রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েবের সকল বিষয় জানেন বলে অনেকে দাবি করে বসেছেন। অথচ গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। প্রথমে নিন্মে কয়েকটি আয়াত ও হাদিস পেশ করছি,
মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম-কে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন যে,
قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أعلمُ الْغَيْبَ
(হে নবী! তাদেরকে) বলো, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন ভাণ্ডার রয়েছে এবং অদৃশ্য সম্পর্কেও আমি (পরিপূর্ণ) জ্ঞান রাখি না। -সুরা আনআম : ৫০
قُل لَّا يَعْلَمُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ ۚ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ
বলে দাও, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়েব জানে না। এবং মানুষ জানে না তাদেরকে কখন পুনর্জীবিত করা হবে। [আন নামল : ৬৫]
وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ ۚ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ۚ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
আর তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের কুঞ্জি। তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা জানে না। স্থলে ও জলে যা-কিছু আছে, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত। (কোনও গাছের) এমন কোনও পাতা ঝরে না, যে সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন। মাটির অন্ধকারে কোনও শস্যদানা অথবা আর্দ্র বা শুষ্ক এমন কোনও জিনিস নেই যা এক উন্মুক্ত কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই। [আল আনআ’ম : ৫৯]
قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۚ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ ۚ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
বল, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ইচ্ছা না করেন, আমি আমার নিজেরও কোন উপকার ও অপকার করার ক্ষমতা রাখি না। আমার যদি গায়েব সম্পর্কে জানা থাকত, তবে ভালো-ভালো জিনিস প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহ করে নিতাম এবং কোনও রকম কষ্ট আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো কেবল একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা সেই সকল লোকের জন্য, যারা (আমার কথা) মানে। -সুরা আরাফ : ১৮৮]
وَيَقُولُونَ لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ آيَةٌ مِّن رَّبِّهِ ۖ فَقُلْ إِنَّمَا الْغَيْبُ لِلَّهِ فَانتَظِرُوا إِنِّي مَعَكُم مِّنَ الْمُنتَظِرِينَ
তারা বলে, এ নবীর প্রতি তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে কোনও নিদর্শন কেন অবতীর্ণ করা হল না? (হে নবী! উত্তরে) তুমি বলে দাও, অদৃশ্যের বিষয়সমূহ তো কেবল আল্লাহরই এখতিয়ারে। সুতরাং তোমরা অপেক্ষা কর। আমিও তোমাদের সঙ্গে অপেক্ষা করছি। [সুরা ইউনুস : ২০]
وَلَا أَقُولُ لَكُمْ عِندِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ إِنِّي مَلَكٌ وَلَا أَقُولُ لِلَّذِينَ تَزْدَرِي أَعْيُنُكُمْ لَن يُؤْتِيَهُمُ اللَّهُ خَيْرًا ۖ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا فِي أَنفُسِهِمْ ۖ إِنِّي إِذًا لَّمِنَ الظَّالِمِينَ
(হে নবি, আপনি বলুন,) আমি তোমাদেরকে বলছি না যে, আমার হাতে আল্লাহর ধন-ভাণ্ডার আছে, এবং এটাও নয় যে, আমি গায়েব জানি এবং আমি একথাও বলছি না যে, আমি কোনও ফেরেশতা। ২১ তোমাদের দৃষ্টিতে যারা হেয়, তাদের সম্পর্কে আমি একথা বলতে পারি না যে, আল্লাহ তাদেরকে কোনও মঙ্গল দান করবেন না। তাদের অন্তরে যা-কিছু আছে, তা আল্লাহই সর্বাপেক্ষা বেশি জানেন। আমি তাদের সম্পর্কে এরূপ কথা বললে নিশ্চয়ই আমি জালিমদের মধ্যে গণ্য হব। -সুরা হুদ : ৩১
অভিযোগ:
অবশ্য এ আয়াত দিয়ে দলিল পেশ করলে, তারা অভিযোগ করে বলে থাকে যে, হাদিসে তো এসেছে
وإنِّي أُعْطِيتُ مَفاتِيحَ خَزائِنِ الأرْضِ، أوْ مَفاتِيحَ الأرْضِ
আর অবশ্যই আমাকে পৃথিবীর ভান্ডারসমূহের চাবিগুচ্ছ প্রদান করা হয়েছে। -সহিহ বুখারী, হাদিস : ৪০৮৫
জবাব:
১. উক্ত হাদিসে ‘مَفاتِيحَ خَزائِنِ الأرْضِ অর্থাৎ পৃথিবীর ভান্ডারসমূহের চাবিগুচ্ছ’ এর ব্যাখ্যায় ইলমে গায়েবের কথা বলা হয়নি, বরং মুহাদ্দিসিনে কেরাম এর ব্যাখ্যায় পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রে ইসলামের বিজয় ইত্যাদী উদ্দেশ্য বলে লিখেছেন । এ ব্যাপারে ‘ফাতহুল বারী লিইবনে হাজার’ শরহু মুসলিম লিল ইমাম নববী’ তে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এরপরও যদি ইলম ধরে নিই তবুও এটা দ্বারা ‘নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল ইলমে গায়েবের মালিক’ একথা প্রমাণ হয় না। কারণ এখানে শুধু দুনিয়ার ধনভাণ্ডারের কথা বলা হয়েছে। তথাপি তিনি দুনিয়ার সকল ইলম জানতেন না বলে তিনি নিজেই বলেছেন। আবদুল্লাহ্ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَفَاتِيْحُ الْغَيْبِ خَمْسٌ ثُمَّ قَرَأَ (إِنَّ اللهَ عِنْدَه عِلْمُ السَّاعَةِ)
গায়বের চাবি পাঁচটি। এরপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন,
اِنَّ اللّٰہَ عِنۡدَہٗ عِلۡمُ السَّاعَۃِ ۚ وَیُنَزِّلُ الۡغَیۡثَ ۚ وَیَعۡلَمُ مَا فِی الۡاَرۡحَامِ ؕ وَمَا تَدۡرِیۡ نَفۡسٌ مَّاذَا تَکۡسِبُ غَدًا ؕ وَمَا تَدۡرِیۡ نَفۡسٌۢ بِاَیِّ اَرۡضٍ تَمُوۡتُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ
নিশ্চয়ই কিয়ামত (-এর ক্ষণ) সম্পর্কিত জ্ঞান কেবল আল্লাহরই কাছে আছে। (তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই জানেন মাতৃগর্ভে কী আছে। কোন প্রাণী জানে না সে আগামীকাল কী অর্জন করবে এবং কোন প্রাণী এটাও জানে না যে, কোন ভূমিতে তার মৃত্যু হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত, সবকিছু সম্পর্কে পরিপূর্ণ খবর রাখেন।) -সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৪৭৭৮
এভাবে কোরআনের আরো বহু আয়াত পেশ করা যাবে। যেগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল গায়েব জানতেন না। এ ছাড়াও হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আনাস রা. সূত্রে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন,
لَيَرِدَنَّ عَلَيَّ نَاسٌ مِنْ أَصْحَابِي الْحَوْضَ حَتَّى عَرَفْتُهُمْ اخْتُلِجُوا دُونِي فَأَقُولُ أَصْحَابِي فَيَقُولُ لاَ تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ
(কিয়ামতের দিন) আমার সামনে আমার উম্মাতের কতক লোক হাউযের কাছে আসবে। তাদেরকে আমি চিনতে পারবো। আমার সামনে থেকে তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি বলবো, এরা আমার উম্মাত। তখন আল্লাহ্ বলবেন, তুমি জানো না তোমার পরে এরা কী সব নতুন নতুন মত ও পথ বের করেছিল। -সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৬৫৮২
উপরন্তু বিরে মাউনার ঐতিহাসিক ঘটনায় বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম-এর সাথে প্রতারণা করে দাওয়াতি কাজের বাহানা দিয়ে ৭০ জন সাহাবীকে একটি প্রতারকচক্র নিয়ে যায় এবং তাদেরকে শহীদ করা হয়। সে ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো সেই সাহাবীদের দুআ। তাঁরা শাহাদাতের পূর্বে দুআ করেছিলেন,
فَقَالُوا اللَّهُمَّ بَلِّغْ عَنَّا نَبِيَّنَا أَنَّا قَدْ لَقِينَاكَ فَرَضِينَا عَنْكَ وَرَضِيتَ عَنَّا
হে আল্লাহ আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের নবীর নিকট সংবাদ পৌছিয়ে দিন যে, আমরা আপনার সন্নিধানে পৌছে গিয়েছি এবং আপনার প্রতি সন্তুষ্ট রয়েছি। আর আপনিও আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট রয়েছেন। -সহিহ মুসলিম : হাদিস নং : ৬৭৭
এখানে দুটি বিষয় পণিধানযোগ্য-
এক. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি সকল বিষয়ের জ্ঞান জানতেন, তাহলে এই সকল সাহাবীদের নিশ্চিত বিপদ জেনেও তিনি কী সাহাবাদেরকে শত্রুদের হাতে তুলে দিতেন? এটা কোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষের পক্ষে কী কোনোভাবেই বিশ্বাস করা সম্ভব? যেহেতু তিনি সাহাবাদেরকে পাঠিয়েছিলেন, এটাই প্রমাণ যে তিনি গায়েবের সকল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন না।
দুই. সাহাবারাও রা. জানতেন যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল গায়েবের খবর জানেন না। এজন্য তাঁরা দুআ করেছিলেন, হে আল্লাহ আমাদের খবর তোমার নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট পৌঁছে দাও।
তাহলে তিনি ভবিষ্যতবানী করতেন কীভাবে?
