Home > ভ্রান্ত মতবাদ > ওযুতে ঘাড় মাসাহ করা কি বিদ’আত?

ওযুতে ঘাড় মাসাহ করা কি বিদ’আত?

ওযুতে ঘাড় মাসাহ করা মুস্তাহাব। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে তথাকথিত আহলে হাদিস মতবাদের কিছু ভাই এটাকে বিদআত বলে প্রচার করে সমাজে বিভ্রান্তী ছড়াচ্ছেন। চলুন এ বিষয়ে আমরা সুস্পষ্ট ধারণা নিই। প্রথমে কিছু হাদিস দেখা যাক।

হাদিস: ১

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনু যায়দ রা. নবীজি সা. ওযু কিভাবে করতেন, সেটা দেখাতে গিয়ে এক পর্যায়ে দেখালেন,

ثُمَّ مَسَحَ رَأْسَهُ بِيَدَيْهِ فَأَقْبَلَ بِهِمَا وَأَدْبَرَ بَدَأَ بِمُقَدَّمِ رَأْسِهِ حَتَّى ذَهَبَ بِهِمَا إِلَى قَفَاهُ ثُمَّ رَدَّهُمَا إِلَى الْمَكَانِ الَّذِي بَدَأَ مِنْهُ، ثُمَّ غَسَلَ رِجْلَيْهِ‏

অর্থাৎ তারপর দু’হাত দিয়ে মাথা মাসাহ করলেন। অর্থাৎ হাতদু’টি সামনে এবং পেছনে নিলেন। মাথার সম্মুখ ভাগ থেকে শুরু করে উভয় হাত পেছনের চুলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিলেন। তারপর আবার যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, সেখানেই ফিরিয়ে আনলেন। তারপর দু’পা ধুলেন।
সূত্র: সহীহ বুখারী হাদিস: ১৮৫

প্রিয় পাঠক, উল্লেখিত হাদিসটি বুঝতে সুরা মায়েদার ৬ নং আয়াতের দিকে একটু নজর বুলাতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فاغْسِلُواْ وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُواْ بِرُؤُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَينِ

অর্থাৎ হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং মাথা মাসাহ করো এবং পদযুগল গিট পর্যন্ত ধৌত করো।

এখানে খেয়াল করুন, আমরা সবাই জানি অত্র আয়াতে “কনূই পর্যন্ত হাত ধোয়া” অথবা “টাখনু পর্যন্ত পা ধোয়া” বলতে “কনূই সহ’ হাত ধোয়া অথবা ‘টাখনুসহ’ পা ধোয়া বোঝায়।

ঠিক তেমনি অালোচ্য হাদীসে “নবীজি সা. ঘাড় পর্যন্ত’ মাসাহ করতেন” বলতে অবশ্যই “ঘাড়সহ’ই মাসাহ করা” বুঝায়। যা নিচের ২য় হাদিসে আরও স্পষ্ট হয়ে যায়।

হাদিস-২

عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ مَعْدِيكَرِبَ، قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم تَوَضَّأَ فَلَمَّا بَلَغَ مَسْحَ رَأْسِهِ وَضَعَ كَفَّيْهِ عَلَى مُقَدَّمِ رَأْسِهِ فَأَمَرَّهُمَا حَتَّى بَلَغَ الْقَفَا ثُمَّ رَدَّهُمَا إِلَى الْمَكَانِ الَّذِي بَدَأَ مِنْهُ

অর্থাৎ মিকদাদ ইবনু মাদীকারাব রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উযু করতে দেখেছি। উযু করতে করতে যখন মাথা মাসেহ্ পর্যন্ত পৌছান, তখন তিনি এভাবে মাথা মাসেহ্ করেন যে, উভয় হাতের তালু মাথার সামনের অংশে স্থাপন করে তা ক্রমান্বয়ে মাথায় পশ্চাদভাগ ( ঘাড়ের সংযোগস্থান)
পর্যন্ত নেন। অতঃপর তিনি পেছনের দিক হতে সামনের দিকে তা শুরুর স্থানে ফিরিয়ে আনেন
সূত্র: সুনানে আবু দাউদ হাদিস: ১২২

