আল্লাহ মহান। যাঁর তুলনা তিনি নিজেই। তিনি সর্বদা সর্ববিষয়ে ক্ষমতাধর ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তাঁকে কেউ পরাস্ত করতে পারে না, কারণ তিনি হার-জিতেরও স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রণকারী।
হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, ইবলিস আল্লাহ-কে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলো, আল্লাহও তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ ইবলিসের চ্যালেঞ্জে হেরে গেছেন, আর ইবলিস জিতে আছে। দেখুন তারা কী লিখেছে,
ক. ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল :
আদমের (আ.) অর্থাৎ মানুষের দেহ নিজ হাতে তৈরি করে তার দেহের ভেতরে আল্লাহর নিজের রুহ, আত্মা থেকে ফুঁকে দিয়ে আল্লাহ মালায়েকদের আদেশ করলেন আদম অর্থাৎ মানুষকে সাজদা করতে (সুরা বাকারাহ ৩০, সুরা আ’রাফ ১১)। ইবলিস অস্বীকার করল ও আল্লাহকে বলল- আমরা মালায়েকরা বলেছিলাম তোমার এই নতুন সৃষ্টি এই আদম, তোমার এই খলিফা পৃথিবীতে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার আর যুদ্ধ, মারামারি, রক্তপাত করবে। আমাদের এই কথা যে সত্য তা প্রমাণ করে দেখাব। আল্লাহ ইবলিসের অর্থাৎ শয়তানের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন কারণ তাঁর খলিফা সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল তাই- পরীক্ষা করা যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিধর তাঁর খলিফা কোন পথে চলে তা দেখা। ইবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তিনি এই নতুন খেলার নিয়ম-কানুন, শর্ত ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে দিলেন। -তাকওয়া ও হেদায়াহ : পৃ. ৩
ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিল, ‘তোমার যে সৃষ্টির কারণে আমাকে বিতাড়িত ও অভিশপ্ত করলে,আমাকে যদি সেই সৃষ্টির দেহ-মনের মধ্যে ঢুকে প্ররোচনা দেবার শক্তি দাও, তাহলে আমি প্রমাণ করে দিব, ঐ সৃষ্টি তোমাকে ইলাহ বা হুকুমদাতা হিসেবে মানবে না। -তওহীদ জান্নাতের চাবি : পৃ. ৪
খ. আল্লাহ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন।
এই দীনের, জীবন-ব্যবস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য হোচ্ছে পৃথিবীতে সব রকম অন্যায়-অবিচার, শোষণ, অশান্তি, রক্তপাত বন্ধ কোরে শান্তি (এসলাম) প্রতিষ্ঠা করা। এটাই হোল আল্লাহর প্রতি এবলিসের চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ আল্লাহ গ্রহণ করেছেন। -শোষণের হাতিয়ার : পৃ. ৫৭
আল্লাহ ইবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে একদিকে তাকে তাঁর খলিফা মানবের দেহ-মনের মধ্যে প্রবেশ করে তাকে তওহীদ অর্থাৎ সেরাতুল মুস্তাকিম থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টার অনুমতি দিলেন। -এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৩৭
গ. হার-জিতের মানদণ্ড কী ছিলো?
