জিহাদের অপব্যাখ্যা:
প্রিয় দ্বীনি ভাই, ইসলামে জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। যে কারণে জিহাদের ব্যাপারে প্রচুর আয়াত রয়েছে পবিত্র কুরআনে হাকীমে। সুতরাং এই জিহাদ নিয়ে যেকারো মন্তব্য করার আগে জিহাদ বিষয়ে ইসলামের পূর্ণ কনসেপ্ট জানা আবশ্যক। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ি দুটোই ঈমান নষ্টের কারণ হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে কেউ তো জিহাদকে একেবারেই তুচ্ছ বিষয় মনে করে এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। আবার কেউ এটাকেই পুঁজি করে বিভিন্ন ধরণের বিধ্বংসী কাজ করে থাকে। কেউ আবার জিহাদকেই ইসলাম বলে সমাজের মানুষের কাছে ইসলামকে একটা সন্ত্রাসী ধর্ম হিসাবে আখ্যায়িত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। হেযবুত তওহীদই সেই সংগঠণ যারা জিহাদের নামে মানুষকে উগ্রবাদ শিক্ষা দিচ্ছে। চলুন আগে জিহাদ সম্পর্কে তাদের মন্তব্যগুলো এক নজরে দেখে নেওয়া যাক। তাদের দাবি হলো,
১. ইসলামের মূল কাজ হলো জিহাদ।
২. নবিজি সাঃ-এর কাজই ছিলো যুদ্ধ করা।
৩. তাবলীগ নবিজি সাঃ-এর দায়িত্ব ছিলো না।
৪. নবিজি সাঃ-এর সুন্নাহ মানেই জিহাদ।
৫. খেলাফত কায়েমের পদ্ধতি সশস্ত্র সংগ্রাম।
৬. যুদ্ধে জয় লাভ করতে পার্থিব উপকরণ যথেষ্ট।
৭. জিহাদ আত্মরক্ষামূলক নয় বরং আক্রমানত্মক।
৮. ঈমানদানের পরিচয় শুধুমাত্র জিহাদ করা।
৯. মুজাহিদদের মর্যাদা নবিদের চেয়েও বেশী।
১০. জান্নাত-জাহান্নাম একমাত্র জিহাদের উপর নির্ভরশীল।
১১. মুজাহিদ কবীরা গুনাহ করলেও জাহান্নামে যাবে না।
১২. জিহাদ না করলে সে কাফের-মুশরিক।
চলুন প্রত্যেকটি বিষয়ে প্রমাণসহ বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
এক. ইসলামের মূল কাজ কী জিহাদ?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ইসলামের মূল হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিহাদ করা। তারা লিখেছেন,
মানবতার কল্যাণে ভূমিকা রাখাই মানুষের প্রকৃত এবাদত। মোমেন হওয়ার প্রথম শর্তই হলো কালেমায়ে তাওহীদে ঈমান আনা অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই। মোহাম্মদ স: আল্লাহর রসুল। আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসাবে মানার অর্থ হলো- যাবতীয় অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এ তাওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হলে তারা হবে মোমেন। এই মোমেনদের সঙ্গে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে তিনি তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিবেন, রক্ষা করবেন, দুনিয়ার জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা এবং পরকালে জান্নাত দিবেন’। [মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ১০৯/১১৪]
অর্থাৎ তাদের মতবাদ হলো, জিহাদই ইসলামের মূল কাজ। এ জিহাদই ছিলো নবিজি সাঃ ও সাহাবায়ে কেরামের মূল কাজ।
ইসলাম কী বলে?
ইসলামের মূল স্তম্ভ পাঁচটি। হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত ইবনু উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেন,
بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ
ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। যথা-
১। আল্লাহ্ ছাড়া ইলাহ্ নেই এবং নিশ্চয় মুহাম্মদ আল্লাহ্র রাসূল-এ কথার সাক্ষ্য দান।
২। সালাত (নামায/নামাজ) কায়েম করা
৩। যাকাত দেওয়া
৪। হাজ্জ (হজ্জ) করা এবং
৫। রামাদান এর সিয়াম পালন করা। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৮]
উক্ত হাদিসে ইসলামের স্তম্ভ বলা হয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে জিহাদ নেই। অবশ্য জিহাদও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম একটি বিধান। কিন্তু এই জিহাদই ইসলামের মূল কাজ বা স্তম্ভ দাবি করা কী এ হাদিসের পরিস্কার বিরোধীতা নয়? উপরন্তু ইবনে আব্বাস রা. থেকে আরেকটি সহিহ সনদে হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
ما قاتل رسولُ اللهِ صلّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ قومًا قطُّ إلا دعاهم
নবিজি সাঃ তাওহীদের দাওয়াত না দিয়ে কোনো যুদ্ধই করেননি। [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ২১০৫]
বুঝা গেলো, জিহাদের পূর্বতম শর্ত হলো তাবলীগ করা বা দাওয়াত দেওয়া। এই দাওয়াতের মাধ্যমে যদি তারা দ্বীন মেনে নেয় তাহলে তো জিহাদের প্রয়োজনীয়তাই আর থাকে না। তাহলে আপনারা বলুন ইসলামের মূল কাজ কী জিহাদ?
দুই. নবিজি সাঃ-এর কাজই ছিলো কী শুধু যুদ্ধ করা?
হেযুত তওহীদ কী বলে?
পন্নী সাহেবের দাবি হলো এটাই যে, নবীজির সা. দায়িত্ব ছিলো শুধু সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। তারা লিখেছেন,
তিনি (নবীজি সা.) আল্লাহ থেকে আদেশপ্রাপ্ত হয়ে নিজের দায়িত্ব ঘোষণা করলেন, আমি আদিষ্ট হয়েছি ততক্ষণ পর্যন্ত স্বশস্ত্র সংগ্রাম (কেতাল) চালিয়ে যেতে, যে পর্যন্ত না প্রত্যেকটি মানুষ আল্লাহকে তাদের একমাত্র এলাহ হিসাবে এবং আমাকে আল্লাহর রসূল হিসাবে মেনে না নেয় (আব্দুল্লাহ এবনে ওমর রা: থেকে বোখারী)। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৯৯]
শেষ রাসুল এই জাতিটিকে গঠন করেছিলেন সশস্ত্র সংগ্রাম করে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর আইন কানুন অর্থাৎ দ্বীন প্রতিষ্ঠার কার্যকারী করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। [যুগসন্ধিক্ষণে আমরা : পৃ. ১]
এই উম্মাহকে গঠন করেছিলেন, আর সেটি হলো সশস্ত্র সংগ্রাম করে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর আইন-কানুন অর্থাৎ দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও কার্যকরী করে মানবজাতির ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সমস্ত অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, শোষণ, অত্যাচার নিঃশেষ করে দিয়ে নায়, সুবিচার, নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৭]
আবু বকর রা: থেকে শুরু করে হাজার হাজার আসহাব তাদের শুধু মাকে ছেড়ে নয়, বাপ-মা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সম্পত্তি বাড়ি-ঘরে হেলায় ত্যাগ করে এসে মহানবীর স: সঙ্গী হয়েছেন। তার সঙ্গে সব রকম দুঃখ বরণ করেছেন। বছরের-পর-বছর ছায়াহীন উত্তপ্ত মরুভূমিতে কাটিয়েছেন। বিশ্বনবীর দায়িত্ব পূরণের সশস্ত্র সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। [বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ২০]
প্রতিটি সাহাবা তাদের পার্থিব সবকিছু কোরবান করে স্ত্রী-পুত্রকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে বছরের পর বছর আরব থেকে বহুদূরে অজানা-অচেনা দেশের সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। [বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৪৮]
যতদিন ওই দায়িত্বপূর্ণ করা না হবে ততদিন তার উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব অপূর্ণ, অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাই তিনি এমন একটি জাতি সৃষ্টি করলেন পৃথিবী থেকে তাঁর চলে যাওয়ার পরও সে জাতি তার উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য তাঁরই মত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই জাতি হলো তাঁর উম্মাহ, উম্মতে মুহাম্মাদী -মোহাম্মাদের জাতি। [আকিদা : পৃ. ১২]
আল্লাহর রসুলের ইসলাম নির্জনবাসি কামেল সুফী সাধক ওয়ায়েস করনী (রা.) কে নির্জনবাস থেকে বের করে এনে তলোয়ার হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ করেছিল। আর বর্তমানের এই ইসলাম যোদ্ধার হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তার হাতে তসবিহ ধরিয়ে দিয়ে মসজিদে আর খানকায় বসিয়ে দেয়। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ১৬]
অর্থাৎ তারা বলতে চায়, ইসলামের মূল হলো, স্বশস্ত্র সংগ্রাম করা।
ইসলাম কী বলে?
অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنتَ مُذَكِّرٌ لَّسْتَ عَلَيْهِم بِمُصَيْطِرٍ
অতএব, আপনি উপদেশ দিন, আপনি তো কেবল একজন উপদেশদাতা, আপনি তাদের শাসক নন। [সূরা গাশিয়াহ : ২১]
উক্ত আয়াত দ্বারা কি বুঝা যায়? নবিজি সাঃ-এর দায়িত্ব ছিলো শুধু সংগ্রাম করা? নিশ্চয় না। তাহলে পন্নী সাহেব সত্যবাদী না চরম পর্যায়ের মিথ্যুক?
