মানুষকে আল্লাহ সবচে সম্মান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু সকল কিছুর ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর কাছে। এটা মুসলিমদের ও মুমিনদের আকীদা। কিন্তু হেযবুত তওহীদ নামক কুফরী দলের আকীদা হলো, আল্লাহর যত ক্ষমতা রয়েছে, সকল ক্ষমতা মানুষকে দিয়েই তিনি সৃষ্টি করেছেন।
হেযবুত তওহীদের দাবি:
‘আদমের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি যা আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই তা এবং আল্লাহর অন্যান্য সকল সিফাত বা গুন প্রবেশ করিয়ে দিলেন। কাজেই এই নতুন অসাধারণ সৃষ্টির নাম দিলেন আল্লাহ খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধি।’
সূত্র: আকীদা পৃ:৫
তারা আরও বলেছেন,
‘আল্লাহ তার নিজের আত্মা যেটাকে তিনি বলছেন আমার আত্মা সেটা থেকে আদমের মধ্যে ফুঁকে দেওয়ার অর্থ আল্লাহর কাদেরিয়াত অর্থাৎ যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসহ আল্লাহর সমস্ত সিফত,গুন, চরিত্র আদমের মধ্যে চলে আসা। আল্লাহর রূহ আদমের অর্থাৎ মানুষের ভেতরে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে অন্যান্য সমস্ত সৃষ্ট জিনিসের চেয়ে বহু উর্ধ্বে উঠে গেল। কারণ তার মধ্যে তখন স্বয়ং আল্লাহর সমস্ত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এসে গেল। আর কোন সৃষ্টির মধ্যে নেই।’
সূত্র: দাজ্জাল পৃ:১০
অর্থাৎ মানুষের মধ্যে আল্লাহর সমস্ত গুণ তথা শক্তি বা ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তার অর্থ হলো, আল্লাহর মধ্যে যে সব গুনাবলী আছে, সে সকল গুনাবলী মানুষের মধ্যেও রয়েছে।
ইসলাম কি বলে?
‘তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত’ হলো, ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অর্থাৎ এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁর সকল সিফাতে কামাল তথা পূর্ণাঙ্গ গুণাবলিতে গুণান্বিত এবং সকল অপূর্ণাঙ্গ গুণাবলি থেকে পবিত্র এবং তিনি এ ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় এবং অতুলনীয়।
এ প্রকার তাওহিদে বিশ্বাস পোষণের পদ্ধতি হলো, আল্লাহ তা’আলা তাঁর নিজের জন্য যেসব নাম ও গুণাবলি তালিকাভুক্ত করেছেন অথবা যেসব নাম ও গুণের কথা উল্লেখ করেছেন- যা কুরআন-সুন্নাহ’য় উল্লিখিত হয়েছে- শব্দে অথবা অর্থে- সে-সবে কোনোরূপ বিকৃতিসাধন, অস্বীকৃতি ও বাতিলকরণ, তার হাকীকত কী তা নির্ণয়করণ ও তার ধরন-ধারণ নির্দিষ্টকরণ, এবং সৃষ্টিজীবের কোনো গুণের সঙ্গে সাদৃশ্যকরণ ব্যতীত তা মেনে নেয়া ও বিশ্বাস করা। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা সকল ক্ষমতায় ও গুনাবলীতে এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর ক্ষমতার অংশীদারিত্ব স্থাপন করা পরিস্কার শিরক। মহান আল্লাহ বলেন,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ
অর্থ: কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়।
সূরা, শুরা, আয়াত: ১১
অর্থাৎ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি,দেখা,শোনা,সৃষ্টি ইত্যাদী সকল বিষয়ে আল্লাহর সাথে কারও কোনো তুলনা নেই। যারা আল্লাহর সমকক্ষ মানুষকে বানাতে চায় তারা কি মুশিরক নয়?