মানবসৃষ্টির সূচনালগ্নে মহান আল্লাহর সঙ্গে ইবলিসের একটি চ্যালেঞ্জ হয়। সেই চ্যালেঞ্জটি বিষয়বস্তু ছিল মানবজাতি পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করবে, নাকি মারামারি কাটাকাটি হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাতে লিপ্ত থাকবে? মানুষ যদি শান্তিতে থাকে তাহলে চ্যালেঞ্জে আল্লাহ বিজয়ী হবেন, আর যদি অশান্তি অরাজকতার মধ্যে বাস করে তাহলে ইবলিস বিজয়ী হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ নবী রসুলদের মাধ্যমে জীবনবিধান পাঠালেন। সেটা মানুষের সামগ্রিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করলে সমাজে শান্তি আসবে। আর অন্য জীবনব্যবস্থা দিয়ে জীবন চালালে অশান্তি বিরাজ করবে। নবী-রাসুলগণ এভাবে আল্লাহকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৯৭-৯৮
তাই আল্লাহ মানুষকে বলেছেন- আমার সার্বভৌমত্ব মেনে নাও, আমিই বিশাল সৃষ্টির স্রষ্টা, তোমাদের দেহ ও মনেরও স্রষ্টা, তাই আমি জানি কেমন সংবিধান, আইন-কানুন, দ-বিধি মেনে চললে তোমরা ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমাহীন সমাজে বাস করতে পারবে, শান্তিতে (ইসলামে) বাস করতে পারবে । আর যদি আমারই দেয়া স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে আমার সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে নিজেরা সার্বভৌম হয়ে সংবিধান, আইন-কানুন ও দ-বিধি, অর্থনীতি তৈরি করে তাই মেনে চলো তবে ইবলিস যে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমায় তোমাদের ফেলবে বলেছিল তোমরা তাতেই পতিত হবে, তাহলে সে আমাকে যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল তাতে সে জয়ী হবে, আমি পরাজিত হবো । আমি সর্বশক্তিমান। -দাজ্জাল : পৃ. ১৬
আল্লাহ ও ইবলিশের এই চ্যালেঞ্জে মাঝখানটায় আছে মানবজাতি। মানুষের ইচ্ছা শক্তি তার পরীক্ষা। সে কোনদিকে যাবে সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে। সে আল্লাহকে জয়ী করবে নাকি ইবলিসকে? আল্লাহকে জয়ী করতে চাইলে আল্লাহর তওহীদের স্বীকৃতি দিতে হবে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করা চলবে না। যদি তওহীদ অস্বীকার করে অন্য কাউকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করা হয় অথবা অন্ততপক্ষে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরিক করা হয় তাহলেই ইবলিস বিজয়ী হয়ে যাবে। -তাওহীদ জান্নাতের চাবি : পৃ. ৫
এ সম্পর্কে আরো দেখুন, এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৩৯; প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৬২; ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ২১-২২; আকিদা : পৃ. ৮/৯
ঘ. ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহ হেরে গেছেন :
আজ সমস্ত পৃথিবীকে ইবলিস জিতে আছে। যে ফাসাদ আর সাফাকুদ্দিমার চ্যালেঞ্জ সে আল্লাহকে দিয়েছিল তা দিয়ে আজ পৃথিবী ভরপুর। আর আল্লাহ যে সুবিচার, ন্যায় ও শান্তি (ইসলাম) কথা বলেছিলেন তা আজ পৃথিবীতে কোথাও নেই।যে উম্মাহ, জাতির উপর আল্লাহ কে জয়ী করাবার দায়িত্ব বিশ্বনবী দিয়ে গিয়েছেন, সে জাতি তার ব্যর্থতার বোঝা কাঁধে নিয়ে দাড়ি লম্বা করে টুপি পাগড়ি আলখাল্লা পরে মসজিদে দৌড়াচ্ছে। -এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৩৪
উপরোক্ত বক্তব্যগুলো দিয়ে তারা সুস্পষ্টভাবে বুঝাচ্ছে, ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো, সে চ্যালেঞ্জে ইবলিস জিতে আছে অর্থাৎ আর আল্লাহ হেরে গেছেন। নাউযুবিল্লাহ। আসতাগফিরুল্লাহ্। কী চরম ধৃষ্টতা!
ইসলাম কী বলে?
