হলো, জুমার জন্য ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকা শর্ত এবং খলীফা বা তার প্রতিনিধির উপস্থিত ছাড়া জুমা জায়েয হবে না। কারণ হিসাবে তারা বলেন, ‘যেহেতু নবীজি সা. মক্কায় জুমা আদায় করেননি কারণ তখনও মক্কায় খেলাফত কায়েম হয়নি। অতএব বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র দারুল হারব, সুতরাং পৃথিবীর কোথাও জুমা পড়া জায়েয নয়।

ইসলাম কী বলে?
এ বিষয়ে জানার জন্য সর্বপ্রথম জানতে হবে দারুল ইসলাম ও দারুল হরব কাকে বলে?

দারুল ইসলাম ও দারুল হরব কাকে বলে?
ইমাম আবু হানীফা রহি. দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,
أَنَّ الْمَقْصُودَ مِنْ إضَافَةِ الدَّارِ إلَى الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ لَيْسَ هُوَ عَيْنَ الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ وَإِنَّمَا الْمَقْصُودُ هُوَ الْأَمْنُ وَالْخَوْفُ وَمَعْنَاهُ أَنَّ الْأَمَانَ إنْ كَانَ لِلْمُسْلِمِينَ فِيهَا عَلَى الْإِطْلَاقِ، وَالْخَوْفُ لِلْكَفَرَةِ عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَهِيَ دَارُ الْإِسْلَامِ، وَإِنْ كَانَ الْأَمَانُ فِيهَا لِلْكَفَرَةِ عَلَى الْإِطْلَاقِ، وَالْخَوْفُ لِلْمُسْلِمِينَ عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَهِيَ دَارُ الْكُفْرِ
দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের প্রতি সম্পৃক্ততার মূল উদ্দেশ্য হলো, পরিপূর্ণ ইসলাম ও পরিপূর্ণ কুফর হওয়া নয়, বরং উদ্দেশ্য হলো, নিরাপত্তা ও ভয় বিষয়ে। অর্থাৎ যদি মুসলমানরা সর্বদিক থেকে নিরাপত্তায় থাকে, আর কুফরী শক্তি স্বাভাবিকভাবে আতংকিত থাকে, তাহলে সেটি দারুল ইসলাম। পক্ষান্তরে সর্বদিক থেকে যদি কুফরী শক্তি নিরাপদে থাকে আর মুসলমানরা ভীত থাকে, তাহলে উক্ত রাষ্ট্র দারুল কুফর বা দারুল হরব। -বাদায়েউস সানায়ে, খ. ৯ পৃ. ৫১৩

দারুল ইসলাম:
এক কথায়, দারুল ইসলাম হলো, ঐ সকল রাষ্ট্র, যেখানে অমুসলিমদের বসবাস খুবই কম তথা মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ট, সেই সাথে ইসলামের বিধান পালনে স্বাধীনতা থাকে এবং কোনো প্রকার বাঁধা এবং বিপদের সঙ্কা না থাকে এবং ইসলামী শক্তি সেখানে প্রবল থাকে, তাহলে উক্ত রাষ্ট্রের নাম হবে দারুল ইসলাম। যেমন অতীতকালের নবীজির সা. হিজরত পরবর্তী মাদীনা। আর বর্তমানে আফগানিস্তান।

দারুল কুফর:
পক্ষান্তরে দারুল হরব বা দারুল কুফর হলো, ঐ সকল রাষ্ট্র, যেখানে মুসলমানদের বসবাস খুবই কম তথা মুসলমানগণ সংখ্যালঘু, সেই সাথে ইসলামের বিধান পালনে স্বাধীনতা না থাকে, বরং নানাভিদ বাঁধা এবং বিপদের মাঝে দিন গোজরান হয় মুসলমানদের এবং কুফরী শক্তি সেখানে শাসক থাকে এবং প্রবল থাকে, তাহলে উক্ত রাষ্ট্রের নাম হবে দারুল হরব বা দারুল কুফর। যেমন অতীতকালের নবীজির সা. হিজরত পূর্ববর্তী মক্কা। আর বর্তমানে ইজরাঈল।

দারুল আমান:
দারুল আমান বলা হয় যে সকল রাষ্ট্রে মুসলিমগণ স্বাভাবিকভাবে স্বীয় ধর্ম পালনে সক্ষম। চাই তারা সংখ্যাগরিষ্ট হোক বা সংখ্যালঘিষ্ট। কিন্তু ইসলামের শাস্তির বিধান প্রয়োগ করতে সক্ষম নয়। তবে দ্বীন প্রচার ও পালনে স্বাধীন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও স্বীয় ধর্ম পালনে স্বাধীন। কোন ধর্ম পালনেই রাষ্ট্র পক্ষ থেকে কোন বিধি-নিষেধ নেই। তবে ইসলামী আইন উক্ত রাষ্ট্রে প্রচলিত নয়। আইন চলে মানবরচিত আইন বা কুফরী আইন। তাহলে উক্ত রাষ্ট্রের নাম হবে দারুল আমান।

যেমন অতীতকালের খৃষ্টান বাদশা নাজ্জাশীর শাসনাধীন হাবশা তথা আবিসিনিয়া ছিল দারুল আমান। আবিসিনিয়া যদিও খৃষ্টান বাদশার শাসনাধীন, কিন্তু সেখানে মুসলমানরা হিজরত করে স্বাধীনভাবে স্বীয় ধর্ম পালন করতে পারতো। তাদের ধর্ম পালনে কোন বাঁধা দেয়া হতো না। সেই সাথে স্বীয় ধর্ম প্রচারেও কোন বাঁধা ছিল না। তবে ইসলামী শরীয়তের নির্দিষ্ট শাস্তির বিধান প্রয়োগ করার সুযোগ ছিল না। সুতরাং আবিসিনিয়া ছিল দারুল আমান। দারুল ইসলাম ও নয়, আবার দারুল হরবও নয়। বর্তমানে অধিকাংশ দোষগুলো দারুল আমানের অন্তুর্ভূক্ত। এমনকি আমেরিকা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোও। কারণ সেখানে সকল ধর্মাবলম্বীরাই স্বীয় ধর্ম পালনে ও প্রচারে স্বাধীন। রাষ্ট্র পক্ষ থেকে কোন প্রকার বিধি-নিষেধ নেই। যদিও সরকারী আইন ইসলামী নয়। এ হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ অধিকাংশ রাষ্ট্রই দারুল আমানের অন্তর্ভূক্ত।

বর্তমানে কোনো দেশে কী জুম’আ পড়া যাবে না?
দারুল ইসলাম হোক বা দারুল হারব হোক কিংবা দারুল আমান হোক সর্বত্র জুম’আ আদায় করা মুসলমানদের জন্য ফরজ। কারণ কুরআন-সুন্নাহর যে সকল আয়াত-হাদিসে এ বিষয়গুলো পালনের হুকুম করা হয়েছে, সেখানে ব্যাপকভাবেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহ’য় এমন কিছু নেই, যেখানে জুম’আ শুধু দারুল ইসলামে ফরজ হওয়ার প্রমাণ বহন করে। কোনো আলেমও জুম’আ ফরজ হওয়ার জন্য দারুল ইসলামকে শর্ত দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। হেযবুত তওহীদ কোথায় এসব কোথায় পেলো সেটাই জানার বিষয়।  কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِي لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
হে মুমিনগণ, জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝো। [সুরা জুমআ : ৯]

উক্ত আয়াতে জুম’আর নামাজ ফরজ হওয়ার জন্য খিলাফতের শর্ত করা হয়নি। উপরন্তু হাদিসসমূহের ভেতরও এ শর্ত কোথাও করা হয়নি। নিন্মে কয়েকটি হাদিস পেশ করা হলো- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার ও আবূ হুরায়রাহ রা. থেকে বর্ণিত, তারা উভয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তার মিম্বারের সিড়িতে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন,
لَيَنْتَهِيَنَّ أَقْوَامٌ عَنْ وَدْعِهِمُ الْجُمُعَاتِ أَوْ لَيَخْتِمَنَّ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ ثُمَّ لَيَكُونُنَّ مِنَ الْغَافِلِينَ ‏
যারা জুমুআর সালাত ত্যাগ করে তাদেরকে এ অভ্যাস বর্জন করতে হবে। নতুবা আল্লাহ তাদের অন্তরে সীল মেরে দিবেন, অতঃপর তারা গাফিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। -সহিহ মুসলিম, হাদিম : ৮৬৫

নবীজির সা. সহধর্মিণী আম্মাজান হাফসাহ রা. সূত্রে বর্ণিত, নবী সাঃ বলেছেন;
رَوَاحُ الْجُمُعَةِ وَاجِبٌ عَلَى كُلِّ مُحْتَلِمٍ
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক লোকের জন্য জুমুআর সালাতে যাওয়া ওয়াজীব। -জামে সগীর, হাদিস : ৪৪৬৭

আবুল জা’দ আদ-দামরী রা. সূত্রে বর্ণিত, যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন,
مَنْ تَرَكَ ثَلَاثَ جُمَعٍ تَهَاوُنًا بِهَا طَبَعَ اللهُ عَلَى قَلْبِهِ
যে ব্যক্তি (বিনা কারণে) অলসতা করে পরপর তিনটি জুমু’আহ ত্যাগ করে মহান আল্লাহ তার অন্তরে সীলমোহর মেরে দেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১০৫২

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
من ترَكَ الجمعةَ ثلاثَ جمعٍ متوالياتٍ فقد نَبذَ الإسلامَ وراءَ ظَهْرِهِ
যে ব্যক্তি পর পর তিনটি জুমা পরিত্যাগ করবে, সে ইসলামকে পেছনের দিকে নিক্ষেপ করল। -আত তারগীব ওয়াত তারহীব খ. ১ পৃ. ৩৫

প্রিয় পাঠক, এ সকল আয়াত-হাদিস থেকে প্রমাণিত হলো, জুমআ ফরজ হওয়ার জন্য খিলাফত শর্ত নয়।

ফাতাওয়ার কিতাবে কী লেখা আছে?
জুমার ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাব অনুযায়ী মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতি বা অনুমতি থাকা শর্ত। তবে এ শর্ত তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন মুসলিমদের সুলতান (রাষ্ট্রপ্রধান) থাকেন এবং তিনি জুম’আর ব্যবস্থাপনা করেন। পক্ষান্তরে অবস্থা যদি এমন হয় যে, সুলতান থাকা সত্ত্বেও তিনি জুমআ কায়েম করার দায়িত্ব পালন না করেন কিংবা কোনো গোলযোগ বা অসুবিধার কারণে তাঁর অনুমতি গ্রহণ সম্ভব না হয় অথবা মুসলমানদের কোনো সুলতান-ই না থাকে, তাহলে এসব পরিস্থিতিতে ইমামের উপস্থিতি বা অনুমতির ওপর জুমআ মওকুফ থাকবে না, বরং এমন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের ওপর আবশ্যক হল, নিজেরাই জুম’আর ইমাম ঠিক করে নেবেন এবং তাঁর ইমামতিতে জুম’আ আদায় করবেন। হানাফি মাজহাবের প্রখ্যাত ইমাম তহাবি রহ. বর্ণনা করেন
عن أبي عبيد مولى ابن أزهر قال شهدت العيد مع علي بن أبي طالب عليه السلام وعثمان محصور فجاء فصلى ثم انصرف فخطب
ইবনু আজহারের আজাদকৃত গোলাম আবু উবায়েদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খলিফা হযরত উসমান রা. যখন অবরুদ্ধ, তখন আমি আলি রা.-এর সঙ্গে ঈদের জামাতে উপস্থিত হয়েছি। তিনি (মানুষকে নিয়ে) ঈদের সালাত আদায় করেছেন। তারপর ফিরে খুতবা প্রদান করেছেন। -মুশকিলুল আসার (ত্বহাবী) হাদিস নং- ৪৫০

এ ববর্ণনার ভিত্তিতেই ইমাম ত্বহাবি হানাফী রহি বলেন,
و روي عن محمد أن أهل مصر لو مات واليهم جاز أن يقدموا رجلا يصلي بهم الجمعة حتى يقدم عليهم وال
মুহাম্মাদ রহ. থেকে বর্ণিত, কোনো শহরবাসীর প্রশাসক মারা গেলে তাদের জন্য বৈধ, তারা একজন ব্যক্তিকে সামনে অগ্রসর করে দেবে, যিনি তাদের নিয়ে জুমআর সালাত আদায় করবেন। যতদিন না (নতুন) প্রশাসকের আগমন ঘটে, ততদিন এভাবেই চলবে। -ফাতহুল বার, খ. ৫ পৃ. ৩৪১

হানাফী মাযহাবের অন্যতম গ্রন্থ ফাতাওয়া শামিতে এসেছে,
لو مات الوالي أو لم يحضر لفتنة ولم يوجد أحد ممن له حق إقامة الجمعة نصب العامة لهم خطيبا للضرورة….وبهذا ظهر جهل من يقول لا تصح الجمعة في أيام الفتنة مع أنها تصح في البلاد التي استولى عليها الكفار
যদি প্রশাসক মৃত্যুবরণ করেন অথবা ফিতনার কারণে উপস্থিত হতে না পারেন এবং এমন কাউকেও না পাওয়া যায়, যার জুমআ কায়েমের অধিকার রয়েছে, তাহলে জরুরতের কারণে সাধারণ মানুষ নিজেদের জন্য একজন খতিব নির্ধারণ করে নেবে….আমাদের এ বক্তব্য থেকে ওই ব্যক্তির অজ্ঞতা স্পষ্ট হয়ে গেছে যারা বলে, ফেতনার দিনগুলোতে জুম’আ সহিহ হবে না। অথচ ওই সমস্ত শহরেও জুমআ সহিহ, যেগুলো কাফেররা দখল করে নিয়েছে। -রাদ্দুল মুহতার, খ. ৩ পৃ. ৬

আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে,
فلو الولاة كفارا يجوز للمسلمين إقامة الجمعة
অর্থাৎ আর যদি প্রশাসক কাফের হয়, তাহলেও মুসলমানদের জন্য জুম’আ কায়েম করা বৈধ। -রাদ্দুল মুহতার, খ. ৩ পৃ. ১৪,

আরও স্পষ্টভাবে হানাফী মাযহাবের গ্রন্থ বাহরুর রায়েকে বলা হয়েছে,
و اما في بلاد عليها ولاة كفار يجوز للمسلمين إقامة الجمع والأعياد فيها
আর যেসব এলাকায় কাফেরদের কর্তৃত্ব রয়েছে, সেসব এলাকাতেও জুম’আ ও ঈদের নামাজ আদায় করা বৈধ। -বাহরুর রায়েক, খ. ৬ পৃ. ৪৬১

আর এসব ফাতাওয়ার ভিত্তিতেই আকাবিরগণ হিন্দুস্তানে জুম’আ ফরজ বলে ফাতওয়া দিয়েছেন। এ ব্যাপারে ফাতওয়া দারুল উলুম দেওবন্দ, কিফায়াতুল মুফতি,  ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়্যাহ দেখতে পারেন। সুতরাং প্রমাণ হলো, ফাতাওয়ার কিতাবে জুম’আ জায়েয হওয়ার জন্য  দারুল ইসলামকে শর্ত করা হয়নি। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এমন আজগুবি কথা কোথায় পেলো আমার বুঝে আসে না। এটাও কী তাদের মিথ্যার জলন্ত প্রমাণ নয়?

