Home > জায়েয-নাজায়েয > তাবিজ ব্যবহার করা কি শিরক?

তাবিজ ব্যবহার করা কি শিরক?

বর্তমানে কিছু ইসলামিক স্কলারগণ সরাসরি সব ধরণের তাবজি ব্যবহারকে শিরক বলে আখ্যায়িত করে চলেছেন। কিন্তু হাদিসের কিতাবগুলো অধ্যয়ন করলে দেখা যায়,অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণ তাবিজ ব্যবহার জায়েযের পক্ষে ফাতাওয়া দিয়েছেন। এমনকি তাঁরা তাবিজ দিয়েছেন। অবশ্য জাহেলী যুগে বিভিন্নভাবে কুফরী মন্ত্র দিয়ে তাবিজ দেয়া হতো। সেসব তাবিজকে নবিজি স: সরাসরি শিরক বলে ঘোষণা করেছেন।

এখানে আমাদের জেনে রাখা উচিৎ তাবিজ শব্দের অর্থ হলো আশ্রয় কামনা করা। সুতরাং আল্লাহকে শিফা দানকারী আকীদা রেখে মাছুর ও মুবাহ তাবিজকে ওসিলা মনে করে যদি কেউ ব্যবহার করে তাহলে শিরক হওয়ার কোন সুযোগ নেই।বরং জায়েয।

এক্ষেত্রে আমারা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের বেশ কিছু মতামত আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

সাহাবায়ে কেরামের অভিমত:

প্রথমে আমরা সাহাবায়ে কেরামের আমল দেখবো।

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা.

عن عمرو بن شعيب عن ابيه عن جده قال قال رسول الله صلي الله عليه وسلم إذا فَزِع أحدُكم في النومِ فلْيَقُلْ أعوذُ بكَلِماتِ اللهِ التامّاتِ من غضبِهِ وعقابِهِ وشرِّ عبادِهِ ومن هَمَزاتِ الشياطينِ وأن يَحْضُرون فإنها لن تَضُرَّه فكان عبدُ اللهِ بنُ عمرٍو يُلَقِّنُها من بلغ من ولدِهِ ومن لم يَبْلُغْ منهم كتبها في صَكٍّ ثم عَلَّقَها في عُنُقِهِ

অর্থ: আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- তোমাদের কেউ ঘুমে ভয় পেলে সে যেন এ দুআ পড়ে-

بِسْمِ اللهِ، أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التّامّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَسُوءِ عِقَابِهِ، وَمِنْ شَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ شَرِّ الشّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ.

বর্ণনাকারী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস তার প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদেরকে এ দুআটি শিখিয়ে দিতেন। আর যারা অপ্রাপ্ত বয়স্ক তাদের জন্য দুআটি লিখে তাদের গলায় ঝুলিয়ে দিতেন।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদীস-২৪০১৩ মুসনাদে আহমাদ খ:২ পৃ:১৮১ তিরমিযী হাদীস-৩৫২৮ মুসতাদরাকে হাকেম হাদীস-২০১০ (হাদিস-হাসান)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা:

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ إذَا عَسِرَ عَلَى الْمَرْأَةِ وِلَادُهَا فَلْيَكْتُبْ بِسْمِ اللَّهِ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ الْحَلِيمُ الْكَرِيمُ سُبْحَانَ اللَّهِ وَتَعَالَى رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوا إلَّا عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوعَدُونَ لَمْ يَلْبَثُوا إلَّا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ بَلَاغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إلَّا الْقَوْمُ الْفَاسِقُونَ

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, কোনো নারীর সন্তান প্রসব কঠিন হয়ে গেলে তার জন্য যেন এ দুআ ও এ দুটি আয়াত একটি থালায় লেখা হয়। অতপর তা ধুয়ে সে নারীকে পান করানো হয়। দুআটি হল-

بِسْمِ اللهِ لا إِلهَ إِلاّ هُوَ الْحَلِيمُ الْكَرِيمُ، سُبْحَانَ اللهِ رَبِّ السّموَاتِ السّبْعِ وَرَبِّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، كَأَنّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوا إِلّا عَشِيّةً أَوْ ضُحَاهَا. كَأَنّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوعَدُونَ لَمْ يَلْبَثُوا إِلّا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ، بَلَاغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إِلّا الْقَوْمُ الْفَاسِقُونَ

সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদিস-২৩৯৭৫

তাবেয়ীদের আমল:

১.সাঈদ ইবনে মুসায়্যিব র:

سألت سعيد بن المسيب عن التعويذ فقال لا بأس به إذا كان في أديم

অর্থ: আবু ইছমা বলেন, আমি সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিবকে তাবীয সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি, জবাবে তিনি বলেন, কোনো অসুবিধা নেই যদি চামড়ায় মোড়ানো থাকে।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদিস-২৪০০৯

عن علقمة قال سأَلْتُ ابْنَ الْمُسَيِّبِ عَنِ الِاسْتِعَاذَةِ تَكُونُ عَلَى الْحَائِضِ وَالْجُنُبِ فَقَالَ لَا بَأْسَ بِهِ إِذَا كَانَ فِي قَصَبَةٍ أَوْ رُقْعَةٍ يَجُوزُ عَلَيْهَا

অর্থ: আলকামা র: বলেন, আমি সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব র: কে জিজ্ঞেস করলাম, গোসল ফরয হওয়া ব্যক্তি বা ঋতুমতী নারীর গায়ে তাবীয থাকাতে কোনো অসুবিধা আছে কি না? জবাবে বললেন, যদি কোনো খোলের মধ্যে হয় অথবা কোনো কাগজে মোড়ানো থাকে তাহলে অসুবিধা নেই।
সূত্র: মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক হাদিস-১৩৪৮

২. হযরত মুজাহিদ র:

عن ثوير قال كان مجاهد يكتب للناس التعويذ فيعلق عليهم

অর্থ: হযরত ছুওয়াইর রাহ. বলেন- মুজাহিদ র: মানুষের জন্য তাবীয লিখতেন। অতপর তাদের গায়ে ঝুলিয়ে দিতেন।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা বর্ণনা-২৪০১১

৩. ইবনে সীরীন র:

عن اسماعيل بن مسلم عن ابن سيرين انه كان لا يرى بأسا بالشيء من القرآن

অর্থ: ইসমাঈল ইবনে মুসলিম র: ইবনে সীরীন র: কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে তাবীয লেখাকে দূষণীয় মনে করতেন না।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা বর্ণনা- ২৪০১৪

৪.হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ র:

عن ليث عن عطاء قال لا بأس أن يعلق القرآن

অর্থ: লাইস র: থেকে বর্ণিত হযরত আতা র: বলেন, কুরআনের আয়াত লিখে ঝুলাতে কোনো অসুবিধা নেই।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা বর্ণনা-২৪০১৬

৫. আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে আলী র:

عن يونس بن خباب قال سألت أبا جعفر عن التعويذ يعلق على الصبيان فرخص فيه

অর্থ: ইউনুছ ইবনে খাব্বাব বলেন-আমি আবু জাফর (মুহাম্মাদ ইবনে আলী)-কে শিশুদের গায়ে তাবীয ঝুলানো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি, তিনি এর অনুমতি দেন।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা বর্ণনা-২৪০১৭

৬. হযরত দাহহাক র:

এর অভিমত বর্ণনা করেন-

عن جويبر عن الضحاك انه لم يكن يرى بأسا أن يعلق الرجل الشيء من كتاب الله، إذا وضع عند الغسل و عند الغائط.

অর্থ: জুওয়াইবির ইবনে সায়ীদ আলআযদী র: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত দাহহাক র: কুরআনের আয়াত দিয়ে তাবীয লিখে তা গায়ে ঝুলাতে কোনো অসুবিধা মনে করতেন না, যদি গোসল ও হাম্মামে যাওয়ার সময় তা খুলে রাখা হয়। (অর্থাৎ যদি খোলের ভেতর না থাকে)।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদিস-২৪০১৮

৭. সাঈদ ইবনে জুরাইজ র:

أخبرنا حجاج قال اخبرني من رأى سعيد بن جبير يكتب التعويذ لمن أتاه

অর্থ: হযরত হাজ্জাজ র: বলেন, হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর এর কাছে কেউ আসলে তিনি নিজে তাকে তাবীজ লিখে দিতেন।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ হাদিস-২৩৯৭৭

