Home > QRF-আহলে কোরআন > ওযু ছাড়া কোরআন ধরা যাবে কি?

ওযু ছাড়া কোরআন ধরা যাবে কি?

ডাক্তার সাহেবের দলীলের জবাব।

ওযু ছাড়া কুরআন ধরা যাবে’ কথাটি প্রমাণ করার জন্য QRF (কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন) এর প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার মতিয়ার রহমান সাহেব কুরআনের তিনটি আয়াত এনে দলীল দিয়েছেন। যদিও আয়াত তিনটির ভেতরে ওযু ছাড়া কুরআন ধরা যাবে মর্মে কোন কথা উল্লেখ্য নেই। তারপরও ডাক্তার সাহেবের দৃষ্টি কোন ও আমাদের জবাব এখানে তুলে ধরছি। আগে আয়াত তিনটি ও ডাক্তার সাহেবের ব্যখ্যা দেখে নেয়া যাক।

আয়াত-১

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فاغْسِلُواْ وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُواْ بِرُؤُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَينِ وَإِن كُنتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُواْ وَإِن كُنتُم مَّرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاء أَحَدٌ مَّنكُم مِّنَ الْغَائِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاء فَلَمْ تَجِدُواْ مَاء فَتَيَمَّمُواْ صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُواْ بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُم مِّنْهُ مَا يُرِيدُ اللّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍ وَلَـكِن يُرِيدُ لِيُطَهَّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

অর্থ: হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং পদযুগল গিটসহ। যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি তোমরা রুগ্ন হও, অথবা প্রবাসে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রসাব-পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও-অর্থাৎ, স্বীয় মুখ-মন্ডল ও হস্তদ্বয় মাটি দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান-যাতে তোমরা কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর। (সুরা মায়েদা আয়াত-৬)

আয়াত-২

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَقْرَبُواْ الصَّلاَةَ وَأَنتُمْ سُكَارَى حَتَّىَ تَعْلَمُواْ مَا تَقُولُونَ وَلاَ جُنُبًا إِلاَّ عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّىَ تَغْتَسِلُواْ وَإِن كُنتُم مَّرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاء أَحَدٌ مِّنكُم مِّن الْغَآئِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاء فَلَمْ تَجِدُواْ مَاء فَتَيَمَّمُواْ صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُواْ بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ إِنَّ اللّهَ كَانَ عَفُوًّا غَفُورًا
হে ঈমাণদারগণ! তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন নামাযের ধারে-কাছেও যেওনা, যতক্ষণ না বুঝতে সক্ষম হও যা কিছু তোমরা বলছ, আর (নামাযের কাছে যেও না) ফরয গোসলের আবস্থায়ও যতক্ষণ না গোসল করে নাও। কিন্তু মুসাফির অবস্থার কথা স্বতন্ত্র আর যদি তোমরা অসুস্থ হয়ে থাক কিংবা সফরে থাক অথবা তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি প্রস্রাব-পায়খানা থেকে এসে থাকে কিংবা নারী গমন করে থাকে, কিন্তু পরে যদি পানিপ্রাপ্তি সম্ভব না হয়, তবে পাক-পবিত্র মাটির দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও-তাতে মুখমন্ডল ও হাতকে ঘষে নাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল। (সুরা নিসা আয়াত-৪৩)

আয়াত-৩

فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

অর্থ: যখন তুমি কোরআন পাঠ কর তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাইবে। তথা (আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বনির রজিম) পড়বে।
সুরা নাহল আয়াত-৯৮

ডাক্তার সাহেবের ব্যখ্যা-

উল্লেখিত তিনটি আয়াত দ্বারা ডাক্তার সাহেব বুঝাতে চেয়েছেন যে, কুরআন ধরার জন্য ওযু করা যদি বাধ্যতামূলক হতো, তাহলে আল্লাহ ‘নামাজের আগে ওযু’ ও কুরআন পড়ার আগে ‘আউযুবিল্লাহ’ বলা যেমন বাধ্যতামূলক করেছেন,তেমনি কুরআন ধরার আগে ওযুর করার কথা উল্লেখ্য করেও আল্লাহ বাধ্যতামূলক করতেন। যেহেতু ওযুর কথা আল্লাহ বলেননি, সেহেতু কুরআন ধরার জন্য ওযু করা জরুরী নয়।
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:৩৪-৩৫

