Home > ভ্রান্ত মতবাদ > বিতর নামাজ কি মাঝে মাঝে পড়লে হবে?

বিতর নামাজ কি মাঝে মাঝে পড়লে হবে?

প্রিয় পাঠক, তথাকথিত সহিহ আকীদার দাবিদার লা-মাযহাবী শায়খগণ একে একে ইসলামের অপব্যখ্যা, ভুল ব্যাখ্যা এবং বিচ্ছিন্ন মতবাদ পেশ করে জনসমাজকে দ্বীনের ভেতর সন্দেহ সৃষ্টি করার মিশন নিয়ে ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে। ইতিপূর্বে সালাত বা নামাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে অবশেষে সরাসরি নামাজ নিয়েই বিভ্রাট সৃষ্টি করে বসেছেন। সম্প্রতি সময়ে জনৈক শায়খ বিতর সালাতের ব্যাপারে ফাতাওয়া দিয়ে বসেছেন যে, বিতর সালাত নিয়মিত প্রতিদিন পড়ার দরকার নেই, মাঝে মাঝে পড়লেই চলবে।

অথচ নবীজি সা. এর শেখানো নামাজ, সাহাবায়ে কেরামের আমল, তাবেয়ীনদের নিয়মিত আমল ছিল বিতর সালাতকে প্রতিদিন পড়া। কোনো ওযরবশত যদি তাঁরা বিতর পড়তে না পারতেন, তাহলে পরে আদায় করে নিতে।

বিতর নামাজ পড়া জরুরী

পবিত্র হাদিসের ভেতর বিতর নামাজকে অত্যান্ত গুরুত্বসহকারে আদায় করতে বলা হয়েছে। হাদিস শরীফে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ الْوِتْرُ حَقٌّ فَمَنْ لَمْ يُوتِرْ فَلَيْسَ مِنَّا الْوِتْرُ حَقٌّ فَمَنْ لَمْ يُوتِرْ فَلَيْسَ مِنَّا الْوِتْرُ حَقٌّ فَمَنْ لَمْ يُوتِرْ فَلَيْسَ مِنَّا ‏

অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ ইবন বুরায়দা র. তাঁর পিতা হযরত বুরায়দা রা. হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ বিতিরের নামায হক (সত্য)। যে ব্যক্তি এটা আদায় করবে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। বিতিরের নামায হক (সত্য)। যে ব্যক্তি এটা আদায় করবে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। বিতিরের নামায হক (সত্য)। যে ব্যক্তি এটা আদায় করবে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।
সূত্র: সুনানে আবু দাউদ হাদিস: ১৪১৯

প্রিয় পাঠক, বিতর নামাজের ব্যাপারে আমাদের নবীজি সা. কত কঠোর অবস্থান নিয়ে বললেন, “যে ব্যক্তি বিতর নামাজ পড়বে না, সে আমাদের দলভূক্ত নয়” এত সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকার পরও কিভাবে বলা যায় যে, বিতর সব সময় পড়া জরুরী নয়?

বিতর নামাজের ওয়াক্ত:

উপরন্তু বিতর নামাজটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ সালাতের জন্য রাসুলুল্লাহ সা. ওয়াক্তও নির্ধারণ করে দিয়ে গেছেন। হাদিসে এসেছে,

عَنْ خَارِجَةَ بْنِ حُذَافَةَ أَنَّهُ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنَّ اللَّهَ أَمَدَّكُمْ بِصَلاَةٍ هِيَ خَيْرٌ لَكُمْ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ الْوِتْرُ جَعَلَهُ اللَّهُ لَكُمْ فِيمَا بَيْنَ صَلاَةِ الْعِشَاءِ إِلَى أَنْ يَطْلُعَ الْفَجْرُ

অর্থ: হযরত খারিজা ইবনু হুযাফা রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে বের হয়ে এসে ইরশাদ করলেন; আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের জন্য একটি সালাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। রক্ত বর্ণের বহু উট থেকেও তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। এই সালাতটি হল বিতর। এশার সালাত ও সুবহে সা’দিক উভয়ের মধ্যবর্তী সময়টিকে আল্লাহ্ তা’আলা এর জন্য তোমাদের ওয়াক্ত নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
সূত্র: জামে তিরমিযি হাদিস: ৪৫২

অপর হাদিসে এসেছে,

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَوْتِرُوا قَبْلَ أَنْ تُصْبِحُوأَ

অর্থ: হযরত আবূ সা’ঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ভোর (ফজর) হওয়ার পূর্বে তোমরা বিতর সালাত আদায় করো।
সূত্র: সহীহ মুসলিম হাদিস: ৭৫৪

অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে,

عن جابر بن عبدالله قالَ قالَ رَسولُ اللهِ ﷺ مَن خافَ أَنْ لا يَقُومَ مِن آخِرِ اللَّيْلِ فَلْيُوتِرْ أَوَّلَهُ

অর্থ: হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তির আশংকা হয় যে, সে রাতের শেষাংশে জাগ্রত হতে পারবে না, সে যেন রাতের শুরু অংশে বিতর সালাত পড়ে নেয়।
সূত্র: সহিহ মুসলিম হাদিস: ৭৫৫

বিতর নামাজের কাযা:

পাশাপাশি বিতর সালাতটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, যদি কেউ কোনো শরয়ী ওজরের কারণে পড়তে না পারে, তাহলে অবশ্যই পরে পড়তে হবে। হাদিস শরীফে এসেছে,

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ نَامَ عَنْ وِتْرِهِ أَوْ نَسِيَهُ فَلْيُصَلِّهِ إِذَا ذَكَرَهُ