আল্লাহ তা’আলা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন,
قُلْ مَن رَّبُّ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ قُلِ اللّهُ قُلْ أَفَاتَّخَذْتُم مِّن دُونِهِ أَوْلِيَاء لاَ يَمْلِكُونَ لِأَنفُسِهِمْ نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ أَمْ جَعَلُواْ لِلّهِ شُرَكَاء خَلَقُواْ كَخَلْقِهِ فَتَشَابَهَ الْخَلْقُ عَلَيْهِمْ قُلِ اللّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ
অর্থ: জিজ্ঞেস করুন নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের পালনকর্তা কে? বলে দিনঃ আল্লাহ! বলুনঃ তবে কি তোমরা আল্লাহ ব্যতীত এমন অভিভাবক স্থির করেছ, যারা নিজেদের ভাল-মন্দের ও মালিক নয়? বলুনঃ অন্ধ চক্ষুষ্মান কি সমান হয়? অথবা কোথাও কি অন্ধকার ও আলো সমান হয়। তবে কি তারা আল্লাহর জন্য এমন অংশীদার স্থির করেছে যে, তারা কিছু সৃষ্টি করেছে, যেমন সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ? অতঃপর তাদের সৃষ্টি এরূপ বিভ্রান্তি ঘটিয়েছে? বলুনঃ আল্লাহই প্রত্যেক বস্তুর স্রষ্টা এবং তিনি একাই এমন, একচ্ছত্র পরাক্রমশালী।
সূরা রা’দ, আয়াত: ১৬
সুতরাং আল্লাহর কোনো গুনাবলীতে অশংশিদারিত্ব স্থাপন করার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَتَجْعَلُونَ لَهُ أَندَادًا ذَلِكَ رَبُّ الْعَالَمِينَ
অর্থ: এবং তোমরা কি তাঁর সমকক্ষ স্থীর কর? তিনি তো সমগ্র বিশ্বের পালনকর্তা।
সূরা হা-মীম সাজদাহ বা ফুসসিলাত, আয়াত: ৯
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنَّمَا هُوَ إِلَـهٌ وَاحِدٌ وَإِنَّنِي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُونَ
অর্থ: আপনি বলে দিনঃ আমি এরূপ সাক্ষ্য দেব না। বলে দিনঃ তিনিই একমাত্র উপাস্য; আমি অবশ্যই তোমাদের শিরক থেকে মুক্ত।
সূরা আন’আম, আয়াত: ১৯
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ তাঁর সামষ্টিক সিফাত ও গুনাবলীতে এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর সমকক্ষ স্থীর করা পরিস্কার শিরক। সুতরাং এরপরও যদি কেউ এ কথা বলে যে, ‘আল্লাহর কাদেরিয়াত অর্থাৎ যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসহ আল্লাহর সমস্ত সিফত,গুন, চরিত্র আদমের মধ্যে রয়েছে’ এটা কি সুস্পষ্টভাবে শিরকি বক্তব্য নয়?
যদি মানুষের মধ্যে আল্লাহর সকল ক্ষমতা থাকে, তাহলে মানুষ অসুস্থতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না কেন? না ঘুমিয়ে থাকতে পারে না কেন? মৃত্যু থেকে বাঁচতে পারে না কেন? অথচ আল্লাহ হলেন তিনি-
اللّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلاَ نَوْمٌ
অর্থ: আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব (চির জীবিত) সবকিছুর সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণকারী। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়।
সূরা বাকারা, আয়াত: ২৫৫
সুতরাং প্রমাণ হলো, মানুষের জন্য আল্লাহর সকল ইচ্ছাশক্তির মালিক হওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। এটা যেমন আক্বীদা বিবর্জিত, তেমনি বাস্তবতা বহির্ভুত একটি ডাহা মিথ্যাচার ও চরম শিরকি আক্বীদা।
অভিযোগ:
আল্লাহ তা’আলা তো মানব সৃষ্টির ব্যাপারে বলেছেন,
ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِن رُّوحِهِ
অর্থ: অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন, তাতে রূহ সঞ্চার করেন ।
সূরা সাজদাহ, আয়াত: ৯
এখানে যে রুহ ফুঁকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, এর অর্থ কি?
জবাব:
এটা মূলত মানুষের সম্মানীত করতে আল্লাহ তা’আলা রুপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। আল্লাম মাহমুদ বাগদাদী আলুসী রহ. বলেন,
أضافَ الرُّوحَ إلَيْهِ تَعالى تَشْرِيفًا لَهُ كَما فِي بَيْتِ اللَّهِ تَعالى وناقَةِ اللَّهِ تَعالى
অর্থাৎ রুহকে আল্লাহ নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন মানুষের সম্মানার্থে। যেমন কা’বাকে বাইতুল্লাহ এবং (সালেহ আ. এর উটকে) আল্লাহ তা’য়ালার উট বলা।
সূত্র: তাফসীরে রুহুল মা’আনী, খ. ৮ পৃ. ১২১
এমনিভাবে নবী হযরত ঈসা আ. কে ‘রুহুল্লাহ’ বলা হয়। এগুলো সব কিছুই রুপক অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে, নির্দিষ্ট বিষয়কে সম্মান প্রদান করার জন্য।
ইমাম বুখারি র. এর উস্তাদ নাঈম ইবনে হাম্মাদ র.বলেন ,
من شبه الله بخلقه كفر ومن حجد ما وصف الله به نفسه أو وصف به رسوله كفر وليس فيما وصف الله به نفسه أو وصف به رسوله تشبيه ولا تمثيل
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহকে মাখলুকের সঙ্গে তুলনা করল, সে কাফের হয়ে গেল। আর যে ব্যক্তি এমন কোনো বিশেষণ অস্বীকার করল, যা আল্লাহ তাআলা নিজের ওপর প্রয়োগ করেছেন, অথবা তাঁর রাসূল তাঁর ওপর প্রয়োগ করেছেন, সেও কাফের হয়ে গেল। আর আল্লাহ তাঁর নিজের ওপর যে বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন অথবা তাঁর রাসূল তাঁর ওপর যে বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন, তাতে কোনো তাশবিহ তথা সাদৃশ্যকরণ, তামছীল তথা উপমানির্ধারণ নেই।
সূত্র: সিয়ারু আলামিন নুবালা, খ. ২০ পৃ. ৮৮ তাফসীরে কাবীর (ইবনে তাইমিয়া) খ. ৭ পৃ. ১১১
সুতরাং আল্লাহর গুনাবলিতে মানুষের অংশাদারিত্ব স্থাপন করা সুস্পষ্ট শিরক। আল্লাহ আমাদের ঈমানের হিফাযত করেন। আমীন!