Home > হিজবুত তাওহীদ > —ফিরিস্তাদের ব্যাপারে কটুক্তি:

—ফিরিস্তাদের ব্যাপারে কটুক্তি:

ফিরিস্তারা আল্লাহপাকের এক অসাধারণ সৃষ্টি ও সম্মানিত বান্দা। যাঁদেরকে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাঁর সৈনিক হিশেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এই ফিরিস্তাদের সম্পর্কেও কটুক্তি করতে পিছপা হয়নি হেযবুত তওহীদ। তাদের দাবি হলো,
১. ফিরিস্তারা শুধু প্রাকৃতিক শক্তি।
২. ফিরিস্তা এবং দেবতা একই জিনিষ।

ফিরিস্তারা কী শুধু প্রাকৃতিক শক্তি?
মহান আল্লাহ-র সম্মানিত এক সৃষ্টির নাম ফিরিস্তা। যাঁদেরকে আল্লাহ-র সৈনিক বলে পবিত্র কুরআনে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যাঁরা প্রাণীজগের অন্তুর্ভূক্ত একটি সৃষ্টি। তবে মহান রবের ঘোষণা অনুযায়ী ফিরিস্তারা তাঁর অনুগত ও সম্মানিত বান্দা।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের কাছে ফিরিস্তারা শুধু প্রাকৃতিক শক্তি মাত্র। আগে দেখুন ফিরিস্তাদের সম্পর্কে হেযবুত তওহীদ কী লিখেছে,
মানুষকে বিজ্ঞান শেখাবার পর তিনি (আল্লাহ) তার মালায়েকদের ডেকে সব জিনিষের নাম জিজ্ঞেস কোরলেন- তারা বোলতে পারলেন না। কারণ আগেই বোলেছি মালায়েকরা প্রাকৃতিক শক্তি মাত্র। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ.  ১৯

সংখ্যায় এরা (ফেরেস্তারা) অগন্য এবং এরা আসলে প্রাকৃতিক শক্তি- যে শক্তি দিয়ে আল্লাহ তার সমস্ত সৃষ্টিকে শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে পরিচালনা করেন এবং এদের কোন ইচ্ছাশক্তি নেই । আল্লাহ যাকে যে নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন, যাকে যে কর্তব্য নির্ধারণ কোরে দিয়েছেন সে ফেরেশতা সামান্যতম বিচ্যুতি না কোরে তা যথাযথ কোরে যাচ্ছেন। আসলে কোন বিচ্যুতি হোতে পারে না- কারণ প্রাকৃতিক শক্তিগুলির কোন স্বাধীন ইচ্ছাই নেই । যেমন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একটি মালায়েক। এর উপর স্রষ্টা কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন সমস্ত কিছুকে আকর্ষণ কোরে ধোরে রাখার। সৃষ্টির প্রথম থেকে এই ফেরেশতা তার কর্তব্য কোরে যাচ্ছেন এবং শেষ পর্যন্ত কোরে যাবেন। তার এতটুকু ইচ্ছা শক্তি নেই যে, এক মুহূর্তের এক ভগ্নাংশের জন্যও তিনি এই কাজের বিরতি দেন, সে ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ তাকে দেননি । এমনি আগুন, বাতাস, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তিগুলি- ফেরেশতা, দেব- দেবী। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ.  ১৬; বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ.) এর ভাষণ : পৃ. ২০০

সুতরাং বুঝা গেলো, হেযবুত তওহীদের কাছে ফিরিস্তারা আলাদা কোনো সৃষ্টি নয় বরং শুধুমাত্র প্রাকৃতিক শক্তি মাত্র।

