Home > ভ্রান্ত মতবাদ > ওযু ছাড়া পবিত্র কুরআন শরীফ স্পর্ষ করা যাবে কি না?

ওযু ছাড়া পবিত্র কুরআন শরীফ স্পর্ষ করা যাবে কি না?

 

বর্তমানে QRF তথা কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আহলে কুরআন) একটি উদ্ভট মতবাদ কায়েম করতে চলেছে। তাদের দাবি হচ্ছে কুরআন শরীফ ওযু ছাড়াও ধরা জায়েয। ভাবতে অবাক লাগে যে, তারা এ কথাটি প্রমাণ করার জন্য হাস্যকর কিছু যুক্তি খাড়া করে সহিহ হাদিসকে অস্বীকার করতে পিছপা হয়নি।

কিন্তু কুরআন শরীফ অপবিত্র অবস্থায় স্পর্ষ করা জায়েয নয় এটাই চুড়ান্ত কথা। এ কথাটি পবিত্র কোরআন,হাদিস, তাফসীর এবং সমস্ত মাযহাবের সিদ্ধান্ত। চলুন আগে ধারাবাহিক ভাবে কুরআন-হাদি,, সাহাবা ও তাবেয়ীদের মতামতের পাশাপাশি ফুকাহায়ে কেরামের রায় জেনে নেয়া যাক। শেষ দিকে QRF এর প্রশ্নের জবাব দেয়া যাবে। ইনশাআল্লা।

 কোরআন থেকে দলীল:

মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ

অর্থ: কেউ আল্লাহর নামযুক্ত বস্তুসমুহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা তো তার হৃদয়ের আল্লাহভীতি প্রসূত। সূরা হজ্ব আয়াত-৩২

অতএব আল্লাহর পবিত্র কালাম,নামযুক্ত কিতাব তথা কিতাবুল্লাহকে অপবিত্র অবস্থায় তা স্পর্শ করা তাকওয়া পরিপন্থী কাজ নয় কি?

উপরন্তু মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,

لَّا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ

অর্থ: যারা পাক-পবিত্র, তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না। সূরা ওয়াকিয়া-৭৯

অবশ্য এই আয়াতটি দিয়ে ডাক্তার মতিয়ার রহমান সাহেব দলীল নিতে একদমই নারাজ। তাঁর দাবি হলো এটা ফিরিস্তা ও লওহে মাহফুজের কুরআন সম্পর্কিত আয়াত। এটা দিয়ে দুনিয়ার কুরআন না ধরার ব্যাপারে আইন করা যায় না।

 যদিও ডাক্তার সাহেবরা অনেকাংশে তাফসীর মানতে নারাজ, তথাপিও এ বিষয়ে তাফসীরের সাহায্য নিয়ে বেশ কয়েক পৃষ্ঠা লিখেছেন মুফাসসরিরিনগণের মতামত। যেহেতু এ ক্ষেত্রে তিনি তাফসীর মেনে নিয়েছেন সেহেতু চলুন আমরা দেখি মুফাসসিরদের মতামত কি?

যদিও আয়াতের তাফসীরে এসেছে যে, পবিত্র সত্তা ছাড়া কেউ তা স্পর্শ করতে পারে না। অর্থাৎ শয়তান কর্তৃক এ বাণী নিয়ে আসা কিংবা নাজিল হওয়ার সময় এতে কর্তৃত্ব খাটানো বা হস্তক্ষেপ করা তো দূরের কথা, যে সময় লাওহে মাহফূজ থেকে নবীর সা: উপর নাজিল করা হয়, সে সময় পবিত্র সত্তাসমূহ অর্থাৎ পবিত্র ফেরেশতারা ছাড়া কেউ তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না।

যদিও আয়াতের ভেতর ফিরিস্তাদের কথা বলা হয়েছে,কিন্তু আয়াতে ফিরিস্তাদের অবস্থা বর্ণনা করে মূলত বান্দাদের নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ আয়াতটি যদিও جملة خبريه (সংবাদ সূচক) কিন্তু  جملة انشائية এর অর্থ প্রদান করবে (নিষেধ সূচক অর্থ)।ফলে আয়াতটির অর্থ হবে- পবিত্রতা ব্যতিত কোরআন স্পর্ষ করো না।

উপরন্তু পবিত্র কোরআন শরীফে এমন অসংখ্য আয়াত রয়েছে,যেখানে আল্লাহ তা’য়ালা নবি স: কে সম্বোধন করে সমস্ত মুসলিমদের আদেশ করেছেন।

হাদিসেও এর প্রমাণ রয়েছে যে, ‘না সূচক’ শব্দ কখনো ‘নিষেধ’ এর অর্থ প্রদান করে।যেমন হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে হাদিস এসেছে,

المسلم أخو المسلم لا يظلمه

অর্থাৎ মুসলমান মুসলমানের ভাই,তার উপর জুলুম করে না।
সূত্র: সহিহ মুসলিম হাদিস-২৫৬৪ বুখারী-৬০৬৪

এখানে একটু ভাবুন তো, এখানে কি সরাসরি ‘নিষেধ সূচক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে? নিশ্চয় না। বরং ‘না সূচক’ শব্দ ব্যবহার করে মূলত ‘নিষেধ সূচক’ অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে।অর্থাৎ কোন মুসলিম আরেক মুসিলেম উপর জুলম করো না।

একইভাবে অত্র আয়াতের অর্থ নিষেধের অর্থেই তাফসীর করা হয়েছে এবং বিভিন্ন মুফাসসিরগণ আয়াতটিকে সামনে রেখে বিভিন্নভাবে তাফসীর করেছেন। এখানে মাত্র ১০ টি তাফসীরের রেফারেন্স তুলে ধরলাম।

