হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম মহান রবের একজন গুরুত্বপূর্ণ নবি। নবি হিশাবে তিনিও মাসুম বা নিস্পাপ। তিনি নিজে কখনও অপরাধ করেননি, অপরাধীকে প্রশ্রয়ও দেননি। সুতরাং কিয়ামতে তিনি অপরাধী হিশেবে উঠবেন না।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের প্রতিষ্ঠাতা বায়াজীদ খান পন্নী খুব কৌশলী শব্দে লিখেছেন,
এমন হতে পারে যে, আসমানে উঠিয়ে নেবার পর আল্লাহ ঈসাকে (আ.) ভবিষ্যতে তাঁর উম্মাহর কাজের ফলে যে দাজ্জালের জন্ম হবে তা দেখিয়ে দিলেন, যা দেখে ঈসা (আ.) আল্লাহকে বললেন- ইয়া আল্লাহ! আমার উম্মতের কাজের ফলের জন্য আমিও অন্তত আংশিকভাবে দায়ী । কাজেই আমার উম্মতের সৃষ্ট দানবকে ধ্বংস করার দায়িত্ব আমাকেই দাও । অথবা এমনও হতে পারে যে, আল্লাহই ঈসাকে (আ.) বললেন- ঈসা! দ্যাখো, তোমরা উম্মতের ভুলের, বিপথগামীতার ফলে কেমন মহাশক্তিধর দানব সৃষ্টি হয়েছে যে আমার সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে নিজেকে রব, প্রভু বলে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং আমার শেষ নবীর উম্মতসহ মানবজাতি তাকে রব বলে মেনে নিয়েছে । যেহেতু তোমার উম্মত থেকেই এই কাফের দানবের জন্ম, কাজেই তোমাকেই আমি দায়িত্ব দিচ্ছি একে ধ্বংস করার জন্য । দাজ্জালকে হত্যা বা ধ্বংস করার জন্য আল্লাহর প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে আসমান থেকে হাজার হাজার বছরের অতীতের একজন নির্দিষ্ট নবীকে পৃথিবীতে পাঠাবার অন্য কোনো কারণ আমি দেখি না । যদি কেউ অন্য কারণ বের করতে পারেন তবে তা প্রকাশ করলে আমার ভুল সংশোধন করবো। – দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা : পৃ. ৫৫
উক্ত বক্তব্যে জনাব পন্নী বললো, ঈসা আ. কিয়ামতে আল্লাহকে বলবেন, ‘আমার উম্মতের কাজের ফলের জন্য আমিও অন্তত আংশিকভাবে দায়ী’ বাক্যটা দিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে চাইলো যে, ঈসা আ. খ্রিষ্টানদের অপরাধে আংশিকভাবে দায়ী বা অপরাধি।
ইসলাম কী বলে?
এক. আমরা যদি জনাব পন্নীকে প্রশ্ন করি যে, ঈসা আ. এই কথাটা যে কিয়ামতে বলবেন এটা আপনি কোথায় পেলেন? কুরআনে? হাদিসে? কোথায়? পন্নী সাহেবকে কবর থেকে উঠিয়ে পৃথিবীর সকল কিতাবাদী তার সামনে দিলেও কিয়ামতের আগে কী এর কোনো জবাব তিনি দিতে পারবেনদ না। তাহলে সে কোথায় পেলেন এ উদ্ভট কথা? এমন ডাহা মিথ্যাচার করে একজন গুরুত্বপূর্ণ নবিকে অপমান করার বৈধতা সে কোথায় পেলেন? এমন একজন জ্বলিলুল ক্বদর রাসুলের শানে এমন বেয়াদবীমূলক অপবাদ দিতে পন্নী সাহেবের হাত কী একবারও কাঁপেনি?
