যারা আল্লাহকে না দেখে বিশ্বাস করে না, তাদেরকে প্রশ্ন করুন-
:তুমি নভোমন্ডলের সব কিছু বিশ্বাস করো?
:করি।
: কেমনে করো? তুমি কি সেগুলো দেখেছো?
: দেখিনি তো।
: তো বিশ্বাস কেন করো?
: আমাদের পন্ডিত বিজ্ঞানীরা দেখেছে এসেছেন। এজন্য নভোমন্ডলের সব কিছু বিশ্বাস করতে অনুবিধা নেই।
এখন তাকে বলে দেন, তোমাদের বিজ্ঞান মানবদের কথায় যদি বিশ্বাস করে অদেখা জিনিষ বিশ্বাস করা যায়, তাহলে বিশ্বের সকল মহামানবদের নায়ক মুহাম্মাদ সা. ও মেরাজের রাতে আল্লাহকে দেখে এসেছেন। সুতরাং আল্লাহ যে আছেন, এটা আমরাও না দেখে বিশ্বাস করতে পারি কোনো অসুবিধা নাই।
ওরা না দেখে বিশ্বাস করলে বিজ্ঞানী, আর আমরা করলে বোকা। আসলে ওরা গাধার বাচ্চা গাধা।
সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় এসে বসে পড়লাম। আমার ক্লান্তি দেখে আমার বড় ছেলে হিব্বান একটি জগভর্তি ডাবের পানি এনে আমাদের দুজনের সামনে রেখে দিলো। টি-টেবিলে দুটো গ্লাসও রাখা ছিলো। আমি গ্লাসে ঢেলে ডাবের পানি অর্ধেকটা পান করে ফেললাম। কিন্তু রাসেলকে ঢেলে দিলাম না। আমি ওকে বললাম, পানিটা খুব ভালো লাগলো খেয়ে। তুমিও নাও। রাসেল জগটা উঁচু করে গ্লাসে পানি ঢালতে চাইলে আমি বললাম, কি রে, এত কষ্ট করিস কেন? জগটা রাখ, এমনি এমনিই গ্লাসে জগ থেকে পানি চলে আসবে দেখিস।
রাসেল আমার দিকে তাকিয়েই গাল ভর্তি হাসি দিয়ে বললো, আপনার মাথায় কি কিছু আছে?
: কেন?
: কেউ না ঢাললে গ্লাসে পানি আসবে কি করে?
আমি তখন বললাম, এই খোলা গ্লাসে কেউ না ঢাললে পানি আসতে না পারলে, চারিদিকে মুখবন্ধ ডাবের ভেতর পানি আসলো কেমনে? ওর মাথা নিচু হয়ে গেলো।
আমি রাসেলকে রেষ্ট নিতে বলে রুমের ভেতরে চলে গেলাম। বালিশে মাথা রেখে মাত্র মোবাইলের ডাটা অন করেছি, মুহুর্তেই একটি মেসেজ আসলো। ইন্ডিয়া থেকে দিপু রায় প্রশ্ন লিখেছেন। কৃষ্ণ রায় হলো, ফেসবুকের “আস্তিক-নাস্তিক” পাবলিক গ্রুপের একজন এডমিন। তিনি বাস্তবে একজন নাস্তিক। অন্যদের তুলনায় তিনি একটু এডভ্যান্স। সবসময় মুমিনদের নিয়ে তার খুব চুলকানি। হুজুরদের তো একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। আমি অনেকবার তার হিটেষ্ট পোষ্ট দেখেও কিছু বলিনি। আজ তিনি আমাকে মেসেঞ্জারে যেহেতু নক করেছেন, তাহলে তো একটু কথা বলতেই হয়।
তিনি প্রথম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “আল্লাহ যে একজন আছেন এটা কিভাবে বিশ্বাস করা যায়? আমি না দেখে তো বিশ্বাস করতে পারি না। আপনারা হুজুররা সব বোকা। না দেখে এসব বিশ্বাস করেন কিভাবে?”
আমি বললাম, দাদা, ডোন্ট মাইন্ড! আপনি কি হালালজাদা নাকি টাটকা হারামজাদা?