প্রিয় পাঠক, উপরিউক্ত বক্তব্যগুলো কী কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব? একমাত্র বেঈমান ছাড়া কারো পক্ষে আল্লাহ তাআলার শানে এমন জঘন্য উক্তি করা কী কোনোভাবেই পসিবল? অথচ সমস্ত ক্ষমতার মালিক হলেন মহান আল্লাহ। তাঁর ওপর কোনো ক্ষমতাধর নেই। মহান রব বলেন,
يَكَادُ الْبَرْقُ يَخْطَفُ أَبْصَارَهُمْ كُلَّمَا أَضَاء لَهُم مَّشَوْاْ فِيهِ وَإِذَا أَظْلَمَ عَلَيْهِمْ قَامُواْ وَلَوْ شَاء اللّهُ لَذَهَبَ بِسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ إِنَّ اللَّه عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
মনে হয় যেন বিজলী তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেবে। যখনই বিজলী তাদের সামনে আলো দান করে, তারা তাতে (সেই আলোতে) চলতে শুরু করে, আবার যখন তা তাদের ওপর অন্ধকার বিস্তার করে, তারা দাঁড়িয়ে যায়। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান। -সুরা বাকারা : ২০
أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللّهَ عَلَىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
তুমি কী জানো না, আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতা রাখেন? -সুরা বাকারা : ১০৬
إِنَّ اللّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান। -সুরা বাকারা : ১০৯
أَيْنَ مَا تَكُونُواْ يَأْتِ بِكُمُ اللّهُ جَمِيعًا إِنَّ اللّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
তোমরা যেখানেই থাকো, আল্লাহ তোমাদের সকলকে (নিজের নিকট) নিয়ে আসবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান। -সুরা বাকারা : ১৪৮
আল্লাহ পাক সবার উপর যে ক্ষমতাবান’ এ সম্পর্কে আরও কয়েক’টি আয়াতে বলা আছে। যেমন সুরা বাকারা : ২৫৯/২৮৪ সুরা আলে ইমরান : ২৬/২৯/ ১৬৫/১৮৯; সুরা নিসা : ১৩৩/১৪৯ সুরা মায়িদা : ১৭/ ১৯/৪০
সূতরাং এসকল আয়াত থেকে বুঝা গেলো, আল্লাহ সব বিষয়ে ক্ষমাবান, তাঁকে হারানো কোনো মাখলুকের পক্ষে সম্ভব নয়। এতোগুলো আয়াত থাকতে, আল্লাহ পাকের শানে কীভাবে এমন জঘন্য উক্তি করা যায় যে, ‘আল্লাহ ইবলিসের কাছে হেরে গেছেন’? এমন আকীদা পোষণ করা কী কুফরী নয়?
উপরন্তু আল্লাহ তাআলা এক ও অদ্বিতীয়। বিশ্ব ভুমণ্ডলে সকল বস্তু আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা পুরো দুনিয়ার একচ্ছত্র অধিকারী। সকল সৃষ্টি আল্লাহর তাআলার হুকুম ও ইচ্ছায় পরিচালিত হয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ-র ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়তে পারে না।
وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلاَّ يَعْلَمُهَا وَلاَ حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الأَرْضِ وَلاَ رَطْبٍ وَلاَ يَابِسٍ إِلاَّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
আর তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের কুঞ্জি। তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা জানে না। স্থলে ও জলে যা-কিছু আছে, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত। (কোনো গাছের) এমন কোনো পাতা ঝরে না, যে সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন। মাটির অন্ধকারে কোনো শস্যদানা অথবা আর্দ্র বা শুষ্ক এমন কোনো জিনিস নেই যা এক উন্মুক্ত কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই। -সুরা আনআম : ৫৯
উক্ত আয়াত পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে, বিশ্বের প্রতিটি বালুকণা, ছোটবড় সকল সৃষ্টির উপর আল্লাহ তাআলার পূর্ণ কর্তৃত্ব বিদ্যমান। যেখানে গাছের একটি পাতা ও ক্ষুদ্র দানা পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিত নড়াচড়া করার অধিকার রাখে না, সেখানে আল্লাহর কোনো সৃষ্টি কীভাবে আল্লাহ তাআলাকে পরাজিত করতে পারে? এটা কী আল্লাহর ব্যাপারে মিষ্টার পন্নীর চরম ধৃষ্টতা ও চরম মূর্খতা নয়?