জবাব-১

প্রথম কথা হলো-‘ ডাক্তার সাহেবের আনিত আয়াত তিনটিতে ‘কুরআন ধরার জন্য ওযু করা লাগবে না’ এ মর্মে কিন্তু কোন কথা বলা হয়নি। সুতরাং আয়াত তিনটি এক্ষেত্রে দলীল হওয়ার উপযুক্ত নয়।

জবাব-২

উপরন্তু উপরোল্লিখিত ৩য় আয়াতে কুরআন পড়ার সময়ে ‘কি পড়তে হবে’ সে কথা বলা হয়েছে, ‘কুরআন ধরার জন্য কি করতে হবে’ সে বিষয়ে কোন কথা বলা হয়নি। সুতরাং তৃতীয় আয়াত দিয়েও এ ক্ষেত্রে দলীল দেয়া মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়।

জবাব-৩

অনুল্লেখিত বিষয় অনস্তিত্বের উপর ইংগিত করে না।

অর্থাৎ কোন জিনিষ কোথাও উল্লেখ্য না থাকার অর্থ এই নয় যে, জিনিষটির অস্তিত্বই নেই। অার কোন জিনিষের অস্তিত্ব থাকলেই যে, সব আয়াতে সেটা উল্লেখ্য থাকবে বিষয়টি এমনও নয়। বরং এক আয়াতের তাফসীর অন্য আয়াত দ্বারা করা হয়। এ কথা ডাক্তার সাহেব নিজেও বলেছেন।
”কোন বিষয়ের একটা দিক এক আয়াতে এবং আর একটা অন্য আয়াতে উল্লেখ্য করা হয়েছে।”
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:১৩

উপরন্তু ইবনে তাইমিয়া র: এর কথা এ ক্ষেত্রে দলীল হিসাবে তিনি উল্লেখ্য করে লিখেছেন,
“ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম ইবনে কাসীর প্রমুখ মনীষী বলেছেন-‘কুরআন তাফসীরের সর্বোত্তম হন্থা হচ্ছে কুরআনের তাফসীর কুরআন দ্বারা করা।”
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:১৩

যেহেতু ডাক্তার সাহেব একটি আয়াতের তাফসীর অন্য আয়াতে থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করেন এবং ইবনে তাইমিয়া র: এর কথাকে দলীল হিসাবে উল্লেখ্য করেছেন,সেহেতু ইবনে তাইমিয়ার আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ্য করা জরুরি মনে করছি। ইবনে তাইমিয়া লেখেন,
عدم الوجدان لا يستلزم عدم الوجود
অর্থাৎ কোন জিনিষ না পাওয়া যাওয়া, তার অস্তিত্বহীনতাকে আবশ্যক করে না।
সূত্র: আল মানতেক পৃ:২২০

তাহলে বুঝা গেল, ডাক্তার সাহেবের উল্লেখিত তিনটি আয়াতে নামাজের আগে ওযু করার কথা এবং কুরআন পড়ার সময় ‘আউযুবিল্লাহ’ পড়ার কথা উল্লেখ্য করা হয়েছে, কিন্তু কুরআন ধরার সময় ওযুর কথা উল্লেখ্য করা হয়নি।এর মানে এই নয় যে কুরআন পড়তে ওযু লাগবে না।

সুতরাং ডাক্তার সাহেবের কথানুযায়ী উল্লেখিত আয়াতে ওযু করার কথা যেহেতু নেই, সেহেতু আয়াতে আছে কি না সেটা দেখতে হবে। আমরা খুঁজে দেখলাম সুরা ওয়াকিয়ার ৭৯ আয়াতে কুরআন ধরার ব্যাপারে পবিত্রতা শর্ত করা হয়েছে। যা শুরুতে আমরা উল্লেখ্য করেছি।

একটি অভিযোগ-

এখন তিনি বলে পারেন যে, সুরা ওয়াকিয়ার ৭৯ নং আয়াতের দ্বারা কুরআন ধরার জন্য ওযু করতে হবে একথা বলা হয়নি। এটা দিয়ে দলীল দোয়া যাবে না।