অভিযোগ:
অবশ্য পন্নী সাহেবের কথা সত্য বলে প্রমাণ করার জন্য হেযবুত তওহীদের লোকেরা হয়তো বলবেন, এসব বিধিবিধান জিহাদের আয়াত নাজিল হওয়ার আগের। অতএব এগুলো দলীল হতে পারে না।
জবাব:
এক. পন্নী সাহেব তার বক্তব্যের মাঝে মাক্কী যিন্দেগী না মাদানী যিন্দেগী এমন তফাৎ করেননি। সুতরাং তাদের অভিযোগ যে মিথ্যা এটা অস্বীকার করার সুযোগ রইলো না।
দুই. জিহাদ ফরজ হওয়ার পরও ইসলামের দাওয়াত চালু ছিলো। এমনকি যুদ্ধ করার আগেও দ্বীনের তাবলীগ করতে হতো। হযরত সুলাইমান ইবনে বুরাইদাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ যখন কোন সেনাবাহিনী কিংবা সেনাদলের উপর আমীর নিযুক্ত করতেন তখন তাঁদেরকে বেশ কিছু নসিহাত করতেন, তার মধ্যে এটাও বলতেন,
وَإِذَا لَقِيتَ عَدُوَّكَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ فَادْعُهُمْ إِلَى ثَلاَثِ خِصَالٍ أَوْ خِلاَلٍ فَأَيَّتُهُنَّ مَا أَجَابُوكَ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ وَكُفَّ عَنْهُمْ ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى الإِسْلاَمِ فَإِنْ أَجَابُوكَ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ وَكُفَّ عَنْهُمْ ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى التَّحَوُّلِ مِنْ دَارِهِمْ إِلَى دَارِ الْمُهَاجِرِينَ وَأَخْبِرْهُمْ أَنَّهُمْ إِنْ فَعَلُوا ذَلِكَ فَلَهُمْ مَا لِلْمُهَاجِرِينَ وَعَلَيْهِمْ مَا عَلَى الْمُهَاجِرِينَ فَإِنْ أَبَوْا أَنْ يَتَحَوَّلُوا مِنْهَا فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّهُمْ يَكُونُونَ كَأَعْرَابِ الْمُسْلِمِينَ يَجْرِي عَلَيْهِمْ حُكْمُ اللَّهِ الَّذِي يَجْرِي عَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَلاَ يَكُونُ لَهُمْ فِي الْغَنِيمَةِ وَالْفَىْءِ شَىْءٌ إِلاَّ أَنْ يُجَاهِدُوا مَعَ الْمُسْلِمِينَ فَإِنْ هُمْ أَبَوْا فَسَلْهُمُ الْجِزْيَةَ فَإِنْ هُمْ أَجَابُوكَ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ وَكُفَّ عَنْهُمْ فَإِنْ هُمْ أَبَوْا فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَقَاتِلْهُمْ
যখন তুমি মুশরিক শত্রুর সম্মুখীন হবে, তখন তাকে তিনটি বিষয় বা আচরণের প্রতি আহ্বান জানাবে। তারা এগুলোর মধ্য থেকে যেটিই গ্রহণ করে, তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়াবে। প্রথমে তাদের ইসলামের দিকে দাওয়াত দিবে। যদি তারা তোমার এ আহবানে সাড়া দেয়, তবে তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে সরে দাঁড়াবে। এরপর তুমি তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে মুহাজিরদের এলাকায় (মদীনায়) চলে যাওয়ার আহ্বান জানাবে। এবং তাদের জানিয়ে দিবে যে, যদি তারা তা কার্যকরী করে, তবে মুহাজিরদের জন্য যেসব উপকার ও দায়-দায়িত্ব রয়েছে, তা তাদের উপর কার্যকরী হবে।
আর যদি তারা বাড়ি-ঘর ছেড়ে যেতে অস্বীকার করে, তবে তাদের জানিয়ে দেবে যে, তারা সাধারণ বেদুঈন মুসলিমদের মত গণ্য হবে। তাদের উপর আল্লাহর সে বিধান কার্যকরী হবে, যা মুমিনদের উপর কার্যকরী হয় এবং তারা গনীমাত ও ফাই* থেকে কিছুই পাবে না। অবশ্য মুসলিমের সঙ্গে শামিল হয়ে যুদ্ধ করলে তার অংশীদার হবে।
আর যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তবে তাদের কাছে জিযয়াহ্ প্রদানের দাবী জানাবে। যদি তারা তা গ্রহণ করে নেয়, তবে তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নিবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে। আর যদি তারা এ দাবি না মানে তবে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়বে। [সহিহ মুসলিম : হাদিস নং : ১৭৩১]
উক্ত হাদিসে জিহাদ শুরু করার আগে তিনটি ধাপ অতিক্রম করতে বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপ হলো, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। এজন্য নবীজি সা. কোনো জিহাদে গেলে আগে সেই সম্প্রদায়ের কাছে ইসলামের দাওয়াতের তাবলীগ করতেন। এটা হেযবুত তওহীদও লিখেছে,
যুদ্ধের আগে নবিজি সাঃ সাহাবাদেরকে রা. তিনটি শর্ত দিতেনন। এক. তওহীদ রিসালাত (এর দাওয়াত)। দুই. রাষ্ট্রশক্তি ছেড়ে দেওয়া। তিন. অন্যথায় যুদ্ধ। [শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১২০]
সুতরাং এরপরও যদি কেউ বলে, ‘মানুষকে বক্তৃতা, ওয়াজ করে যুক্তি দিয়ে, এই দ্বীনের মহাত্ম-গুন বর্ণনা করে মানুষকে দ্বীন গ্রহণ করতে আহ্বান করার কথা আল্লাহ তাঁর রাসুল সা. কে বলেননি, বরং যুদ্ধই মূল কাজ। তাহলে সে কতবড় মিথ্যুক ভেবে দেখেছেন?
অভিযোগ:
অবশ্য পন্নী সাহেব তার মত প্রতিষ্ঠিত করতে কুরআনে কারীমের একটি আয়াত পেশ করে থাকেন। আয়াতটি হলো,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلّهِ فَإِنِ انتَهَواْ فَلاَ عُدْوَانَ إِلاَّ عَلَى الظَّالِمِينَ
আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর, যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত হয়ে যায় তাহলে কারো প্রতি কোন জবরদস্তি নেই, কিন্তু যারা যালেম (তাদের ব্যাপারে আলাদা)। [সুরা বাকারা : ১৯৩]
হাদিস শরীফে এসেছে, আবূ হুরাইরাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ فَإِذَا قَالُوهَا مَنَعُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّهَا وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ
মানুষ ‘আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই’-এর স্বীকারোক্তি না করা পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি। তারা এটা বললে (একত্ববাদে ঈমান আনলে) তাদের রক্ত (জান) ও সম্পদ আমার থেকে নিরাপদ হবে। তবে ইসলামের অধিকার সম্পর্কে ভিন্ন কথা (অর্থাৎ- অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে)। আর তাদের চূড়ান্ত হিসাব আল্লাহ তা’আলার দায়িত্বে। [জামে তিরমিযি : হাদিস নং : ২৬০৬]
উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসে তো বলা হয়েছে যুদ্ধ করতেই থাকতে হবে। তাহলে এর জবাব কী?
জবাব:
উক্ত আয়াত দেখলে স্বাভাবিকভাবে বুঝা যায়, আল্লাহ সকল মুশরিকদের হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আগে পরের আয়াত দেখলে পুরো বিষয়টি ক্লিয়ার হবে। চলুন আগের আয়াতগুলো দেখা যাক। মহান রব বলেন,
وَقَاتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُواْ إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبِّ الْمُعْتَدِينَ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأَخْرِجُوهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ وَلاَ تُقَاتِلُوهُمْ عِندَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّى يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ فَإِن قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ كَذَلِكَ جَزَاء الْكَافِرِينَ فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
আর লড়াই করো, আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।
আর তাদেরকে হত্যাকর যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে যেখান থেকে তারা বের করেছে তোমাদেরকে। বস্তুতঃ ফেতনা ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। আর তাদের সাথে লড়াই করো না মসজিদুল হারামের নিকটে যতক্ষণ না তারা তোমাদের সাথে সেখানে লড়াই করে। অবশ্য যদি তারা নিজেরাই তোমাদের সাথে লড়াই করে। তাহলে তাদেরকে হত্যা কর। এই হল কাফেরদের শাস্তি। আর তারা যদি বিরত থাকে, তাহলে আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু। [সূরা বাকারা : ১৯০-১৯২]
এ আয়াতগুলোর পরেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلّهِ فَإِنِ انتَهَواْ فَلاَ عُدْوَانَ إِلاَّ عَلَى الظَّالِمِينَ
আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর, যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত হয়ে যায় তাহলে কারো প্রতি কোন জবরদস্তি নেই, কিন্তু যারা যালেম (তাদের ব্যাপারে আলাদা)। [সুরা বাকারা : ১৯৩]
পাঠক, একটু ভালো করে পড়ে বুঝে বলুন তো, এখানে কি পৃথিবীর সকল কাফেরকে হত্যা করতে বলা হয়েছে? নাকি যারা ইতিপূর্বে সাহাবায়ে কেরাম রা. কে শহীদ করেছিলো, যারা তাঁদেরকে ঘর-বাড়ি ছাড়া করেছিলো, যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তরবারী উঠিয়েছিলো তাদের সম্পর্কে বলা? যারা অমুসলিম কিন্তু শান্তি প্রিয় তাদের হত্যা করা কী ইসলামে বৈধ? নিশ্চয় না। কারণ সহিহ সনদে নবিজি সাঃ-এর একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবিজি সাঃ বলেন,
أَلَا مَنْ ظَلَمَ مُعَاهِدًا أَوِ انْتَقَصَهُ أَوْ كَلَّفَهُ فَوْقَ طَاقَتِهِ أَوْ أَخَذَ مِنْهُ شَيْئًا بِغَيْرِ طِيبِ نَفْسٍ فَأَنَا حَجِيجُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তির উপর যুলম করবে বা তার প্রাপ্য কম দিবে কিংবা তাকে তার সামর্থের বাইরে কিছু করতে বাধ্য করবে অথবা তার সন্তুষ্টিমূলক সম্মতি ছাড়া তার কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে বাদী হবো। [সুনানে আবু দাউদ : হাদিস নং : ৩০৫২]
সুতরাং ইসলামের অপব্যাখ্যা করে পন্নী সাহেব যে ভ্রান্তি সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার এ মতবাদের বেড়াজালে আটকা পড়ে ঈমান হারানো থেকে সবাই সতর্ক থাকবেন বলে আশাবাদী।
আসল রহস্য কী?
আসলে এরা আদর্শের মূর্তপ্রতিক রাসুৃলুল্লাহ সা. কে সন্ত্রাসী(?) ও সৌন্দর্যময় ইসলামকে ত্রাসের ধর্ম হিসাবে সমাজে পরিচিত করতে চায়। এরা মূলত নেক সুরতে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এটা যেকোনো জ্ঞানীরাই বুঝবেন।
আসল রহস্য কী?
আসলে এরা আদর্শের মূর্তপ্রতিক রাসুৃলুল্লাহ সা. কে সন্ত্রাসী(?) ও সৌন্দর্যময় ইসলামকে ত্রাসের ধর্ম হিসাবে সমাজে পরিচিত করতে চায়। এরা মূলত নেক সুরতে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এটা যেকোনো জ্ঞানীরাই বুঝবেন।
জিহাদের অপব্যাখ্যা:
জিহাদ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল ও আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে মুসলিমদের উপর আরোপিত একটি নির্দেশনা। তাওহীদ, নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাতের মত এটাও ইসলামের একটি অংশ। হযরত হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ বলেন,
الإسلامُ ثمانيةُ أسهُمٍ الإسلامُ سَهمٌ والصَّلاةُ سَهمٌ والزَّكاةُ سُهمٌ وحَجُّ البَيتِ سَهمٌ والصِّيامُ سَهمٌ والأمرُ بالمعروفِ سَهمٌ والنَّهيُ عنِ المُنكَرِ سَهمٌ والجِهادُ في سَبيلِ اللهِ سَهمٌ وقد خابَ مَن لا سَهمَ له
ইসলামের আটটি অংশ। ইসলাম একটি অংশ। নামায একটি অংশ। যাকাত একটি অংশ। বায়তুল্লাহর হজ করা একটি অংশ। জিহাদ একটি অংশ। রমজানের রোযা একটি অংশ। নেককাজের আদেশ প্রদান করা একটি অংশ। অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা একটি অংশ। আর বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হলো সেই ব্যক্তি যার নিকট একটি অংশও নাই। [মুসনাদে বাযযার, হাদিস নং : ২৯২৭]
কিন্তু এই জিহাদকে নিয়ে চরম পর্যায়ের বিকৃতি করে চলেছে হেযবুত তওহীদ। মওদুদী সাহেবের শিষ্য হিসাবে জিহাদের অপব্যাখ্যায় পন্নী সাহেব আরও এক ধাপ এগিয়ে।
তিন. তাবলীগ করা কী নবিজি সাঃ-এর দায়িত্ব ছিলো না?
