বর্তমানে যামানার সকল বিশ্ববাসীর জন্য কিয়ামত অবদি ইসলামী শরীয়াত পালন করা চুড়ান্ত ফরজ। এ বিধান থেকে কোনো অংশ কম-বেশি করার কোনো অধিকার নেই কারও। পাশাপাশি ইসলামি শরীয়াত বাদ দিয়ে কোনো পীর, গুরু, বা কোনো নেতাকেও মান্য করার কোরো সুযোগ নেই। কিন্ত লালন ফকির তার নিজস্ব সঙ্গীতে বলেছে,
‘মোর্শেদ যা ইশারা দেয় বন্দেগির তরিক সেই হয়
কোরানে তা সাফ লেখা রয় আবার অলি দরবেশ তারাও কয়। -অখণ্ড লালনসঙ্গীত : পৃ. ৫৭
এই সঙ্গীতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লালনভক্ত আবদেল মাননান লিখেছে,
‘মোর্শেদরুপে আল্লাহ যার জন্য যে সাধনপদ্ধতি দান করেন সেটাই তার জন্য পালনীয় অপরিহার্য ধর্মবিধান বা শরীয়ত। এটাই কোরআনের নির্দেশনা। সবার জন্য আজীবন একই ধাঁচের নামাজ বা ধ্যান কখনো সঠিক হতে পারে না। জন্মকর্ম, জ্ঞানপাত্র ধারণক্ষমতা অনুসারে এক একজনের জন্য এক একটি পৃথক পৃথক তরিকা বা স্বতন্ত্র পন্থা নির্ধারিত। বিপুল বৈচিত্রের মধ্যে একত্বময় প্রেমিক সুফির এমনই ভজনধারা। এভাবেই গুরু তথা মোর্শেদের কৃপালাভ অর্থাৎ ভগবান বা আল্লাহর পরিপূর্ণ দর্শন লাভ করা সাধকের পক্ষে সম্ভব। তার বিপরীতে গুরুমুখী সাধনাকে অগ্রাহ্য করে যে যতই ধার্মিক সাজুক তাতে কারো শেষ রক্ষা নেই।’ -অখণ্ড লালনসঙ্গীত : পৃ. ৫৭
অর্থাৎ গুরু বা মুরশিদ যে আইন-কানুন ভক্তদের জন্য প্রদান করে থাকে, সেটাই ভক্তের জন্য পালনীয় শরীয়াত। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক।
ইসলাম কী বলে?
এই বক্তব্য দিয়ে তারা শরীয়াতে ইসলামিকে তুড়ি মেরে অস্বীকার করে ছুড়ে ফেলেছে। অথচ ইসলামি শরীয়াতকে মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে চুড়ান্তভাবে পূর্ণতা দান করে ঘোষণা দিয়েছেন,
اِنَّ الدِّیۡنَ عِنۡدَ اللّٰہِ الۡاِسۡلَامُ ۟ وَمَا اخۡتَلَفَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡعِلۡمُ بَغۡیًۢا بَیۡنَہُمۡ ؕ وَمَنۡ یَّکۡفُرۡ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ فَاِنَّ اللّٰہَ سَرِیۡعُ الۡحِسَابِ
নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট (গ্রহণযোগ্য) দীন কেবল ইসলামই। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা তাদের কাছে জ্ঞান আসার পর কেবল পারস্পরিক বিদ্বেষবশত ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে। আর যে-কেউ আল্লাহর আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করবে (তার স্মরণ রাখা উচিত যে,) আল্লাহ অতি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।-সুরা আলে ইমরান: ১৯
উক্ত আয়াতের তাফসীরে হযরত ইবনে কাসীর রহি. লেখেন,
إخبار من الله تعالى بأنه لا دين عنده يقبله من أحد سوى الإسلام، وهو اتباع الرسل فيما بعثهم الله به في كل حين، حتى ختموا بمحمد صلى الله عليه وسلم، الذي سد جميع الطرق إليه إلا من جهة محمد صلى الله عليه وسلم، فمن لقي الله بعد بعثته محمدًا صلى الله عليه وسلم بدِين على غير شريعته، فليس بمتقبل
এই আয়াত দ্বারা এই সংবাদ দেয়া উদ্দেশ্য যে, আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দীন কেবল ইসলাম। আর সর্বযুগে আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত নবীদের ওহীর অনুসরণ করার নাম ইসলাম। সর্বশেষ এবং সকল নবীর সমাপ্তকারী হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তার নবুয়তের পর পূর্বের সকল পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। এখন যে কেউ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হওয়ার পর তার শরী‘আত ব্যতীত অন্য কোন শরীআত গ্রহণ করে মৃত্যু বরণ করবে তা আল্লাহ তাআলার নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। -উমদাতুত তাফসীর: খ. ১ পৃ. ৩৬১
অপর আয়াতে মহান রব বলেন,
اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَاَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَرَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে ইসলামকে (চির দিনের জন্য) পছন্দ করে নিলাম। -সুরা মায়িদা : ৩
উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ চিরদিনের জন্য ইসলামি আইনকেই চুড়ান্ত ঘোষণা করেছেন। যে আইন থেকে কম-বেশি করার আর কোনো সুযোগ নেই। এমনকি কোনো একটি বিধানকে বাদ দেওয়া বা সংস্কার করারও কোনো অফশন খোলা নেই। পক্ষান্তরে ইসলামি আইন বাদ দিয়ে অন্য কোনো আইন হোক তা পূর্ববর্তী ধর্মীয় আইন বা নব্য আবিস্কৃত কোনো আইন, তা মান্য করা মহান রবের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টরূপে নিষিদ্ধ। মহান রব বলেন,
