সম্প্রতি সময়ে কিছু ইসলাম বিদ্বেষীরা ইসলামকে নিয়ে গভীর থেকে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তারা কৌশল অবলম্বন করতে নিজেদেরকে ‘আহলে কুরআন’ বলে পরিচয় দিয়ে আসছে। মূলত তাদের টার্গেট হলো, যদি সমাজে কুরআনের স্লোগান দিয়ে রাসুলুল্লাহ সা. থেকে জাতিকে সরিয়ে রাখা যায়, তাহলে ইবলিসের টার্গেটকে সফতলার চুড়ান্ত রুপ দেওয়া যাবে। এজন্য রাসুলুল্লাহ সা. এই ভ্রষ্ট ও ইসলাম বিদ্বেষী জাতি থেকে ১৪০০ বছর আগেই সতর্ক করে গেছেন। হযরত মিকদাম ইবনে মাদীকারিব রা.হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أَلاَ هَلْ عَسَى رَجُلٌ يَبْلُغُهُ الْحَدِيثُ عَنِّي وَهُوَ مُتَّكِئٌ عَلَى أَرِيكَتِهِ فَيَقُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ كِتَابُ اللَّهِ فَمَا وَجَدْنَا فِيهِ حَلاَلاً اسْتَحْلَلْنَاهُ وَمَا وَجَدْنَا فِيهِ حَرَامًا حَرَّمْنَاهُ وَإِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَمَا حَرَّمَ اللَّهُ
অর্থাৎ খুব শীঘ্রই এমন ব্যক্তির আগমন ঘটবে যে, সে তার সুসজ্জিত গদিতে হেলান দিয়ে বসে থাকবে, তখন তার নিকট আমার কোন হাদীস পৌছলে সে বলবে, আমাদের ও তোমাদের সামনে তো আল্লাহ তা’আলার কিতাবই আছে। আমরা তাতে যা হালাল পাব সেগুলো হালাল বলে মেনে নিব এবং যেগুলো হারাম পাব সেগুলো হারাম বলে মনে নিব। সাবধান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা হারাম ঘোষণা করেছেন, তা আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক হারামকৃত বস্তুর মতোই হারাম।
সূত্র: জামে তিরমিযি, হাদিস: ২৬৬৪
রাসুলুল্লাহ সা. এই গভীর ফিৎনার ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী করার পর দুই’শ বছরের মাথায় এসেই এদের দেখা যায়।
উৎপত্তি:
নবীজির সা. হাদিস-সুন্নাহ অস্বীকারকারী এ সম্প্রদায়ের আবির্ভাব প্রায় ১২০০ বছর আগ থেকে। ইমাম শাফেয়ী রহি. তার লেখা কিতাব الام নামক কিতাবের حكاية قول الطائفة التي ردت الاخبار كلها নামক অধ্যায়ে হাদিস অস্বীকারকারীদের কথোপকথন বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এবং ইমাম শাফেয়ী রহি. তাদের প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাবও দিয়েছিলেন। যা বিস্তারিত সেখানে লেখা রয়েছে। কেউ চাইলে চমৎকার সে আলোচনাটি পড়ে দেখতে পারেন।
সূত্র: কিতাবুল উম্ম খ. ৯ পৃ. ৫-১৯
কিন্তু এরপর সুদীর্ঘ কয়েক’শ বছর পর্যন্ত এই ফিৎনা আর তেমন দেখা যায়নি। তবে বিগত শতাব্দী থেকে এই ফিৎনা আবারও দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে মিসর, ইরাক, ভারত এবং বাংলাদেশে। এদের মূল টার্গেট হলো, দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে জনসাধারণকে সন্দিহান করা। যার বিস্তারিত আলোচনা নিন্মে পেশ করা হলো।
ষড়যন্ত্রের রুপরেখা:
মুলত ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের বর্তমান ষড়যন্ত্রের একটি গভীর ধারা আমাদের অগোচরে। তারা শতশত বছর ধরে গবেষণা করে দেখেছে যে, মুসলমানরা মূলত কুরআনের মাধ্যমেই প্রভাবিত হয়। সেহেতু তারা কুরআন শরীফকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য ভারত উপমহাদেশেই কুরআন শরীফের লক্ষ লক্ষ কপি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো, হাফেজদের ধরে ধরে যবাই করেছিলো। যা ইতিহাসের পাতায় এখনও লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু এত কিছু করার পরও তারা কুরআন মাজীদকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে দিতে পারেনি। তখন তারা ষড়যন্ত্রের রুপরেখা পরিবর্তন করলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো, ‘যেহেতু আমরা কুরআন উঠিয়ে দিতে পারলাম না এবং মুসলিমদের জাগরণ থামাতে পারছি না, সুতরাং প্রমাণ হচ্ছে কুরআন শরীফের কপি জ্বালিয়ে আমরা সফলতা পাবো না। অতএব এখন থেকে ভিন্ন কাজ করতে হবে।’ সেটা কি? তারা সিদ্ধান্ত নিলো, কুরআনের কপি থাকবে, তবে কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে পরিবর্তণ করতে হবে। এজন্য তারা সকল তাফসীরকে সমাজ থেকে উঠিয়ে দিতে কিছু টুপিওয়ালাদের ব্যবহার করলো। যার মূখপাত্র হিসাবে বাংলাদেশে কাজ করছে QRF বা কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামক একটি সংগঠন। যখন পুরাতন তাফসীরকে সমাজ থেকে বয়কট করা হবে, তখন সবাই নিজ ইচ্ছামত তাফসীর করবে। ফলে কুরআন থাকলেও কুরআনের সঠিক রুপ হারিয়ে যাবে। তারা তাদের মিশনে সফল হবে।
উপরন্তু জেনে রাখা উচিৎ যে, হাদিস শরীফেও কুরআন শরীফের তাফসীর করা হয়েছে। আর এ কারণেও তারা হাদিস শরীফ অস্বীকার করার হিম্মত করেছে। সুতরাং হাদিস-সুন্নাহ যদি সমাজ থেকে উঠিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তারা ফাকা মাঠে গোল দিয়ে ইসলামকে মূহুর্তেই শেষ করে দিতে পারবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। আল্লাহর দ্বীন আল্লাহ হিফাযত করবেন। আমাদের দায়িত্ব সতর্ক হওয়া ও সতর্ক করা।
নব্য আহলে কুরআনদের দাবি:
ইসলামের অনেক বিষয়ে অপব্যাখ্যা করে তারা উম্মতের মধ্যে বিভ্রান্তি ও কুফরী ছড়াচ্ছে। তাদের অন্যতম দাবি হলো, মুসলিম হতে হলে শুধু আল্লাহ তা’য়ালার হুকুমই মানতে হবে। কুরআনে বর্ণিত বিধানাবলীর বাহিরে কোনো কিছুই মানা যাবে না। এমনকি কেউ যদি আল্লাহর বিধানের মত রাসুলুল্লাহ সা. এর বিধানও মানে, তাহলে সেও আবু জেহেলের মত মুশিরক।
ইসলাম কি বলে?
প্রিয় পাঠক, ইসলাম হলো একটি জিবন ব্যবস্থা। পৃথিবীতে এমন কোনো বিষয় নেই, যার সমাধান ইসলামে নেই। আর এ সকল সমাধান আল্লাহ তা’আলা পাঠিয়েছেন রাসুলুল্লাহ সা. এর মাধ্যমে। কিন্তু সব বিষয় বিস্তারিতভাবে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়নি। এজন্য মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে তিনটি দিক খেয়াল করে আমল করতে বলেছেন। (১. আল্লাহ তা’য়ালা, ২. রাসুলুল্লাহ সা. ৩. اولوا الامر তথা সাহবায়ে কেরাম বা ফুকাহায়ে কেরাম।) এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে। ইনশাআল্লাহ। চলুন প্রথমত দেখা যাক যে, শুধু কি কুরআনই মানতে হবে?
শুধু কি কুরআনই মানতে হবে?
এক.