খ্রিষ্টান ও হেযবুত তওহীদের আকিদা অভিন্ন:
মূলত ইবলিস ও আল্লাহ-র মধ্যে ‘চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ক বক্তব্য কোনো মুসলিমের নয় বরং খ্রিষ্টানদের। দেখুন খ্রিষ্টানরা কী বলে-
ঈশ্বর ইবলিসের সাথে বিতর্কে জিততে বা নিজের কথা সত্যতা প্রমাণ করতে তার প্রিয় শয়তানের হাতে সমর্পণ করেন। -আইয়ুব ২:১-১০
এটা ছিলো খ্রিষ্টানদের বাইবেলের বক্তব্য ঠিক হুবহু বক্তব্য হেযবুত তওহীদও লিখেছে-
আল্লাহ ইবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে একদিকে তাকে তাঁর খলিফা মানবের দেহ-মনের মধ্যে প্রবেশ করে তাকে তওহীদ অর্থাৎ সেরাতুল মুস্তাকিম থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টার অনুমতি দিলেন। -এসলামের প্রকৃত রুপরেখা : পৃ. ৩৭
এখন আপনারাই বলুন, আল্লাহপাককে অপমানিত করতে খ্রিষ্টানদের বইয়ের বক্তব্য নকল করা কী কোনো তওহীদপন্থিদের কাজ হতে পারে? নিশ্চয় না। আল্লাহপাক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেন ঠিক তার যার ক্ষমতা ঠিক আল্লাহ-র মতোই হবে। এমন কেউ কী অস্তীত্বে থাকতে পারে?
কমনসেন্স কী বলে?
এরপরও যদি তর্কের খাতির ধরে নেওয়া হয় যে, আল্লাহপাক ইবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন, তাহলে সবার বিবেকের কাছে আমার একটি বিষয় বুঝার বাকি। যে আল্লাহপাক অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সকল গায়েবের খবর জানেন। যেহেতু ভবিষ্যতের সকল ঘটনা কী ঘটবে না ঘটবে তাও তিনি জানেন, তাহলে তো এটাও জানার কথা যে, তিনি ভবিষ্যতে ইবলিস বা দাজ্জালের কাছে পরাজিত হবেন। তিনি নিশ্চিত পরাজয় জেনেও তাহলে ইবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন কীভাবে? সাধারণ কোনো বুদ্ধিমানও কী পরাজয় নিশ্চিত জেনেও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে? নিশ্চয় না। তাহলে বুঝা গেলো, যেহেতু মহান রব ভবিষ্যতের খবরও জানেন, সেহেতু তিনি এটাও জানেন যে, তাঁকে পরাজিত করার মতো শক্তি কারও নেই, হতেও পারে না। তাহলে হেযবুত তওহীদের এ দাবির পেছনে কোনো ঘাপলা আছে কী না?
আল্লাহর সাথে ইবলিসের কথোপকথন কী ছিলো?
মূলত আল্লাহ-র সাথে ইবলিসের একটি কথোপকথন হয়েছিলো। ইবলিসকে আল্লাহ পাক বিতাড়িত করার পর ইবলিস বলেছিলো,
قَالَ رَبِّ بِمَآ أَغْوَيْتَنِي لأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الأَرْضِ وَلأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ
সে (ইবলিস) বলল, হে আমার পলনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথ ভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করবো এবং তাদের সবাইকে পথ ভ্রষ্ঠ করে দেবো। তবে আপনার মনোনীত বান্দাদের ব্যতীত। -সুরা হিজর : ৩৯-৪০
প্রিয় পাঠক, এখানে একটু খেয়াল করুন, ইবলিস তার অবাধ্যতার সময় কিন্তু এ কথা বলেনি যে, পৃথিবীতে রক্তপাত ঘটাবো বা আপনার আইন বিরোধীভাবে সবাইকে চালাবো, বরং বলেছিলো, আপনার নেককার মনোনীত বান্দা ব্যতিত সবাইকে পথভ্রষ্ট করে দেবো। এখন আপনারাই বলুন, আল্লাহর মনোনিত কোনো বান্দাকে ইবলিস কী পথভ্রষ্ট করতে পেরেছে? নিশ্চয় না। সকল নবি, ওলিদের তো শয়তান গোমরাহ করতে পারেনি। তাহলে ইবলিস জিতলো কীভাবে?
