পুরুষের মুখে দাঁড়ি ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গুরুত্বটা এতটাই বেশি যে, দাঁড়ি না রাখা , মুন্ডিয়ে ফেলা বা এক মুষ্ঠির কম রাখা হারাম ও কবীরা গুনাহ ঘোষণা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি দাঁড়ি মুন্ডায় বা এক মুঠের চেয়েও ছোট করে ফেলে, তার আমল নামায় পুনরায় দাঁড়ি এক মুঠ পরিমাণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কবীরা গুনাহ লেখা হতে থাকে। কেননা শরীয়তের হুকুম হল, দাঁড়ি কমপক্ষে এক মুঠ পরিমাণ রাখা। তাই এর চেয়ে দাঁড়ি ছোট করে ফেললে বা মুন্ডিয়ে ফেললে যতক্ষন পর্যন্ত সে দাঁড়ি এক মুঠ পরিমাণ না হবে, ততক্ষন পর্যন্ত সে শরীয়তের হুকুম অমান্যকারী সাব্যস্ত হবে এবং তার নামে গুনাহ লেখা হতে থাকবে । অন্যান্য গুনাহ সাময়িক ও অস্থায়ী, কিন্তু দাঁড়ি মুন্ডানো এমন কবীরা গুনাহ যা ছোট করা বা মুন্ডানোর ফলে গুনাহ চলমান থাকে। সুতরাং যে ব্যক্তি দাঁড়ি মুন্ডায় বা এক মুঠের চেয়ে ছোট করে, সে ফাসিক। কিন্তু সময়ে অন্যতম কুফরী মতবাদ হেযবুত তওহীদ এই দাঁড়ি সম্পর্কে এমন আক্বীদা পোষণ করেন যে, দাঁড়ি ইসলামের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই না। চলুন হেযবুত তওহীদ কি বলে আহে সেটা দেখে নেও য়া যাক।
হেযবুত তওহীদের দাবি:
হেযবুত তওহীদের কয়েকটি বক্তব্য নিন্মে পেশ করা হলো,
এক.
‘দাঁড়ির সাথে ইসলামের কোন সম্পর্কই নেই। এটা মূলত মক্কার কাফের পৌত্তলিকদের প্রথা যা অমুসলিম,নাস্তিকরাও রাখে। নবিজি স: নিজেও দাঁড়ি ছাটতেন। মূলত দাড়ির গুরুত্ব এসেছে জাল হাদিসের মাধ্যমে। এখন মানুষকে বলতে হবে “দাড়ির কথা বাদ দিন।’
সূত্র: এসলাম শুধু নাম থাকবে পৃ:১৩১/১৩৬/১৩৭ ধর্মব্যবসার ফাঁদে পৃ:১৩১ প্রিয় দেশবাসী পৃ:১১৩
দুই.
‘অনেকের ধারণামতে যে দাড়ি ছাড়া ইসলামই হয় না, সেই দাড়ি তো আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতাকারী, ঘৃণিত কাফের বোলে আমাদের নিকট পরিচিত আবু জেহেল, আবু লাহাব, ওতবা,শায়েবার মুখেও ছিল। তারাও জোব্বা পোরত, ঠিক রসুল যে জোব্বা পোরতেন ঠিক একই ধরনের জোব্বা। প্রকৃতপক্ষে দাড়ি, টুপি, পাগড়ী, জোব্বার সাথে এসলামের কোন সম্পর্ক নাই। প্রকৃতির আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থার সাথে এগুলো সম্পর্ক রয়েছে। টুপি তো ইহুদীরা,শিখরা বা অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুরাও পরেন, তাদেরও দাঁড়ি আছে, তারাও জোব্বা পড়েন, তাদের অনেকেই পাগড়ী পরেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাড়ি-টুপি, জোব্বা সবই ছিল। শুধু ধর্মীয় সাধু-সন্ন্যাসী নয়, আল্লাহর অস্তিত্বে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী হিসাবে পরিচিত অনেকেরই দাড়ি ছিল যেমন কার্ল মার্কস, চার্লস ডারউইন,আব্রাহাম লিঙ্কন প্রমুখ।
সূত্র: এসলাম শুধু নাম থাকবে পৃ:১৩১
সূত্র: আকীদা-১৭ প্রিয় দেশবাসী পৃ:৯৮
তিন.
‘কথিত আছে পরবর্তীকালে যখন উমাইয়া রাজতন্ত্র চালু হয়, তখন দাড়িকে ইসলামের চিহ্ন বলে এবং রসুলের সুন্নাহ বলে চালু করা হয়। এ কাজে ইয়াজিদের দরবারে পালিত ভাড়াটে আলেমদের বেশ অবদান রয়েছে। ইয়াজিদের বেশ লম্বা দাড়ি ছিল, দাড়ি ছিল তার পিতা মুয়াবিয়ার রা: পিতা আবু সুফিয়ানেরও লম্বা দাড়ি ছিল এবং দাড়ি ছিল তাদেরই পূর্বপুরুষদের অভিজাত বা ঐতিহ্য।সুতরাং সে ঐতিহ্য যেন একেবারেই সমাজ থেকে মুছে না যায়, সেটারই আজীবন মেয়াদে কঠোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল জাল হাদিসের দাড়ির গগণস্পর্শি গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যম।’
সূত্র: ধর্মব্যবসার ফাঁদে পৃ:১৩১
চার.
‘ইসলামের বিশেষজ্ঞরা কোরআন হাদিস নিয়ে গবেষণা করে বের করেছেন যে সালাতের বাইরে শর্তমূলক ৭ ফরদ ভিতরে ৭ ফরদ (রোকন)।২১ টি ওয়াজিব ২১ টি সুন্নাত, ৭ টি। মুস্তাহাব এর মধ্যে দাড়ি-টুপি, জোব্বা, পাগড়ী ইত্যাদি কোন একটি বিষয়ে কোন উল্লেখ্য নেই।’
সূত্র: ধর্মব্যবসার ফাঁদে পৃ:১৩৫
পাঁচ.
‘আদিকাল থেকে দাড়ি মানুষের পৌরুষ ও সৌন্দর্যের প্রতিক হোয়ে আছে। সিংহের যেমন কেশর,ময়ূরের যেমন লেজ,হাতির যেমন দাত,হরিণের যেমন সিং, তেমনি দাড়ি মানুষের প্রাকৃতিক পৌরুষ সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য নষ্ট না করার উদ্দেশ্যেই দাড়ি রাখার নির্দেশ।’
সূত্র: এসলাম শুধু নাম থাকবে পৃ:১৩৬
ছয়.
‘আল্লাহ ও রসূলের উপর দৃঢ় বিশ্বাস ঈমান থাকা সত্ত্বেও আকিদার বিকৃতির ফলে কার্যতঃ শেরক ও কুফরের মধ্যে নিমজ্জিত জাতিকে মনে করিয়ে দিতে হবে দাঁড়ি, মোচ, পাজামা নফল এবাদতের কথা বাদ দিন।’
সূত্র: প্রিয় দেশবাসী পৃ:১১৩
ছয়.
‘বিশ্বনবী তার নিজের জাতিকে নির্দেশ দিলেন আমার এই দ্বীনের সন্ন্যাস বৈরাগ্য নেই।তোমরা ওইসব সংসার থেকে সন্ন্যাসীদের বিপরীত করবে অর্থাৎ দাড়ি ও।মোচ রাখবে এবং ইহুদীদের বিপরীত করবে অর্থাৎ দাড়ি ও মোচ ছেটে ছোট করে রাখবে। জাতিকে সুন্দর দেখানোর শেখানোর জন্য মহানবী নিজে পরিস্কার সুন্দর কাপড় পোরতেন, দাঁড়ি মোচ সুন্দর করে ছেটে রাখতেন। তিনি সফরে গেলেও তার সঙ্গে কাচি, চিরুনি ও আয়না থাকতো।’
সূত্র: এসলাম শুধু নাম থাকবে পৃ:১৩৭
সাত.
‘যে জাতি এখনো দাড়ি এক মুষ্টি হবে না বড় হবে টাখনু কতটুকু দেখা যাবে নবী নূরের তৈরী না মাটির তৈরী তা নিয়ে বিতর্ক করে ঝগড়া করে তাদের কাছে মানবজাতি কি আশা করবে।’
সূত্র: ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে পৃ:২৬
প্রিয় পাঠক, হেযবুত তওহীদের উপরোক্ত বক্তব্যগুলোর সারাংশ দাবি হলো, ১. দাঁড়ির সাথে ইসলামেে সম্পর্ক নেই। ২. দাঁড়ি অমুসলিমদেরও কালচার। ৩. ইসলামে দাঁড়ি জাল হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, এ ব্যাপারে কোনো সহিহ প্রমাণ নেই। ৪. দাঁড়ি মূলত অনর্থক একটি ব্যাপার, যা বাদ দিতে জাতিকে উৎসাহ দিতে হবে। নাউযুবিল্লাহ।
উপরোক্ত বক্তব্যগুলো থেকে জানতে পারলাম, দাঁড়ির প্রতি হেযবুত তওহীদের যথেষ্ট অনীহা এবং বিদ্বেষ রয়েছে। তা না থাকলে এত এত জঘন্যতম কথা কিভাবে বলতে পারে? সুতরাং চলুন, দাঁড়ি সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী সেটা তেখে যাক।
ইসলাম কি বলে:
দাঁড়ি মুসলিমদের ধর্মীয় সংস্কৃতি। যা মুসলিম হিসাবে কাউকে চেনার প্রাথমিক একটি চিহ্ন। এই দাঁড়িকে নিয়ে বাতিলদের ভেতর অনেক বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি দেখা যায়। এ সম্পর্কে এ পর্বে আলোচনা করবো। ইনশাআল্লাহ। এর আগে দাঁড়ি কাকে বলে এ বিষয়ে জানা দরকার।
দাঁড়ির সংজ্ঞা:
ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহ. বলেছেন, পরিভাষায় দাড়ি বলা হয়
الشعر النابت على الخدين من عذار وعارض والذقن
অর্থ: যা উভয় গাল, কানপট্টির উপর,গালের সামনের অংশ,এবং থুতনি সবকিছুকেই মূলত দাঁড়ি বলা হয়ে থাকে।
সূত্র: রদ্দুল মুহতার খ. ১ পৃ. ২১৫
দাঁড়ি না রাখা , মুন্ডিয়ে ফেলা বা এক মুষ্ঠির কম রাখা হারাম ও কবীরা গুনাহ। যে দাঁড়ি মুন্ডায় বা এক মুঠের চেয়েও ছোট করে ফেলে, তার আমল নামায় পুনরায় দাঁড়ি এক মুঠ পরিমাণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কবীরা গুনাহ লেখা হতে থাকে। কেননা শরীয়তের হুকুম হল, দাঁড়ি কমপক্ষে এক মুঠ পরিমাণ রাখা। তাই এর চেয়ে দাঁড়ি ছোট করে ফেললে বা মুন্ডিয়ে ফেললে যতক্ষন পর্যন্ত সে দাঁড়ি এক মুঠ পরিমাণ না হবে, ততক্ষন পর্যন্ত সে শরীয়তের হুকুম অমান্যকারী সাব্যস্ত হবে এবং তার নামে গুনাহ লেখা হতে থাকবে । অন্যান্য গুনাহ সাময়িক ও অস্থায়ী, কিন্তু দাঁড়ি মুন্ডানো এমন কবীরা গুনাহ যা ছোট করা বা মুন্ডানোর ফলে গুনাহ চলমান থাকে। সুতরাং যে ব্যক্তি দাঁড়ি মুন্ডায় বা এক মুঠের চেয়ে ছোট করে, সে ফাসিক।
দাঁড়ি সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে নববীতে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। কয়েকটি দলীল নিচে পেশ করা হলো-
কুরআন শরীফের আয়াত থেকে দলীল
এক.
দাঁড়ি কামানো আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন করার নামান্তর:
শরীরে এমন কোনো কাজ করা জায়েয নেই, যা আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন বয়ে আনে। যেমন ভ্রুপ্লাক করা ইত্যাদী। তবে যেসকল বিষয়ে আয়াত-হাদিসের মাধ্যমে অঙ্গের কোনো অংশ কাটার কথা এসেছে সেগুলো জায়েয। যেমন, নক কাটা, চুল কাটা ইত্যাদী। বাকি সকল ক্ষেত্রে মানুষকে আল্লাহ তা’আলা যেভাবে সৃষ্টি করেছেন, ঠিক সেভাবে থাকা হলো, আল্লাহর চাওয়া। কারণ বিতাড়িত শয়তান আল্লাহর সাথে চ্যালেঞ্জ করার সময় বলেছিলো,
وَلآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللّهِ وَمَن يَتَّخِذِ الشَّيْطَانَ وَلِيًّا مِّن دُونِ اللّهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِينًا
অর্থ: এবং তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ দেব। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়।
সুরাঃ আলে ইমরান আয়াত: ১১৯
উক্ত আয়াত দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম যে, শয়তানের বড় টার্গেট হলো, আল্লাহর সৃষ্টির নমুনা যেন মানুষ পাল্টে ফেলে সেটাই শয়তানের চ্যালেঞ্জে সফলতার জন্য বড় পাওয়া। একারনেই ভ্রুপ্লাক করা, উল্কি অঙ্কণ করা ইত্যাদীর মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টির নমুনা পরিবর্তন করা ইসলামে হারাম করা হয়েছে। এজন্য উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা কুরতুবী রহ. বলেন,
وَكَذَا لَا يَجُوزُ لَهَا حَلْقُ لِحْيَةٍ أَوْ شَارِبٍ أَوْ عَنْفَقَةٍ إِنْ نَبَتَتْ لَهَا لِأَنَّ كُلَّ ذَلِكَ تَغْيِيرُ خَلْقِ اللَّهِ
অর্থাৎ দাঁড়ি, মোচ এবং ঠোটের নিচের পশম গজালে তা মুণ্ডন করা জায়েয হবে না। কারণ এটা আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তনের অন্তুর্ভূক্ত।
সূত্র: তাফসীরে কুরতুবী খ. ৩ পৃ. ২৫২
দুই.
দাঁড়ি কামানো অঙ্গহানীর নামান্তর:
উপরন্তু শরীরের যেকোনো অঙ্গহানি করা ইসলামে পপরিস্কার হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থ: আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।
সুরাঃ রুম, আয়াত: ৩০
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর রহ. বলেন,
قَالَ بَعْضُهُمْ مَعْنَاهُ لَا تُبَدِّلُوا خَلْقَ اللَّهِ
অর্থাৎ কেউ কেউ বলেন, এ আয়াতের অর্থ হলো, তোমরা আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তন করো না।
সূত্র: তাফসীরে ইবনে কাসীর খ. ১১ পৃ. ২৬
অর্থাৎ আয়াতটি থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, “আল্লাহর কোনো সৃষ্টি পরিবর্তন করা তথা অঙ্গহানি করা জায়েয নয়”। এজন্য হাদিসের মধ্যে এসেছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ইয়াযীদ আনসারী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন
نَهَى النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَنْ النُّهْبَى وَالْمُثْلَةِ
অর্থ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লুটতরাজ করতে এবং জীবকে বিকলাঙ্গ বা অঙ্গহানি করতে নিষেধ করেছেন।
সূত্র: সহিহ বুখারী হাদিস: ২৪৭৪
আরও স্পষ্টরুপে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত নবীজি সা. বলেছেন,
مَن مثَّل بالشِّعرِ فليس له عندَ اللهِ خَلاقٌ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি চুল মারফত অঙ্গহানি করবে, তার জন্য আল্লাহর কাছে কোনো প্রতিদান থাকবে না।
সূত্র: মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ. ৮ পৃ. ১২৪
দাঁড়ি মুণ্ডানো কি অঙ্গহানি?