পবিত্র কুরআনে কোথাও এ কথা উল্লেখ্য নেই যে, শুধু আল্লাহর বিধান তথা কুরআনে কারীমকেই মানতে হবে। এটা নিছক এই ভষ্ট্রদের বানানো একটা কুফরী কথা মাত্র, বরং আল্লাহ তা’আলা বলেন,
قُلْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ فإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ
অর্থ: বলুন, আল্লাহ এবং রসূলের আনুগত্য প্রকাশ করো। বস্তুতঃ যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদিগকে ভালবাসেন না।
সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩২
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা প্রথমে তাঁকে মানতে বলেছেন। এর পরপরই রাসুলুল্লাহ সা. কে মানতে বলা হয়েছে। আর যারা এ দু’টি বিষয় অমান্য করে তাদেরকে কাফের বলা হয়েছে। সুতরাং প্রমাণ হলো, যারা শুধুমাত্র আল্লাহকেই মানেন, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সা. কে মানেন না, তারা আল্লাহর সিদ্ধান্তানুযায়ী কাফের।
অভিযোগ:
উক্ত আয়াত দলীল হিসাবে পেশ করার পর তারা অভিযোগ স্বরে বলেন যে, ‘যেহেতু নবীজি সা. আল্লাহর বাণী প্রচার করেন, এজন্যই তাঁকে মানার কথা বলা হয়েছে। আলাদাভাবে রাসুলুল্লাহ সা. কে মানার জন্য নয়।’
জবাব: ১
‘নবীজি সা. যেহেতু আল্লাহর বাণী প্রচার করতেন, এজন্যই তাঁকে মানার কথা বলা হয়েছে।’ এই কথাটি তারা কোথায় পেলো? উক্ত আয়াতে তো এ ধরণের কোনো কথা আল্লাহ তা’আলা বলেননি। বুঝা গেলো, এই কথাটি তারা নিজেরা আবিস্কার করে মহান আল্লাহ’র উপর মিথ্যারোপ করেছেন। আর এমন মিথ্যুকদের ব্যাপারে মহান রব আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ
অর্থ: আর যে, আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অথবা তাঁর নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে, তার চাইতে বড় জালেম কে? নিশ্চয় জালেমরা সফলকাম হবে না।
সূরা আনআম, আয়াত: ২১
সুৎরাং বুঝা গেলো, এরা কুরআন সম্পর্কেও আল্লাহর নামে মনগড়া মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। যার পরিনাম বড় ভয়ানক।
জবাব: ২
হয়তো তারা বলবেন যে, সব কিছু কি কুরআন দিয়ে বুঝতে হয়? কিছু বিষয় তো commonsense (সাধারণ জ্ঞান) দিয়েও বুঝা যায়। তাহলে আমি বলবো-
প্রথমতঃ যাদের কাছে হাদিস শরীফই দলীলযোগ্য হতে পারে না, তাদের কাছে কমনসেন্স দলীল হয় কেমনে? এটা কোন আয়াত দিয়ে প্রমাণিত করবে তারা?
দ্বিতীয়তঃ কমনসেন্স সবার এক রকম হয় না। এই যেমন ধরুন এই আয়াতেই তারা বুঝলো এক রকম, আর আমরা বুঝলাম আরেকরকম। তাহলে কুরআনের সঠিক অর্থ কি সেটা বুঝবো কিভাবে? বরং ১০ জন ১০ রকম ব্যাখ্যা করলে সঠিক অর্থ হারিয়ে যাবে। এজন্য রাসুলুল্লাহ সা. কে মানতে হবে। তাহলেই সঠিক অর্থ জানা যাবে। কারণ আল্লাহ তা’আলা নিজেই রাসুলুল্লাহ সা. কে কুরআনের সঠিক অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,
ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ
অর্থ: এরপর বিশদ বর্ণনা আমারই ।
সূরা কিয়ামাহ, আয়াত: ১৮-১৯
অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা রাসুলুল্লাহ সা. কে বলে দিলেন, হে নবী, এ কুরআনের বিশদ বিবরণ বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমি আল্লাহর।
সুতরাং বুঝা গেলো, রাসুলুল্লাহ সা. কে না মানলে কুরআনকে বুঝা ও মানা সম্ভব নয়। অতএব কুরআন মাজীদ বুঝতে হলেও রাসুলুল্লাহ সা. এর দেওয়া ব্যখ্যাকেও মানতেই হবে। কেননা আল্লাহ দিলেন কুরআনের আয়াত, আর রাসুলুল্লাহ সা. আল্লাহ প্রদত্ত ব্যাখ্যা উম্মতকে জানিয়ে দেবেন। এটা আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক রাসুলুল্লাহ’র সা. উপর অর্পিত দায়িত্ব৷ এখন যদি আল্লাহর মত রাসুলুল্লাহ সা. কে মানা শিরক হয়, তাহলে নবীজির সা. করা ব্যাখ্যা মানলেও তো শিরক হয়ে যাবে। তাহলে তো বিষয়টি এমন হবে যে আল্লাহ তা’আলাই তাঁর বান্দাকে শিরক মানতে বললেন! নাউযুবিল্লাহ।
দুই.