ইসলাম কী বলে?
ফিরিস্তা হলেন আল্লাহপাকের অসাধারণ এক সৃষ্টির নাম। তাঁদেরকে আল্লাহপাক সৃষ্টি করেছেন, আবার তাঁদেরকে মানুষের মত মৃত্যুও দেবেন। তাঁরা আল্লাহ-র ইবাদত করেন, কেউ সিজদায়, কেউ রুকুতে। তারা আল্লাহ-র কাছে তাঁর সম্মানিত ও অনুগত বান্দা এবং তাঁর সৈনিক। চলুন নিন্মে ফিরিস্তাদের সম্পর্কে কিছু আয়াত ও হাদিস দেখি-

এক. ফিরিস্তারা নূর দ্বারা সৃষ্ট।
আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
خُلِقَتِ الْمَلاَئِكَةُ مِنْ نُورٍ وَخُلِقَ الْجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ وَخُلِقَ آدَمُ مِمَّا وُصِفَ لَكُمْ
ফিরিস্তাদেরকে নূর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, আর জিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে নির্ধুম অগ্নিশিখা হতে এবং আদমকে (মানুষকে) সৃষ্টি করা হয়েছে ঐ বস্তু হতে যে সম্পর্কে তোমাদেরকে বর্ণনা করা হয়েছে। (অর্থাৎ মাটি থেকে)। -সহিহ মুসলিম : হাদিস নং : ২৯৯৬

দুই. ফিরিস্তার আল্লাহ-র সৈনিক।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ফিরিস্তাদেরকে নিজের সৈনিক হিশেবে উল্লেখ্য করেছেন,
وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ
তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না। -সুরা মুদ্দাসসির : ৩১

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَاءتْكُمْ جُنُودٌ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَّمْ تَرَوْهَا وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا
হে মুমিনগণ, আল্লাহ তোমাদের প্রতি সেই সময় কীরূপ অনুগ্রহ করেছিলেন তা স্মরণ করো, যখন বহু সৈন্য তোমাদের প্রতি চড়াও হয়েছিলো, তারপর আমি তাদের বিরুদ্ধে এক ঝড়ো হাওয়া পাঠাই এবং এক বাহিনী যা তোমরা দেখতে পাওনি। আর তোমরা যা-কিছু করছিলে, আল্লাহ তা দেখছিলেন। -সুরা আহযাব : ৯

তিন. ফিরিস্তারা আল্লাহ-র সম্মানিত বান্দা।
আরবের কাফেররা ফিরিস্তাদেরকে আল্লাহ তাআলার কন্যা বলে আখ্যায়িত করলে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ফিরিস্তাদেরকে ‘নিজের অনুগত ও সম্মানিত বান্দা’ হিশেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। মহান রব বলেন,
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادٌ مُّكْرَمُونَ
তারা বলে, রহমান (আল্লাহ) সন্তান গ্রহণ করেছেন (আর তাঁর সন্তান হল ফিরিশতাগণ)। সুবহানাল্লাহ! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা।। -সুরা আম্বিয়া : ২৬

চার. ফিরিস্তারা মানুষের প্রহরী হিশেবে কাজ করেন।
ফিরিস্তাদের অন্যতম একটি কাজ হলো- তাঁরা আল্লাহ-র হুকুমে তাঁরই মর্জিমতো মানুষের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন,
لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِّن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللّهِ
প্রত্যেকের সামনে পেছনে এমন প্রহরী (ফিরিস্তা) নিযুক্ত আছে, যাঁরা আল্লাহ-র নির্দেশে পালাক্রমে তার হেফাজত করে থাকে। -সুরা রাদ : ১১

পাঁচ. ফিরিস্তারা আল্লাহ-র তাসবীহ পড়েন।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
وَالْمَلَائِكَةُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِمَن فِي الْأَرْضِ
ফিরিস্তাগণ তাদের প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাসবীহ পাঠ করে এবং পৃথিবীবাসীর জন্য ইসতিগফার করে। -সুরা শুরা : ৫

অপর আয়াতে আল্লাহপাক বলেন,
يُسَبِّحُونَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لَا يَفْتُرُونَ
তাঁরা রাত-দিন তাঁর তাসবীহতে লিপ্ত থাকে, কখনও ক্লান্ত হয় না। -সুরা আম্বিয়া : ২০

ছয়. ফিরিস্তারা সব সময় আল্লাহ-র অনুগত থাকেন।
মহান রব বলেন,
وَلِلّهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ مِن دَآبَّةٍ وَالْمَلآئِكَةُ وَهُمْ لاَ يَسْتَكْبِرُونَ يَخَافُونَ رَبَّهُم مِّن فَوْقِهِمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবিতে যতো প্রাণী আছে তারা এবং সমস্ত ফিরিস্তা আল্লাহকেই সিজদা করে এবং তাঁরা মোটেই অহংকার করে না। তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, যিনি তাঁদের উপরে এবং তাঁরা সেই কাজই করে, যার আদেশ তাঁদেরকে করা হয়। -সুরা নাহল : ৪৯-৫০

وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادٌ مُكْرَمُونَ لَا يَسْقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ وَمَنْ يَقُلْ مِنْهُمْ إِنِّي إِلَهُ مِنْ دُونِهِ فَذَلِكَ نَجْزِيهِ جَهَنَّمَ كَذَلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ.
তারা বলে, রহমান (আল্লাহ) সন্তান গ্রহণ করেছেন (আর তাঁর সন্তান হলো ফিরিস্তাগণ)। সুবহানাল্লাহ! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা তাঁকে ডিঙিয়ে কোনো কথা বলে না এবং তাঁরা তাঁর আদেশ মতই কাজ করে। তিনি তাঁদের সম্মুখ ও পিছনের সবকিছু জানেন। তাঁরা কারও জন্য সুপারিশ করতে পারে না, কেবল তাদের ছাড়া, যাদের জন্য আল্লাহ-র পছন্দ হয়। তাঁরা তাঁর ভয়ে থাকে ভীত। তাদের মধ্যে কেউ যদি এমন কথা বলেও (যদিও সেটা অসম্ভব) যে, ‘আল্লাহ ছাড়া আমিও একজন মাবুদ’, তবে আমি তাকে জাহান্নামের শাস্তি দেবো। এরূপ জালেমদেরকে আমি এভাবেই শাস্তি দেই। -সুরা আম্বিয়া : ২৬-২৯

এ ছাড়াও ফিরিস্তাদের ক্ষেত্রে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে। যা থেকে প্রমাণ হয়, ফিরিস্তারা আল্লাহ-র সম্মানিত বান্দা। তাঁদের মর্যাদা সমুন্নত ও উচ্চ। কথা ও কাজে তাঁরা আল্লাহ-র পরিপূর্ণ অনুগত। তাঁরা আল্লাহ-র আদেশ অমান্য করেন না। আল্লাহ-র আদেশ মান্য করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকেন, বরং আল্লাহ-র নির্দেশই তাঁদের ক্রিয়াশীল করে এবং তাঁদের কাজের সুযোগ করে দেয়। সৃষ্টিজগতের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন ছাড়াও আল্লাহ-র ইবাদতে নিমগ্ন থাকা ফিরিস্তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়াও ফিরিস্তারা আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে নবি-রাসুলগণেরর কাছে ওহি আনতেন। আর এটা জানা কথা যে, কোনো প্রাকৃতিক শক্তির পক্ষে ওহি সরবরাহ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ ছাড়াও ফিরিস্তাদের ব্যাপারে কয়েকজনের নাম বর্ণিত হয়েছে। যেমন-রুহ, জিবরাঈল, মিকাইল, ইসরাফিল, রিজওয়ান, মালেক প্রমুখ। তাঁদের পাখা আছে, তাঁরা আকৃতি পরিবর্তন করতে পারেন, তাঁরা নূরের সৃষ্টি ইত্যাদী। সুতরাং ফিরিস্তাদেরকে শুধু প্রাকৃতিক সৃষ্টি বলা চরম অন্যায় ও মারাত্মক ধৃষ্টতা।