হাদিসটির মান:
ইমাম আবু দাউদ রহ. হাদিসটি সহিহ সনদে বর্ণনা করেছেন। উপরন্তু আহলে হাদিসের মান্যবর ইমাম শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. ও হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
সূত্র: সহিহ আবু দাউদ (আলবানী) ১২২

সুতরাং “ঘাড় মাসাহ করা বিদআত” বলাটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? চলুন আরও সুস্পষ্টভাবে হাদিস দেখে নেয়া যাক।

হাদিস-৩

عن نافع عن ابن عمر أن النبي صلى الله عليه وسلم قال  من توضأ ومسح بيديه على عنقه وقي الغل يوم القيامة

অর্থ: নাফে হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অজু করে এবং উভয় হাত দিয়ে গর্দান মাসাহ করে, তাহলে তাকে কিয়ামতের দিন [আযাবের] বেড়ি থেকে বাঁচানো হবে।
সূত্রঃ- নাইলুল অাওতার খ: ১ পৃষ্টা:
২০৬

হাদিসটির মান:

ইমাম আবুল হাসান ফারেছ রহ. বলেন-

هَذَا إنْ شَاءَ اللَّهُ حَدِيثٌ صَحِيحٌ

অর্থাৎ ইনশাআল্লাহ হাদীসটি সহীহ।
সূত্রঃ- নাইলুল অাওতার খ: ১ পৃষ্টা:
২০৬

হাদিস-৪

ﻋﻦ ﻣﻮﺳﻰ ﺑﻦ ﻃﻠﺤﺔ ﻗﺎﻝ ﻣﻦ ﻣﺴﺢ ﻗﻔﺎﻩ ﻣﻊ ﺭﺃﺳﻪ ﻭﻗﻲ ﺍﻟﻐﻞ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﺎﻣﺔ

অর্থাৎ মুসা ইবনে তালহা থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি মাথার সাথে গর্দানকেও মাসেহ করবে,ক্বিয়ামতের দিন জান্নামের বেড়ী পড়ানো থেকে তাকে মুক্ত রাখা হবে”
সূত্র: তালখীসুল হাবীর খ:১ পৃ: ১৬২ নাইলুল অাওতার খ: ১ পৃষ্টা: ২০৩

হাদিসটির মান:

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেন,

فيحتمل أن يقال هذا وإن كان موقوفا فله حكم الرفع لان هذا لا يقال من قبل الرأي فهو على هذا مرسل

অর্থাৎ বর্ণনাটি সম্পর্কে একথা বলা যায় যে, যদিও তা মাওকুফ (একজন তাবেয়ীর কথা) হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা মারফুউ (রাসূলুল্লাহ সাঃ এর হাদীস) হিসাবে গণ্য হবে। কেননা, তিনি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এমন সংবাদ দেওয়া সম্ভব নয়।
সূত্র: তালখীসুল হাবীর খ:১ পৃ: ১৬২ নাইলুল অাওতার খ: ১ পৃষ্টা:২০৩

হাদিস: ৫

عن أنس بن سيرين عن ابن عمر أنه كان إذا توضأ مسح عنقه ويقول قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من توضأ ومسح عنقه لم يغل بالأغلال يوم القيامة

অর্থ: অানাস ইবনে সিরিন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণনা করেন যে, যখন ইবনে ওমর
রা. ওযু করতেন, তখন ঘাড় মাসাহ করতেন
এবং তিনি বলতেন, রাসুল সা. বলেছেন,
যে ব্যক্তি ওযু করবে এবং ঘাড় মাসাহ
করবে কিয়ামতের দিন তার গলায় বেড়ী
পরানো হবে না।
সূত্রঃ- নাইলুল অাওতার খ: ১ পৃষ্টা:
২০৬

