ফরজ নামাজের পর দোয়া করার ব্যাপারে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন অঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করতে দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ তো এটাকে সরাসরি বিদ’আত বলে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এর স্বপক্ষে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।
তবে আলোচনাটি কয়েকভাবে বিভক্ত করতে চাই।
১. হাত তুলে দুআ করা।
২. হাত তুলে দুআ করার পর মুখে হাত বুলানো।
৩. যেকোনো মজলিসে সম্মিলিত দুআ করা।
৪. ফরজ নামাজের পর একাকী দুআ।৫. ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দুআ।
৬. ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত দুআ।
৭. দুআর বিরোধীদের মূল উদ্দেশ্য।
এক. হাত তুলে দুআ করা।
প্রিয় পাঠক, হাত তুলে দু’আ করার ব্যাপারে কিছু ভাইদের থেকে শোনা যাচ্ছে যে, দু’আ করার সময় হাত তোলার কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। এমনকি তারা এমনও দাবি করে বসেছেন যে, দু’আ করার সময় হাত তোলার কোনও ভিত্তি নেই। অথচ এ ব্যাপারর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। যা পাঠক সমীপে এখানে তুলে ধরলাম।
হাদীস-১
قَالَ أَبُو مُوسَى دَعَا النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَرَأَيْتُ بَيَاضَ إِبْطَيْهِ
অর্থাৎ হযরত আবু মুসা আশআরী রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’আর মধ্যে দু’ হাত উপরে উঠিয়েছেন; এবং আমি তাঁর বগলের শুভ্রতা দেখেছি।
সূত্র: সহিহ বুখারী হাদিস: ৩৫৬৫
হাদিস-২
عن عبدالله بن عباس قال كانَ إذا دعا جعلَ باطنَ كفِّه إلى وجهِهِ
অর্থাৎ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সা. যখন দুআ করতেন, তখন হাতের তালু মুখের দিকে করতেন।
সূত্র: মুসনাদে আহমাদ: ১৬৫৬৩ তাবরানী: ৬৬২৫ জামে সগীর: ৬৬৬৮ তাহযিবুল কামাল খ: ৫ পৃ: ৭৩
হাদিসটির মান:
১. আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ. হাদিসটি হাসান বলেছেন।
সূত্র: জামে সগীর হাদিস: ৬৬৬৮
২. আহলে হাদীসের মূখপাত্র নাসির উদ্দীন আলবানী বলেছেন,
هذا حديث صحيح
অর্থাৎ হাদিসটি সহিহ।
সূত্র: সহিহ আল জামে হাদিস: ৪৭২১
হাদিস-৩
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَا مِنْ عَبْدٍ يَرْفَعُ يَدَيْهِ حَتَّى يَبْدُوَ إِبْطُهُ يَسْأَلُ اللَّهَ مَسْأَلَةً إِلاَّ آتَاهَا إِيَّاهُ مَا لَمْ يَعْجَلْ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَكَيْفَ عَجَلَتُهُ قَالَ يَقُولُ قَدْ سَأَلْتُ وَسَأَلْتُ وَلَمْ أُعْطَ شَيْئًا
অর্থাৎ আবূ হুরাইরাহ রা. হতে বর্ণিত আছে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে সময় কোন বান্দা তার দুই হাত উপরের দিকে উত্তোলন করে, এমনকি তার বগল খুলে আল্লাহর নিকটে কিছু প্রার্থনা করে, তখন তিনি অবশ্যই তাকে তা দেন, যদি সে তাড়াহুড়া না করে। সাহাবীগণ বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার তাড়াহুড়া কি? তিনি বললেনঃ সে বলে, আমি তো প্রার্থনা করছি, আবারও প্রার্থনা করেছি (অধিকবার প্রার্থনা করছি), কিন্তু আমাকে কিছুই দান করা হয়নি।
সূত্রঃ জামে তিরমিযি হাদিস: ৩৬০৪
হাদিস-৪
عَنْ أَنَسً عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم رَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى رَأَيْتُ بَيَاضَ إِبْطَيْهِ
অর্থ: আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’ হাত এতটুকু তুলে দু‘আ করেছেন যে, আমি তার বগলের শুভ্রতা দেখতে পেয়েছি।
সূত্রঃ সহিহ বুখারী হাদিস: ১০৩০ মুসলিম:৮৯৭ আহমাদ: ১২০১৯ আবু দাউদ: ১১৭৫ নাসাঈ: ১৫২৮
হাদিস-৫
عَنْ أَبِي مُوسَى قَالَ دَعَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم بِمَاءٍ فَتَوَضَّأَ ثُمَّ رَفَعَ يَدَيْهِ فَقَالَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِعُبَيْدٍ أَبِي عَامِرٍ وَرَأَيْتُ بَيَاضَ إِبْطَيْهِ فَقَالَ اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَوْقَ كَثِيرٍ مِنْ خَلْقِكَ مِنَ النَّاسِ
অর্থ: হযরত আবূ মূসা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার পানি আনিয়ে অযূ করলেন। তারপর উভয় হাত তুলে দু‘আ করলেনঃ হে আল্লাহ! আপনি ‘উবায়দ আবূ ‘আমরকে মাফ করে দিন। আমি তখন তাঁর বগলের শুভ্রতা দেখলাম। আরও দু‘আ করলেনঃ হে আল্লাহ! আপনি তাকে কিয়ামতের দিন আপনার সৃষ্ট অধিকাংশ অনেক লোকের উপর স্থান দান করুন
সূত্রঃ সহিহ বুখারী হাদিস: ৬৩৮৩
হাদিস-৬
عَنْ سَلْمَانَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ رَبَّكُمْ تَبَارَكَ وَتَعَالَى حَيٌّ كَرِيمٌ يَسْتَحْيِي مِنْ عَبْدِهِ إِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ إِلَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا
অর্থ: হযরত সালমান রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ তোমাদের রব চিরঞ্জীব ও মহান দাতা। যখন কোন বান্দাহ হাত উঠিয়ে দু’আ করে, তখন তিনি তার খালি হাত ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।
সূত্র: সুনানে আবু দাউদ হাদিস:১৪৮৮ তিরমিযি: ৩৫৫৬ ইবনে হিব্বান: ৮৭৬
হাদিসটির মান:
১. আবু দাউদ রহ:, ইবনে হিব্বান রহ: সহ অসংখ্য মুহাদ্দিসগণ হাদিসটি সহিহ সনদে বর্ণনা করেছেন।
২. এমনকি আহলে হাদিসদের মান্যবর ব্যক্তি শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত, শায়খ আলবানীসহ ইবনে বায রহ: হাদিসটি সহিহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
সূত্র: ফাতাওয়া নুর আলাদ্দারব খ: ৯ পৃ: ১৫৬
হাদিস-৭
عَنِ الْفَضْلِ بْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الصَّلاَةُ مَثْنَى مَثْنَى تَشَهَّدُ فِي كُلِّ رَكْعَتَيْنِ وَتَخَشَّعُ وَتَضَرَّعُ وَتَمَسْكَنُ وَتَذَرَّعُ وَتُقْنِعُ يَدَيْكَ يَقُولُ تَرْفَعُهُمَا إِلَى رَبِّكَ مُسْتَقْبِلاً بِبُطُونِهِمَا وَجْهَكَ وَتَقُولُ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَنْ لَمْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَهُوَ كَذَا وَكَذَا
অর্থ: হযরত ফযল ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সালাত হ’ল দু’রাকাআত দু’রাকাআত করে। প্রতি দু’রাকাআতের পর রয়েছে তাশাহ্হুদ। সালাতে আছে খুশূ-খুযূ, আল্লাহর নিকটে বিনয় প্রকাশ এবং আহাজারি করা। ধীরস্থিরভাবে তা আদায় করবে। এতে আরো আছে, দু’আর সময় দুই হাত তোলা। দুই হাতের ভিতরের দিক তোমার চেহারার সামনের দিকে রেখে, তোমার প্রভূর পানে তুলে ধরে বলবেঃ হে আমার রব্ব। যদি এই কাজগুলি কেউ সালাতে না করে, তার সালাত অপূর্ণাঙ্গ হবে।
সূত্রঃ জামে তিরমিযী হাদিস: ৩৮৫ আহমাদ: ১৭৯৯ তুহফাতুল আহওয়াযী খ: ২ পৃ: ২০০
হাদিস-৮
عَنْ الْحُسَيْنِ قَالَ کَانَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ یَرْفَعُ یَدَيْهِ إِذَا ابْتَھَلَ وَدَعَا کَمَا یَسْتَطْعِمُ الْمِسْکِيْنُ
অর্থাৎ হযরত হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সা. যখন দুআ করতেন, তখন দু’হাত এমন ভাবে উত্তলন করতেন, যেমন অসহায় মিসকিন খাবারের জন্য হাত বাড়ায়।
সূত্র: তারিখে বাগদাদ খ: ৮ পৃ: ৬৩
বি:দ্র: হাদিসটির উপর কালাম রয়েছে, কিন্তু তথাপি সমর্থক হিসাবে আনা হয়েছে।
হাদিস-৯
عن أنس بن مالك قَالَ خرجتُ معَ النَّبيِّ صلّى اللَّهُ عليهِ وسلَّمَ منَ البيتِ إلى المسجِدِ وقومٌ في المسجِدِ رافِعي أَيديهم يَدعونَ فقالَ ترى بأَيديهم ما أرى فقلتُ وما بأَيديهِم قالَ بأيديهِم نورٌ قُلتُ ادعُ اللَّهَ أن يُريَنيهِ فدعا فأرانيه فأسرَعَ فرفَعنا أيديَنا
অর্থাৎ হযরত আনাস রা. খেতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন নবী সা. এর সাথে ঘর থেকে বের হয়ে মসজিদের দিকে গেলাম। তখন কিছু লোক হাত তুলে আল্লাহর কাছে দুআ করছিলেন। তখন নবী সা. আমাকে বললেন, তুমি কি ঐ জিনিষটি দেখতে পাচ্ছো যা ওদের হাতের ভেতরে আছে? তখন আমি বললাম, কি আছে তাদের হাতের ভেতর? নবী সা. বললেন, (আমি ওদের হাতের ভেতর দেখছি) নূর। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহর কাছে একটু দুআ করেন যেন তিনি আমাকে ঐ নুর দেখিয়ে দেন। তিনি দুআ করলেন, ফলে আল্লাহ আমাকে ঐ নূর দেখালেন। (অতপর তিনি বললেন, হে আনাস, দ্রুত দেখো) অতপর আমি দ্রুত শেষ করলাম এবং আমরা তাঁদের সাথে আমাদের হাত উত্তলন করলাম।
সূত্র: তারিখে কাবীর (বুখারী রহ.) খ: ৩ পৃ: ২০২ দালায়িলুন নাবুওয়াহ খ: ৬ পৃ: ১৯৭ কিতাবুদ দুআ (তাবরানী) হাদিস: ২০৬
প্রিয় পাঠক, কোনো একটি বিধান প্রমাণ করার জন্য একটি দলীলই যথেষ্ট তবুও পাঠকদের তৃপ্তির জন্য অসংখ্য হাদিস আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। এমন আরও অসংখ্য হাদিস রয়েছে, যা দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে, দু’আ করার সময় হাত তোলা সুন্নাত।
একটি অভিযোগ:
হয়তো কেউ কেউ প্রশ্ন করবেন যে, উপরোল্লিখিত কয়েকটি হাদিসে তো যয়ীফ হাদিস রয়েছে। তো যয়ীফ দিয়ে কেন প্রমাণ দিলেন?
