Home > প্রবন্ধ > আত্মহত্যা ও ইসলাম।

আত্মহত্যা ও ইসলাম।

আত্মহত্যা ও ইসলাম।

‘জীবন’ আল্লাহর দেয়া এক মহানিয়ামত। বিশেষ করে মানবজাতি সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ বলেছেন,

لَقَدۡ کَرَّمۡنَا بَنِیۡۤ اٰدَمَ وَ حَمَلۡنٰهُمۡ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ وَ رَزَقۡنٰهُمۡ مِّنَ الطَّیِّبٰتِ وَ فَضَّلۡنٰهُمۡ عَلٰی کَثِیۡرٍ مِّمَّنۡ خَلَقۡنَا تَفۡضِیۡلًا

অর্থ: আমি আদাম সন্তানকে সম্মানিত করেছি, তাদের জন্য জলে স্থলে যানবাহনের ব্যবস্থা করেছি, তাদেরকে পবিত্র রিযক দিয়েছি আর আমি তাদেরকে আমার অধিকাংশ সৃষ্টির উপর মর্যাদায় শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।
সুরা ইসরা, আয়াত: ৭০

সুতরাং বুঝা গেলো, মানবজীবন আল্লাহ তা’আলার এক অসাধারণ সৃষ্টি।  এজন্য মানবজাতিকে বড় যত্ন করে মহান আল্লাহ নিজ কুদরতি হাতে সৃষ্টি করেছেন, মহান আল্লাহ বলেন,

خَلَقۡتُ بِیَدَیَّ

অর্থাৎ আমার দু’হাতে আমি (মানবজাতিকে) সৃষ্টি করেছি।
সুরা সোয়াদ, আয়াত: ৭৫

সুতরাং বুঝা গেলো, মানবজীবন কোনো সাধারণ নিয়ামত নয়। এটাকে কদর করা আমাদের সবার জন্য জরুরি।অতএব জীবন দানের মালিক যিনি, তিনিই কেবল জীবন নিতে পারেন। কেউ তাতে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করলে সে মহাপাপী হবে এবং জাহান্নামী হবে। এজন্য ইসলামে আত্মহত্যা একটি মহাপাপ তথা কবীরা গুনাহ।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ بِکُمۡ رَحِیۡمًا وَمَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ عُدۡوَانًا وَّ ظُلۡمًا فَسَوۡفَ نُصۡلِیۡهِ نَارًا ؕ وَ کَانَ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰهِ یَسِیۡرًا

অর্থাৎ এবং তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু’’। আর যে ঐ কাজ করবে সীমালঙ্ঘন ও অন্যায়ভাবে, আমি অচিরেই তাকে আগুনে প্রবেশ করাব। আর সেটি হবে আল্লাহর উপর সহজ।
সুরা নিসা আয়াত: ২৯-৩০

এখানে এ কথা জেনে রাখা উচিৎ যে, অন্যান্য কবীরা গুনাহ করে তওবা করে যাওয়ার সুযোগ থাকে, কিন্তু আত্মহত্যার এমন কবীরা গুনাহ যে, এটা করার পর আর তওবা করার সুযোগই থাকে না।

উপরন্তু হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত সাবিত্ বিন্ যাহ্হাক. রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

مَن قَتَلَ نَفْسَهُ بشيءٍ في الدُّنْيا عُذِّبَ به يَومَ القِيامَةِ

‘অর্থাৎ যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন বস্তু দিয়ে আত্মহত্যা করলো, তাকে কিয়ামতে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি দেয়া হবে।
সূত্র: সহিহ বুখারী, হাদিস নং- ৬০৪৭

অপর আরেকটি হাদিসে এসেছে, হযরত জুন্দাব রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

كانَ برَجُلٍ جِراحٌ، فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فقالَ اللَّهُ: بَدَرَنِي عَبْدِي بنَفْسِهِ حَرَّمْتُ عليه الجَنَّةَ

অর্থাৎ জনৈক ব্যক্তি গুরুতর আহত হলে, সে তার ক্ষতগুলোর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বললেন: আমার বান্দাহ্ স্বীয় জান কবযের ব্যাপারে তড়িঘড়ি করেছে, অতএব আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিলাম’।
সূত্র: সহিহ বুখারী হাদিস নং- ১৩৬৪

হযরত আবু হুরাইরাহ্ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيْدَةٍ فَحَدِيْدَتُهُ فِيْ يَدِهِ يَتَوَجَّأُ بِهَا فِيْ بَطْنِهِ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا، وَمَنْ شَرِبَ سُمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَحَسَّاهُ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا، وَمَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَرَدَّى فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا.

অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন লোহা বা লোহা জাতীয় বস্ত্ত দিয়ে আত্মহত্যা করলো সে লোহা বা লোহা জাতীয় বস্ত্তটি তার হাতেই থাকবে। তা দিয়ে সে জাহান্নামের আগুনে নিজ পেটে আঘাত করবে এবং তাতে সে চিরকাল থাকবে। তেমনিভাবে যে ব্যক্তি বিষ পান করে আত্মহত্যা করলো সে জাহান্নামের আগুনে বিষ পান করতেই থাকবে এবং তাতে সে চিরকাল থাকবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করলো সে জাহান্নামের আগুনে লাফাতেই থাকবে এবং তাতে সে চিরকাল থাকবে’’।
সূত্র: সহিহ বুখারী হাদিস নং- ৫৭৭৮

বি:দ্র: এখানে চিরকাল বলতে দীর্ঘ সময় উদ্দেশ্য। কারণ এ সম্পর্কে অন্য হাদিস রয়েছে। এজন্য কেউ ভুল ধারণার স্বীকার না হয়, যে ‘আত্মহত্যাকারী কখনও জাহান্নাম থেকে বের হবে না।’ বিষয়টি এমন নয়, বরং ঈমান থাকার কারণে একদিন না একদিন জান্নাতে যাবেই।)

হযরত আবু হুরাইরাহ্ রা. থেকে আরও বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

الَّذِيْ يَخْنُقُ نَفْسَهُ يَخْنُقُهَا فِيْ النَّارِ، وَالَّذِيْ يَطْعَنُهَا يَطْعَنُهَا فِيْ النَّارِ.

অর্থাৎ যে ব্যক্তি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করলো সে জাহান্নামে গিয়ে এভাবেই করতে থাকবে এবং যে ব্যক্তি নিজকে বর্শা অথবা অন্য কোন কিছু দিয়ে আঘাত করে আত্মহত্যা করলো সেও জাহান্নামে গিয়ে এভাবেই করতে থাকবে।
সূত্র: সহিহ বুখারী হাদিস নং- ১৩৬৫

আত্মহত্যা জাহান্নামে যাওয়ার একটি বিশেষ কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে আগাম সংবাদ দিয়েছেন।

হযরত আবু হুরাইরাহ্ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন; আমরা একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ’হুনাইন্ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। পথিমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক মুসলিম সম্পর্কে বললেন: এ ব্যক্তি জাহান্নামী। যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো তখন লোকটি এক ভয়ানক যুদ্ধে লিপ্ত হলো এবং সে তাতে প্রচুর ক্ষত-বিক্ষত হলো। জনৈক ব্যক্তি বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! যার সম্পর্কে আপনি ইতিপূর্বে বললেন: সে জাহান্নামী সে তো আজ এক ভয়ানক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে মৃত্যু বরণ করলো। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবারো বললেন: সে জাহান্নামী। তখন মুসলিমদের কেউ কেউ এ ব্যাপারে সন্দিহান হলো। এমতাবস্থায় সংবাদ এলো: সে মরেনি; সে এখনো জীবিত। তবে তার দেহে অনেকগুলো মারাত্মক ক্ষত রয়েছে। যখন রাত হলো তখন লোকটি আর ধৈর্য ধরতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সংবাদ দেয়া হলে তিনি বলেন: আল্লাহ্ সুমহান। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ্ তা‘আলার বান্দাহ্ ও তাঁর প্রেরিত রাসূল। অতঃপর তিনি বিলাল (রাঃ) কে এ মর্মে ঘোষণা দিতে বললেন যে,

إِنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْـجَنَّةَ إِلاَّ نَفْسٌ مُسْلِمَةٌ، وَإِنَّ اللهَ يُؤَيِّدُ هَذَا الدِّيْنَ بِالرَّجُلِ الْفَاجِرِ.

অর্থাৎ একমাত্র মু’মিন ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তবে আল্লাহ্ তা‘আলা কখনো কখনো কোন কোন গুনাহ্গার ব্যক্তির মাধ্যমেও ইসলামকে শক্তিশালী করে থাকেন’’।
সূত্র: সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ১১১

আত্মহত্যা না করলে কি পুরস্কার:

ডিপ্রেশনে থেকেও যদি কেউ আল্লাহর ভয়ে আত্মহত্যা না করে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা সুসংবাদ প্রদান করে বলেন,

اِنۡ تَجۡتَنِبُوۡا کَبَآئِرَ مَا تُنۡهَوۡنَ عَنۡهُ نُکَفِّرۡ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ نُدۡخِلۡکُمۡ مُّدۡخَلًا کَرِیۡمًا

তোমরা যদি সেসব কবীরা গুনাহ পরিহার কর, যা থেকে তোমাদের বারণ করা হয়েছে, তাহলে আমি তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাব সম্মানজনক প্রবেশস্থলে।
সুরা নিসা, আয়াত: ৩১

মনে রাখবেন, এ পৃথিবীর সবই ধোকা এবং স্বার্থপর। একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই আমাদের আপন। সুতরাং যদি কেউ দুনিয়ার সব কিছু উর্ধে থেকে মহান আল্লাহকে আপন করে নেন, খোদ আল্লাহ তা’আলা সর্বদা তার বন্ধু হিসাবে পাশে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنتُمْ تُوعَدُونَ

অর্থাৎ নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোন।
সুরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩০

সুতরাং আসুন আমরা সবাই জীবনকে গুরুত্ব দিতে শিখি। দুনিয়ার সামান্যতম পেরেসানি বা ডিপ্রেশনের জন্য আজীবনের ডিপ্রেশনের ঝাপ দেয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। দুনিয়ার সাময়ীক ডিপ্রেশন থেকে বাঁচতে বেশি বেশী আল্লাহর ইবাদত করি। কারণ আল্লাহ ইবাদত ও জিকিরেই প্রশান্তির ছোঁয়া রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
الَّذِينَ آمَنُواْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللّهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

অর্থাৎ যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।
সুরা রা’দ আয়াত: ২৮

মনে রাখবেন, আল্লাহ যার আপন, তার কোনো অভাব নেই। আল্লাহকে ভালোবাসতে পারলে একাকিত্বের ডিপ্রেশন থাকে না। কারণ মহান আল্লাহ সব সময় আমাদের সর্বদিকে রয়েছেন।

এজন্য হাফেজ্জী হুজুর রহ, বলতেন,
‘তুমি দুনিয়ার সব কিছু পেয়েছো, কিন্তু আল্লাহকে পাওনি, তাহলে তুমি কিছুই পাওনি।’

ঠিক তদ্রুপ,
আমরা দুনিয়ার সব পেয়েও যদি আল্লাহকে না পাই তাহলে যেনো কিছুই পেলাম না।

আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে সহিহ বুঝ দান করুন। আমীন!

Check Also

মৃত ব্যক্তির পরিবার কর্তৃক খানার আয়োজন: عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.