দুই. তাছাড়া কুরআনুল কারীমের খ্রিস্টানদের যাবতীয় অপকর্মের সাথে ঈসা আ. এর সংশ্লিষ্টতা সুষ্পষ্টভাবে নাকচ করে দেয়া হয়েছে । পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذْ قَالَ اللّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنتَ قُلتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَـهَيْنِ مِن دُونِ اللّهِ قَالَ سُبْحَانَكَ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أَقُولَ مَا لَيْسَ لِي بِحَقٍّ إِن كُنتُ قُلْتُهُ فَقَدْ عَلِمْتَهُ تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلاَ أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ إِنَّكَ أَنتَ عَلاَّمُ الْغُيُوبِ مَا قُلْتُ لَهُمْ إِلاَّ مَا أَمَرْتَنِي بِهِ أَنِ اعْبُدُواْ اللّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ وَكُنتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَّا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنتَ أَنتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ وَأَنتَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ
এবং (সেই সময়ের বর্ণনাও শোনো,) যখন আল্লাহ বলবেন, হে ঈসা ইবনে মারয়াম, তুমিই কী মানুষকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতিত আমাকে ও আমার মা-কে মাবুদরূপে গ্রহণ করো? সে বলবে, আমি তো আপনার সত্তাকে (শিরক থেকে) পবিত্র মনে করি। যে কথা বলার কোনও অধিকার নেই, সে কথা বলার সাধ্য আমার ছিলো না। আমি এরূপ বলে থাকলে আপনি অবশ্যই তা জানতেন। আমার অন্তরে যা গোপন আছে আপনি তা জানেন, কিন্তু আপনার গুপ্ত বিষয় আমি জানি না। নিশ্চয়ই যাবতীয় গুপ্ত বিষয়ে আপনি সম্যক জ্ঞাত। আপনি আমাকে যে বিষয়ের আদেশ করেছিলেন তা ছাড়া অন্য কিছু আমি তাদেরকে বলিনি। তা এই যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, যিনি আমারও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক এবং যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন আমি তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলাম। তারপর আপনি যখন আমাকে তুলে নিয়েছেন তখন আপনি স্বয়ং তাদের তত্ত্বাবধায়ক থেকেছেন। বস্তুত আপনি সব কিছুর সাক্ষি। -সুরা মায়িদা : ১১৬-১১৭
উপরিউক্ত আয়াত দু’টি থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, খ্রিস্টানদের অপকর্মের সাথে ঈসা আ. এর কোন যোগসূত্র নেই। তিনি এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যা ঈসা আ. নিজেও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এবং সত্য হিসাবে আল্লাহ তাআলা নিজেও স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ্য করেছেন। তাহলে বুঝা গেলো, আল্লাহ নিজেও এ কথা বুঝাতে চাচ্ছেন যে, ঈসা আ. দায়ী নন। তাছাড়া কেউ কারো অপরাধের দায় নিজের কাঁধে নেবে না বা কারও উপর অন্যের অপরাধের দায় চাপানো হবে না। মহা রব বলেন,
وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ
কোনো ভার বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। -সুরা ফাতির : ১৮
উপরিউক্ত আয়াত থেকে প্রমাণিত হলো যে, সবাই নিজ নিজ অপরাধে নিজেই অপরাধি। কারো অপরাধ আরেকজনের উপর চাপানো পবিত্র কুরআন বিরোধি। সুতরাং একজন প্রশিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ নবি ও রাসুলের শানে ‘দায়ী’ বা ‘অপরাধি’ অপবাদ লাগাতে যাদের হাঁত কাঁপেনা তারা আসলে কারা?
অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতেই কী তিনি দাজ্জালের হত্যা করতে আসবেন?
তারা বলেছে যে, ঈসা আ. আল্লাহকে বলেছেন, ‘আমার উম্মতের কাজের ফলের জন্য আমিও অন্তত আংশিকভাবে দায়ী। কাজেই আমার উম্মতের সৃষ্ট দানবকে ধ্বংস করার দায়িত্ব আমাকে দাও। -দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা : পৃ. ৫৫
অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, ঈসা আ. তাঁর উম্মতের অপরাধের কারণে তিনিও আংশিক দায়ী। আর এ দায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য আল্লাহপাকের কাছে নিবেদন পেশ করেছেন। নাউযুবিল্লাহ। এমন জঘন্য মন্তব্য কী কুরআন-সুন্নাহ’র কোথাও উল্লেখ্য আছে? মহান আল্লাহ দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য ঈসা আ. কে কেন নির্বাচন করেছেন, তার জবাব একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। ওহি ব্যতীত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ও ধারণার ভিত্তিতে এ ধরনের উদ্ভট কথোপকথন আবিষ্কারের অধিকার পন্নী সাহেব কোথায় পেলো? কুরআন-সুন্নাহর অতন্দ্র প্রহরী ফকিহ, মুহাদ্দীস ও উলামায়ে কেরামকে দীন বিকৃতকারী ও ভিলেন সাব্যস্ত করতে জনাব পন্নী তার বইয়ের বিভিন্ন স্থানে তাঁদেরকে ‘অতিবিশ্লেষণকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছে, সেই পন্নী সাহেব এখানে এসে কী করলো? আল্লাহ তাআলা যে বিষয় জানাননি, তা নিয়ে পন্নী সাহেবের এতো ঘাটাঘাটির প্রয়োজন হলো কেন? এটা কি অতিবিশ্লেষণ নয়? বরং আমি তো বলবো, ওহি ব্যতীত যে জিনিস জানা সম্ভব নয়, সে বিষয়ে মন্তব্য পেশ করতে গিয়ে একজন সম্মানিত রাসুলের শানে অপবাদ দেয়াকে ‘অতিবিশ্লেষণ’ না বলে ‘অপবিশ্লেষণ’ বলাটা অধিক বাঞ্ছনীয় ।