Home > হিজবুত তাওহীদ > —আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. নিয়ে সমালোচনা:

—আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. নিয়ে সমালোচনা:

সমস্ত নবি-রাসুলগণ নিস্পাপ। এটাই সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আয়েম্মায়ে কেরামসহ সকল মুসলিম উম্মাহর বিশ্বাস। যুক্তিও তাই বলে। কারণ যে নবিরা উম্মতের আদর্শ হবেন, তারা কোনো দোষে দোষী হলে আদর্শের মূর্তপ্রতিক হতে পারেন না। আর সেজন্য ইসলামে সকল নবিদের প্রতি শুধু ঈমান আনাকে ফরজ করা হয়নি, বরং তাঁদের সকলের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া, তাঁদের মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করাও ফরজ করা হয়েছে। যেহেতু তাঁরা হচ্ছেন- শ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহ পাকের নির্বাচিত বিশেষ বান্দা। তাঁরা হচ্ছেন- হেদায়েতের আলোকবর্তিকা; যা অন্ধকার পৃথিবীকে আলোকিত করেছে, হৃদয়গুলোর পাশবিকতা দূর করে কোমলতা এনেছে। তাঁদেরকে ছাড়া শান্তি ও সফলতার কোনো পথ নেই। আর এ  কারণেই সকল মুসলিম এ ব্যাপারে ইজমা তথা ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, নবিদেরকে গালি দেওয়া, হেয় প্রতিপন্ন করা হারাম। যে ব্যক্তি কর্তৃক এমন কিছু সংঘটিত হবে সে মুরতাদ হয়ে যাবে; যেমনিভাবে কেউ আমাদের নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে গালি দিলে মুরতাদ হয়ে যায়। তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দিকনির্দেশা দিয়ে মহান রব বলেন,
قُلْ آمَنَّا بِاللّهِ وَمَا أُنزِلَ عَلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَقَ وَيَعْقُوبَ وَالأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى وَالنَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لاَ نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ
বলে দাও, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ-র প্রতি, আমাদের উপর যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে তাঁর প্রতি, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও (তাঁদের) বংশধরের প্রতি যা (যে হিদায়াত) নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি এবং মুসা, ঈসা ও অন্যান্য নবিগণকে তাঁদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে যা দেওয়া হয়েছে তার প্রতি। আমরা তাঁদের (উল্লিখিত নবিদের) মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই (এক আল্লাহরই) সম্মুখে নতশির। -সুরা আলে ইমরান : ৮৪

সুতরাং কোনো নবিকে অপমান করা বা কারো কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি বের করা বা কারো ব্যর্থ বলা চরম অন্যায় ও মুরতাদ হওয়ার নামান্তর। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, হেযবুত তওহীদ নবিদের ব্যাপারে যেসব মন্তব্য করেছেন, তা দেখলে গা শিউরে ওঠে। প্রথমে এক নজরে দেখুন তারা কী বলেছে-
১. নবি-রাসুলগণ ব্যর্থ ছিলেন।
২. নবিরা যা পারেননি, পন্নীকে দিয়ে আল্লাহ সেটা করাবেন।
৩. মুহাম্মাদ সা. আল্লাহ’র দেওয়া দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারেননি।
৪. মুহাম্মাদ সা. রহমাতুল্লিল আলামিন ছিলেন না, আজও নন।
৫. ইহুদিদের কিতাব দিয়ে রাসুলুল্লাহ সা. বিচার করেছেন।
৬. পন্নীর চেয়ে মুহাম্মাদ সা. এর এরিয়া কম।
৭. ঈসা আ. কোনো নতুন ধর্ম নিয়ে আসেননি।
৮. খ্রিস্টানদের অপকর্মের জন্য ঈসাও আ. দায়ি।
৯. বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির, মনু আল্লাহর নবী ছিলেন।
১০. মনু মূলত নূহ, যুধিষ্ঠির মূলত ইদরিস, জেসাস মূলত ঈসা,  বুদ্ধদেব মূলত যুলকিফল।

নাউযুবিল্লাহ। কতবড় ধৃষ্টতা! আল্লাহ পাকের মনোনিত বান্দাদের শানে এহেন অপমান কোনো মুসলিমের হতে পারে না। চলুন প্রত্যেকটা বিষয়ে আলোচনা করা যাক।

নবি-রাসুলগণ কী ব্যর্থ ছিলেন?
সকল নবিগণ আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব স্বীয় স্থানে পূর্ণভাবে পালন করেছেন। কেউ তাঁদের দায়িত্বে কোনো ত্রুটি রাখেননি। কোনো নবিই ব্যর্থ হননি। এটাই মুসলিমদের আক্বীদা। নবিদের শানে কোনো ধরণের প্রশ্ন তোলা ঈমান নষ্ট হওয়ার একটি কারণ। উপরন্তু যে যত বড় নেককার উম্মত হোক না কেন, কোনো নবির সমমূল্য হতে পারেন না। সম্ভবও নয়। কারণ নবিরা খোদ আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, প্রায় সব নবিরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যার্থ হয়েছেন। এর কারণ হিশাবে তারা বলেছে,
পৃথিবীতে প্রচলিত সমস্ত রকম দীন অর্থাৎ জীবনব্যবস্থাকে পরাজিত করে বা শেষ করে দিয়ে একমাত্র আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা বা দীন ইসলাম প্রতিষ্ঠায়ই আল্লাহর লক্ষ্য এবং বিশ্ব নবীকে পাঠাবার উদ্দেশ্যই তাই। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১২১

পূর্ববর্তী নবীদের যে কারণে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন তাঁর এই শেষ নবীকেও সেই একই উদ্দেশ্যে পাঠালেন- অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের জীবনে শান্তি, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁকে (সা.) নির্দেশ দিলেন- পৃথিবীতে যত রকম জীবনব্যবস্থা আছে সমস্তগুলোকে নিষ্ক্রিয়, বাতিল করে এই শেষ জীবনব্যবস্থা মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে (সুরা তওবা ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা সফ ৯)। -বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৯

অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, সকল নবিদের দায়িত্ব ছিলো বিশ্বময় যত ধর্ম আছে সব বিলুপ্ত করে আল্লাহ-র ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু সব নবিরা তা পারেননি, সে জন্য সকল নবিরা ব্যার্থ। নাউযুবিল্লাহ। দেখুন তারা কী লিখেছে,
একদম মহাসত্য পেয়েও যেখানে নবী রাসূলদের মধ্যে অনেকে ব্যর্থ হোয়েছেন, পারেন নি, সেখানে আমি কে। আমি তো কেউ না, কিছুই না। কি হবে, কি হবে না – এই সংশয় আমার ২০০৮ সনের ফেব্রুয়ারীরর ২ তারিখ পর্যন্ত, পূর্ণভাবে ছিলো। যদিও সেটা আমাকে দমাতে পারেনি, এজন্য যে আমি চেষ্টা কোরে যাবো, নবী রাসূলরা পারেন নি, আর আমি কে?
আমি চেষ্টা কোরে যাবো, মো’জেজার দিনটায় আল্লাহ আমার সব সংশয় অবসান কোরেছেন, জানিয়ে দিলেন নিজে যে- হবে, উনি কোরবেন, আমি না। তোমরাও না, আমিও না, কোরবেন আল্লাহ নিজে, He Himself, সবকিছুই আল্লাহর নিজের করা Actually, সব কিছুই। -আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা : পৃ. ৬৮

বি:দ্র: তাদের বইয়ে লেখা ‘মো’জেজার দিনটায় আল্লাহ আমার সব সংশয় অবসান কোরেছেন,জানিয়ে দিলেন নিজে যে, ‘করো, হবে’। এখানে হেযবুত তওহীদ তাদের বইতে বক্তব্যটা লেখার সময় ‘করো’ শব্দটা কেটে দিয়েছে। কিন্তু ‘করো’ এ শব্দটা তার ভিডিওতে রয়েছে। -ভিডিও লিংক: https://youtu.be/Z2gSXhmYWsg

যাহোক, উক্ত বক্তব্য দিয়ে পন্নী সাহেব দুটি কথা বলতে চেয়েছে,
১. সকল নবিরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ছিলেন।
২. নবিরা যা পারেননি, পন্নীকে দিয়ে আল্লাহ সেটা করাবেন বলে আল্লাহ তাআলা তাকে ওয়াদা দিয়েছেন।

ইসলাম কী বলে?
এক. চলুন প্রথমে নবিদের দায়িত্ব কী সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআন থেকেই জেনে নেওয়া যাক। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসুল পাঠাইনি, যার প্রতি আমি এই ওহি নাযিল করিনি যে, ‘আমি ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত করো’। -সুরা আম্বিয়া : ২৫

এই তাওহীদের ডাক দেওয়াটাই ছিলো নবিদের দায়িত্ব। এ কথাটাও মহান রব বলে দিয়েছেন,
فَهَلْ عَلَى الرُّسُلِ إِلاَّ الْبَلاغُ الْمُبِينُ
কিন্তু স্পষ্টভাবে বার্তা পৌঁছানো ছাড়া রাসুলগণের আর কোনো দায়িত্ব নেই। -সুরা নাহল : ৩৫

এছাড়া খোদ পন্নীই লিখেছে,
আল্লাহ যে তাঁর এক লাখ চব্বিশ হাজার, মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী রসুল (আ.) পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার উদ্দেশ্য কী? একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে এমন একটা জীবন-বিধান, দীন দেয়া যেটা অনুসরণ করে। মানুষের জীবন পরিচালিত করলে মানুষ অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, ও রক্তপাতহীন, প্রগতিশীল একটা জীবনে বাস করতে পারে। এর প্রধান শর্ত হলো আল্লাহকে একমাত্র জীবন-বিধাতা বলে স্বীকার করে নেওয়া, একমাত্র প্রভু স্বীকার করা, (তওহীদ)। কারণ তা না করলে তার দেয়া জীবন বিধানকে একমাত্র জীবন-বিধান বলে স্বীকার করার প্রশ্ন আসে না। দ্বিতীয়ত, যার মাধ্যমে আল্লাহ ঐ বিধান পাঠালেন তাকে প্রেরিত রসুল বলে স্বীকার করা। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১৩৩

সুতরাং বুঝা গেলো, আল্লাহ কর্তৃক নবিদের উপর দায়িত্ব ছিলো, শুধুমাত্র দ্বীনের বাণী, তাওহীদের বাণী পৌঁছে দেওয়া। আর এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক নবিদেরকে চুড়ান্ত পর্যায়ের বিপদে পড়তে হয়েছে। কাউকে করাত দিয়ে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে, কাউকে আগুনে ফেলা হয়েছে, কাউকে দেশান্তরিত করা হয়েছে, কাউকে ফাঁসি দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। আর আমাদের রাসুল সা. এর নির্যাতন তো লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। সুতরাং বুঝা গেলো, আম্বিয়ায়ে কেরাম তাঁদের দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি রাখেননি, এবং সবাই স্বীয় দায়িত্ব পালনে পরিপূর্ণভাবে নিরলস প্রচেষ্টা করে গেছেন, কোনো ত্রুটি করেননি। তাছাড়া পন্নী নিজেও অন্যত্র লিখেছে,
প্রত্যেক নবী তার উপরে দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন তার অনুসারীদের, তার উম্মার সাহায্যে। -বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ১০

যেহেতু জনাব পন্নী নিজেই যখন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে নবিগণ আ. তাঁদের দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন, সেখানে সফলতা কতটুকু সেটা তো রবের ব্যাপার। জনাব পন্নী লিখেছে,
প্রত্যেককে মনে রাখতে হবে যে, সংগ্রামই তার দায়িত্ব, সাফল্য নয়, কারণ সাফল্য ও ব্যর্থতা মানুষের হাতে নয়, সেটা আল্লাহর হাতে। -এসলামের প্রকৃত রূপরেখা : পৃ. ৬৪

সুতরাং এরপরও জনাব পন্নী কর্তৃক নবিদের ব্যার্থ বলা নবি-রাসুলগণের আ. রিসালাতের উপর মারাত্মক অপবাদ এবং তাঁদের অপমান ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ যে ব্যক্তি কোনো নবিকে হেয় প্রতিপন্ন করবে, সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের। এ প্রসঙ্গে কাযী ইয়ায রহি. বলেন;
من استخف بنبينا محمد صلى الله عليه وسلم أو بأحد من الأنبياء عليهم الصلاة والسلام أو أزرى عليهم أو آذاهم أو قتل نبيا أو حاربه فهو كافر بإجماع
যে ব্যক্তি তাঁকে (অর্থাৎ নবি সাঃ-কে) অপমান করবে কিংবা অন্য কোনো নবিকে অপমান করবে কিংবা মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবে, কিংবা তাদেরকে কষ্ট দিবে কিংবা কোনো নবিকে হত্যা করবে কিংবা কোনো নবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, সে ব্যক্তি সর্বসম্মতিক্রমে কাফের। -মানহুল জালীল, খ. ৯ পৃ. ৯৬

দুই. নবিরা যা পারেননি, পন্নীকে দিয়ে আল্লাহ সেটা করাবেন?
পন্নী সাহেবের আরেকটা দাবি ছিলো, নবিরা যা পারেননি, পন্নীকে দিয়ে আল্লাহ সেটা করাবেন বলে আল্লাহ তাকে বলেছেন। অর্থাৎ তার মাধ্যমে পুরো বিশ্বে দ্বীনের বিজয় ঘটাবেন। এটা একটা ডাহা মিথ্যাচার। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, আল্লাহপাক পন্নীকে দিয়ে বিশ্বব্যাপী তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার ওয়াদা দিয়েছেন। তাহলে তো সেটা হওয়ারই কথা ছিলো। কারণ আল্লাহ পাক তো ওয়াদার খেলাফ করেন না। মহান রব বলেন,
وَعْدَ اللَّهِ لَا يُخْلِفُ اللَّهُ وَعْدَهُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
এটা আল্লাহর কৃত ওয়াদা। আল্লাহ নিজ ওয়াদার বিপরীত করেন না। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। -সুরা রুম : ৬

আল্লাহপাক যদি তাঁকে এমন ওয়াদা দিয়েই থাকেন, তাহলে সেটা তো হওয়ারই কথা ছিলো। কারণ আল্লাহ পাক তো ওয়াদার খেলাফ করেননা। অথচ পন্নী সাহেব ২০১২ সালে মারা গেছে। কিন্তু তার মাধ্যমে পুরো বিশ্বে সে দ্বীন পৌঁছায়নি, বরং বাংলাদেশেও মুষ্টিময় লোক ছাড়া কেউ তার মতবাদ গ্রহণ করেনি। । তাহলে এটা কি সত্য নয় যে, পন্নী আল্লাহ-র নামে মিথ্যাচার করে মারা গেছেন? সুতরাং যে লোকটি আল্লাহর নামে এমন জঘন্য মিথ্যাচার করতে পারে, এমন মহামিথ্যুক কীভাবে ‘যামানার এমাম’ হয়? এবং এমন মিথ্যুকের মতবাদ কীভাবে সুস্থ মানুষ গ্রহণ করে, আমাদের বোধগম্য নয়। এমন মিথ্যুকদের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ
যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রটনা করে অথবা তার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে, তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে? নিশ্চিত (জেন), জালিমগণ সফলতা লাভ করতে পারে না। -সুরা আনআম : ২১

নবি-রাসুলগণের দায়িত্ব কী ছিলো, সে সম্পর্কে হেযবুত তওহীদ আরও লিখেছে,
নবী-রসুলদের দায়িত্ব ছিল মানুষের সামনে ন্যায়-অন্যায় সত্য-মিথ্যা আলাদা করে দেওয়া। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ৩৯

আলহামদুলিল্লাহ। নবিরা আমাদের সত্য-মিথ্যা চেনার রূপরেখা দেখিয়ে গেছেন। আর সে কারণেই আমরা হেযবুত তওহীদকে কুফরী মতবাদ হিশেবে চিনতে পারছি।

মুহাম্মাদ সা. কী আল্লাহ’র দেওয়া দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারেননি?
প্রিয় পাঠক, সকল মুসলিম এ ব্যাপারে একমত যে আখেরি নবি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পরিপূর্ণ করে গেছেন এবং এ ব্যাপারে কুরআন-হাদিসে অসংখ্য প্রমাণাদি রয়েছে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানের কুফরী সংগঠণ হেযবুত তওহীদ একটি জঘন্য দাবি করে বসলো যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ কর্তৃক দেওয়া তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ করে যেতে পারেননি। নাউযুবিল্লাহ। বিষয়টি তারা তাদের বইগুলোর ভেতর অসংখ্য জায়গায় লিখেছে,
বিশ্বনবী তাঁর নবীজীবনের তেইশ বছরে সমস্ত আরব উপদ্বীপে এই শেষ জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করলেন- ইসলামের শেষ সংস্করণ মানব জীবনের একটি অংশে প্রতিষ্ঠা হলো। কিন্তু তার উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ না, তার দায়িত্ব সমস্ত পৃথিবী, সম্পূর্ণ মানব জাতি। এর আগে কোন নবীর উপর সম্পূর্ণ মানবজাতির দায়িত্ব অর্পিত হয় নি। যতদিন সম্পূর্ণ মানব জাতির উপর এই শেষ জীবন বিধান জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা না হবে ততদিন মানুষ জাতি আজকের মতোই অশান্তি, যুদ্ধবিগ্রহ, অবিচারের মধ্যে ডুবে থাকবে- শান্তি, ইসলাম আসবে না এবং বিশ্বনবীর উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্বও পূর্ণ হবে না। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১১৫
পূর্ববর্তী নবীদের উপর অর্পিত দায়িত্ব তাঁরা অনেকেই তাদের জীবনেই পূর্ণ করে যেতে পেরেছিলেন, কারণ তাদের দায়িত্বের পরিসীমা ছিল ছোট। কিন্তু এই শেষ জনের দায়িত্ব হলো এত বিরাট যে এক জীবনে তা পূর্ণ করে যাওয়া অসম্ভব। অথচ যতদিন ঐ দায়িত্ব পূর্ণ করা না হবে ততদিন তাঁর উপর আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব অপূর্ণ-অসমাপ্ত থেকে যাবে। -আকিদা : পৃ. ১২; এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব : পৃ. ৭৪-৭৫