অভিযোগের জবাব-১

আয়াতটির দ্বারা ওযু করা শর্ত করা হয়েছে কি না সে কথা আমরা বিস্তারিত ভাবে পূর্বে উল্লেখ্য করেছি। এমনকি যে ইবনে তাইমিয়ার র: কথা ডাক্তার সাহেব নিজেও দলীল হিসাবে পেশ করেন, সে ইবনে তাইমিয়ার যুক্তিভিত্তিক কথা উল্লেখ্য করেছি। পাঠকের সহজের জন্য এখানো আবার উল্লেখ্য করছি।ইবনে তাইমিয়া র: বলেন,
أن الذي في اللوح المحـفوظ هو القرآن الذي في المصحف كما أن الذي في هذا المصحف هو الذي في هذا المصحف بعينه سواء كان المحل ورقاً أو أديماً أو حجراً أو لحافاً فإذا كان مِنْ حكم الكتاب الذي في السماء أن لا يمسه إلا المطهرون وجب أن يكون الكتاب الذي في الأرض كذلك لأن حرمته كحرمته أو يكون الكتاب اسم جنس يعم كل ما فيه القرآن سواء كان في السـماء أو الأرض وقد أوحـــى إلى ذلك قوله تعالى: {رَسُولٌ مِنَ اللَّهِ يَتْلُو صُحُفاً مُطَهَّرَةً} [البينة:2]، وكذلك قوله تعالى: {فِي صُحُفٍ مُكَرَّمَةٍ مَرْفُوعَةٍ مُطَهَّرَةٍ} [عبس:13-14]. فوصفها أنها مطهرة فلا يصلح للمحدث مسها

অর্থ: আমাদের কাছে যে কুরআন রয়েছে এটি সেই কুরআনই যা লৌহে মাহফুজে রয়েছে। যেমন কুরআন তাই, যা কুরআনের মাঝে রয়েছে, চাই তার স্থান পাতা হোক, বা চামড়া হোক, বা পাথর হোক বা মোড়ক হোক। সুতরাং আসমানে অবস্থিত লিখিত কিতাবের হুকুম যেহেতু তা পবিত্র ছাড়া কেউ স্পর্শ করে না, জমিনে থাকা কুরআনের ক্ষেত্রে একই বিধানকে আবশ্যক করে। কেননা, এ [জমিনে থাকা কুরআন] কুরআনের সম্মান সে [আসমানে থাকা কুরআন] কুরআনের মতই। অথবা আয়াতে কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য হল ইসমে জিনস। যা কুরআনকে বুঝাচ্ছে, চাই তা আসমানে থাকুক বা জমিনে থাকুক।
এদিকেই ইংগিত বহন করছে আল্লাহ তাআলার বাণী رَسُولٌ مِنَ اللَّهِ يَتْلُو صُحُفاً مُطَهَّرَةً তথা আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল; যিনি পবিত্র সহীফা তিলাওয়াত করেন। {সূরা বায়্যিনাহ-২} অন্যত্র এসেছে فِي صُحُفٍ مُكَرَّمَةٍ مَرْفُوعَةٍ مُطَهَّرَةٍ অর্থাৎ সমুচ্চ এবং পবিত্র যা রয়েছে সম্মানিত সহীফায়। {আবাসা-১৩-১৪}

সুতরাং কোরআনের বৈশিষ্ট্য হলো পবিত্র হওয়া, সুতরাং কোন অপবিত্র ব্যক্তির জন্য স্পর্শ করা জায়েয হবে না।
সূত্র: শরহুল উমদাহ পৃ:৩৮৪

অভিযোগের জবাব-২

এরপরও যদি ধরে নিই যে, ইবনে তাইমিয়ার উক্ত কথা তিনি মানবেন না অথবা সুরা ওয়াকিয়ার ৭৯ আয়াতে এ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। সেজন্য ডাক্তার সাহেব লিখেছেন,
‘আলোচ্য বিষয়ে কোরআনে কোন তথ্য নেই।’
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:৪০

তাহলে যদি মেনে নিই যে, কুরআনে ব্যাপারে কোন তথ্য নেই তাহলে আমাদের করণীয় কি হবে? সেক্ষেত্রে অবশ্যই নবিজি স: এর সুন্নাহ দেখতে হবে। এটা শুধু আমার কথা নয় ডাক্তার সাহেব নিজেই লিখেছেন,
‘সুন্নাহ হলো কুরআনের বক্তব্যের বাস্তব রুপ বা ব্যখ্যা।’
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:১৩

অর্থাৎ কোন বিষয়ে কুরআনে উল্লেখ্য না থাকলে নবিজির সুন্নাহ দেখতে হবে। আমরা তো এ ব্যাপারে ইতিপূর্বে হযরত আমর ইবনে হাযমের রা: এর হাদিস পেশ করেছি।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي بَكْرِ بْنِ حَزْمٍ أَنَّ فِي الْكِتَابِ الَّذِي كَتَبَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِعَمْرِو بْنِ حَزْمٍ أَنْ لَا يَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلَّا طَاهِرٌ
অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবু বকর বিন হাযম রা: বলেন, রাসূল সাঃ আমর বিন হাযম রা: এর কাছে এই মর্মে চিঠি লিখেছিলেন যে, পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন কেউ স্পর্শ করবে না”।
সূত্র: মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৬৮০, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-২৮৩০, মারেফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস নং-২০৯, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-১৩২১৭, আল মুজামুস সাগীর, হাদীস নং-১১৬২, মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস নং-৪৬৫, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২২৬৬ (হাদিস সহীহ)

অভিযোগ:

উক্ত হাদিসটির ব্যপারে ডাক্তার সাহেব বলে থাকেন, হযরত আমর ইবনে হাযম রা: এর হাদিসটি নবিজির স: হাদিস নয়। কারণ নবিজি স: সাহবাদের সবাইকে জমা করে এ হুকুমটি বলেননি। অর্থাৎ হাদিসটি মানুষের বানানো তথা জাল।

অভিযোগের জবাব:

আমর ইবনে হাযম রা: এর এ হাদিসটি জাল বলার হিম্মত আজ পর্যন্ত কেউ করেননি। বরং অসংখ্য হাদিস বিশারদগণ উক্ত হাদিসকে সহিহ বলেছেন।
আল্লামা সয়ূতী র: হাদিসটিকে সহিহ ইবনে হিব্বানে সহিহ সনদে বয়ান করেছেন।

এরপরও যদি মেনে নিই যে আমর ইবনে হাযমের হাদিসটি জাল তাহলে ইতিপূর্বে সাহবাদের একটি জামাআত তথা ১. হযরত হাকিম ইবনে হিযাম রা: ২. আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা: ৩. হযরত সালমান ফারসী রা: ৪. হযরত উসমান বিন আবুল আস সাকাফী রা: ৫. হযরত আনাস রা: এর যে হাদিসগুলো পেশ করা হয়েছে সব কি তাহলে জাল? নিশ্চয় নয়।

অতএব ডাক্তার সাহেবের কথানুযায়ী কুরআনে ‘ওযু ছাড়া কুরআন ধরার ব্যাপারে কোন আয়াত নেই। কিন্তু আমরা দেখলাম হাদিসে সুস্পষ্টরুপে রয়েছে। অতএব কুরআনের না থাকলেও অসংখ্য হাদিসে যেহেতু বলা হয়েছে ‘পবিত্রতা ছাড়া কুরআন ধরা যাবে না’ এটাই সিন্ধান্ত।

হাদিসের আলোকে ডাক্তার সাহেবের দেয়া দলীল ও তার জবাব।

‘ওযু ছাড়া কুরআন ধরা জায়েয’ প্রমাণ করতে ডাক্তার সাহেব কয়েকটি হাদিস পেশ করেছেন। চলুন তার উল্লেখিত হাদিস গুলো আগে দেখে নেয়া যাক।

হাদিস-১

عن عبدالله بن عباس رضي الله عنه قال أنَّ رسولَ اللَّهِ ﷺ خرجَ منَ الخلاءِ فقرِّبَ إليهِ طعامٌ فقالوا ألا نأتيكَ بوَضُوءٍ فقالَ إنَّما أمرتُ بالوُضُوءِ إذا قمتُ إلى الصَّلاةِ