অর্থ: আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ যে ব্যক্তি নিদ্রা বা ভুলের কারণে বিতিরের নামায আদায় করে নাই, সে যেন তা স্মরণ হওয়ার পরপরই আদায় করে নেয়।
সূত্র: সুনানে আবু দাউদ হাদিস: ১৪৩১ জামে তিরমিযী: ৪৬৫ মুসনাদে আহমাদ: ১৪৩১
শাইখ আলবানী এটিকে সহীহ আল জামে হা: ৬৫৬৩ এ সহিহ বলেছেন।

অন্য একটি হাদিসে এসেছে,

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ نَامَ عَنِ الْوِتْرِ أَوْ نَسِيَهُ فَلْيُصَلِّ إِذَا ذَكَرَ وَإِذَا اسْتَيْقَظَ

অর্থ: আবূ সাঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ কেউ যদি বিতর আদায় না করে শুয়ে পড়ে বা তা আদায় করতে ভূলে যায়, তবে যখনই স্মরণ হবে বা সে নিদ্রা থেকে উঠবে, তখনই তা আদায় করে নিবে।
সূত্র: সুনানে তিরমিযী হাদিস: ৪৬৫ আহমাদ ১৪৩১
আলবানী রহ. বলেন, এ হাদিসটি অন্যান্য সমার্থবোধক হাদিসের মাধ্যমে সহিহ

ইমাম আবু হানিফা র. এর অভিমত

حُكْمُ الْوِتْرِ لِأَنَّهُ فَرْضٌ عَمَلِيٌّ عِنْدَهُ

অর্থ: বিতর নামাজের হুকুম ( হ্যা, অবশ্যই জরুরী।) কেননা তা ফরযে আ’মলী।
সূত্র: রদ্দুল মুহতার খ: ২ পৃ: ৫৩৩

হানাফী মাযহাবের অভিমত:

اما الصلاة الواجبة فنوعان صلاة الوتر و صلاة العيدين

অর্থাৎ ওয়াজীব নামাজ ২ প্রকার; ১. বিতর নামাজ ২. দুই ঈদের নামাজ।
সূত্র: বাদায়েউস সানায়ে খ: ২ পৃ: ২২০

বিতর নামায আদায় করা ফরবে আমালি। তাই এটি কাযা হয়ে গেলে পড়ে কাযা আদায় করতে হবে।

ذهب الحنفية إلى أن من طلع عليه الفجر ولم يصل الوتر يجب عليه قضاؤه، سواء أتركه عمدا أم نسيانا وإن طالت المدة، ومتى قضاه يقضيه بالقنوت. فلو صلى الصبح وهو ذاكر أنه لم يصل الوتر فصلاة الصبح فاسدة عند أبي حنيفة لوجوب الترتيب بين الوتر والفريضة

অর্থ: হানাফি মাযহাব মতে যদি কারো সামনে ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায,এবং সে বিতির পড়তে না পারে,তাহলে তার উপর বিতিরের কা’যা ওয়াজিব।চায় সে ইচ্ছাকরে বিতিরকে কা’যা করুক বা অনিচ্ছায় কা’যা হোক।চায় কা’যা হওয়ার পর অনেক লম্বা সময় অতিবাহিত হয়ে যাক।যখনই কা’যা করা হবে, তখন কুনুত সহ কা’যা করা হবে।যদি বিতির কা’যা হয়েছে,সেটা স্বরণে থাকা সত্তেও কেউ ফজরের নামায পড়ে নেয়,তাহলে ইমাম আবু-হানিফার মাযহাবমতে তার ফজর ফাসিদ হয়ে যাবে।কেননা বিতির এবং ফরয নামাযের মধ্যে তারতিব ওয়াজিব(তবে যদি সে সাহেবে তারতিব না হয়,তাহলে তার নামায ফাসিদ হবে না)।
সূত্র: আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ খ: ২৭ পৃ: ৩০১

ইবনে তাইমিয়া র. এর অভিমত:

পবিত্র হাদিসে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে,

من نام عن صلاة أو نسيها فليصلها إذا ذكرها فإن ذلك وقتها

অর্থ: যে ব্যক্তির ঘুম বা ভুলে যাওয়ার কারণে সালাত ছুটে যায় সে যখনই স্বরণ হবে তা আদায় করে নিবে।কেননা এটাই তার সময়।
সূত্র: মাজমুউল ফাতাওয়া (ইবনে তাইমিয়া র.) খ: ২৩ পৃ: ৯০

ইবনে তাইমিয়া র. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন,

وهذا يعم الفرض وقيام الليل والوتر والسنن الراتبة

অর্থাৎ এ হাদিসটি ফরয, কিয়ামুল্লায়ল (তাহাজ্জুদ), বিতর, সুন্নতে রাতেবা ইত্যাদি সকল প্রকার সালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সূত্র: ফাতাওয়া কুবরা খ: ২ পৃ: ২৪০

তাছাড়া এ মর্মে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা., আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা., আয়েশা রা. প্রমূখ সাহাবী থেকে ফজরের পরে বিতর পড়ার আমল প্রমাণিত হয়েছে।

সুতরাং এতগুলো সুস্পষ্ট হাদিসসহ ফুকাহায়ে কেরামের কথার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে “বিতর নামাজ সব সময় পড়া জরুরী নয়” এ বক্তব্য যারা দিচ্ছেন, তারা কি উম্মতের ফায়দার জন্য করছেন না ক্ষতির জন্য করছেন? একটু ভেবে দেখবেন।

লেখক: 

মুফতী রিজওয়ান রফিকী

Check Also

IMG 20210523 215847

ওযুতে ঘাড় মাসাহ করা কি বিদ’আত?

ওযুতে ঘাড় মাসাহ করা মুস্তাহাব। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে তথাকথিত আহলে হাদিস মতবাদের কিছু ভাই এটাকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.