উত্তর:
১. কোনও যয়ীফ হাদিসের স্বপক্ষে যদি সহিহ হাদিস থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে যয়ীফ হাদিসও প্রমাণ হিসাবে পেশ করতে কোনও অসুবিধা নেই। সে কারণে যয়ীফ হাদিসগুলো শাওয়াহেদ বা সমর্থক হিসাবে উল্লেখ্য করা হয়েছে।
২. কোনও বিধানের বিপক্ষে যদি সহিহ হাদিস না থাকে, সে ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদিসের উপরও আমল করা যায়। এটা শুধু আমাদের দাবী নয়, বরং খোদ আহলে হাদিসের ফতাওয়ায় আসছে,
حدیث ضعیف سے جو موضوع نہ ہو استحباب و جواز ثابت ہوتا ہے
অর্থাৎ যেটা জাল নয় এমন যয়ীফ হাদিস দ্বারা (যেকোনো আমল) মুস্তাহাব এবং জায়েয প্রমাণ হয়।
সূত্র: ফাতাওয়ায়ে উলামায়ে হাদিস খ: পৃ: ২১৭
সুৎরাং উপরোল্লিখিত কোনও হাদিসের ক্ষেত্রে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। অতএব উপরোল্লেখিত সহিহ হাদিস দ্বারা এ কথা প্রমাণ হলো যে, দু’আর সময় দুই হাত তোলা সুন্নাত।
ইমামদের অভিমত:
চলুন, এবার দেখি এ বিষয়ে উলামায়ে কেরাম কি বলেছেন।
সুয়ূতী রহ. এর অভিমত:
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ. বলেন,
أَحَادِيْثُ رَفَعِ الْیَدَيْنِ فِي الدُّعَاءِ فَقَدْ وَرَدَ عَنْهُ ﷺ نَحْوُ مِائَةِ حَدِيْثٍ فِيْهِ رَفَعَ یَدَيْهِ فِي الدُّعَاءِ
অর্থাৎ দু’আর সময় হাত তোলার ব্যাপারে নবী সা. থেকে আনুমানিক এক শত হাদিস বর্ণিত আছে। যেখানে এটা বর্ণিত রয়েছে যে, নবী সা. দুআর সময় হাত উঠাতেন।
তিনি আরও বলেন,
الرَّفْعُ عِنْدَ الدُّعَاءِ تَوَاتَرَ بِاعْتَبَارِ الْمُجْمُوْعِ
অর্থাৎ সমষ্টিগতভাবে হাত তুলে দুআ করা মুতাওয়াতির হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
সূত্র: তাদরীবুর রাবী খ: ২ পৃ: ৬২১
ইমাম নববী রহ. এর অভিমত:
قَالَ جَمَاعَةٌ مِنْ أَصْحَابِنَا وَغَيْرِھِمْ اَلسُّنَّةُ فِي کُلِّ دُعَاءٍ لِرَفْعِ بَلاَءٍ کَالْقَحْطِ وَنَحْوِهِ أَنْ يَّرْفَعَ یَدَيْهِ وَیَجْعَلَ ظَھْرَ کَفَّيْهِ إِلَی السَّمَاءِ
অর্থাৎ আমাদের উলামায়ে কেরাম এবং অন্যান্য মাশায়েখগণ বলেছেন, মসিবত যেমন দুর্ভিক্ষ বা এমন কোনো বিষয় থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য দুআ করার সময় হাত উঠানো সুন্নাত এবং সেটা এভাবে যে, দু’হাতের তালু আসমানের দিকে উঠাবে।
তিনি আরও বলেন,
قَدْ ثَبَتَ رَفْعُ یَدَيْهِ ﷺ فِي الدُّعَاءِ فِي مَوَاطِنَ غَيْرَ الاسْتِسْقَاءِ وَھِيَ أَکْثَرُ مِنْ أَنْ تُحْصَرَ
অর্থাৎ এ বিষয়টি প্রমাণিত যে, নবী সা. ইস্তেস্কার নামাজ ছাড়াও অগনিত সময়ে হাত তুলে দু’আ করেছেন।
সূত্রঃ শরহুল মুসলিম খ: ৬ পৃ: ১৯০ মারিফাতুস সুনান ওয়াল আছার খ: ৫ পৃ: ১৭৯
ইবনে রজব হাম্বলী রহ. এর অভিমত:
আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী রহ. দু’আ কবুল হওয়ার জন্য ৪ টি বিষয় উল্লেখ্য করছেন। তার মধ্যে তৃতীয় বিষয় হিসাবে লিখেছেন,
الثالث: مد يديه إلى السماء، وهو من آداب الدعاء التي يرجى بسببها إجابته
অর্থাৎ তৃতীয় বিষয় হলো, (দু’আ করার সময়)১ দু’হাত আসমানের দিকে তুলে ধরবেন। এটা দু’আর একটি আদব, যার দ্বারা দু’আ কবুল হওয়ার আশা করা যায়।
সূত্র: জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম খ:১ পৃ: ২৫৮
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অভিমত:
শাইখুল ইসলাম আবুল আব্বাস ইবনে তাইমিয়া রহ. দু’আ করার সময় হাত তোলার ব্যাপারে বলেন,
ويسن للداعي رفع يديه
অর্থাৎ দুআকারীর জন্য দু’হাত তোলা সুন্নাত।
সূত্র: আল ফাতাওয়াল কুবরা খ: ৫ পৃ: ৩৩৭
বিন বায রহ. এর অভিমত:
إذا دعا ورفع يديه فهذا من أسباب الإجابة إلا في المواضع التي لم يرفع فيها النبي ﷺ فلا نرفع فيها
অর্থাৎ দু’আ করার সময় দু’হাত তোলা দু’আ কবুল হওয়ার কারণ। তবে কিছু জায়গায় নবী সা. হাত তোলেননি আমরাও সে সব স্থানে হাত তুলবো না।
সূত্র: মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বায খ: ৬ পৃ: ১২৪
সৌদী আরবের সর্বোচ্চ ফতাওয়া বোর্ডের অভিমত:
সঊদী আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের ফতাওয়া বোর্ডের ফতাওয়ার কিতাব আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ লিল বুহুসিল ইলমীয়াহ বলা হয়েছে,
الأصل أن النبي صلى الله عليه وسلم كان إذا اجتهد في الدعاء رفع يديه
অর্থাৎ আসল বিষয় হচ্ছে, নবী সা. যখন দু’আ করতেন, তখন দু’হাত উঠাতেন।
সূত্রঃ আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ খ: ২৪ পৃ: ২৪৬ফতাওয়া নং: ১৮০৫৬
আহলে হাদীসদের ফতাওয়া:
دعا میں ہاتھ اٹھانا مسنون طریقہ ہے
অর্থাৎ দুআর সময় হাত উঠানো সুন্নাত।
সূত্র: ফাতাওয়ায়ে উলামায়ে হাদিস খ: পৃ: ২১৭
প্রিয় পাঠক, এত হাদিস থাকার পরও এ কথা কিভাবে বলা যায় যে, দুআ করার সময় হাত তোলার কোনও দলীল নেই? হাদিস শাস্ত্রে যাদের অপরিসীম অবদান রয়েছে, তাদের বক্তব্যসহ লা-মাযহাবীদের অনেক মান্যবর ব্যক্তিদের থেকেও অভিমত এখানে তুলে ধরেছি। এরপরও কি বলবেন, দুআ করার সময় হাত তোলা বিদআত?
দু’আর সময় মুনাফিকরা হাত উঠাতো না।
দু’আর সময় হাত না উঠানো এটা কখনও মুসলিমদের চরিত হতে পারে না। এটা মুনাফিকদের চরিত্র ছিল। যা পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন,
الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُم مِّن بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ نَسُواْ اللّهَ فَنَسِيَهُمْ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
অর্থ: মুনাফেক নর-নারী সবারই গতিবিধি একরকম; শিখায় মন্দ কথা, ভাল কথা থেকে বারণ করে এবং তারা নিজ হাত বন্ধ করে রাখে।
সুরা তাওবা আয়াত: ৬৭
অত্র আয়াতে মুনাফিকদের কয়েকটা কর্মকান্ড উল্লেখ্য করেছেন মহান আল্লাহ তা’য়ালা। এর ভেতর মুনাফিকদের একটি কর্মকান্ড ছিলো,
وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ
অর্খাৎ তারা (মুনাফিকরা) নিজ হাত বন্ধ করে রাখে।
উক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বিভিন্ন মুফাসসির বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। নিন্মে উল্লেখ্য করা হলো,
তাফসীরে মাওয়ারদী
وَيَقْبِضُونَ أيْدِيَهُم فِيهِ أرْبَعَةُ أقاوِيلَ أحَدُها يَقْبِضُونَها عَنِ الإنْفاقِ في سَبِيلِ اللَّهِ تَعالى قالَهُ الحَسَنُ ومُجاهِدٌ
والثّانِي يَقْبِضُونَها عَنْ كُلِّ خَيْرٍ قالَهُ قَتادَةُ
والثّالِثُ يَقْبِضُونَها عَنِ الجِهادِ مَعَ النَّبِيِّ ﷺ قالَهُ بَعْضُ المُتَأخِّرِينَ
والرّابِعُ يَقْبِضُونَ أيْدِيَهم عَنْ رَفْعِها في الدُّعاءِ إلى اللَّهِ تَعالى
অর্থাৎ এ আয়াতের ব্যাপারে চারটি মত আছে,
এক. তারা (মুনাফিকরা) আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার ব্যাপারে হাত গুটিয়ে রাখতো। এটা হাসান বসরী রহ. ও মুজাহিদ রহ. এর অভিমত।
দুই. তারা (মুনাফিকরা) সকল ভাল কাজ থেকে হাত গুটিয়ে রাখতো। এটা কাতাদাহ রহ. এর অভিমত।
তিন. তারা (মুনাফিকরা) জিহাদ করা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখতো। এটা কিছু মুতাআখখিরিনের মত।
চার. তারা (মুনাফিকরা) আল্লাহর কাছে দুআ করার সময় হাত উঠানো থেকে গুটিয়ে রাখতো।
সূত্র: তাফসীরে মাওয়ারদী খ: ২ পৃ: ৩৭৯
তাফসীরে ইবনুল জাওযী
ইবনুল জাওযী রহ. তিনিও এ আয়াতের ব্যাপারে চারটা অভিমত উল্লেখ্য করেছেন। চতুর্থ নাম্বার অভিমতে উল্লেখ্য করেছেন,
الرّابِعُ عَنْ رَفْعِها في الدُّعاءِ إلى اللَّهِ تَعالى ذَكَرَهُما الماوَرْدِيُّ
অর্থাৎ চার. (মুনাফিকরা) আল্লাহর কাছে দুআ করার সময় হাত উঠানো থেকে গুটিয়ে রাখতো।
তাফসীরে ইবনুল জাওযী খ: ২ পৃ: ৩৫২
তাফসীরে সামআনী
قَالَ بعض الْمُتَأَخِّرين يَعْنِي لَا يبسطونها للدُّعَاء وَالرَّغْبَة إِلَى الله
অর্থ: কিছু মুতাআখখিরিনি বলেছেন, অর্থাৎ তারা (মুনাফিকরা) আল্লাহর কাছে দু’আ করার জন্য হাত প্রশস্ত করতো না।
সূত্রঃ তাফসীরে সামআনী খ: ২ পৃ: ১৫০
প্রিয় পাঠক, দু’আর সময় হাত উত্তলন করা একটি সুন্নাহ আমল। কিন্তু এ সুন্নাহ আমলকে সমাজ থেকে উঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র আসলে কাদের? নিশ্চয় এটা ইসলাম বিদ্বেষীদের একটি ষড়যন্ত্র। কারণ নবীজির সা. যামানায় এ ইসলাম বিদ্বেষী মুনাফিকরাই দুআর সময় হাত তোলার বিরুদ্ধে ছিল, আজও তাদের পেতাত্মারা বসে নেই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হিদায়াত নসীব করুন। আমিন!