যখন আল্লাহ রাসুল (দঃ) এই দুনিয়া থেকে চোলে গেলেন তখন ওই দায়িত্ব স্বভাবতঃই এসে পোড়লো তাঁর গঠন করা জাতিটির ওপর অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদীর ওপর, কারণ রসূলের ওপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব তখনও পূর্ণ হয় নি।  -এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ১০৪-১০৫

আল্লাহর রাসূল আংশিকভাবে তার দায়িত্বপূর্ণ করে চলে গেলেন এবং তার বাকি কাজ পূর্ণ করার ভার দিয়ে গেলেন তাঁর সৃষ্ট জাতির উপর, তার উম্মাহর উপর। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১১৫-১১৬

বিশ্বনবীর উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্বকে যারা মাঝপথে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন, তারা আল্লাহর দেওয়া বিশ্বনবীর উপাধি, ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ কেও পূর্ণ হতে দেননি। -আকিদা : পৃ. ১৯

তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতার অসমাপ্ত কাজ পূর্ণ করতে দেশ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েছিলেন। -বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ১০

শেষ নবীর সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন অর্থাৎ তার নবুয়াত সমস্ত পৃথিবী পরিব্যপ্ত। তার উম্মাহর ব্যর্থতার জন্য তাঁর নবুওয়াত সমস্ত মানবজাতিকে এর অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। যদিও সেটাই ছিলো উম্মতে মোহাম্মদীর উপর অর্পিত সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব। -শোষণের হাতিয়ার : পৃ. ৫৮

অর্থাৎ তাদের দাবি হলো, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দায়িত্ব নিয়ে মহান রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছিলেন, সে দায়িত্ব তিনি পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পারেননি, এমনকি তিনি তাঁর দায়িত্ব পূর্ণ করতে যে সাহাবাদেরকে গঠণ করেছিলেন, তাঁরাও সে দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারেননি। এক কথায় নবিজি সাঃ-ও তাঁর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ছিলেন।

ইসলাম কী বলে?
এ ব্যাপারে সমস্ত মুসলিম একমত যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দায়িত্ব পূর্নাঙ্গরুপে আদায় করে গেছেন। আর এজন্যই তিনি উম্মতের কাছে কামেল-মুকাম্মাল  নবি হিশাবে বিবেচিত হয়েছের। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মহান রব যে দীন দুনিয়াতে প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে  পাঠিয়েছিলেন, সে দায়িত্ব নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদায় করতে গিয়ে অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তিনি দীন প্রচারের কাজ বন্ধ করে দেননি, বরং ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত এ দীনের ফিকির এবং প্রচারের কাজেই ব্যস্ত ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সে দায়িত্বে পূর্ণতা লাভ করেই ইহধাম ত্যাগ করেন। এর স্বপক্ষে প্রমাণস্বরূপ বিদায় হজ্বের ভাষণটি দেখতে পারেন। বিদায় হজ্বে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, হে সাহাবারা, আমি কী আমার দায়িত্ব পরিপূর্ণ ভাবে তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি? প্রতি উত্তরে সাহাবায়ে কেরাম বললেন-
قالوا نشهدُ أنَّكَ قد بلَّغتَ وأدَّيتَ ونصحْتَ ثمَّ قالَ بأُصبعِهِ السَّبَّابةِ يرفعُها إلى السَّماءِ وينكبُها إلى النَّاسِ اللَّهمَّ اشهدْ اللَّهمَّ اشهدْ اللَّهمَّ اشهدْ
সাহাবায়ে কেরাম বললেন আমরা সাক্ষি দিচ্ছি আপনি অবশ্যই আপনার দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দিয়েছেন এবং আদায় করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তার শাহাদাত আঙ্গুল উঁচিয়ে আসমানের দিকে ইশারা করে বললেন যে, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো। তুমি সাক্ষী থাকো। তুমি সাক্ষী থাকো। -সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২১৮

আর সে সময়েই আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিলেন-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে ইসলামকে (চির দিনের জন্য) পছন্দ করে নিলাম। (সুতরাং এ দীনের বিধানাবলী পরিপূর্ণভাবে পালন করো)। -সুরা মায়িদা : ৩

উক্ত আয়াতে মহান রব তাঁর দীনকে পরিপূর্ণ বলে ঘোষণা দেওয়াটাই প্রমাণ করে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দায়িত্ব পূর্ণভাবে পালন করেছেন। কারণ যদি তিনি দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন না করতেন, তাহলে দ্বীন পূর্ণ হতো না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পন্নী সাহেব এত সুস্পষ্ট আয়াত এবং সহিহ হাদিসকে অস্বীকার করলেন কীভাবে? যেখানে সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম সাক্ষী দিলেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলা-কে তিন তিনবার সাক্ষী রাখলেন, এমনকি আল্লাহ তাআলাও সার্টিফিকেট দান করলেন যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন। অথচ পন্নী সাহেব বললেন যে কাফেররা দ্বীনের কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দায়িত্ব পরিপূর্ণ করতে পারেননি। আসতাগফিরুল্লাহ। এমন সুস্পষ্ট আয়াত এবং সহিহ হাদিস থাকার পরও কোন ব্যক্তি যদি দাবি করে থাকে যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব আদায়ে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ করতে পারেননি, তাকে কীভাবে ইসলামের বন্ধু মনে করা যায় সেটা আমার বোধগম্য নয়।

অভিযোগ:
হেযবুত তওহীদ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দায়িত্ব পালনে ব্যার্থ প্রমাণ করতে মূলত একটি আয়াতের অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছে। দেখুন তারা কী লিখেছে,
আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার রাসূলকে সঠিক পথ প্রদর্শন (হেদায়াহ) এবং সত্যদীন দিয়ে প্রেরণ কোরলাম এই জন্যে যে তিনি যেন একে (এই হেদায়াহ ও জীবন ব্যবস্থাকে) পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত জীবন ব্যবস্থার উপর বিজয়ী করেন (কোর’আন-সুরা আল ফাতাহ- ২৮, সুরা আত তওবা- ৩৩ ও সুরা আস সফ- ৯)। অর্থাৎ পৃথিবীতে, মানব জাতির মধ্যে আল্লাহর রাসূলকে প্রেরণের উদ্দেশ্য হোচ্ছে (রাসূলের মাধ্যমে) হেদায়াহ বা পথ প্রদর্শনসহ দীন বা জীবনব্যাবস্থা পাঠানো এবং সেই হেদায়াহ ও দীনকে সমগ্র মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। -এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব : পৃ. ১৮

অর্থাৎ উক্ত আয়াত দ্বারা তারা বুঝাতে চায় যে, আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে পুরো বিশ্বে ইসলামকে বিজয়ী করার দায়িত্ব প্রদান করেছেন। যেহেতু সেটা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করে যেতে পারেন নি, সেহেতু তাঁর দায়িত্ব পুর্ণ করতে পারেন নি, ফলে তিনি ব্যার্থ নবি। নাউযুবিল্লাহ।

জবাব:
ক. মূলত হেযবুত তওহীদ ‘নবি সা. তাঁর দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারেননি’ বলে যে দাবি করেছেন, সেটার স্বপক্ষে তারা নিন্মের আয়াতটি দলীল হিসাবে পেশ করে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا
তিনিই নিজ রাসুলকে হেদায়াত ও সত্য দীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, অন্য সমস্ত দীনের উপর তাকে জয়যুক্ত করার জন্য। আর (এর) সাক্ষ্য দানের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। -সুরা ফাতহ্ : ২৮

প্রিয় পাঠক, উক্ত আয়াতে কিন্তু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে একটি, সেটা হলো, অন্যান্য সমস্ত ধর্মের উপর ইসলামকে বিজয়ী করা।
لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ
অন্য সমস্ত দীনের উপর তাকে জয়যুক্ত করার জন্য। -সুরা ফাতহ্ : ২৮

উক্ত আয়াতের আসল অর্থ কী সে সম্পর্কে ইমাম তাবারী রহি. বলেন,
ليعلي الإسلام على الملل كلها
তিনি যেন এ দীন ইসলামকে অন্য সমস্ত দীন তথা সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করেন। -তাফসীরে তাবারী : খ: ১৪ পৃ: ২১৪

এ আয়াতে বলা হলো, সকল ধর্মের উপর ইসলামকে বিজয়ী করা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দায়িত্ব। কথাটা হেযবুত তওহীদও স্বীকার করেছে। তারা লিখেছে,
পূর্ববর্তী নবীদের যে কারণে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন তাঁর এই শেষ নবীকেও সেই একই উদ্দেশ্যে পাঠালেন- অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের জীবনে শান্তি, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁকে (সা.) নির্দেশ দিলেন- পৃথিবীতে যত রকম জীবনব্যবস্থা আছে সমস্তগুলোকে নিষ্ক্রিয়, বাতিল করে এই শেষ জীবনব্যবস্থা মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে (সুরা তওবা ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা সফ ৯)। -বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৯

জীবনব্যবস্থাকে পরাজিত করে বা শেষ করে দিয়ে একমাত্র আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা বা দীন ইসলাম প্রতিষ্ঠায়ই আল্লাহর লক্ষ্য এবং বিশ্ব নবীকে পাঠাবার উদ্দেশ্যই তাই। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১২১

প্রমাণ হলো, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দায়িত্ব ছিলো অন্য ধর্মের ওপর ইসলামকে বিজয়ী করাই তাঁর দায়িত্ব ছিলো। কিন্তু পুরো দুনিয়াময় বিজয়ী করার কথা তো উক্ত আয়াতে নেই। কিন্তু এখানে দ্বিতীয় যে, দ্বায়িত্বের কথা হেযবুত তওহীদ দাবি করেছে যে,
পৃথিবীতে মানবজাতির মধ্যে আল্লাহর রাসূলকে প্রেরণের উদ্দেশ্যে একটি নয়, দুইটি। একটি রসুলের মাধ্যমে হেদায়াহ, পথ-প্রদর্শনসহ দীন পাঠানো, দ্বিতীয়টি সেই হেদায়াহ ও দীনকে সমগ্র মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। -এসলামের প্রকৃত রূপরেখা : পৃ. ৪৬

পূর্ববর্তীদের (নবীদের) দায়িত্ব ছিল তাদের যার যার সমাজ, গোত্র, জাতির মধ্যে সীমিত, আর এই শেষ-নবীর দায়িত্ব হলো সমস্ত পৃথিবীর (সুরা নেসা-১৭০, সুরা ফোরকান-১)। -ইসলামের প্রকৃত সালাহ : পৃ. ১০

এখানে ‘সমস্ত পৃথিবীর মানবজিবনে সে সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দায়িত্ব ছিল’ এটা তো এ আয়াতে বলা হয়নি? কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পন্নী সাহেব  আয়াতটির অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে বলে দিলেন যে, যেহেতু নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরো পৃথিবিতে দ্বীন কায়েম করে যেতে পারেননি, সুতরাং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ কর্তৃক দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারেননি। অথচ পুরো পৃথিবীতে দ্বীন প্রতিষ্ঠা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দায়িত্ব ছিলো না। দায়িত্ব ছিলো শুধু সব ধর্মের উপর ইসলামকে বিজয়ী করা।

খ. উপরন্তু একজন মানুষের পক্ষে পুরো পৃথিবীময় ইসলাম বিজয় করা কি সম্ভব? চলুন এটার উত্তর সরাসরি হেযবুত তওহীদ থেকেই নেওয়া যাক। তারা লিখেছেন,
এই বিশাল দায়িত্ব, সমস্ত পৃথিবীময় এই শেষ জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করা এক জীবনে অসম্ভব। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১১৫

এই বিশাল দায়িত্ব যে এক জীবনে পালন করার প্রশ্নই আসে না তা তিনি এ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তিনিও জানেন, আর যার উপর অর্পণ করেছেন তিনিও জানেন। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম পৃষ্ঠা-১৩৩-১৩৪

এই শেষ জনের (মুহাম্মাদ স.) দায়িত্ব হলো এত বিরাট যে এক জিবনে তা পূর্ণ করে যাওয়া অসম্ভব।অথচ যতদিন ঐ দায়িত্ব পূর্ণ করা না হবে ততদিন তাঁর উপর আল্লাহর দেয়া দায়ীত্ব অপূর্ণ-অসমাপ্ত থেকে যাবে। -আকিদা : পৃ. ১২

তাহলে হেযবুত তওহীদের কথায় বুঝা গেল, পুরো বিশ্বময় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার যে দায়িত্বের কথা হেযবুত তওহীদই দাবি করছে, সে দায়িত্ব নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একজিবনে পূর্ণ করা সম্ভব নয়। তার অর্থ দাঁড়ালো, আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর সাধ্যের বাহিরে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলেন(?)। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন,
لاَ يُكَلِّفُ اللّهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا
আল্লাহ কারও উপর তার সাধ্যের বাহিরে দায়িত্ব অর্পণ করেন না। -সুরা বাকারা : ২৮৬

যেহেতু আল্লাহ পাক সাধ্যের বাহিরে কারও উপর কিছু চাপিয়ে দেননা, সেহেতু বিশ্বময় ইসলাম প্রতিষ্ঠার দায়িত্বও আল্লাহ পাক তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দেননি, কিন্তু আয়াতের অপব্যাখ্যা করে সে দায়িত্ব নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর ছিলো বলে হেযবুত তওহীদ যে দাবি করেছে, তা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর সরাসরি মিথ্যা অপবাদ। কত্তবড় দুঃসাহস হলে এত বড় জালিয়াতী সম্ভব? এতবড় জালিয়াতীর পেছনে মূল কারণ হলো, পন্নী সাহেবের আরবী সম্পর্কে চরম মুর্খতা। কারণ পন্নী সাহেব ছিলেন আরবীতে নিরক্ষর। তিনি নিজেই লিখেছেন,
আমি বাংলা জানি,যেটুকু জানা দরকার মানুষের,ইংলিশ জানি, যতটুকু মানুষের জানা দরকার,আমি আরবী জানি না,আরবীতে আমি নিরক্ষর। ঠিক আক্ষরিকভাবে নয়,কিন্তু আমি আরবী জানি না। আর যে এসলাম নিয়ে কথা সেই এসলাম রোয়েছে কোর’আন-হাদীসে আর সেটার ভাষা আরবী।ওখানে আমি বাস্তবিক অর্থে নিরক্ষর। -আল্লাহর মো’জেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা : পৃ. ৫৫

তাহলে একজন আরবী সম্পর্কে নিরক্ষর ব্যক্তি ইসলামের ঠিক-বেঠিক যাচাই করেন কীভাবে? কীভাবে তিনি মুসলিমদের নেতা হন? কীভাবে তিনি পবিত্র কুরআনের মতো সাহিত্যপূর্ণ কিতাবের ব্যাখ্যা করতে যান? কোন সাহসে?