হাদিস-৬

عَنْ طَلْحَةَ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَوَضَّأَ فَمَسَحَ رَأْسَهُ هَكَذَا وَأَمَرَّ حَفْصٌ بِيَدَيْهِ عَلَى رَأْسِهِ حَتَّى مَسَحَ قَفَاهُ

অর্থ: হযরত তালহা তিনি তার পিতা, তিনি তার দাদারসূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি অজু করছেন। তখন তিনি এভাবে মাথা মাসাহ করেছেন। উভয় হাতকে জমা করে পাস কাটিয়ে তা দিয়ে গর্দান মাসাহ করতেন।
সূত্র: মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা খ: ১ পৃ: ২৯১ হাদীস: ১৫০

হাদিস-৭

عن مجاهد عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ إِذَا مَسَحَ رَأْسَهُ مَسَحَ قَفَاهُ مَعَ رَأْسِهِ

হযরত ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি যখনি মাথা মাসাহ করতেন, তখন মাথা মাসাহের সাথে গর্দানও মাসাহ করতেন।
সূত্র: সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী٧ হাদীস নং-২৭৯

হাদিস: ৮

عن طلحة بن مصرف عن أبيه عن جده قال رأيت النبي صلى الله عليه وسلم مسح مقدم رأسه حتى بلغ القذال ( مؤخر الرأس ) من مقدم عنقه

অর্থ: হযরত তালহা বিন মুসাররিফ রহ. তার
পিতা থেকে তিনি তার দাদা থেকে
বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূল্লাহ সা.
কে তাঁর মাথার অগ্রভাগ মাসেহ করতে দেখেছেন। এমন কি গর্দানের উপরিভাগ পর্যন্ত মাসাহ
করতে দেখেছেন।
সূত্র: শরহে মানিল আছার (ত্বহাবী) হাদীস নং ১২৯

হাদিস-৯

ওয়ায়েল বিন হুজর রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে নবীজি সা. এর ওযু করার আলোচনায় বর্ণিত হয়েছে,

ثُمَّ مَسَحَ رَقَبَتَهُ

অর্থাৎ অতঃপর তিনি তাঁর ঘাড় মাসাহ করলেন।
সূত্র: মু’জামে কাবীর (তবরানী) হাদিস: ১১৮

হাদিস-১০

عَنْ كَعْبَ بْنَ عَمْرٍو قَالَ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَوَضَّأَ فَمَسَحَ بَاطِنَ لِحْيَتِهِ وَقَفَاهُ

অর্থ: হযরত কা‘ব বিন আমর রা. বলেছেন, আমি নবী করীম সা. কে দেখেছি তিনি ওযূ করলেন, এরপর তিনি তার দাঁড়ির অভ্যন্তরভাগ এবং ঘাড় মাসাহ করলেন।
সূত্র: মু’জামে কাবীর (তবরানী) হাদিস: ৪১২

আহলে হাদিসের অভিযোগ:

প্রিয় পাঠক, ওযুতে ঘাড় মাসাহ করার ব্যাপারে উপরোক্ত হাদিসগুলো যখন আমরা পেশ করে থাকি, তখন আহলে হাদিসের ভাইয়েরা অভিযোগ বসেন যে, উক্ত হাদিসগুলো সব যয়ীফ বা দুর্বল। সুতরাং যয়ীফ হাদিসের উপর আমল করা বিদআত।

জবাব:

আমরা যদি ধরেও নিই যে, “ওযুতে ঘাড় মাসাহের ব্যাপারে যত হাদিস বর্ণিত হয়েছে সব হাদিস যয়ীফ” তবুও ঘাড় মাসাহকে বিদ’আত বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সকল উলামায়ে হাদিসের নিকট যয়ীফ হাদিসের উপর আমল করা জায়েয রয়েছে। খোদ আহলে হাদিসের ফাতাওয়ার কিতাবে বর্ণিত হয়েছে,

