Home > কুরবানীর মাসআলা > যিলহজ্ব মাসের প্রথম ১০ দিনের বিশেষ আমল

যিলহজ্ব মাসের প্রথম ১০ দিনের বিশেষ আমল

 

জিলহজ্ব মাসের আমল অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল।
হাদিস শরীফে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ الْعَشْرِ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَلاَ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏وَلاَ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ

অর্থ: হযরত ইবনু আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এমন কোন দিন নেই যে দিনসমূহের সৎকাজ আল্লাহ্ তা’আলার নিকট জিলহজ্ব মাসের এই দশ দিনের সৎকাজ অপেক্ষা বেশি প্রিয়। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ্ তা’আলার পথে জিহাদ করাও কি (এত প্রিয়) নয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ তা’আলার পথে জিহাদও তার চেয়ে বেশি প্রিয় নয়। তবে জান-মাল নিয়ে যদি কোন লোক আল্লাহ্ তা’আলার পথে জিহাদে বের হয় এবং এ দুটির কোনটিই নিয়ে যদি সে আর ফিরে না আসতে পারে তার কথা (অর্থাৎ সেই শহীদের মর্যাদা) আলাদা।
সূত্র: জামে তিরমিযি হাদিস: ৭৫৭ আল-মুগনী খ. ৪ পৃ. ৪৪৩ (হাদিসটি সহিহ)

এ মাসে বেশ কিছু আমলের বিষয় রাসুলুল্লাহ সা. দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

এক. বেশি বেশি যিকির-আযকার করা।

এই দশক যেহেতু নেক আমলের বিশেষ সময় তাই এই দশ দিনের যেকোনো আমল, যেমন: আল্লাহর নিকট প্রিয় ও পছন্দনীয় অধিক পরিমাণে নফল নামায আদায় করা, রোযা রাখা, যিকির-আযকার, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদি।

عن عبدالله بن عمر قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ما من أيامٍ أعظمُ عندَ اللهِ ولا أحبَّ إليه العملُ فيهنَّ من هذهِ الأيامِ العشرِ فأكثروا فِيهنَّ من التهليلِ والتكبيرِ والتحميدِ

অর্থাৎ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি সা. বলেন, এমন কোন দিন নেই, যে দিনসমূহের সৎকাজ আল্লাহ্ তা’আলার নিকট জিলহজ্ব মাসের এই দশ দিনের সৎকাজ অপেক্ষা বেশি প্রিয়। সুতরাং এ সময়গুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আলহামদুলিল্লাহ পড়ো।
সূত্র: মুসনাদে আহমাদ হাদিস: ৫৪৪৬ ত্বহাবী: ২৯৭১

দুই. চুল, নখ, মোচ ইত্যাদি না কাটা।

যিলহজ্বের চাঁদ দেখার পর থেকে যারা কুরবানী দেবে এবং যারা দেবে না সবাই কুরবানীর আগ পর্যন্ত নিজের নখ, চুল, মোঁচ, নাভীর নিচের পশম ইত্যাদি না কাটা মুস্তাহাব। কারণ হাদিস শরীফে এসেছে,

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا رَأَيْتُمْ هِلاَلَ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ

অর্থ: হযরত উম্মে সালামাহ্ রা. হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমরা যিলহাজ্জ মাসের (নতুন চাঁদ দেখতে পাও) আর তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে, তবে সে যেন তার চুল না ছাটে ও নখ না কাটে।
সূত্র:সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৯৭৭; জামে তিরমিযি: ১৫২৩ আবু দাউদ: ২৭৯১; সুনানে নাসায়ী: ৪৩৬২ সহীহ ইবনে হিববান: ৫৮৯৭

যে ব্যক্তি কুরবানী করতে সক্ষম নয়, তারাও চুল, নখ, গোঁফ ইত্যাদি কাটবে না, বরং তা কুরবানীর দিন কাটবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ، فَقَالَ الرَّجُلُ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيحَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا قَالَ لَا وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.

অর্থাৎ আমি কুরবানীর দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) আল্লাহ তাআলা তা এ উম্মতের জন্য ঈদ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে অর্থাৎ যা শুধু দুধপানের জন্য দেওয়া হয়েছে? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না; বরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে (মুন্ডাবে বা ছোট করবে), নখ কাটবে, মোঁচ এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে।-
সূত্র: মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৫৭৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৭৭৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৪৩৬৫

অর্থাৎ যারা নেসাব পরিমান মালের মালিক না হওয়ায় কুরবানী করতে সক্ষম নয়, তারাও যেন মুসলমানদের সাথে ঈদের আনন্দ ও খুশি উদযাপনে অংশীদার হয়। এজন্য তারাও এগুলো কর্তন না করে পরিপূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে।পাশাপাশি হাজীদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী হবে।

পাশাপাশি ওলীদ বিন মুসলিম বলেন, আমি মুহাম্মাদ বিন আজলানকে যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন, আমাকে নাফে রাহ বলেছেন যে,

أَنَّ ابْنَ عُمَرَ مَرَّ بِامْرَأَةٍ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِ ابْنِهَا فِي أَيَّامِ الْعَشْرِ فَقَالَ لَوْ أَخَّرْتِيهِ إِلَى يَوْمِ النَّحْرِ كَانَ أَحْسَنَ

অর্থ : আব্দুল্লাহ ইবনে উমর এক নারীর নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। মহিলাটি যিলহজ্বের দশকের ভেতর তার সন্তানের চুল কেটে দিচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, যদি ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তবে বড় ভাল হত।
সূত্র: মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৫২০

এ সম্পর্কে আরেকটি বর্ণনা হল,

قال المعتمر بن سليمان التيمي سمعت أبي يقول كان ابن سيرين يكره إذا دخل العشر أن يأخذ الرجل من شعره حتى يكره أن يحلق الصبيان في العشر

অর্থ: মুতামির ইবনে সুলাইমান আততাইমী  বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি যে ইবনে সীরীন রাহ. যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা অপছন্দ করতেন। এমনকি এই দশকে ছোট বাচ্চাদের মাথা মুণ্ডন করাকেও অপছন্দ করতেন।
সূত্র: আল মুহাল্লা (ইবনে হাযম) খ. ৭ পৃ. ৩৬৯

উপরোল্লিখিত দলীলের আলোকে অনেক উলামায়ে কেরাম বলেন, জিলহজ্ব মাসের প্রথম ১০ দিন গোফ, চুল, নখ না কাটা উচিৎ। তবে বিষেশ করে যারা কুরবানী দেবেন, তাদের ক্ষেত্রে তাকিদ বেশি এবং সুন্নাতও বটে।

তিন. ঈদের দিন ছাড়া বাকি নয় দিন রোযা রাখা।

সিয়াম পালন-রোজা রাখা: যিলহজ মাসরে প্রথম দশ দিনের রোজা রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। যেহেতু অন্যান্য নেক আমলরে মধ্যে সিয়ামও অন্যতম, তাই এ দিনগুলোতে খুব যত্নসহকারে সিয়াম পালন করা।

عَنْ بَعْضِ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجَّةِ وَيَوْمَ عَاشُورَاءَ وَثَلَاثَةَ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ أَوَّلَ اثْنَيْنِ مِنَ الشَّهْرِ وَالْخَمِيسَ

অর্থ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো এক স্ত্রী সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ মাসের নয় তারিখ পর্যন্ত, আশুরার দিন, প্রত্যেক মাসে তিনদিন, মাসের প্রথম সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন।
সূত্র: সুনান আবু দাউদ হাদিস: ২৪৩৭ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২২২৩৪; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ২৪১৬

অপর একটি হাদিসে এসেছে,

عن حفصة رضى الله عنها قالت أربع لم يكن يدعهن النبي صلى الله عليه وسلم صيام عاشوراء والعشر وثلاثة أيام من كل شهر والركعتين قبل الغداة

অর্থ: হযরত হাফসা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো চারটি আমল পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হল: আশুরার রোযা, যিল হজ্বের দশ দিনের রোযা, প্রত্যেক মাসে তিন দিনের রোযা, ও ফজরের পূর্বের দুই রাকাত নামাজ।
সূত্র: সহিহ ইবনে হিব্বান হাদিস: ৬৪২২ মুসনাদে আবু ইয়ালা: ৭০৪২ মুসনাদে আহমাদ: ২৬৩৩৯

চার. নয় যিলহজ্ব রোযা রাখা মুস্তাহাব।

যিলহজ্বের প্রথম নয় দিন অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ নয় দিনের মধ্যে নবম তারিখ সবচে গুরুত্বপূর্ণ দিবস।

قَالَتْ عَائِشَةُ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللَّهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهُ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِي بِهِمُ الْمَلاَئِكَةَ فَيَقُولُ مَا أَرَادَ هَؤُلاَءِ

