আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো শরিক নেই, হতে পারে না, হবেও না। তিনি অমুখাপেক্ষী, তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই। তিনি তাঁর সত্তায় এবং সিফাতে তথা সকল গুনাবলীতে এক ও অদ্বিতীয়।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদ আল্লাহ-র সাথে অশংশিদারিত্ব স্থাপন করেছে সুস্পষ্টভাবে। তাও আবার রবের জাত তথা সত্তার সাথে! চলুন আগে তাদের কিছু বক্তব্য দেখে নেওয়া যাক-
আল্লাহ সৃষ্টি কোরলেন আদমকে (আঃ)। যেহেতু এর দেহের ভেতর তিনি তাঁর নিজের আত্মা স্থাপন কোরবেন, সেই সম্মানে আদমের দেহ তিনি তৈরি কোরলেন ‘কুন’ আদেশ দিয়ে নয়, তাঁর নিজের হাতে (কোরান- সুরা সা’দ, আয়াত ৭৫)। তারপর তার দেহের মধ্যে আল্লাহ তাঁর নিজের আত্মা থেকে ফুঁকে (প্রবেশ কোরিয়ে) দিলেন (কোরান-সুরা হেজর, আয়াত ২৯। -দাজ্জাল : পৃ. ১০
মানুষ জন্তু-জানোয়ারের মত কেবল দেহসর্বস্ব, ভোগসর্বস্ব প্রাণী নয়। তার ভিতরে আছে আল্লাহর রূহ, আল্লাহর আত্মা, এজন্য মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। -আসুন সিস্টেমটাকেই পাল্টাই : পৃ. ৯
মানুষের ভেতর স্রষ্টার রূহ অর্থাৎ পরমাত্মার অংশ রয়েছে। -আক্রান্ত দেশ ও ইসলাম : পৃ. ১৯
তিনি (আল্লাহ) নিজ হাত দিয়ে আদমকে বানালেন এবং তাঁর ভিতর নিজের রুহ প্রবেশ করিয়ে দিলেন, মানুষ আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হলো। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৬৭
আল্লাহ তার নিজের আত্মা, যেটাকে তিনি বলছেন- আমার আত্মা, সেটা থেকে আদমের মধ্যে ফুঁকে দেওয়া অর্থ আল্লাহর কাদেরিয়াত অর্থাৎ যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসহ আল্লাহর সমস্ত সিফত, গুণ, চরিত্র আদমের মধ্যে চলে আসা। আল্লাহর রুহ আদমের অর্থাৎ মানুষের ভেতরে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে অন্যান্য সমস্ত সৃষ্ট জিনিসের চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে উঠে গেল। -হেদায়া এবং তাকওয়া : পৃ. ১
অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, মহান আল্লাহর স্বীয় ‘রুহ’ তিনি মানুষের মাঝে ফুঁকে দিয়েছেন। ফলে মানুষ তার নিজের ভেতর আল্লাহর জাত বা সত্তা ধারণকারী। নাউযুবিল্লাহ।
খ্রিষ্টান মতবাদ ও হেযবুত তওহীদের মতবাদ অভিন্ন:
সমস্ত নবি-রাসূল একমত যে, রূহ আল্লাহ-র সৃষ্টি, আল্লাহ-র দ্বারাই প্রতিপালিত ও তাঁরই হুকুমে পরিচালিত। মহান রব বলেন,
وَیَسۡـَٔلُونَكَ عَنِ ٱلرُّوحِۖ قُلِ ٱلرُّوحُ مِنۡ أَمۡرِ رَبِّی وَمَاۤ أُوتِیتُم مِّنَ ٱلۡعِلۡمِ إِلَّا قَلِیلࣰا
(হে নবি,) তারা তোমাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, রূহ আমার প্রতিপালকের হুকুমঘটিত। তোমাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে সামান্যমাত্র। -সুরা ইসরা : ৮৫