নবিজি সাঃ-এর ওপর অর্পিত দায়িত্ব কী পূর্ণ হয়েছিলো?
নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব ছিলো জাযিরাতুল আরবে দীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। যা তিনি পূর্ণ করেছিলেন। এ বিষয়টি মক্কা বিজয়ের দিন স্পষ্ট হয়েছিলো। কারণ সেদিন জাযিরাতুল আরবে সমস্ত ধর্মের পরাজয় হয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ধর্ম ইসলামেরই একচ্ছত্র বিজয় হয়েছিলো। সমস্ত কুফফার সেদিন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলো। আর এ কথাটিই তাফসীরে রাযীতে এসেছে,
المُرادُ لِيُظْهِرَ الإسْلامَ عَلى الدِّينِ كُلِّهِ في جَزِيرَةِ العَرَبِ وقَدْ حَصَلَ ذَلِكَ فَإنَّهُ تَعالى ما أبْقى فِيها أحَدًا مِنَ الكُفّارِ
ইসলামকে বিজয়ী করার অর্থ হলো, জাযিরাতুল আরবের (আরব উপদ্বীপ) সমস্ত ধর্মের উপর ইসলামকে বিজিত করা। আর এ বিজয় অর্জন হয়েই গেছে। কারণ আল্লাহ তাআলা সেখানে কোন কাফেরকে আর অবশিষ্ট রাখেননি। -তাফসীরে রাযী : খ: ১৬ পৃ: ৪২

এ কথাটি শুধু আমার নয়, এর স্বপক্ষে খোদ হেযবুত তওহীদও লিখেছে-
রসুলুল্লাহ তাঁর জীবদ্দশায় ঐ জাতিকে সঙ্গে নিয়ে জেহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সংগ্রাম) চালিয়ে গেলেন এবং সমগ্র আরব উপদ্বীপ আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থার অধীনে এলো। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৭৫

আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সেই মাপকাঠি রসুল ভেঙে চুরমার করে দিলেন। -সম্মানিত আলেমদের প্রতি : পৃ. ৪

বাস্তবেই আল্লাহর রসুল এমন শান্তি, এমন নিরাপত্তা, ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেলেন । তৎকালীন পৃথিবীর সবচাইতে বিশৃঙ্খল, ঐক্যহীন, আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অন্ধকার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত সেই আরব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। শত্রুকে ভাই বানিয়ে দিলেন। -সূত্রাপুরে এমামের ভাষণ : পৃ. ৭

মক্কা যে রসুলকে একদিন বের করে দিয়েছিল সে মক্কা এই ক্ষণে তাঁর পায়ের তলে। চতুর্দিকে উপরে মুসলিম সেনা কাফেরদের ঘেরাও করে আছে। আল্লাহর রসুলের কৃপার আজ মক্কাবাসীর জীবন। তিনি আজ যাদেরকে জীবন ভিক্ষা দেবেন তারা বাঁচবে, যাদেরকে ঘরে থাকতে দেবেন তারা ঘরে থাকবে, যাদেরকে বাহিরে থাকতে দেবেন তারা বাহিরে থাকবে, রসুলাল্লাহ যাদেরকে আজ লোহিত সাগরে নিক্ষেপ করবেন তারা লোহিত সাগরে নিক্ষিপ্ত হবে। আজকের দিনে মক্কা নগরীতে কারো সাধ্য নেই রসুলাল্লাহর কথাকে অমান্য করে। মক্কায় আজ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের নিরংকুশ বিজয়। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১০৯

সুতরাং পবিত্র কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে মহান রব যে দায়িত্ব নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দিয়েছিলেন, অর্থাৎ জাযিরাতুল আরবে অন্য সব ধর্মের ওপর ইসলামকে বিজয়ী করা, সেটা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্ণ করে গেছেন, যা আমরা উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদিস দ্বারা বুঝতে পারলাম। কিন্তু পন্নী সাহেব এটা বুঝতে সক্ষম হননি, কারণ তিনি আরবীতে নিরক্ষর ছিলেন। আরবিতে নিরক্ষর কোন মানুষ যিনি কুরআন-হাদিস না বুঝে বিশ্বনবী সা. সম্পর্কে এতবড় জঘন্য অপবাদ দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না, তাকে এমাম মেনে আমরা জাহান্নামী হচ্ছি না তো? একটু ভেবে দেখবো সবাই।

অভিযোগ:
‘নবিজি সা. আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করতে পারেননি” বলে যে দাবি হেযবুত তওহীদ করে থাকে, এর স্বপক্ষে তারা আরেকটি আয়াত দাঁড় করাতে চায়। সেটা হলো, মহান আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلّهِ
তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা খতম হয়ে যায় এবং দীন আল্লাহ-র হয়ে যায়। -সুরা বাকারা : ১৯৩

উক্ত আয়াত সামনে রেখে তারা লিখেছে,
যতদিন না সমগ্র মানব জাতি নিজেদের তৈরি জীবনব্যবস্থা সমূহ পরিত্যাগ করে মোহাম্মদের মাধ্যমে প্রেরিত আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োগ করবে ততদিন তারা সেই অমান্তি,অন্যায় (ফাসাদ) ও যুদ্ধ,রক্তপাতের (সাফাকুদ্দিমা) মধ্যে ডুবে থাকবে,আজকের মত এবং ততদিন বিশ্বনবীর ঐ উপাধী অর্থবহ হবে না,অর্থপূর্ণ হবে না এবং আজও হয়নি।তাঁর উম্মাহ ব্যর্থ হয়েছে তাঁর উপাধিকে পরিপূর্ণ অর্থবহ করতে। -আকীদা : পৃ. ২০

অর্থাৎ যেহেতু সকল ফিতনার অবসান করে, দীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত স্বশস্ত্র সংগ্রাম করার দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা তাঁর নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দিয়েছিলেন, কিন্তু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বময় ফিতনার অবসান করার আগেই দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। সুতরাং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পরিপূর্ণ করতে পারেননি।

জবাব:
আসলে এখানে বায়াজীদ খান পন্নী সাহেবের একটি চরম ভুল হয়েছে। তিনি আয়াতটির যথাযথ অর্থ করতে পারেননি এবং বোঝেননি। উক্ত আয়াতটির আসল অর্থ কী সেটা সরাসরি হাদিস শরীফ থেকেই দেখে নেয়া যাক।
عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَتَاهُ رَجُلَانِ فِيْ فِتْنَةِ ابْنِ الزُّبَيْرِ فَقَالَا إِنَّ النَّاسَ صَنَعُوْا وَأَنْتَ ابْنُ عُمَرَ وَصَاحِبُ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَمَا يَمْنَعُكَ أَنْ تَخْرُجَ فَقَالَ يَمْنَعُنِيْ أَنَّ اللهَ حَرَّمَ دَمَ أَخِيْ فَقَالَا أَلَمْ يَقُلْ اللهُ : (وَقٰتِلُوْهُمْ حَتّٰى لَا تَكُوْنَ فِتْنَةٌ) : فَقَالَ قَاتَلْنَا حَتَّى لَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ وَكَانَ الدِّيْنُ لِلهِ وَأَنْتُمْ تُرِيْدُوْنَ أَنْ تُقَاتِلُوْا حَتَّى تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ لِغَيْرِ اللهِ
হযরত ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তাঁর কাছে দুই ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের রা. যুগে সৃষ্ট ফিতনার সময় আগমন করলো এবং বললো, লোকেরা সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আর আপনি উমার রা. এর পুত্র এবং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী! কী কারণে আপনি বের হন না? তিনি উত্তর দিলেন, আমাকে নিষেধ করেছে এই কথা, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা আমার ভাইয়ের রক্ত হারাম করেছেন’। তাঁরা দু’জন বললেন, আল্লাহ কী এ কথাও বলেননি যে, তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো যাবৎ না ফিতনার অবসান ঘটে। তখন ইবনে উমার রা. বললেন, ফিতনার অবসান ঘটার আগ পর্যন্ত আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এবং ফলে দীনও আল্লাহ-র জন্য হয়ে গেছে। আর তোমরা ফিতনা প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করার ইচ্ছা করছো, আর যেন আল্লাহ ব্যতিত অন্যের জন্য দ্বীন হয়ে গেছে। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৫১৩

প্রিয় পাঠক, এখানে আমি মূল যে বিষয়টি বুঝাতে চাচ্ছি, সেটা হলো, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. সুরা বাকারার ১৯৩ নং আয়াতে দেয়া নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর আল্লাহ প্রদত্ব দায়িত্ব বাস্তবায়ণ করেছেন কী না, সেটা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বললেন,
قَاتَلْنَا حَتَّى لَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ وَكَانَ الدِّيْنُ لِلهِ
ফিতনার অবসান ঘটার আগ পর্যন্ত আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এবং ফলে দীনও আল্লাহ-র জন্য হয়ে গেছে। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৫১৩

উক্ত হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, ফিৎনার অবসান ঘটাবার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ করার যে দায়িত্ব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দেওয়া হয়েছিলো, সে দায়িত্ব পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। এটা খোদ ইবনে ওমর রা. নিজেই বলে দিলেন। কিন্তু পুরো পৃথিবীতে সংগ্রাম করে দ্বীন বিজয় করার দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দেননি, বরং যতটুকু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তিনি সেটা সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে করে গেছেন। সুতরাং এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোনো দায়িত্বে অপূর্ণতা ছিল না।

নবিজি সাঃ-এর দায়িত্ব কয়টি?
হেযবুত তওহীদ দাবি করেছে যে,
পৃথিবীতে মানবজাতির মধ্যে আল্লাহর রাসূলকে প্রেরণের উদ্দেশ্যে একটি নয়, দুইটি। একটি রসুলের মাধ্যমে হেদায়াহ, পথ-প্রদর্শনসহ দীন পাঠানো, দ্বিতীয়টি সেই হেদায়াহ ও দীনকে সমগ্র মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। -এসলামের প্রকৃত রূপরেখা : পৃ. ৪৬

অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ৪ টি দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। সেগুলো কী কী তা নিন্মোক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়। মহান রব বলেন,
كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولاً مِّنكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُواْ تَعْلَمُونَ
(এ অনুগ্রহ ঠিক সেই রকমই) যেমন আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য হতে, যে তোমাদের সামনে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমতের তালীম দেয় এবং তোমাদেরকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না। -সুরা বাকারা : ১৫১

অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে চারটি কাজের দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন-
১. কিতাবুল্লাহ পাঠ করে শুনানো।
২. উম্মাহকে আত্মশুদ্ধ করা।
৩. কিতাবুল্লাহ’র শিক্ষা প্রদান করা।
৪. হিকমাহ শিক্ষা দেওয়া।

আর এর প্রত্যেকটি তিনি যথাযথভাবে পালন করে গেছেন। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জিবনে পরিপূর্ণভাবে সফল মহান ব্যক্তি ছিলেন। এটা সবাই মানে ও বিশ্বাস করে, এমনকি ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী’ লেখক মাইকেল এইচ. হার্টের মত একজন অমুসলিমও বিশ্বাস করলেও দাজ্জালের সদস্য পন্নী বিশ্বাস করতে পারল না। বিষয়টা দুঃখজনক।

শেষ নোট:
বলাবাহুল্য হেযবুত তওহীদ লিখেছে (মক্কার কাফের কুরাইশরা যখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বিভিন্ন লোভ দেখালো, তখন তিনি বলেছিলেন,) হয় আল্লাহ আমাকে বিজয়ী করবেন নয়তো মোহাম্মদ এ পথে ধ্বংস হয়ে যাবে। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৬১

এখন প্রশ্ন হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী ধ্বংশ হয়েছিলেন? নিশ্চয় না। তাহলে বলতে হবে তিনি বিজয় হয়েছিলেন। যদি তিনি বিজয়ী হয়েই থাকেন, তাহলে তাঁকে ব্যার্থ বলে হেযবুত তওহীদ স্ববিরোধিতা করছে না তো? শুধু কী তাই, হেযবুত তওহীদ আরও লিখেছে,
নবী প্রেরিত হোয়েছেন সমস্ত দুনিয়ার জন্য। কিন্তু ভবিষ্যৎবাণী যখন করলেন তখন তিনি দুনিয়া বোললেন না যে তোমাদের দিয়ে সারা দুনিয়া বিজয় হবে, বললেন তোমাদের দিয়ে এই দুইটি সাম্রাজ্য বিজয় হবে। সীমিত কোরে দিলেন। বাস্তবেও তাই হোল। -আল্লাহর মোজেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা : পৃ. ৫৮

সেই ক্রীতদাস বেলালকে তিনি (মক্কা বিজয়ের দিন)কাবার উপরে উঠালেন। উঠিয়ে প্রমাণ করে দিলেন মানুষ উর্ধ্বে মানবতা উর্ধ্বে। মানুষকে সর্বোচ্চ আসনে উঠানোর জন্যই তিনি এসেছিলেন। এখানে ঘটেছে রাসূলুল্লাহ রাহমাতাল্লিল আলামিন নামের বহিঃপ্রকাশ। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৫৫

এরপরও কী এ কথা বলা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারেননি? যদি পূর্ণ না হয় তাহলে ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ নামের বহির্প্রকাশ হলো কীভাবে?

সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারেননি’ এমন মন্তব্য করা নিতান্তই তাঁর শানে অপমান করা। অথচ আল্লাহ তাআলা আমাদের নবিকে সম্মান করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
(হে রাসূল!) আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদাদাতা ও সতর্ককারীরূপে। যাতে (হে মানুষ!) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনো এবং তাঁকে সাহায্য করো ও তাঁকে সম্মান করো এবং সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ পাঠ করো। -সুরা ফাতহ : ৮-৯

সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দায়িত্বে ব্যার্থতার দায় চাপিয়ে পন্নী ও তার অনুসারিরা কুফরী করেছে।

মুহাম্মাদ সা. কী রহমাতুল্লিল আলামিন নন?
প্রিয় পাঠক, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হিশাবে পৃথিবিতে আগমন করেছেন। যার সুস্পষ্ট ঘোষণা খোদ আল্লাহ তাআলাই পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন। তাছাড়া একটু আগেও আপনারা দেখলেন যে হেযবুত তওহীদ বলেছে,
সেই ক্রীতদাস বেলালকে তিনি (মক্কা বিজয়ের দিন)কাবার উপরে উঠালেন। উঠিয়ে প্রমাণ করে দিলেন মানুষ উর্ধ্বে মানবতা উর্ধ্বে। মানুষকে সর্বোচ্চ আসনে উঠানোর জন্যই তিনি এসেছিলেন। এখানে ঘটেছে রাসূলুল্লাহ রাহমাতাল্লিল আলামিন নামের বহিঃপ্রকাশ। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৫৫

অর্থাৎ আরব উপত্যকায় যে ইসলামের বিজয় হয়েছিলো, সেটার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ হয়েছিলো এবং সে কারণেই তিনি ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ বলে খোদ হেযবুত তওহীদই স্বীকৃতি দিয়ে বসেছে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
অথচ মেই হেযবুত তওহীদই আবার দাবি করে বসলো, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দায়িত্ব ছিলো পুরো পৃথিবিতে দীন ইসলাম কায়েম করা, আর যেহেতু তিনি তা করে যেতে পারেননি, সেহেতু তারা বলে থাকে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বের জন্য রহমত বা ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ ছিলেন না এবং তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হতেও পারেননি। এমন কি এখনও পর্যন্ত তিনি ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ নন। নাউযুবিল্লাহ। দেখুন তারা কী লিখেছে,
বিশ্বনবীর উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্বকে যারা মাঝপথে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন, তারা আল্লাহর দেওয়া বিশ্বনবীর উপাধি, ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ কেও পূর্ণ হতে দেন নি; অর্থাৎ তিনি এখনও ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ হন নি। -আকিদা : পৃ. ১৯

যতদিন না সমগ্র মানব জাতি নিজেদের তৈরি জীবনব্যবস্থা সমূহ পরিত্যাগ করে মোহাম্মদের মাধ্যমে প্রেরিত আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োগ করবে ততদিন তারা সেই অশান্তি,অন্যায় (ফাসাদ) ও যুদ্ধ,রক্তপাতের (সাফাকুদ্দিমা) মধ্যে ডুবে থাকবে,আজকের মত এবং ততদিন বিশ্বনবীর ঐ উপাধী অর্থবহ হবে না,অর্থপূর্ণ হবে না এবং আজও হয়নি।তাঁর উম্মাহ ব্যর্থ হয়েছে তাঁর উপাধিকে পরিপূর্ণ অর্থবহ করতে। -আকীদা : পৃ. ২০

(যদি) পৃথিবী থেকে অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত বন্ধ হয়ে পূর্ণ শান্তিতে মানবজাতি বাস করতে পারতো, মালায়েকদের আশংকা মিথ্যা হতো, ইবলিসের মাথা নত হয়ে যেতো, বিশ্বনবীকে আল্লাহর দেয়া রহমাতাল্লিল আলামিন উপাধির অর্থ পূর্ণ হতো। -বিকৃত সুফিবাদ : পৃ. ৪৫

অর্থাৎ তাদের দাবি অনুযায়ী পুরো বিশ্বে যেহেতু দীন প্রতিষ্ঠা হয়নি, অতএব নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখনও বিশ্ববাসীর জন্য রহমত বা রহমাতুল্লিল আলামিন হতে পারেননি।

ইসলাম কী বলে?
এক. রাসুলুল্লাহ সা. সমস্ত বিশ্বের জন্য রহমত। এটা আমার কথা নয়, বরং মহান রবই এ কথার ঘোষণা দিয়েছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
(হে নবি!) আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য কেবল রহমত করেই পাঠিয়েছি। -সুরা আম্বিয়া : ১০৭

অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন বলেন,
لَقَدْ جاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ ما عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَؤُفٌ رَحِيمٌ
(হে মানুষ!) তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসুল এসেছে। তোমাদের যে-কোনো কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সত্য তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু। -সুরা তাওবা : ১২৮

উক্ত আয়াত দু’টি নিয়ে সাধারণ জ্ঞান দিয়ে ভাবলেও স্পষ্ট বুঝে আসবে যে, মহান আল্লাহ বলেছেন যে, আমি আপনাকে রহমত স্বরুপ পাঠিয়েছি। তার অর্থ হলো, আল্লাহ তাআলা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে যখন প্রেরণ করেছেন, তিনি তখন থেকেই রহমত স্বরূপ। পাশাপাশি হযরত আবু উমামা রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
إنَّ اللهَ بَعَثَني رَحمةً للعالمينَ وهُدًى للعالمينَ
আল্লাহ তাআলা আমাকে ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ করে পাঠিয়েছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ২২৩০৭

