সহজ ভাষায় উম্মতের জন্য যাঁরা আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আগমণ করেন, যাঁরা আমজনতাকে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে তাওহীদের পথে আহ্বান করেন, তাঁদেরকে বলা হয় নবী। যখনই তাঁরা আগমণ করেছেন, তখনই তাঁরা উম্মতকে জানিয়ে দিতেন যে, তারা রবের পক্ষ থেকে আদিষ্ট। যাঁরা কুরআন-সুন্নাহ’র প্রমাণের আলোকে নবি বলে স্বীকৃত, তাঁদের ওপর ঈমান আনয়ণ করা সমস্ত উম্মতের উপর আবশ্যকীয় বিষয়। কিন্তু ‘নবি হিশেবে আবির্ভূত নন বা নবি হওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না’ এমন কাউকে নবি বলে স্বীকৃতি দেওয়া জায়েয নয়, বরং কুফরী। এ ব্যাপারে ইমাম আবু মুহাম্মদ আলী ইবনে হাযম আল-উন্দুলুসী কুরতুবী রহি. পরিষ্কার কথা বলেছেন । তিনি বলেন
ولا يحل لمسلم أن يدخل في الأنبياء من لم يأت نص ولا اجماع أو نقل كافة بصحة نبوته ولا فرق بين التصديق بنبوة من ليس نبيا وبين التكذيب بنبوة من صحت نبوته
যার নবুয়্যাত প্রমাণের জন্যে আল্লাহর সুস্পষ্ট উক্তি, মুসলমানদের ইজমা তথা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ও কুরআন-হাদীসের যথেষ্ট বর্ণনা বিদ্যমান না থাকবে, তাকে নবিগণের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করা কোন মুসলমানের জন্য বৈধ হবে না। যার নবুয়ত বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা ও যে নবি নয় তাকে নবী মনে করার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। -আল-ফসলু ফিল মিলালি ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল : খ. ৪ পৃ. ২১-২২
ইমাম ইবনে হাযম রহি. এর এ উক্তি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কুরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত কোনো নবিকে নবি বলে বিশ্বাস না করা যেমন কুফরী, তদ্রূপ শরয়ী দলিল দ্বারা নবি বলে প্রমাণীত নয়, এমন ব্যক্তিকে নবি মনে করাও কুফরী। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ, মহর্ষী মনু, রাজা রামচন্দ্র, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, মহাবীর জৈন, ও ভারতীয় অন্যান্য অবতারগণ নবি হওয়ার স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোন দলীল নেই। সুতরাং যারা তাদেরকে নবি মনে করবে, তারা কুফরি করবে।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
জনাব পন্নী ও সেলিম এবং তাদের অনুসারীদের বিশ্বাসমতে হিন্দু ও বৈদ্ধদের অনেক দেবতা বা অবতারগণ আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নবি ছিলেন। দেখুন তারা কী লিখেছেন-
সামাজিক দণ্ডবিধি দিয়ে যাদেরকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যে আদম আ., নূহ আ. (মনু), বিভিন্ন বেদ যাদের ওপর অবতীর্ণ হোয়েছিলো, মুসা আ. ও মোহম্মদ সা.। আর আইন-কানুন বাদে শুধু আধ্যাত্মিক দিকটাকে পুনরুদ্ধার কোরে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান হোলেন বুদ্ধ, কৃষ্ণ, মহাবীর, ইসা (আঃ)। এরা কোনও আইন-কানুন আনেননি কারণ পূর্ববর্তী নবীর আনা আইন-কানুন ইত্যাদী অবিকৃত ছিলো। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ. ১৩৯-১৪০
ধর্মকে পুনঃস্থাপন করে মানুষের কল্যান সাধনের জন্যই ভারতবর্ষে এসেছেন শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির, মধ্য এশিয়ায় এসেছেন ইব্রাহীম (আ.) ইহুদীদের মধ্যে এসেছেন মুসা (আ.), দাউদ (আ.), ঈসা (আ.), ইয়াহিয়া (আ.) ইয়াকুব (আ.) এমনই আরো বহু নবী-রসুল অবতার। -সবার উর্ধ্বে মানবতা : পৃ. ৫