কুরআনের আয়াত লিখে ধুয়ে রোগীকে পান করানো:

কুরআনের আয়াত লিখে কাগজটি ধুয়ে রোগীকে পান করানো জায়েয।কারণ হাদিসে এসেছে,

عن ابي قلابة وليث عن مجاهد انهما لم يريا بأسا أن يكتب آية من القرآن ثم يسقاه صاحب الفزع

অর্থ: আবু কিলাবা লাইস এবং মুজাহিদ র: থেকে বর্ণনা করেন, তারা উভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত রোগীর জন্য কোনো আয়াত লিখে তা ধুয়ে রোগীকে খাওয়ানোতে কোনো ধরনের অসুবিধা মনে করতেন না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ২৩৯৭৬

লোহা,তামা,রুপা বা অন্যান্য জিনিষের মধ্যে তাবিজ ঢুকিয়ে ব্যবহার করা জায়েয:

এ ব্যপারে স্পষ্টভাবে হাদিসের কিতাবগুলোতে বর্ণনা এসেছে,

حدثنا عبد الملك عنْ عَطَاءٍ فِي الْمَرْأَةِ الْحَائِضِ فِي عُنُقِهَا التّعْوِيذُ أَوِ الْكِتَابُ قَالَ إِنْ كَانَ فِي أَدِيمٍ فَلْتَنْزِعْهُ وَإِنْ كَانَ فِي قَصَبَةٍ مُصَاغَةٍ مِنْ فِضّةٍ فَلَا بَأْسَ إِنْ شَاءَتْ وَضَعَتْ وَإِنْ شَاءَتْ لَمْ تَفْعَلْ

অর্থ: আব্দুুল মালিক র: বলেন, ঋতুমতী নারীর গলায় তাবীয বা কুরআনের কোনো আয়াত ঝুলানো থাকে, এতে কোনো অসুবিধা আছে কি না- আতা ইবনে আবী রাবাহকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যদি চামড়ায় থাকে তাহলে ঋতু চলাকালীন সময়ে যেন তা খুলে নেয়। আর যদি রুপার খোলের ভেতর থাকে তাহলে ইচ্ছা হলে খুলতেও পারে,আর ইচ্ছা হলে না খুললেও কোনো অসুবিধা নেই।
সূত্র: সুনানে দারেমী হাদিস-১১৭৫

উপরন্তু আরো এসেছে,

عن ابن جريج قال قلت لعطاء القرآن كان على امراة فحاضت أو أصابتها جنابة اتنزعها قال إن كان في قصبة فلا بأس. قلت فكان في رقعة فقال هذه أبغض إلي قلت فلم مختلفان قال إن القصبة هي أكف من الرقعة

قال ابن جريج و سمعته قبل ذلك يسأل أيجعل على الصبي القرآن قال إن كان في قصبة من حديد أو قصبة ما كانت فنعم أما رقعة فلا

অর্থ: ইবনে জুরাইজ রাহ. বলেন, আমি আতা ইবনে আবী রাবাহকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো নারীর শরীরে যদি কুরআনের আয়াত লেখা (তাবীয) থাকে আর সে ঋতুমতী হয় বা তার ওপর গোসল ফরয হয় (অর্থাৎ যে সময় কুরআন স্পর্শ করা নাজায়েয) তাহলে কি সে তাবীযটি খুলে রাখবে?
–জবাবে তিনি বললেন, যদি তা খোলের মধ্যে হয় তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। আমি বললাম, আর যদি কাগজের মধ্যে হয়, তিনি বললেন এটা আমার কাছে খুব অপছন্দনীয়। আমি বললাম উভয়ের মাঝে পার্থক্য কী? জবাবে বললেন, যখন তা খোলের ভেতর থাকে তখন তা ভেতরে থাকে; স্পর্শে আসে না। কিন্তু কাগজে থাকলে স্পর্শে আসে।

ইবনে জুরাইজ বলেন, আমি এর পূর্বে (এক ব্যক্তিকে) তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে শুনেছি যে, শিশুদের গায়ে কুরআনের আয়াত লিখে ঝুলাতে কোনো অসুবিধা আছে কি না? তখন জবাবে তিনি বলেছিলেন, যদি লোহা বা এজাতীয় অন্য কিছুর খোলে হয়, তাহলে অসুবিধা নেই আর যদি কাগজে হয় তাহলে নিষেধ। (কারণ, এতে কুরআনের সম্মান রক্ষা সম্ভব হয় না।)

সূত্র: মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক হাদিস- ১৩৪৭

উপরোক্ত বর্ণনাগুলো থেকে স্পষ্ট হলো যে, শিরক,কুফর মন্ত্র মুক্ত তাবিজ ব্যবহার করা সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীদের যুগেও ছিল। এমনকি সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহ., মুজাহিদ রাহ., সায়ীদ ইবনে জুবায়ের রাহ.-এর মত দ্বীনের এত বড় জ্ঞানী তাবেয়ীগণ নিজেরাও তাবীয লিখতেন। যেগুলো শিশু,নারী-পুরুষ সবাই ব্যবহার করতেন। সুতরাং ঢালাওভাবে তাবিজকে শিরক বললে পরোক্ষভাবে সাহাবা এবং তাবেয়ীগণকে মুশরিক বানানোর নামান্তর নয় কি?

অভিযোগ-১

নবিজি স: তাবিজ ব্যবহার করাকে শিরকও বলেছেন। যেমন হাদিসে এসেছে,

 عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ الْجُهَنِيِّ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ أنَّ رسولَ اللهِ ﷺ أَقْبَلَ إليه رَهْطٌ فبايَعَ تِسعةً وأَمسَكَ عن واحِدٍ فقالوا يا رسولَ اللهِ بايَعْتَ تِسعةً وترَكْتَ هذا قال إنَّ عليه تَميمةً فأَدخَلَ يَدَه فقَطَعَها فبايَعَه وقال مَن عَلَّقَ تَميمةً فقد أَشرَكَ

অর্থ: হযরত উকবা ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত একবার রাসুল সা. এর কাছে (ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১০ সদস্য বিশিষ্ট) একটি দল আসল। নবিজি স: ৯ জনের (ইসলামের) বায়আত নিলেন।বাকি একজন থেকে বিরত থাকলেন। তারা বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! নয় জনের বায়আত নিলেন, কিন্তু এ লোকটিকে ছেড়ে দিলেন কেন? নবিজি স: বললেন, তার কাছে তাবিজ রয়েছে। অতপর হাত ঢুকিয়ে তাবিজ ছিড়ে ফেললেন,অতপর বায়আত নিলেন এবং নবিজি স: বললেন, নিশ্চয় যে তাবিজ ঝুলালো সে শিরক করল।
সূত্র: মুসনাদে আহমাদ-১৭৪২২ সহিহ ইবনে হিব্বান-৬০৮৬ তবরানী-৭৭৫

উক্ত হাদিসে তো সরাসরি তাবিজকে শিরক বলা হয়েছে।

জবাব:

এখানে একটু নজর দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এখানে যে তাবিজকে শিরক বলা হয়েছে সেটা ছিল কুফরী মন্ত্র দিয়ে করা। কারণ তিনি যেহেতু মুসলিম হতে এসেছিলেন, তো এ কথা স্বাভাবিক তিনি এর আগে অমুসলিম ছিলেন। আর তার শরিরে থাকা তাবিজ কোন অমুসলিম থেকেই নেয়া হয়েছিল। আর অমুসলিমরা তো কুরআন দিয়ে তাবিজ দেয় না। বরং তারা বিভিন্ন কুফরী শিরকী মন্ত্র দ্বারা তাবিজ দিয়ে থাকে।যা ইসলামে স্পষ্ট নিষেধ। বরং শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

উপরন্তু হাদীসে বর্ণিত তামীমা অর্থ তাবীয নয়। বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরের মালা যা জাহেলী যুগে ব্যবহার করা হতো। যেগুলোতে কুরআন,হাদিসের কোন মুআমালা থাকতো না।সেটাকে নবিজি স: শিরক বলেছেন।
এজন্য আল্লামা তূরবিশতী র: মাসাবিহুস সুন্নাহ-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থে লেখেন-

والمراد من التميمة ما كان من تمائم الجاهلية ورقاها، فإن القسم الذي يختص بأسماء الله تعالى وكلماته غير داخل في جملته بل مستحب مرجو البركة، عرف ذلك من أصل السنة.

অর্থ: যেসব হাদীসে তামীমাকে শিরক বলা হয়েছে সেখানে তামীমা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, জাহেলী যুগের তামীমা (পাথর)। কারণ, যেগুলো আল্লাহ নাম-কালাম দিয়ে লেখা তা এতে অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং সেগুলো মুস্তাহাব, তা থেকে বরকত পাওয়ার আশা করা যায়। বিষয়টি সুন্নাহর মৌলিক শিক্ষা থেকে বোঝা যায়। সূত্র: আলমুয়াস্সার খ: ৩ পৃ: ১০০৮

ﺍﻟﺘﻤﺎﺋﻢ ﺟﻤﻊ ﺗﻤِﻴﻤﺔ ﻭﻫﻲ ﺧَﺮَﺯﺍﺕ ﻛﺎﻧﺖ ﺍﻟﻌﺮﺏ ﺗُﻌﻠّﻘﻬﺎ ﻋﻠﻰ اﻭﻻﺩﻫﻢ ﻳَﺘَّﻘُﻮﻥ ﺑﻬﺎ ﺍﻟﻌﻴﻦ ﻓﻲ زﻋْﻤﻬﻢ ﻓﺄﺑْﻄﻠﻬﺎ ﺍﻹﺳﻼﻡ

অর্থ: তামাইম হলো তামিমা শব্দের বহু বচন আর এগুলো হলো
পুতি যা আরবরা তাদের সন্তানদের শরীরে ঝুলিয়ে দিতো। তাদের বিশ্বাস ছিল এর মাধ্যমে দৃষ্টির ক্ষতি থেকে বাঁচা যাবে। পরে ইসলাম এটাকে নিষিদ্ধ সাব্যস্ত করে।
সূত্র: রদ্দুল মুহতার খ:৯ পৃ:৫২৩

পক্ষান্তরে তাবীযের (تعويذ) হাকীকত হল, আশ্রয় প্রার্থনা করা। তাবীয ব্যবহারকারী যদি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার নিয়তেই তাবীয ব্যবহার করে এবং তাবীযের লেখা যদি কুরআন-হাদীসেরই কোনো দুআ হয় তাহলে এই তাবীয ব্যবহার মুবাহ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন ঔষধ খাওয়ার ব্যাপারে হাদিসে এসেছে,

عن أسامة بن شريك قال أتيتُ رسولَ اللهِ صلّى اللهُ عليه وسلَّمَ وأصحابَه كأنَّما على رُؤوسِهم الطيرُ فسلَّمتُ ثم قعدْتُ فجاء الأعرابُ من ههنا وههنا فقالوا يا رسولَ اللهِ صلّى اللهُ عليه وسلَّمَ أنَتَداوى فقال تَداوَوْا فإنَّ اللهَ عزَّ وجَلَّ لم يضَعْ داءً إلّا وضَعَ له دواءً غيرَ داءٍ واحدٍ الهَرَمُ

অর্থ : উসামাহ ইবনু শরীক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এস দেখলাম তাঁর সাহাবীদের মাথার উপর যেন পাখী বসে আছে, অর্থাৎ শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। আমি সালাম দিয়ে বসলাম। অতঃপর এদিক-সেদিক থেকে কিছু বেদুঈন এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো? তিনি বলেন, তোমরা চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করো; কেননা মহান আল্লাহ একমাত্র বার্ধক্য ছাড়া সকল রোগেরই ঔষধ সৃষ্টি করেছেন।
সূত্র: আবু দাউদ হাদিস- ৩৮৫৫ মুসনাদে আহমাদ হাদিস-১৮৩৬৭

সুতরাং আল্লাহকে ফিফা দানকারী মনে করে যদি কেউ ঔষধ গ্রহন করে, তাদের ক্ষেত্রে যদি শিরক না হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করে মুবাহ তাবিজ গ্রহণ করলে সেক্ষেত্রে শিরক হবে কেন? অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,

وَنُنَزِّلُ مِنَ ٱلۡقُرۡءَانِ مَا هُوَ شِفَاۤءࣱ وَرَحۡمَةࣱ لِّلۡمُؤۡمِنِینَ وَلَا یَزِیدُ ٱلظَّـٰلِمِینَ إِلَّا خَسَارࣰا

অর্থ: আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গোনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়।

সুতরাং আল্লাহকে শিফা দানকারী মনে করে ঔষধ সেবন যেমন শিরক নয়, তেমনি আল্লাহকে শিফা দানকারী মনে করে তাবিজ ব্যবহারও শিরক নয় বরং জায়েয।

অভিযোগ-২

عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول انّ الرّقَى وَالتّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি রাসুল সা. কে বলতে শুনেছি যে, নিশ্চয় ঝাড় ফুঁক করা তাবিজ করা ও স্বামী বা স্ত্রীকে (ঝাড় ফুঁক বা তাবিজের মাধ্যমে) বশিভুত করা শিরক।
সূত্র: আবু দাউদ হাদীস ৩৮৮৩

এ হাদিসেও তো শিরক বলা হয়েছে। তাহলে তাবিজ জায়েয হয় কিভাবে?

জবাব-

এ হাদিসে তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথমটি হলো ঝাড়ফুঁক। আর এ কথা স্পষ্ট যে, কুরআনের আয়াত দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা কিন্তু শিরক নয়। যেমন হাদিসে এসেছে,

عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ الأَشْجَعِىِّ قَالَ كُنّا نَرْقِي في الجاهِلِيَّةِ فَقُلْنا يا رَسولَ اللهِ، كيفَ تَرى في ذلكَ فَقالَ اعْرِضُوا عَلَيَّ رُقاكُمْ لا بَأْسَ بالرُّقى ما لَمْ يَكُنْ فيه شِرْكٌ

অর্থ: হযরত আউফ ইবনে মালেক আশজায়ী রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহেলিয়াতের যুগে আমরা ঝাড় ফুঁক করতাম অতপর বললাম ইয়া রাসুলুল্লাহ! এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি বলেন তোমাদের মন্ত্রগুলো আমার সামনে পেশ কর। ঝাড় ফুঁকে যদি শিরকের শব্দ না থাকে তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই।
সূত্র: মুসলিম হাদিস-২২০০

বুঝা গেল ঝাড়ফুঁকে কোন শিরক মন্ত্র না থাকলে সেটাকে নবিজি স: শিরক বলেননি। তেমনি হাদিসের মধ্যে থাকা আরেকটি অংশ হলো তাবিজ। সেটাও কুরআনের আয়াত বা নবি স: এর দোয়া,কালাম থাকলে শিরক হওয়ার কোন কারণই থাকতে পারে না।
এ ব্যপারে ইউনুস ইবনে হিব্বান র: থেকে একটি বর্ণনা এসেছে

عن يونس بن حبان قال سأَلْتُ أبا جعفر محمد بن علي أَنْ أُعَلِّقَ التّعْوِيذَ، فَقَالَ إِنْ كَانَ مِنْ كِتَابِ اللهِ أَوْ كَلَامٍ عَنْ نَبِيِّ اللهِ فَعَلِّقْهُ وَاسْتَشْفِ بِهِ مَا اسْتَطَعْتَ

অর্থ: আমি (বিশিষ্ট তাবেয়ী) আবু জাফর বাকির র: কে তাবীয পরিধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাবে বলেন, যদি কুরআন বা নবীর কথা দিয়ে হয় তাহলে পরিধান কর এবং যত পার তা দিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ কর।
সূত্র: যাদুল মাআদ খ: ৪ পৃ:৩০১

হাদিসটি দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, নবি স: যে তাবিজ নিষেধ করেছিলেন, সেটা হল শিরক-কুফর মন্ত্র দ্বারা লেখা তাবিজ। পক্ষান্তরে কুরআনের আয়াত বা নবিজি স: এর শিখানো কালাম দ্বারা করলে কোন অসুবিধা নেই। তবে একথা মনে রাখা চাই যে, তাবিজের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। তাবিজ শুধুমাত্র ওসিলা। যা কিছু হয় সব আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। এ নিয়ত অন্তরে রেখে ঔষধ খাওয়া যেমন শিরক নয়,তেমনি তাবিজ ব্যবহার করাও শিরক নয়।

ফুকাহায়ে কেরামের অভিমত:

আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী র: এর অভিমত:

قَوْلُهُ التَّمِيمَةُ الْمَكْرُوهَةُ أَقُولُ الَّذِي رَأَيْته فِي الْمُجْتَبَى التَّمِيمَةُ الْمَكْرُوهَةُ مَا كَانَ بِغَيْرِ الْقُرْآنِ

অর্থ: আমি মুজতাবা নামক কিতাবে দেখেছি, মাকরুহ তাবিজ হল যা কুরআন ব্যতীত অন্যকিছু দ্বারা হয়ে থাকে।
সূত্র: রদ্দুল মুহতার খ.৯ পৃ: ৫২৩

শায়েখ নিযাম র: এর অভিমত:

ولا بأس بتعليق التعويذ

অর্থ:তথা তাবীজ ব্যবহারে কোন সমস্যা নেই ।
সূত্র: ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া খ:৫ পৃ:৩৫৯

ইবনে তাইমিয়া র: এর অভিমত:

নামধারী আহলে হাদীস ভাইদের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র: বলেন,

يَجُوزُ أَنْ يَكْتُبَ لِلْمُصَابِ وَغَيْرِهِ مِنْ الْمَرْضَى شَيْئًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَذِكْرُهُ بِالْمِدَادِ الْمُبَاحِ وَيُغْسَلُ وَيُسْقَى

অর্থ: বিপদগ্রস্ত বা অসুস্থ লোকদের জন্য কারি দ্বারা আল্লাহর কিতাব, আল্লাহর জিকর লিখে দেয়া এবং ধুয়ে পান করা জয়েজ।
সূত্র: মাজমুউ ফাতাওয়া খ:১৯ পৃ:৩৬

তবে এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে,
অন্যায় ও পাপের জন্যও তাবীযের লেনদেন করা যেমন,
১. যুবক-যুবতীর সম্পর্ক
২.স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি
৩. আরেকজনকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেওয়া ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা জরুরী।

তেমনিভাবে এ তাবীয আনতে গিয়ে নারীরা তাবীয লেখকের কাছে বেপর্দা হওয়া, তাদের সাথে একান্তে বসা, এমন লোকদের কাছ থেকে তাবীয নেওয়া, যে শরীয়তের হুকুম-আহকাম মেনে চলে না, এমনকি নামায-রোযাও করে না। সে যে কুফরী কথা দিয়ে তাবীয লিখবে না- তার নিশ্চয়তাও নেই। আবার তাবীয লিখতে বা ব্যবহার করতে এমন নিয়ম পালন করা হয়, যা শরীয়তসম্মত নয়। যেমন (আল্লাহ মাফ করুন) রক্ত দিয়ে আল্লাহর নাম কালাম লেখা, ব্যাঙের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এগুলো সবই হারাম।

অনুরূপভাবে জাহেলী যুগে যেমন বিভিন্ন কুসংস্কার ও বাতিল আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে পাথর কড়ি ইত্যাদি পরিধান করা হত আজো আমাদের সমাজে সেসব রীতি পরিলক্ষিত হয়, বাচ্চাদের (অথবা বড়দেরও) নানা কুসংস্কার ও বাতিল আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে পুঁতির মালা পরানো হয়। শামুক, কড়ি গায়ে ঝুলানো হয়। গাড়ী, রিক্সায় এমনকি ঘরের দরজায় পুরাতন জুতা ঝুলানো হয়। অনেক যুবক বিধর্মীদের ধর্মীয় চিহ্নসম্বলিত বিভিন্ন লকেট ইত্যাদি গলায় পরে। এগুলোর প্রায় সবই জাহেলী যুগের রীতি। অনেকেই এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখে না। অথচ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক্ষেত্রে কত কঠোর ছিলেন। অতএব এ ধরণের কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। অন্যথায় এ ধরণের শিরকী কর্মকান্ড করলে ঈমান চলে যাবে।

 

লেখক:

মুফতী রিজওয়ান রফিকী  

পরিচালক-মাদরাসা মারকাযুন নূর বোর্ডবাজা, গাজীপুর।  

Check Also

পুরুষের জন্য টাখনুর নিচে কাপড় পরা হারাম।

  عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَا …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.