উপরোল্লিখিত আয়াত এবং হাদিসগুলো থেকে প্রমাণিত হলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ ছিলেন তখনও, যখন ইসলাম পুরো বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়নি, পুরো দুনিয়ায় রক্তপাত বন্ধ হয়নি, তারপরও আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিশ্ববাসীর জন্য “রহমত” সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কিন্তু ১৪’শ বছর পর যখন ইসলাম পৃথিবীর রন্দ্রে রন্দ্রে পৌঁছে গেছে, সেসময় এসে ‘এখনও নবজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হতে পারেননি’ এ কথাটি কী সাহাবায়ে কেরাম রা. ও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনকি আল্লাহ তাআলা-র সাথে চরম বিদ্বেষ লালনের প্রমাণ নয়? তাছাড়া হযরত যাকওয়ান রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
يا أيها الناسُ إنما أنا رحمةٌ مُهداةٌ
হে মানবজাতি, নিশ্চয় আমি (তোমাদের জন্য) রহমত স্বরুপ, সত্য পথের সন্ধানদাতা। -কানযুল উম্মাল : খ. ২ পৃ. ২৯০

হযরত সালমান রা. নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি ভাষণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
أنَّ رسولَ اللهِ ﷺ خَطَبَ فقال أيُّما رَجُلٍ مِن أُمَّتي سَبَبْتُه سَبَّةً في غَضَبي أو لَعَنْتُه لَعْنةً فإنَّما أنا مِن وَلَدِ آدَمَ أغضَبُ كما يَغْضَبون وإنَّما بَعَثَني رَحمةً للعالَمينَ فاجْعَلْها صلاةً عليه يومَ القِيامةِ
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ভাষণে বলেন, রাগের সময় যদি আমি আমার উম্মতদের কাউকে ভাল-মন্দ বলি অথবা লা’নত করি। তাহলে যেনে রেখো, আমিও আদম সন্তান। আমারও রাগ হতে পারে যেমন তোমরা রাগ কর। তবে আল্লাহ তা’আলা আমাকে ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ করে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা যেন আমার এই শব্দগুলোকে (ভালো-মন্দ বলা, লা’নত করা) তাদের জন্য কেয়ামতে রহমতে পরিবর্তন করে দেয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ৪৬৫৯

উক্ত হাদীসগুলোতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কামনার দিকে খেয়াল করুন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেকে যখন ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ বলে দাবি করলেন, তখন তিনি জিবিত। অতএব হাদিসগুলো থেকে বুঝা গেল নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকালের বহু আগ থেকেও রহমত। সুতরাং যেখানে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই নিজেকে ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ বলে দাবি করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম রা. তাঁকে ‘রহমতুল্লিল আলামিন’ বলে স্বীকার ও বিশ্বাস করতেন, এমনকি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ করে পাঠিয়েছেন বলে স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই ঘোষণা করলেন, সেখানে পন্নী সাহেব দাবি করলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখনও ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হতে পারেননি। কতবড় ধৃষ্টতা! কতবড় সীমালঙ্ঘন! ভাবা যায়?

তাছাড়া মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ এর পূর্ণতা পেয়েছে বলে খোদ হেযবুত তওহীদও স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছে,
সেই ক্রীতদাস বেলালকে তিনি (মক্কা বিজয়ের দিন)কাবার উপরে উঠালেন। উঠিয়ে প্রমাণ করে দিলেন মানুষ উর্ধ্বে মানবতা উর্ধ্বে। মানুষকে সর্বোচ্চ আসনে উঠানোর জন্যই তিনি এসেছিলেন। এখানে ঘটেছে রাসূলুল্লাহ রাহমাতাল্লিল আলামিন নামের বহিঃপ্রকাশ। -প্রিয় দেশবাসী : পৃ. ৫৫

এছাড়াও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে  তারা ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ বলে স্বীকার করেছে। -ধর্মব্যবসার ফাঁদে : পৃ. ১২৭; সূত্রাপুরে এমামের ভাষণ : পৃ. ৮; ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে : পৃ. ২৬

এরপরও ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হননি’ বলে যে বক্তব্য হেযবুক তওহীদ দিয়েছে, তা তাতেে স্ববিরোধিতা।

সমগ্র বিশ্ব ইসলাম মানলে তবেই তিনি রহমত?
হেযবুত তওহীদ বুঝাতে চায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখনই ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হবেন, যখন সবাই ইসলাম মেনে শান্তিতে বসবাস করবে। দেখুন তারা লিখেছে,
আল্লাহ তাঁর কোর’আনে তাঁর শেষ রসুলকে রহমাতুল্লিল আ’লামিন বলেছেন (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭) । অর্থাৎ শেষ নবী মোহাম্মদ (দ.) সমস মানবজাতির জন্য আল্লাহর প্রেরিত রহমত । যারা তাঁকে এবং তাঁর মাধ্যমে প্রেরিত দীন, জীবন-ব্যবস্থা মেনে নিয়ে সেটাকে তাদের জীবনে কার্যকর করবে শুধু তাদের জন্যই তিনি আল্লাহর রহমত । আল্লাহ বলেছেন তিনি তাঁর রসুলকে সমস্ত মানবজাতির জন্য রহমত হিসাবে প্রেরণ করেছেন- কাজেই এক সময় সমস্ত মানবজাতি তাঁকে আল্লাহর রসুল হিসাবে মেনে নিয়ে তার মাধ্যমে পাওয়া দীনুল হক (সঠিক জীবন-ব্যবস্থা) তাদের জীবনে কার্যকর, প্রতিষ্ঠা করবে । তা না হলে আল্লাহর দেয়া রহমাতুল্লিল আ’লামিন উপাধি অর্থহীন হয়ে যায়। -দাজ্জাল : পৃ. ৭৫

আল্লাহ আমার প্রিয় নবীর (সা.) টাইটেল দিয়েছেন রাহমাতাল্লিল আলামিন, সমস্ত বিশ্ব জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ, বরকতস্বরূপ…সমস্ত মানবজাতি যখন শান্তি, ন্যায় এবং সুবিচারের মধ্যে থাকবে তবেই তো আমার রাসুল হবেন রহমতাল্লিল আলামিন। -সূত্রাপুরে এমামের ভাষণ : পৃ. ১১

জবাব:
যাঁকে মহান রব নিজে ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ বলে প্রেরণ করার কথা বলেছেন, তিনি সে রহমত হতে কোনো কিছুর জন্য মুখাপেক্ষী নন। কে ঈমান আনলো, কে আনলো না, এটা “রহমাতুল্লিল আলামিন’ হওয়াতে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম নয়। তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবার জন্য রহমত। যেমন ঈমানদারদের জন্য, তেমনি বেঈমানদের জন্যও। কারণ আল্লাহপাক তাঁর নবি-এর ব্যাপারে ব্যাপকভাবে বলেছেন,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
(হে নবি!) আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য কেবল রহমত করেই পাঠিয়েছি। -সুরা আম্বিয়া : ১০৭

উপরিউক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন-
كَانَ مُحَمَّدٌ ﷺ رَحْمَةً لِجَمِيعِ النَّاسِ
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত মানুষের জন্য রহমত স্বরুপ ছিলেন। -তাফসীরে কুরতুবী : খ. ১১ পৃ. ৩০৫

আরও স্পষ্ট করে অন্যত্র এসেছে, হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
من آمن بالله ورسوله فله الرحمة فِي الدنيا والآخرة وَمِنَ لم يؤمن بالله ورسوله عوفي أن يصيبه ما كان يصيب الأمم قبل ذلك فهو رحمة للمؤمنين والكافرين
যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনবে, নবি সা. তার জন্য দুনিয়া এবং আখেরাতে রহমত স্বরুপ। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের সা. প্রতি ঈমান আনবে না, তার জন্য পূর্ববর্তী উম্মতের উপর আসা গজবের মত বিপদ থেতে বাঁচিয়ে দেয়া হবে। সে হিসেবে নবীজি সা. মুমিন এবং কাফের সবার জন্য রহমত স্বরুপ। -তাফসীরে সামারকন্দী : খ. ২ পৃ. ৩৮২

এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে আল্লামা জামাল উদ্দীন, আব্দুর রহমান বিন আলী আল জাওযী আল কুরাইশি রহি. বলেন,
قوله تعالى ‘وما أرسلناكَ إِلا رحمة للعالَمين’ قال ابن عباس هذا عامّ للبَرِّ والفاجر
ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সা. এর ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ হওয়াটা নেককার এবং বদকার সকলের জন্যই ব্যাপক। -তাফসীরে জাদুল মুয়াসসার :  খ. ৪ পৃ. ৩৬৫

সুতরাং বুঝা গেলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবার জন্য রহমত স্বরূপ ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তাছাড়া পবিত্র হাদিসে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
قِيلَ يا رَسُولَ اللهِ ادْعُ على المُشْرِكِينَ قالَ إنِّي لَمْ أُبْعَثْ لَعّانًا وإنَّما بُعِثْتُ رَحْمَةً
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলা হলো, হে আল্লাহর রসুল, আপনি মুশরিকদের ব্যাপারে বদদুআ করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি অভিশাপকারী হিশেবে দুনিয়াতে আসিনি, এসেছি রহমত স্বরুপ। -সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ২৫৯৯

উক্ত হাদিস নিয়ে একটু ভাবলেই স্পষ্ট হবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবদ্দশায়ও কাফেরদের জন্যও রহমতস্বরুপ ছিলেন। কেননা তিনি মুশরিকদের জন্য বদদোয়া করেননি এবং বদদোয়া না করার জন্য তিনি কারণ হিসেবে উল্লেখ্য করলেন যে ‘আমি রহমত স্বরুপ এসেছি।’ যদি তিনি কাফেরদের জন্যও রহমত স্বরুপ না থাকতেন, তাহলে তিনি কারণ হিসেবে ”আমি রহমত স্বরুপ” বাক্যটি বলতেন না। এটা সাধারণ জ্ঞান (common sense) থাকলেও বোঝা যায়।

যুক্তি কী বলে?
আমরা সবাই জানি পানি মানুষের পিপাসা নিবারণ করে, কিন্তু যদি কেউ পানি পান না করে, তাহলে পানির কার্যকরী ক্ষমতা কী নষ্ট হয়ে যায়? নিশ্চয় না। পানি তৃষ্ণা নিবারণকারী সব সময়ের জন্যই, যে পান করবে, সে ফল পাবে, যে করবে না, সে ফল পাবে না। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন রহমত যে, তাঁকে যারা মানে না, তারাও তাঁর ওসীলায় রবের দয়ায় দুনিয়ায় গজব থেকে বেঁচে থাকে।  আমার এ যুক্তির সাথে হেযবুত তওহীদেরও সহমত পাওয়া যায় তাদের বইয়ে। দেখুন কী লিখেছে,
এই জীবনব্যবস্থাও (ইসলাম) পৃথিবীর সর্বত্র প্রযোজ্য, প্রয়োগযোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিদায়ক। এজন্যই আখেরি নবী বিশ্বনবী মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.) এর উপাধি আল্লাহ দিয়েছেন রহমাতাল্লিল আলামিন। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৭২

সুতরাং সারাবিশ্ব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে না মানলেও তিনি সবার জন্য রহমত এটাই চুড়ান্ত সত্য।

অভিযোগ:
‘নবিজি সাঃ এখনও রহমাতুল্লিল আলামিন হন নি’ বলে হেযবুত তওহীদ যে দাবি করেছে, তার কারণ হিসাবে তারা লিখেছে যে, নবিজি সাঃ-কে পাঠানো হয়েছে সারা দুনিয়ার প্রত্যেকটি মানুষের জন্য ও সর্বত্র দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করে সমস্ত রক্তপাত বন্ধ করার জন্য। অতএবং যতদিন রক্তপাত বন্ধ না হচ্ছে ততদিন তিনি ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হতে পারেন না। দেখুন তারা লিখেছেন-
তিনি আল্লাহ থেকে আদেশ প্রাপ্ত হোয়ে নিজের দায়িত্ব ঘোষণা কোরলেন, আমি আদিষ্ট হোয়েছি ততক্ষণ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম (কেতাল) চালিয়ে যেতে, যে পর্যন্ত না প্রত্যেকটি মানুষ আল্লাহকে তাদের একমাত্র এলাহ হিসাবে এবং আমাকে আল্লাহর রসুল হিসাবে মেনে না নেয় [আব্দুল্লাহ এবনে ওমর (রাঃ) থেকে- বোখারী)। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট হোল যে, রসুলাল্লাহর দায়িত্ব সমগ্র মানবজাতির উপরে, পুরো মানবজাতির জন্যই তিনি রহমত, তাই তাঁর উপাধিও আল্লাহ ছিলেন রাহমাতাল্লিল আলামীন। -এসলাম শুধু নাম থাকবে : পৃ. ৯৯

এখানে তারা বুঝাতে চাচ্ছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর দায়িত্ব ছিল, পুরো বিশ্বের প্রত্যেকটি মানুষ যতক্ষন না আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মেনে না নেবে, ততক্ষণ তরবারীর যুদ্ধ করতে তিনি আদিষ্ট ছিলেন। অর্থাৎ বেঈমানরা হয়তো ঈমান আনবে, নইলে নবিজি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ঈমানের পথকে বিজয়ী করতে পারতেন, তাহলেই তিনি ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হতে পারতেন। কিন্তু তিনি ইন্তেকালের আগে শুধু আরব ভূ-খন্ডটি বিজয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন, পুরো বিশ্বে সক্ষম হননি। সেহেতু তিনি বিশ্বের জন্য রহমত হতে পারেননি।

জবাব:
চলুন প্রথমে তাদের উল্লেখিত হাদিসটি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ
আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য নির্দেশিত হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ্ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসুল। -সহিহ বুখারী, হাদিস নং : ২৫

উক্ত হাদিসে বুঝা যাচ্ছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে পৃথিবীর সমস্ত কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আদৌ কি বিষয়টি এমন? না। বিষয়টি বুঝতে উক্ত হাদিসটির প্রেক্ষাপট জানতে হবে। কারণ কুরআন শরীফের অনেক আয়াত নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট থাকে, যাকে শানে নুযুল বলা হয়। ঠিক তেমনি হাদিসেরও প্রেক্ষাপট থাকে। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদিসটি বলারও প্রেক্ষাপট থাকে। যাকে ‘শানে উরুদ’ বলা হয়। উক্ত হাদিসটিরও শানে উরুদ রয়েছে। হাদিসটির শানে উরুদ হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَوْمَ خَيْبَرَ لأُعْطِيَنَّ هَذِهِ الرَّايَةَ رَجُلاً يُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يَفْتَحُ اللَّهُ عَلَى يَدَيْهِ ‏قَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ مَا أَحْبَبْتُ الإِمَارَةَ إِلاَّ يَوْمَئِذٍ قَالَ فَتَسَاوَرْتُ لَهَا رَجَاءَ أَنْ أُدْعَى لَهَا قَالَ فَدَعَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلِيَّ بْنَ أَبِي طَالِبٍ فَأَعْطَاهُ إِيَّاهَا وَقَالَ ‏امْشِ وَلاَ تَلْتَفِتْ حَتَّى يَفْتَحَ اللَّهُ عَلَيْكَ ‏قَالَ فَسَارَ عَلِيٌّ شَيْئًا ثُمَّ وَقَفَ وَلَمْ يَلْتَفِتْ فَصَرَخَ يَا رَسُولَ اللَّهِ عَلَى مَاذَا أُقَاتِلُ النَّاسَ قَالَ ‏قَاتِلْهُمْ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ فَقَدْ مَنَعُوا مِنْكَ دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّهَا وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাইবারের দিন বললেন, নিশ্চয়ই আমি ঐ ব্যক্তির হাতে পতাকা তুলে দেবো, যে লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসে। তাঁর হাতেই আল্লাহ তাআলা বিজয় দেবেন। উমর রা. বলেন, শুধু ঐ দিনটি ব্যতিত আমি কখনো নেতৃত্ব লাভের আশা করিনি। এ প্রত্যাশা নিয়ে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট গেলাম, হয়তো এ কাজের জন্য আমাকে ডাকা হতে পারে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিবকে রা. ডেকে তাঁর হাতে পতাকা তুলে দিলেন এবং বললেন, অগ্রসর হও, এদিক-ওদিক দৃষ্টি দিও না, যতক্ষণ আল্লাহ তাআলা তোমাকে বিজয় দেন। অতঃপর হযরত আলী রা. সামান্য অগ্রসর হয়ে থামলেন, এদিক-সেদিক দেখেননি। এরপর চিৎকার করে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, কোন কথার উপর আমি লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃতপক্ষে আর কোনো ইলাহ নেই, আর নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসুল। যখনই তারা এ সাক্ষ্য প্রদান করবে, তখনই তারা তাদের প্রাণ ও ধন-মাল তোমার হাত হতে মুক্ত করে ফেলবে। তবে কোন প্রাপ্য অধিকারের প্রশ্নে মুক্ত হবে না। আর তাদের হিসাব আল্লাহর নিকট। -সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ২৪০৫

প্রিয় পাঠক, আপনিই ভেবে বলুন তো, হাদিসটি কি পৃথিবির সমস্ত কাফেরদের ব্যাপারে বলা হয়েছিলো? নিশ্চয় না। এজন্য হাদিস বিশারদগণ বলেন,
وان المراد بهذا مشركو العرب و اهل الاوثان ومن لا يؤحد وهم كانوا اول من دعي الي الاسلام وقوتل عليه
এ হাদিসের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, তৎকালীন সময়ের আরবের মুশরিকরা ও মূর্তিপূজারীরা এবং যারা তাওহীদের স্বীকৃতি দেয়নি তারা। কারণ তারাই প্রথম যাদেরকে প্রথমে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল এবং হত্যা করা হয়েছিল। -উমদাতুল ক্বারী : খ. ৮ পৃ. ৩৫৩

সুতরাং ইবনে ওমর রা. এর বুখারীর হাদিসের প্রেক্ষাপট থেকে বুঝা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন, সেটা ছিলো খায়বারের আরবের দুষ্ট মুশরিকদের বিরুদ্ধ। সারা দুনিয়ার সকল মুশরিকদের বিরুদ্ধে নয়। হাদিসটির প্রেক্ষাপট না জেনে, হাদিসটির মর্মার্থ না বুঝে ‘সারা দুনিয়ার কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করে মুসলিম বিশ্ব ইসলাম কায়েম করা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দায়িত্ব এবং সেটা হলেই তিনি ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হবেন’ এমনটা বলা স্পষ্ট মূর্খতা এবং ‘যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটা করে যেতে পারেননি বলে তিনি এখনও ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হতে পারেননি’ এমনটি বলা কুরআন-হাদিসের সুস্পষ্ট বিরোধিতা। যাহোক, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবিবাসীসহ সকল জগতের জন্য রহমত। এটা যারা অস্বীকার করে, তারা আর যাই হোক মুসলিম হতে পারে না।

তাহলে পন্নী কী সমগ্র জাহানের এমাম?
হেযবুত তওহীদ দাবি করেছে,
এ যামানার এমাম, The Leader of the Time, এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। যেহেতু তিনিই সমস্ত মানবজাতিকে আল্লাহর তওহীদের দিকে আহ্বান কোরেছেন কাজেই তিনি কেবল মোসলেম উম্মাহর এমাম নন, তিনি বিশ্ববাসীর এমাম। -এ জাতির পায়ে লুটিয়ে পড়বে বিশ্ব : পৃ. ৩৯
প্রশ্ন হলো, হেযবুত তওহীদের দাবি ছিলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা বিশ্বের জন্য রহমত হতে পারেন তখনই, যখন সবাই তাঁকে মেনে নিয়ে শান্তির সমাজ গঠণ করবে। এর আগে তিনি রহমাতুল্লিল আলামিন হতে পারবেন না’। তাহলে আমার প্রশ্ন হলো, যে পন্নী সাহেব নিজেকে ‘এমামুযযামান তথা যামানার এমাম’ হিশাবে দাবি করেছেন এবং তার অনুসারিরা তাকে বিশ্ববাসীর এমাম বলে মেনে নিয়েছে, অথচ দুনিয়াময় এখনও অশান্তি বিরাজ করছে। উপরন্তু হাতেগোনা কয়েকজন লোক ছাড়া বিশ্ববাসী তাকে এমাম হিশাবে মেনে নেয়নি। মুষ্টিময় কিছু লোক তাকে অনুসরন করার কারণেই যদি সে ‘যামানার এমাম’ হতে পারে, তাহলে পৌনে দুই’শ কোটি মুসলিম যাঁকে মেনে নিলেন, সেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হতে পারেননি, এমন দাবি করা কী এক চোখা দাজ্জালের অনুসরণের প্রমাণ নয়? যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এতো অনুসারী হওয়ার পরও তিনি ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ হতে না পারেন, তাহলে পন্নী সাহেবও ‘যামানার এমাম’ হতে পারে না।

ইহুদিদের কিতাব দিয়ে রাসুলুল্লাহ সা. বিচার করেছেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মহান আল্লাহ নিজেই পবিত্র কুরআন দিয়ে বিচার করতে বলেছেন এবং তিনিও সদাসর্বদা কুরআন দিয়েই বিচার করতেন।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো,
মহানবী মোহাম্মদ (দ:) যখন মদীনায় রাষ্ট্রগঠন করলেন তিনি ইহুদি বা খ্রিস্টানদের উপর কোর’আনের বিধি-বিধান চাপিয়ে দেন নি। এবং ইহুদিরাও আল্লাহর রসুলকে শাসক হিসাবে মেনে নিলেও বিচারক হিসাবে মেনে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আল্লাহর রসুলও তাদেরকে তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী তওরাতের বিধান দিয়েই বিচার করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তওরাতে যে বিধান দিয়েছেন, সেই বিধান যদি ইহুদিরা মান্য করে সেটাই যথেষ্ট। বরঞ্চ আল্লাহ সেদিকেই তাদেরকে আহ্বান করেছেন, কোর’আন মানতে হুকুম করেন নি। কারণ তওরাতও আল্লাহরই হুকুম। -হেযবুত তওহীদের ওয়েবসাইটে ‘আল্লাহর পছন্দনীয় ধর্ম কোনটি’? শিরোনামে লেখা প্রবন্ধ।

ইসলাম কী বলে?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-সদাসর্বদা পবিত্র কুরআন দিয়ে বিচার কার্যত্রম চালাতেন। মহান আল্লাহপাক তাঁকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ وَلا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا
নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি সত্য-সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছি, যাতে আল্লাহ তোমাকে যে উপলব্ধি দিয়েছেন, সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে মীমাংসা করতে পারো। আর তুমি খেয়ানতকারীদের পক্ষাবলম্বনকারী হয়ো না। -সুরা নিসা : ১০৫

যেখানে কুরআন দিয়ে বিচার করার দায়িত্ব খোদ আল্লাহপাক তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে নির্দেশ দিয়েছেন, এরপরও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ইহুদীদের বিচার তওরাত দিয়ে করেছেন? এটা শয়তানেও বিশ্বাস করবে? ভালোভাবে বুঝার জন্য হাদিসে বর্ণিত নিন্মোক্ত ঘটনাটি দেখুন-
أن عمر بن الخطاب أتى النبي صلى الله عليه و سلم بكتاب أصابه من بعض أهل الكتاب فقال يا رسول الله إني أصبت كتابا حسنا من بعض أهل الكتاب قال فغضب وقال امتهوكون فيها يا بن الخطاب فوالذي نفسي بيده لقد جئتكم بها بيضاء نقية لا تسألوهم عن شيء فيخبروكم بحق فتكذبوا به أو بباطل فتصدقوا به والذي نفسي بيده لو كان موسى حيا ما وسعه إلا أن يتبعني
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. নবিজি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খেদমতে কোনো এক আহলে কিতাব (ইহুদীদের) থেকে একটি কিতাব নিয়ে আসলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি একজন আহলে কিতাব থেকে একটি সুন্দর কিতাব পেয়েছি। বর্ণনাকারী বলেন, নবিজি (হযরত উমর রা. এই কিতাব দেখে) রাগান্বিত হয়ে গেলেন এবং বললেন, হে উমর ইবনে খাত্তাব, তোমরা কী তাতে হয়রান হয়ে পড়েছো? যাঁর কুদরতি হাতে আমার প্রাণ তার কসম! নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল দীন নিয়ে এসেছি। তাদেরকে কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। তাহলে তারা সত্য সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করবে, আর তোমরা তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। অথবা মিথ্যা সম্পর্কে অবহিত করবে, আর তোমরা তা সত্য বলে মেনে নেবে। যেই সত্ত্বার হাতে আমার প্রাণ, সেই যাতের কসম! যদি হযরত মুসা আ. জিবিত থাকতেন, তাহলে তাঁর পক্ষেও আমার দীনের অনুসরণ ব্যতীত আর কোনো সুযোগ থাকতো না। -মুসনাদে আহমাদ : হাদিস নং : ১৫১৫৬

এই হাদিসের আলোকে বুঝা গেলো, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-অন্য ধর্মের কিতাব দেখে রাগান্বিত হয়েছেন। হাদিসের শেষে একথাও তিনি বলেছেন, হযরত মুসা আ. যদি জিবিত থাকতেন, তাহলে তার জন্যও আমার ধর্মের অনুসরন করা ব্যতীত অন্য কোনো সুযোগ থাকতো না।
পাশাপাশি হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেন,
لا تسألوا أهلَ الكتابِ عن شيءٍ فإنهم لن يهدوكم وقد ضلُّوا
তোমরা আহলে কিতাবদের কাছে কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। কারণ তারা তোমাদের সঠিক তথ্য দিতে পারবে না। তারা নিজেরাই তো পথভ্রষ্ট। -মাজমাউয যাওয়ায়েদ : খ. ১ পৃ. ১৭৯

এসব হাদিস থাকার পরও কী এটা বলা যায় যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওরাত দিয়ে বিচার করতেন? এটা কী নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আল্লাহ-র অবাধ্য হিশাবে আখ্যায়িত করার নামান্তর নয়?

অভিযোগ:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ الْيَهُوْدَ جَاءُوْا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرُوْا لَهُ أَنَّ رَجُلًا مِنْهُمْ وَامْرَأَةً زَنَيَا فَقَالَ لَهُمْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَا تَجِدُوْنَ فِي التَّوْرَاةِ فِيْ شَأْنِ الرَّجْمِ فَقَالُوْا نَفْضَحُهُمْ وَيُجْلَدُوْنَ فَقَالَ عَبْدُ اللهِ بْنُ سَلَامٍ كَذَبْتُمْ إِنَّ فِيْهَا الرَّجْمَ فَأَتَوْا بِالتَّوْرَاةِ فَنَشَرُوْهَا فَوَضَعَ أَحَدُهُمْ يَدَهُ عَلَى آيَةِ الرَّجْمِ فَقَرَأَ مَا قَبْلَهَا وَمَا بَعْدَهَا فَقَالَ لَهُ عَبْدُ اللهِ بْنُ سَلَامٍ ارْفَعْ يَدَكَ فَرَفَعَ يَدَهُ فَإِذَا فِيْهَا آيَةُ الرَّجْمِ فَقَالُوْا صَدَقَ يَا مُحَمَّدُ فِيْهَا آيَةُ الرَّجْمِ فَأَمَرَ بِهِمَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَرُجِمَا قَالَ عَبْدُ اللهِ فَرَأَيْتُ الرَّجُلَ يَجْنَأُ عَلَى الْمَرْأَةِ يَقِيْهَا الْحِجَارَةَ
ইয়াহুদীরা আল্লাহ-র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে এসে বললো, তাদের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা ব্যভিচার করেছে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা সম্পর্কে তাওরাতে কী বিধান পেয়েছো? তারা বলল, আমরা এদেরকে অপমানিত করবো এবং তাদের বেত্রাঘাত করা হবে। আবদুল্লাহ ইবনু সালাম রা. বললেন, তোমরা মিথ্যা বলছো। তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার বিধান রয়েছে। তারা তাওরাত নিয়ে এসে বাহির করলো এবং প্রস্তর হত্যা করা সম্পর্কীয় আয়াতের উপর হাত রেখে তার আগের ও পরের আয়াতগুলি পাঠ করলো। আবদুল্লাহ ইবনু সালাম রা. বললেন, তোমার হাত সরাও। সে হাত সরালো। তখন দেখা গেলো, প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করার আয়াত আছে। তখন ইয়াহুদীরা বললো, হে মুহাম্মাদ! তিনি সত্যই বলছেন। তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার আয়াতই আছে। তখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্তর নিক্ষেপে দু’জনকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। আবদুল্লাহ রা. বলেন, আমি ঐ পুরুষটিকে মেয়েটির দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখেছি। সে মেয়েটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। -সহিহ বুখারী : হাদিস নং : ৩৬৩৫

উক্ত হাদিসটা উল্লেখ্য করে হেযবুত তওহীদ বুঝাতে চায়, ইহুদীদেরকে তাওরাতের বিধান দিয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার করেছেন।

জবাব:
উপরিউক্ত ঘটনায় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধুমাত্র ইহুদীদেরকে বিবাহিত ব্যাভিচারীদের ব্যাপারে আল্লাহর বিধান রজম তথা পাথর মেরে হত্যা করা হবে, এটা স্বরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তাওরাত অনুযায়ী বিচার করেননি। কারণ ইসলামী আইনেও বিবাহিত ব্যাভিচারীদের ব্যাপারে রজমের হুকুম বিদ্যমান ছিলো। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الشيخُ والشيخةُ إذا زَنَيا فارْجُموهُما البَتَّةَ
বিবাহিত ও বিবাহিতা যদি যিনা-ব্যভীচারে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের উভয়কে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলো। -মুসনাদে আহমাদ : হাদিস নং : ২১৫৯৬

সুতরাং এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও ইসলামের বাহিরে গিয়ে অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ দিয়ে তিনি বিচার করেননি। সুতরাং যে ধর্মগ্রন্থগুলো বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো এখনও পালন করা যাবে, এটা নিছক মূর্খতা ও ইসলাম অবমাননার শামিল। এসব বক্তব্য দিয়ে মূলত তারা জাতিকে বেঈমান বানানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত।

পন্নীর চেয়ে মুহাম্মাদ সা. এর এরিয়া কম?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মহান আল্লাহ প্রেরণ করেছেন সমস্ত বিশ্বসমূহের জন্য রহমত করে। আর তাঁর আনীত দীন একদিন পুরো বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে বলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসেই বলে দিয়েছেন।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
কুফরী সংগঠণ হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা বায়াজীদ খান পন্নী দাবি করে বসলো এক ভয়ঙ্কর কথা। দেখুন তারা কী বলে-
নবী প্রেরিত হোয়েছেন সমস্ত দুনিয়ার জন্য। কিন্তু ভবিষ্যৎবাণী যখন করলেন তখন তিনি দুনিয়া বোললেন না যে তোমাদের দিয়ে সারা দুনিয়া বিজয় হবে, বললেন তোমাদের দিয়ে এই দুইটি সাম্রাজ্য বিজয় হবে। সীমিত কোরে দিলেন। বাস্তবেও তাই হোল। আর সেদিন (০২/০২/০৮) আল্লাহ নিজে যে মোজেজা কোরলেন, সেদিন আমাকে দিয়ে বলালেন ‘দুনিয়া’, এবং ‘তোমাদের দিয়ে’ না বলিয়ে বলালেন হেযবুত তওহীদ দিয়ে। পার্থক্যটা বুঝে নিও। রসূল বোললেন, ‘তোমাদের দিয়ে’ আর ‘পুরো পৃথিবী’ বোললেন না, সীমিত রাখলেন, আর আল্লাহ আমাকে দিয়ে ‘তোমাদেরকে দিয়ে বলালেন না’, বলালেন হেযবুত তাদওহীদ দিয়ে’, কিন্তু কোন সীমানা রাখলেন না বোললেন ‘সারা পৃথিবী’। -আল্লাহর মোজেজা হেযবুত তওহীদের বিজয় ঘোষণা : পৃ. ৫৮

সারা দুনিয়ায় সত্যদীন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বশর্তই হচ্ছে দাজ্জালের ধ্বংস। যেহেতু মোজেজা সংগঠন করে আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে হেযবুত তওহীদ কে আল্লাহ সারা দুনিয়ায় সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য মনোনীত করেছেন। সুতরাং হেজবুত তাওহীদের মাধ্যমেই যে দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদী-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র পতন হবে সেটাও সুস্পষ্ট হয়ে যায়। -মহাসত্যের আহ্বান : পৃ. ২৪

অচিরেই আল্লাহর সত্যদীন এই হেযবুত তওহীদের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে এনশা’আল্লাহ। সুতরাং আজ যে অশান্তিময় পরিবেশে আমরা বসবাস কোরছি তার সমাপ্তি ঘোটতে যাচ্ছে। এবার আল্লাহর রসুলের প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী আবার জেগে উঠবে, এই জাতির কালঘুম টুটবে। মানবজাতির সামনে আবার নতুন কোরে উদ্ভাসিত হবে নবসভ্যতার সূর্য। আল্লাহর রসুলের নাম ‘রহমাতাল্লেল আলামীন’ বাস্তবে স্বার্থকতা লাভ কোরবে। -শোষণের হাতিয়ার : পৃ. ৬১

অর্থাৎ পন্নী সাহেবের দাবি হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এরিয়া সীমিত আর হেযবুত তওহীদের এরিয়া পুরো পৃথিবিময় এবং পৃথিবির সর্বত্র ইসলাম বিজয় হবে হেযবুত তওহীদের মাধ্যমেই। নাউযুবিল্লাহ। কতবড় স্পর্ধা! ভাবা যায়?

