মহান আল্লাহপাক এক, তাঁর কোনো শরীক নেই, তিনি কারো পিতা নন, তাঁর কোনো স্ত্রী বা সন্তান নেই, তিনি অতুলনীয়, তাঁর সাথে কারো শরীকস্থাপন করার কোনো সুযোগ নেই। না তাঁর জাতের সাথে, না তাঁর সিফাত বা গুনাবলির সাথে। তিনি চিরঞ্জিব, তাঁর কোনো মৃত্যু নেই, তন্দ্রাও নেই। তাঁর ক্ষমতা সর্বময় ও সর্বত্র সমানভাবে চলমান। তিনি প্রভূত্বের আসনে ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তাঁর ওপর কারো কোনো ক্ষমতা চলে না, তাঁর ক্ষমতায় কেউ হস্তক্ষেপও করতে পারে না। তিনিই সবার স্রষ্টা, অতএব সকল মানবমণ্ডিল জন্য তাঁর নৈকট্য অর্জন করা ফরজে আইন।
আল্লাহ সম্পর্কে হেযবুত তওহীদের কুফরি বক্তব্যসমূহ:
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, হেযবুত তওহীদ খোদ আল্লাহপাকের ব্যাপারে যেসকল আকীদা পোষণ করে তা নির্ঘাত শিরক ও কুফর। চলুন এক নজরে সেসব বিশ্বাসগুলো জেনে নেওয়া যাক। তাদের দাবি হলো-
১. আল্লাহ তাআলা প্রভুত্বের আসনে নেই।
২.আল্লাহকে হারিয়ে সার্বভৌমত্বের আসনে দাজ্জাল বসে আছে।
৩। আল্লাহ-কে তাঁর প্রভূত্বের আসন ফিরিয়ে দিতে হেযবুত তওহীদ চেষ্টা করছে।
৪. ইবলিসের কাছে আল্লাহ হেরে গেছেন।
৫. আল্লাহ, ঈশ্বর, গড, ব্রহ্মা সব একই।
৬. মানুষের ভিতরে আল্লাহ পবিত্র রূহ আছে।
৭. মানুষের ভেতরে আল্লাহ-র সকল সিফাত ও ক্ষমতা রয়েছে।
৮. জাহিলিযুগে মানুষের প্রাণের মালিক ছিলো রাজা-বাদশাহরা।
৯. আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা আবশ্যক নয়!
চলুন প্রত্যেকটি বিষয়ে প্রমাণসহ আলোচনা করা যাক।
আল্লাহ তাআলা প্রভুত্বের আসনে নেই:
মহান আল্লাহ নিজ ক্ষমতায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তাঁর ক্ষমতা সর্বসময়ের জন্য চিরস্থায়ী। কখনও সামান্য সময়ের জন্য তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন না। এটাই কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রতিয়মান বিষয়।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
বাংলাদেশে গড়ে ওঠা নতুন উগ্রবাদি একটি কুফরী দলের নাম হেযবুত তাওহীদ। এদের অনেকগুলো মনগড়া বিশ্বাসের মধ্যে একটি হলো- ‘আল্লাহ তায়ালা প্রভুত্বের আসনে নেই’। নাউযুবিল্লাহ। দেখুন তারা কী লিখেছেন,
এক. আল্লাহ তাআলা প্রভুত্বের আসনে নেই।
আজ সমস্ত পৃথিবীতে কোথাও স্রষ্টার, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নেই, মানবজাতির সমষ্টিগত জীবনে আজ মানুষেরই সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে। -দাজ্জাল : পৃ. ৯০
দুই. আল্লাহকে হারিয়ে সার্বভৌমত্বের আসনে দাজ্জাল বসে আছে।
দাজ্জাল আল্লাহকে তার সার্বভৌমত্বের (উলুহিয়াতের) আসন থেকে চ্যুত কোরে নিজে সে আসনে বোসতে চায়। -দাজ্জাল : পৃ. ৯০
আজ সমস্ত পৃথিবীতে কোথাও স্রষ্টার, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নেই, মানবজাতির সমষ্টিগত জীবনে আজ মানুষেরই সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে, আর এটাই হোচ্ছে দাজ্জালের দাবী । রাজতন্ত্র (Monarchy), সমাজতন্ত্র (Socialism), গণতন্ত্র (Democracy), সাম্যবাদ (Communism), একনায়কতন্ত্র (Fascism) এগুলো সবই দাজ্জালের বিভিন্ন রূপ। -দাজ্জাল : পৃ. ৯০
একনায়কতন্ত্র ও সাম্যবাদের এই পরাজয়ের পর থেকে ধনতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক শক্তিই আজ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং এই শক্তিই আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে পরাজিত কোরে নিজে প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে। -দাজ্জাল : পৃ. ৯১
তিন. আল্লাহ-কে তাঁর প্রভূত্বের আসন ফিরিয়ে দিতে হেযবুত তওহীদ চেষ্টা করছে।
দাজ্জালের হাত থেকে পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব ছিনিয়ে নিয়ে আল্লাহর হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই সংগ্রাম করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ। -ধর্মবিশ্বাস পৃ. ২০
সমস্ত পৃথিবী যার করতলগত সেই মহা শক্তিধর দাজ্জালকে হটিয়ে দিয়ে প্রভুত্বের আসনে আল্লাহ তায়ালাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার মতো আপাতঃ দৃষ্টিতে অসম্ভব কাজটি করার দায়িত্বে তোমরা নিজেদের নিয়োজিত করেছো। -আসমাঈ ওয়া আত্তাবেয়্যু : পৃ. ৬
অর্থাৎ তাদের দাবি হলো-
১. বর্তমানে আল্লাহ পাক তাঁর প্রভূত্বের আসনে নেই।
২. আল্লাহকে হারিয়ে সার্বভৌমত্বের আসনে দাজ্জাল বসে আছে।
৩. আল্লাহ তাআলাকে তাঁর প্রভূত্বের আসন ফিরিয়ে দিতে হেযবুত তওহীদ দায়িত্ব নিয়েছে।
ইসলাম কী বলে?
প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করুন, তাদের উপরোক্ত বক্তব্যের দু’টি বিষয় আগে জানতে হবে। তাহলে বুঝতে সহজ হবে। ক. ‘প্রভুত্ব’ অর্থ কী? খ. ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত’ অর্থ কী?
প্রভুত্ব অর্থ কী?
প্রভূ আর প্রভূত্বের মাঝে বিস্তর তফাৎ আছে। যেহেতু এটা বাংলা শব্দ সেহেতু বাংলা অভিধান থেকে জেনে নেওয়া উচিৎ। চলুন কী লেখা আছে দেখা যাক- ‘প্রভু’ অর্থ হলো- আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবান, মনিব, পূজনীয় সত্তা। আর ‘প্রভুত্ব’ অর্থ হলো- ঐ আল্লাহ তা’আলার কর্তৃত্ব, আধিপত্য, প্রভুশক্তি, এক কথায় বলি আল্লাহ তা’আলার ক্ষমতা। -আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৮৭১
তাহলে হেযবুত তওহীদের বক্তব্য অনুসারে বুঝা গেলো আল্লাহ তাঁর প্রভুত্বের আসনে তথা নিজের ক্ষমতার আসনে এখন নেই। তাই তাঁকে পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত’ অর্থ কী?
তাদের উল্লেখ করা ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত’ শব্দটির অর্থ হলো – কোন জিনিস আগে প্রতিষ্ঠিত ছিলো, কিন্তু এখন নেই, ফলে পরবর্তীতে আবার প্রতিষ্ঠিত হলে, এটাকেই বলে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। যেমনঃ প্রচার-পুনঃপ্রচার, প্রবেশ – পুনঃপ্রবেশ। ঠিক তেমনি প্রতিষ্ঠিত – পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। বাংলায় ‘পুনঃ’ শব্দটি, পুনরায়/দ্বিতীয়বার অর্থে ব্যবহারিত হয়’। -বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৮৩০
তাহলে তাদের বক্তব্য থেকে বুঝা গেলো, আল্লাহ পাক তাঁর ক্ষমতার আসনে আগে ছিলেন, কিন্তু এখন নেই, তাই পুনরায় সে আসনে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অথচ পবিত্র কোরআন মাজিদে অসংখ্য জায়গায় বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ পাকের ক্ষমতা চিরস্থায়ী। এ সম্পর্কে নিন্মে কয়েকটি আয়াত পেশ করা হলো। মহান রব বলেন,
اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ
আল্লাহ তিনি, যিনি ছাড়া কোনও মাবুদ নেই, যিনি চিরঞ্জীব, (সমগ্র সৃষ্টির) নিয়ন্ত্রক, যাঁর কখনও তন্দ্রা পায় না এবং নিদ্রাও নয়, আকাশমণ্ডলে যা-কিছু আছে (তাও) এবং পৃথিবীতে যা-কিছু আছে (তাও) সব তাঁরই। -সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫৫
প্রিয় পাঠক, এই আয়াতে যে القيوم শব্দ এসেছে, এই القيوم শব্দের ব্যাখ্যায় সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
الَّذِي لَا يَحُولُ وَلَا يَزُولُ
যিনি পরিবর্তন বা বিলীন হন না। -তাফসীরে কুরতুবী, খ. ৪ পৃ. ২৬৮
অর্থাৎ القيوم শব্দের অর্থ হলো-সৃষ্টির তত্ত্বাবধান ও রক্ষনাবেক্ষনের জন্য যে সত্ত্বা অনাদি ও অনন্তকালব্যাপী বিরাজমান, আপন সত্তার জন্য যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
মহিমাময় সেই সত্তা, যার হাতে গোটা রাজত্ব। তিনি সবকিছুর উপর পরিপূর্ণ শক্তিমান। -সুরা মূলক : ১
وَمَا مِن دَآبَّةٍ فِي الأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোনও প্রাণী নেই, যার রিজিক আল্লাহ নিজ দায়িত্বে রাখেননি। তিনি তাদের স্থায়ী ঠিকানাও জানেন এবং সাময়িক ঠিকানাও। সব কিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। -সুরা হুদ : ৬
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
তাঁর ব্যাপার তো এই যে, তিনি যখন কোন কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন কেবল বলেন, ‘হয়ে যাও’। অমনি তা হয়ে যায়। অতএব পবিত্র সেই সত্তা, যার হাতে প্রতিটি জিনিসের শাসন-ক্ষমতা এবং তাঁরই কাছে তোমাদের সকলকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। -সুরা ইয়াসিন : ৮২-৮৩
وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاء وَيَخْتَارُ مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ سُبْحَانَ اللَّهِ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
তোমার প্রতিপালক যা চান সৃষ্টি করেন এবং (যা চান) বেছে নেন। তাদের কোন এখতিয়ার নেই। আল্লাহ তাদের শিরক হতে পবিত্র ও সমুচ্চ। -সুরা কাসাস : ৬৮
فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيدُ
যা-কিছু ইচ্ছা করেন, তা করে ফেলেন। -সুরা বুরুজ : ১৬
এই আয়াতগুলোর মাধ্যমেই প্রমাণিত হলো, আল্লাহ পাক যখন যা ইচ্ছা তাই করেন এবং করতে সক্ষম। যদি আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রভুত্ব তথা ক্ষমতার আসনে না থাকেন, তাহলে আল্লাহ যা ইচ্ছা তা সৃষ্টি করেন কীভাবে? সুতরাং আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা চিরস্থায়ী ও সর্বসময়ে চলমান। সাময়িক সময়ের জন্য আল্লাহ তাআলা ক্ষমতাবিহীন থাকবেন, এটা কল্পনা করাও অসম্ভব। সুতরাং আল্লাহর ক্ষমতা চিরস্থায়ী কেউ তাঁকে তাঁর ক্ষমতার আসন থেকে হটাতে পারে না। তাহলে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার তো প্রশ্নই আসেনা! এমন বিশ্বাস যারা রাখে, তারা নিশ্চিত মুসলমান হতে পারে না।
হেযবুত তওহীদ কী আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দিতে চায়?
ক. উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ পাক তাঁর প্রভুত্ব তথা ক্ষমতার আসনে সর্বদার জন্য ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তিনি যেহেতু তাঁর ক্ষমতার আসন থেকে সামান্য সময়ের জন্যও বিচ্যুৎ নন, সেহেতু হেযবুত তওহীদ সে আসন ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করছে বলে এ দাবিটা চরম মিথ্যা ও বানোয়াট এবং আল্লাহ পাকের নামে সর্বৈব মিথ্যাচার। এদের ব্যাপারেই মহান রব বলেন,
لَّعْنَةُ اللّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ
তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত করি যারা মিথ্যাবাদী। -সুরা আলে ইমরান : ৬১
খ. তাছাড়া হেযবতু তওহীদ তো নিজেরাই দাবি করেছে যে, আল্লাহপাকের দিকে মানুষকে আহ্বান করা তাদের কাজই না। দেখুন তারা কী লিখেছে,
আমরা বলি না যে, আপনারা আল্লাহ বিশ্বাসী হয়ে যান, মো’মেন হয়ে যান, পরকালে বিশ্বাসী হয়ে যান, আল্লাহর প্রতি কে ঈমান আনবে কে আনবে না সেটা তারা আল্লাহর সঙ্গে বুঝবে। সুতরাং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করানো আমাদের কাজ নয়। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৫২
এখন আপনারাই বলুন, যারা আল্লাহ-র প্রতি ঈমান আনতে কোনো মেহনতই নিজেদের কাজ মনে করে না, তারা ‘দাজ্জালকে হটিয়ে আল্লাহকে তাঁর সার্বভৌমত্বের আসন ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে’ বলে যে দাবি তারা করেছে, সেটা কী জলজ্যান্ত মিথ্যাচার নয়। যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানের মিশনই যাদের কাজ নয়, তারা কীভাবে হেযবুত তওহীদ নাম দিতে পারে? এটা কী উম্মাহর সাথে ধোকা নয়?
ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহ হেরে গেছেন:
আল্লাহ মহান। যাঁর তুলনা তিনি নিজেই। তিনি সর্বদা সর্ববিষয়ে ক্ষমতাধর ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তাঁকে কেউ পরাস্ত করতে পারে না, কারণ তিনি হার-জিতেরও স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রণকারী।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ইবলিস আল্লাহ-কে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলো, আল্লাহও তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ ইবলিসের চ্যালেঞ্জে হেরে গেছেন, আর ইবলিস জিতে আছে। দেখুন তারা কী লিখেছে,
ক. ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল :
আদমের (আ.) অর্থাৎ মানুষের দেহ নিজ হাতে তৈরি করে তার দেহের ভেতরে আল্লাহর নিজের রুহ, আত্মা থেকে ফুঁকে দিয়ে আল্লাহ মালায়েকদের আদেশ করলেন আদম অর্থাৎ মানুষকে সাজদা করতে (সুরা বাকারাহ ৩০, সুরা আ’রাফ ১১)। ইবলিস অস্বীকার করল ও আল্লাহকে বলল- আমরা মালায়েকরা বলেছিলাম তোমার এই নতুন সৃষ্টি এই আদম, তোমার এই খলিফা পৃথিবীতে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার আর যুদ্ধ, মারামারি, রক্তপাত করবে। আমাদের এই কথা যে সত্য তা প্রমাণ করে দেখাব। আল্লাহ ইবলিসের অর্থাৎ শয়তানের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন কারণ তাঁর খলিফা সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল তাই- পরীক্ষা করা যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিধর তাঁর খলিফা কোন পথে চলে তা দেখা। ইবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তিনি এই নতুন খেলার নিয়ম-কানুন, শর্ত ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে দিলেন। -তাকওয়া ও হেদায়াহ : পৃ. ৩
ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিল, ‘তোমার যে সৃষ্টির কারণে আমাকে বিতাড়িত ও অভিশপ্ত করলে,আমাকে যদি সেই সৃষ্টির দেহ-মনের মধ্যে ঢুকে প্ররোচনা দেবার শক্তি দাও, তাহলে আমি প্রমাণ করে দিব, ঐ সৃষ্টি তোমাকে ইলাহ বা হুকুমদাতা হিসেবে মানবে না। -তওহীদ জান্নাতের চাবি : পৃ. ৪
খ. আল্লাহ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন।
এই দীনের, জীবন-ব্যবস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য হোচ্ছে পৃথিবীতে সব রকম অন্যায়-অবিচার, শোষণ, অশান্তি, রক্তপাত বন্ধ কোরে শান্তি (এসলাম) প্রতিষ্ঠা করা। এটাই হোল আল্লাহর প্রতি এবলিসের চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ আল্লাহ গ্রহণ করেছেন। -শোষণের হাতিয়ার : পৃ. ৫৭
আল্লাহ ইবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে একদিকে তাকে তাঁর খলিফা মানবের দেহ-মনের মধ্যে প্রবেশ করে তাকে তওহীদ অর্থাৎ সেরাতুল মুস্তাকিম থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টার অনুমতি দিলেন। -এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৩৭
গ. হার-জিতের মানদণ্ড কী ছিলো?
মানবসৃষ্টির সূচনালগ্নে মহান আল্লাহর সঙ্গে ইবলিসের একটি চ্যালেঞ্জ হয়। সেই চ্যালেঞ্জটি বিষয়বস্তু ছিল মানবজাতি পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করবে, নাকি মারামারি কাটাকাটি হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাতে লিপ্ত থাকবে? মানুষ যদি শান্তিতে থাকে তাহলে চ্যালেঞ্জে আল্লাহ বিজয়ী হবেন, আর যদি অশান্তি অরাজকতার মধ্যে বাস করে তাহলে ইবলিস বিজয়ী হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ নবী রসুলদের মাধ্যমে জীবনবিধান পাঠালেন। সেটা মানুষের সামগ্রিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করলে সমাজে শান্তি আসবে। আর অন্য জীবনব্যবস্থা দিয়ে জীবন চালালে অশান্তি বিরাজ করবে। নবী-রাসুলগণ এভাবে আল্লাহকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৯৭-৯৮
তাই আল্লাহ মানুষকে বলেছেন- আমার সার্বভৌমত্ব মেনে নাও, আমিই বিশাল সৃষ্টির স্রষ্টা, তোমাদের দেহ ও মনেরও স্রষ্টা, তাই আমি জানি কেমন সংবিধান, আইন-কানুন, দ-বিধি মেনে চললে তোমরা ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমাহীন সমাজে বাস করতে পারবে, শান্তিতে (ইসলামে) বাস করতে পারবে । আর যদি আমারই দেয়া স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে আমার সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে নিজেরা সার্বভৌম হয়ে সংবিধান, আইন-কানুন ও দ-বিধি, অর্থনীতি তৈরি করে তাই মেনে চলো তবে ইবলিস যে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমায় তোমাদের ফেলবে বলেছিল তোমরা তাতেই পতিত হবে, তাহলে সে আমাকে যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল তাতে সে জয়ী হবে, আমি পরাজিত হবো । আমি সর্বশক্তিমান। -দাজ্জাল : পৃ. ১৬
আল্লাহ ও ইবলিশের এই চ্যালেঞ্জে মাঝখানটায় আছে মানবজাতি। মানুষের ইচ্ছা শক্তি তার পরীক্ষা। সে কোনদিকে যাবে সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে। সে আল্লাহকে জয়ী করবে নাকি ইবলিসকে? আল্লাহকে জয়ী করতে চাইলে আল্লাহর তওহীদের স্বীকৃতি দিতে হবে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করা চলবে না। যদি তওহীদ অস্বীকার করে অন্য কাউকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করা হয় অথবা অন্ততপক্ষে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরিক করা হয় তাহলেই ইবলিস বিজয়ী হয়ে যাবে। -তাওহীদ জান্নাতের চাবি : পৃ. ৫
এ সম্পর্কে আরো দেখুন, এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৩৯; প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৬২; ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ২১-২২; আকিদা : পৃ. ৮/৯
ঘ. ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহ হেরে গেছেন :
আজ সমস্ত পৃথিবীকে ইবলিস জিতে আছে। যে ফাসাদ আর সাফাকুদ্দিমার চ্যালেঞ্জ সে আল্লাহকে দিয়েছিল তা দিয়ে আজ পৃথিবী ভরপুর। আর আল্লাহ যে সুবিচার, ন্যায় ও শান্তি (ইসলাম) কথা বলেছিলেন তা আজ পৃথিবীতে কোথাও নেই।যে উম্মাহ, জাতির উপর আল্লাহ কে জয়ী করাবার দায়িত্ব বিশ্বনবী দিয়ে গিয়েছেন, সে জাতি তার ব্যর্থতার বোঝা কাঁধে নিয়ে দাড়ি লম্বা করে টুপি পাগড়ি আলখাল্লা পরে মসজিদে দৌড়াচ্ছে। -এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৩৪
উপরোক্ত বক্তব্যগুলো দিয়ে তারা সুস্পষ্টভাবে বুঝাচ্ছে, ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো, সে চ্যালেঞ্জে ইবলিস জিতে আছে অর্থাৎ আর আল্লাহ হেরে গেছেন। নাউযুবিল্লাহ। আসতাগফিরুল্লাহ্। কী চরম ধৃষ্টতা!
ইসলাম কী বলে?
প্রিয় পাঠক, উপরিউক্ত বক্তব্যগুলো কী কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব? একমাত্র বেঈমান ছাড়া কারো পক্ষে আল্লাহ তাআলার শানে এমন জঘন্য উক্তি করা কী কোনোভাবেই পসিবল? অথচ সমস্ত ক্ষমতার মালিক হলেন মহান আল্লাহ। তাঁর ওপর কোনো ক্ষমতাধর নেই। মহান রব বলেন,
يَكَادُ الْبَرْقُ يَخْطَفُ أَبْصَارَهُمْ كُلَّمَا أَضَاء لَهُم مَّشَوْاْ فِيهِ وَإِذَا أَظْلَمَ عَلَيْهِمْ قَامُواْ وَلَوْ شَاء اللّهُ لَذَهَبَ بِسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ إِنَّ اللَّه عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
মনে হয় যেন বিজলী তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেবে। যখনই বিজলী তাদের সামনে আলো দান করে, তারা তাতে (সেই আলোতে) চলতে শুরু করে, আবার যখন তা তাদের ওপর অন্ধকার বিস্তার করে, তারা দাঁড়িয়ে যায়। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান। -সুরা বাকারা : ২০
أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللّهَ عَلَىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
তুমি কী জানো না, আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতা রাখেন? -সুরা বাকারা : ১০৬
إِنَّ اللّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান। -সুরা বাকারা : ১০৯
أَيْنَ مَا تَكُونُواْ يَأْتِ بِكُمُ اللّهُ جَمِيعًا إِنَّ اللّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
তোমরা যেখানেই থাকো, আল্লাহ তোমাদের সকলকে (নিজের নিকট) নিয়ে আসবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান। -সুরা বাকারা : ১৪৮
আল্লাহ পাক সবার উপর যে ক্ষমতাবান’ এ সম্পর্কে আরও কয়েক’টি আয়াতে বলা আছে। যেমন সুরা বাকারা : ২৫৯/২৮৪ সুরা আলে ইমরান : ২৬/২৯/ ১৬৫/১৮৯; সুরা নিসা : ১৩৩/১৪৯ সুরা মায়িদা : ১৭/ ১৯/৪০
সূতরাং এসকল আয়াত থেকে বুঝা গেলো, আল্লাহ সব বিষয়ে ক্ষমাবান, তাঁকে হারানো কোনো মাখলুকের পক্ষে সম্ভব নয়। এতোগুলো আয়াত থাকতে, আল্লাহ পাকের শানে কীভাবে এমন জঘন্য উক্তি করা যায় যে, ‘আল্লাহ ইবলিসের কাছে হেরে গেছেন’? এমন আকীদা পোষণ করা কী কুফরী নয়?
উপরন্তু আল্লাহ তাআলা এক ও অদ্বিতীয়। বিশ্ব ভুমণ্ডলে সকল বস্তু আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা পুরো দুনিয়ার একচ্ছত্র অধিকারী। সকল সৃষ্টি আল্লাহর তাআলার হুকুম ও ইচ্ছায় পরিচালিত হয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ-র ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়তে পারে না।
وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلاَّ يَعْلَمُهَا وَلاَ حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الأَرْضِ وَلاَ رَطْبٍ وَلاَ يَابِسٍ إِلاَّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
আর তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের কুঞ্জি। তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা জানে না। স্থলে ও জলে যা-কিছু আছে, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত। (কোনো গাছের) এমন কোনো পাতা ঝরে না, যে সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন। মাটির অন্ধকারে কোনো শস্যদানা অথবা আর্দ্র বা শুষ্ক এমন কোনো জিনিস নেই যা এক উন্মুক্ত কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই। -সুরা আনআম : ৫৯
উক্ত আয়াত পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে, বিশ্বের প্রতিটি বালুকণা, ছোটবড় সকল সৃষ্টির উপর আল্লাহ তাআলার পূর্ণ কর্তৃত্ব বিদ্যমান। যেখানে গাছের একটি পাতা ও ক্ষুদ্র দানা পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিত নড়াচড়া করার অধিকার রাখে না, সেখানে আল্লাহর কোনো সৃষ্টি কীভাবে আল্লাহ তাআলাকে পরাজিত করতে পারে? এটা কী আল্লাহর ব্যাপারে মিষ্টার পন্নীর চরম ধৃষ্টতা ও চরম মূর্খতা নয়?
খ্রিষ্টান ও হেযবুত তওহীদের আকিদা অভিন্ন:
মূলত ইবলিস ও আল্লাহ-র মধ্যে ‘চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ক বক্তব্য কোনো মুসলিমের নয় বরং খ্রিষ্টানদের। দেখুন খ্রিষ্টানরা কী বলে-
ঈশ্বর ইবলিসের সাথে বিতর্কে জিততে বা নিজের কথা সত্যতা প্রমাণ করতে তার প্রিয় শয়তানের হাতে সমর্পণ করেন। -আইয়ুব ২:১-১০
এটা ছিলো খ্রিষ্টানদের বাইবেলের বক্তব্য ঠিক হুবহু বক্তব্য হেযবুত তওহীদও লিখেছে-
আল্লাহ ইবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে একদিকে তাকে তাঁর খলিফা মানবের দেহ-মনের মধ্যে প্রবেশ করে তাকে তওহীদ অর্থাৎ সেরাতুল মুস্তাকিম থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টার অনুমতি দিলেন। -এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৩৭
এখন আপনারাই বলুন, আল্লাহপাককে অপমানিত করতে খ্রিষ্টানদের বইয়ের বক্তব্য নকল করা কী কোনো তওহীদপন্থিদের কাজ হতে পারে? নিশ্চয় না। আল্লাহপাক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেন ঠিক তার যার ক্ষমতা ঠিক আল্লাহ-র মতোই হবে। এমন কেউ কী অস্তীত্বে থাকতে পারে?