حدیث ضعیف سے جو موضوع نہ ہو استحباب و جواز ثابت ہوتا ہے

অর্থাৎ যেটা জাল নয় এমন যয়ীফ হাদিস দ্বারা (যেকোনো আমল) মুস্তাহাব এবং জায়েয প্রমাণ হয়।
সূত্র: ফাতাওয়ায়ে উলামায়ে হাদিস খ: পৃ: ২১৭

সুতরাং হাদিসগুলো যয়ীফ হলেও “ওযুতে ঘাড় মাসাহকে বিদআত” বলার কোনো সুযোগ রইল না।

ইমামদের অভিমত

আহমাদ বিন হাম্বল রহ. এর আমল:

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর ছেলে আব্দুল্লাহ বলেন,

رأيته إذا مسح برأسه وأذنيه مسح قفاه

অর্থাৎ আমি তাকে (আমার পিতাকে) দেখেছি (অযুতে) যখন তিনি মাথা এবং কান মাসেহ করতেন তখন ঘাড় মাসেহ করতেন।
সূত্র: মাসায়িলি আহমাদ ইবনে হাম্বল পৃ: ২৬
আল মুগনী (ইবনে কুদামা) খ: ১ পৃ: ৮৮

হানাফী মাযহাব

উপরোক্ত আলচনা সামনে রেখে হানাফী মাযহাবের মূখপাত্র ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহ. বলেন,

ﻗﻮﻟﻪ (ﻭﻣﺴﺢ اﻟﺮﻗﺒﺔ) ﻫﻮ اﻟﺼﺤﻴﺢ ﻭﻗﻴﻞ ﺇﻧﻪ ﺳﻨﺔ ﻛﻤﺎ ﻓﻲ اﻟﺒﺤﺮ ﻭﻏﻴﺮﻩ

অর্থাৎ ঘাড় মাসাহহ করা মুস্তাহাব, এটাই বিশুদ্ধ মত। তবে কেউ কেউ সুন্নাতও বলে থাকেন যেমন বাহরুর রায়েক ও অন্যান্য কিতাবসমূহে বর্ণিত রয়েছে।
সূত্র: রদ্দুল মুহতার খ: ১ পৃ: ১২৪ বাহরুর রায়েক খ:১ পৃ: ৫৬ আল মাকসুদ খ: ১ পৃ: ১০ বাদায়েউস সানায়ে খ: ১ পৃ: ২৩

শাফেয়ী মাযহাব

শাফেয়ী মাযহাবের অন্যতম ব্যক্তি হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী রহ. ওযুর সুন্নাতসমূহ লিখতে গিয়ে লিখেছেন,

الثانية عشرة مسح الرقبة

অর্থাৎ (ওযুর) বারো নাম্বার (সুন্নাত) হলো ঘাড় মাসাহ করা।
সূত্র: আল ওয়াসীত খ: ১ পৃ: ২৮৮

অভিযোগ

শাফেয়ী মাযহাবের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ইমাম নববী রহ. শরহুল মুহাজ্জাব কিতাবে লিখেছেন যে,

لم يصح عن النبي صلى الله عليه وسلم فيه شيء وليس هو بسنة بل بدعة

অর্থাৎ এ (ঘাড় মাসাহ করার) ব্যাপারে নবীজি সা. থেকে কিছুই বর্ণিত হয়নি এবং এটা সুন্নাতও নয়, বরং বিদআত।

সূত্র: নাইলুল আওতার খ: ১ পৃষ্টা: ২০৬
আল মাজমুউ শরহুল মুহাজ্জাব খ:১ পৃ: ৪৬৫

জবাব

জবাব: ১

ওযুতে ঘাড় মাসাহ করার ব্যাপারে উপরোক্ত হাদিসগুলো যয়ীফ হলেও মাওযু তথা জাল নয়। আর যয়ীফ হাদিসের ব্যাপারে খোদ আল্লামা নববী রহ. বলেন,