তাহলে প্রশ্ন হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো ভবিষ্যতের অনেক বিষয় অগ্রীম সতর্ক করে গেছেন, যেমন কিয়ামতের আলামতসমূহ এবং যা বাস্তবেই ঘটে চলেছে। তাহলে তিনি এগুলো কীভাবে বলে গেলেন? এটা কী গায়েব জানার প্রমাণ নয়?
জবাব:
মূলত যেসকল বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অগ্রীম ভবিষ্যতবানী করে গেছেন, সেগুলো তিনি ওহির মাধ্যমে আল্লাহপাকের কাছ থেকেই জেনে বলে গেছেন। এ কথাটাও পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন।
عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِن رَّسُولٍ فَإِنَّهُ يَسْلُكُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ رَصَدًا
তিনিই সকল গায়েব বিষয় জানেন। তিনি তাঁর গায়েবের জ্ঞান সম্পর্কে কাউকে অবহিত করেন না। তবে তিনি যাকে (এ কাজের জন্য) মনোনীত করেছেন সেই রাসুল ছাড়া। এরূপ ক্ষেত্রে তিনি সেই রাসূলের সামনে ও পেছনে কিছু প্রহরী নিযুক্ত করেন। -সুরা জ্বিন : ২৬-২৭
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা ছাড়া আলিমুল গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞাতা আর কেউ নেই। তবে তিনি তাঁর নবি-রাসুলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা করেন ওহীর মাধ্যমে গায়েবের সংবাদ দান করেন। এরূপ ক্ষেত্রে ফেরেশতাগণকে সেই ওহীর পাহারাদার করে পাঠানো হয়, যাতে শয়তান তাতে কোন রকমের হস্তক্ষেপ করতে না পারে। এ কথার প্রমাণ নিন্মের আয়াত থেকেই পাওয়া যায়। মহান রব বলেন,
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
সে তার নিজ খেয়াল-খুশী থেকে কিছু বলে না। এটা তো খালেস ওহী, যা তাঁর কাছে পাঠানো হয়। -সুরা আন-নাজম : ৩-৪
আর এটাকেই অনেকে গায়েব মনে করে বিতর্ক শুরু করে দেয়। আশ্চর্য! এটা যদি গায়েব হয়, তাহলে ওহী কোনটা? তাছাড়া এ জাতীয় গায়েব তো রাসূল সাঃ এর আগেই জিব্রাইল আঃ জানতেন। তাহলে কী জিবরাঈলকেউ আ. আলিমুল গায়েব বলা যাবে?
পরিশিষ্ট:
এ ব্যাপারে সর্বশেষ একটি হাদিস পেশ করতে চাই। আম্মাজান আয়িশাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন
وَمَنْ حَدَّثَكَ أَنَّهُ يَعْلَمُ الْغَيْبَ فَقَدْ كَذَبَ وَهُوَ يَقُولُ لاَ يَعْلَمُ الْغَيْبَ إِلاَّ اللهُ
আর যে ব্যক্তি তোমাকে বলে মুহাম্মাদ সাঃ গায়েব জানেন, সেও মিথ্যা বলল। কেননা আল্লাহ্ বলেন, গায়িব জানেন একমাত্র আল্লাহ্। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৭৩৮০