আল্লাহপাকের আয়াতের অপব্যাখ্যা করে রবের উপর এতো বড় ব্যার্থতার দায় যারা আল্লাহ-র ওপর চাপিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না, তারা কি আদৌ মুসলমান হতে পারে? বরং এই হেযবুত তওহীদের লোকদেরই শয়তান পথভ্রষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। সে হিসাবে ‘হেযবুত তওহীদের উপরই ইবলিস বিজয়ী হয়েছে’ এটা বলা যুক্তিসঙ্গত, আল্লাহর উপর বিজয় লাভ করেনি আদৌ। কখনও বিজয়ী হতেও পারবে না। কারণ মহান রব সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান। আল্লাহ পাক আমাদের এই কুফরী জাতি থেকে আমাদের সবাইকে হিফাযত করেন।
আল্লাহ’র সিফাত অস্বীকার :
প্রিয় পাঠক, এখানে হেযবুত তওহীদ জয়-পরাজয়ের মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে ‘যদি মানুষ আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে তবে ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহ জয়ী হবেন আর যদি মানুষ আল্লাহ’র হুকুম প্রত্যাখ্যান করে তবে ইবলিস জয়ী হবে আল্লাহ পরাজিত হবেন’। আর যেহেতু দুনিয়াব্যাপী সবাই আল্লাহর হুকুম মানে না, সে হিশাবে আল্লাহ পরাজিত হয়েছেন ইবলিসের কাছে। নাউযুবিল্লাহ। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আল্লাহ-র রাজত্বের ওপর ইবলিস নামক মাখলুকের কর্মের প্রভাব রয়েছে। মহান আল্লাহ’র শানে কতোটা মারাত্মক বেয়াদবি! মূলত এই বক্তব্য দিয়ে তারা আল্লাহ’র কয়েকটি সিফাতকে অস্বীকার করেছে। অথচ আল্লাহ তাঁর নিজের জন্য যেসকল সিফাত সাব্যস্ত করেছেন, সেগুলোর উপর পরিপূর্ণ ঈমান আনা ব্যতিত একজন ব্যক্তির তাওহীদ পূর্ণতা পায় না। কিন্তু হেযবুত তওহীদ আল্লাহপাক সম্পর্কে যে আক্বীদা প্রকাশ করেছে তা বিশ্বাস করলে আল্লাহ’র বহু সিফাতের অস্বীকার অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
মনে রাখা চাই, ‘পরাজয়’ একটি ত্রুটি। অথচ আল্লাহ সকল দোষ-ত্রুটি হতে চিরপবিত্র। দেখুন আল্লাহপাকের একটি সিফাত হচ্ছে, তিনি الْقُدُّوس অর্থাৎ পূত পবিত্র, মহামহিম, মহিমাময়। তিনি সকল ত্রুটি, দুর্বলতা ও অকল্যাণ থেকে মুক্ত ও পবিত্র। যাবতীয় পূর্ণতা ও যোগ্যতার অধিকারী কেবল তিনি। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوس
তিনি (আল্লাহ) পূতপবিত্র মহান বাদশাহ। -সুরা হাশর : ২৩
এ ব্যাপারে সহিহ সনদে হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ كَانَ يَقُولُ فِي رُكُوعِهِ وَسُجُودِهِ : سُبُّوحٌ قُدُّوسٌ رَبُّ الْمَلائِكَةِ وَالرُّوح
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রুকু এবং সিজদায় বলতেন, (মহান আল্লাহ) পূত পবিত্র, মহিমাময় এবং ফেরেশতা মণ্ডলী ও জিবরাইলের প্রভু। -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং : ৪৮৭
যেখানে কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্রতার ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে ‘পরাজয়ের’ ত্রুটি সাব্যস্ত করা কী তাওহীদ থেকে বিচ্যুতি নয়? নিন্মে মহান রবের আরো কয়েকটি সিফাত বা গুনাবলি নিয়ে আলোচনা করা হলো-
মহান আল্লাহ’র একটি সিফাত হলো, তিনি القَدِير অর্থাৎ সর্বশক্তিমান। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعْجِزَهُ مِن شَيْءٍ فِي السَّمَوتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ إِنَّهُ كَانَ عَلِيمًا قَدِيرًا