জুম’আর শর্তাবলী:
তবে বিভিন্ন হাদিসের আলোকে জুম’আ সহিহ হওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি শর্ত রয়েছে-
এক. শহর বা উপশহরে হওয়া। গ্রামে বা জনমানবহীন বিয়াবানে জুমআর নামায শুদ্ধ হবে না।
দুই. জামা’আত হতে হবে।
তিন. যোহরের ওয়াক্ত হতে হবে।
চার.সকলের জন্য আম অনুমতি থাকতে হবে।
পাঁচ. খুৎবা দিতে হবে। -হেদায়া খ. ১ পৃ. ১১৪-১১৬

অভিযোগ:
তারা আরও অভিযোগ করে বলেন,
রসূল মক্কায় থাকতে কোনদিন জুমা কায়েম করেন নি। কারণ ঐ স্থানটি তখনও “দারুল হারর” ছিল অর্থাৎ  এসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। -বিশ্বনবী মোহাম্মাদ (দ:) এর ভাষণ, পৃ. ১৯১

জবাব:
অবশ্য রাসুলুল্লাহ সা. মক্কায় থাকা কালীন সময়ে জুম’আ পড়েননি। এ ব্যাপারে আগে প্রমাণ দেখা যাক। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন
إِنَّ أَوَّلَ جُمُعَةٍ جُمِّعَتْ فِي الإِسْلاَمِ بَعْدَ جُمُعَةٍ جُمِّعَتْ فِي مَسْجِدِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِالْمَدِينَةِ
ইসলামের প্রথম জুম’আ মদীনাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মসজিদে (মসজিদে নববীতে) অনুষ্ঠিত হয়েছে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১০৬৮

এ হাদিসের আলোকে তারা বলতে চান, ‘যেহেতু নবিজি সাà জুম’আর নামাজ মক্কায় থাকাকালিন সময়ে আদায় করেননি, বরং মাদানী যিন্দেগীতে আদায় করেছেন, এর অর্থ হলো, রাষ্ট্র কায়েম না হলে জুম’আ ফরজ হয় না’ এ ধরণের কথাবার্তা মূর্খতার প্রমাণ বহন করে। কারণ ইসলামের সকল বিধান মক্কায় অবতীর্ণ হয়নি, বরং পর্যায়ক্রমে নবীজির সা. পুরো তেইশ বছরে আস্তে ধীরে ধীরে সব কিছুই নাযিল করা হয়েছে। উপরোক্ত অভিযোগ যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে মাদানী জিবনে যত বিধান নাযিল হয়েছে, সব বিধান পালনে কী রাষ্ট্র কায়েম শর্ত দেওয়া যৌক্তিক? কী হাস্যকর কথা! অথচ হেযবুত তওহীদের দাবি অনুযায়ী ‘তাওহীদ’ ব্যাতিত ইসলামের সকল বিধিবিধান এসেছে নবীজির সা. মাদানী যিন্দেগীতে। তারা লিখেছে,

‘মক্কী জীবনে যেসব সাহাবী ইন্তেকাল করেন তারা ইসলাম বলতে কি পেয়েছিলেন? তারা নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত ঈদ কোরবানি কিছুই পেয়েছিলেন কি? তারা পেয়েছেন শুধুমাত্র তাওহিদ এবং বলার অপেক্ষা রাখেনা তাওহীদই তাদের সফলকাম হয়ে জান্নাতে প্রবেশের জন্য যথেষ্ট ছিল। -ওহীদ জান্নাতের চাবি, পৃ. ১০

তাহলে রাষ্ট্র কায়েম করার আগ পর্যন্ত কী ইসলামের অন্য কোনো আমল করা যাবে না? হেযবুত তওহীদের কাছে এর কোনো জবাব আছে কী? জ্বি, আছে। একটাই জবাব, তারা ইসলামের বন্ধু নয়।

নামাজের কয়েকটি বিকৃত পদ্ধতির আবিস্কার:

এক. হুপহিপ নামাজ:
নামাজ সেভাবেই পড়তে হবে যেভাবে রাসুলুল্লাহ সাঃ শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু হেযবুত তওহীদ আবিস্কার করেছে এক বিদ’আতী নামাজ।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, জামাতে নামাজ আদায় করার সময় ইমামের সাথে সাথেই সব করতে হবে। তারা লিখেছে,

সালাতের দৃশ্য পৃথিবীতে আর একটি মাত্র দৃশ্যের সঙ্গে মিলে, আর কিছুর সাথেই মিলে না,আর সেটা হচ্ছে পৃথিবীর যেকোন বাহিনীর কুচকাওয়াজের সঙ্গে। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ২১

যে কারণে একটি সামরিক বাহিনীর প্যারেড, কুচকাওয়াজ করার সময় তাদের পোষাক পরিচ্ছদ অর্থাৎ ইউনিফর্ম একই রকম, ইস্ত্রি করা পরিস্কার হওয়া বাধ্যতামূলক, ঠিক সেই কারণেই মসজিদে সালাতের সময় জাক-জমকপূর্ণ পোষাক পরার জন্য আল্লাহর এই হুকুম। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৩৮

ইসলামের প্রকৃত সালাহর নিয়ম হচ্ছে, এমামের তকবিরের জন্য সতর্ক, তৎপর হয়ে থাকা ও তকবিরের সঙ্গে সঙ্গে জামাতের সকলের সঙ্গে একত্রিতভাবে,একসাথে রুকুতে যাওয়া, এ’তেদাল করা,সাজদায় যাওয়া, সালাম ফেরানো ইত্যাদি করা; ঠিক যেমনভাবে প্যারেড,কুচকাওয়াজের সময় সামরিক বাহিনীর সৈনিকেরা সার্জেন্ট মেজরের(Sergeant-major) আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সকলে একত্রিত ভাবে মার্চ করে,ডাইনে বামে ঘুরে দাঁড়ায়, বসে,দৌঁড়ায়। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ২৬

যেহেতু মূলত সালাহ সামরিক প্রশিক্ষণ সেহেতু এর চলন (Muvenent) দ্রুত হতে বাধ্য। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ২৫

অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, সামরিক প্রশিক্ষণের মত ইমামের সাথে সাথেই মুক্তাদিও আদায় করবে, দেরি করতে পারবে না।

ইসলাম কী বলে?
হাদীসে বর্ণিত পদ্ধতি হলো, ইমামের সাথে সাথে নয়, বরং ইমামের পরে মুক্তাদী রুকু-সিজদা করবে। হাদিস শরীফে লম্বা এক বর্ণনা রয়েছে, নবিজি সাঃ বলেন,
إِذَا صَلَّيْتُمْ فَأَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ ثُمَّ لْيَؤُمَّكُمْ أَحَدُكُمْ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوا وَإِذَا قَالَ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِينَ ‏.‏ يُجِبْكُمُ اللَّهُ فَإِذَا كَبَّرَ وَرَكَعَ فَكَبِّرُوا وَارْكَعُوا فَإِنَّ الإِمَامَ يَرْكَعُ قَبْلَكُمْ وَيَرْفَعُ قَبْلَكُمْ ‏”‏ ‏.‏ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ فَتِلْكَ بِتِلْكَ وَإِذَا قَالَ سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ ‏.‏ فَقُولُوا اللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ ‏.‏ يَسْمَعُ اللَّهُ لَكُمْ فَإِنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى قَالَ عَلَى لِسَانِ نَبِيِّهِ صلى الله عليه وسلم سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ ‏.‏ وَإِذَا كَبَّرَ وَسَجَدَ فَكَبِّرُوا وَاسْجُدُوا فَإِنَّ الإِمَامَ يَسْجُدُ قَبْلَكُمْ وَيَرْفَعُ قَبْلَكُمْ ‏”‏ ‏.‏ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ فَتِلْكَ بِتِلْكَ
তোমরা যখন সালাত আদায় করবে, তোমাদের লাইনগুলো ঠিক করে নিবে। অতঃপর তোমাদের কেউ তোমাদের ইমামতি করবে। সে যখন তাকবীর বলবে, তোমরাও তাকবীর বলবে। সে যখন “গাইরিল মাগযুবি ’আলাইহিম ওয়ালায যোল্লীন” বলবে তোমরা তখন আমীন বলবে। আল্লাহ তোমাদের ডাকে সাড়া দিবেন। সে যখন তাকবীর বলে রুকু’তে যাবে, তোমরাও তাকবীর বলে রুকু’তে যাবে। কেননা, ইমাম তোমাদের আগে রুকু’তে যাবে এবং তোমাদের আগে রুকু থেকে উঠবে।

রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, এটা ওটার বিনিময়ে, তথা ইমাম যেমন রুকু সাজদার আগে যাবে, তেমনি আগে উঠবে। সে যখন “সামি’আল্লাহু লিমান হামিদাহ” বলবে, তোমরা তখন “আল্লাহুম্মা রব্বানা- লাকাল হামদ” বলবে, আল্লাহ তোমাদের এ কথা শুনবেন। কেননা আল্লাহ তা’আলা তার নবী সাঃ এর ভাষায় বলছেনঃ “সামি’আল্লাহু লিমান হামিদাহ” (আল্লাহ তার প্রশংসাকারীর প্রশংসা শুনেন)। সে যখন তাকবীর বলবে এবং সাজদায় যাবে, তোমরাও তার পরপর তাকবীর বলে সাজদায় যাবে। কেননা, ইমাম তোমাদের আগে সাজদায় যাবে এবং তোমাদের আগে সিজদা থেকে উঠবে। রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, তোমাদের তাকবীর ও সিজদা ইমামের পরে হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদিস : ৪০৪

উক্ত হাদিসে নবীজি সাঃ সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, তাকবীর, রুকু, সিজদাসহ সব কিছু আগে ইমাম করবে পরে মুক্তাদি করবে। অথচ হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, সামরিক প্রশিক্ষণের মত ইমামের সাথে সাথেই মুক্তাদিও করবে। এটা কী ১৪০০ বছরের চলে আসা নামাজের বিকৃতি নয়? সুতরাং প্রমাণ হলো, নামাজ কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ নয়।

দুই. নামাজে দাঁড়িয়ে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ রাখতে হবে?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো,
নামাজে দাড়ানো অবস্থায় বাম হাত মুষ্টিবদ্ধ রাখতে হবে। বাম হাতও দৃঢ়ভাবে মুষ্ঠিবদ্ধ থাকবে। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৫০

ইসলাম কী বলে?
এ প্রসঙ্গে সাহাবী হযরত জাবির রা. বলেন,
أنّ رسولَ اللهِ ﷺ مرَّ برجُلٍ وهو يُصلِّي قد وضَع يدَه اليُسْرى على اليُمْنى فانتزَعها ووضَع يدَه اليُمْنى على اليُسْرى
আল্লাহর রাসূল সাঃ একজন নামাযরত ব্যক্তির নিকট দিয়ে গমন করছিলেন, যিনি ডান হাতের উপর বাম হাত রেখে নামায পড়ছিলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত খুলে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখলেন।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫০৯০

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন,
أخذ الأكف على الأكف في الصلاة تحت السرة
নামাযে হাতের পাতাসমূহ দ্বারা হাতের পাতাসমূহ নাভীর নীচে ধরা হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৭৫৮

বুঝা গেলো, নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় ডানহাতের তালু দিয়ে বামহাতের কব্জি ধরে দাঁড়ানো সুন্নাহ। হেযবুত তওহীদের মুষ্টিবদ্ধ হাতে দাঁড়ানো বিকৃত নামাজ।

তিন. তাকবীরের সময় হাতের তালু কোনাকোনি রাখবে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, তাকবীরে উলার সময় হাতের বুড়া আঙ্গুল কানের লতিতে স্পর্ষ করতে হবে এবং উভয় হাতের তালু কোনাকোনিভাবে কেবলার দিতে রাখতে হবে। তারা লিখেছে,
সোজা হয়ে দাড়ানোর পর দুই হাত উঠিয়ে দুই বুড়া আঙ্গুল দুই কানের লতিতে স্পর্শ করাতে হবে এবং দুই হাতের তালু কোনাকোনি ভাবে কেবলার দিকে রাখতে হবে। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৪৯

ইসলাম কী বলে?
তাকবীরে তাহরীমায় উভয় হাত তোলার সময় আঙ্গুলগুলো সোজা রাখবে এবং হাত কিবলামুখী করে রাখবে। তবে কানের লতি স্পর্শ করা সুন্নাত নয়। এ ব্যাপারে হযরত মালেক ইবনে হুওয়াইরিস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان إذا كبر رفع يديه حتى يحاذي بهما أذنيه
রাসূলুল্লাহ সাঃ যখন তাকবীরে তাহরীমা বলতেন, তখন দুই হাত কান বরাবর উঠাতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদিস : ৩৯১

হযরত ত্বঊস রহ. বলেন,
ما رأيت مصليا كهيئة عبد الله بن عمر أشد استقبالا للكعبة بوجهه، وكفيه، وقدميه
আমি নামাযে হযরত ইবনে উমর রা. এর মতো চেহারা, দুই হাত এবং দুই পা অধিক কিবলামুখী করে রাখতে কাউকে দেখিনি। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদিস : ২৯৩৬

বুঝা গেলো, তাকবীরে তাহরীমার সময় উভয় হাতের তালু কোনাকোনিভাবে নয়, বরং সোজাভাবে কেবলার দিকে রাখতে হবে। আর কানের লতি স্পর্শ করা সুন্নত নয়।

চার. নারী-পুরুষের নামাজে পার্থক্য নেই?
নারী-পুরুষ সৃষ্টিগতভাবেই ভিন্ন, সেহেতু ইবাদতের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা রয়েছে, যা হাদিস শরীফ থেকে প্রমাণিত।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
নারীদের সমানাধিকারের স্লোগানধারী হেযবুত তওহীদ ইবাদতের ক্ষেত্রেও সমানাধিকার দেওয়ার মত দু:সাহস দেখিয়েছে। তারা লিখেছে-

ইবলিসের প্ররোচনায় সঠিক,প্রকৃত ইসলামের আকীদা বিকৃত ও বিপরীতমুখী হয়ে যাওয়ার ফলে ইসলামের প্রকৃত সালাহ ও তার উদ্দেশ্যও বিপরিত হয়ে গেছে। এর অন্যতম হলো- পুরুষ ও নারীর সালাহকে ভিন্ন করে দেয়া হয়েছে। মেয়েদের সালাতের প্রক্রিয়া থেকে কিছুটা অন্যরকম করে দেয়া হয়েছে; যেমন বুকের উপর হাত বাধা,সাজদার সময় মেঝের সাথে মিশে থাকা ইত্যাদী।কিন্তু প্রকৃত ইসলামের সালাতে পুরুষ -নারীর প্রক্রিয়ার কোন তফাৎ নেই,উভয়ের একই রকম। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ৫৪

উক্ত লেখায় তারা নারী-পুরুষের নামাজের মধ্যে তারতম্য করতে নারাজ। অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায় যে, নারী-পুরুষ একভাবেই নামাজ পড়বে। বিশেষ করে তারা এখানে দু’টি জিনিষ উল্লেখ্য করেছে।
১. নারীদের বুকে হাত রাখা।
২. সিজদার সময় মাটির সাথে মিশে থাকা।

ইসলাম কী বলে?
সৃষ্টিগতভাবেই নারী-পুরুষের শারীরিক গঠন, শক্তি-সক্ষমতা, নিরাপত্তা ইত্যাদী নানা বিষয়ে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি পার্থক্য রয়েছে ইবাদতসহ শরীয়তের অনেক বিষয়ে। যেমন-

১. আযান-ইকামত শুধু পুরুষই দিবে, কোন নারীকে মুয়াজ্জিন বানানো জায়েজ নয়।
২. নামাজে ইমামের ভুল হলে পুরুষ তাসবীহ আর মহিলাদের তাসফীক করা তথা হাতে শব্দ করার মাধ্যমে লোকমা দেয়ার নিয়ম।
৩. ইমামতি ও খুৎবা শুধু পুরুষই দিতে পারে, কোন নারীর জন্য ইমাম বা খতীব হওয়া জায়েয নয়।
৪. পুরুষের জন্য মসজিদে গিয়ে জামাআতে নামায পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। কিন্তু মহিলাদের জন্য ঘরে নামায পড়াই উত্তম বলা হয়েছে।

এমন অসংখ্য বিষয় রয়েছে, যেখানে নারী-পুরুষের ইবাদতের নিয়মে পার্থক্য করা হয়েছে। উপরন্তু ওড়না ছাড়া নারীদের নামাজ কবুল হয় না। হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আয়েশা রা. সূত্রে বর্ণিত, নবী সাঃ বলেছেন,

لَا يَقْبَلُ اللهُ صَلَاةَ حَائِضٍ إِلَّا بِخِمَارٍ
কোন প্রাপ্তবয়স্কা মহিলা ওড়না ছাড়া সালাত আদায় করলে, আল্লাহ তার সালাত কবুল করেন না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৬৪১

এখন যদি বলতে হয় যে, নারী-পুরুষের নামাজে কোনো পার্থক্য নেই। তাহলে নামাজে নারীদের যেমন ওড়না লাগে, ঠিক নারী-পুরুষের নামাজে পার্থক্য যারা করতে চাননা, তাদেরকেও তো তাহলে ওড়না পরিয়ে নামাজ পড়ানো উচিত। অথচ হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন,

لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّجُلَ يَلْبَسُ لِبْسَةَ الْمَرْأَةِ، وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لِبْسَةَ الرَّجُلِ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন ঐসব পুরুষকে যারা নারীর অনুরূপ পোশাক পরে এবং ঐসব নারীকে যে পুরুষের অনুরূপ পোশাক পরিধান করে। -সহিহ আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৯৮

তাহলে বলুন, নারী-পুরুষের নামাজ কি কখনও এক রকম হতে পারে? অবশ্য তারা বিশেষ করে দুটি বিষয় উল্লেখ্য করেছে।
১. নামাজে নারীদের বুকে হাত রাখা।
২. সিজদার সময় নারীরা মাটির সাথে মিশে থাকা। চলুন উভয় বিষয়টি দলীলসহ জেনে নেওয়া যাক।

নামাজে নারীদের বুকে হাত রাখা।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত আতা রহি. বলেন,
تَجْمَعُ الْمَرْأَةُ يَدَيْهَا فِي قِيَامِهَا مَا اسْتَطَاعَتْ
অর্থাৎ মহিলারা নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় তাদের হাতকে যতদূর সম্ভব গুটিয়ে রাখবে। -মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস: ৫০৬৭

আর এজন্য হযরত আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌবীর রহি. লিখেছেন,
اما فى حق النساء فاتفقوا على ان السنة لهن وضع اليدين على الصدر
আর মহিলাদের ক্ষেত্রে সকলেই ঐক্যমত্ব যে, তাদের ক্ষেত্রে সুন্নত হল তাদের উভয় হাতকে বুকের উপর রাখবে। -আসসিয়ায়াহ, খ. ২ পৃ. ১৫৬

সুতরাং মহিলাদের বুকের উপর হাত বাঁধাটি তাবেয়ীগণ ও উম্মাহর ইজমা দ্বারা প্রমানিত।

মহিলারা সিজদা কীভাবে করবে?
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট তাবেয়ী ইয়াযীদ বিন আবী হাবীব রহি. বলেন, একবার রাসুল সাঃ দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্য) বললেন,
إذا سجدتما فضما بعض اللحم إلى الأرض فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل
যখন সেজদা করবে তখন শরীর যমীনের সাথে মিলিয়ে দিবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মত নয়। -সুনানে বায়হাকী, হাদিস: ৩০১৬

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছন,
إِذَا جَلَسْتِ الْمَرْأَةُ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَتْ فَخِذَهَا عَلَى فَخِذِهَا الأُخْرَى ، وَإِذَا سَجَدْتْ أَلْصَقَتْ بَطْنَهَا فِى فَخِذَيْهَا كَأَسْتَرِ مَا يَكُونُ لَهَا ، وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَنْظُرُ إِلَيْهَا وَيَقُولُ : يَا مَلاَئِكَتِى أُشْهِدُكُمْ أَنِّى قَدْ غَفَرْتُ لَهَا
মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসবে তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সেজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখে বলেন-ওহে আমার ফেরেস্তারা! তোমরা সাক্ষী থাক। আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। -সুনানে বায়হাকী, হাদিস: ৩৩২৪

হযরত আলী রা. বলেছেন,
إذا سجدت المرأة فلتحتفز ولتلصق فخذيها ببطنها
মহিলা যখন সেজদা করে তখন সে যেন খুব জড়সড় হয়ে সেজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে। -মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস: ৫০৭২,

হযরত ইবনে আব্বাস রা. কে জিজ্ঞেস করা হল-মহিলারা কিভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বললেন,
تَجْتَمِعُ وَتَحْتَفِزُ
খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: হাদিস: ২৭৯৪

সুতরাং এরপরও যারা বলছেন, ইসলামের নামাজ পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে, তাহলে নবিজি সাঃ এবং সাহাবায়ে কেরামই রা. কী সে নামাজ নষ্ট করে গেছেন? আল্লাহ এই হেযবুত তওহীদ থেকে মুসলিমদের ঈমানের হিফাযত করেন। আমীন!

যাকাত প্রসঙ্গ:

রাসুলুল্লাহ সাঃ দুনিয়ায় থাকাকালীন সময়ে মুনাফিকরা বিভিন্নভাবে ইসলামকে ধংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো। পরবর্তিতে নবিজি সাঃ দুনিয়া থেকে চলে যাবার পর ইসলাম বিদ্বেষীরা ইসলামকে তাহরীফ তথা অপব্যখ্যা ও বিকৃতি করার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিশাবে যাকাতকে অস্বীকার করে বসলো। ইসলামি ইতিহাসে যারা মুনিকিরিনে যাকাত বা যাকাত অস্বীকারকারী হিশাবে পরিচিত। যাদের বিরুদ্ধে সিদ্দিকে আকবার রা. হাতে তরবারী তুলে নেন এবং তাদেরকে উচিৎ শিক্ষা তেন। কিন্তু এই ধারাবাহিকতা মুসলমানদের ঈমান-আকীদা ও তাহযিব-তামাদ্দুন ধ্বংস করার জন্য যুগে যুগে বিভিন্নভাবে আগমন হয়েছে। তারই ধারাবিহক একটা রূপ হলো হেযবুত ‘তওহীদ নামক’। তাদের দাবিগুলো নিন্মে তুলে ধরা হলো-
১. যাকাত কোনো ইবাদত নয়
২. যাকাত শান্তি প্রতিষ্ঠার ট্রেণিং।
৩. মানবতার কাজ না করে যাকাত দিলেও জাহান্নামে যেতে হবে।
৪. ঈমানদার হওয়ার জন্য যাকাত মূল বিষয় নয়।
৫. যাকাতে গুরুত্ব দেওয়া বিকৃত ইসলামের কাজ।
৬. যাকাতে গুরুত্ব দেওয়া খ্রিস্টানদের শিক্ষা।
৭. যাকাতের উপর গুরুত্ব দিলে খ্রিস্টানদের সুবিধা।
৮. যাকাত না দিলেও জান্নাতে যাওয়া যাবে।

চলুন প্রত্যেকটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

যাকাত কী কোনো ইবাদত নয়?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, যাকাত কোনো ইবাদত নয়। দেখুন তারা কী বলে-

এবাদত হচ্ছে আল্লাহর খেলাফত করা , কিন্তুু ভুল করে নামায , রোযা , হজ্জ , যাকাত ইত্যাদিকে এবাদত বলে মনে করা হচ্ছে । -মহা সত্যের আহ্বান, পৃ . ৪

অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, যাকাত কোনো ইবাদত নয়।

ইসলাম কী বলে?
ইসলামে যাকাত হলো মালি ইবাদত তথা আর্থিক ইবাদত। যা আল্লাহ গ্রহণ করেন বলে পবিত্র কুরআনে এসেছে। মহান রব বলেন-
أَلَمْ يَعْلَمُواْ أَنَّ اللّهَ هُوَ يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَأْخُذُ الصَّدَقَاتِ وَأَنَّ اللّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
তাদের কি জানা নেই যে, আল্লাহই তো নিজ বান্দাদের তাওবা কবুল করেন এবং সদকাও গ্রহণ করেন এবং আল্লাহই অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু? [সুরা তাওবা : ১০৪]

উক্ত আয়াত থেকে জানা গেলো, যাকাত বা সাদাকা এমন ইবাদত যা মহান রব নিজে গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, বরং আল্লাহ পাক তাঁর কুদরতি ডান হাত দ্বারা কবুল করেন। হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ وَلاَ يَقْبَلُ اللَّهُ إِلاَّ الطَّيِّبَ وَإِنَّ اللَّهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِينِهِ ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهِ كَمَا يُرَبِّي أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ حَتَّى تَكُونَ مِثْلَ الْجَبَلِ
যে ব্যাক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ সাদাকা করবে, (আল্লাহ তা কবূল করবেন) এবং আল্লাহ কেবল পবিত্র মাল কবুল করেন। আর আল্লাহ তাঁর ডান হাত দিয়ে তা কবূল করেন। এরপর আল্লাহ দাতার কল্যাণার্থে তা প্রতিপালন করেন যেমন তোমাদের কেউ অশ্ব শাবক প্রতিপালন করে থাকে, অবশেষে সেই সাদাকা পাহাড় বরাবর হয়ে যায়। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১৪১০

উক্ত আয়াত এবং হাদিস থেকে জানা গেলো, দান-সাদাকা বা যাকাত
মহান আল্লাহ নিজে গ্রহণ করেন। যদি এটা ইবাদতই না হয়, তাহলে কবুল করার অর্থ কী?