দু’আ শেষে মুখে হাত মাসাহ করা:
দু’আর শেষে মুখমণ্ডল দুই হাত দিয়ে মাসাহ করা হাদীসে নববী দ্বারা প্রমাণিত একটি শরিয়াত সম্মত আমল। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সা. থেকে গ্রহণযোগ্য অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম,তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন থেকেও অনুরূপ আমলের দালীল-প্রমান সাব্যস্ত রয়েছে। যদ্দারা দু’আ শেষে মুখ মাসাহ করা একটি শরয়ীসম্মত আমল হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। তবে না মুছলেও কোনো গুনাহ নেই।
প্রমাণ-১
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ فِي الدُّعَاءِ لَمْ يَحُطَّهُمَا حَتَّى يَمْسَحَ بِهِمَا وَجْهَهُ
অর্থ: হযরত উমার ইবন খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দু’আর সময় হাত উঠাতেন তখন উভয় হাতে চেহারা মাসেহ না করা পর্যন্ত হাত নামাতেন না।
সূত্র: জামে তিরমিজী হাদীস: ৩৩৮৬, মুসনাদে বাজ্জার: ১১২৯, মুসতাদরাকে হাকেম: ১৯৬৭
হাদিসটির মান:
১. ইবনু হাজার আসকালানী রহ. এই হদীস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন-
أخرجه الترمذي له شواهد منها حديث ابن عباس عند أبي داود وغيره ومجموعها يقضي بأنه حديث حسن
অর্থাৎ এটি ইমাম তিরমিজি রেওয়াত করেছেন। এই হাদিসের আরও অনেক শাহেদ রেওয়াত বিদ্যমান রয়েছে । যেমন সুনানে আবু দাউদে ইবনু আব্বাসের রেওয়াত ও অন্যান্যগুলো । এই গুলোর সমষ্টির অবস্থা দেখে বুঝা যায়, হাদীসটি হাসান।
সূত্র: বুলুগুল মারাম পৃ: ৩১২ সুবুলুস সালাম খ: ৪ পৃ: ৬২৪
২. আল্লামা জালালুদ্দিন সূয়ূতী রহ. হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
هذا حديث حسن
অর্থাৎ হাদিসটি হাসান।
সূত্র: ফাযযুল ওয়া পৃ: ৭৪ জামে সগীর হাদিস ৬৬৮৭
৩. আল্লামা আব্দুল হক আল ইশবিলি রহ. বলেছেন,
أشار في المقدمة أنه صحيح الإسناد
অর্থাৎ তিনি কিতাবের মুকাদ্দামায় হাদিসটির সনদ সহিহ হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
সূত্র: আল আহকামুস সুগরা হাদিস: ৮৯৯
প্রমাণ-২
عَنْ عَبْد اللَّهِ بْنُ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ تَسْتُرُوا الْجُدُرَ مَنْ نَظَرَ فِي كِتَابِ أَخِيهِ بِغَيْرِ إِذْنِهِ فَإِنَّمَا يَنْظُرُ فِي النَّارِ سَلُوا اللَّهَ بِبُطُونِ أَكُفِّكُمْ وَلاَ تَسْأَلُوهُ بِظُهُورِهَا فَإِذَا فَرَغْتُمْ فَامْسَحُوا بِهَا وُجُوهَكُمْ
অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ তোমরা দেয়ালে পর্দা দিও না। যে ব্যক্তি অন্যের বিনানুমতিতে তার চিঠির প্রতি নজর করে সে যেন দোজখের প্রতি দৃষ্টিপাত করল। তোমরা তোমাদের হাতের তালু উপরের দিকে করে দু’আ করবে, হাতের পিঠ উপরের দিকে করে নয় এবং দুআর শেষে (হাত) মুখমণ্ডলে মাসেহ করবে।
সূত্র: সুনানে আবু দাউদ হাদিস: ১৪৮৫ ইবনে মাজাহ: ৭৭৮ মুস্তাদরাকে হাকেম: ১৯৬৮, মুজামে কাবীর লিততাবারানী: ১০৭৭৯
হাদিসটির মান:
আল্লামা জালালুদ্দিন সূয়ূতী রহ. হাদিসটি হাসান বলেছেন।
সূত্র: জামে সগীর হাদিস: ৬০২
প্রমাণ-৩
عن معمر عن الزهرى قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يرفع يديه عند صدره فى الدعاء ثم يمسح بهما وجهه
অর্থ: মা’মার যুহুরী থেকে বর্ণনা করেন “রাসুল(সাঃ) দুয়ার জন্য বুক বরাবর হাত উঠাতেন এবং দুয়ার পর মুখে হাত মাসাহ করতেন।
সূত্র: মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক হাদিস: ৩২৩৪
হাদিসটির উপর অভিযোগ:
এই হাদিসটির উপর একটি অভিযোগ আরোপ করে বলা হয় যে, এ হাদিসটি মুরসাল। কারণ যুহরী রহ. একজন তাবেয়ী, তিনি সরাসরি তো নবীজি সা. থেকে হাদিস শোনেননি। তাহলে হাদিসটি সহিহ নয়, বরং মুরসাল।
জবাব:
জুমহুর উলামায়ে কেরাম মুরসাল হাদিসকে গ্রহণযোগ্য হিসাবে লিখেছেন। প্রশিদ্ধ হাদিস বিশারদ ইবনে আব্দিল বার রহ. বলেন,
ان مرسل الثقة تجب به الحجة ويلزم به العمل كما يجب بالمسند سواء
অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির মুরসাল হাদীস শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য এবং মুসনাদ হাদীসের মত এমন মুরসাল হাদিসের উপর আমল করা যাবে।
সূত্র: আততামহীদ খ: ১ পৃ: ২
এ হাদিসটিতে যুহরী রহ. কোনো সাহাবীর নাম উল্লেখ্য না করলেও তিনি নির্ভরযোগ্য রাবী। কারণ তিনি প্রসিদ্ধ তাবেয়ী। এমন নির্ভরযোগ্য তাবেয়ীর মুরসাল হাদিস জুমহুর মুহাদ্দিসিনদের নিকট গ্রহনযোগ্য।
প্রমাণ-৪
عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا دَعَا فَرَفَعَ يَدَيْهِ مَسَحَ وَجْهَهُ بِيَدَيْهِ
অর্থ: আস-সাইব ইবন য়াযীদ রহ. তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম দু’আর সময় তাঁর উভয় হাত উত্তোলন করতেন এবং তাঁর দ্বারা মুখমণ্ডল মাসেহ করতেন।
সূত্র: সুনানে আবু দাউদ হাদিস: ১৪৯২ আহমাদ: ১৭৯৪৩ নাসবুর রায়াহ খ: ৩ পৃ: ৯১
হাদিসটির মান:
হাদিসটি অনেকেই যয়ীফ বলেছেন। অবশ্য আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী রহ. বলেছেন হাসান।
সূত্র: জামে সগীর হাদিস: ৬৬৬৭
প্রমাণ-৫
حدَّثنا إبرَاهيمُ بن المنذِر قال حدَّثنا محمَّدُ بن فُلَيح قال أخبرني أبِى عن أبى نُعَيم وهو وَهْب قال رَأَيتُ ابنَ عُمَرَ وابنَ الزُّبَيرِ يَدْعُوانِ يُدِيرَانِ بِالرَّاحَتَينِ عَلَى الوَجْهِ
অর্থ: হজরত ওহাব রহ. বলেন আমি হজরত ইবনে উমার ও হজরত ইবনে জুবাইরকে দেখেছি, তাঁরা দুআ করে হাত দুটি মুখের উপর ফেরাতেন।
সূত্র: আল আদাবুল মুফরাদ হাদিস: ৬২৪
হাদিসটির মান:
হাদিসটি অনেক মুহাদ্দিসিন হাসান বলেছেন। কিন্তু কেউ কেউ এ হাদিসের রাবী ফুলাইহ ইবনে সুলাইমানের কারণে হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন। কিন্তু ইবনে আদী রহ. বলেছেন,
هذا عندي لا بأس به قد اعتمده البخاري في صحاحه وله أحاديث صالحة
অর্থাৎ আমার মতে ফুলাইহ ইবনে সুলাইমানের হাদিস গ্রহণ করতে কোনও অসুবিধা নেই। কারণ তার উপর ইমাম বুখারী রহ. নিজেও আস্তা রেখেছেন তার সহিহ বুখারীতে। (অর্থাৎ তার থেকেও হাদিস নিয়েছেন।) এবং তার অসংখ্য সহিহ হাদিসও বর্ণিত রয়েছে।
সূত্র: সিয়ারু আ’লামিন নুবালা খ:৭ পৃ: ৩৫২
قال الدارقطني ولا بأس به
অর্থাৎ ইমাম দারাকুতনী বলেছেন, ফুলাইহ ইবনে সুলাইমানের হাদিস গ্রহণ করতে কোনও অসুবিধা নেই।
সূত্র: সিয়ারু আ’লামিন নুবালা খ:৭ পৃ: ৩৫২
عن المعتمر بن سليمان قال رأيت أبا كعب صاحب الحرير -يدعو رافعا يديه فإذا فرغ مسح بهما وجهه فقلت له مَن رأيتَ يفعل هذا قال الحسن بن أبي الحسن
অর্থাৎ মু’ত্বমার ইবনে সুলাইমান থেকে বর্ণিত, একদা আবু কা’ব রহ. রেশম ওয়ালা দু’আর সময় হাত উত্তলন করলেন এবং দুয়া শেষে মুখে হাত মাসাহ করলেন। যখন আমি (মুত্বমার) তাঁকে এমনটি করার কারন জিজ্ঞেস করলাম, তখন তিনি বললেন, হাসান বসরি রহ. এমনটি করতেন।
সূত্র: ফাযযুল ওয়া’আ লিস সুয়ুতী হাদিস: ৫৯
হাদিসটির মান:
ইমাম সুয়ুতী বলেন, إسناده حسن অর্থাৎ হাদীসটির সনদ হাসান।
সূত্র: ফাযযুল ওয়া’আ লিস সুয়ুতী হাদিস: ৫৯
প্রমাণ-৬
قال عبد الرزاق وربما رأيت معمرا يفعله وأنا أفعله