‘নবীজি সা. যেহেতু আল্লাহর বাণী প্রচার করতেন, এজন্য তাঁকেও মানার কথা বলা হয়েছে।’ এটা যদি যুক্তিসঙ্গত হয়, তাহলে আল্লাহর বাণী তো প্রথম নিয়ে এসেছিলেন বা নবীজির সা. কাছে সর্বপ্রথম প্রচার করেছিলেন হযরত জিবরাঈল আ.। তাহলে তো উক্ত আয়াতে রাসুলুল্লাহ সা. এর স্থলে জিবরাঈল আ. কে মানার কথা বলার দরকার ছিলো। কিন্তু এতদ্বসত্ত্বেও জিব্রাঈল আ. এর কথা কেন বলা হয়নি? সুতরাং বুঝা গেলো, ‘আয়াতটি দ্বারা যদি শুধু মাত্র কুরআন মানাই উদ্দেশ্য হতো, তাহলে হযরত জিকরাঈল আ. এর কথাই আগে বলা হতো। সুতরাং প্রমাণ হলো, এখানে রাসুলুল্লাহ সা. কে মানার অর্থ শুধু কুরআন মানার নয়, বরং নবীজির সা. আদেশ-নিষেধ সবই। চাই সেটা কুরআনে কারীমে বর্ণিক হোক বা নবীজির সা. সুন্নাহই বর্ণিত হোক।
তিন.
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, أَطِيعُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ অর্থাৎ আল্লাহ এবং রসূলের আনুগত্য প্রকাশ করো। আয়াতটির মধ্যে দু’টি আদেশের মাঝে হরফে আতফ واو তথা ‘এবং’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আর এটা যেকোনো শিক্ষিত মানুষই বুঝবেন যে, ‘এবং’ শব্দটি সব সময় আলাদা বিষয় বুঝানোর জন্য বলা হয়। ফলে অর্থ দাঁড়াবে ‘আল্লাহর বিধান মানার পাশাপাশি নবীজির সা. বিধানও মানতে হবে।
একটি উদহরণ:
মনে করুন, আপনি কোনো দোকানে গিয়ে দু’টি পন্য ক্রয় করলেন। একটার দাম ৫৫ টাকা, অপরটার দাম ৪৫ টাকা। দোকানদার যখন আপনাকে দু’টি পন্যের টাকার হিসাব ক্যালকুলেটরে তুলবেন, তখন তিনি যোগ করবেন এভাবে, ৫৫+৪৫=১০০/-। এখন দোকানদার হিসাব করে আপনাকে বললেন, দুটি পন্য একটার দাম ৫৫ টাকা এবং আরেকটার দাম ৪৫ টাকা। মোট ১০০ টাকা দিন। কিন্তু আপনি তো পন্ডিত মানুষ। আপনি ‘এবং’ শব্দটা না মেনে তাকে শুধু প্রথম পন্যের ৫৫ টাকা দিয়ে চলে আসলেন। কিন্তু দোকানদার ‘এবং ৪৫ টাকা’ শব্দটা বলে তিনি আরও বাকি ৪৫ টাকা চাইলেন। কিন্তু আপনি তো ‘এবং’ শব্দের মাধ্যমে আলাদা কিছু মানতে চা না।
ফলে আপনি তাকে বললেন, আমি যেহেতু প্রথম পন্যের টাকা আপনাকে দিয়েছি, সুতরাং পরের ‘এবং ৪৫ টাকা’ আপনি চাইতে পারেন না। কারণ আমি ‘এবং’ শব্দের মাধ্যমে একটাই বুঝি, আলাদা কিছু মানি না। এখন আপনিই বলুন, পিঠ বাঁচবে? নিশ্চয় না। কেন? কারণ ‘এবং’ শব্দের উপর আপনি আমল করেননি। সুতরাং যদি দুনিয়ার আদালতে ‘এবং’ শব্দ না মানার কারণে পিঠ না বাঁচে, তাহলে কিয়ামতের আদালতে ‘এবং রাসুলকে মানো’ শব্দটির আমল না থাকলে কিভাবে জাহান্নাম থেকে বাঁচবেন?