অর্থ: ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৌচাগার থেকে বের হয়ে এলেন। তাঁর সামনে খানা পেশ করা হল। লোকেরা বলল, অযূর পানি নিয়ে আসব কি? তিনি বললেন, আমি অযূ করতে নির্দেশিত হয়েছি যখন আমি সালাতে দাঁড়াব।
সূত্র: তিরমিজী হাদিস-১৮৪৭ নাসাঈ-১৩২

হাদিস-২

عن عبدالله بن عباس أنَّ ابْنَ عَبّاسٍ أَخْبَرَهُ أنَّهُ باتَ لَيْلَةً عِنْدَ مَيْمُونَةَ أُمِّ المُؤْمِنِينَ وَهي خالَتُهُ قالَ فاضْطَجَعْتُ في عَرْضِ الوِسادَةِ واضْطَجَعَ رَسولُ اللهِ ﷺ وَأَهْلُهُ في طُولِها فَنامَ رَسولُ اللهِ ﷺ حتّى انْتَصَفَ اللَّيْلُ أَوْ قَبْلَهُ بقَلِيلٍ أَوْ بَعْدَهُ بقَلِيلٍ اسْتَيْقَظَ رَسولُ اللهِ ﷺ فَجَعَلَ يَمْسَحُ النَّوْمَ عن وَجْهِهِ بيَدِهِ ثُمَّ قَرَأَ العَشْرَ الآياتِ الخَواتِمَ مِن سُورَةِ آلِ عِمْرانَ ثُمَّ قامَ إلى شَنٍّ مُعَلَّقَةٍ فَتَوَضَّأَ منها فأحْسَنَ وُضُوءَهُ ثُمَّ قامَ فَصَلّى قالَ ابنُ عَبّاسٍ فَقُمْتُ فَصَنَعْتُ مِثْلَ ما صَنَعَ رَسولُ اللهِ ﷺ ثُمَّ ذَهَبْتُ فَقُمْتُ إلى جَنْبِهِ

অর্থ: ইবনে আববাস রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিনি তাঁর খালা মু’মিনদের মা মাইমূনাহ রা: এর ঘরে রাত কাটালেন। তিনি বলেন, আমি বালিশের প্রস্থের দিকে শুয়ে পড়লাম, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সহধর্মিণী বালিশের দৈর্ঘ্যে শয়ন করলেন। অতঃপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্যরাত বা তার কিছু আগ বা পর পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকলেন। অতঃপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেগে উঠে বসলেন এবং দু’হাতে মুখমন্ডল মুছে ঘুমের রেশ দূর করলেন। অতঃপর তিনি সূরাহ্ আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত তিলাওয়াত করলেন। পরে একটি ঝুলন্ত মশ্কের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং এর পানি দ্বারা উত্তমরূপে উযূ করে সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘আববাস রা: বলেন, আমিও উঠে পড়লাম এবং তিনি যেমন করেছিলেন, আমিও তেমন করলাম। অতঃপর আমি গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ালাম।
সূত্র: বুখারী হাদিস-১৮১ মুসলিম-৭৬৩

হাদিস-৩

عن علي بن أبي طالب رضي الله عنه قال إن رسول اللهِ ﷺ كان يخرج من الخلاء فيقرئنا القرآن ويأكل معنا اللحم ولم يكن يحجبه أو قال يحجزه عن القرآن شيء ليس الجنابة

অর্থ: হযরত আলী রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পায়খানা হতে বের হয়ে আমাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন এবং আমাদের সাথে গোশতও-খেতেন। স্ত্রী-সহবাস জনিত অপবিত্রতা ছাড়া অন্য কোন অপবিত্রতা তাকে কুরআন তিলাওয়াত থেকে বিরত রাখতে পারত না।
সূত্র: আবু দাউদ (বাংলা) হাদিস-১৮১ (আরবী)-২২৯

হাদিস-৪

عن عبدالله بن عمر رضي الله عنه قال قال النبي صلي الله عليه وسلم لا تقرأُ الحائضُ ولا الجُنبُ شيئًا مِنَ القرآن

অর্থ: হযরত ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণনা করেন যে, নাবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন হায়য বিশিষ্ট মহিলা এবং যাদের উপর গোসল ফরয তারা কুরআনের কিছুই তিলওয়াত করতে পারবে না।
সূত্র: তিরমিযি হাদিস-১৩১

