সম্প্রতি সময়ে গায়েবানা জানাযার নামাজকে বৈধ মনে করা হচ্ছে। অথচ অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাজা বা গায়েবানা জানাযা বলতে কোন শব্দ কুরআন, হাদীসের কোথাও নেই। এর কোন প্রমাণ না কুরআনে আছে, না হাদীসে আছে। রাসুলুল্লাহ সাঃ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীগণ, তাবে তাবেয়ীগণ থেকে এ শব্দের কোন জানাযার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েজ নেই। উপরন্তু রাসূল সাঃ ও খুলাফায়ে রাশেদীন কোন দিন কারো গায়েবানা জানাযা আদায় করেন নি। তবে হাবশার বাদশা নাজ্জাশী ও মুয়াবিয়া ইবনে মুয়াবিয়া রা.-এর জানাযা নিয়ে কেউ কেউ দলীল দিচ্ছেন। চলুন তাদের দলীলগুলো নিয়ে আগে আলোচনা করা যাক।
নাজ্জাশীর জানাযা ও ভুল বুঝাবুঝি:
সহিহ বুখারীতে হাবশার বাদশা নাজ্জাশীর জানাযা নিয়ে এক শ্রেণির মানুষ বৈধতা প্রমাণ করতে চাচ্ছে। চলুন আগে হাদিসটি দেখা যাক। হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم نَعَى النَّجَاشِيَّ فِي الْيَوْمِ الَّذِي مَاتَ فِيهِ خَرَجَ إِلَى الْمُصَلَّى فَصَفَّ بِهِمْ وَكَبَّرَ أَرْبَعًا
নাজাশী যেদিন মারা যান সেদিন-ই আল্লাহর রাসুল সাঃ তাঁর মৃত্যুর খবর দেন এবং জানাযার স্থানে গিয়ে লোকদের কাতারবন্দী করে চার তাকবীর আদায় করলেন। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ১২৪৫]
এই হাদিসকে পেশ করে তারা গায়েবানা জানাযাকে বৈধতা দিতে চান। অথচ এটা গায়েবানা জানাযা ছিলো না। কারণ তখন নাজ্জাশীল লাশ অলৌকিকভাবে নবিজি সাঃ-এর সামনে উপস্থিত করা হয়েছিলো। এ ব্যাপারে কয়েকটি কথা আলোচনা করা হলো।
নাজ্জাশী বাদশার জানাযা:
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
نَعَى النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِلَى أَصْحَابِهِ النَّجَاشِيَّ، ثُمَّ تَقَدَّمَ فَصَفُّوا خَلْفَهُ فَكَبَّرَ أَرْبَعًا
নবী সাঃ তাঁর সাহাবীগণকে নাজাশীর মৃত্যু সংবাদ শোনালেন, পরে তিনি সামনে অগ্রসর হলেন এবং সাহাবীগণ তাঁর পিছনে কাতারবদ্ধ হলে তিনি চার তাকবীরে জানাযার নামাজ আদায় করলেন। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ১২৩৯]
এক. নাজাশীর লাশ কী গায়েব ছিলো?
ইমাম বুখারী রহি. নাজ্জাশি যে হাদিসটি আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, সে একই বিষয়ক হাদিস আরো দু’জন প্রশিদ্ধ সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। ১. হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা. ও জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা.। চলুন দেখা হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা. থেকে হাদিসে কী বর্ণিত আছে দেখা যাক।
নাজ্জাসীর জানাযার ঘটনাটি সহিহ ইবনে হ্বি¦ানে এভাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা. বলেন,
أن النبي صلى الله عليه وسلم قال إن أخاكم النجاشي توفى فقوموا صلو عليه فقام رسول الله صلى الله عليه وسلم وصفوا خلفه فكبر أربعا وهم لا يظنون إلا أن جنازته بين يديه
ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাই নাজ্জাশী ইন্তিকাল করেছেন। চলো তার জানাযার নামাজ পড়ি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে বাইরে এলেন। সাহাবায়ে কেরাম তার পেছনে কাতারবন্দি হলেন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার তাকবীরের সহিত নামাজ পড়ালেন। সাহাবায়ে কেরামের ধারণা নাজ্জাশীর জানাযা নবী করিম রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে রাখা ছিলো। [সহীহ ইবনে হিব্বান : হাদীস নং : ৩১০২]
হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা. বলেন,
وما نَحسبُ الجِنازةَ إلّا مَوضوعةً بيْنَ يدَيه
