প্রিয় পাঠক, আমি আগাগোড়াই বলে আসছি, হেযবুত তওহীদ একটি ভ্রান্ত দল। তাদের এ ভ্রান্তির পেছনে ইসলাম বিদ্বেষীরা মূল মিশন বাস্তবায়ণ করছে। মূলত ইসলাম বিদ্বেষীদের মিশন বাস্তবায়ণ করতে তারা কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করেছে খেয়ে না খেয়ে। এর একটি প্রমাণ হলো, উম্মতে মুহাম্মাদীর বয়সসীমা নিয়ে। আগে চলুন তাদের দাবিটা দেখা যাক।
হেযবুত তাওহীদ কি বলে?
‘প্রকৃত এসলাম হারিয়ে গেছে রসুলুল্লাহর ৬০/৭০ বছর পরেই।’
সূত্র: আসুন সিস্টেমটাকেই পাল্টাই পৃ:১১
মহানবী ভবিষ্যদ্বাণী কোরেছেন –আমার উম্মাহর আয়ূ ৬০/৭০ বছর (হাদিস –আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে তিরমিযি ও ইবনে মাযাহ, মেশকাত) অর্থাৎ তাঁর উম্মাহ পৃথিবীতে থাকবে ৬০/৭০ বছর, তারপর যেটা হবে সেটা নামে মাত্র উম্মতে মোহাম্মদী, সেটা প্রকৃত পক্ষে উম্মতে মোহাম্মদী নয়।
সূত্র: এসলামের প্রকৃত রূপরেখা, পৃ. ৪৯
উক্ত হাদিসটির ভুলভাল ব্যাখ্যা করে তারা জনসাধারণকে বুঝাতে চায় যে, নবীজি সা. সঠিক ইসলাম ধারণকারী উম্মত টিকে থাকবে ৬০/৭০ বছর। আসলে কি তাই?
ইসলাম কি বলে?
এ ব্যাপারে পুরো বিষয়টি বুঝতে হলে, আগে হাদিসটি দেখা যাক। হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
عُمُرُ أُمَّتِي مِنْ سِتِّينَ سَنَةً إِلَى سَبْعِينَ سَنَةً
অর্থাৎ আমার উম্মতের বয়স হল ষাট থেকে সত্তর বছর পর্যন্ত।
সূত্র: জামে তিরমিযি,,হাদীস: ২৩৩১
পন্নী সাহেব যেহেতু আরবী জানতেন না, এজন্য এই হাদিসটি বুঝতে তিনি মারাত্মক ভুল করেছেন। কারণ হাদিসটির মূল বিষয় হলো, উম্মতে মুহাম্মাদীর বয়সসীমা নিয়ে। অর্থাৎ সাধারণভাবে এই উম্মতের লোকদের আয়ুষ্কাল হবে তাদের জীবনের ষাট ও সত্তর দশকের সীমায়। এ ব্যাখ্যাটাই ১৪০০ বছর যাবৎ সমস্ত মুসলিম বুঝে আসছেন। কিন্তু আরবীতে অজ্ঞ পন্নী সাহেব বুঝালেন ভিন্ন কথা। যদি পন্নী সাহেবের এ দাবি সত্যই হয় যে, ‘নবীজির সা. উম্মাহ পৃথিবীতে থাকবে ৬০/৭০ বছর, তারপর যেটা হবে সেটা নামে মাত্র উম্মতে মোহাম্মদী, সেটা প্রকৃত পক্ষে উম্মতে মোহাম্মদী নয়।’ তাহলে অসংখ্য হাদিস মিথ্যা বলতে হবে। কারণ-
এক.
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন,
خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ يَجِيءُ أَقْوَامٌ تَسْبِقُ شَهَادَةُ أَحَدِهِمْ يَمِينَهُ وَيَمِينُهُ شَهَادَتَهُ
অর্থাৎ আমার যুগের লোকেরাই হচ্ছে সর্বোত্তম লোক, এরপর যারা তাদের নিকটবর্তী, এরপর যারা তাদের নিকটবর্তী যুগের। এরপরে এমন সব লোক আসবে যারা কসম করার আগেই সাক্ষ্য দিবে, আবার সাক্ষ্য দেওয়ার আগে কসম করে বসবে।
সূত্র: সহিহ বুখারী, হাদিস: ২৬৫২
ইমাম নববী রহি. বলেন,
والصحيح أن قرنه صلى الله عليه وسلم الصحابة والثاني التابعون والثالث تابعوهم
সূত্র: আল মিনহাজ (শরহে মুসলিম লিননববী) খ. ১৬ পৃ. ৮৫
সাহাবাদের যুগ, তাবেয়ীনদের যুগ, তাবে তাবেয়ীনদের যুগ
উক্ত হাদিসে বর্ণিত ৩ যুগের সময়কাল হিসাব করলে অন্তত দেড়’শ বছর হবে। তাহলে নবীজির সা. সত্যিকারের উম্মত থাকবে ৬০/৭০ বছর এ কথাটা কি এ হাদিসের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক নয়?
দুই.
নবীজি সা. বলেন,
لاَ تَزَالُ عِصَابَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ عَلَى مَنْ نَاوَأَهُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
অর্থ: মুসলমানদের একটি দল সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে লড়াই করবে। যারা তাদের প্রতি বিরূপ ভাব পোষণ করবে তাদের বিরুদ্ধে থাকবে, তারা তাদের উপর বিজয়ী থাকবে। কিয়ামত অবধি এভাবে চলতে থাকবে।
সূত্র: সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১০৩৭
অপর হাদিসে এসেছে, জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি,
لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ قَالَ فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ صلى الله عليه وسلم
অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মাতের একদল হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়তে থাকবে এবং অবশেষে ঈসা (আলাইহিস সালাম) অবতরণ করবেন।
সূত্র: সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৯২
এ সংক্রান্ত অসংখ্য হাদিস রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, কিয়ামতের আগ পর্যন্ত একদল লোক সত্যের উপর থাকবে। সুতরাং সত্যিকারের উম্মতে মুহাম্মাদী যদি নবীজির সা. ইন্তেকালের পর মাত্র ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত জিবিত থাকেন আর এর পর সবাই যদি নামের উম্মত হয়, তাহলে নবীজির ভাষ্য অনুযায়ী এই বিজয়ী দলটিও কি তাহলে উম্মতে মুহাম্মাদী নয়?
সাহাবায়ে কেরামও রা. কি উম্মতে মুহাম্মাদী নন?
হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, সাহাবায়ে কেরামই রা. মূলত উম্মতে মুহাম্মাদী। তারা লিখেছেন,
‘সাহাবায়ে কেরামই উম্মতে মোহাম্মদী।’
সূত্র: আকীদা পৃ:৮ প্রিয় দেশবাসী পৃ:৮৮
তাহলে বুঝতে পারলাম সাহাবায়ে কেরামই রা. উম্মতে মুহাম্মাদী। অথচ নবীজির সা. ইন্তেকালের পর ৬০/৭০ বছর পরও কিন্তু অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম রা. বেঁচে ছিলেন। যেমন হযরত আনাস রা. ৯৩ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। হযরত আবু তুফায়েল আমের ইবনে ওয়াসিলা রা. ইন্তেকাল করেছেন ১১০ হিজরীতে। হযরত ওয়াহাব ইবনে জারীর রহি. বলেন,
سمعت أبي يقول كنت بمكة سنة عشر ومائة فرأيت جنازة فسألت عنها فقالوا هذا أبو الطفيل
অর্থাৎ আমি আমার বাবাকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, আমি মক্কায় ১১০ হিজরীতে একটি জানাজা দেখলাম দেখলাম। অতপর তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে লোকেরা বললো, তিনি সাহাবূ আবু তুফায়েল।
সূত্র: তাদরীবুর রাবী খ. ১ পৃ. ১৩১
তাহলে বুঝতে পারলাম, ১১০ হিজরীতেও নবীজির সা. সাহাবী আবু তুফায়েল আমের ইবনে ওয়াসিলা রা. বেঁচে ছিলেন। এভাবে অসংখ্য সাহাবীদের নাম বলা যাবে, যাঁরা নবীজির সা. ইন্তেকালের ৬০/৭০ বছর পরও বেঁচে ছিলেন। তাহলে তাঁরাও কি উম্মতে মুহাম্মাদী ছিলেন না? আসলে একটা হাদিসের অপব্যাখ্যার কারণে কত হাদিসকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে হচ্ছে, কত সাহাবীকে বেঈমান বানানো হয়েছে। নাউযুবিল্লাহ।
শুধু কি তাই? যদি তাদের কথা সত্য মানতে হয়, তাহলে ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহি. এর হাদিসগ্রন্থও তো মানা যাবে না।
বাংলায় একটা প্রবাদ বাক্য আছে, ‘কারো জন্য গর্ত খুঁড়লে নিজেও সেখানে পড়তে হয়’ ‘উপরে থুথু ফেললে নিজের মুখে আগে পড়ে’ এটাই হয়েছে হেযবুত তওহীদের বেলায়ও। কারণ নবীজির সা. ইন্তেকালের পর যদি কেউ উম্মতে মুহাম্মাদী না থাকে, তাহলে হেযবুত তওহীদও তো তাহলে উম্মতে মুহাম্মাদী নয়। কারণ হেযবুত তওহীদের জন্ম হয়েছে নবীজির সা. ইন্তেকালের ১৪০০ বছর পর ১৯৯৫ সালে। তাহলে তাদের কথায় প্রমাণ হলো, তারাও উম্মতে মুহাম্মাদী নয়।