প্রিয় পাঠক, ইসলাম একটি আদর্শের ধর্ম। নবিজি সাঃ তাঁর আদর্শ দিয়েই, দ্বীনের প্রচারের মাধ্যমেই ইসলামের সৌন্দর্য জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু সে ধর্মকে একটি ত্রাসের ধর্ম বানানোর জন্য ইসলাম বিদ্বেষীরা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। আর সেই ইসলাম বিদ্বেষীদের মিশন বাস্তবায়ণে বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ। তারা বলতে চায়, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রক্রিয়া হলো শুধুমাত্র সশস্ত্র যুদ্ধ। নরম নরম কথা বলে বা তাবলীগ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার কোনো নিয়ম আল্লাহ তাঁর রাসুল সা. কে দেননি। চলুন আগে তাদের দাবিটা দেখা যাক।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা বায়াজীদ খান পন্নী লিখেছেন,
আল্লাহ তার রাসুলকে (দঃ) যে দীন জীবন-বিধান দিয়ে পৃথিবীতে পাঠালেন তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য পথ, প্রক্রিয়া, তরিকা (Process) স্থির কোরলেন সামরিক। অর্থাৎ আল্লাহ তার প্রেরিতকে (দঃ) এ নির্দেশ দিলেন না যে, তুমি মানুষকে বক্তৃতা, ওয়ায কোরে যুক্তি দিয়ে, এই দ্বীনের মহাত্ম-গুন বর্ণনা কোরে মানুষকে এটা গ্রহণ কোরতে আহ্বান কর। এ নির্দেশেও দিলেন না যে তাবলীগ কোরে পৃথিবীর মানুষকে এই দ্বীনে প্রবেশ করাও। এ নির্দেশ আল্লাহ দেননি এই কারণে যে তিনি নিজে এই মানব জাতির স্রষ্টা, তিনি এর মনস্তত্বেরও স্রস্টা। তাই তিনি জানেন যে এই মানুষের দেহের-মনের ভিতরে শক্তিশালী শয়তানকে প্রবেশ করার অনুমতি দেবার পর খুব কম সংখ্যক মানুষই এমন থাকবে যারা তাদের বিবেক, বুদ্ধি, যুক্তি ব্যবহার কোরে দ্বীনের এই প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব বুঝে রসুলের (দঃ) ঐ আহ্বানকে মেনে নিয়ে এই দ্বীন গ্রহণ কোরবে। কাজেই তিনি তার রাসূলকে (দঃ) নির্দেশ দিলেন সামরিক শক্তি বলে এই কাজ করার। তার এই আদেশ কোরানময় ছড়িয়ে আছে। আল্লাহর এই নীতিকে বুঝে তার রসূল (দঃ) ঘোষণা করলেন “আমি আদিষ্ট হোয়েছি সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না সমস্ত মানবজাতি এক আল্লাহকে সর্বময় প্রভু বোলে স্বীকার না করে এবং আমাকে তার প্রেরিত বোলে মেনে না নেয়। [এ ইসলাম ইসলামী নয় : পৃ. ৩৪]
উক্ত কথা দিয়ে পন্নী সাহেব বুঝাতে চেয়েছেন-
১. আল্লাহ তা’আলা নবীজিকে সা. ওয়াজ,বক্তব্য,যুক্তি দিয়ে এক কথায় তাবলীগের মাধ্যমে দ্বীন বুঝাতে নির্দেশ দেননি।
২. আল্লাহ তা’আলা নবীজিকে সা. একটাই দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে মানুষকে জোর করে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে বাধ্য করা।
ইসলাম কী বলে?
আল্লাহ তাআলা নবিজি সাঃ-কে ওয়াজ, বক্তব্য দিয়ে সুন্দরভাষায় দ্বীন বুঝাতে নির্দেশ দেন নি’ বলে যে মন্তব্য পন্নী সাহেব করেছেন, এটা কুরআনের উপর সুস্পষ্ট মিথ্যাচার। কারণ মহান রব বলেন,
ادْعُ إِلِى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
(হে নবী,) তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর ওয়াজের (উপদেশের) মাধ্যমে আহবান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন। [সূরা নাহল : ১২৫]
উক্ত আয়াতে নবীজিকে সা. মহান আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে সুন্দর কথার মাধ্যমে ওয়াজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَقُولُونَ وَمَا أَنتَ عَلَيْهِم بِجَبَّارٍ فَذَكِّرْ بِالْقُرْآنِ مَن يَخَافُ وَعِيدِ
তারা যা বলে, তা আমি সম্যক অবগত আছি। আপনি তাদের উপর জোরজবরকারী নন। অতএব, যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কোরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান করুন। [সুরা ক্ব-ফ : ৪৫]
উক্ত আয়াতেও মহান আল্লাহ উপদেশ তথা ওয়াজ করার নির্দেশ দিয়েছেন, যেন মানুষ ইসলামের পথে ধাবিত হয়। তাহলে পন্নী সাহেবের দাবী কী এ আয়াত দু’টির প্রকাশ্য বিরোধী নয়? যদি তিনি আয়াতগুলো না পড়ে থাকেন, তাহলে তিনি মুর্খতাবশত এমন কথা লিখেছেন, অথবা জেনে শুনেই আল্লাহর উপর মিথ্যাচার করেছেন।
ইসলামে কী তাবলীগ নেই?
এক. পন্নী সাহেব মূলত বলতে চেয়েছেন, ইসলামে তাবলীগ বা দ্বীন প্রচার নেই, বরং সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমেই তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা বলে মূলত তিনি দ্বীনের তাবলীগকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছেন। অথচ মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللّهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
হে রসূল, পৌছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না। [সুরা মায়িদা : ৬৭]
فَإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلاَغُ الْمُبِينُ
অতঃপর যদি তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, তবে আপনার কাজ হল সুস্পষ্ট ভাবে পৌছে দেয়া মাত্র। [সুরা নাহল : ৮২]
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। [সুরা সাবা : ২৮]
উপরোল্লিখিত আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে সা. দ্বীনের বানী মানবজাতির কাছে পৌঁছে দেওয়া বা তাবলীগ করতে সুস্পষ্ট নির্দেশ জারি করেছেন।
দুই. এ কারণেই নবিজি সাঃ পাহাড়ে উঠে মক্কার লোকদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দিলেন। ফলে কাফেররা ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর চাচা চাচা আবু তালেবকে হুমকি দিয়ে গিয়েছিলো এ বলে যে, মুহাম্মাদকে বলে দিও সে যেন এ বিষয়ে নিরব থাকে। তখন তিনি সার্বিক পরিস্থিতির বিষয় বিবেচনা করে যখন নবীজিকে সা. অবগত করলেন, তখন নবিজি সাঃ তাকে বললেন,
يا عم والله لو وضعوا الشمس في يميني والقمر في يساري على أن أترك هذا الأمر حتى يظهره الله أو أهلك فيه ما تركته
হে চাচা, আল্লাহর কসম! যদি তারা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় এর বিনিময়ে আমি মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া ছেড়ে দেই, তবুও আমি সেটা করবো না, যতক্ষণ না আল্লাহ এই দ্বীনকে বিজয় করেন, অথবা এই পথে আমি আমার জিবন বিলিয়ে দেই। [সীরাতে ইবনে হিশাম : খ. ১ পৃ. ২৬৬]
তাবলীগের ব্যাপারে উপরোক্ত আয়াতসমূহ এবং হাদিসসহ অসংখ্য দলীল কুরআন হাদিসে ভুরিভুরি পাওয়া যাবে। যেখানে তাওহীদ-রিসালাতের দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাসুলুল্লাহ সা. এর মক্কার ১৩ বছরের ইতিহাস ছিলো শুধুমাত্র তাবলীগে দ্বীন বা দ্বীন প্রচার। এটা তাদের বই থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। দেখুন তারা কী লিখেছেন,
মক্কায় নির্মম নির্যাতনের মুখেও কোন সাহাবীকে অস্ত্র হাতে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। [হলি আর্টিজেনের পর : পৃ. ১৮]
যদি নবিজি সাঃ-এর দায়িত্ব তাবলীগ না করে শুধু সংগ্রাম করা হতো, তাহলে ২৩ বছরের মধ্যে ১৩ বছরই অস্ত্র হাতে নিতে দেন নি কেন? এই ১৩ বছর তাহলে তিনি কী করেছিলেন? নিশ্চয় তাবলীগের কাজ করেছিলেন। তাহলে হেযবুত তওহীদের মতবাদ যদি সঠিক হয় যে, ‘স্বশস্র সংগ্রামই নবীজির সা. দায়িত্ব ছিলো’ তাহলে তো দেখা যাচ্ছে নবীজি সা. প্রথম ১৩ বছর তাঁর দায়িত্বই পালন করেন নি। নাউযুবিল্লাহ। আর হ্যাঁ, এটাই তারা বুঝাতে চায়। যা ‘আম্বিয়ায়ে কেরামের সমালোচনা’ অধ্যায়ে লিখেছি। সুতরাং তাবলীগ অস্বীকার করা মানেই নবীজির সা. ১৩ বছরের মিশনকে অস্বীকার করা।
চার. নবিজি সাঃ-এর সুন্নাহ মানেই কী জিহাদ?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবী হলো, জিহাদই একমাত্র নবীর সা. সুন্নাহ। তারা লিখেছেন,
নবীজির সা. সুন্নাহ হলো, শুধুমাত্র জিহাদ, অন্যগুলো ব্যক্তিগত অভ্যাস। [আকিদা : পৃ. ১৪; এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৯]
ইসলাম কী বলে?
এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। এমন কোনো কথা রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর পুরো তেইশ বছরে একবারের জন্যও বলেন নি, বরং অসংখ্য বিষয়কে তিনি তাঁর নিজের সুন্নাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। দেখুন হাদিস শরীফে এসেছে, একবার কিছু সাহাবায়ে কেরাম রা. আলোচনা করছিলেন। এমবতাবস্থায় কেউ কেউ বললেন, আমি সারা জীবন রাতে সালাত আদায় করতে থাকব। অপর একজন বলল, আমি সারা বছর রোযা পালন করব এবং কখনও বিরতি দিব না। অপরজন বলল, আমি নারী বিবর্জিত থাকব-কখনও শাদী করব না। তখন নবীজি সাঃ বললেন,
أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي
তোমরা কি ঐ সকল ব্যাক্তি যারা এরূপ কথাবার্তা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি আমি বেশি আনুগত্যশীল; অথচ আমি রোযা পালন করি, আবার রোযা থেকে বিরতও থাকি। সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করি এবং ঘুমাই ও বিয়ে-শাদী করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ ভাব পোষণ করবে, তারা আমার দলভুক্ত নয়। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৬৯৭]
উক্ত হাদিসে নবিজি সাঃ তিনটি বিষয় উল্লেখ্য করেছেন এবং সেগুলোকে নিজের সুন্নাত হিসাবে উল্লেখ্য করেছেন। যথা- রাতের নামাজ, রোযা রাখা, না রাখা, ঘুমানো, বিবাহশাদী করা। এ হাদিসে কিন্তু জিহাদের কথা উল্লেখ্য নেই। বুঝা গেলো, শুধুমাত্র জিহাদই নবীজির সা. সুন্নাহ কথাটা সঠিক নয়। এমন আরও অসংখ্য বিষয় প্রমাণস্বরুপ দেওয়া যাবে, যা দ্বারা প্রমাণ হয় যে, নবীজির সা. থেকে প্রকাশিত বিষয়গুলো সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত।
পাঁচ. খেলাফত কায়েম করার পদ্ধতি কী সশস্ত্র সংগ্রাম?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য একমাত্র নীতি হলো যুদ্ধ করা। দেখুন তারা কী বলে,
শেষ রাসুল এই জাতিটিকে গঠন করেছিলেন সশস্ত্র সংগ্রাম করে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর আইন কানুন অর্থাৎ দ্বীন প্রতিষ্ঠার কার্যকারী করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। [যুগসন্ধিক্ষণে আমরা : পৃ. ১]
রসুলের মাত্র ৯ বছরের মধ্যে ১০৭ টি যুদ্ধ থেকেই আর সন্দেহের কোনো অবকাশই থাকে না যে সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম, যুদ্ধকেই নীতি হিসেবে বেছে নিয়েছেন। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৪৮]
এই কাজ করার জন্য নীতি হিসাবে দিলেন সর্বাত্মক সংগ্রামের’। [শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১৫২]
এই প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া হিসাবে আল্লাহ নির্ধারণ করলেন জেহাদ ও কেতাল অর্থাৎ সংগ্রাম। [ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ৬২]
অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, ইসলামী রাষ্ট্র গঠণের জন্য একমাত্র নীতি হলো যুদ্ধ করা।
ইসলাম কী বলে?
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য শুধুমাত্র ও একমাত্র নীতি যুদ্ধ বা স্বশস্ত্র সংগ্রাম করা এমন কথা কুরআন-সুন্নাহ’র কোথাও নেই, বরং রাসুলুল্লাহ সা. এর জিবনী দেখলে সুস্পষ্টভাবে জানা যাবে, সর্বপ্রথম মদীনায় ইসলামিক রাষ্ট্র গঠণ করেন রাসুলুল্লাহ সাঃ। কিন্তু সে রাষ্ট্র গঠন করতে কেনো যুদ্ধ করা লাগেনি। অথচ হেযবুত তওহীদ লিখেছে,
রাষ্ট্রশক্তি কেউ বিনা যুদ্ধে ছেড়ে দেয় না, এটাও জানা কথা। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৭/৩৭]
অথচ মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র গঠন হয়েছিলো কোনো যুদ্ধ ব্যতিরেকেই। রাসুলুল্লাহ সা. এর হাতে ইসলাম গ্রহণকারী কয়েকজন মদীনাবাসীর সাথে তাঁর প্রতিনিধি হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের রা. এর মাধ্যমে দ্বীনি তালিম দিতে প্রেরণ করেন নবীজি সা.। সেখানকার মানুষের মাঝে তা’লিম ও তাবলীগের মাধ্যমে দ্বীনের আবশ্যকীয়তা বুঝিয়ে তাঁদেরকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। অবশেষে রাসুলুল্লাহ সা. সেখানে গেলে তাঁরা স্বাচ্ছন্দে নবীজি সা. কে কবুল করে নিজেদের নেতা হিসাবে গ্রহণ করে নেন।
পাঠক, একটি বিষয় খুব সুক্ষভাবে বুঝা উচিৎ, তা হলো, কারো উপর জবরদস্তি করে কোনো আদর্শ কবুল করানো যায় না, আদর্শ কবুল করাতে হয় আদর্শিক শিক্ষা ও ব্যবহার দিয়ে। ইসলামের সৌন্দর্য না বুঝিয়ে কোনো স্থানে ইসলাম যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব হয় না। এটাই বাস্তবতা। এ জন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যম দাওয়াত বা প্রচার। কিতাল বা যুদ্ধ হলো প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের সংরক্ষণ, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তার মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ সা. দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। দাওয়াতের বিরুদ্ধে অমানবিক বর্বরতা ও সহিংস প্রতিরোধকে তিনি পরিপূর্ণ অহিংস উত্তম আচরণ দিয়ে মুকাবিলা করেছেন।
বুঝা গেলো, ইসলাম প্রতিষ্ঠার মূল বিষয় হলো, তাবলীগ করা, আর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধ বা জিহাদ করার আইন প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু হেযবুত তওহীদের দাবি হলো,
সেই দীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি, প্রক্রিয়া যে অন্য কোনো পন্থা নয় সশস্ত্র সংগ্রাম এ সিদ্ধান্ত আর কারো নয় স্বয়ং আল্লাহর। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৪৮]
অথচ মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ সাঃ কে দিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রেরণ করে চারটি দায়িত্ব দেন। যা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। মহান রব বলেন,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ
তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত। [সুরা জুম’আ : ২]
কোনটা মানবো?
হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে স্বশস্ত্র সংগ্রাম করতে হবে। তাদের দাবি হলো,
এই প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া হিসাবে আল্লাহ নির্ধারণ করলেন জেহাদ ও কেতাল (স্বশস্ত্র সংগ্রাম)। [ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ৬২]
অর্থাৎ তারা বলছে, রাষ্ট্র গঠণ করতেই স্বশস্ত্র সংগ্রাম করাই হলো আল্লাহ পাকের নীতি। আবার তারা বলছে স্বশস্ত্র সংগ্রামের জন্য রাষ্ট্র থাকা শর্ত। দেখুন কী বলে-
কিতাল ব্যক্তিগত নয় বরং রাষ্ট্রগত। [এসলামের প্রকৃত আকীদা : পৃ. ৬৯]
মদীনায় গিয়ে নবি স. স্বশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৯৯]
কী হাস্যকর! এক দিকে দাবি হলো, রাষ্ট্রজয়ের সিস্টেমই হলো সশস্ত্র যুদ্ধ। আবার অন্যত্র দাবি করে বলে রাষ্ট্র জয় ছাড়া সশস্ত্র সংগ্রাম বৈধ নয়। বিষয়টা হলো এমন যে, মুরগী আগে না ডিম আগে? বেলা শেষে কোনোটাই তারা চায় না।
ছয়. যুদ্ধে জয় লাভ করতে পার্থিব উপকরণ কী যথেষ্ট?
হেযবুত তওহীদ কী বলে.
যাদের আল্লাহ পাকের উপর বিশ্বাস থাকে না, তারা সব সময় পার্থিব উপকরণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে। কিন্তু জিহাদের জন্য মুসলমানদের শক্তি সঞ্চয় করাও জরুরি। তবে মনে রাখতে হবে, এগুলো জাষ্ট ওসিলা। কিন্তু জয়-বিজয় একমাত্র রবের দয়ার উপর নির্ভরশীল। অথচ হেযবুত তওহীদ বলে-
অর্থবল, প্রচারমাধ্যম ও সামরিকশক্তি এই তিনটি যার হাতে থাকবে সেই পৃথিবীর কর্তৃত্ব লাভ করবে’। [হেযবুত তওহীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : পৃ. ১১]
নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। এ কথার মধ্যে আর বেঈমানদের কথার মধ্যে তফাৎ কী?
ইসলাম কী বলে?
ইসলাম কখনও অস্ত্র, শক্তি ও জনসংখ্যাবৃদ্ধি মারফত বিজয় লাভ করেনি। যদি পার্থিব শক্তি বেশি থাকলেই যুদ্ধে বিজয় লাভ করা যেতো, তবে কাফেররাই সব সময় বিজয় লাভ করতো। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মুসলিম সাহাবাদের সংখ্যা কম হলেও সকল যুদ্ধে তাঁরাই বিজয় লাভ করেছেন। কিন্তু হুনায়ন যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যসংখ্যা ছিল চৌদ্দ হাজার। এর আগে অন্য কোন যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যদের সংখ্যা এত বিপুল ছিল না। মুসলিমগণ সর্বদা নিজেদের সৈন্যসংখ্যা অল্প হওয়া সত্ত্বেও বেশি সৈন্যের মুকাবিলায় জয়লাভ করেছে। এবার যেহেতু তাদের সৈন্য সংখ্যাও বিপুল, তাই তাদের কারও কারও মুখ থেকে বের হয়ে গেল যে, আজ আমাদের সংখ্যা অনেক বেশি। সুতরাং আজ আমরা কারও কাছে পরাস্ত হতেই পারি না। মুসলিমগণ আল্লাহ তাআলার পরিবর্তে নিজেদের সংখ্যার উপর নির্ভর করবে এটা আল্লাহ তাআলার পছন্দ হল না। সুতরাং তিনি এর ফল দেখালেন। মুসলিম বাহিনী এক সংকীর্ণ গিরিপথ অতিক্রম করছিল। এ সময় বনু হাওয়াযিনের তীরন্দাজ বাহিনী অকস্মাৎ তাদের উপর বৃষ্টির মত তীর ছুঁড়তে শুরু করল। তা এতটাই প্রচণ্ড ছিল যে, মুসলিম বাহিনী তার সামনে তিষ্ঠাতে পারছিল না। তাদের বহু সদস্য পালাতে শুরু করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবশ্য কতিপয় নিবেদিতপ্রাণ সাহাবীসহ অবিচলিত থাকলেন। তিনি হযরত আব্বাস (রাযি.)-কে হুকুম দিলেন, যেন পলায়নরতদেরকে উচ্চস্বরে ডাক দেন। হযরত আব্বাস (রাযি.)-এর আওয়াজ খুব বড় ছিল। তিনি ডাক দিলেন এবং মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে তা বিজলীর মত ছড়িয়ে পড়ল। যারা ময়দান ত্যাগ করেছিল তারা নতুন উদ্যমে ফিরে আসল। দেখতে না দেখতে দৃশ্যপট পাল্টে গেল এবং মুসলিমদের বিজয় অর্জিত হল। এ কথা পবিত্র কুরআনে মহান রব বলেন,
لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللّهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٍ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُم مُّدْبِرِينَ ثُمَّ أَنَزلَ اللّهُ سَكِينَتَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَنزَلَ جُنُودًا لَّمْ تَرَوْهَا وَعذَّبَ الَّذِينَ كَفَرُواْ وَذَلِكَ جَزَاء الْكَافِرِينَ
আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন অনেক ক্ষেত্রে এবং হোনাইনের দিনে, যখন তোমাদের সংখ্যধিক্য তোমাদের প্রফুল্ল করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্তেও তোমাদের জন্য সংকুচিত হয়েছিল। অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। তারপর আল্লাহ নাযিল করেন নিজের পক্ষ থেকে সান্ত্বনা, তাঁর রসূল ও মুমিনদের প্রতি এবং অবতীর্ণ করেন এমন সেনাবাহিনী যাদের তোমরা দেখতে পাওনি। আর শাস্তি প্রদান করেন কাফেরদের এবং এটি হল কাফেরদের কর্মফল। [সূরা তাওবা : ২৫-২৬]
সুতরাং বুঝা গেলো, বিজয় অর্জন হয় একমাত্র আল্লাহ তা’আলার উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখলে। অর্থবল, প্রচারমাধ্যম ও সামরিকশক্তি এই তিনটি থাকলেই পৃথিবীর কর্তৃত্ব লাভ করা সম্ভব নয়।
সাত. জিহাদ কী আত্মরক্ষামূলক না আক্রমানত্মক?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, জিহাদ আত্মরক্ষামূলক নয়, বরং আক্রমনাত্মক। তারা লিখেছে,
ইসলামের জিহাদ আত্মরক্ষামূলক নয় বরং প্রচন্ডভাবে আক্রমানত্মক। [ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ৪৫/৪৬]
অর্থাৎ অমুসলিমরা ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় হস্তক্ষেপ না করলেও তাদের উপর আক্রমণ করাই জিহাদের আচরণ।
ইসলাম কী বলে?