ইসলাম কী বলে?
উদ্ভট এক মিথ্যা মু’জিজা সাজিয়ে খোদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেয়ে বড় দায়িত্ব প্রাপ্তীর দাবি কী কোনো মুসলমানের সন্তান করতে পারে? জনাব পন্নী দাবি করেছে, রাসুলুল্লাহ সা. নাকি পুরো বিশ্বে তাঁর দ্বীন পৌঁছাবে এমন কোনো কথা বলে যান নি। কতবড় মূর্খতা! কতবড় ধৃষ্টতা! অথচ রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَا يَبْقَى عَلَى ظَهْرِ الْأَرْضِ بَيْتُ مَدَرٍ وَلَا وَبَرٍ إِلَّا أَدْخَلَهُ اللَّهُ كلمة الاسلام بعز عَزِيز أَو ذل ذليل إِمَّا يعزهم الله عز وَجل فَيَجْعَلُهُمْ مِنْ أَهْلِهَا أَوْ يُذِلُّهُمْ فَيَدِينُونَ لَهَا
এ জমিনের উপর এমন কোন মাটির অথবা পশমের ঘর (তাঁবু) বাকী থাকবে না, যে ঘরে আল্লাহ রব্বুল ’আলামীন ইসলামের বাণী পৌঁছিয়ে দিবেন না। সম্মানীর ঘরে সম্মানের সাথে আর লাঞ্ছিতের ঘরে লাঞ্ছনার সাথে তা পৌঁছাবেন। আল্লাহ তা’আলা যাদেরকে সম্মানিত করবেন তাদেরকে স্বেচ্ছায় ইসলাম কবূলের উপযুক্ত করে মর্যাদাবান ও গৌরবময় করে দিবেন। পক্ষান্তরে যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না, তাদের আল্লাহ তা’আলা লাঞ্ছিত করবেন এবং তারা এ কালিমার প্রতি অনুগত হবার জন্য বাধ্য হবে। আমি (মিক্বদাদ) বললাম, তখন তো সমগ্র বিশ্বে আল্লাহরই দীন (প্রতিষ্ঠিত) হয়ে যাবে। (অর্থাৎ- সকল দীনের উপরই ইসলাম বিজয়ী হবে)। -মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ২৩৮১৪

উক্ত হাদিস থেকে জানা গেলো, রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনীত ইসলামকে মহান রব সারা দুনিয়ার প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু পন্নী সাহেব দাবি করলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাকি পুরো দুনিয়ার কথা না বলে সীমিত করে বলেছিলেন। নিজের দল নিয়ে খোদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর এতবড় ডাহা মিথ্যাচার কল্পনা করা যায়? এমন মিথ্যাবাদীদের মাধ্যমে সত্যের মূর্তপ্রতিক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপাধী ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ পূর্ণতা পাবে এমন দাবি নিতান্তই হাস্যকর।

ঈসা আ. কী নতুন কোনো ধর্ম আনেননি?
আল্লাহ পাক, হযরত ঈসাকে আ. নতুন শরীয়ত ও কিতাব দিয়ে বনী ইসরাঈলের কাছে প্রেরণ করেন। তাঁর সে শরীয়ত বা ধর্মের নাম ঈসায়ী বা খ্রিষ্টধর্ম। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এই ধর্মটিকে অস্বীকার করে থাকে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের দাবি হলো, হযরত ঈসা আ. শুধুমাত্র মুসা আ. এর ধর্মের আধ্যাত্মিক সংশোধনের জন্য এসেছিলেন। নতুন কোনো নিয়ম কানুন বা নতুন কোনো ধর্ম নিয়ে আসেননি। দেখুন তারা লিখেছে,
এই নবী রসুল পাঠানোর ধারাবাহিকতায় শেষ রসুল মোহাম্মদ (সা.) এর আগমনের প্রায় ৫০০ বছর আগে আল্লাহ পাঠালেন ঈসাকে (আ.)। তাঁকে পাঠানো হয়েছিল শুধুমাত্র মুসা (আ.) এর অনুসারী ইহুদি জাতির কাছে। তিনি এসেছিলেন মুসা (আ.) এর আনীত দীনকে সত্যায়ন করে শুধু মাত্র দীনের হারিয়ে যাওয়া আত্মিক ভাটাকে যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে দীনের ভারসাম্য পুনঃস্থাপনের জন্য। তিনি কখনই খ্রিষ্ট ধর্ম নামে নতুন কোনো ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান নি। তাঁর জীবনী থেকে এ কথার প্রমাণ দেওয়া যায় । ঈসা (আ.) যদি ইহুদিদের বাইরে তার দেখানো পথ অনুসরণ বা গ্রহণ করতে বলতেন তাহলে তা হতো চরম সীমালংঘন ও অনধিকার চর্চা। কারণ স্রষ্টা তাঁর কাজের সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন এবং তা অবশ্যই শুধুমাত্র ইহুদিদের ভেতরে। কোনো নবীর পক্ষেই এই সীমারেখা অতিক্রম করা সম্ভব নয়, এবং ইতিহাস সাক্ষী যে ঈসা (আ.) তা কখনই করেন নি। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ১৫

যাইহোক, মুসার (আঃ) আইন ঠিক ছিলো বোলেই ঈসার মাধ্যমে নতুন আইন পাঠানো হয়নি। ভারসাম্য যথাস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য তার মাধ্যমে শুধু আধ্যাত্মিক দিকটার দিক নির্দেশনা এসেছিলো। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ. ১৩৯-১৪০

অর্থাৎ তারা বলতে চায়, ঈসা আ. কোনো নতুন শরীয়তের বিধান বা ধর্ম নিয়ে আগমন করেননি, বরং মুসা আ. এর ধর্ম সংস্কার করতেই তাঁর আগমন হয়েছিলো।

ইসলাম কী বলে?
হযরত ঈসা আ. ছিলেন নতুন শরীয়তধারী নবী। যাঁর ধর্মে তাওরাতের বিপরীত কিছু নতুন নতুন কিছু নিয়ম কানুনও ছিলো। এটা পবিত্র কুরআনই দলীল। প্রমাণস্বরুপ নিন্মে কয়েকটি আয়াত পেশ করা হলো। মহান রব বলেন,
وَقَفَّيْنَا عَلَى آَثَارِهِمْ بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَآَتَيْنَاهُ الْإِنْجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً
আমি তাদের (নবিগণের) পর মারইয়ামের পুত্র ঈসাকে তার পূর্ববর্তী কিতাব অর্থাৎ তাওরাতের সমর্থকরূপে পাঠিয়েছিলাম এবং আমি তাকে ইনজিল দিয়েছিলাম, যাতে ছিল হিদায়াহ ও আলো এবং (তা দিয়েছিলাম) তার পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতের সমর্থক এবং মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াহ ও উপদেশরূপে। -সুরা মায়িদা : ৪৬

উক্ত আয়াতে একটি বিষয় লক্ষণীয়, হযরত ঈসা আ. কে নতুন কিতাব ইঞ্জিল শরীফ দেওয়া হয়েছিলো বলে মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন। এবং সেই ইঞ্জিল শরীফে কী ছিলো, সেটাও মহান রব বলে দিলেন যে, তাতে ছিলো هُدًى وَنُورٌ অর্থাৎ হিদায়াত ও আলো। এই আয়াতে হিদায়াহ বলতে শরীয়তের বিধিবিধান এবং আলো বলতে আধ্যাতিক পন্থা বুঝানো হয়েছে। প্রমাণ হলো, এ বিষয়গুলোও মুসা আ. এর উপর অঅবতীর্ণ  তাওরাতে ছিলো। তাওরাত সম্পর্কেও ঠিক এই শব্দ আল্লাহ পাক ব্যবহার করেছেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ
নিশ্চয়ই আমি তাওরাত নাযিল করেছিলাম; তাতে ছিল হিদায়াহ ও আলো। -সুরা মায়িদা : ৪৪

সুতরাং বুঝা গেলো, পবিত্র তাওরাতে যেমন আত্মাধিক বিষয়ের পাশাপাশি বিধিবিধানও ছিলো, ঠিক তেমনিভাবে ঈসা আ. এর ইঞ্জিল শরীফেও আত্মাধিক বিষয়ের পাশাপাশি নতুন বিধিবিধানও ছিলো। ঈসা আ. কে নতুন নতুন নিয়ম-কানুন দিয়েছিলেন, তাঁর আরেকটি প্রমাণ হলো, নিম্মোক্ত আয়াতে কারীমে। মহান রব বলেন,
وَمُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَلِأُحِلَّ لَكُم بَعْضَ الَّذِي حُرِّمَ عَلَيْكُمْ
এবং আমার পূর্বে যে কিতাব এসেছে অর্থাৎ তাওরাত, আমি তার সমর্থনকারী এবং (আমাকে এজন্য পাঠানো হয়েছে) যাতে তোমাদের প্রতি যা হারাম করা হয়েছে, তন্মধ্যে কিছু জিনিস তোমাদের জন্য হালাল করি এবং আমি তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে নিদর্শন নিয়ে এসেছি। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার কথা মান। -সুরা আলে ইমরান : ৫০

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত কাতাদাহ রহি. বলেন,
كان الذي جاء به عيسى ألين مما جاء به موسى، وكان قد حُرّم عليهم فيما جاء به موسى لحومُ الإبل والثُّروب، وأشياء من الطير والحيتان
হযরত মুসা আ. আনীত বিধিবিধান থেকে সহজ ছিলো হযরত ঈসা আ. -এর আনীত বিধানগুলো। হযরত মুসা আলাইহিস সালামের শরীয়তে বনী ইসরাঈলের প্রতি উটের গোশত, চর্বি, কোন কোন মাছ ও কয়েক প্রকার পাখি হারাম করা হয়েছিলো। -তাফসীরে তাবারী : খ. ৬ পৃ. ৪৩৯

হযরত হাসান বসরী রহি. বলেন,
كان حرّم عليهم أشياء فجاءهم عيسى ليحلّ لهم الذي حرّم عليهم، يبتغي بذلك شُكْرهم
বনী ইসরাঈলের প্রতি কিছু জিনিষ হারাম করা হয়েছিলো। অতপর হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এসে সেগুলোকে হালাল করে দিয়েছিলেন। এর দ্বারা তাদের কৃতজ্ঞতা কাম্য ছিলো। -তাফসীরে তাবারী : খ. ৬ পৃ. ৪৩৯

আর এজন্যই ইবনে কাসীর রহি. বলেন,
وَلِهَذَا كَانَ الْمَشْهُورُ مِنْ قَوْلَيِ الْعُلَمَاءِ أَنَّ الْإِنْجِيلَ نَسَخَ بَعْضَ أَحْكَامِ التَّوْرَاةِ.
আর এজন্যই উলামায়ে কেরামের কাছে এটা সুপ্রশিদ্ধ মত যে, ইঞ্জিল শরীফ তাওরাতের বেশ কিছু বিধান রহিত করে দেয়। -তাফসীরে ইবনে কাসীর : খ. ৫ পৃ. ২৪৩

সুতরাং বুঝা গেলো, ঈসা আ. নতুন শরীয়ত ও তাওরাতের স্বীকৃতির পাশাপাশি কিছু পরিবর্তনশীল বিধান নিয়ে আগমণ করেছিলেন। এজন্য তাঁকে প্রেরণ করে মহান আল্লাহ তাঁকে অনুসরণ করার নির্দেশও জারি করে দিয়েছিলেন। যা পবিত্র কুরআন থেকেই জানা যায়। হযরত ঈসা আ. বলেছিলেন,
وَجِئْتُكُم بِآيَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ فَاتَّقُواْ اللّهَ وَأَطِيعُونِ
এবং আমি তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে নিদর্শন নিয়ে এসেছি। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার কথা মানো। -সুরা আলে ইমরান : ৫০

সুতরাং বুঝা গেলো, ঈসা আ. নতুন এক শরীয়ত নিয়ে আগমন করেছিলেন। হেযবুত তওহীদ এ ব্যাপারে যা বলে তা নিছক মিথ্যাচার।

মুসা আ. এর ধর্মের বিধান কী অবিকৃত ছিলো?
হেযবুত তওহীদের আরেকটি দাবি হলো,
খ্রিস্টধর্মে ইহলৌকিক কোন আইন কানুন নেই। সুতরাং অর্থনীতিও নেই। ঈসা (আ.) এসেছিলেন শুধুমাত্র ইহুদীদের আধ্যাত্মিক সংশোধনের জন্য, ইহুদীদের জাতীয় অর্থাৎ রাজনৈতিক আর্থ সামাজিক আইন দন্ড বিধি ইত্যাদি মোটামুটি অবিকৃতই ছিলো। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ২২

জবাব:
মুসা আ. এর ধর্ম বিকৃত হওয়ার পরই আল্লাহপাক ঈসা আ. কে প্রেরণ করেছিলেন। এটা শুধু আমার কথা নয়, বরং জনাব পন্নীই এটা লিখেছে,
মুসার (আ.) দীনকে তাঁর ধর্মের আলেম-যাজকরা বিকৃত, ভারসাম্যহীন করে ফেলায় সেটাকে আবার ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনাই ছিল তাঁর (ঈসা আ.) কাজ। -আকিদা : পৃ. ১৪

বুঝা গেলো জনাব পন্নী নিজেই দাবি করেছে যে, মুসা আ. এর ধর্ম বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো। আর তাছাড়া যদি ইহুদীদের আইন ও দণ্ডবিধি অবিকৃতই থাকতো, তাহলে নতুন করে আসমানী গ্রন্থ নাযিল করার কী দরকার ছিলো আল্লাহ পাকের? এতটুকু কমনসেন্স যাদের নেই, সেই হেযবুত তওহীদ ধর্ম নিয়ে আলোচনা করার কী অধিকার রাখে? সুতরাং প্রমাণ হলো, ঈসা আ. ও তাঁর ধর্ম সম্পর্কে হেযবুত তওহীদের মতবাদ চুড়ান্ত পর্যায়ের বিভ্রান্তি ও কুফরী এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মকে অস্বীকার করার নামান্তর।

খ্রিস্টানদের অপকর্মের জন্য কী ঈসাও আ. দায়ী?
হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম মহান রবের একজন গুরুত্বপূর্ণ নবি। নবি হিশাবে তিনিও মাসুম বা নিস্পাপ। তিনি নিজে কখনও অপরাধ করেননি, অপরাধীকে প্রশ্রয়ও দেননি। সুতরাং কিয়ামতে তিনি অপরাধী হিশেবে উঠবেন না।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
তাদের প্রতিষ্ঠাতা বায়াজীদ খান পন্নী খুব কৌশলী শব্দে লিখেছেন,
এমন হতে পারে যে, আসমানে উঠিয়ে নেবার পর আল্লাহ ঈসাকে (আ.) ভবিষ্যতে তাঁর উম্মাহর কাজের ফলে যে দাজ্জালের জন্ম হবে তা দেখিয়ে দিলেন, যা দেখে ঈসা (আ.) আল্লাহকে বললেন- ইয়া আল্লাহ! আমার উম্মতের কাজের ফলের জন্য আমিও অন্তত আংশিকভাবে দায়ী । কাজেই আমার উম্মতের সৃষ্ট দানবকে ধ্বংস করার দায়িত্ব আমাকেই দাও । অথবা এমনও হতে পারে যে, আল্লাহই ঈসাকে (আ.) বললেন- ঈসা! দ্যাখো, তোমরা উম্মতের ভুলের, বিপথগামীতার ফলে কেমন মহাশক্তিধর দানব সৃষ্টি হয়েছে যে আমার সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে নিজেকে রব, প্রভু বলে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং আমার শেষ নবীর উম্মতসহ মানবজাতি তাকে রব বলে মেনে নিয়েছে । যেহেতু তোমার উম্মত থেকেই এই কাফের দানবের জন্ম, কাজেই তোমাকেই আমি দায়িত্ব দিচ্ছি একে ধ্বংস করার জন্য । দাজ্জালকে হত্যা বা ধ্বংস করার জন্য আল্লাহর প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে আসমান থেকে হাজার হাজার বছরের অতীতের একজন নির্দিষ্ট নবীকে পৃথিবীতে পাঠাবার অন্য কোনো কারণ আমি দেখি না । যদি কেউ অন্য কারণ বের করতে পারেন তবে তা প্রকাশ করলে আমার ভুল সংশোধন করবো। – দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা : পৃ. ৫৫

উক্ত বক্তব্যে জনাব পন্নী বললো, ঈসা আ. কিয়ামতে আল্লাহকে বলবেন, ‘আমার উম্মতের কাজের ফলের জন্য আমিও অন্তত আংশিকভাবে দায়ী’ বাক্যটা দিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে চাইলো যে, ঈসা আ. খ্রিষ্টানদের অপরাধে আংশিকভাবে দায়ী বা অপরাধি।

ইসলাম কী বলে?
এক. আমরা যদি জনাব পন্নীকে প্রশ্ন করি যে, ঈসা আ. এই কথাটা যে কিয়ামতে বলবেন এটা আপনি কোথায় পেলেন? কুরআনে? হাদিসে? কোথায়? পন্নী সাহেবকে কবর থেকে উঠিয়ে পৃথিবীর সকল কিতাবাদী তার সামনে দিলেও কিয়ামতের আগে কী এর কোনো জবাব তিনি দিতে পারবেনদ না। তাহলে সে কোথায় পেলেন এ উদ্ভট কথা? এমন ডাহা মিথ্যাচার করে একজন গুরুত্বপূর্ণ নবিকে অপমান করার বৈধতা সে কোথায় পেলেন? এমন একজন জ্বলিলুল ক্বদর রাসুলের শানে এমন বেয়াদবীমূলক অপবাদ দিতে পন্নী সাহেবের হাত কী একবারও কাঁপেনি?