চার.
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে, উক্ত আয়াতে মূলত নবীজিকে সা. আলাদাভাবে মানতে বলা হয়নি। এজন্যই বলা হয়েছে, যেহেতু তিনি কুরআনে কারীমের প্রচারক। তারপরও অসুবিধা নেই। কারণ এই আয়াতটিই শুধু আমাদের দলীল নয়। কারণ আরও অসংখ্য আয়াতে নবীজি সা. কে মানতে খোদ আল্লাহ তা’আলাই নির্দেশ নিয়েছেন।
দুই.
মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا
অর্থ: রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো।
সূরা, হাশর, আয়াত: ৭
উক্ত এখানে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট করে বলেছেন রাসুলুল্লাহ’র আদেশ নিষেধ সবকিছু মানতে।
অভিযোগ:
এখানে গণীমতের মালের কথা বলা হয়েছে, নবীজির আদেশ-নিষেধের কথা নয়।
জবাব:
এক.
আয়াতের কোথায় গণীমতের কথা লেখা আছে এটা? নিশ্চয় নেই। তাহলে কেন বললেন? তখন তারা বলবে, আয়াতের শানে নুযুলে বিষয়টি লেখা আছে। শানে নুযুলটা কোথায় পেলেন? তখন তারা বলবে, সাহাবা বা তাফেয়ীনগণের তাফসীর থেকে জেনেছি। তখন প্রশ্ন করা উচিৎ আপনারাই তো বলেন, কুরআনের বাহিরে কিছু মানা শিরক। তাহলে নবীজির সা. হাদিস মানলে যদি শিরক হয়, তাহলে আপনাদের দাবিতে তাফসীর মেনে আপনারাও শিরক করলেন।
দুই.
আয়াতের শানে নুযুলের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের রা. কথা মানা যদি বৈধ হয়, তাহলে দ্বীনের ক্ষেত্রে নবীজিকে রা. মানা কেন অবৈধ হবে?
তিন.
উক্ত আয়াতে যদিও গণীমতের মালের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কুরআনে কারীমের আয়াত নাযিল হয় কোনো এক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে, কিন্তু বিধান হয় ব্যাপক। এতটুকু জ্ঞান যাদের নেই, তারা তো বিভ্রান্ত হবেই।
চার.
যদি ধরেও নিই যে, উক্ত আয়াতটি শুধুমাত্র গণীমতের মালের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সা. কে মানতে বলা হয়েছে। তাহলে গণীমতের মালের যদি রাসুলুল্লাহ সা. কে মানা যায়, তাহলে অন্যন্য ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সা. মানা যাবে না, এটা কি বোকামী আর মূর্খতা নয়?
পাঁচ.