যাকাত কী শান্তি প্রতিষ্ঠার ট্রেণিং?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, যাকাত ইসলামে মৌলিক কোনো বিষয় নয়, বরং এটা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটা ট্রেণিং মাত্র। দেখুন তারা কী বলে/
প্রকৃত ইসলামের জীবনব্যবস্থার উদ্দেশ্য মানব জীবনের নিরাপত্তা সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি, আর বর্তমান ইসলামের উদ্দেশ্য ওসব কিছুই না বরং সময়মত নামাজ পড়া, যাকাত দেওয়া, হজ্ব করা, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, লম্বা পোশাক ও খাটো পায়জামা পরা ইত্যাদি। -হেযবুত তওহীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, পৃ. ৭

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানেই হচ্ছে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। যারা এই অঙ্গীকার করবে তাদের চরিত্র অর্জনের জন্য আল্লাহ নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত এর হুকুম দিয়েছেন। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ১০৯

সেই সত্য দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্ব উপায়ে প্রচেষ্টা চালানো প্রত্যেক মো’মিনের অবশ্য কর্তব্য, ফরদ। এই দীন প্রতিষ্ঠা করতে হলে মো’মেনের অবশ্যই কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুন লাগবে। সেই চারিত্রিক, মানসিক আত্মিক গুণ বৈশিষ্ট্য (Attributes) এটা যে সে অর্জন করবে কোথেকে অর্জন করবে? সেটার জন্য আল্লাহ তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছেন। সেটা হলো সালাহ সওম, হজ্ব, যাকাত এগুলো। এগুলোর মাধ্যমে তার চরিত্রে কিছু গুন অর্জিত হবে। তারপর সে আল্লাহর সত্যদীন পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করে মানবসমাজ থেকে অন্যায় অশান্তি দূর করতে পারবে যেটা উম্মতে মুহাম্মদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ৪/৫/৮

অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, যাকাত দীনের মূল কাজ নয়, বরং পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটা ট্রেণিং।

ইসলাম কী বলে?
যাকাতকে জিহাদের ট্রেনিং বলা পবিত্র কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যার শামিল। কারণ আল্লাহপাক ও তাঁর রাসুল সাঃ কোথাও বলেননি যে যাকাত জিহাদের ট্রেণিং। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَأَقِيمُواْ الصَّلاَةَ وَآتُواْ الزَّكَاةَ
তোমরা সালাত কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান কর। [সূরা বাকারা : ১১০

উক্ত আয়াতসহ অসংখ্য আয়াতে মহান রব বলেছেন, যাকাত আদায় করতে বা যাকাত ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো আয়াত বা হাদিসে যযাকাতকে জিহাদের ট্রেণিং বলা হয়নি। সুতরাং কুরআনের শর্তহীন আয়াতকে শর্তযুক্ত করা অপব্যাখ্যার শামিল। অতএব কোনো আয়াতের মনগড়া উক্তি করা এক জঘন্যতম অন্যায়। যার কারণে হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন,
مَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِرَأْيِهِ فَأَصَابَ فَقَدْ أَخْطَأَ
যে ব্যক্তি নিজের মত অনুযায়ী কুরআন প্রসঙ্গে কথা বলে, সে সঠিক বললেও অপরাধ করলো (এবং সঠিক ব্যাখ্যা করলো-সেও ভুল করলো)। -জামে তিরমিযি, হাদিস : ২৯৫২

যাকাত কীসের জন্য?
যাকাত মানুষের গুনাহমুক্তি ও আত্মশুদ্ধির অন্যতম একটি মাধ্যম। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّیْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَیْهِمْ ؕ اِنَّ صَلٰوتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ
তাদের সম্পদ থেকে সদকা বা যাকাত গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দুআ করবেন। আপনার দুআ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। [সূরা তাওবা : ১০৩]

উক্ত আয়াতে যাকাতের দু’টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। এক. যাকাতের মাধ্যমে মন্দচরিত্র ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের পক্ষে সহায়ক হয়। দুই. সৎকাজে বরকত ও উন্নতি লাভ হয়। সুতরাং জানা গেলো, যাকাত কোনো ট্রেণিং নয়, বরং আত্মশুদ্ধির জন্য যাকাতের আইন। শুধু তাই নয়, বরং সম্পদেরও পবিত্র করে যাকাত, সাদাকা। হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত কায়িস ইবনে আবু গারাযাহ রা. সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
يَا مَعْشَرَ التُّجَّارِ، إِنَّ الْبَيْعَ يَحْضُرُهُ اللَّغْوُ وَالْحَلْفُ، فَشُوبُوهُ بِالصَّدَقَةِ
হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়! ব্যবসায়িক জাজে বেহুদা কথাবার্তা এবং অপ্রয়োজনীয় শপথ হয়ে থাকে। সুতরাং তোমরা ব্যবসার পাশাপাশি সাদাকাহ করে তাকে ত্রুটিমুক্ত পবিত্র করো। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩৩২৬

অথচ হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, ‘যাকাত সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচারক প্রতিষ্ঠার একটা ট্রেণিং’ এখন আপনারাই বলুন হেযবুত তওহীদ কী আয়াতের অপব্যাখ্যা করেনি?

মানবতার কাজ না করে যাকাত দিলেও কী জাহান্নামে যেতে হবে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, মানবতার শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের মূল কাজ। এ কাজ না করে নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত কোনটাই কবুল হবে না। দেখুন তারা কী বলে-
আল্লাহর লা’নতের নির্মম শাস্তি সত্ত্বেও এই জাতি তওবা করে তওহীদে, সিরাতুল মুস্তাকিমে, দ্বীন কায়েমায় ফিরে না এসে, নির্বোধের মত নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত হাজার রকমের নফল ইবাদত করে যাচ্ছে আর ভাবছে তাদের জন্য জান্নাতের দরজায় লাল কার্পেট বিছিয়ে রাখা হয়েছে। -ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে? পৃ. ৬

ইসলাম কী বলে?
ইসলামের মূল কাজ শান্তি প্রতিষ্ঠা করা নয়, বরং আল্লাহপাকের ইবাদত করাই মূল। এই ইবাদতের মধ্যে অন্যতম ইবাদত হলো যাকাত দেওয়া। যারা এই ইবাদত করবে, তাদের জন্য কিয়ামতে জাহান্নাম নয়, জান্নাত দেওয়া হবে। মহান রব বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ
নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকাজ করেছে, নামায প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং যাকাত দান করেছে, তাদের জন্যে তাদের পুরষ্কার তাদের পালনকর্তার কছে রয়েছে। তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। [সুরা বাকারা : ২৭৭]

হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আবু আইয়ূব রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَجُلاً قَالَ لِلنَّبِيِّ ﷺ : أَخْبِرْنِي بِعَمَلٍ يُدْخِلُنِي الجَنَّةَ قَالَ تَعْبُدُ اللهَ وَلاَ تُشْرِكُ بِهِ شَيْئاً وَتُقِيمُ الصَّلاَةَ وَتُؤْتِي الزَّكَاةَ وَتَصِلُ الرَّحِمَ
একটি লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলল, আমাকে এমন একটি আমল বলুন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি বললেন, আল্লাহর বন্দেগী করবে, আর তাঁর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার স্থির করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখবে। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১৩৯৬

আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ أَعْرَابِياً أَتَى النَّبِيَّ ﷺ فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللهِ دُلَّنِي عَلَى عَمَلٍ إِذَا عَمِلْتُهُ دَخَلْتُ الجَنَّةَ قَالَ تَعْبُدُ اللهَ لاَ تُشْرِكُ بِهِ شَيْئاً وَتُقِيمُ الصَّلاَةَ وَتُؤتِي الزَّكَاةَ المَفْرُوضَةَ وَتَصُومُ رَمَضَانَ قَالَ : وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لاَ أَزِيدُ عَلَى هَذَا فَلَمَّا وَلَّى قَالَ النَّبِيُّ ﷺمَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الجَنَّةِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى هَذَا
এক বেদুঈন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে নিবেদন করল, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে এমন এক আমলের কথা বলে দিন, যার উপর আমল করলে, আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। তিনি বললেন, আল্লাহর ইবাদত করবে ও তাঁর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার স্থির করবে না। নামায কায়েম করবে, ফরয যাকাত আদায় করবে ও রমযানের রোযা পালন করবে। সে বলল, সেই মহান সত্তার শপথ! যাঁর হাতে আমার জীবন আছে, আমি এর চেয়ে বেশী করব না। তারপর যখন সে লোকটা পিঠ ফিরে চলতে লাগল, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি জান্নাতবাসীদের কোন লোক দেখতে আগ্রহী, সে যেন এই লোকটিকে দেখে। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১২৯৭

বুঝা গেলো, ইসলামে ইবাদত করলে সে জান্নাতে যাবে। তবে মানুষের প্রতি দয়াদ্র হওয়া বা তাদের কষ্ট দূর করলে সেও কিয়ামতের পেরেসানি থেকে বাঁচবে। কিন্তু এটা না করলে যাকাত দিলেও জাহান্নামে যেতে হবে কথাটা ইসলামের বিকৃতি নয় কী?

ঈমানদার হওয়ার জন্য যাকাত কী মূল বিষয় নয়?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদী ঈমানদার হওয়ারপন্থা নয়, বরং ঈমানদার হওয়ার পন্থা হলো, জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করা। দেখুন তারা কী বলে-
নিজেদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে সংগ্রাম করার মধ্যে দিয়েই মোমেন হতে হবে, অন্য কোন পন্থা আল্লাহ দেননি। এই মুমিনের জন্য নামাজ রোজা, হজ্ব, যাকাতসহ ইসলামের অন্যান্য সব আমল। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ১১৩

ইসলাম কী বলে?
মুমিনের গুনাবলী কী কী তা সবিস্তারে কুরআন-সুন্নাহ’য় বলা হয়েছে। সেই গুনাবলীর মধ্যে যাকাত প্রদান অন্যতম। মহান রব বলেন-
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاء ذَلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْعَادُونَ وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ أُوْلَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
নিশ্চয়ই সফলতা অর্জন করেছে মুমিনরা; যারা তাদের নামাযে আন্তরিকভাবে বিনীত। যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে। যারা যাকাত সম্পাদনকারী। যারা নিজ লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে; নিজেদের  স্ত্রী ও মালিকানাধীন দাসীদের ছাড়া অন্য সকলের থেকে, কেননা এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। তবে কেউ এছাড়া অন্য কিছু কামনা করলে তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী। এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। এবং যারা নিজেদের নামাযের পরিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করে। এরাই হল সেই ওয়ারিশ, যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের মীরাস লাভ করবে। তারা তাতে সর্বদা থাকবে। [সূরা মুমিনূন : ১-১১]

আল্লাহপাক অন্যত্র বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ أُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَّهُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ার দেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে। সে সমস্ত লোক যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। তারাই হল সত্যিকার ঈমানদার! তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় পরওয়ারদেগারের নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রুযী। [সুরা আনফাল : ২-৪]

উল্লিখিত আয়াত সমূহ থেকে এবং অন্যান্য আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, সত্যিকারের ঈমানদারে গুনাবলীর মধ্যে যাকাতও শামিল। এরপরও কী বলা যায় যে, যাকাত ইত্যাদীর মাধ্যমে ঈমানদার হওয়ার পন্থা আল্লাহপাক দেননি?

যাকাতে গুরুত্ব দেওয়া কী বিকৃত ইসলামের কাজ?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, যাকাত ইসলামের মৌলিক আমলের অন্তুর্ভূক্ত নয়। তাই এটাকে গুরুত্ব দেওয়া আসল ইসলামের কাজ নয়। তারা লিখেছে-

বিকৃত এসলামে নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত আত্মার পরিচ্ছন্নতার জন্য নানারকম ঘষামাজা আধ্যাত্মিক উন্নতির উপর গুরুত্ব প্রাধান্য দেওয়া হলো। কারণ এরা ঐ এবাদত উপাসনা নিয়ে যত বেশি ব্যস্ত থাকবে ব্রিটিশরা তত নিরাপদ থাকবে। -এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ১১২

ইসলাম কী বলে?
যাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন ও ইসলামের স্তম্ভ। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হল নামাজ ও যাকাত। কুরআন মজীদে বহু স্থানে সালাত-যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ সওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَیْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ
তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। [সূরা বাকারা : ১১০]

وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ
তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার। [সুরা নূর : ৫৬]

وَالْمُقِيمِينَ الصَّلاَةَ وَالْمُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالْمُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ أُوْلَـئِكَ سَنُؤْتِيهِمْ أَجْرًا عَظِيمًا
এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দিব। [সুরা নিসা : ১৬২]

এছাড়া কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, সালাত ও যাকাতের পাবন্দী ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রশ্নই অবান্তর। কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে, যেখানে খাঁটি মু’মিনের গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে সেখানে সালাত-যাকাতের কথা এসেছে অপরিহার্যভাবে। উপরন্তু হযরত মুআয রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ আমাকে (ইয়ামানের শাসকরূপে) পাঠাবার সময় বলেছিলেন,
أفَأعْلِمْهُمْ أنَّ اللهَ قَدِ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤخَذُ مِنْ أغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ فَإنْ هُمْ أطَاعُوا لِذَلِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أمْوَالِهِمْ
তাদেরকে জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তাদের সম্পদের ওপর সাদকাহ (যাকাত) ফরয করেছেন। তাদের মধ্যে যারা সম্পদশালী তাদের থেকে যাকাত উসূল করে যারা দরিদ্র তাদের মাঝে বিতরণ করা হবে। যদি তারা এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তুমি (যাকাত নেওয়ার সময়) তাদের উৎকৃষ্ট মাল নেওয়া থেকে দূরে থাকবে। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১৪৯৬

হযরত ইবনু উমার রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাঃ বলের,
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ؛ فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إلَّا بِحَقِّ الْإِسْلَامِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ تَعَالَى
আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে লড়াই করতে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। আর তারা সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়। যদি তারা এরূপ করে তবে তারা আমার হাত থেকে নিজেদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে নেবে, অবশ্য ইসলামের হক যদি তা দাবী করে তবে আলাদা কথা; আর তাদের হিসাব নেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর উপর ন্যস্ত। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ২৫

হযরত আবু হুরাইরাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
لَمَّا تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَاسْتُخْلِفَ أَبُو بَكْرٍ بَعْدَهُ كَفَرَ مَنْ كَفَرَ مِنَ الْعَرَبِ فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ لأَبِي بَكْرٍ كَيْفَ تُقَاتِلُ النَّاسَ وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَمَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ عَصَمَ مِنِّي مَالَهُ وَنَفْسَهُ إِلاَّ بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو بَكْرٍ وَاللَّهِ لأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الزَّكَاةِ وَالصَّلاَةِ فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ الْمَالِ وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُونِي عِقَالاً كَانُوا يُؤَدُّونَهُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهِ فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فَوَاللَّهِ مَا هُوَ إِلاَّ أَنْ رَأَيْتُ أَنَّ اللَّهَ قَدْ شَرَحَ صَدْرَ أَبِي بَكْرٍ لِلْقِتَالِ فَعَرَفْتُ أَنَّهُ الْحَقُّ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মৃত্যুর পর আবূ বকর (রাযিঃ) যখন খলীফা নির্বাচিত হন, তখন আরবের কিছু সংখ্যক লোক কাফির হয়ে যায়। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিঃ) আবূ বকর (রাযিঃ)-কে বললেন, আপনি এদের বিরুদ্ধে কিভাবে অস্ত্ৰধারণ করবেন, অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষ যে পর্যন্ত না “আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত আর কোন প্ৰভু নেই” এই কথার স্বীকৃতি দিবে সেই পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি। আর যে ব্যক্তি বললো, “আল্লাহ ব্যতীত আর কোন প্ৰভু নেই” সে আমার থেকে তার মাল ও রক্ত (জীবন) নিরাপদ করে নিল। তবে ইসলামের অধিকার সম্পর্কে ভিন্ন কথা। আর তাদের প্রকৃত হিসাব-নিকাশ রয়েছে আল্লাহ তা’আলার দায়িত্বে। আবূ বকর (রাযিঃ) বললেনঃ আল্লাহর শপথ নামায ও যাকাতের মধ্যে যে ব্যক্তি পার্থক্য করে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবোই। কেননা যাকাত সম্পদের হাক্ক। কেউ উটের একটি রশি দিতেও যদি অস্বীকার করে, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে দিত, আল্লাহর কসম! আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবোই। তারপর উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি দেখতে পেলাম আল্লাহ যেন যুদ্ধের জন্য আবূ বকরের অন্তর উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অতঃপর আমি বুঝতে পারলাম যে, তার সিদ্ধান্তই যথার্থ। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ৬৯২৪

উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসসহ অসংখ্য দলীল রয়েছে যাকাতের গুরুত্বের উপর। যে যাকাত ইসলামে ফরজ এবং ৫ স্তম্ভের একটি, যার অস্বীকারদের বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম জিহাদ করেছেন, সেই যাকাতে গুরুত্ব দেওয়া বিকৃত ইসলামের কাজ? কতবড় জঘন্যতা! ভাবা যায়? তারা কী শুধু এটা বলেই ক্ষ্যান্ত হয়েছে? না, বরং যাকাতে গুরুত্ব দেওয়া খ্রিস্টানদের শিক্ষা বলেও তারা মন্তব্য করেছে। দেখুন তারা কী বলে-

পাশ্চাত্য প্রভুদের আরবি শিক্ষিত পণ্ডিতরা এই নতুন মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবস্তু নির্ধারণ করলেন…বিশেষভাবে স্থান দেওয়া হল অপ্রয়োজনীয় কিন্তু বিতর্কিত বিষয়গুলির। নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত, ফারাজের, বিবি তালাকের, কাপড়-চোপড়ের, দাড়ি-টুপির অবিশ্বাস্য চুলচেরা বিশ্লেষণ ও বিতর্কিত বিষয়ের বিচার। উদ্দেশ্য হলো এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা যেন  ঐ ছোটখাটো বিষয়বস্তুর মধ্যেই সীমিত থাকে, ওর উর্ধ্বে যেন উঠতে না পারে। ব্যক্তিগত এবাদতের সুক্ষতম প্রক্রিয়াও এ পাঠ্যবস্তু  থেকে বাদ দেয়া গেল না, কিন্তু জাতীয় ব্যাপারে মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে কোণঠাসা করে দেয়া হলো, সম্ভাব হলে একেবারে বাদ দেওয়া হল। -শিক্ষাব্যবস্থা, পৃ. ২৩

এ জাতির লোকজন ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর উপাসনা, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, দান-খয়রাত ইত্যাদি নানা উপাসনা কোরতে থাকবে এবং জাতীয় জীবনে ব্রিটিশ প্রভুদের আদেশ পালন কোরতে থাকবে; তাদের অধিকার ও শাসন দৃঢ় ও স্থায়ী হবে। এই উদ্দেশ্যে ঐ বিকৃত এসলামে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, আত্মার পরিচ্ছন্নতার জন্য নানারকম ঘষামাজা, আধ্যাত্মিক উন্নতির ওপর গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেয়া হোল। কারণ এরা ঐ এবাদত, উপসনা নিয়ে যত বেশী ব্যস্ত থাকবে ব্রিটিশরা তত নিরাপদ হবে। -যামানার এমামের পত্রাবলী, পৃ. ১০

১. যাকাতে গুরুত্ব দেওয়া খ্রিস্টানদের শিক্ষা।
২. যাকাতের উপর গুরুত্ব দিলে খ্রিস্টানদের সুবিধা।

ইসলাম কী বলে?
উপরোল্লেখিত আয়াত ও হাদিসগুলো থেকে বুঝতে পারলাম, যাকাতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া আল্লাহপাক ও তাঁর রাসুল সাঃ এবং সাহাবায়ে কেরামের শিক্ষা। অথচ হেযবুত তওহীদ দাবি করে বসেছে এটা খ্রিস্টানদের শিক্ষা। এখন আপনারাই বলুন, হেযবুত তওহীদ মুসলমান নাকি সিদ্দিকে আকবারের রা. যামানার মুনকিরিনে যাকাতের পেতাত্মা?

যাকাত না দিলেও জান্নাতে যাওয়া যাবে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, শুধুমাত্র তাওহীদে বিশ্বাস থাকলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদী কিছু না থাকলেও চলবে। তারা লিখেছে-

বিশ্বনবী এ কথাটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন এই বলে যে, আল্লাহর সাথে তাঁর বান্দার চুক্তি (Contract) এই যে, বান্দা তাঁর পক্ষ থেকে যদি এই শর্ত পালন করে যে, সে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহ অর্থাৎ বিধাতা বলে স্বীকার করবে না-তবে আল্লাহও তাঁর পক্ষ থেকে শর্ত পালন করবেন যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। [হাদিস-মুয়াজ (রা.) থেকে বোখারী, মুসলিম, মেশকাত]। এখানে অন্য কোন কাজের (আমলের) শর্ত নেই। -আকিদা, পৃ. ৭

শত নির্যাতন নিপীড়ন বিদ্রূপ অপমান উপেক্ষা করে, খেয়ে না খেয়ে, গাছের লতা-পাতা খেয়ে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। এই সময় যেসব সাহাবী ইন্তেকাল করেন তারা ইসলাম বলতে কি পেয়েছিলেন? তার নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত ঈদ কোরবানি কিছুই পেয়েছিলেন কি? তারা পেয়েছেন শুধুমাত্র তাওহীদ এবং বলার অপেক্ষা রাখেনা তাওহীদই তাদের সফলকাম হয়ে জান্নাতে প্রবেশের জন্য যথেষ্ট ছিল। -তওহীদ জান্নাতের চাবি, পৃ. ১০

অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদী না করলেও শুধু তাওহীদে বিশ্বাস থাকলেই সে জান্নাতে যাবে, জাগান্নামেই যাবেই না।

ইসলাম কী বলে?
যাকাত না দিলো আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে তাদেরকে যে মর্মন্তুদ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে তা-ও কুরআন মজীদে বলে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَلاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُواْ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاللّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত। -সূরা আলইমরান : ১৮০

হাদীস শরীফে এসেছে, আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাঃ বলেছেন,
مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالاً، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ، لَهُ زَبِيبَتَانِ، يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ ـ يَعْنِي شِدْقَيْهِ ـ ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ، أَنَا كَنْزُكَ
যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার যাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন তা বিষধর স্বর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ঐ ধন, আমিই তোমরা পুঞ্জিভূত সম্পদ।’ -সহীহ বুখারী, হাদিস : ১৪০৩

হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসুল সাঃ বলেন,
مَانِعُ الزَّكَاةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي النَّارِ
যাকাত আদায় করে না এমন ব্যক্তি কিয়ামতের দিন জাহান্নামে যাবে। -মু’জামে সাগীর, হাদিস : ৯৩৫,

উপরোক্ত হাদিস ও আয়াত দ্বারা জানা গেলো, যাকাত আদায় না করলে সে জাহান্নামে যাবে। অথচ হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, যাকাত না দিলেও জান্নাতে যেতে পারবে। এটা কী কুফরী মন্তব্য নয়?

রোযা প্রসঙ্গ:
রোযা হলো ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও ফরজ বিধান। কোনো কারণ ছাড়া রোযা পরিত্যাগ করা সুস্পষ্ট কবীরা গুনাহ। যার ফলে রোযা পরিত্যাগকারীকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এটাই এসেছে কুরআন এবং হাদিসে। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এই রোযার ব্যাপারে বেশ কয়েকটা মন্তব্য করেছে। যা দেখলে শরীর শিউরে উঠবে।  চলুন একনজরে রোযা সম্পর্কে তাদের মন্তব্যগুলো দেখা যাক।
১. রোজা নষ্ট হয়ে গেছে বহু আগে।
২. রোযা কোনো ইবাদত নয়।
৩. রোযা হলো জিহাদের ট্রেনিং।
৪. জিহাদ না করে রোযা রেখে কোনো ফায়দা নেই।
৫. রোযা কোনো গুরুত্বপূর্ণ নয়।
৬. রোযার উপর গুরুত্ব দেওয়া বিকৃত ইসলামের কাজ।
৭. রোজা না রাখলে কোনো শাস্তি নেই।
চলুন এবার প্রত্যেকটা বিষয়ে প্রমাণসহ দেখা যাক।

আসল রোজা নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই:
রোজা নষ্ট হয়ে গেছে বহু আগে। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ১০

সওমের দ্বারা যে আল্লাহর হুকুম মান্য করা শিখবে না, তার সওম রাখা না রাখা সমান কথা। বর্তমানে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে আজ এটাই হচ্ছে। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ১৬

রোযা কোনো ইবাদত নয়:
তারা তাদের ওয়াজে নসিহতে মানুষকে কেবল নামাজ রোজা হজ্ব ইত্যাদি করার জন্য উপদেশ দেন। এগুলোকে তারা এবাদত ধর্মকর্ম মনে করেন। -শিক্ষাব্যবস্থা, পৃ. ৯

নামাজ রোজা হজ্ব পূজা প্রার্থনা তীর্থযাত্রা মানুষের মূল এবাদত নয়। মানবজাতী যেন সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে এ লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম, প্রকৃত এবাদত।’-জঙ্গিবাদ সংকট, পৃ. ৫৬

এখন মোসলেম দাবিদার জাতির সামনে থেকে দীনের এই উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে, তারা কেবল নামাজ, রোজা, হজ্ব করাকেই এবাদত হিসাবে ধোরে নিয়ে ভালো মানুষ সবার জন্য জোর প্রচেষ্টা কোরছে। -এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ৮৯

এবাদত হচ্ছে আল্লাহ খেলাফত করা। কিন্তু ভুল করে নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত ইত্যাদিকে এবাদত বলে মনে করা হচ্ছে। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ৯

প্রকৃত ইসলামের জীবনব্যবস্থার উদ্দেশ্য মানব জীবনের নিরাপত্তা সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি, আর বর্তমান ইসলামের উদ্দেশ্য ওসব কিছুই না বরং সময়মত নামাজ পড়া, যাকাত দেওয়া, হজ্ব করা, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, লম্বা পোশাক ও খাটো পায়জামা পরা ইত্যাদি।
সূত্র: হেযবুত তওহীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পৃ:৭।

রোযা হলো জিহাদের ট্রেনিং:
সওম তাদেরই হবে যারা মানবতার মুক্তির জন্য সংগ্রামের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হবে। তাদের জাতির সামগ্রিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতিটি সদস্যের ব্যক্তিগত চরিত্রের প্রশিক্ষণ হল সওম। যারা ঐ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ঐক্যবন্ধ নয় তাদের সওম অর্থহীন। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ১১

সেই সত্য দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্ব উপায়ে প্রচেষ্টা চালানো প্রত্যেক মো’মিনের অবশ্য কর্তব্য, ফরদ। এই দীন প্রতিষ্ঠা করতে হলে মো’মেনের অবশ্যই কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুন লাগবে। সেই চারিত্রিক, মানসিক আত্মিক গুণ বৈশিষ্ট্য (Attributes) এটা যে সে অর্জন করবে কোথেকে অর্জন করবে? সেটার জন্য আল্লাহ তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছেন। সেটা হলো সালাহ সওম,হজ্ব,যাকাত এগুলো। এগুলোর মাধ্যমে তার চরিত্রে কিছু গুন অর্জিত হবে। তারপর সে আল্লাহর সত্যদীন পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করে মানবসমাজ থেকে অন্যায় অশান্তি দূর করতে পারবে যেটা উম্মতে মুহাম্মদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ৪/৫/৮

নিজেদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে সংগ্রাম করার মধ্যে দিয়েই মোমেন হতে হবে, অন্য কোন পন্থা আল্লাহ দেননি। এই মুমিনের জন্য নামাজ রোজা, হজ্ব, যাকাতসহ ইসলামের অন্যান্য সব আমল। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃ. ১১৩

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানেই হচ্ছে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। যারা এই অঙ্গীকার করবে তাদের চরিত্র অর্জনের জন্য আল্লাহ নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত এর হুকুম দিয়েছেন। -মহাসত্যের আহ্বান,  পৃ. ১০৯

আল্লাহ সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষকে অশান্তির আগুনে জ্বলতে দেখেও যারা কাপুরুষের মতো করে লুকায় আর এবাদত মনে পড়ে রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ে, রোজা রাখে, হজ্ব করে, নানা উপাসনায় মশগুল থাকে তাদেরকে আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
সূত্র: ধর্মবিশ্বাস পৃষ্ঠা -৩

কেউ যদি নামাজ রোজা হজ্ব পূজা-অর্চনা উপাসনা ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত ব্যপৃত থাকে, কিন্তু তার ভিতরে মানবতার গুণাবলী না থাকে তাহলে সে প্রকৃত ধার্মিক নয়, আল্লাহর প্রকৃত উপাসক নয়।
সূত্র: ধর্ম বিশ্বাস পৃষ্ঠা-১৪

জিহাদ না করে রোযা রেখে কোনো ফায়দা নেই:
আল্লাহর লা’নতের নির্মম শাস্তি সত্ত্বেও এই জাতি তওবা করে তওহীদে, সিরাতুল মুস্তাকিমে, দ্বীন কায়েমায় ফিরে না এসে, নির্বোধের মত নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত হাজার রকমের নফল ইবাদত করে যাচ্ছে আর ভাবছে তাদের জন্য জান্নাতের দরজায় লাল কার্পেট বিছিয়ে রাখা হয়েছে। -ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে? পৃ. ৬

রোযা কোনো গুরুত্বপূর্ণ নয়:
এই ধর্মের পণ্ডিতদের আলেমদের কাছে দীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নামাজ-রোজা দাড়ি, তারাবি, টুপি,টাখনু, মিলাদ মেসওয়াক ইত্যাদি। আর জেহাদ একেবারে নিষ্প্রয়োজন। এজন্য তাদের এ ইসলাম একটি মৃত, আল্লাহর রাসুলের ইসলামের বিপরীতমুখী ধর্ম। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ১৩