ويجوز عند أهل الحديث وغيرهم التساهل في الأسانيد ورواية ما سوى الموضوع من الضعيف والعمل به من غير بيان ضعفه في غير صفات الله تعالى والأحكام

অর্থাৎ হাদীস বিশারদকারীদের নিকট যঈফ সনদ সমূহে শিথিলতা করা এবং জাল ছাড়া দুর্বল হাদীসের দুর্বলতা উল্লেখ করা ব্যতীত বর্ণনা করা জায়েয। আর তার উপর আমল করা বৈধ। যখন তা আহকাম এবং আল্লাহ তা’য়ালার ছিফাতের ব্যাপারে না হয়”।
সূত্র: তাদরীবুর রাবী পৃষ্ঠা ৩৫০

সুতরাং ইমাম নববী রহ. এর এটি একটি বিচ্ছিন্ন মতবাদ। যা তাঁর এ উসূল অনুযায়ী পরিত্যক্ত।

জবাব: ২

ইমাম নববী রহ. এর জবাবে আহলে হাদিস ও সালাফীদের ইমাম আল্লামা শাওকানী রহ. ঘাড় মাসাহের স্বপক্ষের দুটি হাদিস উল্লেখ্য করে বলেন,

ﻭَﺑِﺠَﻤِﻴﻊِ ﻫَﺬَﺍ ﺗُﻌْﻠَﻢُ ﺃَﻥَّ ﻗَﻮْﻝَ ﺍﻟﻨَّﻮَﻭِﻱِّ ﻣَﺴْﺢُ ﺍﻟﺮَّﻗَﺒَﺔِ ﺑِﺪْﻋَﺔٌ ﻭَﺃَﻥَّ ﺣَﺪِﻳﺜَﻪُ ﻣَﻮْﺿُﻮﻉٌ ﻣُﺠَﺎﺯَﻓَﺔً ﻭَﺃَﻋْﺠَﺐُ ﻣِﻦْ ﻫَﺬَﺍ ﻗَﻮْﻟُﻪُ ﻭَﻟَﻢْ ﻳَﺬْﻛُﺮْﻩُ ﺍﻟﺸَّﺎﻓِﻌِﻲُّ ﻭَﻟَﺎ ﺟُﻤْﻬُﻮﺭُ ﺍﻟْﺄَﺻْﺤَﺎﺏِ ﻭَﺇِﻧَّﻤَﺎ ﻗَﺎﻟَﻪُ ﺍﺑْﻦُ ﺍﻟْﻘَﺎﺹِّ ﻭَﻃَﺎﺋِﻔَﺔٌ ﻳَﺴِﻴﺮَﺓٌ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻗَﺎﻝَ ﺍﻟﺮُّﻭﻳَﺎﻧِﻲُّ ﻣِﻦْ ﺃَﺻْﺤَﺎﺏِ ﺍﻟﺸَّﺎﻓِﻌِﻲِّ ﻓِﻲ ﻛِﺘَﺎﺑِﻪِ ﺍﻟْﻤَﻌْﺮُﻭﻑِ ﺑِﺎﻟْﺒَﺤْﺮِ ﻣَﺎ ﻟَﻔْﻈُﻪُ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺻْﺤَﺎﺑُﻨَﺎ ﻭَﻫُﻮَ ﺳُﻨَّﺔٌ