কমনসেন্স কী বলে?
এরপরও যদি তর্কের খাতির ধরে নেওয়া হয় যে, আল্লাহপাক ইবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন, তাহলে সবার বিবেকের কাছে আমার একটি বিষয় বুঝার বাকি। যে আল্লাহপাক অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সকল গায়েবের খবর জানেন। যেহেতু ভবিষ্যতের সকল ঘটনা কী ঘটবে না ঘটবে তাও তিনি জানেন, তাহলে তো এটাও জানার কথা যে, তিনি ভবিষ্যতে ইবলিস বা দাজ্জালের কাছে পরাজিত হবেন। তিনি নিশ্চিত পরাজয় জেনেও তাহলে ইবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন কীভাবে? সাধারণ কোনো বুদ্ধিমানও কী পরাজয় নিশ্চিত জেনেও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে? নিশ্চয় না। তাহলে বুঝা গেলো, যেহেতু মহান রব ভবিষ্যতের খবরও জানেন, সেহেতু তিনি এটাও জানেন যে, তাঁকে পরাজিত করার মতো শক্তি কারও নেই, হতেও পারে না। তাহলে হেযবুত তওহীদের এ দাবির পেছনে কোনো ঘাপলা আছে কী না?
আল্লাহর সাথে ইবলিসের কথোপকথন কী ছিলো?
মূলত আল্লাহ-র সাথে ইবলিসের একটি কথোপকথন হয়েছিলো। ইবলিসকে আল্লাহ পাক বিতাড়িত করার পর ইবলিস বলেছিলো,
قَالَ رَبِّ بِمَآ أَغْوَيْتَنِي لأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الأَرْضِ وَلأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ
সে (ইবলিস) বলল, হে আমার পলনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথ ভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করবো এবং তাদের সবাইকে পথ ভ্রষ্ঠ করে দেবো। তবে আপনার মনোনীত বান্দাদের ব্যতীত। -সুরা হিজর : ৩৯-৪০
প্রিয় পাঠক, এখানে একটু খেয়াল করুন, ইবলিস তার অবাধ্যতার সময় কিন্তু এ কথা বলেনি যে, পৃথিবীতে রক্তপাত ঘটাবো বা আপনার আইন বিরোধীভাবে সবাইকে চালাবো, বরং বলেছিলো, আপনার নেককার মনোনীত বান্দা ব্যতিত সবাইকে পথভ্রষ্ট করে দেবো। এখন আপনারাই বলুন, আল্লাহর মনোনিত কোনো বান্দাকে ইবলিস কী পথভ্রষ্ট করতে পেরেছে? নিশ্চয় না। সকল নবি, ওলিদের তো শয়তান গোমরাহ করতে পারেনি। তাহলে ইবলিস জিতলো কীভাবে?
আল্লাহপাকের আয়াতের অপব্যাখ্যা করে রবের উপর এতো বড় ব্যার্থতার দায় যারা আল্লাহ-র ওপর চাপিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না, তারা কি আদৌ মুসলমান হতে পারে? বরং এই হেযবুত তওহীদের লোকদেরই শয়তান পথভ্রষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। সে হিসাবে ‘হেযবুত তওহীদের উপরই ইবলিস বিজয়ী হয়েছে’ এটা বলা যুক্তিসঙ্গত, আল্লাহর উপর বিজয় লাভ করেনি আদৌ। কখনও বিজয়ী হতেও পারবে না। কারণ মহান রব সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান। আল্লাহ পাক আমাদের এই কুফরী জাতি থেকে আমাদের সবাইকে হিফাযত করেন।
আল্লাহ’র সিফাত অস্বীকার :
প্রিয় পাঠক, এখানে হেযবুত তওহীদ জয়-পরাজয়ের মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে ‘যদি মানুষ আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে তবে ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহ জয়ী হবেন আর যদি মানুষ আল্লাহ’র হুকুম প্রত্যাখ্যান করে তবে ইবলিস জয়ী হবে আল্লাহ পরাজিত হবেন’। আর যেহেতু দুনিয়াব্যাপী সবাই আল্লাহর হুকুম মানে না, সে হিশাবে আল্লাহ পরাজিত হয়েছেন ইবলিসের কাছে। নাউযুবিল্লাহ। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আল্লাহ-র রাজত্বের ওপর ইবলিস নামক মাখলুকের কর্মের প্রভাব রয়েছে। মহান আল্লাহ’র শানে কতোটা মারাত্মক বেয়াদবি! মূলত এই বক্তব্য দিয়ে তারা আল্লাহ’র কয়েকটি সিফাতকে অস্বীকার করেছে। অথচ আল্লাহ তাঁর নিজের জন্য যেসকল সিফাত সাব্যস্ত করেছেন, সেগুলোর উপর পরিপূর্ণ ঈমান আনা ব্যতিত একজন ব্যক্তির তাওহীদ পূর্ণতা পায় না। কিন্তু হেযবুত তওহীদ আল্লাহপাক সম্পর্কে যে আক্বীদা প্রকাশ করেছে তা বিশ্বাস করলে আল্লাহ’র বহু সিফাতের অস্বীকার অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
মনে রাখা চাই, ‘পরাজয়’ একটি ত্রুটি। অথচ আল্লাহ সকল দোষ-ত্রুটি হতে চিরপবিত্র। দেখুন আল্লাহপাকের একটি সিফাত হচ্ছে, তিনি الْقُدُّوس অর্থাৎ পূত পবিত্র, মহামহিম, মহিমাময়। তিনি সকল ত্রুটি, দুর্বলতা ও অকল্যাণ থেকে মুক্ত ও পবিত্র। যাবতীয় পূর্ণতা ও যোগ্যতার অধিকারী কেবল তিনি। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوس
তিনি (আল্লাহ) পূতপবিত্র মহান বাদশাহ। -সুরা হাশর : ২৩
এ ব্যাপারে সহিহ সনদে হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ كَانَ يَقُولُ فِي رُكُوعِهِ وَسُجُودِهِ : سُبُّوحٌ قُدُّوسٌ رَبُّ الْمَلائِكَةِ وَالرُّوح
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রুকু এবং সিজদায় বলতেন, (মহান আল্লাহ) পূত পবিত্র, মহিমাময় এবং ফেরেশতা মণ্ডলী ও জিবরাইলের প্রভু। -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং : ৪৮৭
যেখানে কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্রতার ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে ‘পরাজয়ের’ ত্রুটি সাব্যস্ত করা কী তাওহীদ থেকে বিচ্যুতি নয়? নিন্মে মহান রবের আরো কয়েকটি সিফাত বা গুনাবলি নিয়ে আলোচনা করা হলো-
মহান আল্লাহ’র একটি সিফাত হলো, তিনি القَدِير অর্থাৎ সর্বশক্তিমান। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعْجِزَهُ مِن شَيْءٍ فِي السَّمَوتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ إِنَّهُ كَانَ عَلِيمًا قَدِيرًا
আল্লাহ এমন নন যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কোন বস্তু তাকে ব্যর্থ করতে পারে। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। -সুরা ফাত্বির : ৪৪
আল্লাহ’র আরেকটি সিফাত হচ্ছে, তিনি الْقَاهِرُ অর্থাৎ প্রতাপশালী, পরাক্রমশালী, প্রবল, অপ্রতিরোধ্য, পরাস্তকারী। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ
তিনি নিজ বান্দাদের উপর পরিপূর্ণ ক্ষমতাবান। -সুরা আনআম : ১৮
ইমাম ইবনুল আসির রহি. الْقَاهِرُ শব্দের অর্থ লিখেছেন,
القاهر هو الغالب جميع الخلق
যিনি সকল সৃষ্টির উপর বিজয়ী। -লিসানুল আরব, ইবনু মুনযির : খ. ৫ পৃ. ১২০
আল্লাহপাকের আরেকটি সিফাত হচ্ছে তিনি; الْقَهَّارُ অর্থাৎ মহা প্রতাপশালী, মহা প্রবল, মহা পরাক্রান্ত, মহা পরাক্রমশালী। মহ্ন আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ
এবং তিনি একাই এমন যে, তাঁর ক্ষমতা সবকিছুতে ব্যাপ্ত। -সুরা রা’দ : ১৬
ইমাম হালীমী (রহিঃ) “আল ক্বহহার” শব্দের অর্থ বলেন,
الَّذِي يَقْهَرُ وَلا يُقْهَرُ بِحَالٍ
যিনি পরাজিত করেন কিন্তু কোনো অবস্থায় তাকে পরাজিত করা যায় না। -আল আসমা ওয়াস সিফাত, বাইহাক্বী : খ. ১ পৃ. ১৬৪
মহান আল্লাহ’র আরেকটি সিফাত হলো, তিনি الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ অর্থাৎ মহা পরাক্রমশালী, অতি প্রভাবশালী, মহা সম্মানিত। মহান রব বলেন,
وَهُوَ الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ
এবং তিনিই শক্তিমান, পরাক্রমশালী। -সুরা শুরা : ১৯
উল্লেখ্য যে, আল্লাহপাকের গুনবাচক নাম ‘الْعَزِيزُ’ এর অর্থ হচ্ছে-
الغالب الذي لا يقهر
অর্থাৎ এমন বিজেতা যাকে পরাজিত করা যায়না। – সফওয়াতুত তাফাসীর : খ. ২ পৃ. ৫৪৬
অন্য বর্ননায়,
الغالب الذي لا يغلبه احد
এমন বিজয়ী যার উপরে কেউই বিজয়ী হতে পারে না। সফওয়াতুত তাফাসীর : খ. ২ পৃ. ৫৪৬
এ ব্যাপারে আরো অসংখ্য আয়াত এসেছে। যেমন
لِلّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَا فِيهِنَّ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে, তার রাজত্ব কেবল আল্লাহরই। তিনি সবকিছুর উপর পরিপূর্ণ ক্ষমতাবান। -সুরা মায়িদা : ১২০
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ
তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি বাদশাহ, পবিত্রতার অধিকারী, শান্তিদাতা, নিরাপত্তাদাতা, সকলের রক্ষক, মহা ক্ষমতাবান, সকল দোষ-ত্রুটির সংশোধনকারী, গৌরবান্বিত, তারা যে শিরক করে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র। -সুরা হাশর : ২৩
فِي مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيكٍ مُقْتَدِرٍ
সত্যিকারের মর্যাদাপূর্ণ আসনে, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহা সম্রাটের সান্নিধ্যে। -সুরা ক্বামার : ৫৫
ইমাম খাত্বাবী রহি. المقتدر শব্দের অর্থ করতে গিয়ে বলেন,
المقتدر هو التام القدرة الذي لا يمتنع عليه شيء ولا يحتجز عنه بمنعة وقوة
যিনি সর্বশক্তিমান, যাকে কোন কিছুই বাধা দিতে পারেনা আর কোন কিছুই তাকে বাধা ও শক্তি প্রয়োগ করতঃ প্রতিরোধ করতে পারেনা। -শুয়াবুল ঈমান (বাইহাকী) : পৃ. ২২৫
এইরূপ আরও বহু আয়াতে আল্লাহপাক নিজের শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। যেখানে আল্লাহ তাআলা নিজের শানে স্বয়ং এমন পরাক্রমের পরিচয় দিয়েছেন, সেখানে ইবলিস
আল্লাহপাকের সামান্য একটি মাখলুক হয়ে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলাকে পরাজিত করার আদৌ ক্ষমতা রাখে কী?
