আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনকে পূর্ণাঙ্গতা প্রদান করেছেন। কুরআন দ্বারাই ইসলামকে সম্পূর্ণভাবে পরিপূর্ণতা দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا.
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে ইসলামকে (চির দিনের জন্য) পছন্দ করে নিলাম। (সুতরাং এ দীনের বিধানাবলী পরিপূর্ণভাবে পালন করো)। -সুরা মায়িদা : ৩
এ আয়াত পরিষ্কার প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা ইসলাম ও কুরআনকে পূর্ণতা প্রদান করেছেন। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করার জন্য মুসলমানদের অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থের প্রতি মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তারা তাদের দেশেরপত্র পত্রিকার সাপ্তাহিক সংকলনে লিখেছে,
কেবল কোর’আন দিয়েই যে ফয়সালা দিতে হবে তা আল্লাহ বলেন নি, তিনি বলেছেন ‘আনযালাল্লাহু’ অর্থাৎ আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান। বেদ, তওরাত, জিন্দাভেস্তা, ত্রিপিটক, যবুর, ইঞ্জিলও আল্লাহর অবতীর্ণ, সুতরাং সেগুলি দিয়ে ফয়সালা দিলেও সেটা এসলামেরই ফয়সালা, সেটাই সমাজে শান্তি আনবে। -দৈনিক দেশের পত্র, সাপ্তাহিক সংকলন : সংখ্যা : ২৪ পৃ. ২৫
ইসলাম কী বলে?
পবিত্র কুরআন ছাড়া অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ দিয়ে বিচার কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ لِكُلِّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ.
এবং (হে রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমি তোমার প্রতিও সত্যসম্বলিত কিতাব নাযিল করেছি, তার পূর্বের কিতাবসমূহের সমর্থক ও সংরক্ষকরূপে। সুতরাং তাদের মধ্যে সেই বিধান অনুসারেই বিচার করো, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন। আর তোমার নিকট যে সত্য এসেছে তা ছেড়ে তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না। তোমাদের মধ্যে প্রত্যেক (উম্মত)-এর জন্য আমি এক (পৃথক) শরীয়ত ও পথ নির্ধারণ করেছি। আল্লাহ চাইলে তোমাদের সকলকে একই উম্মত বানিয়ে দিতেন। কিন্তু (পৃথক শরীয়ত এজন্য দিয়েছেন) যাতে তিনি তোমাদেরকে যা-কিছু দিয়েছেন, তা দ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন। সুতরাং তোমরা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করো। তোমাদের সকলকে আল্লাহরই দিকে ফিরে যেতে হবে। অতঃপর যে বিষয়ে তোমরা মতভেদ করছিলে সে সম্পর্কে তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন। -সুরা মায়িদা : ৪৮
উক্ত আয়াত থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে যেহেতু পূর্ববর্তী সকল ধর্ম রহিত হয়ে গেছে, তাই সেসব ধর্মগ্রন্থকে বর্তমানের জন্যও কার্যকারী মনে করা ও কুরআন বাদ দিয়ে সেসব গ্রন্থ দ্বারা ফায়সালা করতে পারাকে বৈধতা প্রদান করা ইসলাম ও কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণাঙ্গতাকে অস্বীকার করার নামান্তর। উল্লিখিত আয়াতে কুরআনকে পূর্ববর্তী সকল কিতাবের উপর কর্তৃত্বকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর ব্যাখ্যায় ইবনে জুরাইয রহ. বলেন:
القرآن أمين على الكتب المتقدمة، فما وافقه منها فهو حق، وما خالفه منها فهو باطل.
কুরআন পূর্ববর্তী সমস্ত গ্রন্থের সত্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রদানকারী পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে যা কুরআনের সাথে মিলবে, একমাত্র সেটাই সত্য। আর যা কুরআনের বিপরীত হবে, তা বাতিল বলে বিবেচিত হবে। -তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ৩ পৃ. ১৩০
সৌদি আরবের বরেণ্য ইসলামিক স্কলার, বর্তমান বিশ্বের নন্দিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব, শায়খ উসাইমিন রহ. বলেন,
وجميع الكتب السابقة منسوخة بالقرآن العظيم قال الله تعالى : وأنزلنا إليك الكتاب بالحق مصدقاً لما بين يديه من الكتاب ومهيمناً عليه أي حاكماً عليه وعلى هذا فلا يجوز العمل بأي حكم من أحكام الكتب السابقة.
পূর্ববর্তী সকল কিতাব মহাপবিত্র কুরআনের মাধ্যমে রহিত হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে। যা তার পূর্বের কিতাবের সত্যায়নকারী ও সেগুলির উপর তদারকী তথা কর্তৃত্বকারী’। এ ভিত্তিতে পূর্ববর্তী কিতাবের কোন বিধানের উপর আমল করা জায়েয নয়। -শায়খ উসাইমিন রচিত শরহু সালাসাতিল উসূল : পৃ. ৬৫
যেখানে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের কোন বিধানের উপর আমল করা জায়েয নেই। সেখানে হেযবুত তওহীদ কর্তৃক মূর্তি পূজারীদের বেদ আর পারস্যের অগ্নি পুজকদের জিন্দাবেস্তা দ্বারা প্রদানকৃত ফয়সালাকে ইসলামের ফয়সালা বলে আখ্যায়িত করা, আল্লাহর বিধানের সাথে তামাসা ছাড়া আর কী হতে পারে?
তাছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থগুলিকে অধ্যয়ন ও সংরক্ষণ করাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-পছন্দ করতেন না। অথচ ‘কোনরূপ দলিল-প্রমাণ ছাড়া আসমানী কিতাব হিশাবে প্রমাণিত নয়’ এমন সব ধর্ম গ্রন্থকেও হেযবুত তওহীদ আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। জনাব পন্নী হিন্দু, বৌদ্ধ্যসহ অন্যান্য ধর্মকে সত্য ধর্ম বলে বিশ্বাস করার পাশাপাশি তাদের ধর্মগ্রন্থ ও অবতারদেরকে আল্লাহ-র পক্ষ হতে প্রেরিত হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করতো। এমনকি জনাব পন্নী পৌত্তলিকদের হিন্দু ধর্মকে কুরআনে বর্ণিত দ্বীনুল কাইয়্যেমাহ, শ্বাশত চিরন্তন ধর্ম আর প্রকৃত তাওহীদ বলে আখ্যায়িত করেছেন।এসবের পর্যালোচনা সামনে উল্লেখ করা হবে। ইনশাআল্লাহ।
একটি প্রশ্ন :
হেযবুত তওহীদ পূর্ববর্তী সকল ধর্মগ্রন্থ দ্বারা ফায়সালা করাকে সিদ্ধ প্রমাণ করার জন্য কুরআনের একটি আয়াত দ্বারা দলীল পেশ করার অপচেষ্টা করেছে। তাঁরা লিখেছে, আল্লাহ বলেছে ‘আনযালাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান । এ বলে তাঁরা বুঝাতে চাচ্ছে এ সংক্রান্ত আয়াতগুলিতে তো আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে কুরআন দ্বারাই ফায়সালা করতে বলেননি। বরং আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান দ্বারা ফায়সালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সকল ধর্মগ্রন্থই আল্লাহ-র অবতীর্ণ।
জবাব:
এভাবে দলিল উত্থাপন মূলত তাদের সীমাহীন মূর্খতাকেই প্রমাণ করে। তাদের এ দলিলটি দু’টি কারণে সঠিক নয়।
এক. আল্লাহর নাযিলকৃত পূর্বের বিধানগুলো অবিকৃত অবস্থায় বর্তমানে অবশিষ্ট নেই। সাথে সাথে এসব ধর্মগ্রন্থগুলো কুরআন দ্বারা রহিত হয়ে গিয়েছে। বিকৃত ও রহিত কিতাবকে আল্লাহ-র পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বলা কখনই যুক্তিসংঙ্গত হতে পারে না।
দুই. উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ‘বিমা আনযালাল্লাহ’ বলে তাঁর নাযিলকৃত বিধান দ্বারা ফয়সালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ যেহেতু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে প্রদান করা হয়েছে, তাই এখানে ‘বিমা আনযালাল্লাহ’ দ্বারা তাঁর উপর অবতীর্ণ বিধান তথা কুরআনই উদ্দেশ্য হবে। আর এ বিষয়টিই কুরআন-হাদিসের অকাট্য দলিল দ্বারা বলিষ্ঠভাবে প্রমাণিত। ইমাম ইবনে কাসীর রহ. ‘বিমা আনযালাল্লাহ’ এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন:
بِمَا أَنزَلَ اللهُ إليك في هذا الكتاب العظيم.
আল্লাহ তাআলা আপনার উপর যে মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, তা দ্বারা আপনি ফায়সালা করুন। -তাফসীরে ইবনে কাসীর খ. ৩ পৃ. ১২৮
বাস্তবতার আলোকে:
এসব আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ না হওয়ার প্রমাণ জনাব পন্নী প্রচলিত সকল প্রসিদ্ধ ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলিকে আল্লাহ-র পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হওয়ার দাবি করার পাশাপাশি বর্তমানেও এসবের সত্যতা ও সঠিকতার সনদ প্রদান করেছেন। অথচ বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসবের অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থ মানব রচিত। আল্লাহর প্রদানকৃত নয়। যেমন বৌদ্ধদের ত্রিপিটক। বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্বাসীরা আল্লাহ-র উপর ঈমান আনা তো দূরের কথা, তারা স্রষ্টার অস্তিত্বেও বিশ্বাস করে না। তাদের ধারণা মতেও এটা স্রষ্টার পক্ষথেকে অবতীর্ণ কোন বাণী নয়। যেখানে তারা নিজেরাই এটাকে আল্লাহ-র পক্ষ থেকে হওয়ার দাবি করে না। সেখানে গৌতম বুদ্ধের জীবনি ও উক্তিসমূহের সংকলনকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বলে ধারণা করা নিতান্ত হাস্যকর ও জঘন্য কুফরি ছাড়া আর কী বা হতে পারে?
আর তাওরাত ইঞ্জিলের মতো যে সব গ্রন্থ আসমান থেকে অবতীর্ণ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়, সেগুলো বর্তমানে অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান নেই । এসবের মাঝে বিকৃতি আর পরিবর্তন এত বেশি সাধিত হয়েছে যে, বর্তমানে এসবকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ও আল্লাহ তা’আলার প্রদানকৃত বিধান বলে আখ্যায়িত করার অবকাশ নেই। যা ইতিপূর্বে প্রমাণসহ আলোচনা করে আসছি। এমনকি জনাব পন্নী নিজেও স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছে,
ভারত অঞ্চলে আল্লাহ জীবন-বিধান দিয়ে যে সকল নবী রসুল (আঃ) পাঠিয়েছেন, আমরা বিশ্বাস কোরি সেগুলি আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে, কিন্তু কাল পরিক্রমায় সেগুলোর ব্যবহার ও বইগুলি বিকৃত কোরে ফেলা হোয়েছে। একই কাজ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের বেলাতেও করা হোয়েছে। এজন্য সকল প্রাচীন, আঞ্চলিক দীনগুলিকে অনুপযুক্ত ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ ১৪০০ বছর আগে শেষ দীন এসলামের মহাগ্রন্থ আল কোর’আন নাযেল কোরলেন। -এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব : পৃ. ৫৬
অতীতের সবগুলি ধর্মই যেমন কাল পরিক্রমায় বিকৃত হোয়ে গেছে। -এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব : পৃ. ৫৩
বলা বাহুল্য পূর্ববর্তী কেতাবগুলো ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। -ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে : পৃ. ৬
জনাব পন্নী একদিকে অন্য সকল ধর্মগ্রন্থকে বিকৃত বলে দাবি করছে, অপরদিকে সে গুলোকে আল্লাহ-র বাণী বলে আখ্যায়িত করে সেগুলো দ্বারা বিচার-ফায়সালার অনুমতিও দিচ্ছে! কী হাস্যকর না ব্যাপরটা?