অর্থাৎ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রাবি মামার রহ. অনুরূপ আমল (দুআ শেষে মুখে দু হাত মাসাহ) করতেন এবং আমিও তা করতাম।
সূত্র: মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদিস: ৩২৩৫
ইবনে বা’য রহ. এর অভিমত:
مسح الوجه بعد الدعاء ليس بدعة لكن تركه أفضل لأن الأحاديث فيه ضعيفة وقد ذهب جماعة إلى تحسينها لأنها من باب الحسن لغيره كما ذكر الحافظ ابن حجر رحمه الله في آخر بلوغ المرام وذكر ذلك آخرون
অর্থ: দু’আর শেষে মুখ মসাহ করা বিদ’আত নয়।কিন্ত এটা না করাই উত্তম। এই বিষয়ে যঈফ হাদীস এসেছে।অবশ্য এটাকে একটা জামাআত বিদ্বান উত্তম মনে করেছেন।কেননা এই বিষয়ের হাদীস হাসান লি গাইরীহী সাব্যস্ত হয়েছে।যেমনটি ইবনু হাজার উল্লেখ করেছেন স্বীয় বুলুগুল মারামে। এবং অন্যরাও উল্লেখ করেছেন।
তিনি উক্ত ফতাওয়ার শেষ দিকে আরও লিখেছেন,
من مسح فلا حرج ولا ينكر عليه ولا يقال بدعة
অর্থাৎ যদি কেউ মুখ মাসাহ করে, তাতে কোনো অসুবিধা নেই।তাকে মন্দ বলে কটাক্ষ করা যাবেনা ,আর এটা বিদআত বলাও যাবে না।
সূত্র: নুরুন আলাদ্দারব ফাতওয়া নং: ১৭০৩৯
মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উছাইমিন রহ. এর মত:
أَنَّ مَسْحَ الوَجْهِ ليس بالسنة لكِنَّ مَنْ مَسَحَ فَلَا يُنْكَرُ عَليهِ وَمَنْ تَرَكَ فَلَا يُنْكَرُ عَلَيْهِ
অর্থ-“ মুখে হাত মাসাহ করা সুন্নাত নয় ।তবে যে ব্যাক্তি মুখ মাসাহ করবে তাঁর উপর মন্দ আরোপিত হবেনা, আর যে এই আমাল ছেড়ে দেবে তাকেও মন্দ বলা যাবেনা।
সূত্র: মাজমুয়া ফাতাওয়া লি উছাইমীন খ: ১৪ পৃ: ১৬১-১৬২
أن مسح الوجه باليدين بعد الدعاء ليس بسنة ولكن الإنسان لا يفعله ولا ينكر على من فعله لأن بعض العلماء استحبه
অর্থ: মুখ মাসাহ করা সুন্নাত না । কিন্ত যে সকল মানুষেরা এই আমাল করেনা তারা তাদের উপর দোষ আরোপ করবেনা যারা এটা করেন।কেননা অনেক উলামা একে মুস্তাহাব বলেছেন।
সূত্র: ফাতাওয়া নুর আলাদ্দারব লি উছাইমীন- খ: ২৪ পৃঃ ২
শায়খ আল জিবরীন রহ. এর অভিমত:
সৌদির মুফতী শাইখ আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল জিবরীন রহ. বলেন,
إذا دعا خارج الصلاة سُنَّ له رفع اليدين، وبعد الدعاء مسح الوجه بهما، وأحاديث رفع اليدين جمعها السيوطي في رسالة له اسمها (قبض الوعاء في أحاديث رفع اليدين في الدعاء)، وأحاديث مسح الوجه جمعها الشيخ بكر أبو زيد في بعض رسائله فبلغت سبعة أحاديث، وروى ذلك أيضًا من فعل كثير من الصحابة، وهو يعم الدعاء في الصلاة وخارج الصلاة. والله أعلم.
অর্থাৎ যখন নামাজের শেষে দু’আ করবে, তখন সুন্নাহ হলো, “দুই হাত উত্তলিত করবে, এবং দু’আ শেষে মুখে হাত মাসাহ করবে।” ইমাম সুয়ুতি তার فض الوعاء في أحاديث رفع اليدين في الدعاء নামক কিতাবে হাত উত্তলন বিষয়ক অসংখ্য হাদীস একত্রিত করেছেন। আর বাকার আবু যায়দ তার কিতাবে সাতটি হাদীস এনেছেন। উপরন্তু অসংখ্য সাহাবী থেকে এই আমালের রেওয়াত করেছেন। যেগুলির হুকুম ব্যাপক, তা সালাতের বাইরে হোক বা ভিতরে।
সূত্র: ফাতওয়া ইবনু জীবরীন: ৩০০৮
সম্মিলিতভাবে দোয়া:
সম্মিলিতভাবে দোয়া করা প্রসঙ্গে অনেকে বিরুপ মন্তব্য করে থাকেন। অনেকে তো সম্মিলিতভাবে দোয়া করা বিদআত বলেও ঘোষণা করে দিয়েছেন। অথচ শরীয়ত যেখানে কোনো একটি পন্থা নির্দিষ্ট করেনি সেখানে উভয় পন্থাই মুবাহ। বিনা দলীলে কোনো একটিকে যেমন নাজায়েয বলা যায় না তেমনি সুন্নত বা জরুরিও বলা যায় না। এ ধরনের ক্ষেত্রে উভয় পন্থাই মুবাহ ও দোয়াকারীর ইচ্ছাধীন থাকে।
প্রমাণ-১
ফিরআউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা যখন হযরত মুসা আ: এর সত্যের দাওয়াত কবুল করতে অস্বীকৃতি জানালো এবং স্বীয় ভ্রষ্টতা ও কুফরীর উপর অটল থাকার ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল পাশাপাশি ঈমানদারদের উপর জুলুম ও নির্যাতনের ধারা অব্যাহত রাখল, তখন মুসা আঃ আল্লাহর কাছে তাদের ধ্বংসের দোয়া করলেন।
وَقَالَ مُوسَى رَبَّنَا إِنَّكَ آتَيْتَ فِرْعَوْنَ وَمَلأهُ زِينَةً وَأَمْوَالاً فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا رَبَّنَا لِيُضِلُّواْ عَن سَبِيلِكَ رَبَّنَا اطْمِسْ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَاشْدُدْ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَلاَ يُؤْمِنُواْ حَتَّى يَرَوُاْ الْعَذَابَ الأَلِيمَ
অর্থাৎ মুসা বলল, হে আমার পরওয়ারদেগার, তুমি ফেরাউনকে এবং তার সর্দারদেরকে পার্থব জীবনের আড়ম্বর দান করেছ, এবং সম্পদ দান করেছ-হে আমার পরওয়ারদেগার, এ জন্যই যে তারা তোমার পথ থেকে বিপথগামী করব! হে আমার পরওয়ারদেগার, তাদের ধন-সম্পদ ধ্বংস করে দাও এবং তাদের অন্তরগুলোকে কাঠোর করে দাও যাতে করে তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান না আনে যতক্ষণ না বেদনাদায়ক আযাব প্রত্যক্ষ করে নেয়।
সুরা ইউনুস আয়াত:৮৮
তখন আল্লাহ তা’য়ালা জানিয়ে দিলেন,
قَالَ قَدْ أُجِيبَت دَّعْوَتُكُمَا فَاسْتَقِيمَا وَلاَ تَتَّبِعَآنِّ سَبِيلَ الَّذِينَ لاَ يَعْلَمُونَ
অর্থাৎ আল্লাহ বললেন, তোমাদের দোয়া মঞ্জুর হয়েছে। অতএব তোমরা দুজন অটল থাকো এবং তাদের পথে চলো না যারা অজ্ঞ।
সুরা ইউনুস আয়াত:৮৯
এ কথাটি একাধিক সাহাবী ও বেশ কয়েকজন তাবেঈ ইমামের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত মুসা আ. দুআ করেছেন এবং হারূন আ. আমীন বলেছেন। তাফসীরে ইবনে কাসীরে এসেছে,
قَالَ أَبُو الْعَالِيَةِ، وَأَبُو صَالِحٍ، وَعِكْرِمَةُ، وَمُحَمَّدُ بْنُ كَعْبٍ الْقُرَظِيُّ، وَالرَّبِيعُ بْنُ أَنَسٍ: دَعَا مُوسَى وأمَّنَ هَارُونُ
অর্থাৎ আবুল আলিয়া,আবু সালেহ,ইকরামা,মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল কুরাযী এবং রবী ইবনে আনাস বলেন, যখন মুসা আ: দোয়া করছিলেন, তখন হারুন আ: আমিন আমিন বলছিলেন।
সূত্র: তাফসীরে ইবনে কাছীর খ: ২ পৃ: ৪৭০ আদ্দুররুল মানছূর খ: ৩ পৃ: ৩১৫
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা গেল, মুসা আ. ও হারূন আ. একসাথে সম্মিলিতভাবে দুআ করেছেন।
প্রমাণ-২
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا قَالَ الإِمَامُ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِينَ فَإِنَّهُ مَنْ وَافَقَ قَوْلُهُ قَوْلَ الْمَلاَئِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
অর্থ: হযরত আবু হুরাইরাহ্ রা. হতে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইমাম غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ পড়লে তোমরা ‘আমীন’ বলো। কেননা, যার এ (আমীন) বলা ফিরিস্তাদের (আমীন) বলার সাথে একই সময় হয়, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
সূত্র: সহিহ বুখারী হাদিস: ৭৮২
প্রিয় পাঠক, উক্ত হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে যে, নামাজের ভেতর ইমাম সাহেব সকলকে নিয়ে সুরা ফাতিহার মধ্যে যে দুআ আছে, সেটা যখন শেষ করবেন, তখন সবাই আমিন বলবে। এটা কি সম্মিলিত দোয়া বৈধ হওয়ার সুস্পষ্ট দলীল নয়?