তথা আমরা জানাযার ব্যাপারে এটাই অনুধাবন করছিলাম যে, তা আমাদের সামনে রাখা আছে। [মুসনাদে আহমাদ : হাদীস নং : ২০০০৫}
তিনি আরো বলেন, যখন নবিজি সাঃ-এর পেছনে জানাযা পড়েছি,
نحن لا نرى إلا الجنازة قدامنا
আমরা দেখছিলাম যে, আমাদের সামনে জানাযা রাখা। [আউনুল মা’বুদ : খ. ৯ পৃ. ১০৯]
কোন কোন হাদীসে পাওয়া যায়,
أنه قد سويت له أعلام الأرض حتى كان يبصر مكانه
রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর জন্য ভূ-পৃষ্ঠের উপরিস্থিত সবকিছু সমতল করে দেয়া হলো এবং তিনি নাজ্জাশীর অবস্থান দেখতে পেয়েছিলেন। [মাআলিমুস সুনান : খ. ১ পৃ. ৩১১]
বুঝা গেলো, নাজ্জাশীর জানাযা গায়েব ছিলো না, বরং মু’জিজার মাধ্যমে তা রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর সামনে উপস্থিত করা ছিলো। এজন্য ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহি. বলেন,
لأنه رفع سريره أي النجاشي حتى رآه عليه الصلاة والسلام بحضرته فتكون صلاة من خلفه على ميت يراه الإمام وبحضرته دون المأمومين وغير مانع من الإقتداء
কারণ, নাজ্জাশীর কফিন রাসূলের সাঃ উত্তোলন করা হয়েছিল এমনভাবে যে , তিনি তাকে তাঁর সামনেই দেখতে পেয়েছিলেন। সুতরাং যারা তাঁর পেছনে ছিলেন তাদের নামায এমন মৃত ব্যক্তির জন্য ছিলো যাকে ইমাম তাঁর সামনে দেখতে পাচ্ছেন, মুক্তাদীরা দেখতে পাচ্ছে না। এটা ইমামের অনুসরণের পথে কোন বাধা নয়। [রদ্দুল মুহতার : খ. ৩ পৃ. ১০৫]
ইমাম আব্দুল বার রহি. বলেন,
احضر روح النجاشي بين يديه حيث شاهدها وصلي عليها او رفعت له جنازته كما كشف له عن بيت المقدس حين سألته قريش عن صفته
নাজ্জাশীর রুহ রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর সামনে উপস্থিত করা হয়েছিলো। অথবা কাফেররা বাইতুল মুকাদ্দাসের গুনাবলী জানতে চাইলে যেভাবে তাঁর সামনে বাইতুল মুকাদ্দাসের পর্দা উঠিয়ে দেখানো হয়েছিলো, ঠিক তেমনিভাবে নাজ্জাশীর লাশও নবিজি সাঃ-এর সামনে উম্মুক্ত করা হয়েছিলো। [আত তামহীদ : খ. ৬. পৃ. ৩২৮]
দুই. তিনজন বর্ণনাকারী সাহাবীও কী গায়েবানা জানাযা পড়েছেন?
উপরন্তু নাজ্জাশীর জানাযার ঘটনা তিনজন প্রশিদ্ধ সাহাবী বর্ণনা করেছেন-
১. হযরত আবু হুরায়রা রা.।
২. হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা.।
৩. হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা.।
প্রথমত জেনে রাখা দরকার। বাদশা নাজাশী ইন্তেকাল করেছেন নবম হিজরীর রজব মাসে। [হাশিয়ায়ে মুয়াত্তা মালিক : পৃ. ২০৮]
আর হযরত আবু হুরায়রা রা. ইন্তেকাল করেছেন ৫৯ হিজরীতে। অর্থাৎ উক্ত ঘটনার পর হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ প্রায় ৫০ বছর জীবিত ছিলেন।
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. ইন্তেকাল করেছেন ৭৯ হিজরীতে। সেই হিসেবে তিনি উক্ত ঘটনার পর ৭০ বছর জীবিত ছিলেন।
আর হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা. উক্ত ঘটনার পর জীবিত ছিলেন প্রায় ৪৩ বছর।
কিন্তু হযরত আবু হুরায়রা রাঃ-এর ৫০ বছরের মাঝে, হযরত জাবের রা.-এর পুরো ৭০ বছরের মাঝে এবং হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা. তাঁর জীবনের এই ৪৩ বছরের মাঝে কোনদিন কারো গায়েবানা জানাযা পড়েছেন, কিংবা গায়েবানা জানাযা পড়তে বলেছেন কেউ প্রমাণ দেখাতে পারবে? এত দীর্ঘ বেঁচে থাকার পরও উক্ত ঘটনা থেকে এসকল সাহাবাগণ যদি গায়েবানা জানাযা জায়েজের প্রমাণই বুঝে থাকতেন, তাহলে তাদের জমানায় ইন্তেকাল হওয়া অসংখ্য সাহাবীদের গায়েবানা জানাযা তাদের পড়ার কথা। কিন্তু একজনের গায়েবানা জানাযা পড়ানোর কোন প্রমাণ না কোন হাদীস গ্রন্থে আছে না কোন ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়। যা পরিস্কার প্রমাণ করছে যে, উক্ত ঘটনা দ্বারা কোন সাহাবী গায়েবানা জানাযা জায়েজ বোঝেন নি, বরং বিষয় ছিল ভিন্ন। ইমাম খাত্তাবী রহি. বলেন,