অর্থাৎ এসব কিছু থেকে জানা যায় যে, “গর্দান মাসেহ করা বিদআত এবং এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলো মাউযু বা বানোয়াট” বলে ইমাম নববী রহ. যে মন্তব্য করেছেন তা মনগড়া। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো তাঁর এ মন্তব্য যে,
‘ইমাম শাফেঈ এবং তাঁর অনুসারীগণ কেউ গর্দান মাসেহ করার কথা বলেননি’। অথচ ইবনুল কাছ এবং স্বল্প সংখ্যক একটি দল গর্দান মাসেহ করার কথা বলেছেন। শাফেঈ মাজহাবের ইমাম রুইয়ানী আল বাহর নামক কিতাবে বলেন, আমাদের সাথীগণ বলেন, গর্দান মাসেহ করা সুন্নাত।
সূত্রঃ- নাইলুল আওতার খ: ১ পৃষ্টা: ২০৪

সুতরাং ইমাম নববী রহ. এর কথাটি কোনো ভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়।

আহলে হাদীসের ইমামদের অভিমত

ইমাম বগবী রহ. এর অভিমত:

তথাকথিত আহলে হাদীসের অন্যতম মান্যবর ব্যক্তি আল্লামা বগবী রহ. সম্পর্কে খোদ সালাফীদের ইমাম শাওকানী রহ. লিখেছেন,

ﺗَﻌَﻘَّﺐَ ﺍﻟﻨَّﻮَﻭِﻱُّ ﺃَﻳْﻀًﺎ ﺍﺑْﻦَ ﺍﻟﺮِّﻓْﻌَﺔِ ﺑِﺄَﻥَّ ﺍﻟْﺒَﻐَﻮِﻱّ ﻭَﻫُﻮَ ﻣِﻦْ ﺃَﺋِﻤَّﺔِ ﺍﻟْﺤَﺪِﻳﺚِ ﻗَﺪْ ﻗَﺎﻝَ ﺑِﺎﺳْﺘِﺤْﺒَﺎﺑِﻪِ ﻗَﺎﻝَ ﻭَﻟَﺎ ﻣَﺄْﺧَﺬَ ﻟِﺎﺳْﺘِﺤْﺒَﺎﺑِﻪِ ﺇﻟَّﺎ ﺧَﺒَﺮٌ ﺃَﻭْ ﺃَﺛَﺮٌ ﻟِﺄَﻥَّ ﻫَﺬَﺍ ﻟَﺎ ﻣَﺠَﺎﻝَ ﻟِﻠْﻘِﻴَﺎﺱِ ﻓِﻴﻪ

অর্থাৎ ইবনুর রফআহ রহ. ও এ বিষয়ে ইমাম নববীর পিছু ধাওয়া করে বলেন, হাদীসের প্রসিদ্ধ ইমাম বাগাবী রহ. গর্দান মাসেহ করা মুস্তাহাব বলেছেন। আর এ কথার ভিত্তি হতে পারে কেবল হাদীস বা আছার। কারণ এরকম বিষয়ে বিবেক খাটিয়ে কিছু বলা যায় না।
সূত্রঃ- নাইলুল আওতার খ: ১ পৃষ্টা: ২০৪

ইবনে সায়্যিদিনা নাস রহ. এর অভিমত:

আহলে হাদিসের অন্যতম মান্যবর ব্যক্তি ইবনে সায়্যিদিনা নাস রহ. বলেন,

فيه زيادة حسنة وهي مسح العنق

অর্থাৎ ঘাড় মাসাহের ভেতর অতিরিক্ত নেকী রয়েছে।
সূত্রঃ- নাইলুল আওতার খ: ১ পৃষ্টা: ২০৪

ইমাম শাওকানী রহ. এর অভিমত:

পূর্বেই উল্লেখ্য করেছি, সালাফী ইমাম শাওকানী রহ. তাঁর লিখিত কিতাব নাইলুল আওতারে “ঘাড় মাসাহ করা মুস্তাহাব” এর পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন এবং ঘাড় মাসাহ করা বিদআদ সম্পর্কে ইমাম নববী রহ. যে ফতাওয়া দিয়েছেন তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে লিখেছেন,