হাদিস-৫

عن عائشة أم المؤمنين رضي الله عنها قالت أنَّ النبيَّ ﷺ كانَ يَتَّكِئُ في حَجْرِي وأَنا حائِضٌ ثُمَّ يَقْرَأُ القُرْآنَ

অর্থ: আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কোলে হেলান দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর তখন আমি হায়েযের অবস্থায় ছিলাম।
সূত্র: বুখারী (বাংলা) হাদিস-২৯৩ আরবী-২৯৭

উক্ত হাদিস গুলো দিয়ে তিনি কুরআন ধরা জায়েয প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।বুঝাতে চেয়েছেন নবিজি স: ওযু না করেই কুরআন পড়েছেন।

একজন শিক্ষিত মানুষ কিভাবে এত বড় বোকামী করতে পারেন সেটা আমাদের বোধগম্য নয়! ‘ওযু ছাড়া কুরআন ধরা জায়েয’ এ কথা কি উক্ত হাদিস গুলোয় কোথাও রয়েছে? হাদিস গুলোর ভেতর বলা হয়েছে নবিজি স: ওযু না করেই কুরআন পড়েছেন। ধরেছেন বা স্পর্শ করেছেন সেটা তো বলা হয়নি। উপরন্তু নবিজি স: ছিলেন পবিত্র কালামে পাকের হাফেজ।

এসব হাদিসের অর্থ তো কুরআন ধরে পড়েছেন এমনটা নয় বরং না ধরেই মুখস্ত পড়েছেন। এ হাদিস গুলো দিয়ে এ সম্পর্কে দলীল চলে না এটা বাচ্চাও বুঝবে। অতি আফসোস তিনি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে বুঝলেন না!

যুক্তি ও খণ্ডন:

QRF (কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন) এর প্রতিষ্ঠাতা ডা: মতিয়ার রহমান ‘ওযু ছাড়া কোরআন ধরা যাবে’ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাস্যকর যুক্তি পেশ করেছেন। যার সারসংক্ষেপ যুক্তি ও খন্ডন নিন্মে পেশ করা হলো-

যুক্তি-১

কুরআন ধরার জন্য ওযু শর্ত করা না হলে সবার বাসায়,অফিসে,পথে-ঘাটে,পকেটে কুরআন থাকতো। ফলে কুরআনের জ্ঞানী বৃদ্ধি পেত।
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:৭

যুক্তি-২

কুরআন ধরার চেয়ে পড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।অতএব ওযু ছাড়া কুরআন পড়া গেলে, ধরা যাবে না কেন?
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:২৮

যুক্তি-৩

‘ওযু ছাড়া কোরআন ধরা যাবে না’ এ কথার অর্থ হলো, কোরআন থেকে বাধা প্রদান করা। আর কোরআন থেকে বাধা দেয়া কখনও কুরআনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন হতে পারে না। বরং এটা কোরআনের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন।
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:২৯

যুক্তি-৪

কোরআন প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো কোরআনের জ্ঞান অর্জন করে সে অনুযায়ী আমল করা ও ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য বুঝে মানুষের কল্যান সাধন করা।
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:২৯

যুক্তি খন্ডন:

প্রথম কথা হলো, ইতিপূর্বে আমাদের আলোচনায় বিষয়টি ফুটে উঠেছে যে, কুরআন,হাদিস,সাহাবা রা: তাবেয়ীগণ এবং ফুকাহাদের মত হলো কুরআন ওযু ছাড়া ধরা যাবে না। এরপরও এ ধরণের যুক্তি পেশ করা বোকামী ছাড়া কিছু না।

দ্বিতীয়তঃ এরপরও যদি যুক্তিগুলো মেনে নিতে হয়, তাহলে বলবো উক্ত যুক্তিগুলোর খাতিরে যদি ওযু ছাড়া কুরআন ধরার অবকাশ রাখতেই হয়, তাহলে তো সকল মানুষের জন্য সর্বাবস্থায় কুরআন স্পর্শ করার অনুমতি থাকার দরকার। সে হিসাবে যার উপর গোসল ফরজ বা হায়েয,নেফাসগ্রস্থ মহিলা সকলের জন্য কুরআন স্পর্শ করার রাস্তা খোলা রাখা উচিত।কারণ হায়েয অবস্থায় কোন মহিলার মাসে ১০ দিনও মাসিক থাকে। আবার নেফাসগ্রস্থ মহিলার ৪০ দিনও থাকতে পারে। তাহলে তাদের জন্যও তো ওযু ছাড়া কোরআন স্পর্শ করার অনুমতি থাকার কথা। কিন্তু ডাক্তার সাহেব নিজেই লিখছেন,
”গোসল ফরজ অস্থায় কুরআন পড়া এবং স্পর্শও করা উভয়টিই নিষিদ্ধ।
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:৩১/৪৫

