যদি কেউ বড় শিক্ষিত হয়, তবে তার বক্তব্য বুঝতে হলে নিশ্চয় জ্ঞানী হতে হয়, অথবা জ্ঞানীদের থেকে বুঝে নিতে হয়। অনেক সময় নিজের বুঝ অনুয়ায়ী ব্যাখ্যা করলে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। মানবজাতির শিক্ষা বুঝতে যদি শিক্ষকের সাহায্য লাগে, তাহলে আল্লাহপাকের কালাম বুঝতে কী ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই? নিশ্চয় আছে। সেই ব্যাখ্যার নাম তাফসীর। ইসলামের স্বীকৃত একটি জ্ঞানের নাম ‘ইলমুত তাফসীর’ বা তাফসীরের জ্ঞান। যে জ্ঞানের চর্চা আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ সা. করে গেছেন, এরপর সাহাবায়ে কেরাম রা. করে গেছেন, এরপর তাবেয়ীগণ করেছেন, এরপর যুগে যুগে তাদের তাফসীরের উপর ভিত্তি করে অসংখ্য তাফসীরের কিতাব রচিত হয়েছে। অথচ এই তাফসীরের কিতাবগুলো বাদ দিতে হেযবুত তওহীদ যেন আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
আগেই বলেছি, হেযবুত তওহীদ মুসলিম জাতির পবিত্র কুরআনের প্রতি যে অগাধ বিশ্বাস সেটা নষ্ট করতে বদ্ধাপরিকর। এবার তারা দাবি করেছেন যে, পবিত্র কুরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যা পড়া যাবে না। তারা লিখেছে,
বলা বাহুল্য পূর্ববর্তী কেতাবগুলো ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, এবং শেষ ইসলামও তাদের অতিবিশ্লেষণের ভারে বিকৃত হতে হতে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে, কেবল অক্ষত আছে কোর’আনের বর্ণগুলো। তার ব্যাখ্যা পাল্টে বহু রকম হয়ে গেছে। -ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে : পৃ. ৬
এ ছাড়াও হেযবুত তওহীদের দ্বিতীয় এমাম হুসাইন সেলিম অসংখ্য জায়গায় বক্তব্য দিয়ে চলেছেন যে, ‘তাফসীর পড়বেন না, সরাসরি বাংলা অনুবাদ পড়বেন।’ ইউটিউবে এ সম্পর্কে তার অনেক ভিডিও বক্তব্য পাবেন। উপরন্তু তারা তাফসীরকারকদের কাফের বলতেও দ্বিধা করেনি। এ লিংকে কিছু পাবেন- https://youtu.be/Shz1-jtd2KU
ইসলাম কী বলে?
পবিত্র কুরআন তাফসীর ছাড়া বুঝা সম্ভব নয়। এজন্য মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে পবিত্র কুরআনের তাফসীর করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
وَمَا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلاَّ لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُواْ فِيهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
আমি তোমার উপর এ কিতাব এজন্যই নাযিল করেছি, যাতে তারা যে সব বিষয়ে বিভিন্ন পথ গ্রহণ করেছে, তাদের সামনে তা সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা কর এবং যাতে এটা ঈমান আনয়নকারীদের জন্য হিদায়াত ও রহমতের অবলম্বন হয়। -সুরা নাহাল : ৬৪
সুতরাং বুঝা গেলো, তাফসীরের জ্ঞান আল্লাহ তাআলা কর্তৃক স্বীকৃত ও নির্দেশিত। ফলে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-হাদিসের মাধ্যমে কুরআনের তাফসীর করেছেন। যা সাহাবায়ে কেরাম রা. আমাদের জানিয়ে, বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তাফসীর অস্বীকার করা মানেই পবিত্র কুরআন অস্বীকার করা।