১. তাফসীরাতে আহমাদিয়া (মোল্লা আহমাদ জিয়ুন র:):

الاكثر علي انه نفي بمعني النهي…..اي لا يمسه هذا القران الا المطهرون من الاحداث فلا يمسه المحدث والجنب ولا الحائض ولا النفساء

অর্থাৎ অধিকাংশ মুফাসসিরদের মত হলো, আয়াতে ‘না’ সূচক’ শব্দ মূলত ‘নিষেধ সূচক’ অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ এ কোরআন নাপাকি থেকে পবিত্র ব্যক্তি ব্যাতিত কেউ স্পর্ষ করতে পারবে না। সুতরাং ছোট-বড় নাপাকী,হায়েজ-নেফাস ওয়ালা মহিলা স্পর্শ করতে পারবে না।
সূত্র: তাফসীরাতে আহমাদিয়্যাহ পৃ:৪৮৩

২. তাফসীরে কাশশাফ (যামাখশারী র:):

وان جعلتها صفة للقرآن فالمعني لا ينبغي ان يمسه الا من هو علي الطهارة من الناس

অর্থাৎ উক্ত আয়াতটি যদি কোরআন সম্পর্কিত হয়,তাহলে এর অর্থ হলো, কোন মানুষ পবিত্রতা ছাড়া কোরআন স্পর্ষ করা জায়েয হবে না।
সূত্র: তাফসীরে কাশশাফ খ:৪ পৃ:৪৬৯

৩. তাফসীরে রুহুল মা’আনী (আলুসী র:):

وكون المراد بهم المطهرون من الاحداث

অর্থাৎ (আয়াতে) ‘পবিত্র সত্ত্বাগণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ঐ সকল মানুষ যারা নাপাকি থেকে পবিত্র।
সূত্র: তাফসীরে রুহুল মা’আনী খ:১৪ পৃ:১৫৪

৪. তাফসীরে বায়যাবী:
তিনি তিনটি ব্যাখ্যা করেছেন। তার মধ্যে একটি হলো.

لا يَمَسُّ القُرْآنَ إلّا المُطَهَّرُونَ مِنَ الأحْداثِ فَيَكُونُ نَفْيًا بِمَعْنى النَّهْى

অর্থাৎ নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জনকারী ব্যক্তি ব্যাতিত কোরআন স্পর্ষ করবে না। ‘না সূচক’ শব্দটি ‘নিষেধ সূচক’ অর্থ বহন করবে।
সূত্র: বায়যাবী খ:৫ পৃ:১৮৩

৫. তাফসীরে সামারকান্দী:

يجوز للمحدث أن يقرأ، ولا يجوز أن يمس المصحف

অর্থাৎ (ছোট নাপাকীতে) অপবিত্র ব্যক্তির জন্য  কোরআন পড়া জায়েয, কিন্তু স্পর্শ করা জায়েয নয়।

৬. আল বাহরুল মুহিত (আবু হায়্যান রঃ):

وإنْ أُرِيدَ بِكِتابٍ مَكْنُونٍ الصُّحُفُ فالمَعْنى أنَّهُ لا يَنْبَغِي أنْ يَمَسَّهُ إلّا مَن هو عَلى طَهارَةٍ مِنَ النّاسِ

অর্থাৎ (আয়াতে উল্লেখিত) কিতাব দ্বারা যদি মুসহাফ উদ্দেশ্য নেয়া হয়, তাহলে অর্থ হবে কোন মানুষ অপবিত্র অবস্থায় কোরআন স্পর্ষ করতে পারবে না।

৭. তাফসীরে কুরতুবী:

فَالْجُمْهُورُ عَلَى الْمَنْعِ مِنْ مَسِّهِ لِحَدِيثِ عَمْرِو بْنِ حَزْمٍ

অর্থাৎ আমর ইবনে হাযাম রা: এর হাদিসের কারণে জুমহুরে ফুকাহা অপবিত্র ব্যক্তির জন্য কোরআন ধরা নিষেধের ব্যাপারে মত দিয়েছেন।

৮. তাফসীরে নাসাফী:

وإنْ جَعَلْتَها صِفَةً لِلْقُرْآنِ فالمَعْنى لا يَنْبَغِي أنْ يَمَسَّهُ إلّا مَن هو عَلى الطَهارَةِ مِنَ الناسِ

অর্থাৎ উক্ত আয়াতটি যদি কোরআন সম্পর্কিত হয়,তাহলে এর অর্থ হলো, কোন মানুষ পবিত্রতা ছাড়া কোরআন স্পর্ষ করা জায়েয হবে না।
সূত্র: মাদারিকুত তানযিল খ:২ পৃ:৬৪২

৯. তাফসীরে আহকামুল কোরআন (হাফেজ আবু বকর র:):

انه كتب في كتابه لعمرو بن حزم ولا يمس القرآن الا طاهر فوجب ان يكون نهيه ذلك يالآية

অর্থ: নবি স: আমর ইবনে হাযাম রা: এর কাছে প্রেরিত চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কোরআন স্পর্ষ করবে না’ মূলত এ আয়াতের দ্বারা নিষেধ করেছিলেন।
সূত্র: তাফসীরে আহকামুল কোরআন খ:৩ পৃ:৪২১

১০. তাফসীরে ফাতহুল বয়ান (সিদ্দিক হাসান খান র:):

يحرم عليهم مسه بدون الطهارة

অর্থাৎ অপবিত্র অবস্থায় কোরআন স্পর্শ করা হারাম।

সুতরাং উপরোল্লিখিত ১০ টি তাফসীর থেকে আশা করি সকলের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, অপবিত্র অবস্থায় পবিত্র কোরআন স্পর্ষ করা জায়েয কি না।