পুরো কুরআন-সুন্নাহ অধ্যায়ন করলে দেখা যায় মূল জিহাদ দুই ধরণের। ১. প্রতিরোধ বা আত্মরক্ষামূলক জিহাদ, ২. অগ্রগামী বা আক্রমনাত্মক জিহাদ।
আত্মরক্ষামূলক জিহাদ:
অর্থাৎ কোনো অমুসলিম সম্প্রদায় মুসলিমদের উপর হামলা করলে তার মোকাবেলায় জিহাদ করা। এ জিহাদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান রব বলেন,
আক্রমনাত্মক:
অর্থাৎ কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যদি কাফেরদের শক্তি ও দাপোটের সামনে হুমকির মুখে পড়ে বা ইসলাম ও মুসলিমদের বিপদ সুনিশ্চিতভাবে জানা যায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে ইসলাম মুসলমানদের অগ্রসর হয়ে জিহাদ করার নির্দেশ দেয়। কারণ বিপদ জেনেও চুপ করে অপেক্ষা করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এ জিহাদ সম্পর্কে মহান রব বলেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلّه فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তবে আল্লাহ তাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করেন। [সুরা আনফাল : ৩৯]
এই হলো জিহাদের পূর্ণাঙ্গ সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা। কিন্তু হেযবুত তওহীদ পবিত্র কুরআনের দুয়েকটি আয়াত তুলে এনে জিহাদের ব্যাপারে যে ব্যাখ্যা দেয়, তাতে করে মনে হয় জিহাদ শুধুমাত্র সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যম। তারা লিখেছে,
কোরআনের দু’একটি আয়াত তুলে এনে দু’একটি হাদিস তুলে এনে ইসলামের নাম ব্যবহার করে বহু ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। মুসলমানদেরকে প্রকৃতপক্ষে কোরআন কি, হাদিস কি তা বিস্তারিত ভাবে এবং ভালোভাবে বুঝে নেওয়ার দরকার আছে। [প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৪৯]
সুতরাং বুঝা গেলো, তারা জিহাদের এসব ব্যাখ্যা দিয়ে পৃথিবি থেকে জিহাদের ব্যাপারে মানুষের বিপথে পরিচালনা করে সন্ত্রাস তৈরি করতে চায়। এখনই যদি এদের লাগাম টেনে ধরা না হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এরা বড় ধরণের কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ঘটাবে।
আট. ঈমানদানের পরিচয় কী শুধুমাত্র জিহাদ করা?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
নিজেদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে সংগ্রাম করার মধ্যে দিয়েই মোমেন হতে হবে, অন্য কোন পন্থা আল্লাহ দেননি। এই মুমিনের জন্য নামাজ রোজা, হজ্ব, যাকাতসহ ইসলামের অন্যান্য সব আমল’। [মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ১১৩]
যে যোদ্ধা নয়, যুদ্ধ জানে না, তার এই দীনুল এসলাম সমিতির প্রাথমিক সদস্যপদেরও (primary membership) যোগ্যতা নেই, ভালো সভ্য হওয়াতো দুরের কথা। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৪০]
অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, ঈমানদার হওয়ার জন্য শুধুমাত্র জিহাদই করতে হবে।
ইসলাম কী বলে?
পবিত্র কুরআনে ঈমানদারের অসংখ্য গুনাবলীর কথা বর্ণিত হয়েছে। সেসব গুনাবলীর মধ্যে একটি হলো, জিহাদ করা। এই জিহাদই ঈমানদারের একমাত্র পথ বলে যে দাবি তারা করে থাকেন তা সর্বৈব মিথ্যাচার ও জিহাদের অপব্যাখ্যার শামিল। কারণ নারীদের জন্য জিহাদ না করে হজ্ব করার কথা বলেছেন খোদ রাসুলুল্লাহ সা.। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসটি দেখুন। তিনি বলেন,
استأذنت النبي صلى الله عليه وسلم في الجهاد، فقال : جهادكن الحج
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিহাদের অনুমতি চাইলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের জিহাদ হল হজ্ব। [সহীহ বুখারী : হাদীস নং : ২৮৭৫]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قَالَ رَجُلٌ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أُجَاهِدُ قَالَ لَكَ أَبَوَانِ قَالَ نَعَمْ. قَالَ فَفِيهِمَا فَجَاهِدْ
এক ব্যাক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করলোঃ আমি কি জিহাদে যাব? তিনি বলেনঃ তোমার কি পিতা-মাতা আছে? সে বলল হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ তা হলে তাদের (সেবার) মাঝে জিহাদ করো। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৫৯৭২]
সুতরাং বুঝা গেলো, ঈমানদার হওয়ার জন্য শুধুমাত্র জিহাদই শর্ত নয়। তবে ঈমানদারের জন্য জিহাদও একটি গুন। কিন্তু একমাত্র গুন নয়। অতএব হেযবুত তওহীদের দাবিটা জিহাদের অপব্যাখ্যার শামিল। এ কথা শুধু আমার নয়, খোদ হেযবুত তওহীদও ধর্ম ব্যবসার ফাঁদে বইয়ে সে কথা বলেছে। দেখুন তারা কী বলে-
আমানতদার, সত্যবাদী এবং হালাল উপায়ে রেজেক হাসিলকারী নিশ্চয়ই কামেল মোমেন’। [ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ১৩০]
তাহলে পাঠক আপনারাই বলুন, হেযবুত তওহীদের দাবি ‘নিজেদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে সংগ্রাম করার মধ্যে দিয়েই মোমেন হতে হবে, অন্য কোন পন্থা আল্লাহ দেননি’ কথাটা কী তাদের স্ববিরোধী বক্তব্য নয়?
নয়. মুজাহিদদের মর্যাদা কী নবিদের চেয়েও বেশী?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, যারা জিহাদ করে তাদের মর্যাদা নবীদের থেকেও বেশি। দেখুন কী বলে-
তওহীদের ওপর ইসলামে ঈমানের পরই শ্রেষ্ঠ আমল ঐ তওহীদ প্রতিষ্ঠার জেহাদ বলেই তার পুরস্কার আল্লাহ রেখেছেন ইসলামের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ও সম্মান যে পুরস্কার ও সম্মান কয়েকটি বৈশিষ্ট্যে আল্লাহর নবীদেরও ছাড়িয়ে গেছে। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৩৯/৪১/৪৯]
ইসলাম কী বলে?
মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শন করতে মহান রব যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ প্রেরণ করেছেন। যারা সবাই আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত ও মনোনীত। যাদের উপর বিশ্বাস করাটাও ঈমানের অন্যতম অংশ। তাঁদের উপর আর কারো মর্যাদা বেশি হতেই পারে না। সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক খোদ সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকেও বেশি মর্যাদা নবীদের। সাহাবাদের সম্পর্কে হেযবুত তওহীদ বলে থাকে,
এ জাতির (সাহাবায়ে কেরাম) মধ্যে কোনো পুরোহিত শ্রেণী ছিল না, সবাই ছিলেন যোদ্ধা। যিনি যতবড় মো’মেন তিনি ছিলেন ততবড় যোদ্ধা। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ২৬; এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৭/৩৮/৬১]
অর্থাৎ তাদের দাবি মতে সাহাবায়ে কেরাম রা. সবাই মুজাহিদ ছিলেন। সেই সাহাবাদের ব্যাপারেও রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
إنّ اللهَ اختارَ أصحابي على العالمينَ سوى النبيِّينَ والمرسلينَ
আল্লাহ পাক সকল বিশ্ববাসীর উপর আমার সাহাবাদের মনোনীত করেছেন। তবে নবীদের উপর নয়। [তারিখে বাগদাদ : খ. ৩ পৃ. ৩৮১]
উপরন্তু যে নবিদের মাধ্যমে জিহাদের বিধান নাজিল হল, সেই নবিদের সম্মানের চেয়ে বিধান পালনকারীর সম্মান বেড়ে যায়? নাউযুবিল্লাহ! এর মানে নবিদের চেয়ে তাঁদের উম্মতের মর্যাদা বেশি? হেযবুত তওহীদের মর্যাদা নবিদের থেকেও বেশি? হ্যাঁ। এটাই তাদের বিশ্বাস। এ সম্পর্কে ‘হেযবুত তওহীদের কর্মীদের মর্যাদা’ পর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
দশ. জান্নাত-জাহান্নাম কী একমাত্র জিহাদের উপর নির্ভরশীল?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের বক্তব্য হলো, জান্নাতে যাওয়ার জন্য একমাত্র জিহাদই শর্ত। দেখুন তাদের বক্তব্যগুলো-
জান্নাত কান্নাকাটি করে দোয়া করে পাওয়ার বিষয় নয়। এটি একটি লেনদেনের বিষয়। মোমেন নিজের জীবন ও সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে বিনিময় আল্লাহ তাকে জান্নাত দেবেন। [ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৭]
জান্নাতে যাওয়ার জন্য দুটি শর্ত এক. আল্লাহর তাওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং দুই. রসুলের পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবীময় ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম করে যাওয়া। ব্যস এই দুইটি শর্ত যারা পূরণ করতে পারবেন তারাই মুমিন, তারাই সেই জান্নাতি ফেরকা তাতে সন্দেহ নেই। [প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ১১২]
যে মো’মেনের (ঈমানদারের) তলোয়ারের অর্থাৎ অস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তিনি কোনো দরজা দিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না। এ ব্যাপারে লিখতে গেলে শেষ নেই। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৪০]
অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, জান্নাতে যাওয়ার জন্য স্বশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
ইসলাম কী বলে?
জান্নাতে যাওয়ার জন্য কুরআন, সুন্নাহ ও জামাাআতে সাহাবাদের সকল বিধানাবলী মান্য করতে হবে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ
আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা যতক্ষণ তা ধরে থাকবে ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নত। [মুয়াত্তা মালিক : হাদিস নং : ১৬৬১]
অন্য হাদিসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
وَإِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي
বনী ইসরাঈল ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আমার উন্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া তাদের সবাই জাহান্নামী হবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে দল কোনটি? তিনি বললেনঃ আমি ও আমার সাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত। [জামে তিরমিযি : হাদিস নং : ২৬৪১]
সুতরাং বুঝা গেলো, শুধুমাত্র জিহাদ করলেই সে জান্নাতে চলে যাবে কথাটা সঠিক নয়, বরং জান্নাতে যেতে কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের পূর্ণাঙ্গ কনসেপ্ট মানতে হবে।
স্ববিরোধী বক্তব্য:
হেযবুত তওহীদ একদিকে দাবি করছে, জিহাদ না করলে জাহান্নামে যাবে, অপরদিকে আবার দাবি করছে,
এই একটি শর্ত (তওহীদ) পালন করলে কোনো গুনাহই তাকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না;এমনকি মহানবীর উল্লেখিত ব্যভিচার ও চুরির মত কবিরা গোনাহও না’। [আকীদা : পৃ. ৭]
তাহলে হেযবুত তওহীদের কোন দাবিটা সত্য? আগেরটা না পরেরটা? যেকোনো একটা সত্য হলে অপরটা মিথ্যা। আসলে তাদের একটা বক্তব্যও সত্য নয়, দুটোই বিকৃতি।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
لَنْ يُنْجِيَ أَحَدًا مِنْكُمْ عَمَلُهُ قَالَ رَجُلٌ وَلاَ إِيَّاكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ وَلاَ إِيَّاىَ إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِيَ اللَّهُ مِنْهُ بِرَحْمَةٍ وَلَكِنْ سَدِّدُوا
তোমাদের কোন ব্যক্তির আমলই তাকে নাজাত দিতে পারবেনা। (এ কথা শুনে) জনৈক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও কি নন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিও নই। তবে যদি আল্লাহ তা’আলা তাঁর রহমত দ্বারা আমাকে আবৃত করে নেন। তোমরা অবশ্য মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে। [সহিহ মুসলিম : হাদিস নং : ৬৮৫১]
বুঝা গেলো, জান্নাত নির্ভরশীল আল্লাহ তা’আলার দয়ার উপর।
এগারো. মুজাহিদরা কবীরা গুনাহ করলেও কী জাহান্নামে যাবে না?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, জিহাদ করলে সে যত গুনাহই করুক সে জাহান্নামে যাবে না। তারা লিখেছেন,
তাওহীদে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে মগ্ন হলে তার ব্যক্তিগত জীবনের কোন গুনাহ এমনকি চুরি-ডাকাতি জেনা ব্যভিচারে ও তাকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না’। [প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ১১৪]
অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, জিহাদ করলে সকল কবীরা গুনাহ এমনকি যেনা,ব্যাভাবার, চুরি, ডাকাতীর অপরাধ কররেও জাহান্নামে যাবে না।
ইসলাম কী বলে?
জিহাদ করলেই যে তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে এমন নয়, বরং কিয়ামতের দিন সকল অপরাধ মাফ হলেও মানুষের হক মাফ করা হবে না। হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
الْقَتْلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُكَفِّرُ كُلَّ خَطِيئَةٍ فَقَالَ جِبْرِيلُ إِلاَّ الدَّيْنَ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِلاَّ الدَّيْنَ
আল্লাহ্ তা’আলার পথে মৃত্যুবরণ করা সকল পাপের কাফফারা হয়ে যায়। তখন জিবরীল (আঃ) বললেন, ঋণ ব্যতীত (তা ক্ষমা করা হয় না)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঋণ ব্যতীত। [জামে তিরমিযি : হাদিস : ১৬৪০]
অন্য হাদিসে এসেছে, হযরত সাহল ইবনু সা‘দ সায়েদী রা. হতে বর্ণিত যে, একবার আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও মুশ্রিকদের মধ্যে মুকাবিলা হয় এবং উভয়পক্ষ ভীষণ যুদ্ধ লিপ্ত হয়। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজ সৈন্যদলের নিকট ফিরে এলেন, মুশ্রিকরাও নিজ সৈন্যদলে ফিরে গেল। সেই যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সঙ্গীদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি ছিল, যে কোন মুশরিককে একাকী দেখলেই তার পশ্চাতে ছুটত এবং তাকে তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করত। বর্ণনাকারী (সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) বলেন, আজ আমাদের কেউ অমুকের মত যুদ্ধ করতে পারেনি। তা শুনে আল্লাহর রাসুল সাঃ বললেন,
أَمَا إِنَّهُ مِنْ أَهْلِ النَّارِ
সে তো জাহান্নামের অধিবাসী হবে। একজন সাহাবী বলে উঠলেন, আমি তার সঙ্গী হব। অতঃপর তিনি তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন, সে দাঁড়ালে তিনিও দাঁড়াতেন এবং সে শীঘ্র চললে তিনিও দ্রুত চলতেন। তিনি বললেন, এক সময় সে মারাত্মকভাবে আহত হলো এবং সে দ্রুত মৃত্যু কামনা করতে লাগল। এক সময় তলোয়ারের বাঁট মাটিতে রাখল এবং এর তীক্ষ্ণ দিক বুকে চেপে ধরে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করল। অনুসরণকারী ব্যক্তিটি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কী ব্যাপার? তিনি বললেন, যে ব্যক্তিটি সম্পর্কে আপনি কিছুক্ষণ আগেই বলেছিলেন যে, সে জাহান্নামী হবে, তা শুনে সাহাবীগণ বিষয়টিকে অস্বাভাবিক মনে করলেন। আমি তাদের বললাম যে, আমি ব্যক্তিটির সম্পর্কে খবর তোমাদের জানাব। অতঃপর আমি তার পিছু পিছু বের হলাম। এক সময় লোকটি মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং সে শীঘ্র মৃত্যু কামনা করতে থাকে। অতঃপর তার তলোয়ারের বাট মাটিতে রেখে এর তীক্ষ্ণধার বুকে চেপে ধরল এবং তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করল। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন বললেন, ‘মানুষের বাহ্যিক বিচারে অনেক সময় কোন ব্যক্তি জান্নাতবাসীর মত ‘আমল করতে থাকে, আসলে সে জাহান্নামী হয় এবং তেমনি মানুষের বাহ্যিক বিচারে কোন ব্যক্তি জাহান্নামীর মত ‘আমল করলেও প্রকৃতপক্ষে সে জান্নাতী হয়। [সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ২৮৯৮]
উক্ত হাদিস শরীফ থেকে জানা গেলো, নবিজি সাঃ-এর সাথে জিহাদরত ব্যক্তিও আত্মহত্যার অপরাধে তাকে জাহান্নামি বলে অভিহিত করেছেন খোদ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাঃ। তাহলে হেযবুত তওহীদের দাবি ‘তওহীদ ও জিহাদে থাকলে কবীরা গুনাহও জাহান্নামে পাঠাবে না’ কথাটা জিহাদের নামে চরম অপব্যখ্যা নয় কী?
বারো. জিহাদ না করলে সে কী কাফের-মুশরিক?
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, জিহাদ না করলে সে উম্মতে মুহাম্মাদী নয়, এমনকি তাদের দাবি মতে সে বেঈমান, কাফের ও মুশরিক। দেখুন তারা কী বলে,
যারা সেই কাজ অর্থাৎ জেহাদ চালিয়ে যাবে না তারা যত বড় মুসল্লি হোন যতবড় মুত্তাকি, আলেম, দরবেশ, পীর-মাশায়েখ হোন না কেন উম্মতে মোহাম্মদী নন। হাশরের দিন তাঁর উম্মত হিসাবে রসুলের সাফাতের উপর তাদের কোনো দাবি থাকবে না। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৩৯]
উম্মতে মুহাম্মদীর সংজ্ঞা হল, আল্লাহ যে কাজের দায়িত্ব দিয়ে তার রসূলকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন ও যে দায়িত্ব তিনি তার গঠিত জাতির ওপর অর্পণ করে চেলে গিয়েছেন, যে বা যারা সেই কাজ চালিয়ে যাবে শুধু তারাই উম্মতে মুহাম্মদী। যারা সেই কাজ অর্থাৎ জেহাদ চালিয়ে যাবে না তারা যত বড় মুসল্লিই হন,যত বড় মুত্তাকি, আলেম দরবেশ হন না কেন-উম্মতে মুহাম্মদী নন। হাশরের দিন তার উম্মত হিসাবে রসূলের শাফায়াতের ওপর তাদের কোন দাবী থাকবে না। [ইসলামের প্রকৃত আকীদা : পৃ. ১৬]
জেহাদ ত্যাগ করার কারণে এই জনসংখ্যা বহু আগেই মোমেনের সংজ্ঞা থেকে বহিষ্কার হোয়ে গেছে’। [এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ১০৮/১০৫; আকীদা : পৃ. ১৮]
আল্লাহ কোথাও বলেন নাই যে, সালাত (নামাজ) ত্যাগ করলে বা সওম (রোজা) ত্যাগ করলে বা হজ্ব ত্যাগ করলে বা অন্য যে কোন এবাদত ত্যাগ করলে কঠিন শাস্তি দিয়ে এই দীন থেকেই বহিস্কৃত করবেন শুধু জেহাদ (সংগ্রাম) এবং আল্লাহর রাস্তায় (জেহাদে) ব্যয় ছাড়া। [ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ১৫]
জেহাদ না করলে সে কাফের,মোশরেক ও যতই ইবাদত করুক সে জাহান্নামী। [ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ১৬]
অর্থাৎ তাদের দাবি মতে যে জিহাদ করে না সে উম্মতে মুহাম্মাদী নয়, বরং সে বেঈমান, কাফের ও মুশরিক।
ইসলাম কী বলে?
জিহাদ ফরজ হওয়ার পরও জিহাদ না করলে সে কাফের বা মুশরিক হয়ে যাবে এমন কোনো কথা বলা জিহাদের অপব্যাখ্যার শামিল। যদি জিহাদ না করলেই কেউ কাফের হয়ে যেতো, তাহলে আম্মাজান আয়েশা রা. কে নবীজি সা. জিহাদ না করে হজ্ব করতে কেন বললেন? আম্মাজান আয়েশা রা. নবিজি সাঃ কে প্রশ্ন করলেন-
يا رسول الله هل على النساء جهاد قال نعم جهاد لا قتال فيه الحج والعمرة
হে আল্লাহর রাসূল, মহিলাদের জন্য কি জিহাদ আছে?
তিনি বললেন: “হ্যাঁ, এমন জিহাদ আছে যাতে লড়াই নেই। তা হল, হজ্ব ও ওমর। [সুনানে ইবনে মাজাহ : হাদিস নং : ৩৯০১]
উপরন্তু বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবার প্রয়োজন থাকলেও জিহাদ না করে তাদের খেদমত করতে নির্দেশ দিয়েছেন খোদ রাসুলুল্লাহ সা.। যে হাদিসটি উপরে বর্ণনা করেছি। সুতরাং জিহাদ ফরজ হওয়ার পরও না করা সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহ বলা যায়, কিন্তু কাফের বা মুশরিক বলা অপব্যখ্যা।
পরিশিষ্ট:
প্রিয় পাঠক, জিহাদ ইসলামের অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সেন্সিটিভ একটি বিধান। যাকে ঘিরে নানা লোকে নানা ধরণের বিরোধীতা করে যাচ্ছে। কেউ প্রকাশ্যভাবে, কেউ অপ্রকাশ্যভাবে, আবার কেউ অপব্যাখ্যা করে। মনে রাখতে হবে, জিহাদের অনেক গুরুত্ব রয়েছে ইসলামে। এ গুরুত্ব নিন্মে কয়েকটি আয়াত ও হাদিস বর্ণনা করছি। মহান রব বলেন,
لَا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلًّا وَعَدَ اللهُ الْحُسْنٰى وَفَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا
সমান নয় সেসব মু’মিন যারা বিনা ওযরে ঘরে বসে থাকে এবং ওই সব মু’মিন যারা আল্লাহর পথে নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করে। যারা স্বীয় জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের ওপর যারা ঘরে বসে থাকে। আর প্রত্যেককেই আল্লাহ কল্যাণের ওয়া’দা করেছেন। আল্লাহ মুজাহিদীনদের মহান পুরস্কারের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন যারা ঘরে বসে থাকে তাদের ওপর। [সূরা আন নিসা : ৯৫]
وَلَا تَحْسَبَنَّ ٱلَّذِينَ قُتِلُواْ فِى سَبِيلِ ٱللّٰهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ
আর যারা আল্লার পথে শহীদ হয়, তাদেরকে তুমি মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত। [সূরা আলে ইমরান : ১৬৯]
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলূল্লাহ সাঃ বলেছেন,
مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ نَفْسَهُ بِالغَزْوِ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنَ النِّفَاقِ
যে ব্যক্তি মারা গেল অথচ সে জিহাদ করেনি এবং অন্তরে জিহাদ সম্পর্কে কোন চিন্তা-ভাবনাও করেনি, সে মুনাফিক্বীর একটি শাখায় মৃত্যুবরণ করল। [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ৫০৪০
এজন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অর্থাৎ জিহাদে শাহাদাৎ বরণ করা খোদ রাসুলুল্লাহ সাঃ-এরই একান্ত বাসনা ছিল। নবীজি সা. বলেন,
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِه لَوْلَا أَنَّ رِجَالًا مِنْ الْمُؤْمِنِينَ لَا تَطِيبُ أَنْفُسُهُمْ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنِّي وَلَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُهُمْ عَلَيْهِ مَا تَخَلَّفْتُ عَنْ سَرِيَّةٍ تَغْزُو فِي سَبِيلِ اللّٰهِ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِه لَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللّٰهِ ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ
সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, যদি কিছু মু’মিন এমন না হতো যারা আমার সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ না করাকে আদৌ পছন্দ করবে না, অথচ তাদের সবাইকে আমি সওয়ারী দিতে পারছি না, এই অবস্থা না হলে আল্লাহর পথে যুদ্ধরত কোনো ক্ষুদ্র সেনাদল হতেও দূরে থাকতাম না। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, আমার কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় হলো, আমি আল্লাহর পথে নিহত হই, অতঃপর জীবন লাভ করি। আবার নিহত হই আবার জীবন লাভ করি এবং আবার নিহত হই তারপর আবার জীবন লাভ করি। আবার নিহত হই। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ২৭৯৭]
হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
لَغَدْوَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوْ رَوْحَةٌ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا
আল্লাহর পথে একটি সকাল বা একটি বিকাল অতিবাহিত করা, দুনিয়া ও তার সমুদয় সমস্ত সম্পদ হতে সর্বোত্তম। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ২৭৯২]
হযরত আবূ আবস রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
مَا اغْبَرَّتْ قَدَمَا عَبْدٍ فِي سَبِيلِ الله فَتَمَسهُ النَّار
আল্লাহর পথে যে বান্দার পদদ্বয় ধূলায় ধূসরিত হয়, জাহান্নামের আগুন তার পদদ্বয় স্পর্শ করবে না। [সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ২৮১১]
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
لَا يُكَلَّمُ أَحَدٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَنْ يُكَلَّمُ فِي سَبِيلِهِ إِلَّا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَجُرْحُهُ يَثْعَبُ دَمًا اللَّوْنُ لَوْنُ الدَّمِ والريحُ ريحُ المسكِ
কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহর পথে আহত হয়, তবে আল্লাহই প্রকৃতপক্ষে জানেন যে, কে তার পথে হতাহত হয়েছে। কিয়ামতের দিনে সে এরূপ অবস্থায় আগমন করবে যে, তার ক্ষতস্থান হতে রক্ত প্রবাহিত হয়ে বের হতে থাকবে এবং তার বর্ণ রক্তের মতো হবে আর তার সুগন্ধি হবে মিশকের সুঘ্রাণের ন্যায়। [সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ২৮০৩]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা. থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় নবী কারিম সাঃ বলেন,
الْقَتْلُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ يُكَفِّرُ كُلَّ شَىْءٍ إِلاَّ الدَّيْنَ
আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যু বরণ করা সকল বিষয়ের কাফফারা, ঋন ব্যতীত। [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ২]
হযরত মিকদাম ইবনে মাদীকারিব রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
لِلشَّهِيدِ عِنْدَ اللَّهِ سِتُّ خِصَالٍ يُغْفَرُ لَهُ فِي أَوَّلِ دَفْعَةٍ مِنْ دَمِهِ وَيُرَى مَقْعَدَهُ مِنَ الْجَنَّةِ وَيُجَارُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَيَأْمَنُ مِنَ الْفَزَعِ الأَكْبَرِ وَيُحَلَّى حُلَّةَ الإِيمَانِ وَيُزَوَّجُ مِنَ الْحُورِ الْعِينِ وَيُشَفَّعُ فِي سَبْعِينَ إِنْسَانًا مِنْ أَقَارِبِهِ
শহীদের জন্য আল্লাহর নিকট ছয়টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
১. তার দেহের রক্তের প্রথম ফোঁটাটি বের হতেই তিনি তাকে ক্ষমা করেন এবং জান্নাতে তার ঠিকানা তাকে দেখানো হয়।
২. কবরের আযাব থেকে তাকে রক্ষা করা হয়।
৩. (কিয়ামতের) ভয়ংকর ত্রাস থেকে সে নিরাপদ থাকবে।
৪. তাকে ঈমানের চাদর পরানো হবে।
৫. আয়তলোচনা হুরের সাথে তার বিবাহ দেয়া হবে।
৬. এবং তার নিকট আত্মীয়দের মধ্য থেকে সত্তরজনের পক্ষে তাকে শাফা’আত করার অনুমতি দেয়া হবে। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ২৭৯৯]
জিহাদ সম্পর্কে এ রকম অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে। যা থেকে প্রতিয়মান হয় যে, জিহাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফযিলতপূর্ণ বিধান। যার ইচ্ছা প্রত্যেক মুমিনের মধ্যে থাকা জরুরি। কিন্তু এটাকেই ইসলামের মূল কাজ মনে করা চরম বিকৃতি।
হেযবুত তওহীদ কী জঙ্গী সংগঠণ?
মূলত সমাজে জঙ্গীবাদ বা ইসলামের জিহাদের নামে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে থাকে কিছু উগ্রবাদীচক্র। আর এর পেছনে সবচে বড় ভূমিকা রাখে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকা। দুয়েকটি আয়াত ও হাদিস দেখেই ইসলাম কায়েমের নামে তারা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। এ কখা হেযবুত তওহীও লিখেছে এভাকে,
কোরআনের দু’একটি আয়াত তুলে এনে দু’একটি হাদিস তুলে এনে ইসলামের নাম ব্যবহার করে বহু ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। মুসলমানদেরকে প্রকৃতপক্ষে কোরআন কি, হাদিস কি তা বিস্তারিত ভাবে এবং ভালোভাবে বুঝে নেওয়ার দরকার আছে। [প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৪৯]
বুঝা গেলো, ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান কমতির কারণেই মূলত উগ্রবাদ তৈরি হয়। আর এই ভয়ঙ্কর সমস্যাটা হেযবুত তওহীদের মধ্যে পুরোমাত্রায় রয়েছে। এমনকি তাদের প্রতিষ্ঠাতা এমাম বায়াজীদ খান পন্নী সাহেবের মধ্যেই রয়েছে পুরো মাত্রাই। দেখুন পন্নী সাহেব কী বলেছে,
আমি বাংলা জানি,যেটুকু জানা দরকার মানুষের,ইংলিশ জানি, যতটুকু মানুষের জানা দরকার,আমি আরবী জানি না,আরবীতে আমি নিরক্ষর। ঠিক আক্ষরিকভাবে নয়,কিন্তু আমি আরবী জানি না। আর যে এসলাম নিয়ে কথা সেই এসলাম রোয়েছে কোর’আন-হাদীসে আর সেটার ভাষা আরবী। ওখানে আমি বাস্তবিক অর্থে নিরক্ষর। [আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা : পৃ. ৫৫]
সুতরাং বুঝা গেলো, ইসলাম সম্পর্কে তাদের জ্ঞান তেমন নেই। ঠিক তারাই পবিত্র কুরআনের একটি আয়্তকে কেন্দ্র করে তাদের সদস্যদেনকে উগ্রবাদী করে তুলছে। দেখুন তারা কী লিখেছে,
যে মো’মেনের (ঈমানদারের) তলোয়ারের অর্থাৎ অস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তিনি কোনো দরজা দিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না। এ ব্যাপারে লিখতে গেলে শেষ নেই। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৪০]
আল্লাহর রসুলের ইসলাম যে জাতি গঠন করেছিল সে জাতির চরিত্রের সর্ব প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যোদ্ধার চরিত্র, তার প্রমাণ জাতির নেতা আল্লাহর রসুল (দ.) সহ সমস্ত জাতির মধ্যে এমন একটা লোকও বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যেত না যার শরীরে অস্ত্রের আঘাত নেই। বর্তমানের ইসলাম যে জাতি গঠন করে তার চরিত্রের সর্ব প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাপুরুষতা।ছোট-বড় সমস্ত রকম সংঘর্ষ, বিপদ আপদ থেকে পলায়ন। যে যত বেশি ধার্মিক সে ততো বেশি কাপুরুষ; এদের গায়ে সুচের খোঁচারও দাগ নেই। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ১৭]
আল্লাহর রসুলের ইসলাম নির্জনবাসি কামেল সুফী সাধক ওয়ায়েস করনী (রা.) কে নির্জনবাস থেকে বের করে এনে তলোয়ার হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ করেছিল। আর বর্তমানের এই ইসলাম যোদ্ধার হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তার হাতে তসবিহ ধরিয়ে দিয়ে মসজিদে আর খানকায় বসিয়ে দেয়। [এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ১৬]
যে যোদ্ধা নয়, যুদ্ধ জানে না, তার এই দীনুল এসলাম সমিতির প্রাথমিক সদস্যপদেরও (primary membership) যোগ্যতা নেই, ভালো সভ্য হওয়াতো দুরের কথা। এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৪০
অবশ্য তারা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে আবার দাবি করে বসবে,
হেযবুত তওহীদের জন্মের সময় থেকে আমি নীতি হিসাবে রসুলের এই তরিকা অনুসরণ কোরেছি। আমার কঠিন নির্দেশ দেয়া আছে কোন মোজাহেদ কোন রকম বে-আইনি কাজ কোরবে না, কোন আইন ভঙ্গ করবে না, কোন বে-আইনি অস্ত্র হাতে নেবে না। যদি আমি জানতে পারি যে কোন মুজাহেদদের কাছে কোন বে-আইনি অস্ত্র আছে তবে আমি পুলিসে খবর দিয়ে তাকে ধরিয়ে দেব। [জেহাদ, কেতাল ও সন্ত্রাস : পৃ. ৭]
মক্কায় নির্মম নির্যাতনের মুখেও কোন সাহাবীকে অস্ত্র হাতে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। [হলি আর্টিজেনের পর ; পৃ. ১৮]
অবৈধ অস্ত্রের সংস্পর্শে যাওয়া আমাদের এমামুয্যামানের নিষেধ। [গণমাধ্যমের করণীয় : পৃ. ৭০]
প্রথম কথা থেকে জানতে পারলাম, তাদের দাবি ছিলো, অস্ত্রের সাথে সম্পর্ক না থাকলে এবং যুদ্ধ না জানলে সে মুসলমান নয়। আবার পরের দাবি থেকে বুঝলাম, অস্ত্রের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে বুঝা গেলো, তাদের দাবিতে তারাই বেঈমান। যদি তারা পূর্বের দাবিতে অনড় থাকে যে, অস্ত্রের সাথে সম্পর্ক তাদের রয়েছে, তাহলে প্রশাসন কেন তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন না সেটাই আমার প্রশ্ন। এই হেযবুত তওহীদকে জঙ্গীবাদের সম্পৃক্তার অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।
দৈনিক কালেরকণ্ঠ পত্রিকায় ‘হিজবুত তাওহীদের ছদ্মবেশ’ নামক শিরোনামেলেখা হয়েছিলো, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জঙ্গিবাদ বিষয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠা এ সংগঠনের বিরুদ্ধেই মৌলবাদী প্রচারণাসহ জঙ্গিবাদের অভিযোগ আছে। হিজবুত তাওহীদ বা এর অঙ্গীভূত কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গত বছরের ২৩ নভেম্বর এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গত ২২ জানুয়ারি জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ সংগঠন হিজবুত তাওহীদ বা এর কোনো অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে যোগ না দিতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সতর্ক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেসব ‘সন্দেহভাজন’ সংগঠন নিষিদ্ধকরণের পর্যলোচনার তালিকায় আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হিজবুত তাওহীদ। এক বছর ধরে সংগঠনটি প্রচারণার নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে। দলীয় পত্রিকাসহ বিভিন্ন নামে সভা-সেমিনার করছে তারা। [দৈনিক কালেরকণ্ঠ : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ঈসায়ী]
এবং এ জঙ্গী সম্পৃক্তার অভিযোগে তাদের ‘এ ইসলাম ইসলামই নয়’ বইটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়। [যামানার এমামের পত্রাবলী : পৃ. ৫৯]
সুতরাং বুঝা গেলো, আদতেই তারা জঙ্গী। কিন্তু সুর পাল্টিয়ে প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
দাস প্রথা:
ইসলামে দাস-দাসি রাখার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। যে ব্যাপারে পবিত্র কুরআন-হাদিসে ভুরিভুরি প্রমাণ রয়েছে।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি অনুসারে দাসপ্রথার প্রচলন ইসলামে নেই, বরং তারা দাসপ্রথাকে নাস্তিকদের মত বর্বর বলে আখ্যায়িত করে থাকে। [জোরপূর্বক শ্রমব্যবস্থাই দাসত্ব : পৃ. ৬]
এমনকি যারা বলেন ইসলামে দাসপ্রথা রয়েছে, তাদেরকে ইসলামবিদ্বেষী বলেও সম্বোধন করেছে। [জোরপূর্বক শ্রমব্যবস্থাই দাসত্ব : পৃ. ৬]
তারা আরও লিখেছে,
কোন মানুষ প্রকৃত অর্থে যেমনি কখনও কারও প্রভু বা মালিক (Master, lord) হতে পারে না, তেমনি কেউ কারও দাস বা গোলামও (Slave, Servant) হতে পারে না। [জোরপূর্বক শ্রমব্যবস্থাই দাসত্ব : পৃ. ৫]
প্রকৃত সত্য হলো, ইসলামে জোরপূর্বক শ্রমব্যবস্থা বা দাস ব্যবস্থাই নেই। [জোরপূর্বক শ্রমব্যবস্থাই দাসত্ব : পৃ. ৬]
ইসলাম কী বলে?
ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগে দাসপ্রথা ব্যপকহারে প্রচলিত ছিলো। ইসলামি শরিয়াতের অনুমোদিত জিহাদে যুদ্ধবন্দিদের দাস বানানো যেতে পারে— এই একটি রাস্তা ইসলাম খোলা রেখেছে, তবে সেটিও শর্তসাপেক্ষে। জিহাদে যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থ ও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মুসলিম রাষ্ট্রের খলিফা নিম্নের ৪টি সিদ্ধান্তের যে কোনো একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন:
১. তাদেরকে হয়তো অনুগ্রহ করে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেওয়া।
২. মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো।
৩. তাদেরকে হত্যা করা হতো।
৪. আর তা না হলে তাদেরকে দাসদাসী বানিয়ে রাখা।
দাসপ্রথা কী ইসলামে বিলুপ্ত করা হয়েছে?
এ বিধান ইসলামে আজও চলমান রয়েছে। কারণ নবিজির সাঃ-সহধর্মিনী হযরত উম্মে সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم كَانَ يَقُولُ فِي مَرَضِهِ الَّذِي تُوُفِّيَ فِيهِ الصَّلَاةَ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ فَمَا زَالَ يَقُولُهَا حَتَّى مَا يَفِيضُ بِهَا لِسَانُهُ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থায় বলছিলেন, নামাজ এবং তোমাদের অধীনস্থ দাস-দাসী (অর্থাৎ তাদের ব্যাপারে যত্নবান থেকো)। বারবার একথা বলতে বলতে শেষে তাঁর যবান মুবারক জড়িয়ে যায়। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ১৬২৫]
উক্ত হাদিস থেকে বুঝা গেলো, নবিজির সাঃ ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত দাস-দাসির প্রথা বিলুপ্ত করা হয়নি। তাহলে দাসপ্রথা ইসলামে নেই এমন দাবি কী ইসলামের অপব্যাখ্যা নয়? এখন আপনারাই বলুন, যারা বলেন, ইসলামে দাসপ্রথা রয়েছে, তারা কী ইসলামবিদ্বেষী?
দাসপ্রথা কী বর্বর?
নাস্তিকরা ইসলামে দাসপ্রথা চালু থাকার কারণে ইসলাম ধর্মকে বর্বর বলে মনে করে। কারণ তারা দাসের সাথে ইসলামের আচরণ সম্পর্কিত বিধিনিষেধ সম্পর্কে অজ্ঞ। যুদ্ধবন্দীদের সাথে পৃথিবীব্যাপী যে অমানবিক আচরণ করে থাকে, সে তুলনায় ইসলাম তাদের দিয়েছে সহজ জীবন। কারণ তাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফে যেসব দিকনির্দেশা দিয়েছে, তার কয়েকটি নমুনা নিন্মে পেশ করা হলো।
দাস-দাসীর প্রতি সদাচরণ করা:
وَاعْبُدُواْ اللّهَ وَلاَ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالاً فَخُورًا
আর উপাসনা কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্নীয়, এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে। [সুরা নিসা : ৩৬]
হযরত আবু যর রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাঃ-বলেন,
هُمْ إِخْوَانُكُمْ، جَعَلَهُمُ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ، فَمَنْ جَعَلَ اللَّهُ أَخَاهُ تَحْتَ يَدِهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ، وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ، وَلاَ يُكَلِّفُهُ مِنَ الْعَمَلِ مَا يَغْلِبُهُ، فَإِنْ كَلَّفَهُ مَا يَغْلِبُهُ فَلْيُعِنْهُ عَلَيْهِ
তারা (দাস-দাসী) তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তা’আলা ওদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা যার ভাইকে তার অধীন করে দেন, সে নিজে যা খায়, তাকেও যেন তা খাওয়ায়। সে নিজে যা পরে, তাকেও যেন তা পরায়। আর তার উপর যেন এমন কোন কাজের চাপ না দেয়, যা তার শক্তির বাইরে। আর যদি তার উপর এমন কঠিন কোনো চাপ দিতেই হয় তাহলে সে নিজেও যেন তাকে সাহায্য করে। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৬০৫০]
হযরত যাজান রহি. সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَتَيْتُ ابْنَ عُمَرَ وَقَدْ أَعْتَقَ مَمْلُوكًا لَهُ فَأَخَذَ مِنَ الْأَرْضِ عُودًا، أَوْ شَيْئًا، فَقَالَ: مَا لِي فِيهِ مِنَ الْأَجْرِ مَا يَسْوَى هَذَا سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَنْ لَطَمَ مَمْلُوكَهُ، أَوْ ضَرَبَهُ، فَكَفَّارَتُهُ أَنْ يُعْتِقَهُ
একদা আমি ইবনু উমার রা. এর নিকট গেলাম। তিনি তার দাসকে মুক্ত করে দিলেন। অতঃপর তিনি মাটি থেকে এক টুকরা কাঠ বা অন্য কিছু উঠিয়ে বললেন, একে মুক্ত করায় আমার এর সমানও নেকি নেই। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তার ক্রীতদাসকে চড় মারবে বা মারধর করবে, এর কাফফারাহ হলো তাকে মুক্ত করে দেয়া। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ৫১৬৮]
হযরত আবু হুরায়রা রা. সুত্রে বর্ণিত, নবি সাঃ বলেছেন,
مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُسْلِمَةً، أَعْتَقَ اللَّهُ بِكُلِّ عُضْوٍ مِنْهُ عُضْوًا مِنَ النَّارِ، حَتَّى فَرْجَهُ بِفَرْجِهِ
যে ব্যাক্তি একটি মুসলিম গোলাম আযাদ করবে আল্লাহ তা’আলা সে গোলামের প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে জাহান্নামের আগুন থেকে তার প্রতিটি অঙ্গকে মুক্ত করবেন। এমন কি তার গুপ্তাঙ্গকেও গোলামের গুপ্তাঙ্গের বিনিময়ে মুক্ত করবেন। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৬৭১৫]
সুতরাং বুঝা গেলো, ইসলামে দাসপ্রথা চালু থাকলেও ইসলাম তাদেরকে যথাযথ অধিকার দিয়েছে। সুতরাং এ প্রথাকে বর্বর বলা মানেই হলো, ইসলামকে চরমভাবে কটুক্তি করার নামান্তর।
ইসলামে দাসপ্রথার হিকমাহ:
এক. কাফের যদি এমন হয় যে সে ফিরে গেলে পুনরায় মুসলিম উম্মাহর ও ইসলামের ক্ষতি করতে পারে বা ষড়যন্ত্র করতে পারে, তাহলে তার ক্ষতি থেকে মুসলিমরা বেঁচে যাবে। এতে দ্বীনের দাওয়াত প্রসারিত হবে। ফলে দ্বীনি স্বার্থে দাস বানিয়ে রাখাই শ্রেয়।
দুই. দাস বানিয়ে রাখলে কারাগারে নিক্ষেপ থেকে অধিক স্বাধীনতা ভোগ করা সম্ভব। এতে করে মুসলিম মনিবের প্রতি তার ক্রোধ বা আক্রোশ কম হবে। তাছাড়া মনিব যদি দাসের সাথে বিনয়ী, কোমল ও দয়ার্দ্র আচরণ করে তাহলে সেই ক্রোধ বা আক্রোশের সম্ভাবনা অনেক কমে শূন্যের পর্যায়ে চলে আসবে। ফলে দাস বানিয়ে রাখাই উত্তম।
তিন. কারাগারে নিক্ষেপ না করে দাস বানিয়ে রাখা অধিক যুক্তিসম্মত, কেননা কারাগারে রেখে দিলে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে আরো কিছু কর্মচারীর প্রয়োজন পড়তো। এতে করে নব্য ইসলামি রাষ্ট্রের উপর একটি অর্থনৈতিক চাপ পড়ে যেতো। ফলে দাস বানিয়ে রাখাই শ্রেয়।
চার. সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো, মুসলিমদের সাথে বসবাস করতে করে যদি কেউ ইসলামের সুমহান আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয় আর আল্লাহর ইচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে অনন্তকালের জাহান্নাম থেকে বেঁচে যায়, এর থেকে বড় সৌভাগ্যের ও মর্যাদার আর কিছুই হতে পারেনা।
পাঁচ. আর যদি তা না-ও হয়, তবুও দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দাস-দাসী মনিবের সাথে মুকাতাবাত বা লিখিত চুক্তি করে নিতে পারে। মনিব এতে কল্যাণ দেখতে পেলে তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে নিলে, সে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে পারে। সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় দাস বানিয়ে রাখা কোনো অযৌক্তিক বিষয় নয়। এরপরও যারা দাসপ্রথাকে কেন্দ্র করে ইসলামের অবমাননা করে থাকে, তারা ইসলামবিদ্বেষী ও নাস্তিকদের পাচাটা গোলাম।