অন্যান্য নবী রসুলদেরকে আল্লাহ যে সর্বব্যাপী তওহীদ দিয়ে পাঠিয়েছেন, ঈসা (আ.) কেও সেই তওহীদ, সেই সার্বভৌমত্ব, দীনুল কাইয়্যেমা, সনাতন ধর্ম দিয়ে পাঠিয়েছেন এবং তার অনুসারীরা ছিলেন মো’মেন এবং মুসলিম। পবিত্র কোর’আন নাযেল না হলে মানুষ আজও ঈসা (আ.) সম্পর্কে প্রকৃত সত্য জানতে পারত না, ঐ বিকৃতটাই জানত। ঠিক তেমনি হিন্দুদের পুরাণে, বেদে, সংহিতায়, রামায়নে ও মহাভারতে যে ইতিহাস আমরা পাই সেখানেও রয়েছে প্রচুর বিকৃতি । সেই সব বিকৃতির মধ্যেই মিশে আছে কিছু মহাসত্য যা দেখার মত দৃষ্টিশক্তি এই বিকৃত ইসলামের আলেমদের নেই। থাকলে তারা দেখতে পেতেন যে, ঐ সব ধর্মগ্রন্থে যে সব অবতারদের কথা বলা হয়েছে তাদের অনেকেই আল্লাহর প্রেরিত নবী, এবং যে ধর্মগ্রন্থগুলোর চর্চা হিন্দু ধর্মে হয়ে থাকে সেগুলোর কিছু কিছু আল্লাহরই পাঠানো কেতাব। আরও দেখতে পেতেন যে, জেসাস যেমন ঈসারই (আ.) উচ্চারণ ভেদ বা নামান্তর, তেমনি মনু নুহের (আ.) নামান্তর, যুধিষ্ঠির ইদ্রীস (আ.) এর নামান্তর। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৬৫
অনেক ঐতিহাসিক, পণ্ডিত গবেষকের মতে মহর্ষী মনু, রাজা রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, মহাবীর জৈন, মহামতি বুদ্ধ এঁরা সবাই ছিলেন ভারত বর্ষে আগত আল্লাহর নবী। -সকল ধর্মের মর্ম কথা সবার উর্ধ্বে মানবতা : পৃ. ৪
শ্রীকৃষ্ণ
আমাদের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জন্ম-মৃত্যু, ঘর সংসার, পরিবার-পরিজন পরিচালনা, সাধনা-উপাসনা, আদর্শ সমাজ সংস্কার, সত্য-ধর্মের সেবা, প্রয়োজনে মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আদর্শে বিশ্বাসী ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত ও সবকিছু মিলিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর যুগের একজন প্রেরিত- পুরুষ, মহামানব পথ-প্রদর্শক, নবী-অবতাররূপেই আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। -শোষণের হাতিয়ার : পৃ. ৭০
মনুই মূলত নূহ আ.!
অনেক গবেষক মনে করেন বৈবস্বতঃ মনুই হচ্ছেন বৈদিক ধর্মের মূল প্রবর্তক, যাঁকে কোর’আনে ও বাইবেলে বলা হয়েছে নূহ (আ.), ভবিষ্যপুরাণে বলা হয়েছে রাজা ন্যূহ। তাঁর উপরেই নাজিল হয় বেদের মূল অংশ। -সবার উর্ধ্বে মানবতা : পৃ. ৪
তেমনি মনু নুহের (আ.) নামান্তর। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৬৫
নূহ আ. (মনু)। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ. ১৩৯-১৪০
যুধিষ্ঠির মূলত ইদরিস আ.!
যুধিষ্ঠির ইদ্রীস (আ.) এর নামান্তর। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৬৫
যিশু মূলত ঈসা আ.!
জেসাস যেমন ঈসারই (আ.) উচ্চারণ ভেদ বা নামান্তর। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৬৫
আলাইহিস সালাম বলা:
সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে এক জাতিতে পরিণত করার জন্যই যামানার এমামের আবির্ভাব। তিনি ভারতবর্ষে আগত আল্লাহর সকল অবতারদেরকে নবী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতি সালাম পেশ করেছেন । এজন্য তাঁকে বিকৃত এসলামের আলেমদের বহু বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করা হয়েছে, তাঁর বই পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু তিনি সত্য থেকে এক চুলও নড়েন নি। -শিক্ষাব্যবস্থা : পৃ. ৯০
অর্থাৎ হেযবুত তওহীদের দাবি মতে, রামকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির মনু, বুদ্ধদেবসহ সবাই আল্লাহ তাআলার প্রেরিত নবি ছিলেন।
ইসলাম কী বলে?
