যদি কোনো ব্যক্তি টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে চায়, তাহলে সেটা জায়েয আছে। যদি সম্প্রতিকালে কিছু নবাগত শায়খরা এটাকে নাজায়েয বা বিদআদ বলে ফাতাওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু এসমস্ত বক্তব্যগুলো তারা দিচ্ছে একান্তই মনগড়াভাবে। চলুন এ ব্যাপারে কিছু দলীলাদী দেখে নেয়া যাক।
পবিত্র কুরআন থেকে।
মহান আল্লাহ বলেন,
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً
অর্থাৎ তাদের সম্পত্তি থেকে সাদাকা গ্রহণ কর।
সূরা তাওবা আয়াত: ১০৩
উক্ত আয়াতে বলা ‘সম্পত্তি’ শব্দটি মুতলাক বা ব্যাপক। সুতরাং শুধুমাত্র শস্য দিয়েই ফিতরা দিতে হবে, এভাবে মুকায়য়াদ বা শর্তযুক্ত করা আয়াতটির সঠিক ব্যাখ্যা নয়।
একটি অভিযোগ
যদি কেউ দাবী করে বসেন যে, উক্ত আয়াতটি তো যাকাতের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে।
জবাব:
যাকাতের মালের ক্ষেত্রে যদি দ্রব্যের পরিবর্তে টাককা দেয়া যায়, তাহলে নিচু মানের যাকাতুল ফিতর তথা ফিতরা দ্রব্যের পরিবর্তে টাকা দ্বারা জায়েজ হবে না কেন?
পবিত্র হাদিস থেকে।
সাহাবায়ে কেরামের রা. আমল:
ক. হযরত ওমর রা. এর অভিমত:
عن عطاء ، قال كان عمر بن الخطاب يأخذ العروض في الصدقة من الدراهم
অর্থ: হযরত ওমর রা. ফিতরা হিসাবে দিরহাম (টাকা) গ্রহণ করতেন।
সূত্র: আল মুগনী খ. ৩ পৃ. ৬৫ মুসান্নাফে আব্দির রাজ্জাক: ৭১৩৪ দারেকুতনী খ. ২ পৃ. ১৫২
খ. হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. এর আমল:
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، أَنَّ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَعَثَهُ إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ ” خُذِ الْحَبَّ مِنَ الْحَبِّ وَالشَّاةَ مِنَ الْغَنَمِ وَالْبَعِيرَ مِنَ الإِبِلِ وَالْبَقَرَةَ مِنَ الْبَقَرِ
অর্থ: হযরত মু‘আয ইবনু জাবাল রা. সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ইয়ামানে প্রেরণের সময় বললেন, ফসল থেকে ফসল, বকরীপাল থেকে বকরী, উটপাল থেকে উষ্ট্রী, গরুর পাল থেকে গাভী যাকাত বাবদ গ্রহণ করবে।
সূত্র: সুনানে আবু দাউদ হাদিস: ১৫০০
উক্ত হাদিস থেকে জানা গেলো যে, নবীজি সা. হযরত মুয়াজ রা. কে যাকাত আদায়ের জন্য সরাসরি দ্রব্য বা পশু নিতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি কি নিয়েছিলেন, সেটা অন্য হাদিসে এসেছে। হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. এর আমল ইমাম বুখারী তালীকান তাঁর সহিহ বুখারীতে উল্লেখ্য করেছেন।
َقَالَ مُعَاذٌ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ لأَهْلِ الْيَمَنِ ائْتُونِي بِعَرْضٍ ثِيَابٍ خَمِيصٍ أَوْ لَبِيسٍ فِي الصَّدَقَةِ، مَكَانَ الشَّعِيرِ وَالذُّرَةِ أَهْوَنُ عَلَيْكُمْ، وَخَيْرٌ لأَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْمَدِينَةِ
অর্থাৎ হযরত মু‘আয ইবনে জাবাল রা. ইয়ামানবাসীদেরকে বললেন, তোমরা যব ও ভুট্টার পরিবর্তে চাদর বা পরিধেয় বস্ত্র আমার কাছে যাকাত স্বরূপ নিয়ে এসো। ওটা তোমাদের পক্ষেও সহজ এবং মদিনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সাহাবীগণের জন্যও উত্তম।