প্রমাণ-৩
এব্যাপারে আরওসুস্পষ্ট সহিহ হাদিস রয়েছে,
عن سلمان رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ما رفَع قومٌ أكُفَّهم إلى اللهِ عَزَّ وجَلَّ يسألونه شيئًا إلّا كان حقًّا على اللهِ أن يضَعَ في أيديهم الَّذي سألوا
অর্থ হযরত সালমান (রাঃ) বলেন, নবী কারীম সল্লাল্লাহু ‘আলাইহী ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,কোন জামাআত কিছু প্রার্থনা করার জন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুললে আল্লাহ তাআলার উপর ওয়াজিব হয়ে যায় তাদের প্রার্থিত বস্তু তাদের হাতে তুলে দেয়া।
সূত্র: মু’জামে কাবীর (তাবারানী) হাদিস: ৬১৪২
মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ: ১০ পৃ: ১৭২ জামে সগীর হাদিস: ৭৮৯৩
হাদিসটির মান:
আল্লামা হাইসামী রহ: উক্ত হাদিসটির ব্যাপারে বলেন,
ورجاله رجال الصحيح
মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ: ১০ পৃ: ১৭২
প্রমাণ-৪
عن سلمان رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ما رفَع قومٌ أكُفَّهم إلى اللهِ عَزَّ وجَلَّ يسألونه شيئًا إلّا كان حقًّا على اللهِ أن يضَعَ في أيديهم الَّذي سألوا
অর্থ হযরত সালমান (রাঃ) বলেন, নবী কারীম সল্লাল্লাহু ‘আলাইহী ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,কোন জামাআত কিছু প্রার্থনা করার জন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুললে আল্লাহ তাআলার উপর ওয়াজিব হয়ে যায় তাদের প্রার্থিত বস্তু তাদের হাতে তুলে দেয়া।
সূত্র: মু’জামে কাবীর (তাবারানী) হাদিস: ৬১৪২
মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ: ১০ পৃ: ১৭২ জামে সগীর হাদিস: ৭৮৯৩
হাদিসটির মান:
আল্লামা হাইসামী রহ: উক্ত হাদিসটির ব্যাপারে বলেন,
ورجاله رجال الصحيح
মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ: ১০ পৃ: ১৭২
প্রিয় পাঠক, উক্ত হাদিসে সম্মিলিত দোয়া করার ব্যাপারে আমভাবে বলা হয়েছে।
প্রমাণ-৫
عَنْ حَبِيبِ بْنِ مَسْلَمَةَ الْفِهْرِيّ وَكَانَ مُسْتَجَابًا
أَنَّهُ أُمِّرَ عَلَى جَيْشٍ فَدَرِبَ الدُّرُوبِ فَلَمَّا لَقِيَ الْعَدُوَّ قَالَ لِلنَّاسِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ لَا يَجْتَمِعُ مَلَأٌ فَيَدْعُو بَعْضُهُمْ وَيُؤَمِّنُ سَائِرُهُمْ إِلَّا أَجَابَهُمُ اللَّهُ
অর্থ: হযরত হাবীব বিন মাসলামা আলফিহরী রাঃ। যিনি মুস্তাজাবুদ দাওয়া ছিলেন। তাকে একবার একটি বাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের পর তিনি যখন শত্রুর সম্মুখিন হলেন। তখন লোকদের বললেন, আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন “যখনি কোন দল একত্র হয়, তারপর তাদের কথক দোয়া করে, আর অপরদল আমীন বলে তখন আল্লাহ তাআলা তা কবুল করে নেন”।
সূত্র: মাজমাউয যাওয়ায়েদ হাদীস: ১৭৩৪৭, মুস্তাতাদরাক আলাস সহীহাইন: ৫৪৭৮, আলমুজামুল কাবীর, হাদীস নং-৩৫৩৬
হাদিসটির মান:
আল্লামা হায়ছামী রহঃ বলেন,
ورجاله رجال الصحيح غير ابن لهيعة وهو حسن الحديث
অর্থাৎ উক্ত হাদীসের সূত্রের প্রতিটি রাবী সহীহের রাবী। ইবনে লাহিয়াহ ছাড়া। কিন্তু সেও হাসান পর্যায়ের রাবী।
সূত্র: মাযমাউয যাওয়ায়েদ খ: ১০ পৃ: ১৭০
প্রমাণ-৬
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ لله مَلاَئِكَةً يَطُوفُونَ فِي الطُّرُقِ يَلْتَمِسُونَ أَهْلَ الذِّكْرِ فَإِذَا وَجَدُوا قَوْمًا يَذْكُرُونَ اللهَ تَنَادَوْا هَلُمُّوا إِلٰى حَاجَتِكُمْ قَالَ فَيَحُفُّونَهُمْ بِأَجْنِحَتِهِمْ إِلٰى السَّمَاءِ الدُّنْيَا قَالَ فَيَسْأَلُهُمْ رَبُّهُمْ وَهُوَ أَعْلَمُ مِنْهُمْ مَا يَقُوْلُ عِبَادِي قَالُوا يَقُوْلُونَ يُسَبِّحُونَكَ وَيُكَبِّرُونَكَ وَيَحْمَدُونَكَ وَيُمَجِّدُونَكَ قَالَ فَيَقُوْلُ هَلْ رَأَوْنِي قَالَ فَيَقُوْلُونَ لاَ وَاللهِ مَا رَأَوْكَ قَالَ فَيَقُوْلُ وَكَيْفَ لَوْ رَأَوْنِي قَالَ يَقُوْلُونَ لَوْ رَأَوْكَ كَانُوا أَشَدَّ لَكَ عِبَادَةً وَأَشَدَّ لَكَ تَمْجِيدًا وَتَحْمِيدًا وَأَكْثَرَ لَكَ تَسْبِيحًا قَالَ يَقُوْلُ فَمَا يَسْأَلُونِي قَالَ يَسْأَلُونَكَ الْجَنَّةَ قَالَ يَقُوْلُ وَهَلْ رَأَوْهَا قَالَ يَقُوْلُونَ لاَ وَاللهِ يَا رَبِّ مَا رَأَوْهَا قَالَ يَقُوْلُ فَكَيْفَ لَوْ أَنَّهُمْ رَأَوْهَا قَالَ يَقُوْلُونَ لَوْ أَنَّهُمْ رَأَوْهَا كَانُوا أَشَدَّ عَلَيْهَا حِرْصًا وَأَشَدَّ لَهَا طَلَبًا وَأَعْظَمَ فِيهَا رَغْبَةً قَالَ فَمِمَّ يَتَعَوَّذُونَ قَالَ يَقُوْلُونَ مِنْ النَّارِ قَالَ يَقُوْلُ وَهَلْ رَأَوْهَا قَالَ يَقُوْلُونَ لاَ وَاللهِ يَا رَبِّ مَا رَأَوْهَا قَالَ يَقُوْلُ فَكَيْفَ لَوْ رَأَوْهَا قَالَ يَقُوْلُونَ لَوْ رَأَوْهَا كَانُوا أَشَدَّ مِنْهَا فِرَارًا وَأَشَدَّ لَهَا مَخَافَةً قَالَ فَيَقُوْلُ فَأُشْهِدُكُمْ أَنِّي قَدْ غَفَرْتُ لَهُمْ قَالَ يَقُوْلُ مَلَكٌ مِنْ الْمَلاَئِكَةِ فِيهِمْ فُلاَنٌ لَيْسَ مِنْهُمْ إِنَّمَا جَاءَ لِحَاجَةٍ قَالَ هُمْ الْجُلَسَاءُ لاَ يَشْقٰى بِهِمْ جَلِيسُهُمْ
অর্থ: আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর একদল ফেরেশতা আছেন, যাঁরা আল্লাহর যিকরে রত লোকেদের খোঁজে পথে পথে ঘুরে বেড়ান। যখন তাঁরা কোথাও আল্লাহর যিকরে রত লোকেদের দেখতে পান, তখন ফেরেশতারা পরস্পরকে ডাক দিয়ে বলেন, তোমরা আপন আপন কাজ করার জন্য এগিয়ে এসো। তখন তাঁরা তাঁদের ডানাগুলো দিয়ে সেই লোকদের ঢেকে ফেলেন নিকটবর্তী আকাশ পর্যন্ত। তখন তাঁদের প্রতিপালক তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন (যদিও ফেরেশতাদের চেয়ে তিনিই অধিক জানেন) আমার বান্দারা কী বলছে?
তখন তাঁরা বলে, তারা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছে, তারা আপনার শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিচ্ছে, তারা আপনার গুণগান করছে এবং তারা আপনার মাহাত্ম্যপ্রকাশ করছে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি আমাকে দেখেছে? তখন তাঁরা বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার শপথ! তারা আপনাকে দেখেনি। তিনি বলবেন, আচ্ছা, তবে যদি তারা আমাকে দেখত? তাঁরা বলবেন, যদি তারা আপনাকে দেখত, তবে তারা আরও অধিক পরিমাণে আপনার ‘ইবাদাত করত, আরো অধিক আপনার মাহাত্ম্য ঘোষণা করত, আরো অধিক পরিমাণে আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করত।
বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহ বলবেন, তারা আমার কাছে কী চায়? তাঁরা বলবে, তারা আপনার কাছে জান্নাত চায়। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি জান্নাত দেখেছে? ফেরেশতারা বলবেন, না। আপনার সত্তার কসম! হে রব! তারা তা দেখেনি। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, যদি তারা দেখত তবে তারা কী করত? তাঁরা বলবে, যদি তারা তা দেখত তাহলে তারা জান্নাতের আরো অধিক লোভ করত, আরো বেশি চাইত এবং এর জন্য আরো বেশি বেশি আকৃষ্ট হত।। আল্লাহ্ তা‘আলা জিজ্ঞেস করবেন, তারা কী থেকে আল্লাহর আশ্রয় চায়? ফেরেশতাগণ বলবেন, জাহান্নাম থেকে। তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি জাহান্নাম দেখেছে? তাঁরা জবাব দেবে, আল্লাহর কসম! হে প্রতিপালক! তারা জাহান্নাম দেখেনি।
তিনি জিজ্ঞেস করবেন, যদি তারা তা দেখত তখন তাদের কী হত? তাঁরা বলবে, যদি তারা তা দেখত, তাহলে তারা তাত্থেকে দ্রুত পালিয়ে যেত এবং একে অত্যন্ত বেশি ভয় করত। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা বলবেন, আমি তোমাদের সাক্ষী রাখছি, আমি তাদেরক্ষমা করে দিলাম। তখন ফেরেশতাদের একজন বলবে, তাদের মধ্যে অমুক ব্যক্তি আছে, যে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং সে কোন প্রয়োজনে এসেছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলবেন, তারা এমন উপবেশনকারী যাদের মাজলিসে উপবেশনকারী বিমুখ হয় না।
সূত্র: সহীহ বুখারী হাদীস: ৬৪০৮ সহীহ মুসলিম: ২৬৮৯
প্রিয় পাঠজ, একটু ভাবুন, এই হাদীসে যিকিরের মজলিসের ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। যিকরের হালকায় কী আমল হয় তারও বিবরণ আছে। মজলিসে তাসবীহ ও তাহলীলের সঙ্গে জান্নাতের প্রার্থনা ঔ জাহান্নাম থেকে পানাহ চাওয়া ও ইস্তেগফারের আমলও শামিল রয়েছে। প্রশ্ন এই যে, জান্নাত লাভের ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রার্থনা, ইসতিগফার- এগুলো কি দুআ নয়? আর যিকিরের হালকায় যিকরের সঙ্গে যখন দুআও শামিল রয়েছে তো এটা কি সম্মিলিত দুআ হল না? তাহলে সম্মিলিত দুআ যারা বিদআত বলেন, তারা কি একটু ভাববেন না?