পবিত্র কুরআনের তাফসীরের জ্ঞানের জন্য নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে দুআ করেছিলেন। যা হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-তাঁর ব্যাপারে বলেন,
اللَّهمَّ علِّمْهُ الحِكمةَ وتأويلَ القرآنِ
হে আল্লাহ, ইবনে আব্বাসকে রা. তুমি হিকমাহ এবং কুরআনের তাফসীরের জ্ঞান দান করো। -আল ইসতিআব : খ. ৩ পৃ. ৬৭
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এ দুআ এতো বেশি কবুল হয়েছিলো যে, ইবনে আব্বাস রা. এর তাফসীরের জ্ঞানের প্রশংসায় ইবনে মাসউদ রা. বলতেন,
نِعمَ تُرجَمانُ القرآنِ ابنُ عبّاسٍ
কুরআনের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস কতইনা পারদর্শী! [ফাতহুল বারী (ইবনে হাজার) খ. ৭ পৃ. ১২৬]
সুতরাং বুঝা গেলো, তাফসীরের ইলম এটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর থেকে স্বীকৃত। আর নবি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কর্তৃক স্বীকৃত এ জ্ঞানকে বাদ দেওয়া মানেই রাসুলুল্লাহ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর আনীত দ্বীনকে ছুঁড়ে ফেলার নামান্তর। উপরন্তু মনে রাখতে হবে, অতীত তাফসীর ছাড়া পবিত্র কুরআন বুঝা কারও পক্ষেই সম্ভবপর নয়।
তাফসীর ছাড়া নাসেখ-মানসুখ বুঝা সম্ভব নয়।
একটি উদহরণ দিচ্ছি, মনে করুন, আপনি কোনো দোকানে গিয়ে দু’টি পন্য ক্রয় করলেন। একটার দাম ৫৫ টাকা, অপরটার দাম ৪৫ টাকা। দোকানদার যখন আপনাকে দু’টি পন্যের টাকার হিসাব ক্যালকুলেটরে তুলবেন, তখন তিনি যোগ করবেন এভাবে, ৫৫+৪৫=১০০/-। এখন দোকানদার হিসাব করে আপনাকে বললেন, দুটি পন্য একটার দাম ৫৫ টাকা এবং আরেকটার দাম ৪৫ টাকা। মোট ১০০ টাকা দিন। কিন্তু আপনি তো পন্ডিত মানুষ। আপনি + মানে ‘এবং’ শব্দটা না মেনে তাকে শুধু প্রথম পন্যের ৫৫ টাকা দিয়ে চলে আসলেন। কিন্তু দোকানদার ‘এবং ৪৫ টাকা’ শব্দটা বলে তিনি আরও বাকি ৪৫ টাকা চাইলেন। কিন্তু আপনি তো ‘এবং’ শব্দের মাধ্যমে আলাদা কিছু মানতে চান না। ফলে আপনি তাকে বললেন, আমি যেহেতু প্রথম পন্যের টাকা আপনাকে দিয়েছি, সুতরাং পরের ‘এবং ৪৫ টাকা’ আপনি চাইতে পারেন না। কারণ আমি ‘এবং’ শব্দের মাধ্যমে একটাই বুঝি, আলাদা কিছু বুঝি না।
এখন আপনিই বলুন, পিঠ বাঁচবে? নিশ্চয় না। কেন? কারণ ‘এবং’ শব্দের উপর আপনি আমল করেননি। সুতরাং যদি দুনিয়ার আদালতে ‘এবং’ শব্দ না মানার কারণে পিঠ না বাঁচে, তাহলে অতীত কালের তাফসীর না দেখে রহিত বিধানগুলোর উপরও যখন আমল করতে যাবেন, তখন ঈমানের পিঠ বাঁচবে কী? নিন্মে কয়েকটি আয়াত ও হাদিসের দিকে লক্ষ করুন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَالَّذِينَ هَادُواْ وَالنَّصَارَى وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحاً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ
(সার কথা,) মুসলিম হোক বা ইয়াহুদী, খ্রিস্টান হোক বা সাবী, যে-কেউ আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনবে এবং সৎকর্ম করবে, তারা আল্লাহর নিকট নিজ প্রতিদানের উপযুক্ত হবে এবং তাদের কোনও ভয় থাকবে না আর তারা কোনও দুঃখেও ভুগবে না। -সুরা বাকারা : ৬২