আল্লাহ এমন নন যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কোন বস্তু তাকে ব্যর্থ করতে পারে। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। -সুরা ফাত্বির : ৪৪
আল্লাহ’র আরেকটি সিফাত হচ্ছে, তিনি الْقَاهِرُ অর্থাৎ প্রতাপশালী, পরাক্রমশালী, প্রবল, অপ্রতিরোধ্য, পরাস্তকারী। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ
তিনি নিজ বান্দাদের উপর পরিপূর্ণ ক্ষমতাবান। -সুরা আনআম : ১৮
ইমাম ইবনুল আসির রহি. الْقَاهِرُ শব্দের অর্থ লিখেছেন,
القاهر هو الغالب جميع الخلق
যিনি সকল সৃষ্টির উপর বিজয়ী। -লিসানুল আরব, ইবনু মুনযির : খ. ৫ পৃ. ১২০
আল্লাহপাকের আরেকটি সিফাত হচ্ছে তিনি; الْقَهَّارُ অর্থাৎ মহা প্রতাপশালী, মহা প্রবল, মহা পরাক্রান্ত, মহা পরাক্রমশালী। মহ্ন আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ
এবং তিনি একাই এমন যে, তাঁর ক্ষমতা সবকিছুতে ব্যাপ্ত। -সুরা রা’দ : ১৬
ইমাম হালীমী (রহিঃ) “আল ক্বহহার” শব্দের অর্থ বলেন,
الَّذِي يَقْهَرُ وَلا يُقْهَرُ بِحَالٍ
যিনি পরাজিত করেন কিন্তু কোনো অবস্থায় তাকে পরাজিত করা যায় না। -আল আসমা ওয়াস সিফাত, বাইহাক্বী : খ. ১ পৃ. ১৬৪
মহান আল্লাহ’র আরেকটি সিফাত হলো, তিনি الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ অর্থাৎ মহা পরাক্রমশালী, অতি প্রভাবশালী, মহা সম্মানিত। মহান রব বলেন,
وَهُوَ الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ
এবং তিনিই শক্তিমান, পরাক্রমশালী। -সুরা শুরা : ১৯
উল্লেখ্য যে, আল্লাহপাকের গুনবাচক নাম ‘الْعَزِيزُ’ এর অর্থ হচ্ছে-
الغالب الذي لا يقهر
অর্থাৎ এমন বিজেতা যাকে পরাজিত করা যায়না। – সফওয়াতুত তাফাসীর : খ. ২ পৃ. ৫৪৬
অন্য বর্ননায়,
الغالب الذي لا يغلبه احد
এমন বিজয়ী যার উপরে কেউই বিজয়ী হতে পারে না। সফওয়াতুত তাফাসীর : খ. ২ পৃ. ৫৪৬
এ ব্যাপারে আরো অসংখ্য আয়াত এসেছে। যেমন
لِلّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَا فِيهِنَّ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে, তার রাজত্ব কেবল আল্লাহরই। তিনি সবকিছুর উপর পরিপূর্ণ ক্ষমতাবান। -সুরা মায়িদা : ১২০
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ
তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি বাদশাহ, পবিত্রতার অধিকারী, শান্তিদাতা, নিরাপত্তাদাতা, সকলের রক্ষক, মহা ক্ষমতাবান, সকল দোষ-ত্রুটির সংশোধনকারী, গৌরবান্বিত, তারা যে শিরক করে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র। -সুরা হাশর : ২৩
فِي مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيكٍ مُقْتَدِرٍ
সত্যিকারের মর্যাদাপূর্ণ আসনে, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহা সম্রাটের সান্নিধ্যে। -সুরা ক্বামার : ৫৫
ইমাম খাত্বাবী রহি. المقتدر শব্দের অর্থ করতে গিয়ে বলেন,
المقتدر هو التام القدرة الذي لا يمتنع عليه شيء ولا يحتجز عنه بمنعة وقوة
যিনি সর্বশক্তিমান, যাকে কোন কিছুই বাধা দিতে পারেনা আর কোন কিছুই তাকে বাধা ও শক্তি প্রয়োগ করতঃ প্রতিরোধ করতে পারেনা। -শুয়াবুল ঈমান (বাইহাকী) : পৃ. ২২৫
এইরূপ আরও বহু আয়াতে আল্লাহপাক নিজের শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। যেখানে আল্লাহ তাআলা নিজের শানে স্বয়ং এমন পরাক্রমের পরিচয় দিয়েছেন, সেখানে ইবলিস
আল্লাহপাকের সামান্য একটি মাখলুক হয়ে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলাকে পরাজিত করার আদৌ ক্ষমতা রাখে কী?