এ সম্পর্কে আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর রহমান আল-মাগরিবী রহ. বলেন,
حلق اللحية لا يجوز وكذلك الشارب وهو مثلة وبدعة
অর্থ: দাঁড়ি মুণ্ডানো জায়েয নয়, এমনিভাবে মোচ মুণ্ডানো। কারণ এটা অঙ্গহানি এবং বিদ’আত।
সূত্র: মাওয়াহেবুল জলিল খ. ১ পৃ. ৩১৩
সুতরাং বুঝা গেল, দাঁড়ি মুণ্ডানো যেহেতু অঙ্গহানি বা বিকলাঙ্গের মধ্যে অন্তুর্ভূক্ত, সেহেতু উক্ত আয়াতদ্বয়ের কারণে দাঁড়ি মুণ্ডানোর সুযোগ নেই।
হাদিস থেকে দলীল:
দাঁড়ি লম্বা রাখার ব্যাপারে সহিহ হাদিসে সুস্পষ্টভাবে আদেশ করা হয়েছে। নিন্মে কয়েকটি হাদিস পেশ করা হলো।
এক.
হাদিস শরীফে এসেছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
عَنِ النبيِّ ﷺ أنّه أمَرَ بإحْفاءِ الشَّوارِبِ وإعْفاءِ اللِّحْيَةِ
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে গোঁফ খাটো করতে এবং দাড়ি লম্বা করতে আদেশ করেছেন।
সূত্র: সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২৫৯
দুই.
অপর একটি হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قُصُّوا الشَّوَارِبَ وَأَعْفُوا اللِّحَى
অর্থাৎ হযরত আবু হুরায়রা রা. হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, ‘তোমরা গোঁফ অধিক ছোট করবে এবং দাড়ি ছেড়ে দিবে।
সূত্র: মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং- ৭১৩২
তিন.
দাঁড়ি মুণ্ডন করা অমুসলিমদের কালচার:
একটি হাদীছে এসেছে, হযরত আবু উমামা বাহিলী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা সাহাবায়ে কেরাম রা. একদা রাসুল সা. কে বললাম,
يا رسولَ اللهِ إنّ أهلَ الكِتابِ يَقُصُّونَ عَثانينَهم ويُوَفِّرونَ سِبالَهم قال فقال النَّبيُّ ﷺ قُصُّوا سِبالَكم ووَفِّروا عَثانينَكم وخالِفوا أهلَ الكتابِ
অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল সা. আহলে কিতাব তথা ইহুদী ও খৃষ্টানরা দাঁড়ি মুন্ডন করে এবং গোঁফ লম্বা করে। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা গোঁফসমূহ খাটো করে ফেল এবং দাঁড়িগুলো ছেড়ে দাও। আর (এভাবেও) আহলে কিতাবদের বিরোধিতা কর’।
সূত্র: মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং- ২২২৮৩
উক্ত হাদিসে অমুসলিমদের বিরোধীতা করার জন্য দাঁড়ি লম্বা করার কথা খোদ নবীজি সা. বলেছেন।
চার.
আরেকটি হাদিসে আরও সুস্পষ্টভাবে নবীজি সা. ঘোষণা দিয়ে বলেন,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم قَالَ خَالِفُوا الْمُشْرِكِينَ وَفِّرُوا اللِّحَى وَأَحْفُوا الشَّوَارِبَ
অর্থঃ ইবনু ‘উমার রা. সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, তোমরা মুশরিকদের উল্টো করবেঃ দাড়ি লম্বা রাখবে, গোঁফ ছোট করবে।
সূত্র: সহিহ বুখারী, হাদিস নং- ৫৮৯২
পাঁচ.