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, যারা ঈমানদার ইহুদী বা খ্রিষ্টান তারাও জান্নাতে যাবে। আবার অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
যে ব্যক্তিই ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও দীন অবলম্বন করতে চাবে, তার থেকে সে দীন কবুল করা হবে না এবং আখিরাতে সে মহা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। -সুরা আলে ইমরান : ৮৫
উপরিউক্ত আয়াত দুটি থেকে বুঝা যাচ্ছে-
১. বর্তমানের ইহুদী-খ্রিষ্টানরাও জান্নাতে যাবে।
২. বর্তমানের ইহুদী-খ্রিষ্টানরা ইসলাম না মানলে জাহান্নামে যাবে। এখন তাফসীর ব্যাতিত এর সমাধান কী? যখন তাফসীর বাদ দেওয়া হবে, তখন তো এ ধারণা নিয়েই বসে থাকতে হবে যে, ইহুদী-খ্রিষ্টানরাও জান্নাতি। আর বাস্তবে হয়েছেও সেটাই। দেখুন হেযবুত তওহীদ লিখেছে,
স্বর্গে যাবার জন্য আল্লাহ যে বিষয়গুলি বিশ্বাস করতে বলেছেন সেগুলি বিশ্বাস করতে হবে। এখানেই প্রশ্ন, ইসলামের শেষ সংস্করণ এসে যাওয়ার পরও ইসলাম গ্রহণ না করে, পূর্ববর্তী ধর্মবিশ্বাসে স্থির থেকে কেউ কি স্বর্গে যেতে পারবেন? এর জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ, অবশ্যই তাদেরও জান্নাতে যাওয়ার পথ খোলা আছে। এক্ষেত্রে শর্ত হলো, তাদেরকে শেষ নবী ও শেষ গ্রন্থ কোর’আনকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। -হেযবুত তওহীদের ওয়েবসাইটে ‘আল্লাহর পছন্দনীয় ধর্ম কোনটি’? শিরোনামে লেখা প্রবন্ধ।
প্রকৃত সত্য হলো- স্রষ্টা প্রদত্ত সকল ধর্মই সত্যধর্ম। এগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর যে কোনোটি মানুষ মেনে চলতে পারে। তবে মানতে হবে পূর্ণাঙ্গভাবে। -দৈনিক বজ্রশক্তি ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ ঈসায়ী
শেষ নবী কোন ধর্মকেই বাতিল করেন নি, তিনি সকল ধর্মকে সংরক্ষণ ও সত্যায়ন করেছেন। আমরা যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর অনুসারীরা পূর্ববর্তী সকল নবী ও অবতারগণের জাতি- গোষ্ঠী-সম্প্রদায়কে একটি সাধারণ সত্যের উপর ঐক্যবদ্ধ করার আহ্বান করছি মাত্র। সেই সত্য হচ্ছে, সকল মানুষের স্রষ্টা এক, সকল মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান, সকল ধর্ম এসেছে একই স্রষ্টার কাছ থেকে, সকল নবী-রসুল- অবতারগণ একই ধর্মের অনুসারী ছিলেন, তারা একে অপরকে ভাই বলে জেনেছেন। সুতরাং আমরা যদি তাঁদের প্রকৃত অনুসারী হই তবে আমাদেরও একে অপরকে ভাই বলে বিশ্বাস করতে হবে। আমাদের সবাইকেই অন্য ধর্মের নবী-রসুলকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। এতটুকু উদারতা বা হৃদয়ের প্রসারতা যদি আমরা প্রদর্শন করতে না পারি তাহলে পার্থিব ও পারলৌকিক কোন জগতেই আমরা শান্তি লাভের যোগ্যতা অর্জন করতে পারবো না। এই ঐক্য আল্লাহর চূড়ান্ত অভিপ্রায়। -দেশেরপত্র সাপ্তাহিক সংকলন- ২৪ পৃ. ২৫
এখানে তারা সুস্পষ্টভাবে বুঝাতে চায় যে, সব ধর্মের লোকেরা পূর্ণভাবে তাদের ধর্ম মানলে জান্নাতে যাবে। এই আকিদাববিধ্বংসী কুফরী মতবাদটা তারা লালন করে একমাত্র তাফসীর না দেখার কারণে।
সমাধান কী?