হিন্দু ও বৌদ্ধদের ভিত্তিহীন অলীক ধর্মের কল্পকাহিনীর দেবতা শ্রীকৃষ্ণ আর বুদ্ধকে সামান্য ঈমানী আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি নবি বলে মেনে নিতে পারে না। বিষয়টি প্রামাণিকভাবেও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তাছাড়া পবিত্র কুরআন ও হাদীসের কোথাও রাম ও কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, মনু, বুদ্ধদেবকে নবি বলা হয়নি। যাদেরকে কুরআন ও হাদীসের কোথাও নবি বলা হয়নি, তাদের সম্পর্কে নবী হওয়ার বিশ্বাস বা ধারণা পোষণ করা ঈমানবিধ্বংসী কাজ। অতএব কাল্পনিকভাবে কাউকে নবি মনে করা উচিৎ নয়। মহান রব বলেন,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِّن قَبْلِكَ مِنْهُم مَّن قَصَصْنَا عَلَيْكَ وَمِنْهُم مَّن لَّمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآيَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ فَإِذَا جَاء أَمْرُ اللَّهِ قُضِيَ بِالْحَقِّ وَخَسِرَ هُنَالِكَ الْمُبْطِلُونَ
বস্তুত আমি তোমার পূর্বেও বহু রাসূল পাঠিয়েছি। তাদের মধ্যে কতক এমন, যাদের কতিপয়ের বৃত্তান্ত আমি তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি আর কতক এমন যাদের বৃত্তান্ত তোমাকে জানাইনি। কোন রাসূলের এই এখতিয়ার নেই যে, সে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন মুজিযা পেশ করবে। ২৫ অতঃপর যখন আল্লাহর আদেশ আসবে, তখন ন্যায়সঙ্গতভাবে ফায়সালা হয়ে যাবে। আর মিথ্যার অনুসারীরা তখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। -সুরা মুমিন : ৭৮
اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ
আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য হতে তাঁর বার্তাবাহক মনোনীত করেন এবং মানুষের মধ্য হতেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন। -সুরা হাজ্ব : ৭৫
সুতরাং বুঝা গেলো, সকল নবি-রাসুল আল্লাহপাক কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অথচ এসব অবতারদের নবি হওয়ার ব্যাপারে এমন কোনো আয়াত-হাদিস পাওয়া যায় না, যেখানে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত। সুতরাং তাদের নবি বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। তাছাড়া তাদের ব্যাপারে বর্ণিত চরিত্র ও বক্তব্য শুনলে বুঝা যায়, তারা নবি হওয়া দূরের কথা ভালো মানুষ হওয়াও সম্ভব না।
অবতাররা মিথ্যা বলে:
আমরা জানি কোনো নবি কখনও মিথ্যা বলেননি। কিন্তু হিন্দুদের শাস্ত্রমতে তাদের অবতাররাও অসত্য বলেন। মহাভারতে লেখা রয়েছে-
দেবতারাও অসত্য বলেন। -মহাভারত : পৃ. ৪৩৫ রাজশেখরবসবসু অনূদিত, বুক চয়েস ২/৩ প্যারীদাস রোড, ঢাকা- ১১০০ দ্বিতীয় সংস্করণ
যে দেবতা বা অবতারগণ মিথ্যা বলেন, তাদেরকে নবি বলে বিশ্বাস করা নিছক ভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়। এসব বিষয়ে আরও জানতে হিন্দুদের ধর্মীয়গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীবৈহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড’ পড়তে পারেন।
অবতাররা চরিত্রহীনও হয়:
নবিদের চরিত্র পরিচ্ছন্ন। তাঁদের চারিত্রিক কোনো ত্রুটি ছিলো না এবং তাঁরা ছিলেন নেককার ও সৎকর্মশীল। তাঁদের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ বলেন,
وَزَكَرِيَّا وَيَحْيَى وَعِيسَى وَإِلْيَاسَ كُلٌّ مِّنَ الصَّالِحِينَ
এবং যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ঈসা ও ইলিয়াসকেও (হিদায়াত দান করেছিলাম)। এরা সকলে পুণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। -সুরা আনআম : ৮৫
বুঝা গেলো, সকল নবি সৎ হয়ে থাকেন। এজন্য ইবনে হাজার আসকালানী রহি. বলেন,
الأنبياء معصومون من الكبائر بالإجماع
সকল উম্মতের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত হলো, নবিরা সকল কবীরা গুনাহ থেকে পবিত্র। -ফাতহুল বারী : খ. ৮ পৃ. ৬৯
অথচ রামকৃষ্ণ ও অন্য অবতারদের ব্যাপারে যেসব যৌনলীলা ঘটিত চরিত্র বর্ণনা করা হয়, তা কোন নবির চরিত্র হতে পারে না। নবিদের আদর্শ ও শিক্ষার সাথে অবতারদের জীবন-আদর্শের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না, বরং উভয়ের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব পরিলক্ষিত হয়। অথচ নবিগণ সবাই ছিলেন নিষ্কলুষ মহান চরিত্রের অধিকারী।
কৃষ্ণ:
হেযবুত তওহীদ বিশেষ করে শ্রীকৃষ্ণকে নবি বানাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। অথচ কৃষ্ণ নিজেই দাবি যেসব দাবি করেছে, তাতে সে নিজেই নিজেকে স্রষ্টা বলে দাবি করেছে। তার দাবি হলো, দুনিয়াকে ধ্বংস করে আবার সৃষ্টি করতে পারি। দেখুন কী বলে-
আমি সংসারকে ভস্মসাৎ করিয়া পূনর্বার সৃষ্টি করিতে সক্ষম। -শ্রীশ্রীবক্ষ্মবৈবর্ত্ত পুরাণম : শ্রীকৃষ্ণ-জন্মখন্ড, পৃ. ৪৭৭
অথচ সৃষ্টি করার একমাত্র ক্ষমতা আল্লাহপাকের। মহান রব বলেন,
مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى
আমি তোমাদেরকে এ মাটি হতেই সৃষ্টি করেছি, এর মধ্যে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেব এবং পুনরায় তোমাদেরকে এরই মধ্য হতে বের করব। -সুরা ত্ব-হা : ৫৫
অথচ শুধু মানুষ নয়, সবল সৃষ্টি ধ্বংশ ও সৃষ্টি করতে একমাত্র সক্ষম মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা। তাছাড়া কৃষ্ণ আরও দাবি করেছে,
তপাম্যহমহং বর্ষং নিগৃহ্ণাম্যুৎসৃজামি চ।
অমৃতঞ্চৈব মৃত্যুশ্চ সদসচ্চাহমৰ্জ্জুন৷৷১৯ ৷৷
অর্থাৎ হে অৰ্জ্জুন! আমি সূর্য্যস্বরূপে গ্রীষ্মকালে উত্তাপ দান করি, বর্ষাকালে আমি বারিবর্ষণ করিয়া থাকি, আবার কখনও কখনও বর্ষণকে আকর্ষণ করিয়া থাকি। আমিই মোক্ষ এবং মৃত্যু, স্থূল ও সূক্ষ্ম সমুদয় বস্তু৷৷১৯৷৷ -শ্রীমদ্ধভবদ্গীতা : ৯/১৯ পৃ. ২২৮
অথচ বৃষ্টিবর্ষণ করার ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহপাকের। মহান রব বলেন,
الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ مَهْدًا وَسَلَكَ لَكُمْ فِيهَا سُبُلًا وَأَنزَلَ مِنَ السَّمَاء مَاء فَأَخْرَجْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّن نَّبَاتٍ شَتَّى
তিনি সেই সত্তা, যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা বানিয়েছেন, তাতে তোমাদের জন্য চলার পথ দিয়েছেন এবং আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেছেন। তারপর আমি তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি। -সুরা ত্ব-হা : ৫৩
কৃষ্ণ আরও দাবি করেছে, দৃশ্য ও অদৃশ্যের সকল জ্ঞান তার আছে। দেখুন কী বলে,
বেদাহং সমতীতানি বৰ্ত্তমানানি চাৰ্জ্জুন।
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মান্তু বেদ ন কশ্চন৷৷২৬৷৷
হে অৰ্জ্জুন! আমি সমস্ত অতীত, বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ এই
ত্রিকালস্থ স্থাবর জঙ্গমাত্মক সমুদয় বস্তুই জানি। কিন্তু আমার মায়াশক্তি ও যোগমায়া শক্তির দ্বারা তাহাকের জ্ঞান আচ্ছাদনহেতু প্রাকৃত মানব বা প্রকৃতির অতীত কেহই আমাকে যথাযথ ভাবে জানিতে পারে না। -শ্রীমদ্ধভবদ্গীতা : ৭/২৬ পৃ. ১৯৬
অথচ দৃশ্য ও অদৃশ্যের সকল কিছুর খবর জানেন একমাত্র আল্লাহ, কোনো নবিও না কোনো ওলিও না। আল্লাহপাক বলেন,
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ
আল্লাহ্, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই, তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা; তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু। -সুরা হাশর : ২২
যে কৃষ্ণ নিজেই এসব শিরকী কথা দাবি করেছিলো, সে কীভাবে নবি হতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। উপরন্তু শ্রীকৃষ্ণের চারিত্রিক নোংড়ামীর ইতিহাস পড়লে তাকে নবি কল্পনা করাও সুদূর পরাহত।
বুদ্ধ:
বুদ্ধদেব মূলত একজন বস্তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ছিলো। সে স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিলো না, তাছাড়া আখেরাতেও বিশ্বাসী ছিলো না এবং তার বক্তব্যমতে মানুষ মূলত মৃত্যুবরণ করে না, পূনরায় জন্মায়। তার ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে গেলে কিতাবটি দীর্ঘ হবে। এক কথায় জেনে নেওয়া যায়, বুদ্ধদেব আগাগোড়া নাস্তিক ছিলো। এজন্য সাউদি আরবের সর্বোচ্চ ফতওয়া বোর্ড ‘আল লাজনাতুত দায়েমা লিল বুহুসিল ইলমিয়্যাতি ওয়াল ইফতা’ এর এক ফতওয়ায় বুদ্ধকে নবি বলে বিশ্বাসকারীর ব্যাপারে সুস্পষ্ট কাফের হওয়ার ফতওয়া প্রদান করেছে। উক্ত ফতওয়াতে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,
بوذا ليس نبيا، بل كان كافرا فيلسوفا يتنسك على غير دين سماوي فمن اعتقد بنبوته فهو كافر.
বুদ্ধ নবী নয়। বরং সে কাফির ও দার্শনিক ছিল । আসমানী ধর্ম বাদ দিয়ে ভিন্ন পদ্ধতিতে ইবাদত করতো। যে তাকে নবী হওয়ার বিশ্বাস রাখবে সে কাফের। -ফতওয়া লাজনাতিদ দায়েমা লিল বুহুসিল ইসলামিয়া খণ্ড.২৬ পৃ.২৩৮ ফতওয়া নং ২১০০৪
সৌদী আরবের সর্বোচ্চ ফাতাওয়া বোর্ডের ফাতাওয়া অনুযায়ী পন্নী এবং তার অনুসারিরা কাফের। যাহোক, যাঁদের নবি হওয়ার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ’য় সুষ্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা ছাড়া আমরা আর কাউকে নির্ধারিতভাবে নবি বলে বিশ্বাস করতে পারি না। অথচ হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, এসব অবতারদের নবি বলে বিশ্বাস না করলে জান্নাতের আশা করে লাভ নেই। দেখুন তারা কী বলে,
খ্রিস্টানরা আখেরী নবী মোহাম্মদ (দ:)-কে নবী হিসাবে স্বীকার করে না একইভাবে মোসলেমরা ভারতীয় অঞ্চলে ভারতীয় ভাষার মানুষের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত বৌদ্ধ ও শ্রীকৃষ্ণ এঁদেরকে নবী হিসাবে স্বীকার করেন না। কিন্তু তাদের প্রচারিত ধর্মগ্রন্থের মধ্যে আখেরী নবীর আগমনের বহু ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখিত আছে যা গবেষণা কোরলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ঐ ধর্মগুলিও আল্লাহরই প্রেরিত (যা এখন বিকৃত হোয়ে গেছে), এবং স্বভাবতই সেগুলির প্রবক্তারা আল্লাহরই বার্তাবাহক অর্থাৎ নবী ও রসুল। -শোষণের হাতিয়ার : পৃ. ৬২
পূর্ববর্তী নবী-রসুল-অবতার এবং তাঁদের আনীত কেতাবের প্রতিও অবিশ্বাস রেখে জান্নাতের আশা করে লাভ নেই। -দেশেরপত্র সাপ্তাহিক সংকলন- ২৪ পৃ. ২৫
উপমহাদেশে কাকে নবি হিসাবে আল্লাহ পাক পাঠিয়েছিলেন, তাঁদেরকেও আমরা বিশ্বাস করি, কিন্তু তাঁদের নাম সম্পর্কে আমরা জানি না। অতএব রাম, কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, মনু বা বুদ্ধদবেকে নির্দিষ্টাকারে নবি বলে বিশ্বাস করতে অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণ লাগবে। প্রমাণ ছাড়া এসব অবতারদের নবি হিশাবে ঘোষণা দিয়ে ‘তাদের প্রতি ঈমান না আনলে জান্নাতে যাওয়া যাবে না’ এমন দাবি সর্বৈব মিথ্যাচার।
বুদ্ধদেব কী যুলকিফল?
অনেকে গৌতমবুদ্ধকে নবি হওয়ার প্রমাণস্বরুপ বলে থাকে যে, কুরআনে বর্ণিত যুলকিফল হলো গৌতম বুদ্ধ। মহান রব বলেন,
وَاذۡکُرۡ اِسۡمٰعِیۡلَ وَالۡیَسَعَ وَذَا الۡکِفۡلِ ؕ وَکُلٌّ مِّنَ الۡاَخۡیَارِ ؕ
এবং স্মরণ কর ইসমাঈল, আল- ইয়াসা ও যুল-কিফলকে। তারা সকলে ছিল উত্তম ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত। -সুরা ছোয়াদ : ৪৮
তারা এই যুলকিফলকে গৌতম বুদ্ধ বলে প্রমাণ করতে দলিল হিশাবে বলে থাকে, গৌতম বুদ্ধের রাজধানীর নাম ছিলো কাপল। যার আরবী রূপ কাফল। আর আরবীতে ‘যু’ অর্থ অধিকারী, মালিক। সুতরাং সম্পদশালী ব্যক্তিকে ‘যুমালিন’ আর শহর অধিপতিকে “যুবালাদিন” বলা হয়ে থাকে । তাই এখানেও বুদ্ধের রাজধানী কাপলের মালিক ও বাদশাহ কে ‘ফুলকিফল’ বলা হয়েছে।
জবাব:
তাফসীরের কিতাবগুলো দেখলে বুঝা যায়, বনী ইসলাঈলের একজন নেককার ও ন্যায়বিচারক শাসক ছিলেন। সেকারণে তাকে ‘যুলকিফল’ উপাধী হয়ে গিয়েছিলো। উপরন্তু তিনি ছিলেন বনী ইসরাঈলের মানুষ। সহীহ ইবনে হিব্বানে যুলকিফলের ব্যাপারে একটি বর্ণনা এসেছে, হযরত ইবনে উমর রা. বলেন,
سمعت النبي صلى الله عليه وسلم اكثر من عشرين مرة يقول :كان ذو الكفل من بني إسرائيل.