তাছাড়া হেযবুত তওহীদ ফিরিস্তাদেরকে যে প্রাকৃতিক শক্তি বলে আখ্যায়িত করলো, অথচ প্রাকৃতিক শক্তিগুলির মাঝে কোনো অনুভূতি ও আত্মা নেই। অথচ ফিরিস্তারা আল্লাহ তাআলার এমন এক সৃষ্টি, যাঁদের মাঝে প্রাণ ও আত্মা বিদ্যমান রয়েছে। কুরআন-হাদিসে ফিরিস্তাদেরকে এমন অনেক অভিধা ও বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত করা হয়েছে যা তাঁদেরকে প্রাণবিশিষ্ট ও শক্তিশালী সৃষ্টি হিশেবে প্রমাণ করে থাকে। ফিরিস্তাগণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অন্যান্য নবিদের কাছে ওহি নিয়ে আগমন করার কথা কুরআন-হাদিসের অনেক জায়গায় উল্লেখ্য রয়েছে। উম্মতের পঠিত দরূদ ও সালাম পাঠকারীদের পক্ষ থেকে আল্লাহ-র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রওজায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যেও একদল ফিরিস্তা নিয়োজিত রয়েছেন। যাঁরা সর্বদা জমিনে বিচরণ করতে থাকেন। জুমআর দিন মসজিদের দরজায় ফিরিস্তারা দণ্ডায়মান হয়ে অগ্রগামী মুসল্লিদের তালিকা প্রস্তুত করার কথাও বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। এ ধরনের আরও অনেক বিষয় আছে, যা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, পন্নী ও হেযবুত তওহীদের ধারণা অনুযায়ী ‘ফিরিস্তারা প্রাকৃতিক শক্তি’ এটা ডাহা মিথ্যাচার। কারণ প্রাকৃতিক শক্তি কখনও আসা-যাওয়া করতে পারে না। তাছাড়া প্রাকৃতিক শক্তি হলে মানুষের আমলও বা লিপিবদ্ধ করেন কীভাবে তাঁরা?

ফিরিস্তা এবং দেবতা কী একই জিনিষ?
সমস্ত মুসলামানকে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আসমানী কিতাবের মতো ফিরিস্তাদের অস্তিত্বের উপরও ঈমান আনয়ন করতে হয়। কালিমায়ে শাহাদাতের মাঝে ফিরিস্তা সংশ্লিষ্ট আকিদাকে আল্লাহ তাআলার তাওহীদের আকিদার পরপরই স্থান দেয়া হয়েছে। শুধু মুসলমানরা নয় বরং নবিদেরকেও ফিরিস্তাকুলের উপর ঈমান আনয়ন করতে হয়েছে। সুরা বাকারার শেষে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ.
রাসুল (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাতে ঈমান এনেছে, যা তাঁর উপর তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ হতে নাযিল করা হয়েছে এবং (তাঁর সাথে) মুমিনগণও। তাঁরা সকলে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিস্তাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসুলগণের প্রতি ঈমান এনেছে। -সুরা বাকারা : ২৮৫

সমস্ত নবি ও মুমিনদের ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে হেযবুত তওহীদ অমুসলিমদের নাপাক দেব-দেবীদের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, মূলত মুশরিকদের দেবতা ও ফিরিস্তা একই জিনিষ। তারা লিখেছে,
ভারতীয়, রোমান এবং গ্রীকরা যে দেব-দেবী Gods, goddess বিশ্বাস করেন সেগুলো এবং মালায়েক বা ফেরেশতা একই জিনিষ। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ.  ১৬; বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ.) এর ভাষণ : পৃ. ২০০