একটি প্রশ্ন:
ডাক্তার মতিয়ার সাহেব বলতে পারেন যে, যখন এই আয়াতগুলি নাজিল হয় তখন সম্পুর্ন কুরআন নাজিল হয় নি। তাই পৃথিবীর কুরআন এই আয়াত গুলিতে উল্লেখিত সুরক্ষিত গ্রন্থ হতে পারে না”।

উত্তর:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন স্পর্শ করার আদবের প্রতি নির্দেশ দিয়ে আরবী ব্যাকরণের মুজারে’ তথা বর্তমান ও ভবিষ্যতকালীন অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করেছেন। যার অর্থ দাড়ায় ‘যারা পাক পবিত্র, তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করছে না এবং করবে না।’

তাহলে বুঝা গেল, আল্লাহ তা’য়ালা তখনকার নাযিলকৃত অসম্পূর্ণ কোরআন আর পরবর্তিতে নাযিলকৃত পূর্ণাঙ্গ কোরআনের ব্যাপারেই আল্লাহ তা’য়ালা বুঝাতে চেয়েছেন যে, ওযু ছাড়া এ কোরআন  এখনও ধরবে না ভবিষ্যতেও ধরবে না।

আরেকটি প্রশ্ন:

তিনি বলতে পারেন যে, মুফাসসিরিনগণ আয়াতটি নির্দিষ্ট একটি ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত হিসেবে তাফসীরে লিখেছেন অর্থাৎ ফিরিস্তাদের বিষয়ে। তাহলে এটা দিয়ে কি সবার জন্য ব্যাপক হুকুম জারি করা উচিত?

উত্তর:
মূলত এ কথাটি তাদের মুখেই শোভা পায,যারা মুফাসসিরিন ও ফুকাহাদের মূলনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ। একটি প্রশিদ্ধ মূলনীতি রয়েছে,

العبرة لعموم اللفظ لا لخصوص السبب

অর্থ: আয়াতের ভেতর থাকা নির্দিষ্ট ঘটনা (শানে নুযুল) নয় বরং শব্দের ব্যপকতা ধর্তব্য।
সূত্র: কাশফুল আসরার খ:৩ পৃ:৩৭৬

সুতরাং আয়াতের ভেতরে থাকা নির্দিষ্ট ঘটনা মূলত একটি হুকুম জারি করার জন্যই এসেছে। অর্থাৎ ওযু বা পবিত্রতা ছাড়া কোরআন ধরা যাবে না।

হাদিস থেকে দলীল:

নবি স: এর আদেশ:

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي بَكْرِ بْنِ حَزْمٍ أَنَّ فِي الْكِتَابِ الَّذِي كَتَبَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِعَمْرِو بْنِ حَزْمٍ أَنْ لَا يَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلَّا طَاهِرٌ

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবু বকর বিন হাযম রা: বলেন, রাসূল সাঃ আমর বিন হাযম রা: এর কাছে এই মর্মে চিঠি লিখেছিলেন যে, পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন কেউ স্পর্শ করবে না”।
সূত্র: মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৬৮০, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-২৮৩০, মারেফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস নং-২০৯, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-১৩২১৭, আল মুজামুস সাগীর, হাদীস নং-১১৬২, মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস নং-৪৬৫, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২২৬৬ (হাদিস সহীহ)

সাহাবায়ে কেরাম রা: এর অভিমত:

এ ব্যাপারে বেশ কয়েকজন সাহাবির নাম উল্লেখ্য করা হয়,যাঁরা ওযু ছাড়া কোরআন শরীফ স্পর্শ করা জায়েয মনে করতেন না। বিশেষ করে আলী রা: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: সা’দ বিন ওয়াক্কাস রা: আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা: সাঈদ ইবনে যায়েদ রা: এবং সালমান ফারসী রা: অন্যতম। এখানে কয়েকজন সাহাবির হাদিস উল্লেখ্য করলাম।

১. হযরত হাকিম ইবনে হিযাম রা:

عن حكيم بن حزام قَالَ قَالَ النَّبِيُّ ﷺ لَا تَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلَّا وَأَنْتَ طَاهِرٌ

অর্থাৎ হাকিম ইবনে হিযাম রা: থেকে  বর্ণিত নবিজি স: বলেন, তুমি পবিত্র অবস্থা ব্যাতিত কোরআন স্পর্ষ করো না।
সূত্র: জামে সগীর হাদিস-৯৮৪৭ (হাদিস সহীহ)

২. আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা:

عن عبد الله بن عمر أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لا يمس القرآن إلا طاهر

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন,’পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না।
সূত্র: মাযমাউজ যাওয়ায়েদ হাদীস-১৫১২

عن نافع عن ابن عمر انه كان لا يمس المصحف الا وهو طاهر

অর্থাৎ নাফে র: থেকে বর্ণিত, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা: পবিত্র অবস্থা ব্যাতিত কোরআন শরীফ স্পর্ষ করতেন না।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ হাদিস-৭৫০

৩. হযরত সালমান ফারসী রা:

عن عبد الرحمن بن يزيد رحمه الله أنه قال كنا مع سلمان في حاجة فذهب فقضى حاجته ثم رجع فقلنا له توضأ يا أبا عبد الله لعلنا نسألك عن آي من القرآن قال فاسألوا فإني لا أمسه إنه لا يمسه إلا المطهرون قال فسألناه فقرأ علينا قبل أن يتوضأ