উপরোল্লিখিত দিটি আয়াতে প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘ইহুদী খ্রিস্টানরাও ঈমান থাকলে জান্নাতে যাবে’। অবার অপর আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম মানলে জাহান্নামে যাবে’। এখন সমাধান কী? চলুন তাফসীরে কী বলা হচ্ছে দেখে নেওয়া যাক। তাফসীরে কুরতুবীতে এসেছে, সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
رُوِيَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ قَوْلَهُ إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هادُوا الآية منسوخ بقوله تعالى وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ
আয়াত ‘إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَالَّذِينَ هَادُواْ নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী(…তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে) আয়াতটি পরবর্তিতে নাযিলকৃত আয়াত وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না। এ আয়াতের মাধ্যমে রহিত হয়ে গেছে। -তাফসীরে কুরতুবী : খ.১ পৃ. ২৯৬
আয়াতটি মানসুখ বা রহিত হওয়ার কারণ হিসাবে ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
قَوْلِهِ إنَّ الَّذِينَ آمَنُوا والَّذِينَ هادُوا قالَ فَأنْزَلَ اللَّهُ بَعْدَ هَذا ومَن يَبْتَغِ غَيْرَ الإسْلامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنهُ وهو في الآخِرَةِ مِنَ الخاسِرِينَ
অর্থাৎ ‘إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَالَّذِينَ هَادُواْ ‘অর্থ: নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী(,…তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে) আয়াতটি وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না। আয়াতটি পরবর্তিতে নাযিল হয়েছে। -তাফসীরে শাওকানী : খ. ১ পৃ. ৮০
সুতরাং বুঝা গেলো, ইসলামের সূচনালগ্নে ইহুদী-খ্রিস্টানদের তাওহীদের উপর অটুট থেকে স্বীয় ধর্মে থাকার অনুমতি থাকলেও পরবর্তীকালে তা রহিত হয়ে যায়। সুতরাং প্রমাণ হলো, তাফসীর বাদ দিয়ে বঙ্গানুবাদ পড়ে পবিত্র কুরআন বুঝা সম্ভবপর নয়।
আরও একটি নমুনা দেখুন। আল্লাহ পাক বলেন,
وَلِلّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّواْ فَثَمَّ وَجْهُ اللّهِ إِنَّ اللّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
পূর্ব ও পশ্চিম সব আল্লাহরই। সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ ফেরাবে সেটা আল্লাহরই দিক। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বব্যাপী ও সর্বজ্ঞ। -সুরা বাকারা : ১১৫
উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণ হয়, যেকোনো দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা যাবে। যেহেতু আল্লাহ পাক সবদিকেই আছেন। অথচ অপর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,
قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاء فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّواْ وُجُوِهَكُمْ شَطْرَهُ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوْتُواْ الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ وَمَا اللّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ
(হে নবি,) আমি তোমার চেহারাকে বারবার আকাশের দিকে উঠতে দেখছি। সুতরাং যে কিবলাকে তুমি পছন্দ করো আমি শীঘ্রই সে দিকে তোমাকে ফিরিয়ে দেব। সুতরাং এবার মসজিদুল হারামের দিকে নিজের চেহারা ফেরাও। এবং (ভবিষ্যতে) তোমরা যেখানেই থাকো (সালাত আদায়কালে) নিজের চেহারা সে দিকেই ফেরাবে। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তারা জানে এটাই সত্য, যা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এসেছে। আর তারা যা-কিছু করছে আল্লাহ সে সম্বন্ধে উদাসীন নন।। -সুরা বাকারা : ১৪৪
উপরোক্ত দু’টি আয়াতের প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে, যেকোনো দিকে ফিরেই নামাজ পড়া যাবে। আর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হচ্ছে, শুধু কাবা শরীফের দিকে ফিরে নামাজ পড়া আল্লাহ-র নির্দেশ। এখন বলুন এটার সমাধান কী? তাফসীর ছাড়া কী এটার সমাধান হেযবুত তওহীদ দিতে পারবে? নিশ্চয় না। চলুন তাফসীর কী বলা হচ্ছে জেনে নেওয়া যাক। এ সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রা. তাফসীর করে বলেন,
كان أول ما نسخ من القرآن القبلة
কুরআনের সর্বপ্রথম রহিত আয়াত হলো, কিবলার আয়াত। -তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ২ পৃ. ২৯
অর্থাৎ প্রথমত তো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন, কিন্তু পরবর্তিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পছন্দমত আল্লাহপাক বাইতুল মুকাদ্দাসের আয়াত রহিত করে কাবার দিকে ফেরার নির্দেশ দিলেন। -উমদাতুত তাফসীর : খ. ১ পৃ. ১৯৪
তাহলে বলুন, তাফসীর না দেখলে কী এর সমাধান পাওয়া যেতো? এমন প্রমাণ দিলে ভুরিভুরি প্রমাণ দেওয়া যাবে যে, তাফসীর ছাড়া কুরআন মাজীদ বুঝা সম্ভব না।
দ্বিতীয় কথা হলো, পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নাযিল করা হয়েছে। যাকে ‘শানে নুযুল’ বলা হয়। যে প্রেক্ষাপটগুলো না জানলে সে আয়াতগুলোর প্রকৃত অর্থ বুঝে আসে না। অথচ এ প্রেক্ষাপটগুলো লেখা আছে বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে। সুতরাং যদি তাফসীর বাদ দিতে হয়, তাহলে কুরআন শরীফের অর্থ কিভাবে বুঝবেন আমার জানা নেই।
একটা গভীর ষড়যন্ত্র:
একটা গভীর ষড়যন্ত্রের রূপরেখা বলছি, মুলত ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের বর্তমান ষড়যন্ত্রের একটি গভীর ধারা আমাদের অগোচরে। তারা শতশত বছর ধরে গবেষণা করে দেখেছে যে, মুসলমানরা মূলত কুরআনের মাধ্যমেই প্রভাবিত হয় সবচে বেশি। সেহেতু তারা কুরআন শরীফকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য ভারত উপমহাদেশেই কুরআন শরীফের লক্ষ লক্ষ কপি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো, হাফেজদের ধরে ধরে যবাই করেছিলো। যা ইতিহাসের পাতায় এখনও লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু এতো কিছু করার পরও তারা কুরআন মাজীদকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে দিতে পারেনি। তখন তারা ষড়যন্ত্রের রুপরেখা পরিবর্তন করলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো, ‘যেহেতু আমরা কুরআন উঠিয়ে দিতে পারলাম না এবং মুসলিমদের জাগরণ থামাতে পারছি না, সুতরাং প্রমাণ হচ্ছে কুরআন শরীফের কপি জ্বালিয়ে আমরা সফলতা পাবো না। অতএব এখন থেকে ভিন্ন কাজ করতে হবে।’ কিন্তু সেটা কীভাবে?
তারা সিদ্ধান্ত নিলো, পৃথিবিতে কুরআনের কপি থাকবে বটে, তবে কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে পরিবর্তণ করতে হবে। এজন্য তারা সকল তাফসীরকে সমাজ থেকে উঠিয়ে দিতে কিছু নামধারী মুসলিমদের কাজে লাগালো। তাদের টার্গেট হলো, যখন পুরাতন তাফসীরকে সমাজ থেকে বয়কট করা হবে, তখন সবাই নিজ ইচ্ছামত তাফসীর করবে ও তাদের সেই দালালরা যে ব্যাখ্যা দেবে, সেটাও তাদের অনুসারিরা মেনে আমল করবে। ফলে কুরআন থাকলেও কুরআনের সঠিক রুপ হারিয়ে যাবে এবং তারা তাদের মিশনে সফল হবে। এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে বাংলাদেশে তাদের মূখপাত্র হিশাবে কাজ করছে কয়েকটি সংগঠন। যেমন ‘আহলে কুরআন’ QRF (কুরআন রিচার্জ ফাউণ্ডেশন) আরেকটা হলো, হেযবুত তওহীদ। এরা পরিচয়ে মুসলিম হলেও আদতে ইসলাম বিদ্বেষীদের গোপন দালাল। তাদের উদ্দেশ্য কী তা উপরে বর্ণনা করেছি। সুতরাং হেযবুত তওহীদের এহেন জঘন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ থেকে আমাদের বিরত থাকা ঈমানী দায়িত্ব।