প্রিয় পাঠক, ইসলাম একটি আদর্শের ধর্ম। নবীজি সা. আদর্শ দিয়েই, দ্বীনের প্রচারের মাধ্যমেই ইসলামের সৌন্দর্য জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু সে ধর্মকে একটি ত্রাসের ধর্ম বানানোর জন্য ইসলাম বিদ্বেষীরা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। আর সেই ইসলাম বিদ্বেষীদের মিশন বাস্তবায়ণে বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ। তারা বলতে চায়, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রক্রিয়া হলো শুধুমাত্র সশস্ত্র যুদ্ধ। নরম নরম কথা বলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার কোনো নিয়ম আল্লাহ তাঁর রাসুল সা. কে দেননি। চলুন আগে তাদের দাবিটা দেখা যাক।
হেযবুত তওহীদের দাবি:
হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা বায়াজীদ খান পন্নী লিখেছেন,
‘আল্লাহ তার রাসুলকে (দঃ) যে দীন জীবন-বিধান দিয়ে পৃথিবীতে পাঠালেন তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য পথ, প্রক্রিয়া, তরিকা (Process) স্থির কোরলেন সামরিক। অর্থাৎ আল্লাহ তার প্রেরিতকে (দঃ) এ নির্দেশ দিলেন না যে, তুমি মানুষকে বক্তৃতা, ওয়ায কোরে যুক্তি দিয়ে, এই দ্বীনের মহাত্ম-গুন বর্ণনা কোরে মানুষকে এটা গ্রহণ কোরতে আহ্বান কর। এ নির্দেশেও দিলেন না যে তাবলীগ কোরে পৃথিবীর মানুষকে এই দ্বীনে প্রবেশ করাও। এ নির্দেশ আল্লাহ দেননি এই কারণে যে তিনি নিজে এই মানব জাতির স্রষ্টা, তিনি এর মনস্তত্বেরও স্রস্টা। তাই তিনি জানেন যে এই মানুষের দেহের-মনের ভিতরে শক্তিশালী শয়তানকে প্রবেশ করার অনুমতি দেবার পর খুব কম সংখ্যক মানুষই এমন থাকবে যারা তাদের বিবেক, বুদ্ধি, যুক্তি ব্যবহার কোরে দ্বীনের এই প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব বুঝে রসুলের (দঃ) ঐ আহ্বানকে মেনে নিয়ে এই দ্বীন গ্রহণ কোরবে। কাজেই তিনি তার রাসূলকে (দঃ) নির্দেশ দিলেন সামরিক শক্তি বলে এই কাজ করার। তার এই আদেশ কোরাময় ছড়িয়ে আছে। আল্লাহর এই নীতিকে বুঝে তার রসূল (দঃ) ঘোষণা করলেন “আমি আদিষ্ট হোয়েছি সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না সমস্ত মানবজাতি এক আল্লাহকে সর্বময় প্রভু বোলে স্বীকার না করে এবং আমাকে তার প্রেরিত বোলে মেনে না নেয়।’
সূত্র এ ইসলাম ইসলামী নয় পৃষ্ঠা: ৩৪
উক্ত কথা দিয়ে পন্নী সাহেব বুঝাতে চেয়েছেন-
১. আল্লাহ তা’আলা নবীজিকে সা. ওয়াজ,বক্তব্য,যুক্তি দিয়ে এক কথায় তাবলীগের মাধ্যমে দ্বীন বুঝাতে নির্দেশ দেননি।
২. আল্লাহ তা’আলা নবীজিকে সা. একটাই দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে মানুষকে জোর করে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে বাধ্য করা।
ইসলাম কি বলে?
এক.
‘আল্লাহ তা’আলা নবীজিকে সা. ওয়াজ,বক্তব্য,যুক্তি দিয়ে দ্বীন বুঝাতে নির্দেশ দেননি’ বলে যে মন্তব্য পন্নী সাহেব করেছেন, এটা কুরআনের উপর সুস্পষ্ট মিথ্যাচার।
ادْعُ إِلِى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
অর্থ: (হে নবী,) তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর ওয়াজের (উপদেশের) মাধ্যমে আহবান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন।
সূরা নাহল, আয়াত: ১২৫
উক্ত আয়াতে নবীজিকে সা. মহান আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে সুন্দর কথার মাধ্যমে ওয়াজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَقُولُونَ وَمَا أَنتَ عَلَيْهِم بِجَبَّارٍ فَذَكِّرْ بِالْقُرْآنِ مَن يَخَافُ وَعِيدِ
অর্থ: তারা যা বলে, তা আমি সম্যক অবগত আছি। আপনি তাদের উপর জোরজবরকারী নন। অতএব, যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কোরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান করুন।
সূরা ক্ব-ফ, আয়াত: ৪৫
উক্ত আয়াতেও কুরআন মাজীদের মাধ্যমে উপদেশ তথা ওয়াজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পন্নী সাহেবের দাবি এ আয়াতগুলোর প্রকাশ্য বিরোধী। যদি তিনি আয়াতগুলো না পড়ে থাকেন, তাহলে তিনি মুর্খতাবশত এমন কথা লিখেছেন, অথবা জেনে শুনেই আল্লাহর উপর মিথ্যাচার করেছেন।
ইসলামে তাবলীগ কি নেই?
পন্নী সাহেব মূলত তাবলীগ (দ্বীন প্রচার) নয়, বরং সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমেই তাওহীদ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন এবং তিনি দ্বীনের তাবলীগকে অস্বীকার করেছেন। অথচ মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللّهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
অর্থ: হে রসূল, পৌছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।
সুরা মায়িদা, আয়াত: ৬৭
অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
فَإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلاَغُ الْمُبِينُ
অর্থ: অতঃপর যদি তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, তবে আপনার কাজ হল সুস্পষ্ট ভাবে পৌছে দেয়া মাত্র।
সুরা নাহল, আয়াত: ৮২
আরেকটি আয়াত দেখুন,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থ: আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।
সুরা সাবা, আয়াত: ২৮
উপরন্তু মক্কার কাফেররা যখন নবীজির সা. চাচা আবু তালেবকে হুমকি দিয়ে গিয়েছিলো, তখন তিনি সার্বিক পরিস্থিতির বিষয় যখন নবীজিকে সা. অবগত করলেন, তখন নবীজি সা. তাকে বললেন,
يا عم والله لو وضعوا الشمس في يميني والقمر في يساري على أن أترك هذا الأمر حتى يظهره الله أو أهلك فيه ما تركته
অর্থাৎ হে চাচা, আল্লাহর কসম! যদি তারা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় এর বিনিময়ে আমি মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া ছেড়ে দেই, তবুও আমি সেটা করবো না, যতক্ষণ না আল্লাহ এই দ্বীনকে বিজয় করেন, অথবা এই পথে আমি আমার জিবন বিলিয়ে দেই।
সূত্র: সীরাতে ইবনে হিশাম, খ. ১ পৃ. ২৬৬
উপরোক্ত আয়াতসমূহ এবং হাদিসসহ অসংখ্য দলীল কুরআন হাদিসে ভুরিভুরি পাওয়া যাবে। যেখানে তাওহীদ-রিসালাতের দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাসুলুল্লাহ সা. এর মক্কার ১৩ বছরের ইতিহাস ছিলো শুধুমাত্র তাবলীগে দ্বীন বা দ্বীন প্রচার। জিহাদ তখনও ফরজ হয়নি। তাহলে তাবলীগ অস্বীকার করা মানেই নবীজির সা. ১৩ বছরের মিশনকে অস্বীকার করে দেওয়া।
নবীজি কি শুধুই যুদ্ধ করতে এসেছিলেন?
পন্নী সাহেবের দাবি হলো এটাই যে, নবীজির সা. দায়িত্ব ছিলো শুধু সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنتَ مُذَكِّرٌ لَّسْتَ عَلَيْهِم بِمُصَيْطِرٍ
অর্থ: অতএব, আপনি উপদেশ দিন, আপনি তো কেবল একজন উপদেশদাতা, আপনি তাদের শাসক নন।
সূরা গাশিয়াহ, আয়াত: ২১
উক্ত আয়াত দ্বারা কি বুঝা যায়? পন্নী সাহেব সত্যবাদী না চরম পর্যায়ের মিথ্যুক?
অভিযোগ:
অবশ্য তার কথা প্রমাণিত করার জন্য হেযবুত তওহীদের লোকেরা বলবেন, এসব বিধিবিধান জিহাদের আয়াত নাজিল হওয়ার আগের।
জবাব:
এক.
পন্নী সাহেব তার বক্তব্যের মাঝে মাক্কী যিন্দেগী না মাদানী যিন্দেগী এমন তফাৎ করেননি। সুতরাং তার দাবি যে মিথ্যা এটা অস্বীকার করার সুযোগ রইলো না।
দুই.