অর্থ: হযরত আয়েশাহ রা. বলেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আরাফাহ দিবসের (নয় জিলহজ্ব) তুলনায় এমন কোন দিন নেই- যেদিন আল্লাহ তা’আলা সর্বাধিক সংখ্যক লোককে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তা’আলা নিকটবতী হন, অতঃপর বান্দাদের সম্পর্কে মালায়িকার সামনে গৌরব প্রকাশ করেন এবং বলেনঃ তারা কী উদ্দেশে সমবেত হয়েছে (বা তারা কী চায়)?
সূত্র: সহিহ মুসলিম হাদিস: ১৩৪৮

এ দিনে রোযা সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ। হাদিস শরীফে এসেছে,

عَنْ أَبِي قَتَادَةَ  قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ

অর্থাৎ, আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইয়াওমে আরাফার (নয় যিলহজ্ব) রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, তিনি এর দ্বারা এর আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।
সসূত্র: সহীহ মুসলিম হাদীস: ১১৬২ জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪২৫

হযরত সাহল ইবনে সা’দ আস সায়েদী রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি সা. বলেন,

من صام يوم عرفة غفر له سنتين متتابعتين

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আরাফার দিন রোযা রাখবে তার লাগাতার দুই বছরের (গুনাহ ক্ষমা করা হবে।
সূত্র: আত-তারগীব খ. ২ পৃ. ১২৭ মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস: ৭৫৪৮ মাজমাউয যাওয়াইদ: ৫১৪১

আরাফার দিন মানে কত তারিখ?

বি:দ্র: উপরোল্লিখিত হাদীসে বর্ণিত ইয়াওমে আরাফা দ্বারা আরাফার মাঠের আমল উদ্দেশ্য নয়,বরং যিলহজ্বের নয় তারিখ উদ্দেশ্য। এই তারিখের পারিভাষিক নাম হচ্ছে ইয়াওমে আরাফা। ‘ইয়াওমে আরাফা’ মানে যে ৯ জিলহজ্ব এর কয়েকটি প্রমাণ নিন্মে পেশ করছি,

এক.
আরাফার দিন তো হাজীদের জন্য রোযা না রাখা মুস্তাহাব। কারণ নবীজি সা. উকুফে আরাফা অবস্থায় রোযা রাখেননি। হাদীস শরীফে এসেছে,

عَنْ أُمِّ الْفَضْلِ بِنْتِ الْحَارِثِ أَنَّ نَاسًا تَمَارَوْا عِنْدَهَا يَوْمَ عَرَفَةَ فِي صَوْمِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ بَعْضُهُمْ هُوَ صَائِمٌ وَقَالَ بَعْضُهُمْ لَيْسَ بِصَائِمٍ فَأَرْسَلَتْ إِلَيْهِ بِقَدَحِ لَبَنٍ وَهُوَ وَاقِفٌ عَلَى بَعِيرِهِ فَشَرِبَهُ

অর্থ: হযরত উম্মুল ফাযল বিনত হারিস রা. সূত্রে বর্ণনা করেন যে, কিছু সংখ্যক লোক ‘আরাফাতের দিনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সওম পালন সম্পর্কে তাঁর কাছে সন্দেহ প্রকাশ করে। তাদের কেউ বলল, তিনি সওম পালন করেছেন। আর কেউ বলল, না, তিনি করেননি। এতে উম্মুল ফাযল (রাযি.) এক পেয়ালা দুধ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট পাঠিয়ে দিলেন এবং তিনি তা পান করে নিলেন। এ সময় তিনি উটের পিঠে (‘আরাফাতে) উকূফ অবস্থায় ছিলেন।
সূত্র: সহীহ বুখারী হাদিস: ১৯৮৮

উক্ত হাদিসকে সামনে রেখে ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন, হাজ্বীদের জন্য আরাফার দিন রোযা না রাখা উত্তম। অথচ হাদিস শরীফে এসেছে,

عَنْ أَبِي قَتَادَةَ  قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ

অর্থাৎ, আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইয়াওমে আরাফার (নয় যিলহজ্ব) রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, তিনি এর দ্বারা এর আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।
সসূত্র: সহীহ মুসলিম হাদীস: ১১৬২ জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪২৫

একটু খেয়াল করুন, নবীজি সা. এ হাদিসে বললেন, আরাফার দিন রোযা রাখা নেকির কাজ, অথচ নবীজি সা. উকুফে আরাফা অবস্থায় রোযা রাখেননি। এর দ্বারা কি প্রমাণিত হয়? আরাফার দিনের রোযা কি আরাফার মাঠের সাথে সম্পৃক্ত? নিশ্চয় না, বরং এটা একটি পারিভাষিক অর্থ “ইয়াওমে আরাফা” কিন্তু বাস্তব অর্থ হলো, জিলহজ্বের নয় তারিখ। সুতরাং বুঝা গেল, হাদীসে ‘ইয়াওমে আরাফা’ দ্বারা নয় যিলহজ্ব অর্থাৎ ঈদের আগের দিনই উদ্দেশ্য।

কারণ কি?