অর্থ: আব্দুর রহমান বিন ইয়াযিদ বলেন, আমরা সালমান ফারসী রা: এর সাথে ছিলাম। (কিছুক্ষন পর) তিনি বের হয়ে ইস্তেঞ্জা করতে গেলেন। (ফিরে আসার পর) আমি তাকে বললাম, হে আবু আব্দিল্লাহ ! আপনি যদি একটু অযু করে আসতেন, আমরা কোরআনের একটি আয়াতের ব্যাপারে আপনাকে প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। তিনি জবাব দিলেন – আমি তো এখন কোরআন স্পর্শ করছি না। পবিত্র না হয়ে কোরআন স্পর্শ করা যায় না। (কিন্তু, স্পর্শ না করে শুধু পড়তে তো কোন সমস্যা নেই)। এরপর আমরা যা শুনতে চেয়েছিলাম, তিনি ওযু করার পূর্বেই তা আমাদের পড়ে শোনালেন।
সূত্র- মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ হাদিস- মুসান্নাফে আব্দির রাজ্জাক-১৩২৭ মুসতাদরকে হাকেম খ:২ পৃ:৪৭৭ সুনানে দারা কুতনি খ: ১ পৃ:৩০৪

৪. হযরত উসমান বিন আবুল আস সাকাফী  রা:

عن عثمان بن أبي العاص قال قال النبي صلي الله عليه وسلم لا تمس القران إلا وأنت طاهر

অর্থ: হযরত উসমান বিন আবুল আস রা: থেকে বর্ণিত নবিজি স: বলেন, তুমি পবিত্র অবস্থা ব্যতিরেকে কোরআন স্পর্শ করবে না।
সূত্র: মু’জামে কাবীর (তবরানী) হাদিস-৮৩৩৬

৫. হযরত আনাস রা: থেকে উমর রা: এর বর্ণিত ঘটনা:

َ عن أنس بن مالك….فقالت له اخته انك رجس ولا يمسه الا المطهرون فقم فاغتسل او  توضأ فقام عمر فتوضأ ثم اخذ الكتاب فقرأ طه

অর্থাৎ হযরত ওমর রাঃ যখন কাফের থাকা অবস্থায় বোনকে কুরআন দেখাতে বলেছিলেন, তখন তার বোন বলেছিলেন যে, তুমি নাপাক! আর এ গ্রন্থ পবিত্র ছাড়া কেউ ধরতে পারে না। অতএব তুমি যাও গোসল করো অথবা ওযু করো। অতপর ওমর রা: ওযু করে কোরআন ধরে সুরা ত্বহা পড়লেন।
সূত্র: মুস্তাদরাকে হাকেম হাদিস-6897  মুসনাদুল বাজ্জার খ:১ পৃ:৪০১ সুনানে দারা কুতনী খ:১ পৃ:১২১ সুনানুল কুবরা (বায়হাকী) খ:১ পৃ:৮৭ 377

উপরোক্ত হাদিস গুলো দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরামের নিরব ঐক্যমত ছিলো যে, ওযু ছাড়া বা অপবিত্র অবস্থায় কোরআন শরীফ স্পর্শ করা জায়েয নয়। এ কথাটিই বলেছেন ইমাম নববী র:

واستدل أصحابنا بالحديث المذكور وبأنه قول علي وسعد بن أبي وقاص وابن عمر – رضي الله عنهم -، ولم يعرف لهم مخالف في الصحابة

অর্থ: পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা নিষেধ বক্তব্যটি হযরত আলী রাঃ এবং সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রাঃ এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ দের। এ মতের উল্টো কোন মত সাহাবাগণ থেকে বর্ণিত নয়
সূত্র: আল মাজমু খ:২ পৃ:৯০

সুতরাং এ কথা স্পষ্ট হলো যে, সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমত হলো, অপবিত্র ব্যক্তির জন্য কোরআন শরীফ স্পর্শ করার কোন সুযোগ নেই।

তাবেয়ীদের মতামত:

অসংখ্য তাবেয়ীদের মত হলো, কোরআন শরীফ ওযু ছাড়া স্পর্শ করা যাবে না। কয়েকজন তাবেয়ীর মতামত এখানে তুলে ধরছি-

১. আতা ইবনে আবী রবাহ র:

عن عطاء قال أحب أن لا تمس الدراهم والدنانير إلا على وضوء

অর্থ: আতা র: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি পছন্দ করি যে, (আল্লাহর নাম বা আয়াত সম্বলিত) দিরহাম বা দিনারে ওযু ছাড়া তুমি স্পর্শ করো না।
সূত্র: মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদিস-১৩৩৫

২. কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ র: এর মত:

عن القاسم بن محمد انه كره ان يمسها الا وهو طاهر

অর্থ: কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ র: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, তিনি পবিত্রতা ছাড়া কোরআন শরীফ স্পর্শ করা অপছন্দ করতেন।
সূত্র: আল মাসাহিফ হাদিস-৭৫৪

৩. ইবরাহীম নাখায়ী র:

عن إبراهيم قال لا تمس الدراهم التي فيها ذكر الله إلا على وضوء

অর্থাৎ ইবরাহীম নাখায়ী র: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যে দিরহামে আল্লাহর নাম থাকে সেটা ওযু ছাড়া স্পর্শ করো না।
সূত্র: মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদিস-১৩৩৮

৪. জুহরী র: এর অভিমত:

عن الزهري قال لا تمس الدراهم التي فيها القرآن إلا على وضوء

অর্থ: জুহরী র: বলেন, যে দিরহামে কোরআন লেখা রয়েছে সেটা ওযু ছাড়া স্পর্শ করো না।
মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদিস-১৩৩৬

৫. শা’বী,তাউস র: এর অভিমত:

عن الشعبي وطاوس والقاسم بن محمد كرهوا أن يمس المصحف وهو على غير وضوء

অর্থ: শা’বী,ত্বউস,কাসিম বিন মুহাম্মাদ তাঁরা ওযু ছাড়া কোরআন শরীফ স্পর্শ করা মাকরুহ (তাহরিমী) মনে করতেন।
সূত্র: মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদিস-১৩৩৪