দীর্ঘ এক হাদিসে বর্ণিত আছে,
ودخلا على رسول الله صلى الله عليه وسلم وَقَدْ حَلَقَا لِحَاهُمَا وَأَعْفَيَا شَوَارِبَهُمَا فَكَرِهَ النَّظَرَ إليهما ثم أَقْبَلَ عَلَيْهِمَا فَقَالَ وَيْلَكُمَا مَنْ أَمَرَكُمَا بِهَذَا قَالا أَمَرَنَا بِهَذَا رَبُّنَا يَعْنِيَانِ كِسْرَى فَقَالَ رسول الله لَكِنَّ رَبِّي قَدْ أَمَرَنِي بِإِعْفَاءِ لِحْيَتِي وَقَصِّ شَارِبِي
অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে দু’জন (মুশরিক) আগমন করলেন, যাদের মোচ লম্বা এবং দাঁড়ি মুণ্ডানো ছিলো। নবীজি সা. তাদের দিকে তাকাতে অনীহা পেশ করে বললেন, ‘তোমরা ধ্বংশ হও! কে তোমাদেরকে এমনটা করতে বলেছে? তারা দু’জন বললেন, আমাদের প্রভূত কেসরার বাদশা। অতপর রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, কিন্তু আমার রব আমাকে দাঁড়ি লম্বা এবং মোচ ছোট করার আদেশ দিয়েছেন।
সূত্র: তারীখে তাবারী খ. ২ পৃ. ১৪৩
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত হাদিসগুলো ছাড়াও দাঁড়ি লম্বা রাখার নির্দেশ সংক্রান্ত অনেক সহিহ হাদিস বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
এক. إعفاء اللحى (ইফা) সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-১২২১
দুই. أعفوا اللحى (আ’ফু) সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৮৯৩
তিন. أَرْخُوا اللِّحَى (আরখু) সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬০
চার. أَوْفُوا اللِّحَى (আওফু) সহীহ মুসলিম হাদীস নং-২৫৯
পাঁচ. وَفِّرُوا اللِّحَى (ওয়াফ্ফিরু) সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৮৯২
ছয়. أوفِروا اللِّحى (আওফিরু) জামে সগীর, হাদিস নং- ৩৮৭৮
এ সকল হাদিসে দাঁড়ি লম্বা করার আদেশ করা হয়েছে। মূন্ডানোর নির্দেশ তো দূরের কথা অনুমতি সংক্রান্ত কোন জাল হাদীসও নেই। আরও দেখতে চাইলে দেখুন। সহিহ মুসলিম হাদিস নং- ২৫৯ আল মু’জামুল আওসাত (তাবরানী) খ. ৯ পৃ. ১৬২ বায়হাকী, হাদিস নং- ২৮৬৪ মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ. ৮ পৃ. ৪১ মুসনাদে আহমাদ,হাদিস নং- ৪৬৫৪ দাঁড়হী আওর ইসলাম (বাবুনগরী) পৃ. ২৮
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদিসসমূহ থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, দাঁড়ি মুণ্ডানো ইসলামের কোনভাবেই বৈধ নয়।
মাযহাবের অভিমত:
হানাফী
দাঁড়ি মুণ্ডানোর ব্যাপারে হানাফী মাযহাবের সুস্পষ্ট বক্তব্য কী এ ব্যাপারে হানাফী মাযহাবের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ইমাম শামী রহি. বলেন-
ويحرم على الرجل قطع لحيته
অর্থাৎ পুরুষের জন্য দাঁড়ি মুণ্ডানো হারাম।
সূত্র: রদ্দুল মুহতার, খ. ৯ পৃ. ৫৮৩
মালেকী
মালেকী মাযহাবের শায়েখ আদ-দুসুকী রহি. বলেন,
يحرم على الرجل حلق لحيته
