রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মহান আল্লাহ নিজেই পবিত্র কুরআন দিয়ে বিচার করতে বলেছেন এবং তিনিও সদাসর্বদা কুরআন দিয়েই বিচার করতেন।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো,
মহানবী মোহাম্মদ (দ:) যখন মদীনায় রাষ্ট্রগঠন করলেন তিনি ইহুদি বা খ্রিস্টানদের উপর কোর’আনের বিধি-বিধান চাপিয়ে দেন নি। এবং ইহুদিরাও আল্লাহর রসুলকে শাসক হিসাবে মেনে নিলেও বিচারক হিসাবে মেনে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আল্লাহর রসুলও তাদেরকে তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী তওরাতের বিধান দিয়েই বিচার করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তওরাতে যে বিধান দিয়েছেন, সেই বিধান যদি ইহুদিরা মান্য করে সেটাই যথেষ্ট। বরঞ্চ আল্লাহ সেদিকেই তাদেরকে আহ্বান করেছেন, কোর’আন মানতে হুকুম করেন নি। কারণ তওরাতও আল্লাহরই হুকুম। -হেযবুত তওহীদের ওয়েবসাইটে ‘আল্লাহর পছন্দনীয় ধর্ম কোনটি’? শিরোনামে লেখা প্রবন্ধ।
ইসলাম কী বলে?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-সদাসর্বদা পবিত্র কুরআন দিয়ে বিচার কার্যত্রম চালাতেন। মহান আল্লাহপাক তাঁকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ وَلا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا
নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি সত্য-সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছি, যাতে আল্লাহ তোমাকে যে উপলব্ধি দিয়েছেন, সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে মীমাংসা করতে পারো। আর তুমি খেয়ানতকারীদের পক্ষাবলম্বনকারী হয়ো না। -সুরা নিসা : ১০৫
যেখানে কুরআন দিয়ে বিচার করার দায়িত্ব খোদ আল্লাহপাক তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে নির্দেশ দিয়েছেন, এরপরও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ইহুদীদের বিচার তওরাত দিয়ে করেছেন? এটা শয়তানেও বিশ্বাস করবে? ভালোভাবে বুঝার জন্য হাদিসে বর্ণিত নিন্মোক্ত ঘটনাটি দেখুন-
أن عمر بن الخطاب أتى النبي صلى الله عليه و سلم بكتاب أصابه من بعض أهل الكتاب فقال يا رسول الله إني أصبت كتابا حسنا من بعض أهل الكتاب قال فغضب وقال امتهوكون فيها يا بن الخطاب فوالذي نفسي بيده لقد جئتكم بها بيضاء نقية لا تسألوهم عن شيء فيخبروكم بحق فتكذبوا به أو بباطل فتصدقوا به والذي نفسي بيده لو كان موسى حيا ما وسعه إلا أن يتبعني
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. নবিজি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খেদমতে কোনো এক আহলে কিতাব (ইহুদীদের) থেকে একটি কিতাব নিয়ে আসলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি একজন আহলে কিতাব থেকে একটি সুন্দর কিতাব পেয়েছি। বর্ণনাকারী বলেন, নবিজি (হযরত উমর রা. এই কিতাব দেখে) রাগান্বিত হয়ে গেলেন এবং বললেন, হে উমর ইবনে খাত্তাব, তোমরা কী তাতে হয়রান হয়ে পড়েছো? যাঁর কুদরতি হাতে আমার প্রাণ তার কসম! নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল দীন নিয়ে এসেছি। তাদেরকে কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। তাহলে তারা সত্য সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করবে, আর তোমরা তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। অথবা মিথ্যা সম্পর্কে অবহিত করবে, আর তোমরা তা সত্য বলে মেনে নেবে। যেই সত্ত্বার হাতে আমার প্রাণ, সেই যাতের কসম! যদি হযরত মুসা আ. জিবিত থাকতেন, তাহলে তাঁর পক্ষেও আমার দীনের অনুসরণ ব্যতীত আর কোনো সুযোগ থাকতো না। -মুসনাদে আহমাদ : হাদিস নং : ১৫১৫৬
এই হাদিসের আলোকে বুঝা গেলো, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-অন্য ধর্মের কিতাব দেখে রাগান্বিত হয়েছেন। হাদিসের শেষে একথাও তিনি বলেছেন, হযরত মুসা আ. যদি জিবিত থাকতেন, তাহলে তার জন্যও আমার ধর্মের অনুসরন করা ব্যতীত অন্য কোনো সুযোগ থাকতো না।
পাশাপাশি হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন,
لا تسألوا أهلَ الكتابِ عن شيءٍ فإنهم لن يهدوكم وقد ضلُّوا
তোমরা আহলে কিতাবদের কাছে কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। কারণ তারা তোমাদের সঠিক তথ্য দিতে পারবে না। তারা নিজেরাই তো পথভ্রষ্ট। -মাজমাউয যাওয়ায়েদ : খ. ১ পৃ. ১৭৯
এসব হাদিস থাকার পরও কী এটা বলা যায় যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওরাত দিয়ে বিচার করতেন? এটা কী নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আল্লাহ-র অবাধ্য হিশাবে আখ্যায়িত করার নামান্তর নয়?