সৃষ্টির অবাধ্যতা স্রষ্টার রাজত্ব হ্রাস করে না:
সকল মাখলুক আল্লাহ-র হুকুম পালন করলে যেমন তাঁর রাজত্বে কোনো বৃদ্ধি আসে না, ঠিক তেমনি সমগ্র মাখলুক তাঁর হুকুম প্রত্যাখ্যান করলেও তাঁর রাজত্বে কোনো প্রভাব পড়ে না। কারণ তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
إِن تَكْفُرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنكُمْ
তোমরা কুফর অবলম্বন করলে নিশ্চিত জেনে রেখো আল্লাহ তোমাদের কারও মুখাপেক্ষী নন। -সুরা যুমার : ৭
وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَلَمِينَ
কেউ (এটা) অস্বীকার করলে আল্লাহ তো বিশ্ব জগতের সমস্ত মানুষ হতে বেনিয়ায (অমুখাপেক্ষী)। -সুরা আলে ইমরান : ৯৭
وَقَالَ مُوسَى إِن تَكْفُرُوا أَنتُمْ وَمَن فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا فَإِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ حَمِيدٌ
এবং মুসা বলেছিলো, তোমরা এবং পৃথিবীতে বসবাসকারী সকলেই যদি অকৃতজ্ঞতা করো, তবে (আল্লাহর কোনও ক্ষতি নেই। কেননা) আল্লাহ অতি বেনিয়ায, তিনি প্রশংসার উপযুক্ত। -সুরা ইবরাহীম : ৮
উপরন্তু বিষয়টি হাদিসে কুদসিতে আরও স্পষ্ট করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
يَا عِبَادِي لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أَتْقَى قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مِنْكُمْ مَا زَادَ ذَلِكَ فِي مُلْكِي شَيْئًا يَا عِبَادِي لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أَفْجَرِ قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مَا نقص ذلِكَ مِنْ مُلْكِي شَيْئًا
হে আমার বান্দারা, তোমাদের আদি-অন্ত, তোমাদের মানুষ ও জিন জাতির মধ্যে যার অন্তর আমাকে সবচাইতে বেশি ভয় পায়, তোমরা সবাই যদি তার মতো হয়ে যাও তাতে আমার রাজত্ব একটুও বৃদ্ধি পাবে না। হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের আদি-অন্ত, তোমাদের সকল মানুষ ও জিন জাতির মধ্যে যার অন্তর সবচাইতে পাপিষ্ঠ, তোমরা সবাই যদি তার মতো হয়ে যাও, তাহলে আমার রাজত্ব কিছুমাত্র হ্রাস পাবে না। -সহীহ মুসলিম : হাদিস নং : ২৫৭৭
প্রিয় পাঠক, কুরআন-হাদিসের এমন সুস্পষ্ট দলিলের ভিত্তিতে একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, গোটা দুনিয়ার সকল মানুষও যদি কুফুরী করে তাহলেও আল্লাহ -র রাজত্বে কোনও কমতি আসে না। এমতাবস্থায় ‘বর্তমানে পৃথিবিতে আল্লাহর হুকুম কায়েম নেই’ এই অজুহাতে ইবলিসকে জয়ী এবং আল্লাহ তাআলাকে পরাজিত সাব্যস্ত করা কুফুরির শামিল। তাওহীদের দল বলে দাবিদার হেযবুত তওহীদের নিজেদের তাওহীদেরই যদি এমন বেহাল দশা হয়, তবে আর এই নামের যথার্থতা কোথায় রইল?