অর্থাৎ পুরুষের জন্য দাঁড়ি মুণ্ডানো হারাম।
সূত্র: হাশিয়াতুদ দুসুকী খ. ১ পৃ. ১৫০
হাম্বলী:
হাম্বলী মাযহাবের প্রশিদ্ধ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহি. বলেন,
ويحرم حلق اللحية
অর্থাৎ দাঁড়ি মুণ্ডানো হারাম।
সূত্র: আল ফাতাওয়া আল কুবরা, খ. ৫ পৃ. ৩০২
শাফেয়ী:
এ ব্যাপারে শাফেয়ী মাযহাবের ফাতাওয়া খোদ ইমাম শাফেয়ী রহি. বলেন,
وهو وإن كان في اللحية لا يجوز
অর্থাৎ মুণ্ডানোর বিষয়টি যদি দাঁড়ির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, তাহলে সেটা তো জায়েযই নেই।
সূত্র: কিতাবুল উম্ম খ. ৭ পৃ. ২০৩
সালাফী:
সালাফী মাযহাবের অন্যতম মূখপাত্র বিন বায রহি. বলেন,
وليس لأحد من الناس الأخذ منها ولا حلقها ولا تقصيرها بل يجب إعفاؤها وتوفيرها وإرخاؤها عملاً بقول النبي
অর্থাৎ নবীজি সা. এর নির্দেশ মোতাবেক কোনো পুরুষের জন্য দাঁড়ি মুণ্ডানো, কাটা বা ছাটা জায়েয নেই বরং লম্বা করা ওয়াজিব।
সূত্র: নূরুন আলাদ্দারব খ. ১ পৃ. ৫৮৭
জাহেরী মাযহাব:
ইমাম দাউদ জাহিরি রহি. বলেন,
والمذهب الظاهري قال حلق اللحية حرام
অর্থাৎ জাহেরী মাযহাব হলো, দাঁড়ি মুণ্ডন করা হারাম।
সূত্র: আল-বুরহানুল মুবিন খ. ১ পৃ. ৪৬৫
ইজমায়ে উম্মাত:
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহি. বলেন,
ويُحرم حلق اللحية للأحاديث الصحيحة ولم يُبحه أحد
অর্থ: দাড়ি রাখার ব্যাপারে বিশুদ্ধ হাদীছ বর্ণিত হওয়ায় তা মুন্ডন করা হারাম। আর এটিকে কেউ বৈধ বলেননি’।
সূত্র: আল-বুরহানুল মুবিন খ. ১ পৃ. ৪৬৫
ইমাম ইবনে হাযেম রহি. বলেন,
وذلك محرم بالاجماع
অর্থাৎ এ দাঁড়ি সেভ করা সর্বোসম্মতক্রমে হারাম।
সূত্র: আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ খ. ১৪ পৃ. ২৭৪
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, দাঁড়ি মুণ্ডন করা ইসলামে পরিস্কার হারাম। কিন্তু এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত অংশ কাটা বা ছাটা বৈধ। নিন্মে এ সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হলো।
ইজমায়ে উম্মত:
এ ব্যাপারে উম্মতের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হলো-
وأما الأخذ منها وهي دون ذلك كما يفعله بعض المغاربة مُخَنَّثة الرجال فلم يبحه أحد
অর্থাৎ পশ্চিমা সভ্যতা ও হিজড়াদের মত এক মুষ্ঠি থেকে দাঁড়ি ছেটে ফেলাকে কেউ বৈধতা দেননি।
সূত্র: রদ্দুল মুহতার, খ. ৩ পৃ. ৩৯৮ বাহরুর রায়েক খ. ২ পৃ. ৪৯০ তাবয়ীনুল হাকায়েক খ. ২ পৃ. ১৮৭
সুপ্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম, অন্তত দাঁড়ি রাখা পুরুষের জন্য ওয়াজিব। একটি ওয়াজীব বিধানের প্রতি হেযবুত তওহীদের কতটা বিদ্বেষ! এটা কী ইসলাম বিকৃতির নামান্তর নয়? যাদের দাঁড়ি সম্পর্কে কনসেপ্ট এতটা জঘন্য তারা কিভাবে মুসলিম হয়? জবাব আশা করি পাঠক মহলই বের করবেন।