সমস্ত মুসলামানকে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আসমানী কিতাবের মতো ফিরিস্তাদের অস্তিত্বের উপরও ঈমান আনয়ন করতে হয়। কালিমায়ে শাহাদাতের মাঝে ফিরিস্তা সংশ্লিষ্ট আকিদাকে আল্লাহ তাআলার তাওহীদের আকিদার পরপরই স্থান দেয়া হয়েছে। শুধু মুসলমানরা নয় বরং নবিদেরকেও ফিরিস্তাকুলের উপর ঈমান আনয়ন করতে হয়েছে। সুরা বাকারার শেষে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ.
রাসুল (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাতে ঈমান এনেছে, যা তাঁর উপর তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ হতে নাযিল করা হয়েছে এবং (তাঁর সাথে) মুমিনগণও। তাঁরা সকলে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিস্তাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসুলগণের প্রতি ঈমান এনেছে। -সুরা বাকারা : ২৮৫
সমস্ত নবি ও মুমিনদের ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে হেযবুত তওহীদ অমুসলিমদের নাপাক দেব-দেবীদের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, মূলত মুশরিকদের দেবতা ও ফিরিস্তা একই জিনিষ। তারা লিখেছে,
ভারতীয়, রোমান এবং গ্রীকরা যে দেব-দেবী Gods, goddess বিশ্বাস করেন সেগুলো এবং মালায়েক বা ফেরেশতা একই জিনিষ। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ. ১৬; বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ.) এর ভাষণ : পৃ. ২০০
অন্যান্য ধর্মে যেমন দেব-দেবীরা কোন না কোন প্রাকৃতিক শক্তির ভারপ্রাপ্ত, যেমন হিন্দু শাস্ত্রে বরুন বাতাসের দেবতা, সূর্য্য একটি দেবতা- সূর্য্যদেব, গ্রীকদের নেপচুন সমুদ্রের, পানির দেবতা, রোমানদের ভালকান হচ্ছেন আগুনের দেবতা, তেমনি ইসলাম ধর্মেও আগুনের, বাতাসের ইত্যাদির ফেরেশতা আছেন। আরও ব্যাপারে মিল আছে। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ. ১৬; বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ.) এর ভাষণ : পৃ. ২০০
অর্থাৎ হেযবুত তওহীদ বলতে চায়, অমুসলিমরা যেগুলোকে দেবতা, গড বা ঈশ্বর হিসাবে বিশ্বাস করে, সেগুলো আর ফিরিস্তারা একই জিনিষ। নাউযুবিল্লাহ।
ইসলাম কী বলে?
ক. ফিরিস্তাদের ব্যাপারে তাদের উল্লিখিত দাবি কুরআন-হাদিসের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। কুরআন-হাদিসের অনেক স্থানে ফিরিস্তাদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত অনেক বিষয়ের আলোচনা এসেছে। কিন্তু তাঁরা দেব-দেবী হওয়ার যে দাবি করেছে, তার স্বপক্ষে একটি বিবরণও কুরআন হাদীসে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
খ. আমরা হিন্দুশাস্ত্র পড়লে দেখতে পাই, হিন্দুরা যাদেরকে দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে বিশ্বাস করে তারা সবাই শিরক ও নষ্টামীর রাজত্ব তৈরি করেছিলো। মুশরিকদের সম্পর্কে মহান রব বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلاَ يَقْرَبُواْ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَـذَا
হে মুমিনগণ, মুশরিকরা তো আপাদমস্তক অপবিত্র। সুতরাং এ বছরের পর যেন তারা মসজিদুল হারামের নিকটেও না আসে। -সুরা তাওবা : ২৮
পক্ষান্তরে ফিরিস্তারা আল্লাহ পাকের ঘোষণা অনুযায়ী তাঁর সম্মানিত বান্দা। মহান রব বলেন,
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادٌ مُّكْرَمُونَ
তারা বলে, রহমান (আল্লাহ) সন্তান গ্রহণ করেছেন (আর তাঁর সন্তান হলো ফিরিস্তাগণ)। সুবহানাল্লাহ! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা।। -সুরা আম্বিয়া : ২৬
যেখানে আল্লাহ তাআলা ফিরিস্তাদেরকে তাঁর অনুগত ও সম্মানিত বান্দা বলে আখ্যায়িত করেছেন, সেখানে তাঁদেরকে প্রভুত্বের আসনে বসিয়ে দেব- দেবী বলে আখ্যায়িত করা কখনই সঠিক হতে পারে না।
গ. এক স্থানে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَا في السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مِنْ دَابَّةٍ وَالْمَلَائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ.
আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যতো প্রাণী আছে, তারা এবং সমস্ত ফিরিস্তা আল্লাহকেই সিজদা করে এবং তাঁরা মোটেই অহংকার করে না। -সুরা আন-নাহল : ৪৯
এ আয়াতে ফিরিস্তা ‘প্রাণ সম্পন্ন সৃষ্টি’ হওয়ার বিষয়টি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্ৰমাণিত । এখানে আল্লাহ তাআলা আন্যান্য প্রাণীদের সাথে ফিরিস্তাদেরকেও আল্লাহ-র জন্যে সিজদাকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাথে সাথে এ আয়াত দ্বারা আল্লাহ তাআলা তুর্কি, পারস্যের অগ্নিপূজারী, পন্নী এবং হেযবুত তওহীদসহ বিশ্বের সকল মুশরিক আর পৌত্তলিকদের আকীদা বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করে দিলেন। সুতরাং ফিরিস্তা আর দেবতা বা ঈশ্বর কখনও কী এক হতে পারে?
ঘ. অমুসলিমরা যেগুলোকে দেবতা বলে বিশ্বাস করে, সেগুলোকে তারা আল্লাহ পাকের সমান মর্যাদা ও ক্ষমতাবান বলে বিশ্বাস করে। যেমন হিন্দুদের সৃৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণুু, বিনাশকর্তা শিব ঠাকুর। মুসলিমদের সবকিছুর কর্তাই আল্লাহ। হিন্দুরা তাদের দেবতা বা ঈশ্বর সবাইকে পুজা করে। কিন্তু মুসলিমরা কোনো ফিরিস্তাকে পুজা করেন না। হিন্দু শাস্ত্র মতে যিনি সর্বত্র সমভাবে বিরাজমান তিনিই বিষ্ণু। ইসলাম ধর্মে আল্লাহ তাআলার কুরসী আসমান জমিন সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। কোনো ফিরিস্তাও সর্বত্র বিরাজমান নন। হিন্দুরা যাদেরকে দেবতা অথবা ঈশ্বর হিশেবে বিশ্বাস করেন, তাদের স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা সবই আছে। কিন্তু ফিরিস্তাদের এসবের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাঁরা আল্লাহর নির্দেশে সৃষ্টি হন।
ঙ. হিন্দুরা যাদেরকে দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে বিশ্বাস করে, তাদের শাস্ত্রমতে প্রায় সবার জিবনেই কিছু না কিছু নারী কেলেঙ্কারীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এমনকি তাদের কাছে সৃষ্টির দেবতা ‘ব্রহ্মা’ নিজের মেয়ের সাথেও যৌনাচার করেছিলো। তাদের ধর্মগ্রন্থেই এটা লেখা আছে,
শতরুপা, প্রথমা নারী। তিনি ব্রহ্মার কন্যা। মৎসপুরানে আছে, নয় জন মানসপুত্র সৃষ্টি করার পর ব্রম্মা এক কন্যা সৃষ্টি । এই কন্যাই শতরূপা, সাবিত্রী, গায়ত্রী, স্বরস্বতী, ও ব্রাহ্মণী নামে খ্যাতা। শতরূপার রূপে মুগ্ধ হয়ে সৃষ্টিকর্তা ব্রম্মা তার কন্যা শতরূপাকে গ্রহণ করেন। ব্রহ্মা তার কন্যার সঙ্গে অজাচারের ফলে প্রথম মনু সায়ম্ভুব-এর জন্ম হয়। -পৌরাণিক অভিধান : পৃ. ৪৯৫
উপরন্তু হিন্দুদের দেবতাদের স্ত্রী, সন্তান সবই আছে। দেখুন তারা কী লিখেছে-
সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী, দেবসেনা ও দৈত্যসেনা এঁর দুই কন্যা। ব্রহ্মা চতুর্ভুজ চতুরানন ও রক্তবর্ণ। প্রথমে তাঁর পাঁচটি মস্তক ছিলো; কিন্তু একদা শিবের প্রতি অসম্মানসূচক বাক্য উচ্চারণ করায় শিবের তৃতীয় নয়নের অগ্নীতে ব্রহ্মার একটি মস্তক দগ্ধ হয়। ব্রহ্মার বাহন হংস। -পৌরনিক অবিধান : পৃ. ৩৮৩