অন্যান্য ধর্মে যেমন দেব-দেবীরা কোন না কোন প্রাকৃতিক শক্তির ভারপ্রাপ্ত, যেমন হিন্দু শাস্ত্রে বরুন বাতাসের দেবতা, সূর্য্য একটি দেবতা- সূর্য্যদেব, গ্রীকদের নেপচুন সমুদ্রের, পানির দেবতা, রোমানদের ভালকান হচ্ছেন আগুনের দেবতা, তেমনি ইসলাম ধর্মেও আগুনের, বাতাসের ইত্যাদির ফেরেশতা আছেন। আরও ব্যাপারে মিল আছে। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ.  ১৬; বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ.) এর ভাষণ : পৃ. ২০০

অর্থাৎ হেযবুত তওহীদ বলতে চায়, অমুসলিমরা যেগুলোকে দেবতা, গড বা ঈশ্বর হিসাবে বিশ্বাস করে, সেগুলো আর ফিরিস্তারা একই জিনিষ। নাউযুবিল্লাহ।

ইসলাম কী বলে?
ক. ফিরিস্তাদের ব্যাপারে তাদের উল্লিখিত দাবি কুরআন-হাদিসের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। কুরআন-হাদিসের অনেক স্থানে ফিরিস্তাদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত অনেক বিষয়ের আলোচনা এসেছে। কিন্তু তাঁরা দেব-দেবী হওয়ার যে দাবি করেছে, তার স্বপক্ষে একটি বিবরণও কুরআন হাদীসে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

খ. আমরা হিন্দুশাস্ত্র পড়লে দেখতে পাই, হিন্দুরা যাদেরকে দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে বিশ্বাস করে তারা সবাই শিরক ও নষ্টামীর রাজত্ব তৈরি করেছিলো। মুশরিকদের সম্পর্কে মহান রব বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلاَ يَقْرَبُواْ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَـذَا
হে মুমিনগণ, মুশরিকরা তো আপাদমস্তক অপবিত্র। সুতরাং এ বছরের পর যেন তারা মসজিদুল হারামের নিকটেও না আসে। -সুরা তাওবা : ২৮

পক্ষান্তরে ফিরিস্তারা আল্লাহ পাকের ঘোষণা অনুযায়ী তাঁর সম্মানিত বান্দা। মহান রব বলেন,
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادٌ مُّكْرَمُونَ
তারা বলে, রহমান (আল্লাহ) সন্তান গ্রহণ করেছেন (আর তাঁর সন্তান হলো ফিরিস্তাগণ)। সুবহানাল্লাহ! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা।। -সুরা আম্বিয়া : ২৬

যেখানে আল্লাহ তাআলা ফিরিস্তাদেরকে তাঁর অনুগত ও সম্মানিত বান্দা বলে আখ্যায়িত করেছেন, সেখানে তাঁদেরকে প্রভুত্বের আসনে বসিয়ে দেব- দেবী বলে আখ্যায়িত করা কখনই সঠিক হতে পারে না।

গ. এক স্থানে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَا في السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مِنْ دَابَّةٍ وَالْمَلَائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ.
আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যতো প্রাণী আছে, তারা এবং সমস্ত ফিরিস্তা আল্লাহকেই সিজদা করে এবং তাঁরা মোটেই অহংকার করে না। -সুরা আন-নাহল : ৪৯

এ আয়াতে ফিরিস্তা ‘প্রাণ সম্পন্ন সৃষ্টি’ হওয়ার বিষয়টি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্ৰমাণিত । এখানে আল্লাহ তাআলা আন্যান্য প্রাণীদের সাথে ফিরিস্তাদেরকেও আল্লাহ-র জন্যে সিজদাকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাথে সাথে এ আয়াত দ্বারা আল্লাহ তাআলা তুর্কি, পারস্যের অগ্নিপূজারী, পন্নী এবং হেযবুত তওহীদসহ বিশ্বের সকল মুশরিক আর পৌত্তলিকদের আকীদা বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করে দিলেন। সুতরাং ফিরিস্তা আর দেবতা বা ঈশ্বর কখনও কী এক হতে পারে?

ঘ. অমুসলিমরা যেগুলোকে দেবতা বলে বিশ্বাস করে, সেগুলোকে তারা আল্লাহ পাকের সমান মর্যাদা ও ক্ষমতাবান বলে বিশ্বাস করে। যেমন হিন্দুদের সৃৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণুু, বিনাশকর্তা শিব ঠাকুর। মুসলিমদের সবকিছুর কর্তাই আল্লাহ। হিন্দুরা তাদের দেবতা বা ঈশ্বর সবাইকে পুজা করে। কিন্তু মুসলিমরা কোনো ফিরিস্তাকে পুজা করেন না। হিন্দু শাস্ত্র মতে যিনি সর্বত্র সমভাবে বিরাজমান তিনিই বিষ্ণু। ইসলাম ধর্মে আল্লাহ তাআলার কুরসী আসমান জমিন সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। কোনো ফিরিস্তাও সর্বত্র বিরাজমান নন। হিন্দুরা যাদেরকে দেবতা অথবা ঈশ্বর হিশেবে বিশ্বাস করেন, তাদের স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা সবই আছে।  কিন্তু ফিরিস্তাদের এসবের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাঁরা আল্লাহর নির্দেশে সৃষ্টি হন।

ঙ. হিন্দুরা যাদেরকে দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে বিশ্বাস করে, তাদের শাস্ত্রমতে প্রায় সবার জিবনেই কিছু না কিছু নারী কেলেঙ্কারীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এমনকি তাদের কাছে সৃষ্টির দেবতা ‘ব্রহ্মা’ নিজের মেয়ের সাথেও যৌনাচার করেছিলো। তাদের ধর্মগ্রন্থেই এটা লেখা আছে,
শতরুপা, প্রথমা নারী। তিনি ব্রহ্মার কন্যা। মৎসপুরানে আছে, নয় জন মানসপুত্র সৃষ্টি করার পর ব্রম্মা এক কন্যা সৃষ্টি । এই কন্যাই শতরূপা, সাবিত্রী, গায়ত্রী, স্বরস্বতী, ও ব্রাহ্মণী নামে খ্যাতা। শতরূপার রূপে মুগ্ধ হয়ে সৃষ্টিকর্তা ব্রম্মা তার কন্যা শতরূপাকে গ্রহণ করেন। ব্রহ্মা তার কন্যার সঙ্গে অজাচারের ফলে প্রথম মনু সায়ম্ভুব-এর জন্ম হয়। -পৌরাণিক অভিধান : পৃ. ৪৯৫

উপরন্তু হিন্দুদের দেবতাদের স্ত্রী, সন্তান সবই আছে। দেখুন তারা কী লিখেছে-
সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী, দেবসেনা ও দৈত্যসেনা এঁর দুই কন্যা। ব্রহ্মা চতুর্ভুজ চতুরানন ও রক্তবর্ণ। প্রথমে তাঁর পাঁচটি মস্তক ছিলো; কিন্তু একদা শিবের প্রতি অসম্মানসূচক বাক্য উচ্চারণ করায় শিবের তৃতীয় নয়নের অগ্নীতে ব্রহ্মার একটি মস্তক দগ্ধ হয়। ব্রহ্মার বাহন হংস। -পৌরনিক অবিধান : পৃ. ৩৮৩

পক্ষান্তরে ফিরিস্তাদের ব্যাপারে এমন কল্পনা করাও ইসলাম ধর্মে মহাপাপ।

চ. তাছাড়া কুরআন-হাদিসের বিস্তারিত বিবরণের আলোকে ফিরিস্তাদের ব্যাপারে তাদের উল্লেখিত ভ্রান্ত ধারণা অনেকগুলো কারণে সঠিক নয়। তা থেকে কয়েকটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
এক. পৌত্তলিকদের দেব-দেবীগুলোর মাঝে স্ত্রীলিঙ্গ ও পুংলিঙ্গ রয়েছে। কিন্তু ফিরিস্তাদের কোনো লিঙ্গ নেই।

দুই. দেব-দেবীদের পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততিও রয়েছে। আর ফেরেশতাদের মাঝে সন্তান প্রজনন ও বংশ পরিচয়ের বিষয় নেই ।

তিন. দেব-দেবীদেরকে ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন সৃষ্টি মনে করা হয় ৷ যারা একজন আরেকজনের উপর রাগান্বিত হয়। কেউ জয়ী আবার কেউ পরাস্ত হয়। ভারতীয় পৌত্তলিকদের দেবতাগুলির ব্যাপারে এ ধরনের অনেক ইতিহাস প্রচলিত আছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার ফেরেশতাগণ এ সমুদয় বিষয় হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র ।

চার. দেব-দেবীরা তাদের পূজারীদের উপাসনায় সন্তুষ্ট হয়ে থাকে। উপাসকরাও তাদের উপাস্য দেবতাগুলিকে তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূর্ণ করে দিতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করে থাকে। অথচ ফেরেশতাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। তাঁরা একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করে থাকেন।

মুশরিকদের আকিদা ও হেযবুতের আকিদা অভিন্ন:
হিন্দু ও পারস্যের অগ্নি পূজারীগণ ফেরেশতাদেরকে দেব-দেবী মনে করে থাকে। জাহেলি যুগের কাফের মুশরিকরাও ফিরিস্তাদেরকে দেবতা ও প্রভু মনে করতো।  আল্লাহ তাআলা তদের এ ভ্রান্ত আকিদা খণ্ডন করে পবিত্র কুরআনে আয়াত অবতীর্ণ করেন । আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَجَعَلُوا الْمَلَائِكَةَ الَّذِينَ هُمْ عِبَادُ الرَّحْمَن إِنَانًا أَشَهِدُوا خَلْقَهُمْ سَتُكْتَبُ شَهَادَتُهُمْ وَيُسْأَلُونَ.
অধিকন্তু তারা ফিরিস্তাদেরকে, যারা কিনা আল্লাহর বান্দা, নারী গণ্য করেছে। তবে কি তাদের সৃজনকালে তারা উপস্থিত ছিলো? তাদের এ দাবি লিপিবদ্ধ করা হবে এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। -সুরা যুখরুফ : ১৯

এ ছাড়াও আরও অসংখ্য বিষয় আছে, যা থেকে প্রতিয়মান হয় যে, হিন্দুদের দেবতা বা ঈশ্বর আর ফিরিস্তা কখনও, কোনোভাবেই, কোনো ক্রমেই এক হতে পারে না। কিন্তু হেযবুত তওহীদ হিন্দুদের দেবতা ও ফিরিস্তা এক বলে আখ্যায়িত করে সম্মানিত ফিরিস্তাদেরকে চরম অপমান করেছে। যা ফিরিস্তাদের সাথে শত্রুতারও প্রমাণ বহন করে। অথচ ফিরিস্তাদের শত্রুদের ব্যাপারে মহান রব বলেন,
مَن كَانَ عَدُوًّا لِّلّهِ وَمَلآئِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللّهَ عَدُوٌّ لِّلْكَافِرِينَ
যদি কোনও ব্যক্তি আল্লাহর, তাঁর ফিরিশতাদের, তাঁর রাসুলগণের এবং জিবরাঈল ও মিকাঈলের শত্রু হয়, তবে (সে শুনে রাখুক) আল্লাহ কাফিরদের শত্রু। -সুরা বাকারা : ৯৮

Check Also

মানবতাই ধর্ম:

প্রিয় পাঠক, হেযবুত তওহীদ ইসলামকে ধর্ম হিসাবে মানতে নারাজ। তাদের কাছে ধর্ম হলো, ‘মানবতা’ বা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.