সূত্র: সহীহ বুখারী খ. ১ পৃ. ১৯৪
উক্ত হাদিস দ্বারা দুটি বিষয় ক্লিয়ার হলো-
১. ফিতরা প্রদানকারীর জন্য কোন জিনিষটি সহজ, সেটার দিকে খেয়াল করা।
২. ফিতরা গ্রহীতার জন্য কোন জিনিষটি উপযোগী সেটার দিকে গুরুত্ব দেয়া।
আর এ বিষয়টি খেয়াল রেখেই হযরত মুয়াজ ইবনে জানাল রা. ইয়ামানবাসীদেরকে যবের পরিবর্তে কাপড় দিতে বলেছিলেন। কারণ সকল সাহাবায়ে কেরাম নবীজি সা. এর মেজাজ বুঝতেন। আর সে মেজাজটা বুঝেই সাহাবায়ে কেরাম রা. সে অনুযায়ী আমল করতেন। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, আমরা সাহাবায়ে কেরাম রা. এর চেয়েও নবীজির সা. মেজাজ বেশি বুঝতে যাচ্ছি। আর তখনই হচ্ছে সমাজে ফিৎনা।
তাবেয়ীদের আমল:
আবু ইসহাক রহ. এর বক্তব্য:
عَنْ زُهَيْرٍ قَالَ سَمِعْتُ أَبَا إِسْحَاقَ يَقُولُ أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدَّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطَّعَامِ
অর্থ: হযরত যুহাইর রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত আবূ ইসহাক রহ. থেকে শুনেছি তিনি বলেছেন,আমি হযরত সাহাবায়ে কেরামকে রা. এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তাঁরা পবিত্র রমাযান মাসে সাদাকায়ে ফিতর খাবারের বিনিময়ে দিরহাম বা টাকা দ্বারা আদায় করতেন।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ বর্ণনা: ১০৪৭২
হাসান বসরী রহ. এ বক্তব্য
হযরত হিশাম রহ. বলেন,
عَنِ الْحَسَنِ قَالَ لاَ بَأْسَ أَنْ تُعْطِيَ الدَّرَاهِمَ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ
অর্থ: হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন, দিরহাম বা টাকা দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করার দ্বারা কোনো সমস্যা নেই।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ বর্ণনা: ১০৪৭১
ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. এর আমল:
কুররা রহ. বলেন,
جَاءَنَا كِتَابُ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيزِ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ نِصْفُ صَاعٍ عَنْ كُلِّ إنْسَانٍ أَوْ قِيمَتُهُ نِصْفُ دِرْهَمٍ
অর্থাৎ আমাদের কাছে উমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ. এর চিঠি পৌঁছেছে যে, সদাকাতুল ফিতর হচ্ছে প্রত্যেক (সামর্থ্যবান) ব্যক্তির পক্ষ হতে ‘অর্ধ-সা’ (গম) কিংবা তার মূল্য হিসাবে অর্ধ দিরহাম প্রদান করা।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ বর্ণনা: ১০৪৭০
প্রিয় পাঠক, সাহাবী-তাবেয়ীদের উপরোক্ত আসারসমূহকে সামনে রেখে হানাফী মাযহাবের ইমামগণসহ ইমাম বুখারী রহ. আরো অনেকে মূল্য দ্বারা সদাকাতুল ফিতর আদায় করা জায়েয বলেছেন। এটি সাহাবাদের যুগ থেকেই স্বীকৃত মাসআলা। সুতরাং এ নিয়ে সংশয়-সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং সাহাবায়ে কেরাম রা. সহ তাবেয়ীনদের অভিমতও ছুঁড়ে ফেলে দিতে চান তারা কারা?