দুই. তাছাড়া কুরআনুল কারীমের খ্রিস্টানদের যাবতীয় অপকর্মের সাথে ঈসা আ. এর সংশ্লিষ্টতা সুষ্পষ্টভাবে নাকচ করে দেয়া হয়েছে । পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذْ قَالَ اللّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنتَ قُلتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَـهَيْنِ مِن دُونِ اللّهِ قَالَ سُبْحَانَكَ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أَقُولَ مَا لَيْسَ لِي بِحَقٍّ إِن كُنتُ قُلْتُهُ فَقَدْ عَلِمْتَهُ تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلاَ أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ إِنَّكَ أَنتَ عَلاَّمُ الْغُيُوبِ مَا قُلْتُ لَهُمْ إِلاَّ مَا أَمَرْتَنِي بِهِ أَنِ اعْبُدُواْ اللّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ وَكُنتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَّا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنتَ أَنتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ وَأَنتَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ
এবং (সেই সময়ের বর্ণনাও শোনো,) যখন আল্লাহ বলবেন, হে ঈসা ইবনে মারয়াম, তুমিই কী মানুষকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতিত আমাকে ও আমার মা-কে মাবুদরূপে গ্রহণ করো? সে বলবে, আমি তো আপনার সত্তাকে (শিরক থেকে) পবিত্র মনে করি। যে কথা বলার কোনও অধিকার নেই, সে কথা বলার সাধ্য আমার ছিলো না। আমি এরূপ বলে থাকলে আপনি অবশ্যই তা জানতেন। আমার অন্তরে যা গোপন আছে আপনি তা জানেন, কিন্তু আপনার গুপ্ত বিষয় আমি জানি না। নিশ্চয়ই যাবতীয় গুপ্ত বিষয়ে আপনি সম্যক জ্ঞাত। আপনি আমাকে যে বিষয়ের আদেশ করেছিলেন তা ছাড়া অন্য কিছু আমি তাদেরকে বলিনি। তা এই যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, যিনি আমারও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক এবং যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন আমি তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলাম। তারপর আপনি যখন আমাকে তুলে নিয়েছেন তখন আপনি স্বয়ং তাদের তত্ত্বাবধায়ক থেকেছেন। বস্তুত আপনি সব কিছুর সাক্ষি। -সুরা মায়িদা : ১১৬-১১৭

উপরিউক্ত আয়াত দু’টি থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, খ্রিস্টানদের অপকর্মের সাথে ঈসা আ. এর কোন যোগসূত্র নেই। তিনি এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যা ঈসা আ. নিজেও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এবং সত্য হিসাবে আল্লাহ তাআলা নিজেও স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ্য করেছেন। তাহলে বুঝা গেলো, আল্লাহ নিজেও এ কথা বুঝাতে চাচ্ছেন যে, ঈসা আ. দায়ী নন। তাছাড়া কেউ কারো অপরাধের দায় নিজের কাঁধে নেবে না বা কারও উপর অন্যের অপরাধের দায় চাপানো হবে না। মহা রব বলেন,
وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ
কোনো ভার বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। -সুরা ফাতির : ১৮

উপরিউক্ত আয়াত থেকে প্রমাণিত হলো যে, সবাই নিজ নিজ অপরাধে নিজেই অপরাধি। কারো অপরাধ আরেকজনের উপর চাপানো পবিত্র কুরআন বিরোধি। সুতরাং একজন প্রশিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ নবি ও রাসুলের শানে ‘দায়ী’ বা ‘অপরাধি’ অপবাদ লাগাতে যাদের হাঁত কাঁপেনা তারা আসলে কারা?

অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতেই কী তিনি দাজ্জালের হত্যা করতে আসবেন?
তারা বলেছে যে, ঈসা আ. আল্লাহকে বলেছেন, ‘আমার উম্মতের কাজের ফলের জন্য আমিও অন্তত আংশিকভাবে দায়ী। কাজেই আমার উম্মতের সৃষ্ট দানবকে ধ্বংস করার দায়িত্ব আমাকে দাও। -দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা : পৃ. ৫৫

অর্থাৎ তারা বুঝাতে চায়, ঈসা আ. তাঁর উম্মতের অপরাধের কারণে তিনিও আংশিক দায়ী। আর এ দায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য আল্লাহপাকের কাছে নিবেদন পেশ করেছেন। নাউযুবিল্লাহ। এমন জঘন্য মন্তব্য কী কুরআন-সুন্নাহ’র কোথাও উল্লেখ্য আছে? মহান আল্লাহ দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য ঈসা আ. কে কেন নির্বাচন করেছেন, তার জবাব একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। ওহি ব্যতীত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ও ধারণার ভিত্তিতে এ ধরনের উদ্ভট কথোপকথন আবিষ্কারের অধিকার পন্নী সাহেব কোথায় পেলো? কুরআন-সুন্নাহর অতন্দ্র প্রহরী ফকিহ, মুহাদ্দীস ও উলামায়ে কেরামকে দীন বিকৃতকারী ও ভিলেন সাব্যস্ত করতে জনাব পন্নী তার বইয়ের বিভিন্ন স্থানে তাঁদেরকে ‘অতিবিশ্লেষণকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছে, সেই পন্নী সাহেব এখানে এসে কী করলো? আল্লাহ তাআলা যে বিষয় জানাননি, তা নিয়ে পন্নী সাহেবের এতো ঘাটাঘাটির প্রয়োজন হলো কেন? এটা কি অতিবিশ্লেষণ নয়? বরং আমি তো বলবো, ওহি ব্যতীত যে জিনিস জানা সম্ভব নয়, সে বিষয়ে মন্তব্য পেশ করতে গিয়ে একজন সম্মানিত রাসুলের শানে অপবাদ দেয়াকে ‘অতিবিশ্লেষণ’ না বলে ‘অপবিশ্লেষণ’ বলাটা অধিক বাঞ্ছনীয় ।

বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির, মনু আল্লাহর নবী ছিলেন?
সহজ ভাষায় উম্মতের জন্য যাঁরা আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আগমণ করেন, যাঁরা আমজনতাকে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে তাওহীদের পথে আহ্বান করেন, তাঁদেরকে বলা হয় নবী। যখনই তাঁরা আগমণ করেছেন, তখনই তাঁরা উম্মতকে জানিয়ে দিতেন যে, তারা রবের পক্ষ থেকে আদিষ্ট। যাঁরা কুরআন-সুন্নাহ’র প্রমাণের আলোকে নবি বলে স্বীকৃত, তাঁদের ওপর ঈমান আনয়ণ করা সমস্ত উম্মতের উপর আবশ্যকীয় বিষয়। কিন্তু ‘নবি হিশেবে আবির্ভূত নন বা নবি হওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না’ এমন কাউকে নবি বলে স্বীকৃতি দেওয়া জায়েয নয়, বরং কুফরী। এ ব্যাপারে ইমাম আবু মুহাম্মদ আলী ইবনে হাযম আল-উন্দুলুসী কুরতুবী রহি. পরিষ্কার কথা বলেছেন । তিনি বলেন
ولا يحل لمسلم أن يدخل في الأنبياء من لم يأت نص ولا اجماع أو نقل كافة بصحة نبوته ولا فرق بين التصديق بنبوة من ليس نبيا وبين التكذيب بنبوة من صحت نبوته
যার নবুয়্যাত প্রমাণের জন্যে আল্লাহর সুস্পষ্ট উক্তি, মুসলমানদের ইজমা তথা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ও কুরআন-হাদীসের যথেষ্ট বর্ণনা বিদ্যমান না থাকবে, তাকে নবিগণের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করা কোন মুসলমানের জন্য বৈধ হবে না। যার নবুয়ত বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা ও যে নবি নয় তাকে নবী মনে করার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। -আল-ফসলু ফিল মিলালি ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল : খ. ৪ পৃ. ২১-২২

ইমাম ইবনে হাযম রহি. এর এ উক্তি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কুরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত কোনো নবিকে নবি বলে বিশ্বাস না করা যেমন কুফরী, তদ্রূপ শরয়ী দলিল দ্বারা নবি বলে প্রমাণীত নয়, এমন ব্যক্তিকে নবি মনে করাও কুফরী। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ, মহর্ষী মনু, রাজা রামচন্দ্র, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, মহাবীর জৈন, ও ভারতীয় অন্যান্য অবতারগণ নবি হওয়ার স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোন দলীল নেই। সুতরাং যারা তাদেরকে নবি মনে করবে, তারা কুফরি করবে।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?
জনাব পন্নী ও সেলিম এবং তাদের অনুসারীদের বিশ্বাসমতে হিন্দু ও বৈদ্ধদের অনেক দেবতা বা অবতারগণ আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নবি ছিলেন। দেখুন তারা কী লিখেছেন-
সামাজিক দণ্ডবিধি দিয়ে যাদেরকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যে আদম আ., নূহ আ. (মনু), বিভিন্ন বেদ যাদের ওপর অবতীর্ণ হোয়েছিলো, মুসা আ. ও মোহম্মদ সা.। আর আইন-কানুন বাদে শুধু আধ্যাত্মিক দিকটাকে পুনরুদ্ধার কোরে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান হোলেন বুদ্ধ, কৃষ্ণ, মহাবীর, ইসা (আঃ)। এরা কোনও আইন-কানুন আনেননি কারণ পূর্ববর্তী নবীর আনা আইন-কানুন ইত্যাদী অবিকৃত ছিলো। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ. ১৩৯-১৪০

ধর্মকে পুনঃস্থাপন করে মানুষের কল্যান সাধনের জন্যই ভারতবর্ষে এসেছেন শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির, মধ্য এশিয়ায় এসেছেন ইব্রাহীম (আ.) ইহুদীদের মধ্যে এসেছেন মুসা (আ.), দাউদ (আ.), ঈসা (আ.), ইয়াহিয়া (আ.)  ইয়াকুব (আ.) এমনই আরো বহু নবী-রসুল অবতার। -সবার উর্ধ্বে মানবতা : পৃ. ৫

অন্যান্য নবী রসুলদেরকে আল্লাহ যে সর্বব্যাপী তওহীদ দিয়ে পাঠিয়েছেন, ঈসা (আ.) কেও সেই তওহীদ, সেই সার্বভৌমত্ব, দীনুল কাইয়্যেমা, সনাতন ধর্ম দিয়ে পাঠিয়েছেন এবং তার অনুসারীরা ছিলেন মো’মেন এবং মুসলিম। পবিত্র কোর’আন নাযেল না হলে মানুষ আজও ঈসা (আ.) সম্পর্কে প্রকৃত সত্য জানতে পারত না, ঐ বিকৃতটাই জানত। ঠিক তেমনি হিন্দুদের পুরাণে, বেদে, সংহিতায়, রামায়নে ও মহাভারতে যে ইতিহাস আমরা পাই সেখানেও রয়েছে প্রচুর বিকৃতি । সেই সব বিকৃতির মধ্যেই মিশে আছে কিছু মহাসত্য যা দেখার মত দৃষ্টিশক্তি এই বিকৃত ইসলামের আলেমদের নেই। থাকলে তারা দেখতে পেতেন যে, ঐ সব ধর্মগ্রন্থে যে সব অবতারদের কথা বলা হয়েছে তাদের অনেকেই আল্লাহর প্রেরিত নবী, এবং যে ধর্মগ্রন্থগুলোর চর্চা হিন্দু ধর্মে হয়ে থাকে সেগুলোর কিছু কিছু আল্লাহরই পাঠানো কেতাব। আরও দেখতে পেতেন যে, জেসাস যেমন ঈসারই (আ.) উচ্চারণ ভেদ বা নামান্তর, তেমনি মনু নুহের (আ.) নামান্তর, যুধিষ্ঠির ইদ্রীস (আ.) এর নামান্তর। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৬৫

অনেক ঐতিহাসিক, পণ্ডিত গবেষকের মতে মহর্ষী মনু, রাজা রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, মহাবীর জৈন, মহামতি বুদ্ধ এঁরা সবাই ছিলেন ভারত বর্ষে আগত আল্লাহর নবী।  -সকল ধর্মের মর্ম কথা সবার উর্ধ্বে মানবতা : পৃ. ৪

শ্রীকৃষ্ণ
আমাদের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জন্ম-মৃত্যু, ঘর সংসার, পরিবার-পরিজন পরিচালনা, সাধনা-উপাসনা, আদর্শ সমাজ সংস্কার, সত্য-ধর্মের সেবা, প্রয়োজনে মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আদর্শে বিশ্বাসী ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত ও সবকিছু মিলিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর যুগের একজন প্রেরিত- পুরুষ, মহামানব পথ-প্রদর্শক, নবী-অবতাররূপেই আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। -শোষণের হাতিয়ার : পৃ. ৭০

মনুই মূলত নূহ আ.!
অনেক গবেষক মনে করেন বৈবস্বতঃ মনুই হচ্ছেন বৈদিক ধর্মের মূল প্রবর্তক, যাঁকে কোর’আনে ও বাইবেলে বলা হয়েছে নূহ (আ.), ভবিষ্যপুরাণে বলা হয়েছে রাজা ন্যূহ। তাঁর উপরেই নাজিল হয় বেদের মূল অংশ। -সবার উর্ধ্বে মানবতা : পৃ. ৪

তেমনি মনু নুহের (আ.) নামান্তর। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৬৫

নূহ আ. (মনু)। -এ ইসলাম ইসলামই নয় : পৃ. ১৩৯-১৪০

যুধিষ্ঠির মূলত ইদরিস আ.!
যুধিষ্ঠির ইদ্রীস (আ.) এর নামান্তর। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৬৫

যিশু মূলত ঈসা আ.!
জেসাস যেমন ঈসারই (আ.) উচ্চারণ ভেদ বা নামান্তর। -শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম : পৃ. ৬৫

আলাইহিস সালাম বলা:
সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে এক জাতিতে পরিণত করার জন্যই যামানার এমামের আবির্ভাব। তিনি ভারতবর্ষে আগত আল্লাহর সকল অবতারদেরকে নবী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতি সালাম পেশ করেছেন । এজন্য তাঁকে বিকৃত এসলামের আলেমদের বহু বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করা হয়েছে, তাঁর বই পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু তিনি সত্য থেকে এক চুলও নড়েন নি। -শিক্ষাব্যবস্থা : পৃ. ৯০

অর্থাৎ হেযবুত তওহীদের দাবি মতে, রামকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির মনু, বুদ্ধদেবসহ সবাই আল্লাহ তাআলার প্রেরিত নবি ছিলেন।

ইসলাম কী বলে?
হিন্দু ও বৌদ্ধদের ভিত্তিহীন অলীক ধর্মের কল্পকাহিনীর দেবতা শ্রীকৃষ্ণ আর বুদ্ধকে সামান্য ঈমানী আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি নবি বলে মেনে নিতে পারে না। বিষয়টি প্রামাণিকভাবেও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তাছাড়া পবিত্র কুরআন ও হাদীসের কোথাও রাম ও কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, মনু, বুদ্ধদেবকে নবি বলা হয়নি। যাদেরকে কুরআন ও হাদীসের কোথাও নবি বলা হয়নি, তাদের সম্পর্কে নবী হওয়ার বিশ্বাস বা ধারণা পোষণ করা ঈমানবিধ্বংসী কাজ। অতএব কাল্পনিকভাবে কাউকে নবি মনে করা উচিৎ নয়। মহান রব বলেন,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِّن قَبْلِكَ مِنْهُم مَّن قَصَصْنَا عَلَيْكَ وَمِنْهُم مَّن لَّمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآيَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ فَإِذَا جَاء أَمْرُ اللَّهِ قُضِيَ بِالْحَقِّ وَخَسِرَ هُنَالِكَ الْمُبْطِلُونَ
বস্তুত আমি তোমার পূর্বেও বহু রাসূল পাঠিয়েছি। তাদের মধ্যে কতক এমন, যাদের কতিপয়ের বৃত্তান্ত আমি তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি আর কতক এমন যাদের বৃত্তান্ত তোমাকে জানাইনি। কোন রাসূলের এই এখতিয়ার নেই যে, সে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন মুজিযা পেশ করবে। ২৫ অতঃপর যখন আল্লাহর আদেশ আসবে, তখন ন্যায়সঙ্গতভাবে ফায়সালা হয়ে যাবে। আর মিথ্যার অনুসারীরা তখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। -সুরা মুমিন : ৭৮

اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ
আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য হতে তাঁর বার্তাবাহক মনোনীত করেন এবং মানুষের মধ্য হতেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন। -সুরা হাজ্ব :  ৭৫

সুতরাং বুঝা গেলো, সকল নবি-রাসুল আল্লাহপাক কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অথচ এসব অবতারদের নবি হওয়ার ব্যাপারে এমন কোনো আয়াত-হাদিস পাওয়া যায় না, যেখানে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত। সুতরাং তাদের নবি বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। তাছাড়া তাদের ব্যাপারে বর্ণিত চরিত্র ও বক্তব্য শুনলে বুঝা যায়, তারা নবি হওয়া দূরের কথা ভালো মানুষ হওয়াও সম্ভব না।

অবতাররা মিথ্যা বলে:
আমরা জানি কোনো নবি কখনও মিথ্যা বলেননি। কিন্তু হিন্দুদের শাস্ত্রমতে তাদের অবতাররাও অসত্য বলেন। মহাভারতে লেখা রয়েছে-
দেবতারাও অসত্য বলেন। -মহাভারত : পৃ. ৪৩৫ রাজশেখরবসবসু অনূদিত, বুক চয়েস ২/৩ প্যারীদাস রোড, ঢাকা- ১১০০ দ্বিতীয় সংস্করণ