النجاشي رجل مسلم قد آمن برسول الله صلى الله عليه وسلم وصدقه على نبوته إلا أنه كان يكتم إيمانه، والمسلم إذا مات يجب على المسلمين أن يصلوا عليه، إلا أنه كان بين ظهراني أهل الكفر، ولم يكن بحضرته من يقوم بحقه في الصلاة عليه، فلزم رسول الله صلى الله عليه وسلم أن يفعل ذلك إذ هو نبيه ووليه وأحق الناس به،
নাজ্জাশী ছিলেন একজন মুসলিম ব্যক্তি। যিনি রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর ওপর ঈমান আনেন এবং তাঁর নবুওয়াতের সত্যায়ণ করেন। কিন্তু তিনি তাঁর ঈমানকে গোপন রেখেছিলেন। আর মুসলিম ব্যক্তি মারা গেলে তাঁর জানাযা পড়া মুসলিমদের ওপর আবশ্যক। কিন্তু নাজ্জাশী কুফফারদের মাঝে ইন্তেকাল করেন, এমতাবস্থায় তাঁর জানাযা পড়ার জন্য কোনো মুসলমান উপস্থিত ছিলেন না। ফলে নবিজি সাঃ-এর জন্য এ কাজটি করা আবশ্যক ছিলো। কারণ তিনি ছিলেন নাজ্জাশীর নবি ও অভিভাবক এবং মানুষের মধ্যে সবচে বেশি হকদার। [মাআলিমুস সুনান : খ. ১ পৃ. ৩১০]
সুতরাং বুঝা গেলো, নাজ্জাশী বাদশার জানাযা নবিজি সাঃ পড়েছিলেন বিষেশ এক কারণে, পাশাপাশি নবিজি সাঃ-এর সামনে অলৌকিকভাবে তাঁর লাশ উপস্থিত ছিলো। সুতরাং নাজ্জাশী বাদশার ঘটনা দিয়ে গায়েবানা জানাযা বৈধ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
মুয়াবিয়া আল মুযানি রা. এর ঘটনা:
এ ছাড়াও তারা হযরত মুয়াবিয়া ইবনে মুয়াবিয়া আল-মুযানী রা. এর গায়েবানা জানাযার ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন
نَزَلَ جِبْرِيْلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ مَاتَ مُعَاوِيَةُ بْنُ مُعَاوِيَةَ الْـمُزَنِيُّ، أَتُحِبُّ أَنْ تُصَلِّيَ عَلَيْهِ؟ قَالَ: ، فَضَرَبَ بِجَنَاحَيْهِ فَلَمْ تَبْقَ شَجَرَةٌ، وَلَا أَكَمَةٌ إِلَّا تَضَعْضَعَتْ، وَرَفَعَ لَهُ سَرِيْرَهُ حَتَّىٰ نَظَرَ إِلَيْهِ، فَصَلَّىٰ عَلَيْهِ وَخَلْفَهُ صَفَّانِ مِنَ الْـمَلَائِكَةِ فِيْ كُلِّ صَفٍّ سَبْعُوْنَ أَلْفًا، فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم لِـجِبْرِيْلَ: يَا جِبْرِيْلُ! مَا بَلَّغَ هَذَا هَذِهِ الْـمَنْزِلَةَ مِنَ اللهِ؟ قَالَ: بِحُبِّهِ “قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ” وَقِرَاءَتِهِ إِيَّاهَا جَائِيًا وَذَاهِبًا وَقَائِمًا وَقَاعِدًا وَعَلَىٰ كُلِّ حَالٍ
একদিন জিবরাইল আলায়হিস্ সালাম রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহ তাআলার রাসুল! মুআবিয় ইবনে মুআবিয়া আল-মুযানী ইন্তেকাল করেছেন। আপনি তার নামাযে জানাযা পড়তে আগ্রহী? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অবশ্যই। তখন জিবরাইল আলায়হিস্ সালাম তার উভয় ডানা দ্বারা জমিনে আঘাত করলেন। ফলে জমিনের সকল গাছ-পালা টিলা-টুম্বর সমান হয়ে গেল। অতঃপর মুআবিয়ার লাশ সামনে আনা হলো। যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখতে পেলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাযার নামায পড়ালেন। পেছনে দু’কাতার ফেরেশতা দাঁড়ালেন। প্রতি কাতারে সত্তর হাজার করে ফেরেশতা ছিল। নামায শেষে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরাইল আলায়হিস্ সালামকে জিজ্ঞাসা করলেন। কোন আমলের বরকতে মুআবিয়া এই মর্যাদা লাভ করল। উত্তরে হযরত জিবরাইল আলায়হিস্ সালাম বললেন, মুআবিয়া সুরা ইখলাসকে খুবই মুহাব্বত করতেন এবং চলতে ফিরতে উঠতে বসতে সর্বাবস্থায় তিনি সুরা আল-ইখলাস তেলাওয়াত করতেন। [আল-মু’জামুল কবীর (তাবরানী) হাদিস নং : ১০৪০]
হাদিসটির মান:
উক্ত হাদিস বর্ণনা করার পর ইমাম যাহাবী রহি. বলেন,
فيه محبوب بن هلال مجهول
হাদিসটির মধ্যে মাহবুব ইবনে হালাল নামক রাবী অপরিচিত। [তারিখুল ইসলাম : খ. ২ পৃ. ৬৪০]