কৃষ্ণ দা তো প্রশ্ন শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন,
: কোনো ভদ্র মানুষ জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না।
: কোনো সচেতন মানুষ তার শ্রষ্টা নিয়ে সন্দেহ করতে পারে না। আমি আরও বললাম, আপনার জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যদি অভদ্রতা হয়, তাহলে আমার রব নিয়ে প্রশ্ন তোলা আপনার কোন ভদ্রতার মধ্যে পড়ে? যাহোক, দাদা, আমি আসলে আপনাকে হিট করার জন্য বলিনি, জাষ্ট জানতে চেয়েছি
: আপনি কি আপনার বাবার বৈধ সন্তান?
: অবশ্যই। কেন নয়?
: না। মানে আপনি তো না দেখে কিছু বিশ্বাস করেন না, তো আপনার মায়ের সাথে বিশেষ কাজটা কি শুধু আপনার বাবা করেছে নাকি আরও ১০ জন পুরুষ মিলে আপনাকে জন্ম দিয়েছে এটা আপনি জানলেন কিভাবে? আপনি কি আপনার মায়ের পেট থেকে উঁকি মেরে দেখেছিলেন?
: না। তাতো দেখিনি।
: তাহলে না দেখে কেমনে বিশ্বাস করে নিলেন যে, আপনি আপনার বাবার বৈধ সন্তান?
: আমার চেহারা আমার বাবার মত হুবহু।
: আপনার ভাইবোন সব কি বাবার মত?
: না। ভিন্নরকম চেহারাও আছে।
: তাহলে আপনার কথা অনুযায়ী ঐ ভাইবোনগুলো আপনার বাবার জন্ম দেয়া নয়, তার মানে ওরা সব জারজ, আর আপনার মা লুচ্চা?
বে-চারা সহ্য করতে না পেরে বলে উঠলেন,
: আপনি আমারাকে নিয়ে প্রশ্ন তুললেন?
: আপনার যুক্তিতে আপনার মায়ের এই অবস্থা দাঁড়াচ্ছে। আমার কি করার আছে?
: আসলে হুজুর, আমার মা আমাকে বলেছিলো, আমি আমার বাবার ছেলে, এটা না দেখে বিশ্বাস করলে অসুবিধা তো নাই।
: আপনার মা কি সাধারণ মানুষ নাকি মহান মানুষ?
: সাধারণ মানুষ।
: তাহলে শুনুন। সাধারণ একটা মানুষ মায়ের কথা না দেখে বিশ্বাস করা যদি যুক্তিসঙ্গত হয়, তাহলে বিশ্বামানব মহানবী মুহাম্মাদ সা. এর কথা না দেখে আমারাও বিশ্বাস করেছি আমাদের স্রষ্টা আমাদের রব একমাত্র আল্লাহ।
এক.
প্রথমে জেনে রাখা উচিৎ, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
دار البلاء
“দুনিয়াটা হলো পরীক্ষার জায়গা”। আর এ কথা সবার জানা যে, পরীক্ষার হলে শুধু প্রশ্ন পত্র আর সাদা খাতা দেওয়া হয়, উত্তরপত্র দেওয়া হয় না। এখন কেউ যদি পরীক্ষার হলে, গাইডবুক দেখে দেখে লেখার দাবি জানাায়, সে যেমন মুর্খ, ঠিক তেমনি পৃথিবী নামক এ পরীক্ষার হলে আমরা সবাই পরীক্ষার্থী। এখানে আল্লাহকে দেখে বিশ্বাস করতে চাওয়া তেমন বোকামী।
দুই.
মাদরাসার মাহফিলের পোষ্টার করাবো বলে, টঙ্গী এক প্রেসে বসে আছি। হঠাৎ একজন লোক বাহির থেকে ডাক দিলো, কি রে রিজওয়ান না? ডাক শুনে তাকিয়ে দেখি, আমার ছোট বেলার এক বন্ধু “সাবলু”।
:কি রে দোস্ত, তুই সাবলু না?
: হ্যাঁ।
: আরে, কত দিন দেখিনি তোরে। এদিকে আস। কই থাকিস তুই?
: এই তো মীরের বাজারের পাশেই একটা কোম্পানীতে জব করি দোস্ত। কোম্পানীর একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাপানোর জন্য আসছি। ইন্টারভিউ কল কববো আমরা। ২০০ জন লোক লাগবে কোম্পানীতে।
ওর পোষাক-আশাক দেখে বললাম-
: দোস্ত, নামাজ-কালাম তো মনে হয় করিস না?