যুক্তির দাবি:
উপরন্তু ফিতরা দেওয়ার মূল কারণ হলো, গরীব মানুষের অসহায়ত্ব দূর করা। প্রমাণ হলো,
১. হযরত ইবনু ‘আব্বাস রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন,
فَرَضَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِينِ
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদাকাতুল ফিতর ফারয করেছেন- অশ্লীল কথা ও বেহুদা কাজ হতে (রমাযানের) সওমকে পবিত্র করতে এবং মিসকীনদের খাদ্যের ব্যবস্থার জন্য।
সূত্র: সুনান আবু দাউদ হাদিস: ১৬০৯
যেহেতু গরীব-মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা করা ফিতনার মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং তাদেরকে যব,আটা না দিয়ে টাকা দিলে তারা তাদের রুচিসম্মত খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে। এতে তাদের জন্য উপযোগী খাবারের ব্যবস্থা তারা করে নিতে পারবে।
আচ্ছা বলুন তো, যে ব্যক্তি যব বা আটা খান না, তাকে এটা দিলে কি ফায়দা হবে? এরচে তাকে টাকা দিলে কি উপকারটা ব্যাপক হলো না? নিশ্চয়। তাহলে যে এলাকায় যে জিনিষটি দিলে গরীব-দুঃখীদের উপকার হয়, সেখানে সেটা দিয়েই ফিতরা দেওয়া উচিৎ।
২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, নবীজি সা. বলেছেন,
أغنُوهم عن السُّؤالِ في هذا اليَومِ
অর্থাৎ ঈদের দিনে (ফিতরা দিয়ে) গরীব-মিসকিনদেরকে সাহায্য নির্ভরহীন, সমৃদ্ধ করে দাও।
সূত্র: তালখিসুল হাবির খ. ২ পৃ. ৩৫২
সুতরাং বুঝা গেল, যেহেতু যাকাত-ফিতরার মূল উদ্দেশ্য হলো গরীব-মিসকিনদেরকে সাহায্যের হাত পাতানো থেকে বিরত রাখা, সুতরাং তাদের যে জিনিষটি দিলে এই মহান উদ্দেশ্য সফল হয়, সেটাই করা উচিৎ। আর এটা সুস্পষ্ট কথা যে, টাকা দিলে তারা তাদের প্রয়োজন সারতে পারবে।
হাদিস ও ফিকহের ইমামদের অভিমত:
ইমাম বুখারীর উস্তাযের অভিমত:
ইমাম বুখারীর রহ. উস্তায ইবনু আবি শায়বা রহ. তার মুসান্নাফে একটি শিরোনাম দিয়েছেন,
فِي إِعْطَاءِ الدَّرَاهِمِ فِي زَكَاةِ الْفِطْرِ
অর্থাৎ দিরহাম (টাকা) দিয়ে ফিতরা দেওয়ার বৈধতা নিয়ে’।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা খ. ২ পৃ. ৩৯৮
অর্থাৎ তিনি টাকা দিয়ে ফিতরা দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। যা তার শিরোনামেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
ইমাম বুখারীর রহ. মত:
এ ব্যাপারে খোদ ইমাম বুখারী রহ. তার সহিহ বুখারীতে শিরোনাম দিয়েছেন بَابُ الْعَرْضِ فِي الزَّكَاةِ এ শিরোনামের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সহিহ বুখারীর ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারীর’ লেখক ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,
أَيْ جَوَازُ أَخْذِ الْعَرْضِ
অর্থাৎ টাকা দিয়ে (ফিতরা) বৈধ হওয়া প্রসঙ্গে।
সূত্র: ফাতহুল বারী খ. ৪ পৃ. ২৮০
বুঝা গেল ইমাম বুখারী রহ. নিজেও টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করার বৈধতার পক্ষে ছিলেন। এজন্য ইবনে হাজার আসকালানী রহ. আল্লামা ইবনু রাশীদ রহ. এর উক্তি তিনি নকল করে বলেন,
وَافَقَ الْبُخَارِيُّ فِي هَذِهِ الْمَسْأَلَةِ الْحَنَفِيَّةَ
অর্থ: উক্ত মাসয়ালাটির মাঝে ইমাম বুখারী রহ. হানাফীদের সাথে সহমত পোষন করেছেন।
সূত্র: ফাতহুল বারী লি ইবনে হাজার খ. ৩ পৃ. ৩১২
অর্থাৎ ইমাম বুখারী নিজেও টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
সুতরাং এরপরও যে সকল শায়খগণ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ের পক্ষে কথা বলেন, তাদের কথায় তো তাহলে ইমাম বুখারী নিজেও বিদআতী! হায় জাহালাত, হায় মুর্খতা।
এ বিষয়ে আহমদ আল গুমারী রহ. এর আরবী ভাষায়
تحقيق الامال فى فى اخراج زكوة الفطر بالمال
নামে ১৫০ পৃষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি কিতাব লিখেছেন। পাশাপাশি হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য ফাতাওয়ার কিতাব বিশেষ করে বাদায়েউস সানায়ে এবং আল মাবসুত মুতালাআ করা জরুরী। মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সকল ফিৎনা থেকে হিফাযত করুন। আমীন!