অভিযোগ:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ الْيَهُوْدَ جَاءُوْا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرُوْا لَهُ أَنَّ رَجُلًا مِنْهُمْ وَامْرَأَةً زَنَيَا فَقَالَ لَهُمْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَا تَجِدُوْنَ فِي التَّوْرَاةِ فِيْ شَأْنِ الرَّجْمِ فَقَالُوْا نَفْضَحُهُمْ وَيُجْلَدُوْنَ فَقَالَ عَبْدُ اللهِ بْنُ سَلَامٍ كَذَبْتُمْ إِنَّ فِيْهَا الرَّجْمَ فَأَتَوْا بِالتَّوْرَاةِ فَنَشَرُوْهَا فَوَضَعَ أَحَدُهُمْ يَدَهُ عَلَى آيَةِ الرَّجْمِ فَقَرَأَ مَا قَبْلَهَا وَمَا بَعْدَهَا فَقَالَ لَهُ عَبْدُ اللهِ بْنُ سَلَامٍ ارْفَعْ يَدَكَ فَرَفَعَ يَدَهُ فَإِذَا فِيْهَا آيَةُ الرَّجْمِ فَقَالُوْا صَدَقَ يَا مُحَمَّدُ فِيْهَا آيَةُ الرَّجْمِ فَأَمَرَ بِهِمَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَرُجِمَا قَالَ عَبْدُ اللهِ فَرَأَيْتُ الرَّجُلَ يَجْنَأُ عَلَى الْمَرْأَةِ يَقِيْهَا الْحِجَارَةَ
ইয়াহুদীরা আল্লাহ-র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে এসে বললো, তাদের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা ব্যভিচার করেছে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা সম্পর্কে তাওরাতে কী বিধান পেয়েছো? তারা বলল, আমরা এদেরকে অপমানিত করবো এবং তাদের বেত্রাঘাত করা হবে। আবদুল্লাহ ইবনু সালাম রা. বললেন, তোমরা মিথ্যা বলছো। তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার বিধান রয়েছে। তারা তাওরাত নিয়ে এসে বাহির করলো এবং প্রস্তর হত্যা করা সম্পর্কীয় আয়াতের উপর হাত রেখে তার আগের ও পরের আয়াতগুলি পাঠ করলো। আবদুল্লাহ ইবনু সালাম রা. বললেন, তোমার হাত সরাও। সে হাত সরালো। তখন দেখা গেলো, প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করার আয়াত আছে। তখন ইয়াহুদীরা বললো, হে মুহাম্মাদ! তিনি সত্যই বলছেন। তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার আয়াতই আছে। তখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্তর নিক্ষেপে দু’জনকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। আবদুল্লাহ রা. বলেন, আমি ঐ পুরুষটিকে মেয়েটির দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখেছি। সে মেয়েটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। -সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৩৬৩৫
উক্ত হাদিসটা উল্লেখ্য করে হেযবুত তওহীদ বুঝাতে চায়, ইহুদীদেরকে তাওরাতের বিধান দিয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার করেছেন।
জবাব:
উপরিউক্ত ঘটনায় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধুমাত্র ইহুদীদেরকে বিবাহিত ব্যাভিচারীদের ব্যাপারে আল্লাহর বিধান রজম তথা পাথর মেরে হত্যা করা হবে, এটা স্বরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তাওরাত অনুযায়ী বিচার করেননি। কারণ ইসলামী আইনেও বিবাহিত ব্যাভিচারীদের ব্যাপারে রজমের হুকুম বিদ্যমান ছিলো। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الشيخُ والشيخةُ إذا زَنَيا فارْجُموهُما البَتَّةَ
বিবাহিত ও বিবাহিতা যদি যিনা-ব্যভীচারে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের উভয়কে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলো। -মুসনাদে আহমাদ : হাদিস নং : ২১৫৯৬
সুতরাং এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও ইসলামের বাহিরে গিয়ে অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ দিয়ে তিনি বিচার করেননি। সুতরাং যে ধর্মগ্রন্থগুলো বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো এখনও পালন করা যাবে, এটা নিছক মূর্খতা ও ইসলাম অবমাননার শামিল। এসব বক্তব্য দিয়ে মূলত তারা জাতিকে বেঈমান বানানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত।