সম্প্রতিককালে একটি বিষয় খুব চর্চিত হচ্ছে ‘হযরত ফাতেমা রা. কে মা বলা বলা যাবে কী না’ এ প্রসঙ্গে।
প্রথমত: জেনে রাখা উচিত, হযরত ফাতিমা রা. কে কুরআন, হাদিস, সাহাবিদের বক্তব্য, তাবেঈনদের বক্তব্য, যুগে যুগে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এর অগণিত মুহাদ্দিস ও মুফাফসির কেউ মা বলে সম্বোধন করেছেন বলে ইতিহাস পাওয়া যায় না। কোনও হাদিসের কিতাব, সিরাতের কিতাব বা ইসলামের ইতিহাসের কিতাবে তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে বলে জানা নাই।
দ্বিতীয়ত: ফাতেমাকে রা. মা বলা শিয়াদের আবিস্কার:
মূলত: রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর কন্যা ফাতেমা রা. কে ‘মা’ বলার প্রচলন শিয়াদের মাধ্যমেই এসেছে। শিয়া ইসনা আশারাদের ১১ তম ইমাম হাসান আল-আসকারীই এটা প্রথমত দাবি করেন। শিয়া শায়খ মুহাম্মাদ ফাযেল আল মাসউদী তার কিতাবে নকল করেন, শিয়া ইসনা আশারাদের ১১ তম ইমাম হাসান আল-আসকারী বলেছে,
نحن حجج الله على الخلائق، وأمنا فاطمة حجة الله علينا
আমরা সৃস্টিজগতের ওপর আল্লাহর দলিল। আর আমাদের মা ফাতিমা যিনি আমাদের ওপর আল্লাহর দলিল।
সূত্র: আল আসরারুল ফাতিমিয়্যাহ : পৃ. ১৭
সুতরাং হযরত ফাতিমা রা. কে ‘মা’না বলে সম্বোধন করা মানেই শিয়া মতবাদকে সমর্থন করা, যা পরিত্যাজ্য।
হযরত ফাতিমার রা. শান-মান:
হযরত ফাতিমা রা. এর সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাঃ যা বলেছেন, ততোটুক যথেষ্ট। নিজেদের থেকে বানিয়ে তাঁকে সম্মানিত করার কোনো অর্থ নেই। ফাতেমা রা. এর মর্যাদা সম্পর্কে নিন্মে কয়েকটি হাদিস বর্ণনা করছি।
এক. হযরত মিসওয়ার ইবনু মাখরামাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
وَإِنَّ فَاطِمَةَ بَضْعَةٌ مِنِّي، وَإِنِّي أَكْرَهُ أَنْ يَسُوءَهَا
আর ফাতিমাহ আমার টুকরা; তাঁর কোন কষ্ট হোক তা আমি কখনও পছন্দ করি না। -সহীহুল বুখারী, হাদিস : ৩৭২৯
দুই. হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَقْبَلَتْ فَاطِمَةُ تَمْشِي، كَأَنَّ مِشْيَتَهَا مَشْىُ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ” مَرْحَبًا بِابْنَتِي ”. ثُمَّ أَجْلَسَهَا عَنْ يَمِينِهِ أَوْ عَنْ شِمَالِهِ، ثُمَّ أَسَرَّ إِلَيْهَا حَدِيثًا، فَبَكَتْ فَقُلْتُ لَهَا لِمَ تَبْكِينَ ثُمَّ أَسَرَّ إِلَيْهَا حَدِيثًا فَضَحِكَتْ فَقُلْتُ مَا رَأَيْتُ كَالْيَوْمِ فَرَحًا أَقْرَبَ مِنْ حُزْنٍ، فَسَأَلْتُهَا عَمَّا قَالَ. فَقَالَتْ مَا كُنْتُ لأُفْشِيَ سِرَّ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حَتَّى قُبِضَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَسَأَلْتُهَا فَقَالَتْ أَسَرَّ إِلَىَّ ” إِنَّ جِبْرِيلَ كَانَ يُعَارِضُنِي الْقُرْآنَ كُلَّ سَنَةٍ مَرَّةً، وَإِنَّهُ عَارَضَنِي الْعَامَ مَرَّتَيْنِ، وَلاَ أُرَاهُ إِلاَّ حَضَرَ أَجَلِي، وَإِنَّكِ أَوَّلُ أَهْلِ بَيْتِي لَحَاقًا بِي ”. فَبَكَيْتُ فَقَالَ ” أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ تَكُونِي سَيِّدَةَ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ ـ أَوْ نِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ ”. فَضَحِكْتُ لِذَلِكَ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চলার ভঙ্গিতে চলতে চলতে ফাতিমা (রাঃ) আমাদের নিকট আগমন করলেন। তাঁকে দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার স্নেহের কন্যাকে অনেক অনেক মোবারকবাদ। তারপর তাঁকে তাঁর ডানপাশে অথবা বামপাশে (রাবির সন্দেহ) বসালেন এবং তাঁর সাথে চুপিচুপি (কি যেন) কথা বললেন। তখন তিনি (ফাতিমা) (রাঃ) কেঁদে দিলেন। আমি [আয়িশা (রাঃ)] তাকে বললাম কাঁদছেন কেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, পুনরায় চুপিচুপি তাঁর সাথে কথা বললেন। তিনি [ফাতিমা (রাঃ)] এবার হেঁসে উঠলেন। আমি [আয়িশা (রাঃ)] বললাম, আজকের মত দুঃখ ও বেদনার সাথে সাথে আনন্দ ও খুশী আমি আর কখনো দেখিনি। আমি তাঁকে [ফাতিমা (রাঃ)] কে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি [নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কি বলেছিলেন?
তিনি উত্তর দিলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গোপন কথাকে প্রকাশ করবো না। পরিশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকাল হয়ে যাওয়ার পর আমি তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি কি বলেছিলেন? তিনি বললেন, তিনি [নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] প্রথমবার আমাকে বলেছিলেন, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) প্রতিবছর একবার আমার সঙ্গে পরস্পর কোরআন পাঠ করতেন, এ বছর দু’বার এরূপ পড়ে শুনিয়েছেন। আমার মনে হয় আমার বিদায় কাল ঘনিয়ে এসেছে এবং এরপর আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে। তা শুনে আমি কেঁদে দিলাম। দ্বিতীয়বার বলেছিলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, জান্নাতবাসী মহিলাদের অথবা মু’মিন মহিলাদের তুমি সরদার (নেত্রী) হবে। এ কথা শুনে আমি হেসেছিলাম। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ৩৩৬৪
তিন. হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
فاطمةُ سيِّدةُ نساءِ أهلِ الجنَّةِ، إلا مريمَ بنتَ عمرانَ.
মারইয়াম বিনতে ইমরান ব্যাতিত ফাতিমা জান্নাতের রমনীদের সার্দারনী। -জামে সগীর, হাদিস : ৫৮১৭
সুতরাং বুঝা গেলো, হযরত ফাতিমা রা. এর শান-মান অনেক উর্ধ্বে। তিনি নবিজি সাঃ-এর সবচে প্রিয় কন্যা। সকল মুমিনরা নারীদের সর্দারনী এবং জান্নাতী রমনীদেরও সর্দারনী। সুতরাং তাঁকে অধিক মর্যাদা দিতে শিয়াদের আবিস্কৃত কোনো বিষয়কে কোনো সুন্নী মুসলমান মেনে নিতে পারে না।