: না। করি না। ওগুলো আমি বিশ্বাসও করিনা।
কথাটি শোনার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ ওর বাবা একজন দ্বীনদার মানুষ। কিন্তু ছেলে এমন হবে এটা আসলেই অবিশ্বাস্য। আমি বললাম-
: বিশ্বাস করিস না মানে?
: হ্যাঁ। আল্লাহ বলে যদি কেউ থাকতেন। তাহলে তাকে দেখা যায় না কেন? বিশ্বাস করতে হলে আগে আল্লাহকে দেখবো তারপর বিশ্বাস করবো। তোরা আসলে না দেখে বিশ্বাস করে বড় বোকামীর পরিচয় দিস।
আমি কোনো জবাব না দিয়ে বললাম,
: আচ্ছা, দোস্ত, এসব রাখ এখন। তোর অফিসে একদিন যাবো। চায়ের দাওয়াত দিস। সেখানে গিয়ে নিরিবিলি কথা বলবো, কবে আসবো বল।
: আগামী সোমবার ইন্টারভিউ কল করেছি। তাহলে ঐ দিন আসিস। ইন্টারভিউ বিচারক প্যানেলে তুইও থাকিস।
সময় মত আমি সোমবার হাজির। দেখলাম সাবলু খুব একটা ভাব নিয়ে বসে আছে। ইন্টারভিউ নিচ্ছে। আমাকে দেখেই হাত ধরে টেনে তার পাশের চেয়ারে বসালো। কিছুক্ষণ পর একজন পরীক্ষার্থী এসে আমাদের সামনে বসলো। সাবলু তাকে একটি প্রশ্ন করলো। কিন্তু বেচারা উত্তর দিতে না পেরে লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে রইলো। মুখটা ঘর্মাক্ত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর লোকটি বলে বসলো, স্যার, আমার ব্যাগে উত্তরপত্রের বইটা আছে একটু দেখে দেখে বলি?
সাবলু ছোট বেলা থেকে প্রচুর রাগি, ইচ্ছামত লোকটিকে ধমকাতে লাগলো। এ পর্যায়ে বলতে লাগলো,
: আপনার মাথা ঠিক আছে মিয়া? এটা ইন্টারভিউ কক্ষ। এখানে উত্তরপত্র দেখতে চাওয়াও তো মুর্খতা। এতটুকু জ্ঞান নাই আপনার?
আমি বললাম,
: সাবলু, সাবলু, একটু থাম। একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার।
: বল, কি বলবি?
: আচ্ছা তুই না সেদিন আল্লাহকে দেখার বিষয় জানতে চাইছিলি?
: হ্যাঁ। চাইছিলাম তো। তো কি হয়েছে বল।
আমি এবার নড়েচড়ে বসলাম। তারে বললাম,
: দেখ, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, এই দুনিয়াটা ইন্টারভিউ বা পরীক্ষার হল। তোর এই ইন্টারভিউ হলরুমে উত্তরপত্র দেখতে চাওয়া যদি এ লোকটার জন্য বোকামী হয়, তাহলে এ দুনিয়া নামক পরীক্ষার হলে আল্লাহকে দেখতে চাওয়া কি সেদিন তোর বোকামী হয়নি?
সাবলু তো নিয়মিত থোতামোতা খেয়ে গেলো।বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কিছুক্ষন পর আবার বললাম-
: আচ্ছা দোস্ত, বলতো, যে পরীক্ষা বা ইন্টারভিউতে উত্তরপত্র বা গাইডবুক দেখে দেখে উত্তর দেয়ার অফশন থাকে , সে পরীক্ষার কোন মূল্য থাকে?
: নিশ্চয় না। জবাব দিল সাবলু।
: ঠিক তদ্রুপ, দুনিয়া নামক এ পরীক্ষার হলে “আল্লাহকে দেখেই বিশ্বাস করতে হবে” এমন অফশন চালু থাকলে এ দুনিয়ার আয়োজন কি অনর্থক হতো না?