সুতরাং বুঝা গেলো, ‘রুহ’ এটা আল্লাহপাকের হুকুমে পরিচালিত একটি সৃষ্ট বিষয়। এটা দীনের অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞাতব্য বিষয়, যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। সকল সাহাবা, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের যুগে এ ব্যাপারে কোনও মতানৈক্য ছিলো না, আর এ তিনটি যুগ ছিলো সর্বোত্তম যুগ। এরপর পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত খ্রিষ্টানরা দাবি করলো যে, ‘রূহ’ আল্লাহর সৃষ্টি নয়; বরং তারা মনে করে থাকে ‘ঈসা আ.-এর মধ্যে আল্লাহর রুহের অংশ আছে।’ আর এই কারণেই তারা ঈসা আ. কে আল্লাহর সন্তান বলে দাবি করে থাকে। নাউযুবিল্লাহ। এব্যাপারে বিশিষ্ট ইমাম হযরত মুহাম্মদ বিন নছর আল মারওয়াযী রহি. বলেন,
تأوَّل صنف من الزناديقة وصنف من الروافض في روح آدم ما تأولته النصارى في روح عيسى وما تأوله قوم من أن الروح إنفصل من ذات الله فصار فى المؤمن
যিন্দিক ও রাফেযীদের এক দল আদম আ. এর রূহের ব্যাপারে এমন ব্যাখ্যা করে, খ্রিষ্টানরা ঈসা আ. এর রূহের ব্যাপারে যেমন ব্যাখ্যা করেছে। এ ধরণের ব্যাখ্যা আরো এক দল করে যে, ‘রূহ’ আল্লাহ তাআলার জাত থেকে পৃথক হয়ে মুমিনদের মাঝে প্রবেশ করেছে। -আর রূহ ফিল কালাম আলা আরওয়াহীল আমওয়াত : পৃ. ১৬৩
ইমাম মুহাম্মদ বিন নছর আল মারওয়াযী রহি.-এর এ বক্তব্য দ্বারা একথা প্রমাণিত যে, আল্লাহ তাআলার ‘আত্মা’ আদম আ. এর মাঝে প্রবেশ করার এ আকীদা বস্তুত খ্রিষ্টান, মুরতাদ ও রাফেযীদের আকীদা। এমনকি ইবনে কাসীর রহি. বলেন,
أي من خلقه ومِنْ عنده وليست (مِنْ) للتبعيض كما تقوله النصارى عليهم لعائن الله المتتابعة بل هي لابتداء الغاية
আল্লাহ-র ‘রুহ’ থেকে’ মানে হলো, তার সৃষ্টি থেকে বা তাঁর পক্ষ থেকে। আল্লাহর অংশ থেকে নয়। যেমনটা মনে করে অভিশপ্ত খ্রিষ্টানরা। (অর্থাৎ তারা মনে করে ঈসা আ. আল্লাহর সত্ত্বার অংশ’।) সুতরাং এখানে من ‘থেকে’ শব্দটা ابتداء এর তথা ‘শুরু” অর্থ বুঝানোর জন্য ব্যবহ্নত হয়েছে, تبعيض তথা (আল্লাহ-র) ‘অংশ’ বুঝানোর জন্য নয়। -তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ৪ পৃ. ৩৮৯
সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম, এই আকীদাটা তথা ‘ঈসা আ.-এর ভেতর আল্লাহর রুহ তথা পরমাত্মার অংশ রয়েছে’ বলে ঈসা আ.-কে আল্লাহর অংশ বলে বিশ্বাস করে থাকে খ্রিষ্টানরা। কিন্তু হেযবুত তওহীদরা তো পুরো মানবজাতিকে আল্লাহ-র অংশ বলে দাবি করে বসলো। তাহলে এই আক্বীদার কারণে হেযবুত তওহীদ কী খ্রিষ্টানদের চেয়েও বড় কাফের-মুশরিক নয়? এমন কুফরি ধারণা বা বিশ্বাস মুসলমানদের অন্তরে প্রবেশ করিয়ে মুসলিমদের মুশরিক বানানোর মিশন হাতে নিয়ে হেযবুত তওহীদ কী মাঠে নামেনি?
আল্লাহ’র রুহ মানে কী?
তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে, আল্লাহ তো নিজেই বলেছেন, তাঁর ‘রুহ’ তিনি বান্দার মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন। এর অর্থ কী? চলুন এ সম্পর্কিত আগে আয়াতটি দেখা যাক। মহান আল্লাহ বলেন,
ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِن رُّوحِهِ
তারপর তাকে ঠিকঠাক করতঃ তার ভেতর নিজ রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। -সুরা সাজদাহ : ৯
উক্ত আয়াতসহ অন্য যেসকল আয়াতে আদম আ. ও মানুষের ভেতর আল্লাহ-র ‘রুহ’ ফুঁকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে আল্লাহ তাঁর ‘রুহ’ তাঁর বান্দার মাঝে ফুঁকে দিয়েছেন এর অর্থ এমনটা নয় যে, আল্লাহ তাঁর সত্ত্বাগত রুহের অংশ বান্দার মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন, বরং আল্লাহর রুহ মানুষের মাঝে ফুঁকে দেওয়ার প্রকৃত অর্থ হলো, মানবজাতির গুরুত্ব ও সম্মানের আধিক্যতা বুঝানো। চলুন এ ব্যাপারে কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরা যাক। ইবনে আব্বাস রা. এর বক্তব্য:
أنَّ الرَّوْحَ خَلْقٌ مِن خَلْقِ اللَّهِ عَزَّ وجَلَّ صُوَرُهم عَلى صُوَرِ بَنِي آَدَمِ
‘রুহ’ আল্লাহর সৃষ্টি থেকে একটি সৃষ্টি। যা আল্লাহ তাআলা আদম সন্তানের আকারে গঠন করেছেন। -তাফসীরে জাওযী, খ. ৫ পৃ. ৬০
ইমাম রাযী রহি. বলেন,
وإنَّما أضافَ اللَّهُ سُبْحانَهُ رُوحَ آدَمَ إلى نَفْسِهِ تَشْرِيفًا لَهُ وتَكْرِيمًا
‘আদমের রুহ’কে আল্লাহ তাঁর নিজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, হয়েছে আদমের সম্মানার্থে। -তাফসীরে রাযী : খ. ১৯ পৃ. ১৮৬
ইমাম কুরতুবী রহি. বলেন,
فَالرُّوحُ خَلْقٌ مِنْ خَلْقِهِ أَضَافَهُ إِلَى نَفْسِهِ تَشْرِيفًا وَتَكْرِيمًا كَقَوْلِهِ أَرْضِي وَسَمَائِي وَبَيْتِي وَنَاقَةُ اللَّهِ وَشَهْرُ اللَّهِ وَمِثْلُهُ
‘রুহ’ হলো আল্লাহর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। মানুষের রুহকে আল্লাহ তাঁর নিজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, হয়েছে মানুষের সম্মানার্থে। যেমন- অন্যত্রে আল্লাহর বলা ‘আমার যমীন, আমার আসমান, আমার ঘর এবং আল্লাহর উটনী, আল্লাহর মাস ইত্যাদী। -তাফসীরে কুরতুবী : খ. ৯ পৃ. ১৭
বিষয়টি বুঝতে নিন্মোক্ত দুটি আয়াতের দিকে খেয়াল করুন। আল্লাহ পাক বলেন,
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَن لَّا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
এবং সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহীমকে সেই ঘর (অর্থাৎ কাবাগৃহ)-এর স্থান জানিয়ে দিয়েছিলাম। (এবং তাকে হুকুম দিয়েছিলাম) আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার ঘরকে সেই সকল লোকের জন্য পবিত্র রেখ, যারা (এখানে) তাওয়াফ করে, ইবাদতের জন্য দাঁড়ায় এবং রুকূ-সিজদা আদায় করে। -সুরা হাজ্ব : ২৬
উক্ত আয়াতে কাবা শরীফকে আল্লাহ পাক নিজের ঘর বলেছেন। এর অর্থ কী সেখানে আল্লাহ বসবাস করেন? নাউযুবিল্লাহ। নিশ্চয় না। কিন্তু ঘরটিকে আল্লাহ তাআলা নিজের ঘর বলে আখ্যায়িত করেছেন কাবা শরীফের সম্মানার্থে। উপরন্তু সামুদ জাতিকে আল্লাহ সেই আলোচিত উটনীর ব্যাপারে বলেছিলেন,
هَـذِهِ نَاقَةُ اللّهِ لَكُمْ آيَةً
এটা আল্লাহর উটনী, যা তোমাদের জন্য একটি নিদর্শনস্বরূপ। -সুরা আ’রাফ : ৭৩
উক্ত আয়াতে উট ও কাবাকে আল্লাহ তাআলা রুপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। আল্লাম মাহমুদ বাগদাদী আলুসী রহ. বলেন,
أضافَ الرُّوحَ إلَيْهِ تَعالى تَشْرِيفًا لَهُ كَما فِي بَيْتِ اللَّهِ تَعالى وناقَةِ اللَّهِ تَعالى
রুহকে আল্লাহ নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন মানুষের সম্মানার্থে। যেমন কাবাকে বাইতুল্লাহ এবং (সালেহ আ. এর উটকে) আল্লাহ তাআলার উট বলা। -তাফসীরে রুহুল মা’আনী, খ. ৮ পৃ. ১২১
এমনিভাবে নবী হযরত ঈসা আ. কে ‘রুহুল্লাহ’ বলা হয়। এগুলো সব কিছুই রুপক অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে, নির্দিষ্ট বিষয়কে সম্মান প্রদান করার জন্য। ইমাম বুখারি রহি. এর উস্তাদ নাঈম ইবনে হাম্মাদ রহি.বলেন ,
من شبه الله بخلقه كفر ومن حجد ما وصف الله به نفسه أو وصف به رسوله كفر وليس فيما وصف الله به نفسه أو وصف به رسوله تشبيه ولا تمثيل
যে ব্যক্তি আল্লাহকে মাখলুকের সঙ্গে তুলনা করল, সে কাফের হয়ে গেল। আর যে ব্যক্তি এমন কোনো বিশেষণ অস্বীকার করল, যা আল্লাহ তাআলা নিজের ওপর প্রয়োগ করেছেন, অথবা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ওপর প্রয়োগ করেছেন, সেও কাফের হয়ে গেলো। আর আল্লাহ তাঁর নিজের ওপর যে বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন অথবা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ওপর যে বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন, তাতে কোনো তাশবিহ তথা সাদৃশ্যকরণ, তামছীল তথা উপমানির্ধারণ নেই। -সিয়ারু আলামিন নুবালা, খ. ২০ পৃ. ৮৮
যুক্তির আলোকে দলীল:
আল্লাহ-র ‘রুহ’ মানে যদি আল্লাহ-র অংশগত রুহ হয়, তাহলে কয়েকটি প্রশ্ন এসে যায়-
এক. মানুষের রুহ যদি আল্লাহর রুহের অংশ হয়, তাহলে হযরত আজরাঈল আ. যে মানুষের রুহ কবজ করেন, তাহলে এ কথা কী বলতে হবে না যে, আজরাঈল আ. আল্লাহর রুহ কবজ করবেন? নাউযুবিল্লাহ। এটা কী কোনো বুদ্ধিমানের আক্বীদা হতে পারে? নিশ্চয় নয়।
দুই. আল্লাহ-র রুহের অংশ যদি মানুষের মধ্যে থেকে থাকে, তবে মানুষের রুহ কবজ করা মানেই কী আল্লাহর রুহেরও কিছু অংশ কবজ করা নয়?
তিন. হাদিস শরীফে অসংখ্য জায়গায় ঈসা আ. কে সরাসরি আল্লাহর রুহ বলা হয়েছে। এখন আল্লাহর রুহ বান্দার মধ্যে ফুঁকে দেওয়া হয়েছে, এটার অর্থ যদি হয়, আল্লাহর সত্ত্বাগত রুহের অংশ মানুষের মাঝে দেওয়া হয়েছে, তাহলে তো ঈসা আ. কে আল্লাহর রুহ বলার কারণে ঈসা আ. কে ‘আংশিক আল্লাহ’ বলে মেনে নিতে হবে। নাউযুবিল্লাহ।
সুতরাং বুঝা গেলো, হেযবুত তওহীদের এ আক্বীদা একটি কুফরী ও শিরকি আক্বীদা এবং খ্রিষ্টানদের আক্বীদা। যা কোনো মুসলিমের আক্বীদা হতে পারে না। সুতরাং চলুন সবাই এ কুফরী আক্বীদা থেকে নিজেকে বাঁচাই অন্যকেও বাঁচাতে সাহায্য করি।