সৃষ্টির অবাধ্যতা স্রষ্টার রাজত্ব হ্রাস করে না:
সকল মাখলুক আল্লাহ-র হুকুম পালন করলে যেমন তাঁর রাজত্বে কোনো বৃদ্ধি আসে না, ঠিক তেমনি সমগ্র মাখলুক তাঁর হুকুম প্রত্যাখ্যান করলেও তাঁর রাজত্বে কোনো প্রভাব পড়ে না। কারণ তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
إِن تَكْفُرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنكُمْ
তোমরা কুফর অবলম্বন করলে নিশ্চিত জেনে রেখো আল্লাহ তোমাদের কারও মুখাপেক্ষী নন। -সুরা যুমার : ৭
وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَلَمِينَ
কেউ (এটা) অস্বীকার করলে আল্লাহ তো বিশ্ব জগতের সমস্ত মানুষ হতে বেনিয়ায (অমুখাপেক্ষী)। -সুরা আলে ইমরান : ৯৭
وَقَالَ مُوسَى إِن تَكْفُرُوا أَنتُمْ وَمَن فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا فَإِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ حَمِيدٌ
এবং মুসা বলেছিলো, তোমরা এবং পৃথিবীতে বসবাসকারী সকলেই যদি অকৃতজ্ঞতা করো, তবে (আল্লাহর কোনও ক্ষতি নেই। কেননা) আল্লাহ অতি বেনিয়ায, তিনি প্রশংসার উপযুক্ত। -সুরা ইবরাহীম : ৮
উপরন্তু বিষয়টি হাদিসে কুদসিতে আরও স্পষ্ট করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
يَا عِبَادِي لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أَتْقَى قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مِنْكُمْ مَا زَادَ ذَلِكَ فِي مُلْكِي شَيْئًا يَا عِبَادِي لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أَفْجَرِ قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مَا نقص ذلِكَ مِنْ مُلْكِي شَيْئًا
হে আমার বান্দারা, তোমাদের আদি-অন্ত, তোমাদের মানুষ ও জিন জাতির মধ্যে যার অন্তর আমাকে সবচাইতে বেশি ভয় পায়, তোমরা সবাই যদি তার মতো হয়ে যাও তাতে আমার রাজত্ব একটুও বৃদ্ধি পাবে না। হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের আদি-অন্ত, তোমাদের সকল মানুষ ও জিন জাতির মধ্যে যার অন্তর সবচাইতে পাপিষ্ঠ, তোমরা সবাই যদি তার মতো হয়ে যাও, তাহলে আমার রাজত্ব কিছুমাত্র হ্রাস পাবে না। -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং : ২৫৭৭
প্রিয় পাঠক, কুরআন-হাদিসের এমন সুস্পষ্ট দলিলের ভিত্তিতে একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, গোটা দুনিয়ার সকল মানুষও যদি কুফুরী করে তাহলেও আল্লাহ -র রাজত্বে কোনও কমতি আসে না। এমতাবস্থায় ‘বর্তমানে পৃথিবিতে আল্লাহর হুকুম কায়েম নেই’ এই অজুহাতে ইবলিসকে জয়ী এবং আল্লাহ তাআলাকে পরাজিত সাব্যস্ত করা কুফুরির শামিল। তাওহীদের দল বলে দাবিদার হেযবুত তওহীদের নিজেদের তাওহীদেরই যদি এমন বেহাল দশা হয়, তবে আর এই নামের যথার্থতা কোথায় রইল?
আল্লাহ, ঈশ্বর, গড, ব্রহ্মা সব একই:
মহান রব আল্লাহপাকের নাম সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহ’য় যথেষ্ট বর্ণনা রয়েছে। অপরদিকে বিধর্মীদের কালচারকে না মানার জন্য বারবার তাকিদ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আল্লাহপাকের কয়টা ও কী কী নাম রয়েছে সে সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহ যে তথ্য দিয়েছে, সেগুলোই আমাদের জন্য যথেষ্ট। অমুসলিমরা যাদেরকে প্রভু বলে স্বীকার করে ও তাদেরকে যে নামে ডাকে, সে নামগুলোকে আল্লাহ-র নাম বলে পরিচয় দেওয়া নিতান্তই ভ্রষ্টতার শামিল।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, মুসলমানদের আল্লাহ, খ্রিষ্টানদের গড, হিন্দুদের ব্রহ্মা সবই এক। সবাই তারই আনুগত্য করছে। দেখুন তারা লিখেছে,
সকলের আদিতে যিনি তিনিই স্রষ্টা, সবকিছুর শেষেও তিনি (কোরআন, সুরা হাদীদ ৩)। বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে- তিনিই আলফা, তিনিই ওমেগা । (Revelation 22:13). আল্লাহকে যে যে নামেই ডাকুক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে সেই মহান স্রষ্টার প্রশ্নহীন আনুগত্যই সকল ধর্মের ভিত্তি। -সকণ ধর্মের মর্মকথা সবার উর্ধ্বে মানবতা : পৃ. ৪
অর্থাৎ তারা দাবি করতে চায়-
১. ব্রহ্মা, গড, ঈশ্বর ও আল্লাহ তাআলা একই সত্তা।
২. মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মাবলম্বীরা প্রশ্নহীনভাকে আল্লাহ তাআলারই আনুগত্য করছে।
ইসলাম কী বলে?
মুসলমানদের আল্লাহ, হিন্দুদের ব্রহ্মা ও খ্রিষ্টানদের আলফা-ওমেগা, গড বা ঈশ্বর কখনই এক নয়। অর্থাৎ মুসলমানদের আল্লাহ’র প্রতি যে বিশ্বাস তার সাথে হিন্দু ব্রহ্মা ও খ্রিষ্টানদের গড বা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস কখনই এক নয়, বরং আসমান যমীনের ব্যবধান। কারণ হিন্দুরা যাকে ব্রহ্মা মনে করে মুসলমানরা তাকে আল্লাহ মনে করেন না। দেখুন আল্লাহ তাআলা ও ব্রহ্মার মাঝে কতো তফাৎ!
হিন্দুদের ব্রহ্মা:
হিন্দুরা যাকে ব্রহ্মা মনে করেন, তার ব্যাপারে তাদের ধর্মগ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে,
সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী, দেবসেনা ও দৈত্যসেনা এঁর দুই কন্যা। ব্রহ্মা চতুর্ভুজ চতুরানন ও রক্তবর্ণ। প্রথমে তাঁর পাঁচটি মস্তক ছিলো; কিন্তু একদা শিবের প্রতি অসম্মানসূচক বাক্য উচ্চারণ করায় শিবের তৃতীয় নয়নের অগ্নীতে ব্রহ্মার একটি মস্তক দগ্ধ হয়। ব্রহ্মার বাহন হংস’। -পৌরনিক অবিধান পৃ. ৩৮৩
তাদের ধর্মগ্রন্থে আরও লেখা আছে, ‘শতরুপা, প্রথমা নারী। তিনি ব্রহ্মার কন্যা। মৎসপুরানে আছে, নয় জন মানসপুত্র সৃষ্টি করার পর ব্রম্মা এক কন্যা সৃষ্টি । এই কন্যাই শতরূপা, সাবিত্রী, গায়ত্রী, স্বরস্বতী, ও ব্রাহ্মণী নামে খ্যাতা। শতরূপার রূপে মুগ্ধ হয়ে সৃষ্টিকর্তা ব্রম্মা তার কন্যা শতরূপাকে গ্রহণ করেন। ব্রহ্মা তার কন্যার সঙ্গে অজাচারের ফলে প্রথম মনু সায়ম্ভুব-এর জন্ম হয়। -পৌরাণিক অভিধান, পৃ. ৪৯৫
অর্থাৎ হিন্দুরা যাকে ব্রহ্মা মনে করেন, তার ৫টি মাথা ছিলো, শিব একটি মাথা ধ্বংশ করে দেয়, তার কালার রক্তবর্ণ, তার সন্তান-স্ত্রী সবই আছে। এমন কি ব্রহ্মা নিজের মেয়ের সাথে কুকর্ম করে মনুকে জন্ম দেন। অথচ মুসলমানরা যাঁকে আল্লাহ মনে করেন, তিনি এ সব থেকে পবিত্র। আল্লাহ পাক ঈমানদের বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন,
وَأَنَّهُ تَعَالَى جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَةً وَلَا وَلَدًا
এবং এই (বিশ্বাস করেছি) যে, আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা সমুচ্চ। তিনি কোনও স্ত্রী গ্রহণ করেননি এবং কোন সন্তানও নয়। -সুরা জ্বিন : ৩
সুতরাং প্রমাণ হলো, হিন্দুদের ব্রহ্মা আর মুসলমানদের। আল্লাহ কস্মিনকালেও এক হতে পারে না।
খ্রিষ্টানদের গড বা ঈশ্বর:
তদ্রুপ খ্রিষ্টানরা যাকে আলফা ওমেগা বা গড-ঈশ্বর বলে তার প্রতি যে বিশ্বাস রাখে, সে বিশ্বাস মুসলমানদের হতেই পারে না। চলুন খ্রিষ্টানদের ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস কী তা দেখে নেওয়া যাক-
খ্রিষ্টানদের ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস:
১. ঈশ্বর অনেক কিছুই দেখেন না’। -পয়দায়েশ ৩:৯, ১৮:২০-২১
২. ঈশ্বর না বুঝে কাজ করে পরে অনুশোচনা করেন। -পয়দায়েশ ৬:৫-৭
৩. ঈশ্বর অমঙ্গল বিধান দেন। -ইহিস্কেল ২০:২৫
৪. ঈশ্বর মানুষের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করে পরাজিত হয়েছেন। -পয়দায়েশ ১৮:১-১৮
৫. ঈশ্বর সাতটি বৃহৎ জাতিকে গণহত্যার মাধ্যমে নির্দয়ভাবে নির্মূল করতে বলেন এবং ক্ষমা করতে নিষেধ করেন’। -দ্বিতীয় বিবরণ ৭:১-২
৬. ঈশ্বর মানুষের পাপের শাস্তি তার সন্তান এবং স্ত্রীদের দেন। -হোশেয় ১৩:১৬
৭. ঈশ্বর ইবলিসের সাথে বিতর্কে জিততে বা নিজের কথা সত্যতা প্রমাণ করতে তার প্রিয় শয়তানের হাতে সমর্পণ করেন। -আইয়ুব ২:১-১০
৮. ঈশ্বর ব্যাভিচারের ব্যবস্থা করে দেন। -২ শমূয়েল ১২:১১
প্রিয় পাঠক, এখন আপনারাই বলুন, খ্রিষ্টানরা যাকে ঈশ্বর মনে করেন এবং যার প্রতি এ রকম ধারণা বা বিশ্বাস রাখেন, এই ঈশ্বর আর মুসলমানদের আল্লাহ তাআলা কী কখনই এক হতে পারেন?
খ্রিষ্টানরা যাকে গড বা ঈশ্বর মনে করেন,তারা দাবি করেন যে, ঈশ্বরের পূত্র হলেন যিশুখ্রিস্ট। -যোহন ১০:২৫-৩৯
উপরন্তু খ্রিষ্টান যিশুখ্রিস্টকে ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করে থাকে। -যোহন ১:১-৪, ১০:৩০
প্রিয় পাঠক, এখন আপনারাই বলুন, খ্রিষ্টানরা ঈশ্বর বলে যাকে অবিহিত করে, তাদের ঈশ্বর আর মুসলমানদের আল্লাহ কী কখনই এক হতে পারে?
আল্লাহ-র নাম নিয়ে সতর্কতা:
আল্লাহ তাআলার নামের ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসে কী বলা হয়েছে? যারা কোরআন ও হাদিসের সামান্য জ্ঞান রাখে তারাও জানেন যে, কোরআন-হাদিসে আল্লাহর অসংখ্য সুন্দর সুন্দর বর্ণিত হয়েছে। আর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সে সকল নামের ওসিলা দিয়ে দুআ করার এবং সে সব নাম ধরে ডাকার নির্দেশও দিয়েছেন। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلِلَّـهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا ۖ وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ۚ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
উত্তম নামসমূহ আল্লাহরই। সুতরাং তাকে সেই সব নামেই ডাকবে। যারা তার নামের ব্যাপারে বক্র পথ অবলম্বন করে, তাদেরকে বর্জন করো। তারা যা-কিছু করছে, তাদেরকে তার বদলা দেওয়া হবে। -সুরা আরাফ : ১৮০
অত্র আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহপাকের নামে যারা বিভ্রান্তি ছড়ায় তাদের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। হেযবুত তওহীদ কী এ আয়াতটি দেখে না? দেখবে কীভাবে? কুরআন শরীফ তো পড়তেও জানে না এ জাহেলরা।
আল্লাহর নাম:
আল্লাহ পাক তাঁর নামের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলেন,
قُلِ ادْعُوا اللَّهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الأسْمَاءُ الْحُسْنَى
বলে দাও, তোমরা আল্লাহকে ডাকো বা রহমানকে ডাকো, যে নামেই তোমরা (আল্লাহকে) ডাকো, (একই কথা। কেননা) সমস্ত সুন্দর নাম তো তাঁরই। -সুরা ইসরা : ১১০
হাদিস শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ ، أَوْ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ
আমি আপনার সেই সকল নাম ধরে প্রার্থনা করছি, যে নামগুলো আপনি নিজেই নিজের জন্য নির্ধারণ করেছেন। অথবা সৃষ্ট জগতের কাউকে শিক্ষা দিয়েছেন, অথবা আপনার কিতাবে নাজিল করেছেন অথবা আপনার নিজের কাছেই ইলমে গায়ব (অদৃশ্য জ্ঞান)এ সংরক্ষিত রেখে দিয়েছেন। -মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং : ৩৭১২
সুতরাং বুঝা গেলো, ইসলামে আল্লাহ পাকের নাম কী কী তা বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ পাকের নাম কতটি?
আল্লাহ তাআলার নামের সংখ্যার ব্যাপারে সহিহ হাদীসে স্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلاَّ وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ
অবশ্যই আল্লাহ তা’আলার নিরানব্বইটি নাম অর্থাৎ- এক কমে একশটি নাম রয়েছে। যে লোক তা মুখস্ত বা আয়াত্ত করবে সে জান্নাতে গমন করবে। -সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ৬৭০৩
সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো, আল্লাহ তাআলা যে সকল নাম নিজের জন্য পছন্দ করেছেন, সেগুলো ধরে আহ্বান করা। এ ছাড়া অন্যান্য নাম বর্জন করা উচিৎ। অতএব আল্লাহ তাআলাকে বুঝাতে গড, ঈশ্বর ইত্যাদি শব্দ পরিত্যাগ করা উচিত। তবে অনারব ভাষায় তার নামের অর্থ ধরে আহ্বান করায় কোন আপত্তি নেই। যাহোক, ঈশ্বর, গড, ব্রহ্মা ইত্যাদী যেহেতু কুরআন-সুন্নাহ’ই বর্ণিত হয়নি, সেহেতু বিজাতীয়দের খুশি করতে আল্লাহ, গড, ঈশ্বর, ব্রহ্মা, আলফা-ওমেগা সব এক করার সুযোগ নেই।
মানুষের ভিতরে আল্লাহ পবিত্র রূহ আছে:
আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো শরিক নেই, হতে পারে না, হবেও না। তিনি অমুখাপেক্ষী, তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই। তিনি তাঁর সত্তায় এবং সিফাতে তথা সকল গুনাবলীতে এক ও অদ্বিতীয়।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদ আল্লাহ-র সাথে অশংশিদারিত্ব স্থাপন করেছে সুস্পষ্টভাবে। তাও আবার রবের জাত তথা সত্তার সাথে! চলুন আগে তাদের কিছু বক্তব্য দেখে নেওয়া যাক-
আল্লাহ সৃষ্টি কোরলেন আদমকে (আঃ)। যেহেতু এর দেহের ভেতর তিনি তাঁর নিজের আত্মা স্থাপন কোরবেন, সেই সম্মানে আদমের দেহ তিনি তৈরি কোরলেন ‘কুন’ আদেশ দিয়ে নয়, তাঁর নিজের হাতে (কোরান- সুরা সা’দ, আয়াত ৭৫)। তারপর তার দেহের মধ্যে আল্লাহ তাঁর নিজের আত্মা থেকে ফুঁকে (প্রবেশ কোরিয়ে) দিলেন (কোরান-সুরা হেজর, আয়াত ২৯। -দাজ্জাল : পৃ. ১০
মানুষ জন্তু-জানোয়ারের মত কেবল দেহসর্বস্ব, ভোগসর্বস্ব প্রাণী নয়। তার ভিতরে আছে আল্লাহর রূহ, আল্লাহর আত্মা, এজন্য মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। -আসুন সিস্টেমটাকেই পাল্টাই : পৃ. ৯
মানুষের ভেতর স্রষ্টার রূহ অর্থাৎ পরমাত্মার অংশ রয়েছে। -আক্রান্ত দেশ ও ইসলাম : পৃ. ১৯
তিনি (আল্লাহ) নিজ হাত দিয়ে আদমকে বানালেন এবং তাঁর ভিতর নিজের রুহ প্রবেশ করিয়ে দিলেন, মানুষ আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হলো। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৬৭
আল্লাহ তার নিজের আত্মা, যেটাকে তিনি বলছেন- আমার আত্মা, সেটা থেকে আদমের মধ্যে ফুঁকে দেওয়া অর্থ আল্লাহর কাদেরিয়াত অর্থাৎ যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসহ আল্লাহর সমস্ত সিফত, গুণ, চরিত্র আদমের মধ্যে চলে আসা। আল্লাহর রুহ আদমের অর্থাৎ মানুষের ভেতরে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে অন্যান্য সমস্ত সৃষ্ট জিনিসের চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে উঠে গেল। -হেদায়া এবং তাকওয়া : পৃ. ১
অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, মহান আল্লাহর স্বীয় ‘রুহ’ তিনি মানুষের মাঝে ফুঁকে দিয়েছেন। ফলে মানুষ তার নিজের ভেতর আল্লাহর জাত বা সত্তা ধারণকারী। নাউযুবিল্লাহ।
খ্রিষ্টান মতবাদ ও হেযবুত তওহীদের মতবাদ অভিন্ন:
সমস্ত নবি-রাসূল একমত যে, রূহ আল্লাহ-র সৃষ্টি, আল্লাহ-র দ্বারাই প্রতিপালিত ও তাঁরই হুকুমে পরিচালিত। মহান রব বলেন,
وَیَسۡـَٔلُونَكَ عَنِ ٱلرُّوحِۖ قُلِ ٱلرُّوحُ مِنۡ أَمۡرِ رَبِّی وَمَاۤ أُوتِیتُم مِّنَ ٱلۡعِلۡمِ إِلَّا قَلِیلࣰا
(হে নবি,) তারা তোমাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, রূহ আমার প্রতিপালকের হুকুমঘটিত। তোমাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে সামান্যমাত্র। -সুরা ইসরা : ৮৫
সুতরাং বুঝা গেলো, ‘রুহ’ এটা আল্লাহপাকের হুকুমে পরিচালিত একটি সৃষ্ট বিষয়। এটা দীনের অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞাতব্য বিষয়, যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। সকল সাহাবা, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের যুগে এ ব্যাপারে কোনও মতানৈক্য ছিলো না, আর এ তিনটি যুগ ছিলো সর্বোত্তম যুগ। এরপর পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত খ্রিষ্টানরা দাবি করলো যে, ‘রূহ’ আল্লাহর সৃষ্টি নয়; বরং তারা মনে করে থাকে ‘ঈসা আ.-এর মধ্যে আল্লাহর রুহের অংশ আছে।’ আর এই কারণেই তারা ঈসা আ. কে আল্লাহর সন্তান বলে দাবি করে থাকে। নাউযুবিল্লাহ। এব্যাপারে বিশিষ্ট ইমাম হযরত মুহাম্মদ বিন নছর আল মারওয়াযী রহি. বলেন,
تأوَّل صنف من الزناديقة وصنف من الروافض في روح آدم ما تأولته النصارى في روح عيسى وما تأوله قوم من أن الروح إنفصل من ذات الله فصار فى المؤمن
যিন্দিক ও রাফেযীদের এক দল আদম আ. এর রূহের ব্যাপারে এমন ব্যাখ্যা করে, খ্রিষ্টানরা ঈসা আ. এর রূহের ব্যাপারে যেমন ব্যাখ্যা করেছে। এ ধরণের ব্যাখ্যা আরো এক দল করে যে, ‘রূহ’ আল্লাহ তাআলার জাত থেকে পৃথক হয়ে মুমিনদের মাঝে প্রবেশ করেছে। -আর রূহ ফিল কালাম আলা আরওয়াহীল আমওয়াত : পৃ. ১৬৩
ইমাম মুহাম্মদ বিন নছর আল মারওয়াযী রহি.-এর এ বক্তব্য দ্বারা একথা প্রমাণিত যে, আল্লাহ তাআলার ‘আত্মা’ আদম আ. এর মাঝে প্রবেশ করার এ আকীদা বস্তুত খ্রিষ্টান, মুরতাদ ও রাফেযীদের আকীদা। এমনকি ইবনে কাসীর রহি. বলেন,
أي من خلقه ومِنْ عنده وليست (مِنْ) للتبعيض كما تقوله النصارى عليهم لعائن الله المتتابعة بل هي لابتداء الغاية
আল্লাহ-র ‘রুহ’ থেকে’ মানে হলো, তার সৃষ্টি থেকে বা তাঁর পক্ষ থেকে। আল্লাহর অংশ থেকে নয়। যেমনটা মনে করে অভিশপ্ত খ্রিষ্টানরা। (অর্থাৎ তারা মনে করে ঈসা আ. আল্লাহর সত্ত্বার অংশ’।) সুতরাং এখানে من ‘থেকে’ শব্দটা ابتداء এর তথা ‘শুরু” অর্থ বুঝানোর জন্য ব্যবহ্নত হয়েছে, تبعيض তথা (আল্লাহ-র) ‘অংশ’ বুঝানোর জন্য নয়। -তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ৪ পৃ. ৩৮৯
সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম, এই আকীদাটা তথা ‘ঈসা আ.-এর ভেতর আল্লাহর রুহ তথা পরমাত্মার অংশ রয়েছে’ বলে ঈসা আ.-কে আল্লাহর অংশ বলে বিশ্বাস করে থাকে খ্রিষ্টানরা। কিন্তু হেযবুত তওহীদরা তো পুরো মানবজাতিকে আল্লাহ-র অংশ বলে দাবি করে বসলো। তাহলে এই আক্বীদার কারণে হেযবুত তওহীদ কী খ্রিষ্টানদের চেয়েও বড় কাফের-মুশরিক নয়? এমন কুফরি ধারণা বা বিশ্বাস মুসলমানদের অন্তরে প্রবেশ করিয়ে মুসলিমদের মুশরিক বানানোর মিশন হাতে নিয়ে হেযবুত তওহীদ কী মাঠে নামেনি?
আল্লাহ’র রুহ মানে কী?
তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে, আল্লাহ তো নিজেই বলেছেন, তাঁর ‘রুহ’ তিনি বান্দার মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন। এর অর্থ কী? চলুন এ সম্পর্কিত আগে আয়াতটি দেখা যাক। মহান আল্লাহ বলেন,
ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِن رُّوحِهِ
তারপর তাকে ঠিকঠাক করতঃ তার ভেতর নিজ রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। -সুরা সাজদাহ : ৯
উক্ত আয়াতসহ অন্য যেসকল আয়াতে আদম আ. ও মানুষের ভেতর আল্লাহ-র ‘রুহ’ ফুঁকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে আল্লাহ তাঁর ‘রুহ’ তাঁর বান্দার মাঝে ফুঁকে দিয়েছেন এর অর্থ এমনটা নয় যে, আল্লাহ তাঁর সত্ত্বাগত রুহের অংশ বান্দার মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন, বরং আল্লাহর রুহ মানুষের মাঝে ফুঁকে দেওয়ার প্রকৃত অর্থ হলো, মানবজাতির গুরুত্ব ও সম্মানের আধিক্যতা বুঝানো। চলুন এ ব্যাপারে কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরা যাক। ইবনে আব্বাস রা. এর বক্তব্য:
أنَّ الرَّوْحَ خَلْقٌ مِن خَلْقِ اللَّهِ عَزَّ وجَلَّ صُوَرُهم عَلى صُوَرِ بَنِي آَدَمِ
‘রুহ’ আল্লাহর সৃষ্টি থেকে একটি সৃষ্টি। যা আল্লাহ তাআলা আদম সন্তানের আকারে গঠন করেছেন। -তাফসীরে জাওযী, খ. ৫ পৃ. ৬০
ইমাম রাযী রহি. বলেন,
وإنَّما أضافَ اللَّهُ سُبْحانَهُ رُوحَ آدَمَ إلى نَفْسِهِ تَشْرِيفًا لَهُ وتَكْرِيمًا
‘আদমের রুহ’কে আল্লাহ তাঁর নিজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, হয়েছে আদমের সম্মানার্থে। -তাফসীরে রাযী : খ. ১৯ পৃ. ১৮৬
ইমাম কুরতুবী রহি. বলেন,
فَالرُّوحُ خَلْقٌ مِنْ خَلْقِهِ أَضَافَهُ إِلَى نَفْسِهِ تَشْرِيفًا وَتَكْرِيمًا كَقَوْلِهِ أَرْضِي وَسَمَائِي وَبَيْتِي وَنَاقَةُ اللَّهِ وَشَهْرُ اللَّهِ وَمِثْلُهُ
‘রুহ’ হলো আল্লাহর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। মানুষের রুহকে আল্লাহ তাঁর নিজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, হয়েছে মানুষের সম্মানার্থে। যেমন- অন্যত্রে আল্লাহর বলা ‘আমার যমীন, আমার আসমান, আমার ঘর এবং আল্লাহর উটনী, আল্লাহর মাস ইত্যাদী। -তাফসীরে কুরতুবী : খ. ৯ পৃ. ১৭
বিষয়টি বুঝতে নিন্মোক্ত দুটি আয়াতের দিকে খেয়াল করুন। আল্লাহ পাক বলেন,
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَن لَّا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
এবং সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহীমকে সেই ঘর (অর্থাৎ কাবাগৃহ)-এর স্থান জানিয়ে দিয়েছিলাম। (এবং তাকে হুকুম দিয়েছিলাম) আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার ঘরকে সেই সকল লোকের জন্য পবিত্র রেখ, যারা (এখানে) তাওয়াফ করে, ইবাদতের জন্য দাঁড়ায় এবং রুকূ-সিজদা আদায় করে। -সুরা হাজ্ব : ২৬
উক্ত আয়াতে কাবা শরীফকে আল্লাহ পাক নিজের ঘর বলেছেন। এর অর্থ কী সেখানে আল্লাহ বসবাস করেন? নাউযুবিল্লাহ। নিশ্চয় না। কিন্তু ঘরটিকে আল্লাহ তাআলা নিজের ঘর বলে আখ্যায়িত করেছেন কাবা শরীফের সম্মানার্থে। উপরন্তু সামুদ জাতিকে আল্লাহ সেই আলোচিত উটনীর ব্যাপারে বলেছিলেন,
هَـذِهِ نَاقَةُ اللّهِ لَكُمْ آيَةً
এটা আল্লাহর উটনী, যা তোমাদের জন্য একটি নিদর্শনস্বরূপ। -সুরা আ’রাফ : ৭৩
উক্ত আয়াতে উট ও কাবাকে আল্লাহ তাআলা রুপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। আল্লাম মাহমুদ বাগদাদী আলুসী রহ. বলেন,
أضافَ الرُّوحَ إلَيْهِ تَعالى تَشْرِيفًا لَهُ كَما فِي بَيْتِ اللَّهِ تَعالى وناقَةِ اللَّهِ تَعالى
রুহকে আল্লাহ নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন মানুষের সম্মানার্থে। যেমন কাবাকে বাইতুল্লাহ এবং (সালেহ আ. এর উটকে) আল্লাহ তাআলার উট বলা। -তাফসীরে রুহুল মা’আনী, খ. ৮ পৃ. ১২১
এমনিভাবে নবী হযরত ঈসা আ. কে ‘রুহুল্লাহ’ বলা হয়। এগুলো সব কিছুই রুপক অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে, নির্দিষ্ট বিষয়কে সম্মান প্রদান করার জন্য। ইমাম বুখারি রহি. এর উস্তাদ নাঈম ইবনে হাম্মাদ রহি.বলেন ,
من شبه الله بخلقه كفر ومن حجد ما وصف الله به نفسه أو وصف به رسوله كفر وليس فيما وصف الله به نفسه أو وصف به رسوله تشبيه ولا تمثيل
যে ব্যক্তি আল্লাহকে মাখলুকের সঙ্গে তুলনা করল, সে কাফের হয়ে গেল। আর যে ব্যক্তি এমন কোনো বিশেষণ অস্বীকার করল, যা আল্লাহ তাআলা নিজের ওপর প্রয়োগ করেছেন, অথবা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ওপর প্রয়োগ করেছেন, সেও কাফের হয়ে গেলো। আর আল্লাহ তাঁর নিজের ওপর যে বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন অথবা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ওপর যে বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন, তাতে কোনো তাশবিহ তথা সাদৃশ্যকরণ, তামছীল তথা উপমানির্ধারণ নেই। -সিয়ারু আলামিন নুবালা, খ. ২০ পৃ. ৮৮
যুক্তির আলোকে দলীল:
আল্লাহ-র ‘রুহ’ মানে যদি আল্লাহ-র অংশগত রুহ হয়, তাহলে কয়েকটি প্রশ্ন এসে যায়-
এক. মানুষের রুহ যদি আল্লাহর রুহের অংশ হয়, তাহলে হযরত আজরাঈল আ. যে মানুষের রুহ কবজ করেন, তাহলে এ কথা কী বলতে হবে না যে, আজরাঈল আ. আল্লাহর রুহ কবজ করবেন? নাউযুবিল্লাহ। এটা কী কোনো বুদ্ধিমানের আক্বীদা হতে পারে? নিশ্চয় নয়।
দুই. আল্লাহ-র রুহের অংশ যদি মানুষের মধ্যে থেকে থাকে, তবে মানুষের রুহ কবজ করা মানেই কী আল্লাহর রুহেরও কিছু অংশ কবজ করা নয়?
তিন. হাদিস শরীফে অসংখ্য জায়গায় ঈসা আ. কে সরাসরি আল্লাহর রুহ বলা হয়েছে। এখন আল্লাহর রুহ বান্দার মধ্যে ফুঁকে দেওয়া হয়েছে, এটার অর্থ যদি হয়, আল্লাহর সত্ত্বাগত রুহের অংশ মানুষের মাঝে দেওয়া হয়েছে, তাহলে তো ঈসা আ. কে আল্লাহর রুহ বলার কারণে ঈসা আ. কে ‘আংশিক আল্লাহ’ বলে মেনে নিতে হবে। নাউযুবিল্লাহ।
সুতরাং বুঝা গেলো, হেযবুত তওহীদের এ আক্বীদা একটি কুফরী ও শিরকি আক্বীদা এবং খ্রিষ্টানদের আক্বীদা। যা কোনো মুসলিমের আক্বীদা হতে পারে না। সুতরাং চলুন সবাই এ কুফরী আক্বীদা থেকে নিজেকে বাঁচাই অন্যকেও বাঁচাতে সাহায্য করি।
মানুষের ভেতরে আল্লাহ-র সকল সিফাত ও ক্ষমতা রয়েছে:
মানুষকে আল্লাহ সবচে সম্মান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু সকল কিছুর ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর কাছে। এটা মুসলিমদের ও মুমিনদের আকীদা। কিন্তু হেযবুত তওহীদ নামক কুফরী দলের আকীদা হলো, আল্লাহর যতো ক্ষমতা রয়েছে, সকল ক্ষমতা মানুষকে দিয়েই তিনি সৃষ্টি করেছেন।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
নিন্মে হেযবুত তওহীদের কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরা হলো,
আদম সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তার সব মালায়েকদের ডেকে তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন যে, তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করতে চান যার ভিতরে আল্লাহ সব গুণ থাকবে, সে হবে আল্লাহর প্রতিনিধি। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৫৮
আল্লাহ তাঁর নিজের আত্মা, যেটাকে তিনি বলছেন আমার আত্মা, সেটা থেকে আদমের মধ্যে ফুঁকে দেওয়া অর্থ আল্লাহর কাদেরিয়াত অর্থাৎ যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসহ আল্লাহর সমস্ত সিফত, গুণ, চরিত্র আদমের মধ্যে চলে আসা। আল্লাহর রূহ আদমের অর্থাৎ মানুষের ভেতরে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে অন্যান্য সমস্ত সৃষ্ট জিনিসের চেয়ে বহু ঊর্ধে উঠে গেলো, কারণ তার মধ্যে তখন স্বয়ং আল্লাহর সমস্ত সিফতসহ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এসে গেলো যা আর কোনো সৃষ্টির মধ্যে নেই। -দাজ্জাল : পৃ. ১০
নিজের আত্মা থেকে ফুঁকে দেওয়ার অর্থ আল্লাহর যত গুণ (সিফত) আছে সবগুলিই আদমের মধ্যে চলে এলো। আল্লাহর গুণগুলির (সিফত) মধ্যে একটি হলো কাদেরিয়াহ,
নিজের ইচ্ছামত কাজ করার শক্তি, যেটা সৃষ্টির আর কারো নেই; যে জন্য মানুষকে বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সম্মানিত। -দাজ্জাল : পৃ. ৮৫
তাই আল্লাহ আদম অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টি করলেন । আদমের মধ্যে আল্লাহ তাঁর নিজের আত্মা (রূহ্) থেকে ফুঁকে দিলেন (সুরা হেজর ২৯) অর্থাৎ আদমের মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি, যা আল্লাহ ছাড়া আর কারও নেই, তা এবং আল্লাহর অন্যান্য সকল সিফত্ বা গুণ প্রবেশ করিয়ে দিলেন । কাজেই এই নতুন অসাধারণ সৃষ্টির নাম দিলেন আল্লাহর খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধি (সুরা বাকারা ৩০)। -আকীদা : পৃ. ৫
অর্থাৎ হেযবুত তওহীদ বুঝাতে চায়, আল্লাহ তাঁর স্বীয় রুহ তথা পরম আত্মা মানুষের মধ্যে ফুঁ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে আল্লাহ যতো গুনেগুনান্বিত, সবগুলি গুন বান্দার মধ্যেও আছে, এমনকি আল্লাহর সকল স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি বান্দারও আছে। নাউযুবিল্লাহ।
ইসলাম কী বলে?
‘তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত’ হলো, ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অর্থাৎ এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল সিফাতে কামাল তথা পূর্ণাঙ্গ গুণাবলিতে গুণান্বিত এবং সকল অপূর্ণাঙ্গ গুণাবলি থেকে পবিত্র এবং তিনি এ ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় এবং অতুলনীয়।
এ প্রকার তাওহিদে বিশ্বাস পোষণের পদ্ধতি হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের জন্য যেসব নাম ও গুণাবলি তালিকাভুক্ত করেছেন অথবা যেসব নাম ও গুণের কথা উল্লেখ করেছেন- যা কুরআন-সুন্নাহ’য় উল্লিখিত হয়েছে- শব্দে অথবা অর্থে- সে-সবে কোনোরূপ বিকৃতিসাধন, অস্বীকৃতি ও বাতিলকরণ, তার হাকীকত কী তা নির্ণয়করণ ও তার ধরন-ধারণ নির্দিষ্টকরণ, এবং সৃষ্টিজীবের কোনো গুণের সঙ্গে সাদৃশ্যকরণ ব্যতীত তা মেনে নেয়া ও বিশ্বাস করা। সুতরাং আল্লাহ তাআলা সকল ক্ষমতায় ও গুনাবলীতে এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর ক্ষমতার অংশীদারিত্ব স্থাপন করা পরিস্কার শিরক। মহান আল্লাহ বলেন,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْء
কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। -সুরা, শুরা : ১১
অর্থাৎ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, দেখা, শোনা, সৃষ্টি ইত্যাদী সকল বিষয়ে আল্লাহর সাথে কারও কোনো তুলনা নেই। যারা আল্লাহর সমকক্ষ মানুষকে বানাতে চায় তারা কি মুশিরক নয়? আল্লাহ তাআলা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন,
قُلْ مَن رَّبُّ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ قُلِ اللّهُ قُلْ أَفَاتَّخَذْتُم مِّن دُونِهِ أَوْلِيَاء لاَ يَمْلِكُونَ لِأَنفُسِهِمْ نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ أَمْ جَعَلُواْ لِلّهِ شُرَكَاء خَلَقُواْ كَخَلْقِهِ فَتَشَابَهَ الْخَلْقُ عَلَيْهِمْ قُلِ اللّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ
(হে নবি, কাফেরদেরকে) বলো, কে তিনি, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবির প্রতিপালন করেন? বলো, আল্লাহ! বলো, তবুও তোমরা তাঁকে ছেড়ে এমন সব অভিভাবক গ্রহণ করলে, যাদের খোদ নিজেদেরও কোন উপকার সাধনের ক্ষমতা নেই এবং অপকার সাধনেরও না? বলো, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কী সমান হতে পারে? অথবা অন্ধকার ও আলো কী একই রকম হতে পারে? না-কি তারা আল্লাহর এমন সব শরিক সাব্যস্ত করেছে, যারা আল্লাহ যেমন সৃষ্টি করেন সে রকম কিছু সৃষ্টি করেছে, ফলে তাদের কাছে উভয়ের সৃষ্টিকার্য একই রকম মনে হচ্ছে? (কেউ যদি এ বিভ্রান্তির শিকার হয়ে থাকে, তবে তাকে) বলে দাও, কেবল আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি একাই এমন যে, তাঁর ক্ষমতা সবকিছুতে ব্যাপ্ত। -সুরা রা’দ : ১৬
সুতরাং আল্লাহর কোনো গুনাবলীতে অশংশিদারিত্ব স্থাপন করার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ أَئِنَّكُمْ لَتَكْفُرُونَ بِالَّذِي خَلَقَ الْأَرْضَ فِي يَوْمَيْنِ وَتَجْعَلُونَ لَهُ أَندَادًا ذَلِكَ رَبُّ الْعَالَمِينَ
বলে দাও, সত্যিই কি তোমরা সেই সত্তার সাথে কুফরি পন্থা অবলম্বন করছো, যিনি পৃথিবি সৃষ্টি করেছেন দু’দিনে এবং তার সাথে অন্যকে শরিক করছো? তিনি তো জগতসমূহের প্রতিপালক। -সুরা ফুসসিলাত : ৯
قُلْ إِنَّمَا هُوَ إِلَـهٌ وَاحِدٌ وَإِنَّنِي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُونَ
বলে দাও, তিনি তো একই মাবুদ। তোমরা যে সকল জিনিসকে তাঁর শরীক সাব্যস্ত করো, আমি তাদের থেকে বিমুখ। -সুরা আনআম : ১৯
প্রিয় পাঠক, উপররিউক্ত আয়াতগুলো থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ তাঁর সামষ্টিক সিফাত ও গুনাবলীতে এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর সমকক্ষ স্থীর করা পরিস্কার শিরক। সুতরাং এরপরও যদি কেউ এ কথা বলে যে, ‘আল্লাহর কাদেরিয়াত অর্থাৎ যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসহ আল্লাহর সমস্ত সিফত, গুন, চরিত্র আদমের মধ্যে রয়েছে’ এটা কী সুস্পষ্টভাবে শিরকি বক্তব্য নয়?
উপরন্তু যদি মানুষের মধ্যে আল্লাহর সকল ক্ষমতা থাকে, তাহলে মানুষ অসুস্থতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না কেন? না ঘুমিয়ে থাকতে পারে না কেন? মৃত্যু থেকে বাঁচতে পারে না কেন? অথচ আল্লাহ হলেন তিনি-
اللّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلاَ نَوْمٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ
আল্লাহ তিনি, যিনি ছাড়া কোনও মাবুদ নেই, যিনি চিরঞ্জীব, (সমগ্র সৃষ্টির) নিয়ন্ত্রক, যাঁর কখনও তন্দ্রা পায় না এবং নিদ্রাও নয়, আকাশমণ্ডলে যা-কিছু আছে (তাও) এবং পৃথিবীতে যা-কিছু আছে (তাও) সব তাঁরই। -সুরা বাকারা : ২৫৫
সুতরাং প্রমাণ হলো, মানুষের জন্য আল্লাহ-র সকল ইচ্ছাশক্তির মালিক হওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। এটা যেমন আক্বীদা বিবর্জিত, তেমনি বাস্তবতা বহির্ভুত একটি ডাহা মিথ্যাচার ও চরম শিরকি আক্বীদা।
এটা খ্রিস্টান ও মুশরিকদের আকিদা:
হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, আল্লাহ-র পরম আত্মা এবং তিনি যত গুনেগুনান্বিত সব গুন বান্দার মধ্যেও আছে, এমনকি আল্লাহর সকল স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি বান্দারও আছে। অথচ এ আক্বীদা কোনো মুসলিমের আকিদা নয়, বরং এটা খ্রিস্টান ও মুশরিকদের আকিদা। যেটাকে ‘আকিদায়ে হুলুল’ বলে। অথচ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের স্বীকৃত আকিদা হলো, আল্লাহপাকের যাত ও সিফাত ‘কাদীম’ তথা অবিনশ্বর। তাঁর কোনো শুরু-শেষ নেই। তিনি তেমন, তিনি যেমন। তাঁর কোনো তুলনা নেই। তিনি স্রষ্টা বাকি সবই তাঁর সৃষ্টি। তিনি যেহেতু অবিনশ্বর, সেহেতু তাঁর জাত বা গুনাবলী কারও মধ্যে প্রবেশ করে না। কারণ সকল সৃষ্টি ধ্বংশশীল। সুতরাং যদি আল্লাহপাকের কোনো সিফাত বা গুনাবলী কোনো সৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করে, তাহলে ঐ সৃষ্টি ধ্বংশের সাথে সাথেই আল্লাহপাকের সিফাতও ধ্বংশ হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। যা কল্পনা করাও অসম্ভব। অথচ হেযবুত তওহীদ আল্লাহপাকের সিফাত তথা শুধু গুনাবলী নয়, বরং ‘সরাসরি আল্লাহর রুহ বান্দার মধ্যে আছে’ বলে আল্লাহপাকের জাতের ব্যাপারে এমন আকীদা পোষন করেছে। অথচ এমন আকীদা পোষণ করা সরাসরি শিরক। এ ব্যাপারে ইমাম হামোবী রহি. লিখেছেন,
ومن قال إن شيئاً من صفات الله حال في العبد، أو قال بالتبعيض على الله فقد كفر
যে ব্যক্তি বলবে আল্লাহ তাআলার সিফাত সমূহের মধ্যে থেকে কোনো সিফাত বান্দার মাঝে প্রবেশ করেছে, কিংবা আল্লাহর যাত বা সিফাতের কোনো অংশ বান্দার মাঝে প্রবেশ করার প্রবক্ত হবে সে কাফের। -আল ফাতাওয়া আল হামোবীয়াহ : খ. ১ পৃ. ১১১
ইমাম ত্বহাবী রহি. আল্লাহ তাআলার উপর মানবীয় গুণ আরোপের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন-
ومن وَصَفَ الله بمعنى من معاني البشر فقد كفر، فمن أبصر هذا اعتبر، وعن مثل قول الكفار انزجر، وعلم أنه بصفاته ليس كالبشر.
যারা আল্লাহ তাআলাকে মানবীয় কোনো বৈশিষ্ট্যে বিশেষিত করে তারা মূলত কুফরে লিপ্ত হয়। সুতরাং যারা এবিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয় তারা সঠিক শিক্ষা লাভ করে, তারা কাফেরদের মতো কথা বলা থেকে বিরত থাকে এবং তারা বুঝতে পারে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর গুণাবলির ক্ষেত্রে মানুষের মতো নন। -আল আকিদাতুত তহাবিয়্যাহ : পৃ. ৫৭-৫৮
মনে রাখতে হবে, আল্লাহ-র সমস্ত সিফাত মানুষের মধ্যে থাকা এই আকিদা একেবারেই শিরক ও কুফরি। কারণ কোনো বান্দার মধ্যে আল্লাহর সব গুনাবলী বিদ্যমান বলে আল্লাহর সকল গুনাবলীর সাথে শরিক স্থাপন করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ তাআলার সমকক্ষ বা অংশীদার হয় না। আল্লাহ তাআলা পরিস্কার ঘোষনা দিয়েছেন
وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ
এবং তার সমকক্ষ নয় কেউ। -সুরা ইখলাস : ৪
سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
তিনি পবিত্র এবং তারা যে শিরক করে তা থেকে তিনি বহু ঊর্ধ্বে। -সুরা যুমার : ৬৭
যারা রবের সাথে অন্য কিছুর অংশীদার সাব্যস্ত করে তাদের ক্ষমা নেই। মহান আল্লাহ বলেন-
إِنَّ اللّهَ لاَ يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَن يَشَاء وَمَن يُشْرِكْ بِاللّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا
নিশ্চয়ই আল্লাহ এ বিষয়কে ক্ষমা করেন না যে, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করা হবে। এর চেয়ে নিচের যে-কোন বিষয়ে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে, সে এক গুরুতর পাপে লিপ্ত হলো। -সুরা নিসা : ৪৮
শিরক মিশ্রিত কোনো নেক আমলই আল্লাহ তাআলা কুবল করেন না, বরং শিরক সম্পাদনকারী সম্পূর্ণরূপে ইসলাম থেকে খারিজ-বহিস্কৃত। আল্লাহপাক আরও বলেন,
وَلَوْ أَشْرَكُواْ لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
তারা যদি শিরক করতো, তবে তাদের সমস্ত (সৎ) কর্ম নিষ্ফল হয়ে যেতো। -সুরা আনআ’ম : ৮৮
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
নিশ্চয়ই তোমাকে এবং তোমার পূর্বের নবিগণকে ওহির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, তুমি যদি শিরক কর, তবে নির্ঘাত তোমার সমস্ত কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। -সুরা যুমার : ৬৫
উপরন্তু শিরককারী জাহান্নামে যাবে। মহান রব বলেন,
إِنَّهُ مَن يُشْرِكْ بِاللّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللّهُ عَلَيهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ
নিশ্চয়ই, যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরিক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই। -সুরা মায়িদা : ৭২
উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে বুঝা গেলো-
১. আল্লাহ তাআলার সমকক্ষ বা অংশীদার হয় না।
২. মুশরিকদের ক্ষমা নেই।
৩. মুশরিকদের সকল আমল বরবাদ।
৪. মুশরিকরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী।
সুতরাং ‘আল্লাহর সকল গুনাবলী বান্দার মধ্যে রয়েছে’ বলে যে আকিদা হেযবুত তওহীদ পোষণ করে ত সম্পূর্ণরুপে শিরকি আকিদা, যা ক্ষমাযোগ্য নয়।
জাহিলিযুগে মানুষের প্রাণের মালিক ছিলো রাজা-বাদশাহরা:
মানুষের জিবন ও মৃত্যুর মালিক শুধুমাত্র আল্লাহ। কেউ কারো জিবন যেমন দিতে পারে না, ঠিক তেমনি মৃত্যুদান করতেও অক্ষম।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
অথচ হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, জাহিলি যুগে মানুষের জিবনের মালিক ছিলো রাজা-বাদশাহরা। দেখুন তারা কী লিখেছে,
তখনকার দিনের রাজা-বাদশাহরা ছিলের সর্বেসর্বা, তাদের হুকুমই ছিলো আইন। (জাহেলী যুগে) মানুষের প্রাণের মালিক ছিল রাজা বাদশারা। -এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৬০
ইসলাম কী বলে?
আল্লাহর দুটি গুণবাচক নাম المحيي ‘মুহয়ি’ (জীবন দানকারী) ও المميت ‘মুতিত’ (মৃত্যু দানকারী)। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা আল্লাহর এই গুণ প্রমাণিত। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
كَيْفَ تَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَكُنتُمْ أَمْوَاتاً فَأَحْيَاكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
তোমরা আল্লাহর সাথে কুফরি কর্মপন্থা কিভাবে অবলম্বন করো, অথচ তোমরা ছিলে নিষ্প্রাণ, অতঃপর তিনিই তোমাদেরকে জিবন দান করেছেন। অতঃপর তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর তিনি (পুনরায়) তোমাদেরকে জিবিত করবেন, তারপর তোমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাবে। -সুরা বাকারা : ২৮
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
وَهُوَ الَّذِي أَحْيَاكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ إِنَّ الْإِنسَانَ لَكَفُورٌ
তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে জিবন দান করেছেন, তারপর তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, তারপর পুনরায় তোমাদেরকে জিবিত করবেন। সত্যিই মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ। -সুরা হাজ্ব : ৬৬
যেহেতু মহান আল্লাহই জিবন ও মৃত্যুর স্রষ্টা ও মালিক, তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে উত্তম জিবন ও মর্যাদাকর মৃত্যু কামনা করতে বলেছেন। হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لاَ يَتَمَنَّيَنَّ أَحَدُكُمْ الْمَوْتَ مِنْ ضُرٍّ أَصَابَه“ فَإِنْ كَانَ لاَ بُدَّ فَاعِلاً فَلْيَقُلْ اللَّهُمَّ أَحْيِنِي مَا كَانَتْ الْحَيَاةُ خَيْرًا لِي وَتَوَفَّنِي إِذَا كَانَتْ الْوَفَاةُ خَيْرًا لِي
তোমাদের কেউ দুঃখ কষ্টে পতিত হবার কারণে যেন মৃত্যু কামনা না করে। যদি কিছু করতেই চায়, তা হলে সে যেন বলেঃ হে আল্লাহ! আমাকে জিবিত রাখো, যতদিন আমার জন্য বেঁচে থাকা কল্যাণকর হয় এবং আমাকে মৃত্যু দাও, যখন আমার জন্য মরে যাওয়া কল্যাণকর হয়। -সহিহ বুখারি : হাদিস নং : ৫৬৭১
সুতরাং প্রমাণ হলো, আল্লাহপাকই একমাত্র জিবন ও মৃত্যুদাতা। কেননা তিনি জিবনহীন শুক্রাণুতে জীবন সঞ্চার করেন এবং তাতে তরতাজা প্রাণের বিকাশ ঘটান। আবার কিয়ামতের দিন অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়া দেহগুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে দেবেন। তিনি মৃত অন্তরকে জিবিত করে তাঁর মারেফাতের নূর দ্বারা। তিনি মৃত ভূমিতে বৃষ্টিপাত করে তা থেকে শস্য উৎপাদন করে তা জিবিত করেন। তিনি মৃত্যু দানকারী। কেননা তিনি জীবের প্রাণ কেড়ে নেন এবং শক্তিশালী ও অহংকারীকে মৃত্যু দ্বারা লাঞ্ছিত করেন। এরপরও যারা রাজা-বাদশাহদেরকে জিবনের মালিক বলে অভিহিত করে এটা কী সুস্পষ্ট শিরক নয়?
আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা আবশ্যক নয়!
প্রিয় পাঠক, মহান আল্লাহ আমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ চান যেন সকল বান্দা তাঁকে ভালোবাসেন, তাঁকে মহব্বত করেন। যারা রব থেকে দূরে সরে যায়, তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ
হে মানুষ! কোন জিনিস তোমাকে তোমার সেই মহান প্রতিপালক সম্বন্ধে ধোঁকায় ফেলেছে? -সুরা ইনফিতার : ৬
সুতরাং বুঝা গেলো, আল্লাহর চাওয়া হলো, তাঁর বান্দারা দুনিয়াপ্রীতি থেকে সরে তাঁর ভালোবাসা কামনা করুক। অতএব একথা চিরসত্য যে, সকল বান্দার জন্য আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করাই হলো মূল টার্গেট।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল বিষয়টি আবশ্যক নয় বলে দাবি করছে হেযবুত তওহীদ। তাদের বক্তব্য দেখুন-
আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা নফল:
প্রশ্ন আসে তবে কি আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের প্রয়োজনীয়তা এ দ্বীনে নেই? আছে, আগেই বলেছি এ দ্বীন ভারসাম্যযুক্ত, কাজেই দুটোই আছে। কিন্তু প্রথম হলো পৃথিবীতে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত কোরে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা কোরে, তারপর আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা। প্রথমটা ফরজ, দ্বিতীয়টা নফল। ফরদ নামায বাদ দিয়ে শুধু সুন্নত বা নফল নামায পড়লে শরিয়াহ মোতাবেকই তা যেমন নাজায়েয, ঠিক তেমনি বিশ্ব নবীর (দঃ) ওপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্বকে পূর্ণ করার ফরদ্র কাজ বাদ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া অর্থাৎ নফল কাজ নিয়ে ব্যস্ত হোলে তা ঐ শরিয়াহ মোতবেকই জায়েয হবে না। প্রথমে ফরজ তারপর ওয়াজেব, তারপর সুন্নাহ, তারপর নফল ও তারপর মুস্তাহাব’। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ. ১১০
আল্লাহ-র নৈকট্য অর্জন করানোর দায়িত্ব নবিজি সা. এর নয়:
তাসাওয়াফের মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে তাঁর নৈকট্যলাভের প্রক্রিয়া শিক্ষা দেওয়া মোহাম্মদের (সা.) লক্ষ্য নয়, তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন আইন, নতুন সমাজ-ব্যবস্থা স্থাপন করা। -বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ১৭
প্রিয় পাঠক, একটু ভেবে দেখুন তো কথাটি কতবড় ভয়ঙ্কর কথা। সুতরাং হেযবুত তওহীদের উক্ত বক্তব্য থেকে তারা দুটি বিষয় স্পষ্ট করতে চেয়েছে।
ক. ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা ফরজ আর আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা নফল, তথা আবশ্যক নয়।
খ. আল্লাহ-র নৈকট্য অর্জন করার শিক্ষা দেওয়া নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ নয়।
গ. ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার প্রচেষ্টা নাজায়েয।
ইসলাম কী বলে?
ক. আল্লাহ-র নৈকট্য অর্জন করা ফরজ নয়?
মহান আল্লাহ-র নৈকট্য অর্জন করা সর্বাবস্থায় ফরজ। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসংখ্য হাদিস রয়েছে। চলুন কয়েকটি প্রমাণ দেখা যাক। মহান রব বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللّهِ أَندَاداً يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللّهِ وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَشَدُّ حُبًّا لِّلّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُواْ إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلّهِ جَمِيعاً وَأَنَّ اللّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ
এবং (এতদসত্ত্বেও) মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোকও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে (তাঁর প্রভুত্বে) অংশীদার সাব্যস্ত করে, যাদেরকে তারা ভালোবাসে আল্লাহর ভালোবাসার মতো। তবে যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকেই সর্বাপেক্ষা বেশি ভালোবাসে। হায়! এ জালিমগণ (দুনিয়ায়) যখন কোনও শাস্তি প্রত্যক্ষ করে, তখনই যদি বুঝতো যে, সমস্ত শক্তি আল্লাহরই এবং (আখিরাতে) আল্লাহর আজাব হবে সুকঠিন। -সুরা বাকারা : ১৬৫
প্রিয় দ্বীনি ভাই, উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ ঈমানদারদের পরিচয় বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ ঈমানদার হলো তারা, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। সুতরাং বুঝা গেলো ঈমানদার হলো, যাঁদের অন্তরে সবচে বেশি আল্লাহর ভালোবাসা থাকবে। সুতরাং যারা আল্লাহ-র নৈকট্যকে আবশ্যকীয় মনে করে না, তারা কখনও ঈমানদার হতে পারে না। আল্লাহপাব আরও বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَابْتَغُواْ إِلَيهِ الْوَسِيلَةَ
হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর পর্যন্ত পৌঁছার জন্য অছিলা সন্ধান করো। -সুরা মায়িদা : ৩৫
‘ওসীলা’ শব্দের অর্থ কী?
রঈসুল মুফাসসিরিন, বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এ ব্যাপারে মতামত পেশ করেছেন,
عَنْ عَطَاءٍ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَيِ الْقُرْبَةَ
বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা রহি. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, (ওসীলা) অর্থ হলো, নৈকট্য অর্জন করা। -তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ৩ পৃ. ৭৫
ইমাম ইবনে কাসীর রহি. আরও বলেন,
وَكَذَا قَالَ مُجَاهِدٌ وَعَطَاءٌ وَأَبُو وَائِلٍ وَالْحَسَنُ وَقَتَادَةُ وَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ كَثِيرٍ وَالسُّدِّيُّ وَابْنُ زَيْدٍ
এমনই মত পোষণ করেছেন (অসংখ্য তাবেয়ী, যেমন) হযরত মুজাহিদ, আতা, আবু ওয়ায়িল, হাসান বসরী, কাতাদাহ, আব্দুল্লাহ ইবনে কাসীর, সুদ্দী এবং ইবনে যায়েদ রহি. প্রমুখ। -তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ৩ পৃ. ৭৫
তাবেয়ী কাতাদাহ রহি. বলেন,
قوله فيها أى تقربوا إليه بطاعته والعمل بما يرضيه
আয়াতের অর্থ হলো- ‘তোমরা তাঁর আনুগত্য করার মাধ্যমে এবং যে সকল কাজ তিনি খুশী হন তার মাধ্যমে তাঁর (আল্লাহর) নিকটবর্তী হও। -তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ৩ পৃ. ১০৩
এ কথাগুলো উল্লেখ করার পর ইমাম ইবন কাসীর রহি. বলেন,
وهذا الذى قاله هؤلاء الأئمة لا خلاف بين المفسرين فيه
এ সকল মহান ইমামগণ আয়াতের তাফসীরে এ কথাগুলোই বলেছেন। যে ব্যাপারে মুফাসসিরদের মাঝে কোন মতভেদ নেই। -তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ৩ পৃ. ১০৩
সুতরাং প্রমাণ হলো, ওসীলা শব্দের অর্থ হলো, নৈকট্য অর্জন করা। আর এ আয়াত দিয়ে প্রমাণ হলো যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর নৈকট্য অর্জন করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করা ফরজ।
অভিযোগ ও জবাব:
হেযবুত তওহীদ হয়তো দাবি করতে পারে যে, এখানে ‘ওসীলা’ শব্দের অর্থ ‘নৈকট্য অর্জন করা’ এটা আমাদের মনগড়া ব্যাখ্যা। তাহলে নিন্মের আয়াতটি দেখুন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ
এবং সিজদা করো ও নিকটবর্তী হও। -সুরা আলাক : ১৯
উক্ত আয়াতের তাফসীর কাতে গিয়ে ইমাম কুরতুবী রহি.বলেন,
واسجد أي صل لله واقترب أَيْ تَقَرَّبْ إِلَى اللَّهِ جَلَّ ثَنَاؤُهُ بِالطَّاعَةِ وَالْعِبَادَةِ
‘সেজদা করুন’ অর্থ হলো, ‘আল্লাহর জন্য নামাজ পড়ুন’ এবং ‘নৈকট্য অর্জন করুন’ অর্থ হলো, অনুসরণ ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করুন। -তাফসীরে কুরতুবী : খ. ২০ পৃ. ১১৪
প্রিয় পাঠক, এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে নৈকট্য অর্জনের সরাসরি শব্দটিই আল্লাহ তাআলা ব্যবহার করেছেন। সুতরাং এখন তো আর অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং প্রমাণ হলো, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা এটা মহান রবের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ট বিধান।
সুতরাং উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর নৈকট্য অর্জনের কথা বলতে গিয়ে صيغة الامر তথা আদেশসূচক বাক্য ব্যবহার করেছেন। আর পবিত্র কুরআনের সকল আদেশসূচক শব্দ ফরজ বা ওয়াজীবের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অবশ্য যেসব বিষয়ে ভিন্ন কোনো বিধান বর্ণিত হয়, সেগুলোর কথা ভিন্ন। কিন্তু এ আয়াতে বর্ণিত বিধানের বিপরীত ভিন্ন কোনো বিধান অন্য কোথাও নেই। সুতরাং মহান রবের নৈকট্য অর্জন করা ফরজ। এ ব্যাপারে একমাত্র হেযবুত তওহীদ ব্যতিত অন্য কারও দ্বিমত নেই।
খ. আল্লাহ-র নৈকট্য অর্জনের শিক্ষা দেওয়া কী নবিজি সা.-এর কাজ নয়?
প্রত্যেক নবি আ.-এর মূল কাজ ছিলো, আল্লাহ-র পথভোলা বান্দাদেরকে আল্লাহ-র সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেওয়া। সে ধারাবাহিকতায় আমাদের নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরও কাজ ছিলো আল্লাহ-র নৈকট্য অর্জনের পথ দেখানো। এ বাপারে স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে, হযরত আবূ উমামাহ্ রা. বলেন, আমর ইবনু আবাসাহ রা. আমার কাছে রিওয়ায়াত করেছেন যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তিনি বলতে শুনেছেন,
أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الرَّبُّ مِنَ الْعَبْدِ فِي جَوْفِ اللَّيْلِ الآخِرِ فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَكُونَ مِمَّنْ يَذْكُرُ اللَّهَ فِي تِلْكَ السَّاعَةِ فَكُنْ
আল্লাহ তাআলা শেষ রাতে তার বান্দার সবচেয়ে নিকটবর্তী হন। অতএব যারা এ সময় আল্লাহর যিকর করে (নামায পড়ে ও দু’আ করে), তুমি পারলে তাদের দলভুক্ত হয়ে যাও। -জামে তিরমিযি : হাদিস নং : ৩৫৭৯
সুতরাং উক্ত হাদিস থেকে বুঝা গেলো, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার জন্য নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই সাহাবাদেরকে উৎসাহ দিতেন। এছাড়াও অসংখ্য আয়াত-হাদিস রয়েছে। যা থেকে প্রমাণ হয় হেযবুত তওহীদের দাবিটা সর্বৈব মিথ্যা।
গ. ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার প্রচেষ্টা নাজায়েয?
তাদের দাবি ছিলো, ‘আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠান আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সকল প্রক্রিয়া তথা আমল নাজায়েয’।
ইসলাম কী বলে?
এক. উপরোক্ত আয়াতটিতে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য কোনো শর্তারোপ করা হয়নি। অর্থাৎ ‘ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যাবে কী যাবে না, এমন কোনো শর্তারোপ মহান আল্লাহ করেননি। অতএব বুঝা গেলো, আল্লাহর নির্দেশ হলো, সর্বহালতে তাঁর নৈকট্য অর্জন করা লাগবেই। এটা আল্লাহর নির্দেশ, তথা ফরজ। সুতরাং কুরআনে কারীমের مطلق তথা শর্তহীন আয়াতকে مقيد তথা শর্তযুক্ত করার অধিকার পৃথিবির কারও নেই। অতএব আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রচেষ্টা করার আগে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করার শর্তারোপ করা কুরআনের অপব্যাখ্যার শামিল। সুতরাং ‘ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা নাজায়েয’ এটা একটি ডাহা মিথ্যাচার। ও খোদাদ্রোহীতার শামিল।
দুই. তাছাড়া উপরিউক্ত আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছিলো। তখনও কিন্তু ইসলামি শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এর আগেই এ আয়াত নাজিল হয়েছিলো। সুতরাং আল্লাহ তাআলা নিজেই তাঁর আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগেই তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য সিজদা বা নামাজের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুতরাং বুঝা গেলো, সর্বহালতে আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তাঁর নৈকট্য অর্জন করা ফরজ। এর বিপরীতে গিয়ে যে কথা হেযবুত তওহীদ দাবি করেছে, এটা উক্ত আয়াতকে অস্বীকার করার অপরাধে তাদের মুসলিম বলার কোনো সুযোগ আছে কী?
তিন. হাদিসে কুদসীতে এসেছে, হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রতিপালক থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
إِذَا تَقَرَّبَ الْعَبْدُ إِلَيَّ شِبْرًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا وَإِذَا تَقَرَّبَ مِنِّي ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ مِنْهُ بَاعًا وَإِذَا أَتَانِي مَشْيًا أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً
আমার বান্দা যখন আমার দিকে এক বিঘত নিকটবর্তী হয়, আমি তখন তার দিকে এক হাত নিকটবর্তী হই। আর সে যখন আমার দিকে এক হাত নিকটবর্তী হয়, আমি তখন তার দিকে দু’হাত নিকটবর্তী হই। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌঁড়ে যাই। -সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৭৫৩৬
চার. আরেকটি হাদিসে কুদসীতে এসেছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ قَالَ مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَىَّ عَبْدِي بِشَىْءٍ أَحَبَّ إِلَىَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَىَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطُشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِي لأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لأُعِيذَنَّهُ وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَىْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِي عَنْ نَفْسِ الْمُؤْمِنِ يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ
আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যাক্তি আমার কোন ওলীর সঙ্গে শত্রুতা রাখবে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করি। আমার বান্দা আমি যা তার উপর ফরয করেছি, সেই ইবাদতের চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয় কোন ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করবে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নিই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে সবকিছু দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যার দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোন কিছু সাওয়াল করে, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি যে কোন কাজ করতে চাইলে এটাতে কোন রকম দ্বিধা সংকোচ করি-না যতটা দ্বিধা সংকোচ মুমিন বান্দার প্রাণ হরণে করি। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার কষ্ট অপছন্দ করি। -সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৬৫০২
সুবহানাল্লাহ্! আল্লাহর নৈকট্য অর্জনকারীরা কতো প্রিয় মহান রবের কাছে। অথচ এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি থেকে দূরে রাখার জন্য তারা কতো ভয়ঙ্কর ছক এঁকেছে।
পাঁচ. প্রিয় পাঠক, আপনার কমনসেন্সসকে একবার প্রশ্ন করুন তো, যিনি আমাদের সৃষ্টি করলেন, নিয়মিত লালন-পালন করে যাচ্ছেন, তাঁর নৈকট্য অর্জন করার জন্য কোনো দলিল প্রয়োজন হয়? এটা তো সর্বজনবিদিত বিষয় যে, গোলাম তাঁর মালিকের নৈকট্য অর্জন করবে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের নৈকট্য অর্জন করবে এবং করে থাকে। এটা নৈতিকতার দাবি। তাহলে রব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন আবশ্যকীয় নয়, এটা কী কোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষ বিশ্বাস করবে? আর যারা এমন কথা প্রচার করে যাচ্ছেন, তারা কিভাবে মুমিন-মুসলিম হয়, এটা পাঠকদের বিবেকের কাছে সোপর্দ করলাম।