ইবনে কাসীর রহি. দুটি সনদে ঘটনাটি বর্ণনা করে দুটোর ব্যাপারেই বলেছেন, সনদটি মুনকার। [আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ : খ. ৫ পৃ. ১৬
উক্ত ঘটনাটি আবু উমামা বাহিলী রা. থেকে যে সনদে বর্ণিত, সেটা কামাল ইবনুল হুমাম রহি. বর্ণনি করে লেখেন,
فيه بقية بن الوليد وقد عنعنه
এ সনদে বাকিয়্যাহ ইবনে ওয়ালিদ আনআনা সূত্র বর্ণনা করেছেন। [শরহু ফাতহিল কাদীর : খ. ২ পৃ. ১২১]
আর বাকিয়্যাহ ইবনে ওয়ালিদ অপরিচিত কারো থেকে বা আনআনা দিয়ে বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। তার ব্যাপারে আহমাদ বিন হাম্বল রহি. নাসাঈ রহি. আবু হাতেম রাযী রহি. ইবনে হিব্বান রহি. সহ অসংখ্য হাদিস বিশারদ সতর্ক করেছেন।
[তাহযিবুল কামাল ফি আসমায়ির রিজাল : খ. পৃ. ৮৫; সিয়ারু আলামিন নুবালা : খ. ২ ৮ পৃ. ৫২১-৫২২]
সুতরাং মুয়াবিয়া বিন মুয়াবিয়া আল মুযানি রা. এর ঘটনার ব্যাপারে প্রথম কথা হলো অনেক মুহাদ্দিসের নিকট হাদীসটি মুনকার ও অগ্রহনযোগ্য। তদুপরি এই হাদীস দ্বারা গায়েবানা জানাযা প্রমাণিত হয় না। কেননা হাদীসের বর্ণনা দ্বারাই স্পষ্ট যে, সব পর্দা ও প্রতিবন্ধকতা উঠিয়ে দিয়ে তার লাশ রাসুল সাঃ-এর সামনে এনে দেয়া হয়েছিলো। সুতরাং এটা দিয়ে গায়েবানা জানাযার দলীলসম্মত নয়। এ ছাড়াও যতো হাদিস এ ব্যাপারে রয়েছে সবগুলোতে রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর সামনে অলৌকিকভাবে লাশ হাজির করার কথা রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি গায়েবানা জানাযা ইসলামে জায়েয হতো, তাহলে তাঁদের লাশ জিবরাঈল আ. এর মাধ্যমে নবিজি সাঃ-এর সামনে উপস্থিত কেন করা হতো? এতেই কী বুঝা যায় না যে, লাশ উপস্থিত না থাকলে জানাযা জায়েয নেই? এতুটুকু বুঝও কী আমাদের নেই? এজন্য ফিকহে হানাফীতে গায়েবানা জানাযা জায়েয নয়। চলুন মাযহাবগত মতপার্থক্য সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
হানাফী মাযহাব:
গায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা রহি. বলেন,
هذا خاص به وليس ذلك لغيره
এটা রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর জন্য খাছ, অন্যদের জন্য তা জায়েয নেই। [জামিউল ফিকহ : খ. ২ পৃ. ৪৪৯]
হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠতম ভাষ্যকার আল্লামা ইবনুল হুমাম (রহঃ) বলেন,
وَشَرْطُ صِحَّتِهَا إسْلَامُ الْمَيِّتِ وَطَهَارَتُهُ وَوَضْعُهُ أَمَام الْمُصَلِّي فَلِهَذَا الْقَيْدِ لَا تَجُوزُ عَلَى غَائِبٍ وَلَا حَاضِرٍ مَحْمُولٍ عَلَى دَابَّةٍ أَوْ غَيْرِهَا ، وَلَا مَوْضُوعٍ مُتَقَدِّمٍ عَلَيْهِ الْمُصَلِّي وَهُوَ كَالْإِمَامِ مِنْ وَجْهٍ
জানাযা সহিহ হওয়ার জন্য শর্ত হলো, মৃতকে মুসলমান হতে হবে। পবিত্র হতে হবে এবং লাশ মুসল্লিদের সামনে রাখতে হবে। কাজেই অনুপস্থিত লাশের ওপর গায়েবানা জানাযা জায়েয নয়। (ফাতহুল কাদীর : খ. ২ পৃ. ৮০ ;আল বাহরুর রায়েক : খ. ২. পৃ. ৩১৪; লুমআতুত তানকীহ ফী শরহে মিশকাতিল মাসাবিহ : খ. ৪ পৃ. ১২০; মিরকাতুল মাফাতিহ : খ. ৪ পৃ. ১৫২; আল হালবী আল কাবীর : খ. ২ পৃ. ৫০২
মালেকী মাযহাব:
মালেকী মাযহাবে গায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। এ প্রসংঙ্গে ইবনে হাজার আসকালানী রহি. বলেন,
قال ابن العربي المالكي قال المالكية ليس ذلك الا لمحمد
ইবনুল আরাবী মালেকী রহি. বলেন, মালেকীরা বলেন, গায়েবানা জানাযা মুহাম্মাদ সাঃ ছাড়া কারো জন্য শরীয়তসম্মত নয়। [ফাতহুল বারী : খ. ৩ পৃ. ২৩৫]
আল্লামা ইবনু আবদিল বার রহি. গায়েবানা জানাযা নাজায়েয হওয়ার উক্তিকে জমহুর ফুক্বাহা তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কেরামের মতামত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন,