وَمَنۡ یَّبۡتَغِ غَیۡرَ الۡاِسۡلَامِ دِیۡنًا فَلَنۡ یُّقۡبَلَ مِنۡہُ ۚ وَہُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ
যে ব্যক্তিই ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও দীন অবলম্বন করতে চাবে, তার থেকে সে দীন কবুল করা হবে না এবং আখিরাতে সে মহা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। -সুরা আলে ইমরান : ৮৫
এ ছাড়াও কুরআন-সুন্নাহর আইনকে মজবুতভাবে আকড়ে ধরার তাকিদ সরাসরি সহিহ হাদিসেই বলা হয়েছে, হযরত যায়দ বিন আরকাম রা. বলেন,
قَامَ رَسُولُ اللهِ ﷺ يَوْمًا فِينَا خَطِيبًا بِمَاءٍ يُدْعَى خُمًّا بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ فَحَمِدَ اللهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ وَوَعَظَ وَذَكَّرَ ثُمَّ قَالَ أَمَّا بَعْدُ أَلاَ أَيُّهَا النَّاسُ فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِىَ رَسُولُ رَبِّى فَأُجِيبَ وَأَنَا تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَلَيْنِ أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللهِ فِيهِ الْهُدَى وَالنُّورُ فَخُذُوا بِكِتَابِ اللهِ وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ
একদিন মক্কা-মদীনার মধ্যপথে ’খুম’ নামক জলাশয়ের ধারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। সুতরাং তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও স্ত্ততি বর্ণনা করে ওয়ায-নসীহত করার পর বললেন, অতঃপর, হে লোক সকল! শোনো, আমি একজন মানুষ মাত্র, শীঘ্রই (আমার নিকট) আমার প্রতিপালকের দূত আসবেন এবং আমি (আল্লাহর নিকট যাওয়ার জন্য) তাঁর ডাকে সাড়া দেব। আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী (গুরুত্বপূর্ণ) বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে একটি আল্লাহর কিতাব, যাতে হিদায়াত ও আলো রয়েছে। সুতরাং তোমরা আল্লাহর কিতাবকে গ্রহণ কর এবং তা মযবুত ক’রে ধারণ কর। -সহিহ মুসলিম : হাদিস নং : ৬৩৭৮
এসব সুস্পষ্ট হাদিস থাকা সত্ত্বেও যারা এ ইসলামি বিধানগুলোকে বাদ দেবে, অথবা গুরুর আইন শরীয়াত হিশাবে যারা গ্রহণ করবে, তাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধ্বংশশীল হিশাবে ঘোষণা দিয়েছেন। হযরত ইরবায বিন সারিয়াহ রা. কর্তৃক বর্ণিত, তিনি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট শুনেছেন, তিনি বলেছেন যে,
قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا لَا يَزِيغُ عَنْهَا بَعْدِي إِلَّا هَالِكٌ
অবশ্যই তোমাদেরকে উজ্জল (স্পষ্ট দ্বীন ও হুজ্জতের) উপর ছেড়ে যাচ্ছি; যার রাত্রিও দিনের মতই। আমার পর ধ্বংসোন্মুখ ছাড়া অন্য কেউ তা হতে ভিন্নপথ অবলম্বন করবে না। -মুসনাদে আহমাদ : হাদিস নং : ১৭১৪২
এতো এতো হাদিস থাকার পরও কী বলা যায় এ কথা যে, গুরুর আইনই ভক্ত বা মুরিদের শরীয়াত? যদি ইসলামি শরীয়াত বাদ দিয়ে গুরুর আইন মানতেই হয়, তাহলে নিন্মোক্ত হাদিসের ব্যাপারে কী বলবেন? হযরত জাবির রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَوْ بَدَا لَكُمْ مُوسَى فَاتَّبَعْتُمُوهُ وَتَرَكْتُمُونِي لَضَلَلْتُمْ عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ وَلَوْ كَانَ حَيًّا وَأَدْرَكَ نُبُوَّتِي لَاتَّبَعَنِي
আল্লাহর কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন! যদি (তাওরাতের নবী স্বয়ং) মূসা আ. তোমাদের মধ্যে থাকতেন আর তোমরা তাঁর অনুসরণ করতে আর আমাকে ত্যাগ করতে, তাহলে তোমরা অবশ্যই সঠিক সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে। মূসা আ. যদি এখন জীবিত থাকতেন এবং আমার নুবূওয়্যাতের যুগ পেতেন, তাহলে তিনিও নিশ্চয়ই আমার অনুসরণ করতেন। -সুনানে দারিমী : হাদিস নং : ৪৩৫
উক্ত হাদিস থেকে তো এ কথা পরিস্কার জানতে পারলাম যে, এ যামানায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ বাদ দিয়ে মুসা আ.-এর মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ নবি আ.-কেউ মানা জায়েয নয়। সেখানে পুরো ইসলামি আইন এমনকি নামাজের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিধানকেও বাদ দিয়ে কিভাবে পীর, গুরু বা মোর্শেদের বিধানকে শরীয়াত হিশাবে মানা যায়? এটা কী লালনদের কুফরি মতবাদ নয়? এটা যদি কুফরি মতবাদ না হয়, তাহলে কুফর আর কাকে বলে? আল্লাহপাক আমাদেরকে লালন ফকিরদের কুফরী মতবাত থেকে হিফাযত করেন। আমীন!