শোন সাবলু, সারা বছর কষ্ট করে পড়াশোনা করে পরীক্ষার হলে গিয়ে ভালোমতো উত্তর লিখতে পারা যেমন সফল ছাত্রের পরিচয়, ঠিক তদ্রুত সারা জিবন কষ্ট করে আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে, ইবাদত করে আল্লাহ তা’য়ালা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করে কবরে গিয়ে ফিরিস্তাদের প্রশ্নের “আমার রব আল্লাহ” বলতে পারাটাও সফল মানুষের পরিচয়। এতএব, ইন্টারভিউ কক্ষে বই দেখে দেখে জবাব দেয়া যেমন মুর্খতা, ঠিক তেমনি এ দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখে ঈমান আনার দাবি করে নিজেকে আর বোকার পরিচয় দিস না। মানুষে তোকে মুর্খ বলবে, আমার লজ্জা লাগবে। সাবলুর মাথা এতক্ষণে নত হয়ে গিয়েছিলো।
হঠাৎ মাথা উঁচু করে সাবলু বললো,
: আচ্ছা দোস্ত, পৃথিবীর গবেষকরা তো পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ সিস্টেম আবিস্কার করেছে মূলত যোগ্য মানুষ তৈরি করে যোগ্য জায়গায় চাকরির জন্য।
তো আল্লাহ নিজেকে অদৃশ্যে রেখে কি চাচ্ছেন আসলে?
আমি বললাম,
: তোরা ইন্টারভিউ সিস্টেমে উত্তরপত্র দেখাস না কেন?
সে বলল,
: উত্তরপত্র গোপন রেখে কে কে ভালো জ্ঞানী বা আমাদের অফিসের জন্য কে যোগ্য মানুষ তাদেরকে আলাদাভাবে সিলেক্ট করি আমরা।
আমি বললাম,
: দেখ, কুরআন শরীফ পড়লে উত্তর তুই তোর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতিস। কেননা আল্লাহ বলেছেন,
لنبلوكم ايكم احسن عملا
অর্থাৎ তোরা যেমন ইন্টারভিউ নিয়ে উত্তরপত্র গোপন রেখে কে কে ভালো জ্ঞানী বা তোদের অফিসের জন্য যোগ্য মানুষ তাদেরকে আলাদাভাবে সিলেক্ট করে অফিসে চাকরির জন্য কনফার্ম করিস, ঠিক আল্লাহও নিজেকে অদৃশ্যে রেখে কে কে আল্লাহকে গবেষণা করে আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে জান্নাতের জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলেছে সে মানুষগুলোকে বাছাই করেন তাঁর জান্নাতের জন্য।
আরেকটা প্রশ্ন করি,
: বলতো, পরীক্ষায় বই দেখে উত্তর দিলে যোগ্যতা বাড়বে? নাকি না দেখে উত্তর দিলে যোগ্যতা বাড়ে?
: নিশ্চয় না দেখে উত্তর দেয়ার নিয়ম থাকলে সবাই লেখাপড়া করবে এবং যোগ্যতা অর্জন হবে। দেখে উত্তর দেয়ার সুযোগ রাখা হলে লোকজন কষ্ট করে লেখাপড়া করে আসবে না, তখন অযোগ্যরাও যোগ্যতার জায়গায় আসীন হবে।
আমি আর দেরি না করে বললাম,
: ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহ চেয়েছেন, তার বান্দারা যোগ্যতা দিয়ে তাঁকে চিনে নিক। এজন্য এ পৃথিবীতে আল্লাহকে দেখার অফশন বন্ধ করে রাখা হয়েছে, যেন সবাই যোগ্য হয়ে আল্লাহকে চিনে এবং মেনে কবরে যায়।
সাবলু আমার কথায় বেশ প্রভাবান্বিত হয়েছে বলে মনে হলো। দুজন চা পর্ব শেষ করে আমি বাসার দিকে রওনা হলাম। বাসায় এসে দরজায় নক করলাম। রাসেল দরজা খুলে দিলো। বললাম,
: কি রে, রেষ্ট করেছিস?
: হ্যাঁ।
রাসেল এবার বুয়েটে চান্স পেয়েছে। সাইন্সের ছাত্ররা মেধাবী হয়। তারা মেধাটা যদি ঠিকমত ব্যবহার করে তাহলে নাস্তিক হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু অহেতুক কিছু মানুষের কারণে ওরা বিজ্ঞান দিয়ে সব মাপতে যায়। তবে কেউ বিজ্ঞান দিয়েও স্রষ্টা খুঁজে পায়, কিন্তু কেউ দাম্ভিকতার কারণে গবেষণা না করে নাস্তিক হয়ে যায়।
আমি রাসেলকে বললাম,
: কি খবর তোর? কিছুটা বুঝ আসছে?
: না। দুলাভাই, আমার চোখে কোনো প্রবলেম নেই। আমি সব দেখি তবে আল্লাহকে কেন দেখতে পাই না? না দেখলে বিশ্বাস করাটা সচেতন মানুষের কাজ নয়।
আমি রাসেলকে বললাম,
: তুই নভোমন্ডলের সব কিছু তো বিশ্বাস করিস না?
:করি তো।
: কেমনে করিস? তুই কি সেগুলো দেখেছিস?
: দেখিনি তো।
: তো বিশ্বাস কেন করিস?
: আমাদের পন্ডিত বিজ্ঞানীরা দেখে এসেছেন। এজন্য নভোমন্ডলের সব কিছু বিশ্বাস করতে অসুবিধা কি?
: তোদের বিজ্ঞান মানবদের কথায় যদি বিশ্বাস করে অদেখা জিনিষ বিশ্বাস করা যায়, তাহলে বিশ্বের সকল মহামানবদের নায়ক মুহাম্মাদ সা. ও মেরাজের রাতে আল্লাহকে দেখে এসেছেন। সুতরাং আল্লাহ যে আছেন, এটা না দেখে বিশ্বাস করতে তোর অসুবিধা হচ্ছে কেন? তোরা না দেখে বিশ্বাস করলে বিজ্ঞানী, আর আমরা করলে বোকা। আসলে তোরা কি গাধা?
: তুই আইনস্টাইনকে তো মানিস না?
:হ্যাঁ। মানি।
: আইনস্টাইস টাইমকে ৪র্থ মাত্রা হিসাবে গণণা করেছেন। তিনি বলেছেন, যদি টাইম ট্রাভেল করা যেত, তাহলে অতীত এবং ভবিষ্যতের সব কিছু দেখা যেত। আইনস্টাইন টাইমকে না দেখেও বিশ্বাস করেছেন, তুই তাকেও কি বোকা বলবি?
সাইন্সে স্থানকেও মাত্রা হিসাবে গণণা করা হয়। বিজ্ঞানিরা বলেছেন, হাইপার ও স্পেস ব্যবহার করা গেলে মুহুর্তেই পুর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত সফর করা যেত। তোদের বিজ্ঞানিরা কি কখনও হাইপার-স্পেস দেখেছে?
: না। তাহলে বিশ্বাস করিস কেমনে? তাহলে তুইও কি বোকা?
পদার্থ বিজ্ঞানের স্ট্রীং থিউরীতে মাত্রার সংখ্যা সর্বমোট ১০ টি উল্লেখ্য করা হয়েছে। এর মাঝে মাত্র তিনটি ব্যবহার করা যায়। দৈর্ঘ্য প্রস্থ এবং উচ্চতা। বাকি ৭টি মাত্রা ব্যবহার করা যায় না, এমনকি দেখাও যায় না। তাহলে এরপরও তোরা বিশ্বাস করিস। তখন তোরা বড়বড় বিজ্ঞানী, আর আমরা আল্লাহকে না দেখে বিশ্বাস করলে বোকা হয়ে যাই। আসলে তোদের মাথায় কি আছে আমি বুঝি না।
এক নাগাড়ে বলতে দেখে রাসেল আমাকে বললো,
: দুলাভাই, আপনি এসব শিখলেন কি করে?
: আমি যত পড়েছি, তত আমার স্রষ্টাকে খুঁজে পেয়েছি। তুইও পড়ালেখা কর, কারো কথায় কান দিয়ে মুর্খ থাকিস না।
রাতের ডিনার শেষে দুজন যার যার রুমে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে একটু হাটাহাটি করে বাসায় এসে শুনি রাসেলের চোখ ও কানে একটু প্রোবলেম। বেশ অসুস্থ সে। ওকে নিয়ে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। রাসেল আমাকে বলল,
: দুলাভাই, আমার প্রাইভেট একজন ডাক্তার আছে ধানমন্ডি। উনি ভালো মানের ডাক্তার। চলেন উনার কাছে যাই।
গাড়িতে বসলাম। যেতে পথে রাসেল আমাকে বলল,
: দুলাভাই, যে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, উনি কিন্তু খুব শিক্ষিত। উনার সাথে আবার বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়েন না।
মনে মনে যা ভাবছিলাম তাই হলো। কারণ যে যেমন তার সঙ্গ তেমন হয়।
: তোর পরিচিত ঐ ডাক্তারও কি নাস্তিক?
: হ্যাঁ। উনি অনেক শিক্ষিত মানুষ। আজ পর্যন্ত কেউ তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি।
মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
: তোর ডাক্তার তো এ পৃথিবীর কোনো ভার্সিটিতে পড়েছেন নাকি?
: সেটা তো বটেই।
: আমার রাসুল সা. আরশের মালিকের থেকে জ্ঞান অর্জন করে এসেছেন। পৃথিবীর এমর কোনো সমস্যা নেই, যার সমাধান নেই। চল দেখি।
ডাক্তার সাহেবের চেস্বারে সিরিয়ালে বসে আছি। কারণ প্রত্যেক রোগীর জন্য তিনি লম্বা টাইম দেন। খবর পেলাম তিনি চিকিৎসার পাশাপাশি সবাইকে জ্ঞান বিরতণ করেন। সময় অনুযায়ী আমাদের ডাক আসলো। ভেতরে ঢুকতেই আমার টুপি-দাঁড়ি দেখেই তো উনার জ্ঞান সমুদ্রে উত্তাল তরঙ্গমালা ঢেউ খেলতে লাগলো। প্রেসক্রিপশন লিখে বলল,
: আপনি তো আল্লাহকে বিশ্বাস করেন না?
: প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করেন।
: কোনো শিক্ষিত মানুষ না দেখে বিশ্বাস করতে পারে না। তিনি জোর গলায় বললেন।
: আপনিও বিশ্বাস করেন স্যার।
: কি বলেন? আমার সম্পর্কে আপনি কতটুকু অবগত?
: আপনি চোখ ও কানের অনেক ভালো ডাক্তার। আর এ বিষয়ে যে যত বড় ডাক্তার, সে ততবড় অন্ধবিশ্বাসী!
: যেমন?
: এই যে ধরুণ কানের শ্রবণশক্তির একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অর্থাৎ ২০ এর কম আর ২০,০০০ এর বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ হলেই সেই শব্দ আমরা আর শুনতে পাইনা। তার মানে কি এই যে, এর বাহিরের যে শব্দ আছে তা সব মিথ্যা?
: নিশ্চয় না।
: তাহলে সেগুলো না শুনেই আপনি বিশ্বাস করছেন। আবার, দৃষ্টিশক্তির ক্ষেত্রেও মানুষের একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন ৪০০-৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘের আলোর বাইরের কোন আলো মানুষ দেখতে পায়না। এখন কেউ যদি বলে, ‘৮০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কোন আলো আমরা দেখতে পাইনা। সেটা কি ঠিক?
: নিশ্চয় না।
: তাহলে সীমাবদ্ধতার বাহিরের আওয়াজ না শুনে এবং আলো আপনি না দেখেও বিশ্বাস করেন। তাহলে আপনারা শিক্ষিত মানুষরাই না দেখে না শুনে বিশ্বাস করছেন। এটা যদি ঠিক হয়, তাহলে আমরা না দেখে আল্লাহকে বিশ্বাস করলে আপনারা কোন যুক্তিতে আমাদেরকে বোকা বলেন? আমরা না দেখে বিশ্বাস করলে যদি বোকা হই, তাহলে আপনারা কিভাবে শিক্ষিত সেজে বসে আছেন?
ডাক্তার সাহেব কথাগুলো শুনে বললেন, আচ্ছা এখন আপনারা আসুন, আমি একটু বাথরুমে যাবো।
আমরা আল্লাহকে দেখতে পাই না কেন?