ﻭَﺑِﺠَﻤِﻴﻊِ ﻫَﺬَﺍ ﺗُﻌْﻠَﻢُ ﺃَﻥَّ ﻗَﻮْﻝَ ﺍﻟﻨَّﻮَﻭِﻱِّ ﻣَﺴْﺢُ ﺍﻟﺮَّﻗَﺒَﺔِ ﺑِﺪْﻋَﺔٌ ﻭَﺃَﻥَّ ﺣَﺪِﻳﺜَﻪُ ﻣَﻮْﺿُﻮﻉٌ ﻣُﺠَﺎﺯَﻓَﺔً

অর্থাৎ এসব কিছু থেকে জানা যায় যে, “গর্দান মাসেহ করা বিদআত এবং এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলো মাউযু বা বানোয়াট” বলে ইমাম নববী রহ. যে মন্তব্য করেছেন তা মনগড়া
সূত্রঃ- নাইলুল আওতার খ: ১ পৃষ্টা: ২০৪

সিদ্দিক হাসান খান ভূপালীর অভিমত:

তথাকথিত আহলে হাদিস মতবাদের বড় ইমাম ও মূখপাত্র নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান ভূপালী রহ. বলেন,

اگر چہ در مسح رقبہ حدیثی کہ موصوف بصحت یا حسن بود نیامدہ مگر ابن حجر در تلخیص احادیث غیر بالغ بدرجہ احتجاج آوردہ وآں مفید فی الجملہ اصلیت اوست نہ چنانکہ نووی گفتہ کہ مسح رقبہ بدعت است و حدیثش موضوع وآنکہ ابن القیم در ہدی و مجد الدین در سفر السعادہ گفتہ اند کہ در مسح رقبہ البتہ حدیثی بصحت نرسیدہ انتہی پس مسلم است ولکن در صالح احتجاج صحت مشترط نباشد بلکہ حسن صالح حجیت است وہمچنیں حدیث ضعیف کہ کثرت طرقش موجب قوت گردد پس آں قسم حسن لغیرہ باشد بشرطیکہ معارض حدیث صحیح نبود

অর্থাৎ যদিও গর্দান মাসহের হাদীসটি সহীহ ও হাসান পর্যায়ের নয়, কিন্তু ইবনে হাজর রহ. “তালখিস” গ্রন্থে আনা হাদিসগুলো দলিল যোগ্য না হলেও ঘাড় মাসাহের বিষয়ের মূল ভিত্তি আছে বলে বুঝা যায়। সুতরাং শুধু ইমাম নববী রহ. বলেননি যে, গর্দান মাসহ বিদআদত, এবং তার হাদিস মাউজু তথা জাল, বরং ইবনুল কায়্যিম রহ. زاد المعاد فی هدي العباد গ্রন্থে এবং মজদুদ্দীন রহ. سفر السعاده গ্রন্থে বলেছেন যে, অবশ্যই গর্দান মাসহের হাদিস সহিহ এর স্থরে পৌছেনি ৷ এ কথাগুলো অবশ্য ঠিক ৷ কিন্তু প্রত্যেক হাদিস দলিলযোগ্য হওয়ার জন্য সহিহ হওয়া শর্ত নয়, বরং হাসান হাদিসও দলিলযোগ্য হতে পারে। যয়িফ হাদিস বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হলে তা হাসান লিগায়রিহী হয়ে যায় ৷ শর্ত হলো তার বিপক্ষে সহীহ হাদিস না থাকতে হবে।

সূত্র: বুদুরুল আহিল্লাহ পৃ: ২৮

প্রিয় পাঠক, “উযুতে ঘাড় মাসাহ করা”র ব্যাপারে উপরোক্ত আলোচনা থেকে আশা করি আর বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। নবীজি সা. এর হাদিসসহ খোদ আহলে হাদিস ও সালাফীদের ইমামদের উক্তিও উল্লেখ্য করেছি। এরপরও যদি কেউ “উযুতে ঘাড় মাসাহ করা বিদআত” বলে দাবী করেন, তাহলে তাদের জন্য আমাদের দুআ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

 

লেখক

মুফতী রিজওয়ান রফিকী

মুহতামিম: মাদরাসা মারকাযুন নূর বোর্ডবাজার,গাজীপুর।

Check Also

ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত দোয়া কি বিদআত?