জিহাদ ফরজ হওয়ার পরও ইসলামের দাওয়াত চালু ছিলো। এমনকি যুদ্ধ করার আগেও দ্বীনের তাবলীগ করতে হতো। হযরত সুলাইমান ইবনু বুরাইদাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন সেনাবাহিনী কিংবা সেনাদলের উপর আমীর নিযুক্ত করতেন তখন তাঁদেরকে বেশ কিছু নসিহাত করতেন, তার মধ্যে এটাও বলতেন,
وَإِذَا لَقِيتَ عَدُوَّكَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ فَادْعُهُمْ إِلَى ثَلاَثِ خِصَالٍ أَوْ خِلاَلٍ فَأَيَّتُهُنَّ مَا أَجَابُوكَ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ وَكُفَّ عَنْهُمْ ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى الإِسْلاَمِ فَإِنْ أَجَابُوكَ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ وَكُفَّ عَنْهُمْ ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى التَّحَوُّلِ مِنْ دَارِهِمْ إِلَى دَارِ الْمُهَاجِرِينَ وَأَخْبِرْهُمْ أَنَّهُمْ إِنْ فَعَلُوا ذَلِكَ فَلَهُمْ مَا لِلْمُهَاجِرِينَ وَعَلَيْهِمْ مَا عَلَى الْمُهَاجِرِينَ فَإِنْ أَبَوْا أَنْ يَتَحَوَّلُوا مِنْهَا فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّهُمْ يَكُونُونَ كَأَعْرَابِ الْمُسْلِمِينَ يَجْرِي عَلَيْهِمْ حُكْمُ اللَّهِ الَّذِي يَجْرِي عَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَلاَ يَكُونُ لَهُمْ فِي الْغَنِيمَةِ وَالْفَىْءِ شَىْءٌ إِلاَّ أَنْ يُجَاهِدُوا مَعَ الْمُسْلِمِينَ فَإِنْ هُمْ أَبَوْا فَسَلْهُمُ الْجِزْيَةَ فَإِنْ هُمْ أَجَابُوكَ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ وَكُفَّ عَنْهُمْ فَإِنْ هُمْ أَبَوْا فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَقَاتِلْهُمْ
অর্থাৎ যখন তুমি মুশরিক শত্রুর সম্মুখীন হবে, তখন তাকে তিনটি বিষয় বা আচরণের প্রতি আহ্বান জানাবে। তারা এগুলোর মধ্য থেকে যেটিই গ্রহণ করে, তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়াবে।
প্রথমে তাদের ইসলামের দিকে দাওয়াত দিবে। যদি তারা তোমার এ আহবানে সাড়া দেয়, তবে তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে সরে দাঁড়াবে। এরপর তুমি তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে মুহাজিরদের এলাকায় (মদীনায়) চলে যাওয়ার আহ্বান জানাবে। এবং তাদের জানিয়ে দিবে যে, যদি তারা তা কার্যকরী করে, তবে মুহাজিরদের জন্য যেসব উপকার ও দায়-দায়িত্ব রয়েছে, তা তাদের উপর কার্যকরী হবে। আর যদি তারা বাড়ি-ঘর ছেড়ে যেতে অস্বীকার করে, তবে তাদের জানিয়ে দেবে যে, তারা সাধারণ বেদুঈন মুসলিমদের মত গণ্য হবে। তাদের উপর আল্লাহর সে বিধান কার্যকরী হবে, যা মুমিনদের উপর কার্যকরী হয় এবং তারা গনীমাত ও ফাই* থেকে কিছুই পাবে না। অবশ্য মুসলিমের সঙ্গে শামিল হয়ে যুদ্ধ করলে তার অংশীদার হবে।
আর যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তবে তাদের কাছে জিযয়াহ্ প্রদানের দাবী জানাবে। যদি তারা তা গ্রহণ করে নেয়, তবে তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে। আর যদি তারা এ দাবী না মানে তবে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়বে।
সূত্র: সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৩১
প্রিয় পাঠক, উক্ত হাদিসে জিহাদ শুরু করার আগে তিনটি ধাপ অতিক্রম করতে বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপ হলো, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। এজন্য নবীজি সা. কোনো জিহাদে গেলে আগে সেই সম্প্রদায়ের কাছে ইসলামের দাওয়াতের তাবলীগ করতেন। ইবনে আব্বাস রা. থেকে সহিহ সনদে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
ما قاتل رسولُ اللهِ صلّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ قومًا قطُّ إلا دعاهم
অর্থাৎ নবীজি সা. তাওহীদের দাওয়াত না দিয়ে কোনো যুদ্ধই করেননি।
সূত্র: মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২১০৫ দারেমী: ২৪৪৪
সুতরাং এরপরও যদি কেউ বলে, ‘মানুষকে বক্তৃতা, ওয়াজ করে যুক্তি দিয়ে, এই দ্বীনের মহাত্ম-গুন বর্ণনা করে মানুষকে এটা গ্রহণ করতে আহ্বান করার কথা আল্লাহ তাঁর রাসুল সা. কে বলেননি।’ সে কতবড় মিথ্যুক ভেবে দেখেছেন?
এর পেছনে রহস্য কি?