واكثر اهل العلم يقولون ان هذا خصوص النبي صلي الله عليه وسلم وقد اجاز بعضهم الصلاة علي الغائب اذا بلغه الخبر بقرب موته
অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম বলেন, নাজ্জাশীর ঘটনাটি নবিজি সাঃ-এর জন্য নির্দিষ্ট ছিলো। কবে কিছু কিছু উলামায়ে কেরাম মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর নিকটবর্তী খবরে গায়েবানা জানাযার জায়েযের মত দিয়েছেন। [আত তামহীদ : খ. ৬ পৃ. ৩২৮]
শাফেয়ী মাযহাব:
ইমাম শাফেয়ী রহি. মাইয়্যিত ভিন্ন শহরে থাকলে গায়েবানা জানাযা জায়েযের পক্ষে হলেও
শাফেয়ী মযহাবের আলেম আবুল মাহাসিন রুয়ানী ও ইমাম খাত্তাবী রহি. এর অভিমত হলো,
لا يُصَلَّى عَلَى الْغَائِبِ إلا إذَا وَقَعَ مَوْتُهُ بِأَرْضٍ لَيْسَ فِيهَا مَنْ يُصَلِّي عَلَيْهِ وَاسْتَحْسَنَهُ الرُّويَانِيُّ من الشافعية
ফাতহুল বারী : খ. ৪ পৃ. ৮৭
হাম্বলী মাযহাব:
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহি. থেকে জায়েয হওয়ার একটি উক্তি থাকলেও স্বীয় শাগরিদ ইবনে আবী মুসা তাঁর থেকে নাজায়েয হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। বিষয়টি হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফিক্বাহবিদ আল্লামা ইবনে কুদামা রহি. এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,
وقال مالك وابو حنيفة لا يجوز وحكي ابن ابن موسي عن احمد رواية كقولهما
ইমাম মালেক রহি. ও ইমাম আবু হানীফা রহি. উভয়ে বলেন, গায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। ইমাম আহমদ রহি. থেকে ইবনে আবী মুসা উক্ত ইমামদ্বয়ের অনুরূপ (নাজায়েয হওয়ার) একটি উক্তি বর্ণনা করেছেন। [আলমুগনী : খ. ৩ পৃ. ৩১৫]
হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফিক্বাহবিদ আল্লামা ইমাম ইবনুল কায়্যীম জাওযী রহি. এ মর্মে বলেন:
ولم يكن من هديه وسنته الصلاة على كل ميت غائب، فقد مات خلق كثير من المسلمين من الصحابة وغيرهم، وهم غيب، فلم يصل عليهم
প্রত্যেক মৃত্যুর গায়েবানা জানাযা পড়াটা রাসূলের কর্মপন্থা ও নীতি ছিল না। সাহাবীসহ কত মুসলমান মৃত বরণ করেছেন দূরে বসে। কিন্তু তিনি তাদের কারো গায়েবানা জানাযা পড়েন নি। [জামিউল ফিকহ : খ. ২ পৃ. ৪৪৯]
ইবনে তাইমিয়াহ:
হাম্বলী মাযহাবের প্রশিদ্ধ ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহি. বলেন,
ﺍﻟﺼﻮﺍﺏ ﺃﻥ ﺍﻟﻐﺎﺋﺐ ﺇﺫﺍ ﻣﺎﺕ ﺑﺒﻠﺪ ﻟﻢ ﻳﺼﻞ ﻋﻠﻴﻪ ﻓﻴﻪ ﺻﻠﻲ ﻋﻠﻴﻪ ﺻﻼﺓ ﺍﻟﻐﺎﺋﺐ ﻛﻤﺎ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻨﺠﺎﺷﻲ؛ ﻷﻧﻪ ﻣﺎﺕ ﺑﻴﻦ ﺍﻟﻜﻔﺎﺭ ﻭﻟﻢ ﻳﺼﻞ ﻋﻠﻴﻪ، ﻭﺇﻥ ﺻﻠﻰ ﻋﻠﻴﻪ ﺣﻴﺚ ﻣﺎﺕ، ﻟﻢ ﻳﺼﻞ ﻋﻠﻴﻪ ﺻﻼﺓ ﺍﻟﻐﺎﺋﺐ؛ ﻷﻥ ﺍﻟﻔﺮﺽ ﻗﺪ ﺳﻘﻂ ﺑﺼﻼﺓ ﺍﻟﻤﺴﻠﻴﻤﻦ ﻋﻠﻴﻪ
সঠিক কথা হলো অনুপস্থিত ব্যক্তি যদি এমন জায়গায় মারা যায় যেখানে তার জানাযা হয় নি, তার উপর গায়েবানা জানাযা পড়া হবে। যেমন, রাসুলুল্লাহ সাঃ নাজ্জাশীর জানাযা পড়েছিলেন। কারণ তিনি কাফেরদের মাঝে থাকার কারণে তার জানাযা পড়া হয়নি। আর যদি কেউ এমন জায়গায় মারা যায়, যেখানে তার জানাযা হয়েছে, তার গায়েবানা জানাযা পড়া হবে না। কারণ ঐ জানাযার মাধ্যমে ফরজ আদায় হয়ে গেছে। [জামিউল ফিকহ : খ. ২ পৃ. ৪৪৯-৪৫০; যাদুল মা’আদ : খ. পৃ. ৩৯]
ইবনে উসাইমিন:
ইবনে উসািমিন রহি. বলেন,
إذا تأكدت أنه لم يصل عليهم فصل عليهم لأن الصلاة فرض كفاية لكن ربما أهله صلوا عليه لأن الصلاة على الميت تكون بواحد على كل حال
যদি আপনি নিশ্চিত হয়ে থাকেন যে, তার জানাযা হয় নি, তাহলে তার জানাযা পড়ুন। কারণ জানাযা ফরজে কিফায়াহ। তবে তার পরিবার যদি জানাযা পড়ে, (তাহলে দ্বিতীয়বার পড়া যাবে ন) কারণ সর্বাবস্থায় মৃতব্যক্তির জানাযা একবারই পড়ার নিয়ম। [মাজমুউ ফাতাওয়া আশ শায়খ ইবনে উসাইমিন : খ. ১৭ পৃ. ১৪৮]
ইমাম বুখারীর ইঙ্গিত:
ইমাম বুখারী রহি. ততাঁর সহিহ বুখারী শরীফে শিরোনাম স্থাপনের নীতিমালার ৬৫ নম্বরে উল্লেখ রয়েছে, কোন মাসআলা ইমাম বুখারী রহি. এর মতামতের পরিপন্থী হলে শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করেন না। এজন্য গায়েবানা জানাযার পক্ষে তাঁর অবস্থান না থাকায়, তিনি নাজ্জাশীর জানাযার বিষয়ের হাদিস উল্লেখ্য করলেও শিরোনাম হিশাবে ‘باب الصفوف على الجنازة’ তথা ‘জানাযাতে কাতারবন্দী হওয়া’ শিরোনাম নিয়েছেন ‘الصلاة علي الغائب’ তথ ‘গায়েবানা জানাযায় কাতারবন্দী হওয়া’ শিরোনাম দেন নি। এজন্য শায়েখ জাকারিয়া রহি. লিখেছেন,
هو الظاهر ان الامام البخاري اشار بلفظ الترجمة الرد علي من قال بالصلاة علي الغائب فان الامام البخاري مع تخريجه حديث الصلاة علي النجاشي بطرق لم يبوب بالصلاة علي الغائب …فالامام البخاري مال في هذه المسئلة الي قول الحنفية والمالكية
এটা সত্য যে, ইমাম বুখারী রহি. শিরোনাম দিয়ে গায়েবানা জানাযার প্রবর্তকদের খণ্ডন করেছেন। কারণ ইমাম বুখারী রহি. নাজ্জাশীর জানাযার হাদিস কয়েকভাবে আনলেও গায়েবানা জানাযার উপর শিরোনাম কায়েম করেন নি।… সুতরাং (বুঝা যায়) ইমাম বুখারী গায়েবানা জানাযার ব্যাপারে হানাফী ও মালেকী মাযহাবের দিকে আকৃষ্ট ছিলেন। [আল আবওয়াবু ওয়াত তারাজিম : খ. ২ পৃ. ১৯৬]
সুতরাং বুঝা গেল যে, ইমাম বুখারী রহি নিজেই উক্ত হাদীসকে গায়েবানা জানাযা জায়েজের দলীল মনে করেন নি।
একটি হাস্যকর দলীল!
তবে কেউ কেউ গায়েবানা জানাযাকে জায়েজ প্রমাণ করতে একটি হাস্যকর দলীল পেশ করে থাকেন। তারা বলে থাকেন, গায়েবানা জানাযা পড়া যে, জায়েজ এর পরিস্কার দলীল হলো, জানাযার নামাযে যে দু’আ পড়া হয়, তাতে বলা হয়, شاهدنا وغائبنا তথা উপস্থিত ও অনুপস্থিত উভয় ব্যক্তির জন্যই দু’আ করা হয়ে থাকে। আর জানাযা নামায যেহেতু দুআ। আ’র তাতে উপস্থিত ও অনুপস্থিত উভয় ব্যক্তির জন্যই মাগফিরাতের কথা এসেছে, তাই বুঝা যাচ্ছে অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযাও জায়েজ আছে। অর্থাৎ গায়েবানা জানাযা বৈধ।
জবাব:
আসলে এ দলীলটি খুবই হাস্যকর দলীল। যদি গায়িবিনা তথা অনুপস্থিত ব্যক্তির মাগফিরাতের কথা উল্লেখ থাকায় গায়েবানা জানাযা জায়েজ হয়ে যায়, তাহলেতো একই যুক্তিতেই জীবিত ব্যক্তির জানাযাও পড়া জায়েজ হয়ে যাবে। কারণ জানাযার নামাযের দু’আয় পড়া হয়, اللَّهُمَّ اغفرْ لحينا وميتِنا তথা হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জীবিত ও মৃতদের মাফ করে দাও। লক্ষ্য করুন, মাফ চাওয়া হয় প্রথমে জীবিতদের ব্যাপারে, তারপর বলা হয় و شاهدنا وغائبنا অর্থাৎ উপস্থিত অনুপস্থিত সবাইকে মাফ করেন’
যদি ‘وغائبنا’ শব্দ থাকায় অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযা পড়া জায়েজ হয়ে যায়, তাহলে “হাইয়্যিানা” শব্দ থাকায় জীবিত ব্যক্তির জানাযা কেন জায়েজ হবে না? আসলে এ দলীলটি খুবই হাস্যকর ও বোকামীসূলভ।
জানাযার জন্য লাশ উপস্থিত জরুরি:
জানাযা নামায সহীহ হওয়ার জন্য লাশ সামনে উপস্থিত থাকা আবশ্যক। অনুপস্থিত লাশের গায়েবানা জানাযা নামায আদায়ের বিধান নেই। রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর জীবদ্দশায় অসংখ্য সাহাবী মদীনার বাইরে দূর-দূরান্তে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাঃ থেকে তাদের গায়েবানা জানাযা পড়ার কোনো ঘটনা বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নেই। অথচ রাসুলুল্লাহ সাঃ সাহাবায়ে কেরামের জানাযা নামায পড়ার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন। এজন্য তিনি বলে দিয়েছিলেন যে-
مَا مَاتَ مِنْكُمْ مَيِّتٌ مَا كُنْتُ بَيْنَ أَظْهُرِكُمْ إِلّا آذَنْتُمُونِي بِهِ فَإِنّ صَلَاتِي عَلَيْه رَحْمَةٌ.
তোমাদের কেউ মারা গেলে আমাকে জানাবে। কেননা আমার জানাযা নামায মৃতের জন্য রহমত। [সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩০৮৭]
এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, লাশ ছাড়া জানাযা তথা গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েয নয়।
রাজনৈতিক জানাযা:
কিছু কিছু ভাই, গায়েবানা জানাযার বৈধতার দলিল দিতে গিয়ে এটাকে রাজনৈতিক জানাযা বলে অভিহিত করছেন। অর্থাৎ তারা বুঝাতে চান, সরকার কর্তৃক এ সকল মানুষের জানাযা পড়তে বাধা প্রদান করা হচ্ছে বলে গায়েবানা জানাযা পড়া হচ্ছে। অথচ রাসুলুল্লাহ সাঃ কাফেরদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনে কোনো রাজনৈতিক জানাযা পড়েন নি। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর আমলে কতো ক্বারী সাহাবীকে মুসাইলামায়ে কাজ্জাব শহীদ করেছে। আরো কতো সাহাবী জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছেন, কিন্তু হযরত আবু বকর রা. এবং অন্যান্য সাহাবীগণ কেউই গায়েবানা জানাযা আদায় করেননি।
হযরত উমর রা. এর আমলে কতো জিহাদ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কত হাজার হাজার সাহাবা জিহাদের ময়দানে মদীনা থেকে বহু দূরে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোন একজনেরও গায়েবানা জানাযা হযরত উমর রা. আমলে অনুষ্ঠিত হয়েছে মর্মে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। হযরত উসমান রা. ও হযরত আলী রা. এর আমলেও কতো হাজার হাজার সাহাবা ও তাবেয়ীগণ শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোন সাহাবীই গায়েবানা জানাযার ইলান করেছেন বা নিজে গায়েবানা জানাযার নামায পড়েছেন মর্মে কোন প্রমাণ না হাদীস থেকে পেশ করতে পারবে, না ইতিহাস থেকে পেশ করতে পারবে।
উপরন্তু হযরত উসমান রা. কে শাহাদাতের আগে তাঁকে গৃহবন্দি করা হয় [ফাতহুল বারী : খ. ২ পৃ. ১৮৮] ও হুসাইন রা. এর শশাহাদাতের পর ইবনে যিয়াদ কতো নিকৃষ্টভাবে তাঁর লাশের সাথে আচরণ করেছিলো, তা মোটামুটি সবার জানা এবং তাঁদের জানাযা পড়তে কতো নিষেধাজ্ঞা ছিলো, সেটাও সুস্পষ্ট। কিন্তু কোনো সাহাবী তাঁদের গায়েবানা জানাযা পড়েন নি। এজন্য কামাল ইবনু হুমাম রহি. বলেন,
ثُمَّ دَلِيْلُ الْـخُصُوْصِيَّةِ أَنَّهُ لَـمْ يُصَلِّ عَلَىٰ غَائِبٍ إلَّا عَلَىٰ هَؤُلَاءِ وَمَنْ سِوَى النَّجَاشِيِّ صَرَّحَ فِيْهِ بِأَنَّهُ رُفِعَ لَهُ وَكَانَ بِمَرْأًى مِنْهُ مَعَ أَنَّهُ قَدْ تُوُفِّيَ خَلْقٌ مِنْهُمْ غَيْبًا فِي الْأَسْفَارِ كَأَرْضِ الْـحَبَشَةِ وَالْغَزَوَاتِ وَمِنْ أَعَزِّ النَّاسِ عَلَيْهِ كَانَ الْقُرَّاءُ، وَلَـمْ يُؤْثَرْ قَطُّ عَنْهُ بِأَنَّهُ صَلَّىٰ عَلَيْهِمْ وَكَانَ عَلَى الصَّلَاةِ عَلَىٰ كُلِّ مَنْ تُوُفِّيَ مِنْ أَصْحَابِهِ حَرِيْصًا حَتَّىٰ قَالَ:لَا يَمُوتَنَّ أَحَدٌ مِنْكُمْ إلَّا آذَنْتُمُوْنِيْ بِهِ، فَإِنَّ صَلَاتِيْ عَلَيْهِ رَحْمَةٌ لَهُ عَلَىٰ مَا سَنَذْكُرُ.
‘বহু সাহাবায়ে কেরাম এমন রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সফরে মদিনার বাইরে ইন্তেকাল করেন। যেমন সিরিয়া বা বিভিন্ন যুদ্ধেেত্র। এক বীরে মাউনার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডেই শহীদ হয়েছেন সত্তরজন সাহাবী। যারা ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র; কিন্তু তিনি তাদের কারো গায়েবানা জানাযা পড়েছেন বলে একটি বর্ণনাও পাওয়া যায় না। অথচ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের জানাযায় শরীক হতে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। যে কারণে তিনি বলে রাখতেন, তোমাদের মধ্যে কারো ইন্তেকাল হলে আমাকে সংবাদ দেবে। যাতে আমি তার জানাযা পড়তে পারি। কারণ আমি যার জানাযায় শরীক হবো তা তার জন্য রহমতের কারণ হবে। [শরহু ফাতহিল কাদির : খ. ২, পৃ. ১২১]
সুতরাং যদি গায়েবানা জানাযা জায়েয হতো, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম রা. নবিজি সাঃ-এর এ কাজটির অনুসরণ ছাড়তেন না। কারণ সাহাবায়ে কেরাম রা. ছিলেন নবিজি সাঃ-এর উত্তম অনুসারী। কিন্তু নাজ্জাশী ছাড়া কোনো সাহাবীর গায়েবানা জানাযা না নবিজি সাঃ পড়েছেন, না খুলাফায়ে রাশেদীন পড়েছেন, না অন্য সাহাবায়ে কেরাম পড়েছেন। এজন্য ইমাম ইবনে কাসীর রহি. বলেন,
وَأَمَّا أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ فَيَقُولُونَ فِي كُلِّ فِعْلٍ وَقَوْلٍ لَمْ يَثْبُتْ عَنِ الصَّحَابَةِ: هُوَ بِدْعَةٌ؛ لِأَنَّهُ لَوْ كَانَ خَيْرًا لسبقونا إليه، لأنهم لَمْ يَتْرُكُوا خَصْلَةً مِنْ خِصَالِ الْخَيْرِ إِلَّا وَقَدْ بَادَرُوا إِلَيْهَا
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতবাদ হলো, যে কাজ বা কথা সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে প্রমাণিত নয়, তা বিদ’আত। কারণ তাঁরা যদি কাজটা ভালো মনে করতেন, তাহলে সবার আগে কাজটা তাঁরাই করতেন। তাঁরা তো কোনো ভালো কাজ ছাড়েন নি, বরং সবার আগে তা সম্পাদনা করেছেন। [তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ৭ পৃ. ২৭৮]
আশরাফ ইবরাহীম কাতকাত রহি. ইবনে কাসীর রহি. এর সূত্র দিয়ে বলেন, ইবনে কাসীর রহি. বলেছেন,
وما تركه النبي من جنس العبادات ولم يفعله مع وجود المقتضي لفعله علي عهده ففعله بدعة وتركه سنة
রাসুলুল্লাহ সাঃ ও তাঁর সাহাবারা যে সমস্ত ইবাদাত ছেড়ে দিয়েছেন কাজটি করার যুক্তি ও সুযোগ থাকা সত্বেও, তা বর্জন করা ওয়াজিব এবং তা করা বিদআত এবং না করাই সুন্নাত। [আল বুরহানুল মুবিন : খ. ২ পৃ. ২৬৮-২৬৯]
যাইহোক, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আশা করি এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছে যে, গায়েবানা জানাযা পড়ার কোন দলীল কুরআন ও হাদীস এবং সাহাবাগণের আমল দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাই একাজটি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য। সুতরাং শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এমন কাজের প্রচলন ঘটানো যা শরিয়ত দ্বারা প্রমাণিত নয় তা সম্পূর্ণ বিদ’আত ও পরিত্যাজ্য। মৃত ব্যক্তির জন্য দু’আ করতে হলে, তার রূহের মাগফিরাত কামনায় শরিয়ত অনুমোদিত পন্থায় যাবতীয় শর্ত-শরায়েত মেনেই করতে হবে। এটা দিয়েও তো রাজনৈতিক ঘৃণা প্রদর্শন করা যেতো। অথচ এটি এখন রাজনৈতিক একটি কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। যাকে রাজনৈতিক বিদ’আত বলাই সংগত।
বাংলাদেশে হানাফী মাযহাব কেন গুরুত্বপূর্ণ:
পরিশেষে বলতে চাই, মাজহাব অনুসরণের ক্ষেত্রে যে কোনো একটির অনুসরণ করতে হবে। সুবিধাবাদী অবস্থান নিয়ে জগাখিচুড়ি পাকালে হবেনা। আর বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ হানাফী মাযহাবের অনুসরন করে থাকেন। উপরন্তু জামায়াতে ইসলামীরাও হানাফী মাযহাবের অনুসারী বলে জানি। অথচ তারা হানাফী ফিকহকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে গায়েবানা জানাযাকে বৈধতা দিতে দেশব্যাপী এ নাজায়েয কাজটা করেই যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের দেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই গায়েবানা জানাজা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে বুঝার তওফিক দান করুন। আমীন।