এছাড়া আরো অনেক তাবেয়ীদের থেকে বর্ণনা রয়েছে। যার দ্বার সুস্পষ্টভাবে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, ওযু ছাড়া কোরআন স্পর্শ করা জায়েয নয়।

চার মাযহাবের মতমত:

সমস্ত সালাফে সালেহীন এবং ফুকাহায়ে কেরাম সুরা ওয়াকিয়ার আয়াতের ভেতরে থাকা অর্থের ব্যাপকতা এবং বিভিন্ন হাদিস সামনে রেখে লিখেছেন যে, কোরআন শরীফ স্পর্শ করতে ওযু অবশ্যই লাগবে।

হাম্বলী মাযহাবের সিদ্ধান্ত:

১. ইবনে কুদামা হাম্বলী র: বলেন,
ولا يمس المصحف إلا طاهر يعني طاهراً من الحدثين جميعاً
অর্থ: কোরআন শরীফ স্পর্শ করবে না পবিত্রতা ছাড়া অর্থাৎ উভয় প্রকার অপবিত্রতা থেকে (পাক না হয়ে)।
সূত্র: আল মুগনী খ:১ পৃ:২০২

২. হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী র: বলেন,
وأصل هَذهِ المسألة منع المحدث مِن مس المصحف وسواء كان حدثه حدثاً أكبر وهو من يجب عليه الغسل أو أصغر وهو من يجب عليه الوضوء هذا قول جماهير العلماء وروي ذلك عن علي وسعد وابن عمر وسلمان ولا يعرف لهم مخالف من الصحابة
অর্থ: এ মাসআলার মুল কথা হলো নাপাক অবস্থায় কোরআন স্পর্শ করা নিষেধ। চাই বড় নাপাকী হোক, যে কারণে গোসল করতে হয়। অথবা ছোট নাপাক, যে কারণে ওযু করতে হয়। এটা জুমহুরের উলামাদের মত। আর এ কথাটি আলী রা:, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা:, ইবনে ওমর রা:, সালমান ফারসী রা: তাঁদের মত। এমতের বিপক্ষে কোন সাহাবা ছিলেন বলে জানা যায় না।
সূত্র: ফাতহুল বারী শরহে বুখারী খ:১ পৃ:৪০৪-৫

৩. ইমাম ইবনে হুবায়রা হাম্বলী র: বলেন,
وأجمعوا على أنه لا يجوز للمحدث مس المصحف
অর্থ: ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, অপবিত্র ব্যক্তির জন্য কোরআন স্পর্শ করা জায়েয নেই।
সূত্র: আল ইফছাহ খ:১ পৃ:৬৮

হাম্বলী মাযহাবের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ এ ইমামদের কথা থেকে সুস্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে, হাম্বলী মাযহাবে ‘অপবিত্র অবস্থায় কোরআন শরীফ স্পর্শ করা’ জায়েয নেই’।

শাফেয়ী মাযহাবের মত:

ইমাম আবু জাকারিয়া নববী শাফেয়ী র:
واستدل أصحابنا بالحديث المذكور وبأنه قول علي وسعد بن أبي وقاص وابن عمر – رضي الله عنهم -، ولم يعرف لهم مخالف في الصحابة
অর্থ: পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা নিষেধ বক্তব্যটি হযরত আলী রাঃ এবং সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রাঃ এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ দের। এ মতের উল্টো কোন মত সাহাবাগণ থেকে বর্ণিত নয়
সূত্র: আল মাজমু খ:২ পৃ:৯০

আবু আব্দিল্লাহ উসমানী শাফেয়ী র:
لا يجوز مس المصحف ولا حمله لمحدث بالإجماع
অর্থ: সর্বসম্মতিক্রমে অপবিত্র ব্যক্তির জন্য কোরআন শরীফ স্পর্শ করা এবং উঠানো জায়েয নেই।
সূত্র: রহমাতুল উম্মাহ পৃ:২১

ইমাম আবু আব্দিল্লাহ হালিমী শাফেয়ী র:
فثبت ان المطهرين من الناس هو الذي ينبغي له ان يمس المصحف والمحدث ليس كذلك
অর্থ: (আয়াত থেকে) এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, পবিত্র মানুষই কোেআন স্পর্শ করতে পারবে, যারা অপবিত্র তারা পারবে না।
সূত্র: মারিফাতুস সুনান (বায়হাকী) খ:১ পৃ:১৮৭

শাফেয়ী মাযহাবের এ তিনজন ইমামের লেখা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট ভাবে বলা যায় যে, শাফেয়ী মাযহাবেও ওযু ছাড়া বা অপবিত্র অবস্থায় কোরআন শরীফ স্পর্শ করা জায়েয নয়।

মালেকী মাযহাবের মত:

১. হাফেজ ইবনে আব্দিল বার মালেকী র: বলেন,
أجمع فقهاء الأمصار الذين تدور عليهم الفتوى وعلى أصحابهم بأن المصحف لا يمسه إلا الطاهر،
অর্থ: সমগ্র পৃথিবীর সকল ফক্বীহগণ ও তাদের অনুসারীগণ একমত এবং এর উপরই সকলে ফাতওয়া প্রদান করে থাকেন যে, কুরআনে কারীম পবিত্র হওয়া ছাড়া স্পর্শ করা জায়েজ নেই
সূত্র: আল ইস্তেযকার খ:৮ পৃ:১০

তিনি আরো বলেন,
ولم يختلف فقهاء الأمصار بالمدينة والعراق والشام أن المصحف لا يمسه إلا الطاهر على وضوء وهو قول مالك
অর্থ: এবং মাদীনা,ইরাক ও শাম দেশের যুগের কোন ফকীহ এ ব্যাপারে ভিন্ন মত গ্রহণ করেননি যে, ‘অপবিত্র ব্যাক্তি কোরআন স্পর্শ করতে পারবে না’। আর এটাই ইমাম মালেক র: এর মত।
সূত্র: আত তামহীদ খ:১৭ পৃ:৩৯৭

২. ফক্বীহ আবু খাত্তাব উন্দুলুসী মালেকী র: বলেন,
ولم يختلف فقهاء الأمصار بالمدينة والعراق والشام أن المصحف لا يمسه إلا الطاهر على وضوء وهو قول مالك
অর্থ: এবং মাদীনা,ইরাক ও শাম দেশের যুগের কোন ফকীহ এ ব্যাপারে ভিন্ন মত গ্রহণ করেননি যে, ‘অপবিত্র ব্যাক্তি কোরআন স্পর্শ করতে পারবে না’। আর এটাই ইমাম মালেক র: এর মত।
সূত্র: আদাউ মা ওয়াজাব পৃ:১৭১

৩. ইবনে ওয়াহাব র: বলেন,
ﻗﺎﻝ ﻣﺎﻟﻚ ﻻ ﻳﺤﻤﻞ ﺍﻟﻤﺼﺤﻒ ﺑﻌﻼﻗﺘﻪ ﻭﻻ ﻋﻠﻰ ﻭﺳﺎﺩﺓ ﺃﺣﺪ ﺇﻻ ﻭﻫﻮ ﻃﺎﻫﺮ
অর্থাৎ ইমাম মালিক র: বলেছেন, পবিত্র ব্যক্তি ব্যতিত গিলাফ কিংবা বালিশের মাধ্যমেও কেউ যেন কোরআন স্পর্শ না করে।
সূত্র:আল মাসাহিফ (আবু দাউদ)- ৭৫৮ আল-মুহাল্লা খ: ১ পৃ:৯৯ আল-ইস্তিযকার খ:১ পৃ: ১১

মালেকী মাযহাবের গুরুত্বপূর্ণ এ ইমামদের কথা দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, মালেকী মাযহাবেও ওযু ছাড়া বা পবিত্রতা ছাড়া কোরআন স্পর্শ করা জায়েয নয়।

হানাফী মাযহাবের অভিমত:

১. ইমাম আলাউদ্দীন কাসানী হানাফী র: বলেন,
ﻻ ﻳﺠﻮﺯ ﻟﻠﻤﺤﺪﺙ ﺃﺩﺍﺀ ﺍﻟﺼﻼﺓ ﻟﻔﻘﺪ ﺷﺮﻁ ﺟﻮﺍﺯﻫﺎ ﻭﻫﻮ ﺍﻟﻮﺿﻮﺀ ﻗﺎﻝ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻻ ﺻﻼﺓ ﺇﻻ ﺑﻮﺿﻮﺀ ﻭﻻ ﻣﺲ ﺍﻟﻤﺼﺤﻒ ﻣﻦ ﻏﻴﺮ ﻏﻼﻑ ﻋﻨﺪﻧﺎ
অর্থ: নামায বৈধ হওয়ার মৌলিক শর্ত “ওযু” না থাকার কারনে ওযুবিহীন ব্যক্তির জন্য নামায আদায় বৈধ নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ওযু ব্যতিত কোন নামায নেই। তেমনি ভাবে, আমাদের নিকট ওযুবিহীন ব্যক্তির জন্য গিলাফ ব্যতিত কোরআন স্পর্শ করাও জায়েয নেই।
সূত্র: বাদাইউস সানায়ি খ: ১ পৃ:৩৪

২. ইমান যায়নুদ্দীন ইবনে নুজাইম হানাফী র: বলেন,
وإن جعلتها صفة للقرآن فالمعنى لا ينبغي أن يمسه إلا من هو على الطهارة من الناس
অর্থাৎ উক্ত আয়াতটি যদি কোরআন সম্পর্কিত হয়,তাহলে এর অর্থ হলো, কোন মানুষ পবিত্রতা ছাড়া কোরআন স্পর্ষ করা জায়েয হবে না।
সূত্র: আল বাহরুর রায়েক খ:১ পৃ:২১২ ফাতহুল কাদীর খ:১ পৃ:১৬৯

৩. আল্লামা শামী র: সুরা ওয়াকিয়ার আয়াতটির ব্যাখ্যা উল্লেখ্য করে বলেন,
وَعَلَى الثَّانِي الْمُرَادُ مِنْهُمْ النَّاسُ الْمُطَهَّرُونَ مِنْ الْأَحْدَاثِ وَعَلَيْهِ أَكْثَرُ الْمُفَسِّرِين
অর্থাৎ ‘পবিত্র সত্তাসমূহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ সকল মানুষ যারা নাপাকী থেকে পবিত্র। আর অধিকাংশ মুফাসসিরদের মত এটাই।
সূত্র: রদ্দুল মুহতার খ:১ পৃঃ৯৬