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ বারের বেশি বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, যুলকিফল বনী ইসরাইলের লোক ছিল। -সহিহ ইবনে হিব্বান : হাদিস নং : ৩৮৬
সুনানে তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, মুসতাদরাকে হাকেম, ইমাম তাবরান রচিত আল-মুজামুল কাবীর, ইমাম বায়হাক্বী রহ. এর শুয়াবুল ঈমান, এর বর্ণনায় এসেছে,
كان الكفل من بني إسرائيل
কিফল তথা যুলকিফল বনী ইসরাইলের মধ্য থেকে ছিল। -জামে তিরমিযি : হাদিস নং : ২৪৯৬
উক্ত হাদিস দুটি থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, কুরআনে বর্ণিত যুলকিফল বনী ইসরাইলের লোক ছিল। এবং তিনি একজন নেককার মানুষ ছিলেন। হযরত আবু মুসা আশআরী রা. ও মুজাহিদ রহি. বলেন,
كان ذو الكفل عبدا صالحا ولم يكن نبيا
যুলকিফল নেককার বান্দা ছিলেন। তবে তিনি নবি ছিলেন না। -তাফসীর আল বাহরুল মুহিত : খ. ৬ পৃ. ৩১০
উক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো,
১. ‘যুলকিফল’ বনী ইসরাঈলের ছিলেন, আর বুদ্ধ ছিলো নেপালের বাসিন্দা।
২. ‘যুলকিফল’ ছিলেন একজন নেককার সৎ বান্দা, আর গৌতম বুদ্ধ ছিলো একজন আগাগোড়া নাস্তিক। সুতরাং এমন মানুষকে নবি বলে স্বীকৃতি দিতে এতো আগ্রহ কেন বুঝে আসে না আমার।
বাহায়ী ও কাদিয়ানী মতাদর্শের পুনঃচর্চা
মিথ্যা নবি দাবিদার বাহায়ী মতাদর্শের প্রবর্তক মির্জা হোসেন আলী ইবনে আব্বাস প্রকাশ বাহাউল্লাহ মূলত বুদ্ধ ও কৃষ্ণকে আল্লাহর নবি বলে প্রচার করে। বাহায়ীদের ধারণা মতে নবির সংখ্যা ৯ জন। যথা: ১.ইব্রাহীম ২.কৃষ্ণ ৩. মুসা ৪. জড়থুস্ট্র ৫.বুদ্ধ ৬.যীশু ৭.মুহাম্মদ ৮. মির্জা আলী মুহাম্মদ বাব ৯.বাহাউল্লাহ। অন্যদিকে ভণ্ডনবি মির্জা কাদিয়ানীও তাদের নবি বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। ঠিক তাদের মতো হেযবুত তওহীদও একই পথে হেটেছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে অন্য কোনো সংকলনে লেখার চেষ্টা করবো। ইনশাআল্লাহ।
অভিযোগ:
হেযবুত তওহীদের যুক্তি হলো, আল্লাহপাক তো প্রত্যেক সম্প্রদায় ও জনপদে নবি প্রেরণ করেছেন। এ ব্যাপারে অনেক আয়াতও রয়েছে। সে সকল আয়াতকে দলিল হিশাবে উত্থাপন করে তারা বলতে চায়, ভারত উপমহাদেশের এসব এলাকার জন্যেও তো আল্লাহ তাআলা নবি প্রেরণ করেছেন। তাহলে সে সকল নবিরা কারা? নিশ্চয় কৃষ্ণ, বুদ্ধ, যুধিষ্ঠির, মনু প্রমুখ?
উত্তর:
আল্লাহ তাআলা এসব এলাকাতেও নবি পাঠিয়েছেন। তবে তারা কারা? মহান রব বলেন,
ولقد ارسلنا رسلا من قبلك منهم من قصصنا عليك ومنهم من لم نقصص عليك.
বস্তুত আমি তোমার পূর্বেও বহু রাসূল পাঠিয়েছি। তাদের মধ্যে কতক এমন, যাদের কতিপয়ের বৃত্তান্ত আমি তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি আর কতক এমন যাদের বৃত্তান্ত তোমাকে জানাইনি। -সুরা মুমিন : ৭৮
উক্ত আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন, আপনার পূর্বেও আমি অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি। তাদের মধ্য থেকে অনেকের বিবরণ আপনাকে বলে দিয়েছি। যাদের তাদের সংখ্যা পঁচিশ। কিন্তু বাকিদের নাম আল্লাহ জানাননি। তবে প্রয়োজন হলে নিশ্চয় জানানো হতো। তবে নাম না জানা নবিদের ওপরেও আমরা ঈমান রাখি। তবে যাঁদের নাম কুরআন-সুন্নাহ’য় বর্ণিত হয়নি, তাঁদের বেলায় জোর করে কাউকে নবি বলে প্রচার করা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিদ্রোহের শামিল। প্রকাশ থাকে যে, এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবি-রসুলের যে সংখ্যা বলা হয় তা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে বর্ণিত নয়।