পক্ষান্তরে ফিরিস্তাদের ব্যাপারে এমন কল্পনা করাও ইসলাম ধর্মে মহাপাপ।
চ. তাছাড়া কুরআন-হাদিসের বিস্তারিত বিবরণের আলোকে ফিরিস্তাদের ব্যাপারে তাদের উল্লেখিত ভ্রান্ত ধারণা অনেকগুলো কারণে সঠিক নয়। তা থেকে কয়েকটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
এক. পৌত্তলিকদের দেব-দেবীগুলোর মাঝে স্ত্রীলিঙ্গ ও পুংলিঙ্গ রয়েছে। কিন্তু ফিরিস্তাদের কোনো লিঙ্গ নেই।
দুই. দেব-দেবীদের পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততিও রয়েছে। আর ফেরেশতাদের মাঝে সন্তান প্রজনন ও বংশ পরিচয়ের বিষয় নেই ।
তিন. দেব-দেবীদেরকে ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন সৃষ্টি মনে করা হয় ৷ যারা একজন আরেকজনের উপর রাগান্বিত হয়। কেউ জয়ী আবার কেউ পরাস্ত হয়। ভারতীয় পৌত্তলিকদের দেবতাগুলির ব্যাপারে এ ধরনের অনেক ইতিহাস প্রচলিত আছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার ফেরেশতাগণ এ সমুদয় বিষয় হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র ।
চার. দেব-দেবীরা তাদের পূজারীদের উপাসনায় সন্তুষ্ট হয়ে থাকে। উপাসকরাও তাদের উপাস্য দেবতাগুলিকে তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূর্ণ করে দিতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করে থাকে। অথচ ফেরেশতাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। তাঁরা একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করে থাকেন।
মুশরিকদের আকিদা ও হেযবুতের আকিদা অভিন্ন:
হিন্দু ও পারস্যের অগ্নি পূজারীগণ ফেরেশতাদেরকে দেব-দেবী মনে করে থাকে। জাহেলি যুগের কাফের মুশরিকরাও ফিরিস্তাদেরকে দেবতা ও প্রভু মনে করতো। আল্লাহ তাআলা তদের এ ভ্রান্ত আকিদা খণ্ডন করে পবিত্র কুরআনে আয়াত অবতীর্ণ করেন । আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَجَعَلُوا الْمَلَائِكَةَ الَّذِينَ هُمْ عِبَادُ الرَّحْمَن إِنَانًا أَشَهِدُوا خَلْقَهُمْ سَتُكْتَبُ شَهَادَتُهُمْ وَيُسْأَلُونَ.
অধিকন্তু তারা ফিরিস্তাদেরকে, যারা কিনা আল্লাহর বান্দা, নারী গণ্য করেছে। তবে কি তাদের সৃজনকালে তারা উপস্থিত ছিলো? তাদের এ দাবি লিপিবদ্ধ করা হবে এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। -সুরা যুখরুফ : ১৯
এ ছাড়াও আরও অসংখ্য বিষয় আছে, যা থেকে প্রতিয়মান হয় যে, হিন্দুদের দেবতা বা ঈশ্বর আর ফিরিস্তা কখনও, কোনোভাবেই, কোনো ক্রমেই এক হতে পারে না। কিন্তু হেযবুত তওহীদ হিন্দুদের দেবতা ও ফিরিস্তা এক বলে আখ্যায়িত করে সম্মানিত ফিরিস্তাদেরকে চরম অপমান করেছে। যা ফিরিস্তাদের সাথে শত্রুতারও প্রমাণ বহন করে। অথচ ফিরিস্তাদের শত্রুদের ব্যাপারে মহান রব বলেন,
مَن كَانَ عَدُوًّا لِّلّهِ وَمَلآئِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللّهَ عَدُوٌّ لِّلْكَافِرِينَ
যদি কোনও ব্যক্তি আল্লাহর, তাঁর ফিরিশতাদের, তাঁর রাসুলগণের এবং জিবরাঈল ও মিকাঈলের শত্রু হয়, তবে (সে শুনে রাখুক) আল্লাহ কাফিরদের শত্রু। -সুরা বাকারা : ৯৮