৪. মাম বুরহানুদ্দীন মারগিনানী হানাফী র:
ﻭﻟﻴﺲ ﻟﻠﺤﺎﺋﺾ ﻭﺍﻟﺠﻨﺐ ﻭﺍﻟﻨﻔﺴﺎﺀ ﻗﺮﺍﺀﺓ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻭﻟﻴﺲ ﻟﻬﻢ ﻣﺲ ﺍﻟﻤﺼﺤﻒ ﺇﻻ ﺑﻐﻼﻓﻪ ﻭﻻ ﺃﺧﺬ ﺩﺭﻫﻢ ﻓﻴﻪ ﺳﻮﺭﺓ ﻣﻦ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﺇﻻ ﺑﺼﺮﺗﻪ ﻭﻛﺬﺍ ﺍﻟﻤﺤﺪﺙ ﻻ ﻳﻤﺲ ﺍﻟﻤﺼﺤﻒ ﺇﻻ ﺑﻐﻼﻓﻪ
অর্থ: হায়েযা, জুনুবি ও নেফাসগ্রস্থ মহিলার জন্য কোরআন তিলাওয়াত করা নিষেধ। এবং তাদের জন্য গিলাফ ব্যতিত কোরআন ধরা বা এমন কোন দিরহাম স্পর্শ করাও বৈধ নয়, যেখানে কোরআনের কোন সুরাহ লিখা রয়েছে। হা, যদি সেই দিরহাম থলের ভেতর থাকে, তাহলে থলেসহ তা ধরা যেতে পারে। একই বিধান, ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যার ওযু নেই। তার জন্য গিলাফ ব্যতিত বিনা অযুতে কোরআন স্পর্শ করা জায়েজ নেই।
সূত্র: বিদায়াতুল মুবতাদি খ: ১ পৃ: ৮ আলবাহরুর রায়িক খ: ১ পৃ: ২০১  শরহুন নুকায়া খ:১ পৃ: ৮৬ মুলতাকাল আবহুর খ: ১ পৃ:৮১

হানাফী মাযহাবের গুরুত্বপূর্ণ এ ইমামগণের লেখা থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে, ওযু ছাড়া বা অপবিত্র অবস্থায় কোরআন শরীফ স্পর্শ করা হানাফী মাযহাবেও জায়েয নই।

ইবনে তাইমিয়া র: এর অভিমত:

যারা নিজেদেরকে লা-মাযহাবী পরিচয় দিতে ভালোবাসেন তারা কোন ইমামকে না মানলেও ইবনে তাইমিয়া র: কে খুব মান্য করে থাকেন। তাদের জন্য ইবনে তাইমিয়া র: মতটি উল্লেখ্য করা জরুরী মনে করছি। চলুন তাঁর অভিমতটি দেখা যাক।

واما مس المصحف فالصحيح انه يجب له الوضوء كقول الجمهور وهذا هو المعروف عن الصحابة سعد وسلمان وابن عمر
অর্থাৎ সহিহ কথা হলো কোরআন স্পর্শ করার জন্য ওযু করা ওয়াজীব।যেমনটি বলেছেন জুমহুরে ফুকাহা। আর এটাই সাহাবি সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা:,সালমান ফারসী রা: এবং ইবনে ওমর রা: থেকে প্রমাণিত।
সূত্র: মাজমুউ ফাতাওয়া খ:২১ পৃ:২৮৭

أن الذي في اللوح المحـفوظ هو القرآن الذي في المصحف كما أن الذي في هذا المصحف هو الذي في هذا المصحف بعينه سواء كان المحل ورقاً أو أديماً أو حجراً أو لحافاً فإذا كان مِنْ حكم الكتاب الذي في السماء أن لا يمسه إلا المطهرون وجب أن يكون الكتاب الذي في الأرض كذلك لأن حرمته كحرمته أو يكون الكتاب اسم جنس يعم كل ما فيه القرآن سواء كان في السـماء أو الأرض وقد أوحـــى إلى ذلك قوله تعالى: {رَسُولٌ مِنَ اللَّهِ يَتْلُو صُحُفاً مُطَهَّرَةً} [البينة:2]، وكذلك قوله تعالى: {فِي صُحُفٍ مُكَرَّمَةٍ  مَرْفُوعَةٍ مُطَهَّرَةٍ} [عبس:13-14]. فوصفها أنها مطهرة فلا يصلح للمحدث مسها

অর্থ: আমাদের কাছে যে কুরআন রয়েছে এটি সেই কুরআনই যা লৌহে মাহফুজে রয়েছে। যেমন কুরআন তাই, যা কুরআনের মাঝে রয়েছে, চাই তার স্থান পাতা হোক, বা চামড়া হোক, বা পাথর হোক বা মোড়ক হোক। সুতরাং আসমানে অবস্থিত লিখিত কিতাবের হুকুম যেহেতু তা পবিত্র ছাড়া কেউ স্পর্শ করে না, জমিনে থাকা কুরআনের ক্ষেত্রে একই বিধানকে আবশ্যক করে। কেননা, এ [জমিনে থাকা কুরআন] কুরআনের সম্মান সে [আসমানে থাকা কুরআন] কুরআনের মতই। অথবা আয়াতে কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য হল ইসমে জিনস। যা কুরআনকে বুঝাচ্ছে, চাই তা আসমানে থাকুক বা জমিনে থাকুক।
এদিকেই ইংগিত বহন করছে আল্লাহ তাআলার বাণী رَسُولٌ مِنَ اللَّهِ يَتْلُو صُحُفاً مُطَهَّرَةً তথা আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল; যিনি পবিত্র সহীফা তিলাওয়াত করেন। {সূরা বায়্যিনাহ-২} অন্যত্র এসেছে فِي صُحُفٍ مُكَرَّمَةٍ  مَرْفُوعَةٍ مُطَهَّرَةٍ অর্থাৎ সমুচ্চ এবং পবিত্র যা রয়েছে সম্মানিত সহীফায়। {আবাসা-১৩-১৪}

সুতরাং কোরআনের বৈশিষ্ট্য হলো পবিত্র হওয়া, সুতরাং কোন অপবিত্র ব্যক্তির জন্য স্পর্শ করা জায়েয হবে না।
সূত্র: শরহুল উমদাহ পৃ:৩৮৪

আশা করি ইবনে তাইমিয়া র: এর কথাটি ‘ওযু ছাড়া কোরআন ধরা যায়’ যারা বলেন,তাদের মুখ বন্ধ করতে সহায়ক হবে। তারপরও যদি তারা এ মতবাদটি প্রচার করেই যায়, তাহলে বিন বায এর মতবাদ তুলে ধরা যুক্তিসঙ্গত। চলুন তাঁরা কি বলেন দেখি।