উক্ত আয়াতে ما (যা কিছু) বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো, রাসুলুল্লাহ সা. এর জিবনের সকল আদেশ-নিষেধ মানতে বলা হয়েছে। এ আদেশ নিষেধ চাই পবিত্র কুরআনে উল্লেখ্য থাক বা না থাক। উপরন্তু আর আমরা জানি রাসুলুল্লাহ’র সা. কোনো আদেশ-নিষেধ কুরআনে বর্ণিত হয়নি। সুতরাং বুঝা গেলো, আয়াতটিতে বিশেষ করে কুরআনে যেগুলো উল্লেখ্য নেই, সেগুলোর দিকে আল্লাহ তা’আলা ইশারা করেছেন। সার কথা হলো, রাসুলুল্লাহ সা. পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে যে আদেশ নিষেধ করেছেন, সেটাও যেমন মানতে হবে, তেমনি হাদিসের মাধ্যমে যে আদেশ নিষেধ করেছেন, সেটাও মানতে হবে। কারণ ওহী দুই প্রকার: এক. متلو তথা পবিত্র কুরআন। দুই. غير متلو তথা নবীজির সুন্নাহ।
সুতরাং উক্ত আয়াত দিয়েও প্রমাণ হলো, ‘শুধু কুরআনে মাজীদ মানতে হবে’ এটা পবিত্র কুরআন বিরোধী কথা, বরং আল্লাহর কুরআনের পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ’র সা. সকল বিধিবিধান মানতে হবে।
তিন.
মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
অর্থ: বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।
সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১
প্রিয় পাঠক, উক্ত আয়াতে কিন্তু আল্লাহর মহব্বতের জন্য নবীজির সা. অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এখানে শুধু কুরআন মানতে হবে এটা কিন্তু বলা হয়নি। ফলে এর অর্থ দাঁড়ায় যে, আল্লাহর মহব্বত পেতে হলে রাসুলুল্লাহ সা. এর সকল বিষয়ের নির্দেশনাবলীর অনুসরণ করতে হবে। চাই সেটা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত থাকুক বা না থাকুক। সবই মানতে হবে। যদি শুধু কুরআনে কারীম মানলেই আল্লাহর মহব্বত পাওয়া যেতো, তাহলে এখানে আল্লাহ তা’আলা শুধু কুরআনে মাজীদ মানার কথাই বলতেন। সুতরাং প্রমাণ হলো, শুধু কুরআন মাজীদ মানতে হবে রাসুলুল্লাহ সা. কে মানা যাবে না এটা পবিত্র কুরআন বিরোধী কুফরী মন্তব্য।
চার.
মহান রব বলেন,
وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
অর্থ: আপনার কাছে আমি স্মরণিকা (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বিস্তারিত বর্ণনা করেন, যে গুলো তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।
সূরা নাহল, আয়াত: ৪৪
উক্ত আয়াতে মহান রব শুধু কুরআনের আয়াত তিলাওয়াতের কথা নবীজিকে সা. বলেননি, বরং لِتُبَيِّنَ বলে পবিত্র কুরআনের বিস্তারিত আলোচনার কথা নবীজিকে সা. বলা হয়েছে। যদি শুধু কুরআনের আয়াতের কথা বলা হতো, তাহলে لتتلو তিলাওয়াতের কথা বলা হতো। বুঝা গেলো, শুধু আয়াত যথেষ্ট নয়, বরং রাসুলুল্লাহ সা. এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়া কুরআন বুঝাও সম্ভব নয়, মানাও সম্ভব নয়। অতএব কুরআন মানতে হলেও রাসুলুল্লাহ সা. কে মানা ছাড়া কোনো উপায় রইল না।
পাঁচ.
মহান আল্লাহ বলেন,
قَدْ جَاءكُم مِّنَ اللّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ يهْدِي بِهِ اللّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلاَمِ وَيُخْرِجُهُم مِّنِ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ
অর্থ: তোমাদের কাছে একটি উজ্জল জ্যোতি (নবী) এসেছে এবং একটি সমুজ্জল গ্রন্থ। এর দ্বারা আল্লাহ যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং সরল পথে পরিচালনা করেন।
সূরা মায়িদা, আয়াত: ১৫-১৬
উক্ত আয়াতে হিদায়াতের রাস্তা দিতে মহান আল্লাহ দু’টি বিষয় পাঠিয়েছে। কিতাবুল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ সা.। সুতরাং হিদায়াত পাওয়ার জন্য অবশ্যই এ দুটি বিষয় মানতেই হবে। শুধু কুরআন মানলেই যে হিদায়াত পাওয়া যাবে বিষয়টি এ আয়াত বিরোধী বক্তব্য।