যে দেবতা বা অবতারগণ মিথ্যা বলেন, তাদেরকে নবি বলে বিশ্বাস করা নিছক ভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়। এসব বিষয়ে আরও জানতে হিন্দুদের ধর্মীয়গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীবৈহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড’ পড়তে পারেন।

অবতাররা চরিত্রহীনও হয়:
নবিদের চরিত্র পরিচ্ছন্ন। তাঁদের চারিত্রিক কোনো ত্রুটি ছিলো না এবং তাঁরা ছিলেন নেককার ও সৎকর্মশীল। তাঁদের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ বলেন,
وَزَكَرِيَّا وَيَحْيَى وَعِيسَى وَإِلْيَاسَ كُلٌّ مِّنَ الصَّالِحِينَ
এবং যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ঈসা ও ইলিয়াসকেও (হিদায়াত দান করেছিলাম)। এরা সকলে পুণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। -সুরা আনআম : ৮৫

বুঝা গেলো, সকল নবি সৎ হয়ে থাকেন। এজন্য ইবনে হাজার আসকালানী রহি. বলেন,
الأنبياء معصومون من الكبائر بالإجماع
সকল উম্মতের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত হলো, নবিরা সকল কবীরা গুনাহ থেকে পবিত্র। -ফাতহুল বারী : খ. ৮ পৃ. ৬৯

অথচ রামকৃষ্ণ ও অন্য অবতারদের ব্যাপারে যেসব যৌনলীলা ঘটিত চরিত্র বর্ণনা করা হয়, তা কোন নবির চরিত্র হতে পারে না। নবিদের আদর্শ ও শিক্ষার সাথে অবতারদের জীবন-আদর্শের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না, বরং উভয়ের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব পরিলক্ষিত হয়। অথচ নবিগণ সবাই ছিলেন নিষ্কলুষ মহান চরিত্রের অধিকারী।

কৃষ্ণ:
হেযবুত তওহীদ বিশেষ করে শ্রীকৃষ্ণকে নবি বানাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। অথচ কৃষ্ণ নিজেই দাবি যেসব দাবি করেছে, তাতে সে নিজেই নিজেকে স্রষ্টা বলে দাবি করেছে। তার দাবি হলো, দুনিয়াকে ধ্বংস করে আবার সৃষ্টি করতে পারি। দেখুন কী বলে-
আমি সংসারকে ভস্মসাৎ করিয়া পূনর্বার সৃষ্টি করিতে সক্ষম। -শ্রীশ্রীবক্ষ্মবৈবর্ত্ত পুরাণম : শ্রীকৃষ্ণ-জন্মখন্ড, পৃ. ৪৭৭

অথচ সৃষ্টি করার একমাত্র ক্ষমতা আল্লাহপাকের। মহান রব বলেন,
مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى
আমি তোমাদেরকে এ মাটি হতেই সৃষ্টি করেছি, এর মধ্যে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেব এবং পুনরায় তোমাদেরকে এরই মধ্য হতে বের করব। -সুরা ত্ব-হা : ৫৫

অথচ শুধু মানুষ নয়, সবল সৃষ্টি ধ্বংশ ও সৃষ্টি করতে একমাত্র সক্ষম মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা। তাছাড়া কৃষ্ণ আরও দাবি করেছে,

তপাম্যহমহং বর্ষং নিগৃহ্ণাম্যুৎসৃজামি চ।
অমৃতঞ্চৈব মৃত্যুশ্চ সদসচ্চাহমৰ্জ্জুন৷৷১৯ ৷৷
অর্থাৎ হে অৰ্জ্জুন! আমি সূর্য্যস্বরূপে গ্রীষ্মকালে উত্তাপ দান করি, বর্ষাকালে আমি বারিবর্ষণ করিয়া থাকি, আবার কখনও কখনও বর্ষণকে আকর্ষণ করিয়া থাকি। আমিই মোক্ষ এবং মৃত্যু, স্থূল ও সূক্ষ্ম সমুদয় বস্তু৷৷১৯৷৷ -শ্রীমদ্ধভবদ্গীতা : ৯/১৯ পৃ. ২২৮

অথচ বৃষ্টিবর্ষণ করার ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহপাকের। মহান রব বলেন,
الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ مَهْدًا وَسَلَكَ لَكُمْ فِيهَا سُبُلًا وَأَنزَلَ مِنَ السَّمَاء مَاء فَأَخْرَجْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّن نَّبَاتٍ شَتَّى
তিনি সেই সত্তা, যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা বানিয়েছেন, তাতে তোমাদের জন্য চলার পথ দিয়েছেন এবং আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেছেন। তারপর আমি তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি। -সুরা ত্ব-হা : ৫৩

কৃষ্ণ আরও দাবি করেছে, দৃশ্য ও অদৃশ্যের সকল জ্ঞান তার আছে। দেখুন কী বলে,
বেদাহং সমতীতানি বৰ্ত্তমানানি চাৰ্জ্জুন।
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মান্তু বেদ ন কশ্চন৷৷২৬৷৷

হে অৰ্জ্জুন! আমি সমস্ত অতীত, বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ এই
ত্রিকালস্থ স্থাবর জঙ্গমাত্মক সমুদয় বস্তুই জানি। কিন্তু আমার মায়াশক্তি ও যোগমায়া শক্তির দ্বারা তাহাকের জ্ঞান আচ্ছাদনহেতু প্রাকৃত মানব বা প্রকৃতির অতীত কেহই আমাকে যথাযথ ভাবে জানিতে পারে না। -শ্রীমদ্ধভবদ্গীতা : ৭/২৬ পৃ. ১৯৬

অথচ দৃশ্য ও অদৃশ্যের সকল কিছুর খবর জানেন একমাত্র আল্লাহ, কোনো নবিও না কোনো ওলিও না। আল্লাহপাক বলেন,
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ
আল্লাহ্, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই, তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা; তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু। -সুরা হাশর : ২২

যে কৃষ্ণ নিজেই এসব শিরকী কথা দাবি করেছিলো, সে কীভাবে নবি হতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। উপরন্তু শ্রীকৃষ্ণের চারিত্রিক নোংড়ামীর ইতিহাস পড়লে তাকে নবি কল্পনা করাও সুদূর পরাহত।

বুদ্ধ:
বুদ্ধদেব মূলত একজন বস্তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ছিলো। সে স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিলো না, তাছাড়া আখেরাতেও বিশ্বাসী ছিলো না এবং তার বক্তব্যমতে মানুষ মূলত মৃত্যুবরণ করে না, পূনরায় জন্মায়। তার ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে গেলে কিতাবটি দীর্ঘ হবে। এক কথায় জেনে নেওয়া যায়, বুদ্ধদেব আগাগোড়া নাস্তিক ছিলো। এজন্য সাউদি আরবের সর্বোচ্চ ফতওয়া বোর্ড ‘আল লাজনাতুত দায়েমা লিল বুহুসিল ইলমিয়্যাতি ওয়াল ইফতা’ এর এক ফতওয়ায় বুদ্ধকে নবি বলে বিশ্বাসকারীর ব্যাপারে সুস্পষ্ট কাফের হওয়ার ফতওয়া প্রদান করেছে। উক্ত ফতওয়াতে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,
بوذا ليس نبيا، بل كان كافرا فيلسوفا يتنسك على غير دين سماوي فمن اعتقد بنبوته فهو كافر.
বুদ্ধ নবী নয়। বরং সে কাফির ও দার্শনিক ছিল । আসমানী ধর্ম বাদ দিয়ে ভিন্ন পদ্ধতিতে ইবাদত করতো। যে তাকে নবী হওয়ার বিশ্বাস রাখবে সে কাফের। -ফতওয়া লাজনাতিদ দায়েমা লিল বুহুসিল ইসলামিয়া খণ্ড.২৬ পৃ.২৩৮ ফতওয়া নং ২১০০৪

সৌদী আরবের সর্বোচ্চ ফাতাওয়া বোর্ডের ফাতাওয়া অনুযায়ী পন্নী এবং তার অনুসারিরা কাফের। যাহোক, যাঁদের নবি হওয়ার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ’য় সুষ্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা ছাড়া আমরা আর কাউকে নির্ধারিতভাবে নবি বলে বিশ্বাস করতে পারি না। অথচ হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, এসব অবতারদের নবি বলে বিশ্বাস না করলে জান্নাতের আশা করে লাভ নেই। দেখুন তারা কী বলে,
খ্রিস্টানরা আখেরী নবী মোহাম্মদ (দ:)-কে নবী হিসাবে স্বীকার করে না একইভাবে মোসলেমরা ভারতীয় অঞ্চলে ভারতীয় ভাষার মানুষের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত বৌদ্ধ ও শ্রীকৃষ্ণ এঁদেরকে নবী হিসাবে স্বীকার করেন না। কিন্তু তাদের প্রচারিত ধর্মগ্রন্থের মধ্যে আখেরী নবীর আগমনের বহু ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখিত আছে যা গবেষণা কোরলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ঐ ধর্মগুলিও আল্লাহরই প্রেরিত (যা এখন বিকৃত হোয়ে গেছে), এবং স্বভাবতই সেগুলির প্রবক্তারা আল্লাহরই বার্তাবাহক অর্থাৎ নবী ও রসুল। -শোষণের হাতিয়ার : পৃ. ৬২

পূর্ববর্তী নবী-রসুল-অবতার এবং তাঁদের আনীত কেতাবের প্রতিও অবিশ্বাস রেখে জান্নাতের আশা করে লাভ নেই। -দেশেরপত্র সাপ্তাহিক সংকলন- ২৪ পৃ. ২৫

উপমহাদেশে কাকে নবি হিসাবে আল্লাহ পাক পাঠিয়েছিলেন, তাঁদেরকেও আমরা বিশ্বাস করি, কিন্তু তাঁদের নাম সম্পর্কে আমরা জানি না। অতএব রাম, কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, মনু বা বুদ্ধদবেকে নির্দিষ্টাকারে নবি বলে বিশ্বাস করতে অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণ লাগবে। প্রমাণ ছাড়া এসব অবতারদের নবি হিশাবে ঘোষণা দিয়ে ‘তাদের প্রতি ঈমান না আনলে জান্নাতে যাওয়া যাবে না’ এমন দাবি সর্বৈব মিথ্যাচার।

বুদ্ধদেব কী যুলকিফল?
অনেকে গৌতমবুদ্ধকে নবি হওয়ার প্রমাণস্বরুপ বলে থাকে যে, কুরআনে বর্ণিত যুলকিফল হলো গৌতম বুদ্ধ। মহান রব বলেন,
وَاذۡکُرۡ اِسۡمٰعِیۡلَ وَالۡیَسَعَ وَذَا الۡکِفۡلِ ؕ  وَکُلٌّ مِّنَ الۡاَخۡیَارِ ؕ
এবং স্মরণ কর ইসমাঈল, আল- ইয়াসা ও যুল-কিফলকে। তারা সকলে ছিল উত্তম ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত। -সুরা ছোয়াদ : ৪৮

তারা এই যুলকিফলকে গৌতম বুদ্ধ বলে প্রমাণ করতে দলিল হিশাবে বলে থাকে, গৌতম বুদ্ধের রাজধানীর নাম ছিলো কাপল। যার আরবী রূপ কাফল। আর আরবীতে ‘যু’ অর্থ অধিকারী, মালিক। সুতরাং সম্পদশালী ব্যক্তিকে ‘যুমালিন’ আর শহর অধিপতিকে “যুবালাদিন” বলা হয়ে থাকে । তাই এখানেও বুদ্ধের রাজধানী কাপলের মালিক ও বাদশাহ কে ‘ফুলকিফল’ বলা হয়েছে।

জবাব:
তাফসীরের কিতাবগুলো দেখলে বুঝা যায়, বনী ইসলাঈলের একজন নেককার ও ন্যায়বিচারক শাসক ছিলেন। সেকারণে তাকে ‘যুলকিফল’ উপাধী হয়ে গিয়েছিলো। উপরন্তু তিনি ছিলেন বনী ইসরাঈলের মানুষ। সহীহ ইবনে হিব্বানে যুলকিফলের ব্যাপারে একটি বর্ণনা এসেছে, হযরত ইবনে উমর রা. বলেন,
سمعت النبي صلى الله عليه وسلم اكثر من عشرين مرة يقول :كان ذو الكفل من بني إسرائيل.
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ বারের বেশি বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, যুলকিফল বনী ইসরাইলের লোক ছিল। -সহিহ ইবনে হিব্বান : হাদিস নং : ৩৮৬

সুনানে তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, মুসতাদরাকে হাকেম, ইমাম তাবরান রচিত আল-মুজামুল কাবীর, ইমাম বায়হাক্বী রহ. এর শুয়াবুল ঈমান, এর বর্ণনায় এসেছে,
كان الكفل من بني إسرائيل
কিফল তথা যুলকিফল বনী ইসরাইলের মধ্য থেকে ছিল। -জামে তিরমিযি : হাদিস নং : ২৪৯৬

উক্ত হাদিস দুটি থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, কুরআনে বর্ণিত যুলকিফল বনী ইসরাইলের লোক ছিল। এবং তিনি একজন নেককার মানুষ ছিলেন। হযরত আবু মুসা আশআরী রা. ও মুজাহিদ রহি. বলেন,
كان ذو الكفل عبدا صالحا ولم يكن نبيا
যুলকিফল নেককার বান্দা ছিলেন। তবে তিনি নবি ছিলেন না। -তাফসীর আল বাহরুল মুহিত : খ. ৬ পৃ. ৩১০

উক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো,
১. ‘যুলকিফল’ বনী ইসরাঈলের ছিলেন, আর বুদ্ধ ছিলো নেপালের বাসিন্দা।
২. ‘যুলকিফল’ ছিলেন একজন নেককার সৎ বান্দা, আর গৌতম বুদ্ধ ছিলো একজন আগাগোড়া নাস্তিক। সুতরাং এমন মানুষকে নবি বলে স্বীকৃতি দিতে এতো আগ্রহ কেন বুঝে আসে না আমার।

বাহায়ী ও কাদিয়ানী মতাদর্শের পুনঃচর্চা
মিথ্যা নবি দাবিদার বাহায়ী মতাদর্শের প্রবর্তক মির্জা হোসেন আলী ইবনে আব্বাস প্রকাশ বাহাউল্লাহ মূলত বুদ্ধ ও কৃষ্ণকে আল্লাহর নবি বলে প্রচার করে। বাহায়ীদের ধারণা মতে নবির সংখ্যা ৯ জন। যথা: ১.ইব্রাহীম ২.কৃষ্ণ ৩. মুসা ৪. জড়থুস্ট্র ৫.বুদ্ধ ৬.যীশু ৭.মুহাম্মদ ৮. মির্জা আলী মুহাম্মদ বাব ৯.বাহাউল্লাহ। অন্যদিকে ভণ্ডনবি মির্জা কাদিয়ানীও তাদের নবি বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। ঠিক তাদের মতো হেযবুত তওহীদও একই পথে হেটেছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে অন্য কোনো সংকলনে লেখার চেষ্টা করবো। ইনশাআল্লাহ।

অভিযোগ:
হেযবুত তওহীদের যুক্তি হলো, আল্লাহপাক তো প্রত্যেক সম্প্রদায় ও জনপদে নবি প্রেরণ করেছেন। এ ব্যাপারে অনেক আয়াতও রয়েছে। সে সকল আয়াতকে দলিল হিশাবে উত্থাপন করে তারা বলতে চায়, ভারত উপমহাদেশের এসব এলাকার জন্যেও তো আল্লাহ তাআলা নবি প্রেরণ করেছেন। তাহলে সে সকল নবিরা কারা? নিশ্চয় কৃষ্ণ, বুদ্ধ, যুধিষ্ঠির, মনু প্রমুখ?

উত্তর:
আল্লাহ তাআলা এসব এলাকাতেও নবি পাঠিয়েছেন। তবে তারা কারা? মহান রব বলেন,
ولقد ارسلنا رسلا من قبلك منهم من قصصنا عليك ومنهم من لم نقصص عليك.
বস্তুত আমি তোমার পূর্বেও বহু রাসূল পাঠিয়েছি। তাদের মধ্যে কতক এমন, যাদের কতিপয়ের বৃত্তান্ত আমি তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি আর কতক এমন যাদের বৃত্তান্ত তোমাকে জানাইনি। -সুরা মুমিন : ৭৮

উক্ত আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন, আপনার পূর্বেও আমি অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি। তাদের মধ্য থেকে অনেকের বিবরণ আপনাকে বলে দিয়েছি। যাদের তাদের সংখ্যা পঁচিশ। কিন্তু বাকিদের নাম আল্লাহ জানাননি। তবে প্রয়োজন হলে নিশ্চয় জানানো হতো। তবে নাম না জানা নবিদের ওপরেও আমরা ঈমান রাখি। তবে যাঁদের নাম কুরআন-সুন্নাহ’য় বর্ণিত হয়নি, তাঁদের বেলায় জোর করে কাউকে নবি বলে প্রচার করা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিদ্রোহের শামিল। প্রকাশ থাকে যে, এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবি-রসুলের যে সংখ্যা বলা হয় তা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে বর্ণিত নয়।

Check Also

মানবতাই ধর্ম:

প্রিয় পাঠক, হেযবুত তওহীদ ইসলামকে ধর্ম হিসাবে মানতে নারাজ। তাদের কাছে ধর্ম হলো, ‘মানবতা’ বা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.