রোযার উপর গুরুত্ব দেওয়া বিকৃত ইসলামের কাজ:
বিকৃত এসলামে নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত আত্মার পরিচ্ছন্নতার জন্য নানারকম ঘষামাজা আধ্যাত্মিক উন্নতির উপর গুরুত্ব প্রাধান্য দেওয়া হলো। কারণ এরা ঐ এবাদত উপাসনা নিয়ে যত বেশি ব্যস্ত থাকবে ব্রিটিশরা তত নিরাপদ থাকবে। -এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ১১২

রোজা না রাখলে কোনো শাস্তি নেই:
আল্লাহ কোথাও বলেন নাই যে, সালাত (নামাজ) ত্যাগ করলে বা সওম (রোজা) ত্যাগ করলে বা হজ্ব ত্যাগ করলে বা অন্য যে কোন এবাদত ত্যাগ করলে কঠিন শাস্তি দিয়ে এই দীন থেকেই বহিস্কৃত করবেন শুধু জেহাদ (সংগ্রাম) এবং আল্লাহর রাস্তায় (জেহাদে) ব্যয় ছাড়া। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ১৫

‘আল্লাহ মানুষকে কষ্ট দিতে চান না, পরিশুদ্ধ করতে চান। তাই তিনি ইসলামের ভিতরে যে কোন বাড়াবাড়ি কে হারাম করেছেন। সওম না রাখার জন্য তিনি কাউকে জাহান্নামে দিবেন বা শাস্তি দিবেন এমন কথা কোর’আনে কোথাও নেই। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ১২

অর্থাৎ তাদের উপরোক্ত বক্তব্যগুলো দিয়ে তারা বুঝাতে চেয়েছে, রোযা কোনো ইবাদত নয়, এটা জিহাদের ট্রেণিং, জিহাদ এবং মানবতার কাজ না করলে রোযা রেখে লাভ নেই, রোযা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় এবং রোযা না রাখলে কোনো শাস্তিও নেই।

ইসলাম কি বলে?
রোযা ইসলামের ৫ স্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। হযরত ইবনে ওমর রা. রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ  وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَان
ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল,নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া, হজ্জ আদায় করা এবং রমজান মাসে রোজা পালন করা। -সহীহ বুখারী, হাদিস : ৮

রোযা যে ফরজ, এর দলীল পবিত্র কুরআনেই রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّها الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার। [সূরা বাক্বারাহ : ১৮৩]

উক্ত আয়াত ও হাদিমে সুস্পষ্টভাবে রোযাকে ইসলামে ফরজ করা হয়েছে এবং ইসলামের একটি স্তম্ভ বলা হয়েছে। এরপরও কী এ কথা বলা যায় যে, রোযার উপর গুরুত্ব দেওয়া বিকৃত ইসলামের কাজ? উপরন্তু রোযা এমন একটি ফরজ বিষয় কোন ওজর ছাড়া পরিত্যাগ করলে ও এ ফরজ বিধানকে ইবাদত বলে অস্বীকার করলে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে এটাও আল্লাহ তা’আলা জানিয়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَن يَعْصِ اللّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُّهِينٌ
যে কেউ আল্লাহ ও রসূলের অবাধ্যতা করে এবং তার সীমা অতিক্রম করে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সে সেখানে চিরকাল থাকবে। তার জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। [সূরা নিস : ১৪]

উপরন্তু নবজি সা: বলেন,
بينا أنا نائمٌ إذ أتاني رجلانِ فأخذا بِضَبعيَّ فأتيا بي جبلًا وعرًا فقالا لي اصعَد فقلتُ إنِّي لا أطيقُهُ فقالا إنّا سنسهِّلُهُ لكَ فصعِدتُ حتّى إذا كنتُ في سَواءِ الجبلِ إذا أنا بأصواتٍ شديدةٍ قلتُ ما هذهِ الأصواتُ قالوا هذا عُوِيُّ أهلِ النّارِ ثمَّ انطلقَ بي فإذا أنا بقومٍ معلَّقينَ بعراقيبِهم مشقَّقةٍ أشداقُهم تسيلُ أشداقُهم دمًا قالَ قلتُ من هؤلاءِ قالَ هؤلاءِ الَّذينَ يُفطِرونَ قبلَ تحلَّةِ صومِهم
একবার আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এ সময় দুইজন মানুষ এসে আমার দুইবাহু ধরে আমাকে দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে গেলো। সেখানে নিয়ে তারা আমাকে বললঃ পাহাড়ে উঠুন।আমি বললামঃ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা বললঃ আমরা আপনার জন্য সহজ করে দিচ্ছি।তাদের আশ্বাস পেয়ে আমি উঠতে লাগলাম এবং পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত উঠে গেলাম। সেখানে প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এটা কিসের শব্দ? তারা বললঃ এটা জাহান্নামী লোকদের চিৎকার।
এরপর তারা আমাকে এমন কিছু লোকদের কাছে নিয়ে এল যাদেরকে পায়ের টাখনুতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের গাল ছিন্নবিন্ন, তা হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এরা কারা? তিনি বললেনঃ এরা হচ্ছে এমন রোজাদার যারা রোজা পূর্ণের আগে ইফতার করত। -সহীহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদিস : ১৯৮৬

প্রিয় ভাই, এই শাস্তি হলো তাদের তার জন্য যারা রোজা রেখেছে; কিন্তু ইফতারের সময় হওয়ার পূর্বে ইচ্ছাকৃতভাবে ইফতার করে ফেলেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি মূলত রোজা-ই রাখেনি তার অবস্থা কি হতে পারে।

সুতরাং রোযা না রাখলে জাহান্নামে যেতে হবে এটাই চুড়ান্ত। মুর্খ ও ইসলাম বিদ্বেষীদের কথায় কান না দিয়ে চলুন ইসলামের পরিপূর্ণ বিধান পালনে সচেষ্ট হই। যারা রোযাকে বিকৃত করে, তাদের থেকে দূরে থাকি।

হজ্ব প্রসঙ্গ:
হজ্ব পরম করুণাময় আল্লাহর ইবাদত। বান্দার প্রতি স্রষ্টার হক্ব। ঈমানের আলোকিত নিদর্শন। সামর্থবানদের জন্য এ হজ্ব ফরজ। পাশাপাশি হজ্ব ইসলামের ৫ স্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যে হজ্বের আবশ্যকীয়তা সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে নববীতে এবং সাহাবায়ে কেরাম রা. তাবেয়ীনদের কেরাম রহি. তাবে তাবেয়ীনদের রহি. আয়েম্মায়ে মুজতাহিদীন রহি. সহ সকল মুসলিম উম্মাহ শত শত বছর আলোচনা করে আসছেন। কিন্তু হেযবুত তওহীদ সে হজ্ব নিয়ে যতবড় স্পর্ধা দেখিয়েছে, তা শয়তানকেও হার মানাবে। চলুন তাদের বক্তব্যগুলো এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা হজ্বের ব্যাপারে বেশ কয়েকটি ঈমানবিধ্বংসী কথা দাবি করেছে-
১. হজ্ব কোনো ইবাদত নয়?
২. হজ্ব আধ্যাত্মিক বিষয় নয়:
৩. আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য এত দূরে কষ্ট করে যেতে হবে কেন?
৪. হজ্ব হলো জিহাদের ট্রেনিং:
৫. হজ্ব মুসলিম প্রতিনিধিদের বার্ষিক সম্মেলন:
৬. হজ্বের উপর গুরুত্ব দেওয়া বিকৃত ইসলামের কাজ:
৭. জিহাদ ও মানবতার কাজ  না করে হজ্ব করে ফায়দা নেই:
৮. পুরো দুনিয়ায় খেলাফত কায়েম হলেই কী হজ্ব করতে হবে:
৯. হজ্ব না করলে আল্লাহ জাহান্নামে দেবেন না:

চলুন তাদের বক্তব্যগুলোর ধারাবাহিক জবাব আলোচনা করা যাক।

হজ্ব কোনো ইবাদত নয়?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
ইসলামে হজ্ব এতটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কিন্তু হেযবুত তওহীদ হজ্বকে ইবাদত হিসাবে মানতেই নারাজ। তাদের দাবি হলো-

‘এবাদত হচ্ছে আল্লাহ খেলাফত করা। কিন্তু ভুল করে নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত ইত্যাদিকে এবাদত বলে মনে করা হচ্ছে। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃষ্ঠা. ৯

‘তারা তাদের ওয়াজে নসিহতে মানুষকে কেবল নামাজ রোজা হজ্ব ইত্যাদি করার জন্য উপদেশ দেন। এগুলোকে তারা এবাদত ধর্মকর্ম মনে করেন। -শিক্ষাব্যবস্থা, পৃষ্ঠা. ৯

‘নামাজ রোজা হজ্ব পূজা প্রার্থনা তীর্থযাত্রা মানুষের মূল এবাদত নয়। মানবজাতী যেন সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে এ লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম, প্রকৃত এবাদত। -জঙ্গিবাদ সংকট, পৃ. ৫৬

‘এখন মোসলেম দাবিদার জাতির সামনে থেকে দীনের এই উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে, তারা কেবল নামাজ, রোজা, হজ্বব করাকেই এবাদত হিসাবে ধোরে নিয়ে ভালো মানুষ সবার জন্য জোর প্রচেষ্টা কোরছে। -এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ৮৯

অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, হজ্ব কোনো ইবাদত নয়। হজ্বকে ইবাদত মনে করা ভূল।

ইসলাম কী বলে?
হজ্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল বা ইবাদত। যার প্রমাণ হাদিস থেকেই পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা রা. হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
سُئِلَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم  أَىُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ قَالَ إِيْمَانٌ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ قِيْلَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ جِهَادٌ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ قِيْلَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ حَجٌّ مَبْرُوْرٌ
রাসূল সা. কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন আমলটি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘শ্রেষ্ঠ আমল হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনা। বলা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কি? তিনি বললেন, কবুল হজ্জ। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১৫১৯

উক্ত হাদিসে হজ্বকেও ঈমান ও জিহাদের মত উত্তম আমল বা ইবাদত বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে। এটা হেযবুত তওহীদও লিখেছে-
ইসলামের আমল কি? অবশ্যই নামায, যাকাত হজ্ব,রোজা ইত্যাদি, আরও বহুবিধ ফরজ ওয়াজিব সুন্নত নফল ইত্যাদি। -তাকওয়া ও হেদায়াহ, পৃ. ৯

সুতরাং তাদের বক্তব্য থেকেও জানা গেলো, হজ্বও একটি ইসলামের আমল বা ইবাদত। এরপরও যদি তারা হজ্বকে ইবাদত মনে না করে তবে তারা মিথ্যুক।

হজ্ব কী আধ্যাত্মিক বিষয় নয়?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের আনেকটা জঘণ্য উক্তি হলো- ‘ইসলামের অন্য সব কাজের মতোই আজ হজ্ব সম্বন্ধেও এই জাতির আকীদা বিকৃত হয়ে গেছে। এই বিকৃত আকীদায় হজ্ব আজ সম্পূর্ণরূপে একটি আধ্যাত্মিক ব্যাপার, আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করার পথ। প্রথম প্রশ্ন হোচ্ছে- আল্লাহ সর্বত্র আছেন, সৃষ্টির প্রতি অনু-পরামাণুতে আছেন, তবে তাঁকে ডাকতে, তাঁর সান্নিধ্যের জন্য এত কষ্ট কোরে দূরে যেতে হবে কেন’? -হিযবুত তাওহীদের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত ‘মোসলেম উম্মাহর বার্ষিক মহাসম্মেলন’ প্রবন্ধ-১ম প্যারা।

অর্থাৎ তারা বলতে চায়, ১. হজ্ব কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাপার নয়। ২. আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য এত দূরে কষ্ট করে কেন যেতে হবে?

ইসলাম কী বলে?
হজ্বের বিধান পুরোটাই আল্লাহপাকের সাথে বান্দার ভালোবাসার এক গভীর মূহুর্ত। কেমন যেন বান্দা তার সকল ভালোবাসা ছেড়ে এক আল্লাহ’র ভালোবাসায় ডুব দিতে খালি পায়ে মুসাফির বেশে রওনা হলেন। প্রেমিক যেমন সবাইকে ফেলে প্রেমিকাকে নিয়ে হঠাৎ কোথাও রওনা হয়ে যায়, ঠিক বান্দা তেমনি আল্লাহ পাকের ভালোবাসার প্রেম সাগরে ডুব দিতে রওনা হয়ে যান। আর এজন্যই হজ্বের জন্য সীমাহীন সওয়াব বা প্রতিদানের কথা হাদিস শরীফ থেকে পাওয়া যায়। নিন্মে কয়েকটা হাদিস পেশ করছি।

এক. হযরত আমর ইবনুল আস রা. হতে বর্ণিত নবীজি সা. বলেন,
أَنَّ الإِسْلاَمَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهَدَّمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا وَأَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ
ইসলাম (গ্রহণ) তার পূর্বেকার সকল পাপ বিদূরিত করে দেয় এবং হিজরত তার পূর্বেকার সকল কিছুকে বিনাশ করে দেয়। একইভাবে হজ্ব তার পূর্বের সবগুনাহকে বিনষ্ট করে দেয়। -সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২১

দুই. হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَمَا وَلَدَتْهُ أُمُّهُ
যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্ব করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ্ব হতে ফিরবে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১৫২১

অর্থাৎ সে কাবীরা-ছাগীরা, প্রকাশ্য-গোপনীয় সকল গুনাহ থেকে ঐরূপ মুক্ত হয়ে ফিরে আসে। যেরূপ একজন শিশু গুনাহ মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে।

তিন. হযরত আবু হুরায়রাহ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ
এক ওমরাহ অপর ওমরাহ পর্যন্ত সময়ের (ছগীরা গুনাহের) কাফফারা স্বরূপ। আর জান্নাতই হ’ল কবুল হজ্জের একমাত্র প্রতিদান। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১৭৭৩

এ সকল হাদিসগুলো কী বুঝাতে চায়, হজ্ব কোনো আধ্যাত্মিক বিষয় নয়? যদি আধ্যাত্মিক বিষয় না হবে, তাহলে এ সকল ফযিলতের কথা রাসুলুল্লাহ সাঃ কেন বললেন? হেযবুত তওহীদ কী কোনো জবাব দিতে পারবে? সুতরাং প্রমাণ হলো, হজ্বের পুরো বিষয়টিই আল্লাহ পাকের মহব্বতের এক গভীর সফর। এটাকে ইবাদত বলে স্বীকার না করা, আধ্যাত্মিক বিষয় বলে না মানা, মুসলিমদের বার্ষিক মহাসম্মেলন বলে আখ্যায়িত করা চরম অন্যায় ও ইসলামের চুড়ান্ত বিকৃতি।

আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য এত দূরে কষ্ট করে যেতে হবে কেন?
হজ্ব মুসলিম উম্মাহর আল্লাহকে স্বরণ করা ও গুনাহ মাফ করার এক বিশেষ আমল। মহান আল্লাহ বলেন,
وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالاً وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ، لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ
এবং মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পদযোগে এবং দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রমকারী উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যেগুলো (দীর্ঘ সফরের কারণে) রোগা হয়ে গেছে। যাতে তারা তাদের জন্য স্থাপিত কল্যাণসমূহ প্রত্যক্ষ করে এবং নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে সেই সকল পশুতে যা তিনি তাদেরকে দিয়েছেন। সুতরাং (হে মুসলিমগণ!) সেই পশুগুলি থেকে তোমরা নিজেরাও খাও এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও। [সূরা হজ্ব : ২৭-২৮]

উক্ত আয়াতে হজ্বের এতটি বিশেষ আমল কুরবানীর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হজ্ব পালনকারীরা আল্লাহ’র নামে পশু যবাহ করবে। এখন যদি হেযবুত তওহীদের যুক্তির আলোকে পাল্টা প্রশ্ন তুলি যে, আল্লাহ তো সর্বত্র আছেন, তাহলে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে এত দূর কষ্ট করে যেতে হবে কেন? হেযবুত তওহীদের কাছে এ প্রশ্নের জবাব আছে কী? নিশ্চয় নির্বাক থাকবেন তারা। সুতরাং আসল কথা হলো, আল্লাহ পাক যে বিধান দিয়েছেন, সে বিধান পালনে কোনো ‘কারণ’ তালাশ করা শয়তানের কর্মপন্থা। যেমন ইবলিসকে আল্লাহ পাক যখন আদমকে আ. সিজদা দেওয়ার হুকুম দিলেন, তখন ইবলিস প্রশ্ন তুলেছিলো ‘কেন আদমকে সিজদা করবো’? ফলে আল্লাহ পাক তাকে বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। সুতরাং আল্লাহর দেওয়া কোনো হুকুমে প্রশ্ন তোলা চরম বিয়াদবীর ও শয়তানের অনুকরণ।

হজ্ব কী জিহাদের ট্রেণিং?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের নিকট হজ্ব কোনো ইবাদত নয়, বরং এটা শুধুমাত্র জিহাদের ট্রেনিং। এ সম্পর্কে তারা অসংখ্য বক্তব্য দিয়েছে। তারা লিখেছে,

‘সেই সত্য দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্ব উপায়ে প্রচেষ্টা চালানো প্রত্যেক মো’মিনের অবশ্য কর্তব্য, ফরদ। এই দীন প্রতিষ্ঠা করতে হলে মো’মেনের অবশ্যই কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুন লাগবে। সেই চারিত্রিক, মানসিক আত্মিক গুণ বৈশিষ্ট্য (Attributes) এটা যে সে অর্জন করবে কোথেকে অর্জন করবে? সেটার জন্য আল্লাহ তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছেন। সেটা হলো সালাহ সওম,হজ্ব,যাকাত এগুলো। এগুলোর মাধ্যমে তার চরিত্রে কিছু গুন অর্জিত হবে। তারপর সে আল্লাহর সত্যদীন পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করে মানবসমাজ থেকে অন্যায় অশান্তি দূর করতে পারবে যেটা উম্মতে মুহাম্মদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য। -সওমের উদ্দেশ্য, পৃ. ৪/৫/৮

‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানেই হচ্ছে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। যারা এই অঙ্গীকার করবে তাদের চরিত্র অর্জনের জন্য আল্লাহ নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত এর হুকুম দিয়েছেন। -মহাসত্যের আহ্বান, পৃষ্ঠা. ১০৯

ইসলাম কী বলে?
জিহাদ ইসলামের অত্যাধিক গুরুত্ববহ একটি বিধান। জিহাদের কোনোরুপ গুরুত্বহীন হয় এমন শব্দ থেকে আল্লাহ আমার কলমকে হিফাযত করেন। কিন্তু হজ্বও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বতন্ত্র বিধান। শক্তি ও সামর্থের উপর এটা ফরজ করা হয়েছে। হজ্বকে কোথাও জিহাদের ট্রেনিং বলে আল্লাহ তা’আলা বা তাঁর রাসুল সা. ঘোষণা দেননি। বরং যেখানেই হজ্বের কথা বলা হয়েছে, মেখানেই কোন শর্ত ছাড়াই উল্লেখ্য করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন,
وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا ؕ وَ مَنْ كَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ الْعٰلَمِیْنَ
মানুষের মধ্যে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের উপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ্জ করা ফরয। কেউ (এটা) অস্বীকার করলে আল্লাহ তো বিশ্ব জগতের সমস্ত মানুষ হতে অমুখাপেক্ষী। [সূরা আলে ইমরান : ৯৭]

উক্ত আয়াতসহ অন্য কোথাও হজ্বের ব্যাপারে জিহাদের ট্রেণিং বলা হয় নি। সুতরাং কোনো শর্তহীন আয়াতকে জিহাদের শর্তারোপ করা আয়াতের অপব্যাখ্যার শামিল। উপরন্তু হজ্ব হলো ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন,
بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ  وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَان
ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল,নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া, হজ্জ আদায় করা এবং রমজান মাসে রোজা পালন করা। -সহীহ বুখারী, হাদিস : ৮

এ হাদিসে ইসলামের স্তম্ভ করা হয়েছে ৫ টি। এর মধ্যে একটি হলো হজ্ব। অবশ্যই ইসলামে জিহাদও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। সুতরাং জিহাদকে জিহাদের জায়গায় রাখা এবং হজ্বকে হজ্বের জায়গায় রাখা উচিৎ। অতএব হজ্বকে জিহাদের ট্রেলিংব বলা ডাহা মিথ্যাচার ও ইসলামের বিকৃতি।

হজ্ব কী মুসলিম প্রতিনিধিদের বার্ষিক সম্মেলন?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
ইসলামের ৫ স্তম্ভের একটি হলো পবিত্র হজ্ব। এটাকে নিছক একটি সম্মেলনের সাথে তুলনা করা বিকৃতির শামিল। অথচ হেযবুত তওহীদ সেই বিকৃতিটাই করে বসেছে। তারা লিখেছে-
মনে রাখতে হবে সেই হজ্ব কিন্তু বিকৃত আকীদার আধ্যাত্মিক সফর বা তীর্থযাত্রা ছিল না, সেটা ছিল উম্মাহর বাৎসরিক মহাসম্মেলন। -আসুন সিস্টেমটাকেই পাল্টাই, পৃ. ১৪

আজ যে ব্যক্তিগত ‘এবাদতের’ আকীদায় হজ্ব করা হয় তা যে আল্লাহর ও তার রসূলের উদ্দেশ্য নয় তার আর এক প্রমাণ হোলো মক্কা ও আরাফাতের চারদিক দিয়ে বহু কিলোমিটার জুড়ে একটি এলাকাকে অমোসলেমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। এই নিষিদ্ধ করণের উদ্দেশ্য কি? মোসলেমদের হজ্ব করার দৃশ্য অমোসলেমদের দেখাতে মোসলেমদের ক্ষতি কি? মোসলেমদের জামাতের সালাতের দৃশ্য সাম্যের, মানুষের ভ্রাতৃত্বের, ঐক্য ও শৃংখলার এক অপূর্ব দৃশ্য। সালাতের দৃশ্য দেখেই বহু অমোসলেম মুগ্ধ হয়ে এসলাম সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে পড়াশোনা করে মোসলেম হোয়ে গেছে। তাহলে এই নিষিদ্ধ করণের কি অর্থ? এক কথায় এর অর্থ রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা (state secret)। যে জাতিটি দুনিয়ার অন্য সব রকম জীবন ব্যবস্থা ভেঙে আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত সে জাতির বার্ষিক মহাসম্মেলনে অবশ্যই বহু বিষয়ে আলোচনা, পরামর্শ হবে, সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যেগুলো অতি গোপনীয়। এই গোপনীয়তাকে অমোসলেমদের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য এই সতর্কতা। নইলে যে জীবন ব্যবস্থা, দীনকে সমস্ত পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেওয়ার কথা সেটার কেন্দ্রস্থলকে আড়াল কোরে রাখার কোন মানে হয় না। হজ্ব যদি জাতীয়, রাজনৈতিক সামরিক ইত্যাদি গোপনীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার না হতো, শুধু আধ্যাত্মিক, ব্যক্তিগত ব্যাপার হোতো তবে ঐ নিষিদ্ধকরণ উদ্দেশ্যহীন, অর্থহীন। -বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ:) এর ভাষণ, পৃ. ১৯০

অর্থাৎ তারা হজ্বকে শুধু বিশ্ব সম্মেলন হিসাবেই গণ্য করে থাকে। এবং ইসলামী রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের কাজ বলে বুঝাতে চাচ্ছে।

ইসলাম কী বলে?
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,
وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالاً وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ
এবং মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পদযোগে এবং দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রমকারী উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যেগুলো (দীর্ঘ সফরের কারণে) রোগা হয়ে গেছে। [সূরা হজ্ব, আয়াত : ২৭]

উক্ত আয়াতসহ যেসকল আয়াতের মাধ্যমে হজ্ব ফরজ করা হয়েছে, কোনো আয়াত বা হাদিসে ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের জন্যই হজ্ব ফরজ’ এমন কোনো কথা বলা হয়নি। সুতরাং মুতলাক (শর্তহীন) আয়াতকে মুকায়য়াদ (শর্তারোপ) করা আয়াতের অপব্যাখ্যার শামিল।

উপরন্তু হজ্ব যদি বার্ষিক সম্মেলন হতো, তাহলে প্রতি বছর মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য সেখানে উপস্থিত হওয়া বাধ্যতামূলক বা ফরজ করা হতো। কিন্তু হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ الْأَقْرَعَ بْنَ حَابِسٍ، سَأَلَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، الْحَجُّ فِي كُلِّ سَنَةٍ أَوْ مَرَّةً وَاحِدَةً قَالَ: بَلْ مَرَّةً وَاحِدَةً، فَمَنْ زَادَ فَهُوَ تَطَوُّعٌ
হযরত আকরা’ ইবনু হাবিস রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হজ্ব প্রতি বছরই ফরয, নাকি মাত্র একবার? তিনি বললেন, জীবনে বরং একবারই, তবে কেউ অধিক করলে সেটা তার জন্য নফল। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং- ১৭২১

উক্ত হাদিস থেকে জানা গেলো, হজ্ব মুসলিমদের কোনো বার্ষিক সম্মেলনের নাম নয়, তাই যদি হতো তাহলে প্রতিবছর প্রত্যেক মুসলিম জনপ্রতিনিধির উপর ফরজ করা হতো। কিন্তু জিবনে একবার ফরজ করা হয়েছে, তাও আবার সামর্থবানদের উপরে। সুতরাং বুঝা গেলো, হজ্ব কোনো বার্ষিক সম্মেলন নয় এবং শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, বরং এটা সবার ব্যক্তিগত পালনীয় বিষয়।

হজ্বের উপর গুরুত্ব দেওয়া কী বিকৃত ইসলামের কাজ?

হেযব্রম তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদ কতটা জঘন্য মানোসিকতা পোষণ করে তা নিন্মের লেখাটা দেখলেই অনুমান করা যায়। তারা লিখেছে-
বিকৃত এসলামে নামায-রোযা হজ্ব-যাকাত আত্মার পরিচ্ছন্নতার জন্য নানারকম ঘষামাজা আধ্যাত্মিক উন্নতির উপর গুরুত্ব প্রাধান্য দেওয়া হলো। কারণ এরা ঐ এবাদত উপাসনা নিয়ে যত বেশি ব্যস্ত থাকবে ব্রিটিশরা তত নিরাপদ থাকবে। -এসলাম শুধু নাম থাকবে, পৃ. ১১২

ইসলাম কী বলে?
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনা আর তাদের এই বক্তব্যটা সামনে রেখে আপনারাই সিদ্ধান্ত দিন হেযবুত তওহীদ মুসলিম কী না? হজ্বের বিষয়ে উপরে অসংখ্য আয়াত-হাদিস এবং সাহাবায়ে কেরাম রা. এর বক্তব্য উল্লেখ্য করেছি। যাতে প্রমাণ হয়েছে যে, হজ্বের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন আল্লাহ পাক, তাঁর রাসুল সা. ও সাহাবায়ে কেরাম রা.। তাহলে হেযবুত তওহীদের এ বক্তব্য থেকে কী বুঝে নিতে হবে যে ইসলামকে আল্লাহ তা’আলা, তাঁর রাসুল সা. ও সাহাবায়ে কেরাম বিকৃত করেছেন? যদি তা না হয়, তাহলে কী এটা সহজেই অনুমেয় নয় যে, ইসলামকে চরমভাবে বিকৃত করছে হেযবুত তওহীদ? আশা করি সকল সচেতন মহল বুঝতে পেরেছেন।

জিহাদ ও মানবতার কাজ  না করে হজ্ব করলে কোনো ফায়দা নেই?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা লিখেছে, ‘কেউ যদি নামাজ রোজা হজ্ব পূজা-অর্চনা উপাসনা ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত ব্যপৃত থাকে, কিন্তু তার ভিতরে মানবতার গুণাবলী না থাকে তাহলে সে প্রকৃত ধার্মিক নয়, আল্লাহর প্রকৃত উপাসক নয়। -ধর্মবিশ্বাস, পৃ. ১৪

আল্লাহর লা’নতের নির্মম শাস্তি সত্ত্বেও এই জাতি তওবা করে তওহীদে, সিরাতুল মুস্তাকিমে, দ্বীন কায়েমায় ফিরে না এসে, নির্বোধের মত নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত হাজার রকমের নফল ইবাদত করে যাচ্ছে আর ভাবছে তাদের জন্য জান্নাতের দরজায় লাল কার্পেট বিছিয়ে রাখা হয়েছে। -ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে? পৃ. ৬

