রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীন ইসলাম প্রচারের উত্তম আচরণ ও নমনীয়তা দিয়ে বিপ্লব তৈরি করেছিলেন। দাওয়াতি মেহনত ছিলো তাঁর জিবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এই মহান কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে মিষ্টার আবুল আ’লা মওদুদী। দেখুন তিনি কী লিখেছেন,
وعظ و تلقین کی نا کامی کے بعد داعی اسلام نے ہاتھ میں تلوار لی
দাওয়াত ও নসীহতের ব্যর্থতার পর ইসলামের দিকে আহ্বানকারী (নবীজি সা.) হাতে তরবারি নিয়েছিলেন। -আল জিহাদ ফিল ইসলাম পৃ. ১৭৪
এই বক্তব্য দিয়ে মিষ্টার মওদুদী সাহেব বুঝাতে চেয়েছেন-
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াতি কাজে ব্যার্থ ছিলেন।
২. ইসলাম প্রচারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তরবারী হাতে তুলে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ তরবারীর জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন।
নাউযুবিল্লাহ। কতো বড় ধৃষ্টতা! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর কতোবড় অপবাদ!
ইসলাম কী বলে?
অথচ ইবনে আব্বাস রা. থেকে আরেকটি সহিহ সনদে হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
ما قاتل رسولُ اللهِ صلّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ قومًا قطُّ إلا دعاهم
নবিজি সাঃ তাওহীদের দাওয়াত না দিয়ে কোনো যুদ্ধই করেননি। -মুসনাদে আহমাদ : হাদিস নং : ২১০৫
অথচ উপরিউক্ত হাদিস থেকে জানা গেলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো জিহাদের দাওয়াতের আগে তরবারী চালাননি। এমন সুস্পষ্ট হাদিস থাকার পরও মওদুদী সাহেব কী করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দাওয়াতি মেহনতের ওপর কলম চালানেন এটা আমাদের বুঝে আসে না।
তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মহান রবের নির্দেশের পূর্ণাঙ্গ অনুসারি। আর মহান রব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে নির্দেশ দিয়ে বলেন,
فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنتَ مُذَكِّرٌ لَّسْتَ عَلَيْهِم بِمُصَيْطِرٍ
সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি উপদেশ দিতে থাক, তুমি তো একজন উপদেশদাতাই। তোমাকে তাদের উপর জবরদস্তি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। -সুরা গাশিয়াহ : ২১-২২
لاَ إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىَ لاَ انفِصَامَ لَهَا وَاللّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
দীনের বিষয়ে কোনও জবরদস্তি নেই। হিদায়াতের পথ গোমরাহী থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। এর পর যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, সে এক মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরল, যা ভেঙ্গে যাওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই। আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও সবকিছু জানেন। -সুরা বাকারা : ২৫৬
وَقُلِ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ فَمَن شَاء فَلْيُؤْمِن وَمَن شَاء فَلْيَكْفُرْ
বলে দাও, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তো সত্য এসে গেছে। এখন যার ইচ্ছা ঈমান আনুক এবং যার ইচ্ছা কুফর অবলম্বন করুক। -সুরা কাহাফ : ২৯
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
এবং (হে নবী!) আমি তোমাকে সমস্ত মানুষের জন্য একজন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই পাঠিয়েছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বুঝছে না। -সূরা সাবা : ২৮
ادْعُ إِلِى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। -সুরা নাহল : ১২৫
প্রিয় পাঠক, এ সকল আয়াত দ্বারা বুঝা যায় দাওয়াতি কাজ করা ছিলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যেখানে আল্লাহপাকই তাঁকে নম্রতার সাথে দাওয়াতি কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে তিনি সেই দাওয়াতি কাজ ছেড়ে তরবারী হাতে তুলে নিয়েছিলেন এবং দাওয়াতি কাজে তিনি ব্যার্থ ছিলেন এটা কী সুস্পষ্ট ভ্রান্তি নয়? মওদুদী সাহেবের বক্তব্য মতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াতি কাজ বাদ দিয়ে হাতে তরবারী তুলে এ সকল আয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এটাই কী প্রমাণিত হলো না? কী জাহালাত! কী ধৃষ্টতা! অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ই ছিলেন আল্লাহপাকের হুকুমের পূর্ণ অনুসারি।
উপরন্তু অন্যায়ভাবে কারো ওপর তরবারী ধারণ করা তো দূরের কথা সামান্যতম জুলুমও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরদাশত করতেন না। এ ব্যাপারে প্রচুর পরিমান দিকনির্দেশনা খোদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ই দিয়েছেন। নিন্মে কয়েকটি হাদিস দেখুন। আবু শুরাইহ রা. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা বলছিলেন,
وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ قِيلَ وَمَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الَّذِي لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَايِقَهُ
আল্লাহর কসম! সে ব্যাক্তি মুমিন নয়। আল্লাহর কসম! সে লোক মুমিন নয়! আল্লাহর কসম। সে ব্যাক্তি মুমিন নয়। জিজ্ঞাসা করা হলঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ কে সে লোক? তিনি বললেনঃ যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে না। -সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৬০১৬
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
أَلَا مَنْ ظَلَمَ مُعَاهِدًا، أَوِ انْتَقَصَهُ، أَوْ كَلَّفَهُ فَوْقَ طَاقَتِهِ، أَوْ أَخَذَ مِنْهُ شَيْئًا بِغَيْرِ طِيبِ نَفْسٍ، فَأَنَا حَجِيجُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তির উপর যুলম করবে বা তার প্রাপ্য কম দিবে কিংবা তাকে তার সামর্থের বাইরে কিছু করতে বাধ্য করবে অথবা তার সন্তুষ্টিমূলক সম্মতি ছাড়া তার কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে বাদী হবো। -সুনানে আবু দাউদ : হাদিস নং : ৩০৫২
এই বক্তব্যগুলো খোদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর। সেই তিনিই তরবারীর জোরে ইসলাম প্রচার করেছিলেন, এটা শয়তানও বিশ্বাস করবে? অবশ্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অমুসলিমদের মধ্যে যারা অপরাধি ও যাদের বিরুদ্ধে কিতাল করার হুকুম মহান রব তাঁকে দিয়েছিলেন, তিনি তাদের বিরুদ্ধে তরবারী হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করতে কাউকে তরবারী দিয়ে বাধ্য করেননি।
আসলেই কী তিনি ব্যার্থ ছিলেন?
আসলেই কী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াতি কাজে ব্যার্থ ছিলেন? নিশ্চয় না, বরং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দাওয়াতি কাজে দিয়েই সাহাবাদের রা. এক বিরাট জামাআত তিনি তৈরি করেছিলেন। তাহলে মওদুদী সাহেব কেন এ ধরণের বক্তব্য দিলেন?
মওদুদী সাহেবের উদ্দেশ্য কী?
বর্তমানে ইহুদী-খ্রিস্টানরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর এ অপবাদ লাগিয়ে থাকে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অস্ত্রের মাধ্যমে দ্বীনের প্রসার করেছিলেন। সেই একই অপবাদ মওদুদী সাহেবও দিলেন। তাহলে তফাৎ কী থাকলো? তাহলে আমরা কী ধরে নেবো যে, ইহুদী-খ্রিস্টানদের মতো মওদুদী সাহেবও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সন্ত্রাসী হিশাবে জানান দিতে চায়?