প্রমাণ-৭
عَنْ عَائِشَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَا حَسَدَتْكُمُ الْيَهُودُ عَلَى شَىْءٍ مَا حَسَدَتْكُمْ عَلَى السَّلاَمِ وَالتَّأْمِينِ
অর্থ: হযরত আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ইয়াহূদীরা তোমাদের কোন ব্যাপারে এত বেশি ঈর্ষান্বিত নয় যতটা তারা তোমাদের সালাম ও আমীনের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত।
সূত্র: ইবনে মাজা হাদিস: ৮৫৬ মুসনাদে আহমাদ:২৫০২৯ জামে সগীর: ৭৭৭১ ফাতহুল গফফার খ: ১ পৃ: ৩৩৮
হাদিসটির মান:
১. ইমাম মুনয়িরী র. বলেন,
إسناده صحيح
অর্থাৎ হাদিসটির সনদ সহিহ।
সূত্র: আত তারগীব ওয়াত তারহীব খ:১ পৃ: ২৩৮
২. আহলে হাদিসের মান্যবর ব্যক্তি আলবানী মরহুম বলেন,
إسناده صحيح رجاله رجال مسلم
অর্থাৎ হাদিসটির সনদ সহিহ এবং এ হাদিসের সকল রাবী মুসলিমের রাবী।
সূত্র: আসলু সিফাতিস সালাহ খ: ১ পৃ: ৩৮৮
প্রিয় পাঠক, একটু গভীরে ভাবলে অনেক কিছুই পরিস্কার হয়ে যাবে হাদিসটির মাধ্যমে। নবীজি সা. বলেছেন, তোমাদের আমিনের উপর ইহুদী খৃষ্টানদের হিংসা হয়, এর অর্থ হলো “যখন কেউ দুআ করে আর তোমরা “আমিন” “আমিন” বলতে থাকো” এটা ইহুদী খ্রীষ্টানদের কাছে একটি হিংসার ব্যাপার। এটা কি সম্মিলিত দুআর হাদিস নয়? এত গুলো দলীলের পরও কি বলা যায় এ কথা যে, যেকোনো মজলিসে সম্মিলিত দুআ বিদআত? আল্লাহ সবাই সহিহ বুঝ দান করুন। আমিন!
ফরজ নামাজের পর একাকী দোয়া:
মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,
فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ
অর্থাৎ: (হে রাসূল সা.) যখন আপনি নামাজ থেকে অবসর হবেন, তখন দোয়ায় লিপ্ত হোন এবং আপনার প্রভূর দিকে মনোনিবেশ করুন ৷
সূরা ইনশিরাহ আয়াত: ৭
অত্র আয়াতের বিভিন্ন তাফসীর মুফাসসিরীনে কেরাম লিখেছেন। এ ব্যাপারে ১০ টি তাফসীরের উদ্বৃত পেশ করা হলো,
১. তাফসীরে ইবনে কাসীর:
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ: ﴿فَانْصَبْ وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ﴾ بَعْدَ فَرَاغِكَ مِنَ الصَّلَاةِ وَأَنْتَ جَالِسٌ
অর্থাৎ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি সূরা ইনশিরাহ এর فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ আয়াতের তাফসীরে বলেন, যখন তুমি ফরজ নামায থেকে ফারেগ হবে, তখন বসা অবস্থায় (আল্লাহর দরবারে দু’আতে মশগুল হবে)।
২. তাফসীরে তাবারী
عن ابن عباس ﴿فَإِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْ﴾ يقول: فإذا فرغت مما فُرض عليك من الصلاة فسل الله، وارغب إليه، وانصب له
অর্থাৎ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, তিনি সূরা ইনশিরাহ এর فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ আয়াতের তাফসীরে বলেন, তোমার উপর কৃত ফরজ নামাজ আদায় করবে, তখন আল্লাহর কাছে চাও, আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করো এবং আল্লাহর কাছে দোয়ায় মশগুল হও।
৩. তাফসীরে কুরতুবী
قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ و قتادة فَإِذَا فَرَغْتَ مِنْ صَلَاتِكَ فَانْصَبْ أَيْ بَالِغْ فِي الدُّعَاءِ وَسَلْهُ حَاجَتَكَ
অর্থাৎ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, যখন তুমি তেমার নামাজ আদায় করবে, তখন দোয়ায় মশগুল হও এবং তোমার প্রয়োজনীয় বিষয়াদি আল্লাহর কাছে চাও।
قَالَ فَإِذَا فَرَغْتَ مِنْ صَلَاتِكَ فَانْصَبْ أَيْ بَالِغْ فِي الدُّعَاءِ وَسَلْهُ حَاجَتَكَ
অর্থাৎ: হযরত কাতাদাহ র. বলেন, যখন তুমি তেমার নামাজ আদায় করবে, তখন দোয়ায় মশগুল হও এবং তোমার প্রয়োজনীয় বিষয়াদি আল্লাহর কাছে চাও।
৪. তাফসীরে বগবী:
قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ وَقَتَادَةُ وَالضَّحَّاكُ وَمُقَاتِلٌ وَالْكَلْبِيُّ فَإِذَا فَرَغْتَ مِنَ الصَّلَاةِ الْمَكْتُوبَةِ فَانْصَبْ إِلَى رَبِّكَ فِي الدُّعَاءِ وَارْغَبْ إِلَيْهِ فِي الْمَسْأَلَةِ يُعْطِكَ
অর্থাৎ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কাতাদাহ র. যাহহাক র. মুকাতিল র. এবং কালবী র. বলেন, যখন তুমি তেমার ফরজ নামাজ আদায় করবে, তখন দোয়ায় আল্লাহর দিকে মশগুল হও এবং চাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করো, তিনি তেমাকে দান করবেন।
وَرَوَى عَبْدُ الْوَهَّابِ بْنُ مُجَاهِدٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ إِذَا صَلَّيْتَ فَاجْتَهِدْ فِي الدُّعَاءِ وَالْمَسْأَلَةِ
অর্থাৎ: আব্দুল ওয়াহহাব ইবনে মুজাহিদ তিনি তার পিতা মুজাহিদ র. থেকে বর্ণনা করেন, যখন তুমি নামাজ আদায় করবে তখন দোয়া এবং চাওয়ার আমল করো।
৫. তাফসীরে রাযী
قالَ قَتادَةُ والضَّحّاكُ ومُقاتِلٌ: إذا فَرَغْتَ مِنَ الصَّلاةِ المَكْتُوبَةِ ﴿فانْصَبْ وإلى رَبِّكَ﴾ [الشَّرْحِ: ٧] في الدُّعاءِ وارْغَبْ إلَيْهِ في المَسْألَةِ يُعْطِكَ
অর্থাৎ: কাতাদাহ র. যাহহাক র. মুকাতিল র. বলেন, যখন তুমি তেমার ফরজ নামাজ আদায় করবে, তখন দোয়ায় আল্লাহর দিকে মশগুল হও এবং চাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করো, তিনি তেমাকে দান করবেন।
৬. তাফসীরে ইবনুল জাওযী
অত্র আয়াতের মোট পাঁচটি অর্থ করেছেন। এর মধ্যে ২য় অর্থ করেছেন-
والثّانِي: فَإذا فَرَغْتَ مِنَ الصَّلاةِ فانْصَبْ في الدُّعاءِ، قالَهُ ابْنُ عَبّاسٍ، والضَّحّاكُ، ومُقاتِلٌ.
অর্থাৎ: আর দ্বিতীয় অর্থ হলো, যখন তুমি নামাজ শেষ করবে, তখন দোয়ায় মশগুল হও। এটা বলেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., যাহহাক র. এবং মুকাতিল র.।
৭. তাফসীরে নাসাফী
وعَنِ ابْنِ عَبّاسٍ – رَضِيَ اللهُ عَنْهُما -: “فَإذا فَرَغْتَ مِن صَلاتِكَ فاجْتَهِدْ في الدُعاءِ
অর্থাৎ: ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন তুমি নামাজ আদায় করবে তখন দোয়া এবং চাওয়ার আমল করো।
৮. তাফসীরে কাশশাফ
وعن ابن عباس: فإذا فرغت من صلاتك فاجتهد في الدعاء
অর্থাৎ: ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন তুমি নামাজ আদায় করবে তখন দোয়া এবং চাওয়ার আমল করো।
৯. দুররে মানসুর
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ ﴿فَإذا فَرَغْتَ فانْصَبْ﴾ إلى الدُّعاءِ ﴿وإلى رَبِّكَ فارْغَبْ﴾ في المَسْألَةِ
অর্থাৎ: ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন তুমি নামাজ শেষ করবে, তখন দোয়ায় মশগুল হও এবং চাওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করো।
১০. তাফসীরে বায়যাবী
فَإذا فَرَغْتَ مِنَ الصَّلاةِ فانْصَبْ بِالدُّعاءِ
অর্থাৎ: যখন তুমি নামাজ শেষ করবে, তখন দোয়ায় মশগুল হও।
হাদিস-১
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَتَانِي اللَّيْلَةَ رَبِّي تَبَارَكَ وَتَعَالَى فِي أَحْسَنِ صُورَةٍ قَالَ أَحْسَبُهُ قَالَ فِي الْمَنَامِ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ هَلْ تَدْرِي فِيمَ يَخْتَصِمُ الْمَلأُ الأَعْلَى قَالَ قُلْتُ لاَ قَالَ فَوَضَعَ يَدَهُ بَيْنَ كَتِفَىَّ حَتَّى وَجَدْتُ بَرْدَهَا بَيْنَ ثَدْيَىَّ أَوْ قَالَ فِي نَحْرِي فَعَلِمْتُ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ قَالَ يَا مُحَمَّدُ هَلْ تَدْرِي فِيمَ يَخْتَصِمُ الْمَلأُ الأَعْلَى قُلْتُ نَعَمْ قَالَ فِي الْكَفَّارَاتِ وَالْكَفَّارَاتُ الْمُكْثُ فِي الْمَسَاجِدِ بَعْدَ الصَّلَوَاتِ وَالْمَشْىُ عَلَى الأَقْدَامِ إِلَى الْجَمَاعَاتِ وَإِسْبَاغُ الْوُضُوءِ فِي الْمَكَارِهِ وَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ عَاشَ بِخَيْرٍ وَمَاتَ بِخَيْرٍ وَكَانَ مِنْ خَطِيئَتِهِ كَيَوْمَ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ وَقَالَ يَا مُحَمَّدُ إِذَا صَلَّيْتَ فَقُلِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَتَرْكَ الْمُنْكَرَاتِ وَحُبَّ الْمَسَاكِينِ وَإِذَا أَرَدْتَ بِعِبَادِكَ فِتْنَةً فَاقْبِضْنِي إِلَيْكَ غَيْرَ مَفْتُونٍ
অর্থ: ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একদা রাতে সুমহান ও বরকতময় আমার রব আমার কাছে সুন্দরতম রূপে এসেছিলেন। (রাবী বলেন, যতদূর মনে পড়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ’স্বপ্নে’ কথাটি বলেছিলেন।) তিনি বললেনঃ হে মুহাম্মাদ! আপনি কি জানেন, কি নিয়ে মালা-এ-আলা (সর্বোচ্চ ফেরেশতা পরিষদ)-এ বিতর্ক হচ্ছে? আমি বললামঃ না।
নবীজী বলেনঃ তখন তিনি আমার কাঁধের মাঝে তার হাত রাখলেন। এমনকি এর স্নিগ্ধতা আমি আমার বুকেও অনুভব করলাম। এতে আসমান ও যমীনের যা কিছু আছে সব আমি জানতে পারলাম।
তিনি বললঃ হে মুহাম্মাদ! আপনি কি জানেন, কি নিয়ে মালা-এ আলায় আলোচনা হচ্ছে?