তুতীয়তঃ যদি বলা হয় ওযু ছাড়া কুরআন যদি পড়া যায়,তাহলে ধরা যাবে না কেন? আচ্ছা! গোসল ফরজ অবস্থায় তো মসজিদে ঢোকা নিষেধ। তার অর্থ কি এই যে, মসজিদের অসম্মান করা হলো? একজন ডাক্তার হয়ে এমন অযৌক্তিক কথা কেন?

হ্যাঁ! ডাক্তার সাহেব এখন বলবেন, হাদিসে এসব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, বিধায় এসব ক্ষেত্রে কমনসেন্স বা যুক্তি চলবে না। ঠিক একই কথা আমিও বলছি, যেহেতু নবিজি স: থেকে ওযু ছাড়া কুরআন না ধরার ব্যাপারে আমর ইবনে হাযম রাঃ ছাড়াও একাধিক সাহাবা থেকে হাদিস রয়েছে, সেহেতু এক্ষেত্রে উল্লেখিত যুক্তি চলবে না। অতএব ডাক্তার সাহেবে মতানুযায়ী যেমন হায়েয,নেফাসগ্রস্থ মহিলার জন্য পবিত্রতা ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যায় না, তেমনি ওযু ছাড়াও স্পর্শ করা যাবে না। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই হাদিসের নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সব খানে যুক্তি দেয়া যায় না। এটা ইসলাম ডাক্তারী সাইন্স নয়।

যুক্তির নামে জ্ঞানপাপ।

ডাক্তার মতিয়ার রহমান সাহেব এক্ষেত্রে সবচে বড় হাস্যকর যে যুক্তি দিতে গিয়ে লিখেছেন যে, কোরআনের জ্ঞান না থাকা সবচে বড় গুনাহ। সুতরাং কুরআন ধরতে ওযুর শর্ত করা মানে হলো কুরআনের জ্ঞান থেকে দুরে রাখা। আর গুনাহের কাজে সহযোগিতা করাও গুনাহ।
সূত্র: ওযু গোসলের সাথে কুরআনের সম্পর্ক পৃ:২৯

যুক্তিখণ্ডন:

প্রথম কথা হলো- সবার মাঝে কুরআনের জ্ঞান থাকা অবশ্যই উচিৎ। কিন্তু কুরআনের জ্ঞান না থাকা সবচে বড় গুনাহ, এমনকি শিরকের চেয়েও বড় গুনাহ এ কথাটি শরীয়ত সম্মত নয়। ( এ সম্পর্কে অন্যত্র আলোচনা করা হবে।ইনশাআল্লাহ)

এরপরও যদি মেনে নিই যে, কোরআনের জ্ঞান না থাকা সবচে বড় গুনাহ। সুতরাং কুরআন ধরতে ওযুর শর্ত করা মানে হলো কুরআনের জ্ঞান থেকে দুরে রাখা। আর গুনাহের কাজে সহযোগিতা করাও গুনাহ। তাহলে আমার প্রশ্ন হলো- নবিজি স: হায়েযা মহিলাদের ক্ষেত্রে কুরআন না ধরতে দিয়ে কি গুনাহ করলেন? নাউযুবিল্লাহ। এ কেমন যুক্তি? যে যুক্তিতে নবিজিও পাপী বনে যান, সে যুক্তি একজন জ্ঞানপাপী ডাক্তারের পক্ষেই মানায়। তবে মনে রাখতে হবে যুক্তি যেন পাপ না হয়।

 

লেখক:

মুফতী রিজওয়ান রফিকী

পরিচালক- মাদরাসা মারকাযুন নূর বোর্ডবাজা, গাজীপুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.