বিন বায এর ফতাওয়া:

বর্তমানে অনেক লা-মাযহাবী বা সালাফীরা বিন বায র: কে খুব মান্য করে থাকেন। তাদের জন্য এ ফাতাওয়াটি লক্ষণী।  বিন বায র: বলেন,

لا يجوز للمسلم مس المصحف وهو على غير وضوء عند جمهور أهل العلم وهو الذي عليه الأئمة الأربعة وهو الذي كان يفتي به أصحاب النبي عليه الصلاة والسلام

অর্থাৎ জুমহুরে ফুকাহাদের নিকট অপবিত্র অবস্থায় কোরআন শরীফ স্পর্শ করা জায়েয নয়।এটাই চার মাযহাবের মত এবং এটাই নবিজি স: এর সাহাবাদের ফাতাওয়া ছিল।
সূত্র: মাজমুউ ফাতাওয়া খ:১০ পৃ:১৪৯-১৫০

উপরোক্ত আলোচনা গুলো দিয়ে আমরা এ বিষয়টির ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা পেলাম যে, ওযু ছাড়া বা অপবিত্র অবস্থায় কোরআন শরীফ স্পর্শ করা জায়েয নয়। এটা পবিত্র কোরআনের আয়াত, হাদিস,তাফসীর,সাহাবা,তাবেয়ীন ও সমস্ত মাযহাবের ফুকাহায়ে কেরামের মত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।

অমুসলিমদের কোরআন স্পর্শ করার হুকুম।

এ ব্যাপারে হানাফী মাযহাবের বিভিন্ন কিতাবে এসেছে,

النصراني اذا تعلم القرآن اي اراد تعلم القرآن يعلمه ويفهمه كذلك لانه عسي يهتدي لكن لا يمس المصحف واذا اغتسل ثم مسه لا بأس به

অর্থ: কোন খৃষ্টান যদি কোরআন শিখতে চায় তাহলে তাকে কোরআন শিখাবে এবং বুঝাবে। হয়তো সে হিদায়াত পাবে।তবে কোরআন স্পর্শ করতে দেয়া যাবে না। তবে যদি সে গোসল করে তাহলে অসুবিধা নেই।
সূত্র: ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া খ:১ পৃ:৩১১ দুররে মুহতার খ:১ পৃ:১৭৭ বাহরুর রায়েক খ:৮ পৃ:২৩১

মূলত এ ফাতাওয়াটি হাদিস থেকেই নেয়া হয়েছে।হযরত আনাস রা: থেকে উমর রা: এর বর্ণিত ঘটনা:

َ عن أنس بن مالك….فقالت له اخته انك رجس ولا يمسه الا المطهرون فقم فاغتسل

অর্থাৎ হযরত ওমর রাঃ যখন কাফের থাকা অবস্থায় বোনকে কুরআন দেখাতে বলেছিলেন, তখন তার বোন বলেছিলেন যে, তুমি নাপাক! আর এ গ্রন্থ পবিত্র ছাড়া কেউ ধরতে পারে না। অতএব তুমি যাও গোসল করো।
সূত্র: মুস্তাদরাকে হাকেম হাদিস-6897  মুসনাদুল বাজ্জার খ:১ পৃ:৪০১ সুনানে দারা কুতনী খ:১ পৃ:১২১ সুনানুল কুবরা (বায়হাকী) খ:১ পৃ:৮৭ 377

অমুসলিমদের কেউ কোরআন শিখতে চাইলে তাকে শুধু শোনানো যাবে। এ কথা আয়াতে কারীমায় আসছে।মহান আল্লাহ বলেন,
وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلاَمَ اللّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لاَّ يَعْلَمُونَ
অর্থ: আর যদি মুশরিকদের কেউ তোমার কাছে আশ্রয় চায়, তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনে, অতঃপর তাকে পৌঁছিয়ে দাও তার নিরাপদ স্থানে। তা এই জন্য যে, তারা এমন এক কওম, যারা জানে না। (সুরা তাওবা আয়াত-৬)

উক্ত আয়াত থেকে বোঝা গেল অমুসলিমদের কোরআন শোনার অনুমতি দেয়া যাবে। তবে স্পর্শ করার সুযোগ দেয়ার কথা আল্লাহ বলেননি।

তবে এখানে দু’টি কথা লক্ষণীয়:

১. অমুসলিমরা নিজ থেকে যদি কোরআন ধরে সেটা তাদের ব্যাপার। এজন্য মুসলমানরা গুনাহগার হবে না। কারণ সে তাকে ধরতে বলেনি বা জানেনা। অতএব কোন অমুসলিম নিজ থেকে ধরলে সেটা তার ব্যাপার। তারা ঈমান আনার আগে তো ইসলামি বিধিবিধানের মুকাল্লাফই নয়।

২. কোন চিঠিতে কোরআনের আয়াত থাকলে সেটা ওযু ছাড়া ধরা যাবে। কারণ সেটা চিঠি, কোরআন নয়। তবে সে ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়, যেন আয়াতের উপর হাত না লাগে।

আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে পবিত্র কোরআনের মর্যাদা রক্ষা করার তাওফীক দান করেন। আমিন!

লেখক:

মুফতী রিজওয়ান রফিকী

পরিচালক- মাদরাসা মারকাযুন নূর বোর্ড বাজার,গাজীপুর।

Check Also

IMG 20210523 215847

ওযুতে ঘাড় মাসাহ করা কি বিদ’আত?

ওযুতে ঘাড় মাসাহ করা মুস্তাহাব। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে তথাকথিত আহলে হাদিস মতবাদের কিছু ভাই এটাকে …

One comment

  1. পবিত্র অবস্থায় কুরআন পড়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অনেকেরই কাজে লাবগে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.