যেহেতু ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান হজ্বের প্রধান রোকন হচ্ছে, “উকুফে আরাফা” ঐ স্থানের তারিখ হিসাবে নয় যিলহজ্বে আদায় করা হয়, তাই এ তারিখেরই নাম হয়ে গেছে ‘ইয়াওমে আরাফা’। একারণে যেসব আমল আরাফা বা উকূফে আরাফার সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়; বরং যিলহজ্বের নয় তারিখের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেগুলোকেও ‘ইয়াওমে আরাফা’র আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, নয় তারিখে বা ঈদের আগের দিন আমলটি করতে হবে।

দুই.
বিষয়টি আরেকটু বুঝার জন্য খেয়াল করুন, মক্কার আরাফায় যে সময় সূর্য ডোবে, তখন মক্কায় পার্শ্ববর্তী যে এলাকায় সূর্য আধা ঘন্টা পরে ডোবে, তাদের ওখানে ইফতারি কি মক্কার আরাফার সময় অনুযায়ী ইফতারি করলে রোযা হবে? নাকি আধা ঘন্টা পরেই করতে হবে? নিশ্চয় রোযা ঠিক রাখতে হলে আধা ঘন্টা পরেই করতে হবে। তাহলে আধা ঘন্টার দূরত্বের ক্ষেত্রে এমনটা করা হলে, যেসব এলাকায় সময়ের দুরত্বে তারিখ বা দিন পরিবর্তন হয় সেসব এলাকায় কেন মক্কার আরাফার দিনের হিসাবে রোযা রাখতে হবে? বুঝা গেল, ইয়াওমে আরাফা দ্বারা ৯ জিলহজ্ব উদ্দেশ্য। যে দেশে যখন ৯ জিলহজ্ব হবে তখন সে এলাকায় রোযা রাখতে হবে।

তিন.
‘তাকবীরে তাশরীক’ সম্পর্কে আগে হাদিসটি দেখা যাক।

عن علي رضي  الله عنه أنه كان يكبر بعد صلاة الفجر يوم عرفة إلى صلاة العصر من آخر أيام التشريق ويكبر بعد العصر

অর্থ: হযরত আলী রা. নয় তারিখ আরাফার দিন ফজর থেকে তের তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীর তাশরিক পড়তেন।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদিস: ৫৬৭৪ বায়হাকি ৬৫০০

তাকবীরে তাশরীক ‘আরাফা’ বা ‘উকুফে আরাফা’র বিশেষ কোনও আমল নয়।  শুরু হয় নয় যিলহজ্ব ফজর থেকে। যাকে এ হাদিসে ‘ইয়াওমে আরাফা’ হিসাবে উল্লেখ্য করা হয়েছে। সুতরাং যে দলীল দ্বারা নয় তারিখ থেকে তাকবীরে তাশরীক শুরু হওয়া প্রমাণিত তাতেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ শব্দই আছে।বুঝা গেল, ইয়াওমে আরাফা মানে হলো, জিলহজ্ব মাসের নয় তারিখ।

চার.

عن ابنِ عبّاسٍ أنَّ الأيّامَ المعلوماتِ عشرُ ذي الحجَّةِ آخرُها يومُ النَّحرِ وأنَّ المعدوداتِ ثلاثةُ أيّامٍ بعدَ يومِ النَّحرِ

অর্থাৎ হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (সুরা বাকারার ২৮ নং আয়াতে বর্ণিত)فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ (নির্দিষ্ট দিনগুলোতে) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, জিলহজ্ব মাসের ১০ দিন। যার শেষ (১০ দিনের নাম) হলো হলো, ইয়ামুন নাহর।
সূত্র: আল-মুহাল্লা খ. ৭ পৃ. ২৭৫

প্রিয় পাঠক, উক্ত বর্ণনায় জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখকে যেমন ইয়াওমে নাহর হিসাবে উল্লেখ্য করা হয়েছে, ঠিক তেমনি জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখকে ইয়াওমে আরাফা হিসাবে উল্লেখ্য করা হয়েছে। এটা একটি জাষ্ট পরিভাষা।