প্রকৃত ইসলামের জীবনব্যবস্থার উদ্দেশ্য মানব জীবনের নিরাপত্তা সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি, আর বর্তমান ইসলামের উদ্দেশ্য ওসব কিছুই না বরং সময়মত নামাজ পড়া, যাকাত দেওয়া, হজ্ব করা, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, লম্বা পোশাক ও খাটো পায়জামা পরা ইত্যাদি। -হেযবুত তওহীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, পৃ. ৭

‘আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষকে অশান্তির আগুনে জ্বলতে দেখেও যারা কাপুরুষের মতো ঘরে লুকায় আর এবাদত মনে করে রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ে, রোজা রাখে, হজ্ব করে, নানা উপাসনায় মশগুল থাকে তাদেরকে আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’। -ধর্মবিশ্বাস, পৃ. ৩

অর্থাৎ তাদের বক্তব্য হলো, মানবতার কষ্ট দূরিভূত না করে বা দ্বীন কায়েমের জিহাদ না করে হজ্ব করে কোনো ফায়দা নেই।

ইসলাম কী বলে?
জিহাদ যখন ফরজ হয় তখন জিহাদ করা যেমন আবশ্যক, ঠিক তেমনি হজ্ব করার সামর্থ হলে হজ্ব করাও তেমন ফরজ। ‘জিহাদ না করে হজ্ব করে কোনো ফায়দা নেই বা হজ্ব না করে জিহাদ করে কোনো ফায়দা নেই’ এ ধরণের কথা বলা ভ্রান্তি, বরং ইসলামী বিধান অনুযায়ী যখন যেটা ফরজ হবে, তখন সেটা করা আবশ্যক। জিহাদ বা মানবতার কাজ না করে হজ্ব করা যাবে না বলে হেযবুত তওহীদের যে দাবি ছিলো, তা নিন্মোক্ত দুটি হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে জবাব পাওয়া যাবে আশা করি

এক. নারীদের জন্য জিহাদের চেয়ে হজ্বকে উত্তম বলেছেন খোদ রাসুলুল্লাহ সা.। হাদিসে পাকে এসেছে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ! أَلاَ نَغْزُوْا وَنُجَاهِدُ مَعَكُمْ؟ فَقَالَ : لَكُنَّ أَحْسَنُ الْجِهَادِ وَأَجْمَلُهُ الْحَجُّ، حَجٌّ مَبْرُوْرٌ. فَقَالَتْ عَائِشَةُ فَلاَ أَدَعُ الْحَجَّ بَعْدَ إِذْ سَمِعْتُ هَذَا مِنْ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم-
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধ ও জিহাদে অংশগ্রহণ করব না? তিনি বললেন, তোমাদের জন্য উত্তম ও উৎকৃষ্ট জিহাদ হলো হজ্বব, কবূল হজ্ব। আয়েশা রা. বললেন, আল্লাহর রাসূল সা. হ’তে এ কথা শোনার পর আমি আর কখনো হজ্জ ছাড়ব না। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১৮৬১

দুই. হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم يَسْتَأْذِنُهُ فِي الْجِهَادِ فَقَالَ ‏أَحَىٌّ وَالِدَاكَ ‏قَالَ نَعَمْ ‏قَالَ فَفِيهِمَا فَجَاهِدْ
এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলো। এরপর সে তার নিকট জিহাদে অংশগ্রহণের অনুমতি চাইল। তখন তিনি বললেন, তোমার মাতা-পিতা কি জীবিত আছেন? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তাদের উভয়ের (খিদমাত করে) সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা কর। -সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৪৯

তিন. হাদিস শরীফে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لَا صَرُورَةَ فِي الإِسلامِ
(সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও) হজ্জ/হজ পালন না করে সন্ন্যাসী থাকা ইসলামে নেই। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৭২৯

চার. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ وَلَا تُسَافِرَنَّ امْرَأَةٌ إِلَّا وَمَعَهَا مَحْرَمٌ فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ اكْتُتِبْتُ فِي غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا وَخَرَجَتِ امْرَأَتِي حَاجَّةً قَالَ: «اذهبْ فاحجُجْ مَعَ امرأتِكَ
কোন পুরুষ যেন কখনো কোন স্ত্রীলোকের সাথে এক জায়গায় নির্জনে একত্র না হয়, আর কোন স্ত্রীলোক যেন কক্ষনো আপন কোন মাহরাম ব্যতীত একাকিনী সফর না করে। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রসূল! অমুক অমুক যুদ্ধে আমার নাম লেখানো হয়েছে। আর আমার স্ত্রী একাকিনী হজের উদ্দেশে বের হয়েছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যাও তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্ব করো। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ৩০০৬

সুতরাং বুঝা গেলো, জিহাদ বা মানবতার কাজ না করে হজ্ব করে কোনো ফায়দা নেই কথাটা ভিত্তিহীন।

পুরো দুনিয়ায় খেলাফত কায়েম হলেই কী হজ্ব করতে হবে?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদের ২য় এমাম হুসাইন সেলিম একটি ভিডিওতে বলেছেন, যেদিন সবাই তাওহীদের ডাকে সাড়া দেবে, সেদিন তিনি হজ্ব করবেন।

ইসলাম কী বলে?
এক. সামর্থবানের জন্য হজ্ব করা আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন। হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত,
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا يُوجِبُ الْحَجَّ قَالَ الزَّادُ وَالرَّاحِلَةُ ‏
এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরকাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! কিসে হজ্জ ফরয হয়? তিনি বললেন, পাথেয় ও বাহন যোগাড়ে সক্ষম হলে। -জামে তিরমিযি, হাদিস : ৮১১

উক্ত হাদিস বর্ণনার পর ইমাম তিরমিযি রহি. বলেন,
وَالْعَمَلُ عَلَيْهِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ أَنَّ الرَّجُلَ إِذَا مَلَكَ زَادًا وَرَاحِلَةً وَجَبَ عَلَيْهِ الْحَجُّ
আলেমগণ এতদনুসারে আমল করেছেন। তাঁরা বলেন, কোন ব্যক্তি যখন পাথেয় ও বাহন যোগাড়ে সক্ষম হয় তখন তার উপর হজ্জ ফরয হয়।

সুতরাং পাথেয় ও বাহনের ব্যবস্থায় রয়েছে, এমন প্রাপ্তবয়স্ক,স্বাধীন, সুস্থ মুসলিমের জন্য হজ্ব আত্যাবশ্যকীয় একটি আমল। এক কথায় সামর্থ থাকা শর্ত, পুরো দুনিয়া শিরক মুক্ত হওয়া শর্ত নয়। যা আমরা কুরআন-হাদিস থেকে উপরে প্রমাণ পেলাম। এরপরও বিশ্ববাসীর শিরক পরিহার করার অপেক্ষা করা বা শর্তারোপ করা চরম মুর্খতা ও ইসলামের নামে চরম অপব্যখ্যা।

দুই. হাদিসে এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাঃ ইন্তেকালের আগেই হজ্ব করেছেন। কিন্তু সে সময় কি পুরোবিশ্ববাসী কালেমার ছায়াতলে এসেছিলো? নিশ্চয় না। যা হেযবুত তওহীদও তাদের বইয়ে লিখেছে,
‘বিশ্বনবি সা. তার নবীজীবনের তেইশ বছরে সমস্ত আরব উপদ্বীপে এই শেষ জীবনবিধান প্রতিষ্ঠা করলেন। ইসলামের শেষ সংস্করণ মানব জীবনের একটি অংশে প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু তাঁর দায়ীত্ব সমস্ত পৃথিবী, সমস্ত মানব জাতি’। -বিকৃত সুফিবাদ, পৃ. ৯

তাহলে নবীজি সা. নিজে বিশ্বাবাসীর জন্য অপেক্ষা না করেই হজ্ব করলেন, কিন্তু মহামান্য(?) এমামুযযামান সেলিম সাহেব পারছেন না। এটা কি তার মুর্খতা নাকি ইসলামী বিধানের ব্যাপারে চরম অবজ্ঞা সেটা পাঠক আপনারই ডিসাইড করুন।

হজ্ব না করলে কী আল্লাহ জাহান্নামে দেবেন না?

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদের আরও জঘন্য বক্তব্য হলো,
‘আল্লাহ কোথাও বলেন নাই যে, সালাত (নামাজ) ত্যাগ করলে বা সওম (রোজা) ত্যাগ করলে বা হজ্ব ত্যাগ করলে বা অন্য যে কোন এবাদত ত্যাগ করলে কঠিন শাস্তি দিয়ে এই দীন থেকেই বহিস্কৃত করবেন শুধু জেহাদ (সংগ্রাম) এবং আল্লাহর রাস্তায় (জেহাদে) ব্যয় ছাড়া। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ, পৃ. ১৫

ইসলাম কী বলে?
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন,
وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا ؕ وَ مَنْ كَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ الْعٰلَمِیْنَ
মানুষের মধ্যে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের উপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ্জ করা ফরয। কেউ (এ বিষয়ে) কুফরী করলে আল্লাহ তো বিশ্ব জগতের সমস্ত মানুষ হতে অমুখাপেক্ষী। [সুরা আলে ইমরান : ৯৭]

উপরোক্ত আয়াত হজ্বের বিপক্ষ শক্তিকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছেন মহান আল্লাহ। এজন্য উক্ত আয়াতের তাফসীরে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. মুজাহিদ রহি. সহ অনেকেই বলেন
أَيْ وَمَنْ جَحَد فَرِيضَةَ الْحَجِّ فَقَدْ كَفَرَ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি হজ্বের আবশ্যকীয়তা অস্বীকার করবে, সে কাফের। -তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ. ১ পৃ. ৬০

আর এ আয়াতের কারণেই হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আলী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
مَنْ مَلَكَ زَادًا وَرَاحِلَةً تُبَلِّغُهُ إِلَى بَيْتِ اللَّهِ وَلَمْ يَحُجَّ فَلَا عَلَيْهِ أَنْ يَمُوتَ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا وَذَلِكَ أَنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَقُولُ: (وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حَجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِليهِ سَبِيلا)
যে ব্যক্তি ’বায়তুল্লাহ’ পৌঁছার পথের খরচের মালিক হয়েছে অথচ হজ্ব পালন করেনি সে ইয়াহূদী বা খ্রীস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করুক এতে কিছু যায় আসে না। আর এটা এ কারণে যে, আল্লাহ তা’আলা বলেন, ’’মানুষের জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ/হজ পালন করা ফরয, যে ব্যক্তি ওখানে পৌঁছার সামর্থ্য লাভ করেছে। -জামে তিরমিযী, হাদিস : ৮১২

হযরত আবূ উমামাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
وَعَنْ أَبِي أُمَامَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ لَمْ يَمْنَعْهُ مِنَ الْحَجِّ حَاجَةٌ ظَاهِرَةٌ أَوْ سُلْطَانٌ جَائِرٌ أَوْ مَرَضٌ حَابِسٌ فَمَاتَ وَلَمْ يَحُجَّ فَلْيَمُتْ إِنْ شَاءَ يَهُودِيًّا وَإِنْ شَاءَ نَصْرَانِيًّا»
যে ব্যক্তি সুস্পষ্ট অভাব অথবা অত্যাচারী শাসকের বাধা, অথবা সাংঘাতিক রোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়া হজ্ব পালন না করে মৃত্যুপথে যাত্রা করেছে, সে যেন মৃত্যুবরণ করে ইয়াহূদী হয়ে অথবা নাসারা হয়ে। -সুনানে দারিমী, হাদিস : ১৮২৬

আমিরুল মুমিনিন হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন,
من أطاق الحج فلم يحج فسواء عليه مات يهوديا أو نصرانيا
যে ব্যক্তি হজ্ব করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ্ব করে না , সে ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খিস্টান হয়ে তার কোনো পরোয়া আল্লাহ’র নেই। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ,খ. ১ পৃ. ৫৭৮

হযরত উমার রা. আরও কঠিন ভাষায় বলেন,
لقد هممتُ أن أبعثَ رجالًا إلى هذِهِ الأمصارِ فلينظُروا كلَّ من كان له جِدَةٌ ولم يَحُجَّ فيضربوا عليهِمُ الجزيَةَ ما هم بِمسلِمينَ ما هم بِمسلِمينَ
আমার ইচ্ছে হয়, বিভিন্ন শহরে আমি লোক পাঠাই, তারা যেন দেখে সামর্থ্যবান হওয়ার পরেও কে হজ্ব করেনি, তাকের উপর যেন তারা জিযিয়া আরোপ করে দেয়। কারণ, তারা মুসলিম নয়, তারা মুসলিম নয়। -দুররে মানসুর, খ. ৩ পৃ. ৬৯৩

সুতরাং প্রমাণ হলো, হজ্ব না করার শাস্তি কতটা ভয়াবহ। কিন্তু এতদ্বসত্ত্বেও হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, ‘হজ্ব না করলে আল্লাহ কঠিন শাস্তি দেবেন এমন কথা আল্লাহ বলেননি’। এখন আপনারাই বিবেচনা করুন হেযবুত তওহীদ মুসলিম কী না?

হজ্বের ফযিলত:
প্রিয় পাঠক, এসকল ভ্রান্ত লোকের কথায় কান না দিয়ে চলুন সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা হজ্বের বিধান দ্রুত পালন করি। মনে রাখতে হবে হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন,
سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ مَنْ حَجَّ للهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ
আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশে হাজ্জ করলো এবং অশালীন কথাবার্তা ও গুনাহ হতে বিরত রইল, সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে হাজ্জ হতে ফিরে আসবে যেদিন তাকে তার মা জন্ম দিয়েছিল। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ১৫২১

উপরন্তু সহিহ বুখারীতে হাদিস এসেছে, হযরত আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি সা. বলেন,
وأنَّ الحَجَّ يَهْدِمُ ما كانَ قَبْلَهُ
হজ্ব ইতিপূর্বের সকল গুনাহ ধ্বংস করে দেয়। -সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১

সুতরাং আসুন, হজ্ব নিয়ে হেযবুত তওহীদের এ ভ্রান্ত মতবাদ থেকে সতর্ক হই।

Check Also

মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা:

আল্লাহ’র দ্বীনের একমাত্র হিফাযতকারী শিক্ষাব্যবস্থা হলো, মাদরাসা। যেখানে দিবানিশি আল্লাহ তাআলার কুরআন ও তাঁর রাসুল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.