ফরজ নামাজের পর দোয়া করার ব্যাপারে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন অঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করতে দেখা …

৩ comments

  1. পর্যালোচনা : এটি প্রত্যাখ্যাত বর্ণনা। হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেছেন,قُلْتُ: بَيْنَ ابْنِ فَارِسٍ، وَفُلَيْحٍ مَفَازَةٌ، فَيُنْظَرُ فِيْهَا ‘আমি বলেছি, ইবনে ফারেস এবং ফুলায়হ-এর মাঝে সমস্যার স্থলটি রয়েছে। অতএব এতে লক্ষ্য করতে হবে।[4]

    অর্থাৎ উভয়ের মাঝে কোন্ রাবী লুক্কায়িত আছে তা লক্ষ্য করতে হবে। আল্লামা শাওকানী (রহঃ)-এর মতে, যদি উভয়ের মাঝে হুসায়েন বিন উলওয়ান থাকেন, তবে তিনি সমালোচিত রাবী।[5] যেমন-

    (১) আবূ হাতিম বলেন,كَانَ يَضَعُ الْحَدِيثَ لَا يَحِلُّ كَتْبُ حَدِيْثِهِ، كَذَّبَهُ أَحْمَدُ وَيَحْيَى ‘তিনি (হুসায়েন বিন উলওয়ান) হাদীছ জাল করতেন। তার হাদীছ লেখা যাবে না। আহমাদ এবং ইয়াহ্ইয়া তাকে মিথ্যুক বলেছেন।[6]

    (২) সাখাবী (রহঃ) লিখেছেন, فالحسين متهم بالكذب، ‘আর হুসায়েন মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত’।[7]

    (৩) ইয়াহ্ইয়া বিন মাঈন তাকে মিথ্যুক[8], হায়ছামী যঈফ[9], ইবনে হাজার (রহঃ) মাতরূক বা পরিত্যাজ্য[10], আবূ হাতেম অত্যন্ত দুর্বল ও মাতরূকুল হাদীছ অভিহিত করেছেন।[11]

    (৪) শাওকানী (রহঃ) ও ইবনে আদী হুসাইন বিন উলওয়ানকে হাদীছ জালকারী বলে উল্লেখ করেছেন।[12]

    (৫) ইবনুল জাওযী উল্লেখ করেন, হুসাইন বিন উলওয়ানকে ইয়াহইয়া বিন মাঈন মিথ্যুক ও আলী ইবনু মাদীনী তাকে অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন। ইমাম নাসাঈ, আবূ হাতেম ও দারাকুৎনী বলেছেন, তিনি মাতরূকুল হাদীছ এবং আবুল ফাৎহ আযদী তাকে মহা মিথ্যুক, খবীছ আখ্যায়িত করেছেন।[13]

    সুতরাং যদি হুসায়েন এই সনদে থেকে থাকেন, তবে এটি বানোয়াট। নতুবা রাবী মাজহূল থাকার কারণে এটি যঈফ।

  2. তর্কের খাতিরে মানলাম এটা মুস্তাহাব, আর মুস্তাহাব ছেড়ো দিলে কোন গোনাহ হয় না। অতপর আহলে হাদিসের কথায় ইহা যদি বিদাত হইয়া যায় তাহলেতো মাওলানা সাহেব আপনার সালাতই বাতিল!!!

  3. আমি একবার এক মাদ্রাসায় পড়াকালে অজু করার সময় ঘাড় মাসেহ করছিলাম । আর েএটা দেখে অনেকেই অনেক ধরনের মন্তব্য করে। যদিও এটা সম্পর্কে পরে জানতে পারি যে এটাম মুস্তাহাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.