পাঁচ.
সকলে এ কথার উপর একমত যে, ইয়াওমে আরাফার পরের দিনটিই হহলো, ইয়াওমুন নাহর তথা কুরবানীর দিন। আর কুরবানীর দিন শুরু হয় ১০ জিলহজ্বে। তাহলে ইয়ামুন নাহর মানে যদি ১০ জিলহজ্ব হয়, তাহলে তার আগের দিনকে ইয়াওমে আরাফা নাম হলেও সেটা কি ৯ জিলহজ্ব নয়? সুতরাং এটাও প্রমাণ করে যে, ইয়াওমুন নাহর’ যেমন একটি তারিখের নাম,আর তা হচ্ছে দশ যিলহজ্ব, ঠিক তেমনি ‘ইয়াওমে আরাফা’ও একটি তারিখের নাম, আর তা হচ্ছে নয় যিলহজ্ব।

ছয়.
‘ইয়াওমে আরাফা’ মানে মক্কার আরাফার দিনের সময় অনুযায়ী যদি আমল করা শুরু হয়, তাহলে এরপর দিন ইয়ামুন নাহর তথা কুরবানীর দিন, তাহলে মক্কার লোকেরা ঈদ পালন করলে আমাদের দেশেও তো সৌদীর সাথে মিলিয়েই ঈদ পালন করা লাগবে। যা হাস্যকর বিষয়।

সুতরাং আমাদের দেশের চাঁদের হিসেবে যেদিন নয় তারিখ হয়, সে দিনই ইয়াওমে আরাফা হিসেবে রোযা রাখা মুস্তাহাব হবে। সৌদীর হিসাবে আরাফার দিন অনুযায়ী নয়।

তাকবীরে তাশরীক পড়া

নয় যিলহজ্ব হতে তের যিলহজ্ব আছর পর্যন্ত মোট তেইশ ওয়াক্তের নামাযের পর একবার করে তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। জামাতে নামায পড়া হোক বা একাকি, পুরুষ বা নারী, মুকীম বা মুসাফির সকলের উপর ওয়াজিব। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وَاذْكُرُواْ اللّهَ فِي أَيَّامٍ مَّعْدُودَاتٍ

অর্থাৎ আর স্মরণ কর আল্লাহকে নির্দিষ্ট সংখ্যক কয়েকটি দিনে।
সুরাঃ বাকারা আয়াত: ২০৩

একাধিক সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে প্রমাণিত আছে যে, তাঁরা নয় তারিখ আরাফার দিন ফজর থেকে তের তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীর পড়তেন। তন্মধ্যে হলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনে আবি তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. যুহরী, মাকহুল, সুফিয়ান সাওরীসহ প্রমুখ সাহাবা ও তাবেয়ীগণ।

হযরত আলীর রা. আমল:

عن علي رضي  الله عنه أنه كان يكبر بعد صلاة الفجر يوم عرفة إلى صلاة العصر من آخر أيام التشريق ويكبر بعد العصر

অর্থ: হযরত আলী রা. নয় তারিখ আরাফার দিন ফজর থেকে তের তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীর তাশরিক পড়তেন।
সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদিস: ৫৬৭৪ বায়হাকি: ৬৫০০

কোন শব্দে তাকবীর বলবে?

তাকবীরের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শব্দ হাদিসে এসেছে, কিন্তু সবার কাছে সবচে গ্রহণযোগ্য বর্ণিত তাকবীর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. আইয়ামে তাশরীকে পড়তেন,

الله أكبر، الله أكبر، لا إله إلاالله والله أكبر، الله أكبر ولله الحمد

সূত্র: মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা হাদীস: ৫৬৯৬-৯৯ বাইহাকী: ৬৫০১ আল আওসাত (ইবনে মুনযির) খ. ৪ পৃ. ৩৪৯; এলাউস সুনান খ. ৮ পৃ. ১৫৬; বাদায়েউস সানায়ে খ. ১ পৃ. ৪৫৮ নাসবুর রায়াহ খ. ২ পৃ. ২২৩

 

Check Also

মহিলারা কুরবানীর পশু যবাহ করতে পারবে?

  মুসলিম মহিলারা কুরবানীর পশু যবাহ করতে পারবে। যদি তারা যবাহের নিয়ম ভালোভাবে জানে। তবে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.