ডাক্তার মহোদয়কে বিল দিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে বোর্ডবাজার বাসায় আসতে পথে ভাবলাম একটু চা খেয়ে নেয়া যাক। গাড়িটা থামিয়ে খাটি গরুর দুধের একটা চা স্টলে বসে চা অর্ডার দিলাম। রাসেলও আমার সাথে আসলো। আমাদের পাশে দুজন কোর্ট-টাই পরা দুজন লোক বসে চা খাচ্ছিলেন। আমি চায়ের কাপে মুখ দেয়ার আগে যথানিয়মে দুআ পড়ে চা খেতে লাগলাম। পাশের ভদ্র লোক দুটো দেখি বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। তাদের চাহুনিটা বেশ কৌতুহল সৃষ্টি করলো আমার মনে। আমি প্রশ্ন করলাম, ভাই কিছু বলবেন মনে হয়।
তাদের একজন বলল, না মানে আপনাকে ইন্টারনেটে খুব দেখা যায়। আপনি নাস্তিকদের অনেক প্রশ্নের জবাব দেন মনে হয়। আপনি নিশ্চয় রিজওয়ান রফিকী?
: জ্বি।
: আচ্ছা, হুজুর আপনারা যে আল্লাহকে না দেখে বিশ্বাস করেন এটা কতুটুকু যুক্তিসঙ্গত? আল্লাহ বলতে যদি কেউ থাকেন, তাহলে আমরা দেখি না কেন?
আমি কিছুটা নিরব হয়ে উনার চেহারার দিকে চেয়ে রইলাম। দেখলাম, উনার চোখে অনেক পাওয়ারী চশমা। চশমাটা খুলে নিয়ে বললাম,
: ভাই, ঐ ব্যানারটায় কি লেখা আছে পড়ুন তো?
লোকটি বললেন,
: চশমা দেন, এখনই পড়ে বলছি।
: না। চশমা ছাড়াই পড়ে বলুন।
: আমার চোখের প্রোবলেম, এটা ছাড়া দুরে দেখি না আমি। জবাব দিলেন তিনি।
: ভাইয়া, চোখের দৃষ্টি কম হওয়ায় চশমা ছাড়া একটু দুরের লেখা পড়তে পারেন না, তাহলে এই দুনিয়ার দুর্বল চোখ দিয়ে আল্লাহকে কেমনে দেখতে চান?
লোকটা নিরব হয়ে চায়ের কাপে টান দিলো। আমি আবার প্রশ্ন করলাম,
: আপনি কি করেন পেশায়?
: এই তো এ পাশের মার্কেটে আমার কম্পিউটারের দোকান আছে।
: এখন আপনার দোকানে কোন খরিদদার আসছে?
: সেটা কেমনে বলবো? আমি তো এখন এখানে, দোকানে থাকলে তো বলতে পারতাম।
: ও তার মানে, দোকানে না গেলে দেখতে পারবেন না, এই তো?
: হ্যাঁ, সেখানে না গেলে কেমন করে দেখবো কিভাবে বলবো?
: এভাবেই ভাই, জান্নাতে গেলে তখন দেখতে পারবেন আল্লাহকে। এই দুনিয়ার দৃষ্টির সীমাবদ্ধতায় যেমন দোকানে কে আছেন, সেটা দেখতে পারছেন না, ঠিক তেমনি মাখলুকের চোখের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা আল্লাহকে দুনিয়াতে দেখা যাবে না, এর জন্য আপনাকে আগে জান্নাতে যেতে হবে।
রাসেল পাশে বসে নিরবে শুনছিলো। আমি রাসেলকে বললাম,
: তোকে একটা ঘটনা বলি।
: জ্বি বলেন।
: একটা ছেলে নতুন বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে আনলো। কিন্তু বউটা ছিলো বামন বা সাড়ে তিন ফিট লম্বা। একদিন রান্না ঘরের কলসের মধ্যে তার হাতের আংটিটা পড়ে গেলো। নববধূ আংটিটা বের করার জন্য কলসের নিচে হাত দিতে চাইলো। কিন্তু সম্ভব হলো না। শাশুড়িকে গিয়ে বলছে,
: মা, কি একটা কলস আনছেন এটার তো তলায়ই নেই।
: আসলে বউ মা, কলসের তলা আছে, কিন্তু তোমার হাত পর্যাপ্ত লম্বা না। এটা কলসের দোষ নয়, বরং তোমার হাতের দোষ।
ঠিক তেমনি আল্লাহ আছেন, বাট আমাদের দেখার মত সে চোখ নেই। এতে আল্লাহর অপরাধ নেই, বরং আমাদের দৃষ্টি খাটো।