আমি বললামঃ হ্যাঁ, গুনাহের কাফফারা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সালাতের পর মসজিদে অবস্থান করাও কাফফারা, জামাআতে পায়ে হেঁটে যাওয়া, কষ্টের সময় পরিপূর্ণভাবে উযূ করাও কাফফারা। যে ব্যক্তি এই কাজ করবে তার জীবন হবে কল্যাণময়, আর মৃত্যুও হবে কল্যাণময়। যেই দিন তাঁর মা তাকে ভূমিষ্ঠ করলেন গুনাহর ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থা হবে সেই দিনের মত। আমার রব বললেনঃ হে মুহাম্মাদ! সালাত (নামায) শেষে বলবেনঃ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَتَرْكَ الْمُنْكَرَاتِ وَحُبَّ الْمَسَاكِينِ وَإِذَا أَرَدْتَ بِعِبَادِكَ فِتْنَةً فَاقْبِضْنِي إِلَيْكَ غَيْرَ مَفْتُونٍ
হে আল্লাহ্! আপনার কাছে আমি যাঞ্ছা করি ভাল কাজ করা এবং মন্দ কাজ পরিত্যাগের, দরিদ্রদের প্রতি ভালবাসা পোষণের তওফীক। আপনি যখন বান্দাদের বিষয়ে ফেতনা মুসীবতের ইরাদা করবেন তখন আমাকে যেন ফেতনা মুক্ত অবস্থায় উঠিয়ে নেন।
সূত্র: জামে তিরমিযি হাদিস: ৩২৩৩ আহমাদ: ৩৪৮৪
হাদিসটি সহিহ সনদে বর্ণিত। এমনকি আহলে হাদিসদের শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানীও হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
হাদিস-২
ফরজ নামাজের পর দোয়া দ্রুত কবুল হয়:
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ قَالَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَىُّ الدُّعَاءِ أَسْمَعُ قَالَ جَوْفُ اللَّيْلِ الآخِرُ وَدُبُرَ الصَّلَوَاتِ الْمَكْتُوبَاتِ
অর্থ: হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি সা. কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোন দু’আ বেশী কবুল হয়? তিনি বললেনঃ শেষ রাতের মাঝে আর ফরয নামাজগুলের পরে।
সূত্র: জামে তিরমিযি হাদিস: ৩৪৯৯
হাদিসটির মান:
১. ইমাম তিরমিযি নিজেই হাদিসটর ব্যাপারে বলেছেন,
قَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ
অর্থাৎ এ হাদিসটি হাসান।
২. ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেছেন,
رجاله ثقات
অর্থাৎ হাদিসটির বর্ণনাকারীগণ সবাই “ছিকা”।
সূত্র: আদ দিরায়াহ খ: ১ পৃ: ২২৫
৩. আহলে হাদিসদের শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী র: বলেন,
صحيح لغيره
অর্থাৎ হাদিসটি সহিহ লি গায়রিহি তথা হাসান।
সূত্র: সহিহ আত তারগীব হাদিস: ১৬৪৮
একটি প্রশ্ন:
এ হাদিসটি দলীল হিসাবে আমরা যখন পেশ করি, তখন আহলে হাদিসের শায়খরা বলে থাকেন, এখানে الدُّعَاءِ (দোয়া) অর্থ হলো, “যিকির আযকার”।
জবাব:
১. الدُّعَاءِ (দোয়া) শব্দের অর্থ যিকির-আযকার এমন কোনো অর্থ কোনোঅভিধানে নেই।
২. আহলে হাদিসের শায়খরা তো হাদিসের তাবীল বা বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা বৈধ মনে করেন না, যে কারণে আবু হানিফাসহ কোনো ইমামই মানেন না, সুতরাং তাদের দাবী অনুযায়ী এ ক্ষেত্রেও তারা এমন ব্যাখ্যার আশ্রয় নিতে পারেন না।
অতএব ফরজ নামাজের পরে দোয়া করা হাদিস সম্মত।
হাদিস:৩
عن أبي بكرة نفيع بن الحارث أنَّهُ مَرَّ بِوالِدِهِ وهو يَدْعو وَيَقول اللَّهمَّ إنِّي أعوذُ بِكَ مِنَ الكُفرِ وَالفَقرِ وَعَذابِ القَبرِ قال فأخَذتُهُنَّ عنه وكنتُ أدْعُو بِهِنَّ في دُبُرِ كُلِّ صَلاة قالَ فمَرَّ بي وأنا أدْعو بِهِنَّ فقالَ يا بُنَيَّ أنَّى عقَلتَ هؤلاء الكَلماتِ قالَ يا أبَتاهُ سَمِعتُكَ تَدْعو بِهِنَّ في دُبُرِ كُلِّ صَلاةٍ فأخَذتُهُنَّ عنكَ قالَ فالْزَمْهُنَّ يا بُنَيَّ فإنَّ رَسولَ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسَلَّمَ كانَ يَدعو بِهِنَّ في دُبُرِ كُلِّ صَلاةٍ
অর্থ: হযরত আবু বাকরাহ নুফাই’ ইবনে হারিস সাকাফী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি একদিন তাঁর পিতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় এই দোয়া করতে শুনেছিলেন,
اللَّهمَّ إنِّي أعوذُ بِكَ مِنَ الكُفرِ وَالفَقرِ وَعَذابِ القَبرِ
অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট কুফরী ও দরিদ্রতা এবং কবরের আযাব থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই।
তিনি বলেন, আমি দোয়াটি আমার পিতা থেকে মুখস্ত করে নিলাম এবং প্রতি নামাজের পর দোয়াটি করতাম। অতপর একদিন আমার
আমার পিতা পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময়
আমাকে দোয়াটি করতে দেখে প্রশ্ন করলেন, তুমি এ কালিমাগুলো কোত্থেকে শিখেছো? আমি বললাম, হে বাবা, আমি আপনাকে প্রতি নামাজের পর দোয়াটি করতে দেখে আপনার থেকে মুখস্ত করে নিয়েছি। তিনি বললেন, হে সন্তান, এ দোয়াটি আমলে আবশ্যিক করে নাও। কারণ নবী কারীম সা. প্রত্যেক নামাজের পর এ দোয়াটি নিয়মিত করতেন।
সূত্র: মুসনাদে আহমাদ হাদিস: ২০৪৪৭ আবু দাউদ:৫০৯০ নাসাঈ:১৩৪৭ নাতায়িজুল আফকার খ: ২ পৃ: ৩০৯
হাদিসটির মান:
১. ইবনে হাজার আসকালানী র. হাদিসটি হাসান বলেছেন।
সূত্র: নাতায়িজুল আফকার খ: ২ পৃ: ৩০৯
২. আহলে হাদিসের মান্যবর ব্যক্তি শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত বলেন,
إسناده قوي على شرط مسلم
অর্থাৎ ইমাম মুসলিম রহ. এর শর্ত অনুযায়ী হাদিসটির সনদ শক্তিশালী।
সূত্র: তাখরিজুল মুসনাদ হাদিস: ২০৪৪৭
নোট: প্রিয় পাঠক, হাদিসটি থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট-
১. নবীজি সা. দোয়াটি নিশ্চয় উঁচু আওয়াজে করতেন। কারণ দোয়াটি যদি নবীজি সা. আস্তে আস্তে করতেন তাহলে সাহাবী শুনলেন কিভাবে?
২. সাহাবায়ে কেরাম রা. তাঁরাও দোয়াটি নবীজির সা. সাথে করতেন৷ কারণ নবীজি সা. দোয়াটি উঁচুস্বরে করার সময় সাহাবায়ে কেরাম চুপচাপ বসে ছিলেন, এটা মেনে নেয় যায় না। কারণ নবীকে সা. সর্বদিক থেকে সব সময় পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণ করতেন সাহাবায়ে কেরাম রা.।
ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দুআ:
হাদিস-১
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَبِي يَحْيَى قَالَ رَأَيْتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ الزُّبَيْرِ وَرَأَى رَجُلًا رَافِعًا يَدَيْهِ بِدَعَوَاتٍ قَبْلَ أَنْ يَفْرُغَ مِنْ صَلَاتِهِ فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهَا قَالَ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَكُنْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ صَلَاتِهِ
অর্থ: হযরত মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহইয়া (রহঃ) বলেন, ‘আমি আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ) কে দেখেছি যে,তিনি এক ব্যক্তিকে সালাম ফিরানোর পূর্বে হাত তুলে মুনাজাত করতে দেখে তার নামায শেষ হওয়ার পর তাকে ডেকে বললেন,‘রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু ‘আলাইহী ওয়া সাল্লাম কেবল নামায শেষ করার পরই হস্তদ্বয় উত্তোলন করে মুনাজাত করতেন; আগে নয়।’
সূত্র: মু’জামে কাবীর (তাবরানী) হাদিস: ১৩৭৯১
মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ: ১০ পৃ: ১৭২ ই’লাউস সুনান খ: ৩ পৃ: ১৬১
হাদিসটির মান:
আল্লামা হায়ছামী রহ: বলেন-
رجاله ثقات
অর্থাৎ হাদিসের সকল বর্ণনাকারী “ছিকা” তথা সহিহ হাদিসের রাবী।
সূত্র: মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ: ১০ পৃ: ১৭২
প্রমাণ-২
حديث الأسود العامري عن أبيه قال صليت مع النبي صلي الله عليه وسلم الفجر فلما سلم انحرف ورفع يديه و دعا
অর্থাৎ আসওয়াদ আমেরি তাঁর বাবার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করেছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) সালাম ফেরানোর পর পাশ ফেরালেন এবং হাত তুলে দোয়া করলেন।
এলাউস সুনান ৩/১৬৪
তুহফাতুল আহওয়াযী খ: ২ পৃ: ১৬৮
নোট:
হাদিসটি যয়ীফ হলেও এর সমর্থনে আরও হাদিস রয়েছে। বিধায় অত্র হাদিস দ্বারা শুধু আমরা নই খোদ লা-মাযহাবীদের মুখপাত্র মিয়া নজির দেহলবী রহ. ও দলীল পেশ করেছেন।
সূত্র: ফাতাওয়ায়ে নজিরিয়া খ: ১ পৃ: ৫৬৬
ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত দুআ:
ফরজ নামাজের পর দোয়া করার ব্যাপারে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন অঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করতে দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ তো এটাকে সরাসরি বিদ’আত বলে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এর স্বপক্ষে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। চলুন এ সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা দেখা যাক।
দলীল:১
বাহরাইনে মুরতাদদের সঙ্গে ১১ হিজরীতে যে লড়াই হয়েছিল তাতে তিনি সিপাহসালার ছিলেন। সেই অভিযানের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা এই যে, মুসলিম বাহিনী একস্থানে যাত্রাবিরতি করতেই কাফেলার সকল উট রসদপত্রসহ পলায়ন করল। একটি উটও পাকড়াও করা গেল না। অবস্থা এই দাড়াল যে, পরনের কাপড় ছাড়া কোনো রসদ কাফেলার সঙ্গে রইল না। সবার পেরেশান অবস্থা। ‘আলা আলহাযরামী রা. ঘোষকের মাধ্যমে সবাইকে একত্র করলেন এবং শান্তনা দিয়ে বললেন, ‘তোমরা মুসলমান, আল্লাহর রাস্তায় আছ তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী। অতএব আল্লাহ তোমাদেরকে সহায়-সঙ্গী বিহীন অবস্থায় ত্যাগ করবেন না।’
نودي بصلاة الصبح حين طلع الفجر فصلى بالناس، فلما قضى الصلاة جثا على ركبتيه وجثا الناس، ونصب في الدعاء ورفع يديه وفعل الناس مثله حتى طلعت الشمس
অর্থাৎ অতপর ফজরের নামাযের ওয়াক্ত হলে আজান দেয়া হলো। অতঃপর তিনি সকলকে নিয়ে নামায পড়লেন। নামায শেষ করে তিনি হাঁটু গেড়ে (তাশাহহুদের বৈঠকের ন্যায়) বসলেন এবং লোকেরা সকলে হাঁটু গেড়ে বসলো। হযরত আলা বিন হাযরামী রা. হাত তুলে দুআয় মাশগুল হলেন এবং লোকেরাও দুআয় মাশগুল হলো। এভাবে সূর্য ওঠা পর্যন্ত চললো।
সূত্র: আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ খ: ৬ পৃ: ৩৬১
হযরত আলা বিন হাযরমী রা. এবং ও সাথীদের আমল হতে ফরয নামাযের পরে ইজতিমাঈ দুআ প্রমাণিত হয়। আর হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী ইবাদাতের ক্ষেত্রে সাহাবাদের আমল হুকমী মারফু’ অর্থাৎ, রসূলুল্লাহ স. হতে শুনে বা দেখে করেছেন বলে ধরে নেয়া হয়ে থাকে(শরহু নুখবাতিল ফিকার: ৫০-৫১)।
একটি প্রশ্ন:
এই হাদিস দিয়ে দলীল দিলে এক শ্রেণীর লেকজন বলেন, “এটা তো সাহাবায়ে কেরাম রা. বিপদের জন্য করেছেন”।
জবাব:
প্রশ্নটি যারা করেন, জানি না তারা কেমন গভীর জ্ঞান নিয়ে প্রশ্নটি করেন! তাদের জানা উচিৎ যে, সাহাবায়ে কেরাম নবীজি সা. এর দ্বীন পালনে এত মজবুত ছিলেন যে, পাহাড় সরে গেলেও তারা বিদআত কাজ করতেন না। সম্মিলিত দুআ যদি বিদআত হতো, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম রা. সামান্য দুনিয়াবী বিপদে পড়েই বিদআত কাজে শামিল হয়ে গেলেন? কতবড় মুর্খতা ভেবে দেখেছেন কখনও?
দলীল-২
عَنْ ثَوْبَانَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ…وَلاَ يَؤُمَّ قَوْمًا فَيَخُصَّ نَفْسَهُ بِدَعْوَةٍ دُونَهُمْ فَإِنْ فَعَلَ فَقَدْ خَانَهُمْ
অর্থ: হযরত সাওবান রা. হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন:…এবং কোন জনসমষ্টির ইমামতি করে দোয়ার বেলায় তাদের বাদ দিয়ে কেবল নিজের জন্য দোয়া করবে না। এরূপ করলে তাদের সাথে খেয়ানত করা হবে।
সূত্র: জামে তিরমিজী হাদিস: ৩৫৭
হাদিসটির মান:
১. ইমাম তিরমিজী রহ. বলেন: সাওবান রা.-এর হাদীসটি হাসান
সূত্র: জামে তিরমিজী খ: ১ পৃষ্ঠা: ৮২
২. আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ: বলেছেন,
হাদিসটি হাসান।
সূত্র: নাতায়িজুল আফকার খ: ২ পৃ: ১৬৫
একটি প্রশ্ন:
প্রিয় পাঠক, এ হাদীসে মুক্তাদীদেরকে বাদ দিয়ে ইমাম শুধু তাঁর নিজের জন্য দোয়া করলে এটাকে রসূলুল্লাহ স. মুক্তিদীদের সাথে খেয়ানত বলে উল্লেখ করেছেন। হয়তো আহলে হাদিসের ভায়েরা এখানে একটি প্রশ্ন করবেন- “এখানে মূলত নামাজের ভেতরে যেসকল মাসনুন দোয়া রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে বলা হয়েছে, নামাজের পরের দোয়ার কথা বলা হয়নি।”
উত্তর:
এখানে নামাজের ভেতরের দোয়া না বাহিরের দোয়া সে বিষয়টি উল্লেখ্য নেই। উপরন্তু নামাযের মধ্যে আমরা যে দোয়া পড়ে থাকি তার কোনটায় মুক্তাদীদেরকে শরীক করে কোন দোয়া নেই। দুই সিজদার মাঝে এবং দুরুদের পরে যে দোয়া হাদীসে বর্ণিত আছে, সেগুলোও কেবল নিজের জন্য। সুতরাং খেয়ানত থেকে বাঁচার কোন ব্যবস্থা নামাযে পঠিত দোয়াগুলোতে নেই। অবশ্য, নামাযের পরের দোয়াকে হিসাব করলে উক্ত খেয়ানত হতে বাঁচার একটি পথ পাওয়া যেতে পারে।
হাদিসটির দুটি অর্থের সম্ভাবনা:
হাদিসটির فَيَخُصَّ نَفْسَهُ بِدَعْوَةٍ دُونَهُمْ (কোন জনসমষ্টির ইমামতি করে দোয়ার বেলায় তাদের বাদ দিয়ে কেবল নিজের জন্য দোয়া করবে না।)
এর অর্থের ব্যপারে দুটি সম্ভাবনা রয়েছে-
১. শুধু নিজের জন্য দোয়া করা, মুসল্লীদের জন্য না করা।
২. মুসল্লিদের সাথে না নিয়ে শুধু একা একা দোয়া করা।
প্রথম অর্থটি যদি গ্রহণ করি অর্থাৎ “শুধু নিজের জন্য দোয়া করা, মুসল্লীদের জন্য না করা খিয়ানত”
তাহলে সে ক্ষেত্রেও খিয়ানত থেকে বাঁচতে মুসল্লিদের জন্যও দোয়া করতে হবে। সুতরাং ইমাম সাহেবের জন্য নামাজের পর দোয়া করা যেহেতু এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হলো, পরোক্ষভাবে এটাও প্রমাণিত হলো যে, মুসল্লিরাও সে দোয়ায় শরীক হবে। কারণ ইমাম সাহেব যাদের জন্য দোয়া করবেন তাদের জন্য ইমাম সাহেবের সাথে হাত তোলা বিদআত, এটা মুর্খতা সুলভ কথা।
আর যদি ২য় অর্থ গ্রহণ করি অর্থাৎ “মুসল্লিদের সাথে না নিয়ে শুধু একা একা দোয়া করা খিয়ানত।” তাহলে এ ক্ষেত্রে ইমাম সাহেব একা একা দোয়া না করে বরং মুসল্লিদের সাথে নিয়ে সম্মিলিত দোয়া করা বিদআত নয়, বরং আবশ্যকীয় বিষয় প্রমাণ করবে হাদিসটি।
এক কথায় হাদিসটি যেভাবেই অর্থ করুন না কেন ফরজ নামাজের পর সমিলিত দোয়া বৈধ হওয়ার একটি সুস্পষ্ট দলীল।
আহলে হাদীস শায়খরা কি বলেন?
আব্দুর রহমান মুবারকপুরীর অভিমত:
আহলে হাদীসদের দৃষ্ঠিতে ভারত উপমহাদেশে যে কয়জন শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আছেন শায়খ মুবারকপুরী তাদের অন্যতম। তিনি ফরজ নামাজের পর ইমামের সাথে মুসল্লিদের সম্মিলিত মুনাজাত সম্পর্কে বলেন,
اگر امام دعا کرے تو دعا میں شریک ہوجائے اور امام کو بھی بعد نماز فرض کے دعا کرنے کے لیے بیٹھنا ضروری نہیں
অর্থাৎ যদি ইমাম সাহেব দুআ শুরু করে দেন, তাহলে মুক্তাদিও (ইমামের সাথে) শরীক হয়ে যাবে। অবশ্য ইমামের জন্যও ফরজ নামাজের পর দুআ করার জন্য বসা জরুরী নয়।
সূত্র: ফাতাওয়ায়ে উলামায়ে হাদিস খ: ৩ পৃ: ২০৫
নজীর হুসাইন দেহলভীর অভিমত:
আহলে হাদিসের মুখপাত্র মিয়া নজীর হুসাইন দেহলভী রহ. বলেন,
صاحب فہم پر مخفی نہ رہے کہ بعد نماز فراٸض کے ہاتھ اٹھا کے دعا مانگنا جاٸز و مستحب ہے
অর্থাৎ চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, ফরজ নামাজের পর হাত তুলে মুনাজাত করা জায়েয ও মুস্তাহাব।
সূত্র: ফাতাওয়ায়ে নাযীরিয়াহ খ: ১ পৃ: ৫৬৬
ছানাউল্লাহ আমৃতসরীর অভিমত:
আহলে হাদিসের প্রশিদ্ধ আলেম ও মুখপাত্র মাওলানা ছানাউল্লাহ আমৃতসরী বলেন,
حضور صلی اللہ علیہ وسلم نے بھی بعد فراٸض برفع یدین دعاء کی ہے اور امت کو بھی ترغیب دی ہے
অর্থাৎ নবীজি সা. নিজেও ফরজ নামাজের পর দ’হাত তুলে দুআ করেছেন এবং উম্মতকেও উৎসাহ দিয়েছেন।
সূত্র: ফাতাওয়ায়ে ছানাইয়্যাহ-১ পৃ: ৫০০
উপরন্তু আহলে হাদিসের এ প্রশিদ্ধ আলেম মাওলানা ছানাউল্লাহ আমৃতসরী রহ. ফাতাওয়ায়ে ছানাইয়্যাহ ৫০০ পৃষ্ঠা থেকে ৫০৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দীর্ঘ লেখা লিখেছেন। আহলে হাদীস মতবাদের যারা ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দুআ করা বিদআত বলে থাকেন তাদের প্রত্যেকটি কথার দলীল ভিত্তিক জবাব দিয়েছেন।