আসলে এরা আদর্শের মূর্তপ্রতিক রাসুৃলুল্লাহ সা. কে সন্ত্রাসী(?) ও সৌন্দর্যময় ইসলামকে ত্রাসের ধর্ম হিসাবে সমাজে পরিচিত করতে চায়। এরা মূলত নেক সুরতে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এটা যেকোনো জ্ঞানীরাই বুঝবেন।
অভিযোগ:
অবশ্য পন্নী সাহেব তার মত প্রতিষ্ঠিত করতে কুরআনে কারীমের একটি আয়াত পেশ করে থাকেন। আয়াতটি হলো,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلّهِ فَإِنِ انتَهَواْ فَلاَ عُدْوَانَ إِلاَّ عَلَى الظَّالِمِينَ
অর্থ: আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর, যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত হয়ে যায় তাহলে কারো প্রতি কোন জবরদস্তি নেই, কিন্তু যারা যালেম (তাদের ব্যাপারে আলাদা)।
সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯৩
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا لَا إله إِلَّا اللَّهُ
এ আয়াতে তো বলা হয়েছে যুদ্ধ করতেই থাকতে হবে।
এর জবাব কি?
জবাব:
উক্ত আয়াত দেখলেই স্বাভাবিকভাবে বুঝা যায়, আল্লাহ সকল মুশরিকদের হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আগে পরের আয়াত দেখলে পুরো বিষয়টি ক্লিয়ার হবে। চলুন আগের আয়াতগুলো দেখা যাক। মহান রব বলেন,
وَقَاتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُواْ إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبِّ الْمُعْتَدِينَ
وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأَخْرِجُوهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ
وَلاَ تُقَاتِلُوهُمْ عِندَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّى يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ فَإِن قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ كَذَلِكَ جَزَاء الْكَافِرِينَ فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
অর্থ: আর লড়াই করো, আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।
আর তাদেরকে হত্যাকর যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে যেখান থেকে তারা বের করেছে তোমাদেরকে। বস্তুতঃ ফেতনা ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। আর তাদের সাথে লড়াই করো না মসজিদুল হারামের নিকটে যতক্ষণ না তারা তোমাদের সাথে সেখানে লড়াই করে। অবশ্য যদি তারা নিজেরাই তোমাদের সাথে লড়াই করে। তাহলে তাদেরকে হত্যা কর। এই হল কাফেরদের শাস্তি।
আর তারা যদি বিরত থাকে, তাহলে আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু।
সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯০-১৯২
এ আয়াতগুলোর পরপরই আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلّهِ فَإِنِ انتَهَواْ فَلاَ عُدْوَانَ إِلاَّ عَلَى الظَّالِمِينَ
অর্থ: আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর, যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত হয়ে যায় তাহলে কারো প্রতি কোন জবরদস্তি নেই, কিন্তু যারা যালেম (তাদের ব্যাপারে আলাদা)।
সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯৩
পাঠক, একটু ভালো করে পড়ে বুঝে বলুন তো, এখানে কি পৃথিবীর সকল কাফেরকে হত্যা করতে বলা হয়েছে? নাকি যারা ইতিপূর্বে সাহাবায়ে কেরাম রা. কে শহীদ করেছিলো, যারা তাঁদেরকে ঘর-বাড়ি ছাড়া করেছিলো, যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তরবারী উঠায় তাদের সম্পর্কে? যারা অমুসলিম কিন্তু শান্তি প্রিয় তাদের হত্যা করা কি ইসলামে বৈধ? নিশ্চয় না। কারণ সহিহ সনদে নবীজি সা. এর একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি সা. বলেন,
أَلَا مَنْ ظَلَمَ مُعَاهِدًا، أَوِ انْتَقَصَهُ، أَوْ كَلَّفَهُ فَوْقَ طَاقَتِهِ، أَوْ أَخَذَ مِنْهُ شَيْئًا بِغَيْرِ طِيبِ نَفْسٍ، فَأَنَا حَجِيجُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
অর্থাৎ সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তির উপর যুলম করবে বা তার প্রাপ্য কম দিবে কিংবা তাকে তার সামর্থের বাইরে কিছু করতে বাধ্য করবে অথবা তার সন্তুষ্টিমূলক সম্মতি ছাড়া তার কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে বাদী হবো।
সূত্র: সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩০৫২
সুতরাং ইসলামের অপব্যাখ্যা করে পন্নী সাহেব যে ভ্রান্তি সমাজে ছড়িয়ে গেছেন, তার এ মতবাদের বেড়াজালে আটকা পড়ে ঈমান হারানো থেকে সবাই সতর্ক থাকবেন বলে আশাবাদী।
মক্কায় নির্মম নির্যাতনের মুখেও কোন সাহাবীকে অস্ত্র হাতে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
সূত্র: হলি আর্টিজেনের পর পৃষ্ঠা-১৮।