Home > হিজবুত তাওহীদ > আত্মশুদ্ধি নিয়ে হেযবুত তওহীদের ভ্রান্তি:

আত্মশুদ্ধি নিয়ে হেযবুত তওহীদের ভ্রান্তি:

নফস হলো মানব জিবনের এক ভয়ঙ্কর ফিৎনার কেন্দ্রস্থল। কারণ নফস বেশিরভাগ সময়েই মানুষকে খারাপ কর্মের নির্দেশনা দেয়। যার প্রমাণ কুরআন শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ইউসুফ আ. বলেন,

وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلاَّ مَا رَحِمَ رَبِّيَ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ

অর্থ: আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না। নিশ্চয় মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ কিন্তু সে নয়-আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয় আমার পালনকর্তা ক্ষমাশীল, দয়ালু
সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৩

সুতরাং বুঝা গেলো, নফসে আম্মারা ও বিতাড়িত ইবলিস শয়তান সর্বদা মানুষকে কুকর্মের দিকে আহ্বান করে। আর মানুষ যখন নফসের অনুসারী হয়ে যায়, তখন তার সকল কিছুই তার নিজের ও আম জনতার জন্য বড় ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য নফসকে পরিচ্ছন্ন রাখা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। যাকে পরিভাষায় ‘তাযকিয়াতুন নাফস’ বলে আখ্যায়ীত করা হয়। কিন্তু সময়ের দুর্ধর্ষ ঈমান ডাকাত হেযবুত তওহীদ এই তাযকিয়ার বিরুদ্ধে চরম পর্যায়ের আঘাত করেছে। চলুন আগে তাদের দাবিগুলো দেখে নেওয়া যাক।

হেযবুত তওহীদ কী বলে?

নিন্মে হেযবুত তওহীদের কিছু বক্তব্য তাদের বই থেকে হুবহু তুলে ধরা হলো-

এক.
আধ্যাত্মিকতা ইসলামের আসল উদ্দেশ্য নয়।

‘আধ্যাত্মিকতা ইসলামের আসল উদ্দেশ্য নয়।:
সূত্র: শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃষ্ঠা: ৫৭

‘জেহাদ করার পর যদি সময় থাকে তবে তাসাউফের সাধনা করুন, কোন আপত্তি নেই।’
সূত্র: বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ পৃষ্ঠা-৪৩

‘এই সামরিক দীন পৃথিবীর অন্যান্য অসামরিক দীনের পর্যায়ে পর্যবসিত হলো অর্থাৎ খ্রিষ্টান,বৌদ্ধ,হিন্দু,ইহুদি,জৈন ইত্যাদি বহু দীনের(ধর্মের) মত আরেকটি ধর্মে পরিণত হলো যেটার উদ্দেশ্য এবাদত,পূজা,উপাসনা করে আত্মার চর্চা করা।’
সূত্র: ইসলামের প্রকৃত সালাহ পৃ:২০

‘নির্জনে বা হুজরায় বসে ব্যক্তিগতভাবে আত্মিক উন্নতি করতে পারে এবং ব্যক্তিগতভাবে তার ফল ভোগ করতে পারে। কিন্তু তাতে জাতি উপকৃত হবে না। পারলেও তা অতি সামান্য।’
সূত্র: বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ পৃষ্ঠা-১৭

‘একজন মোজাহেদ জেহাদ করে প্রথমত মানবজাতির কল্যানের জন্য আল্লাহকে বিজয়ী করার জন্য। পক্ষান্তরে সাধু ফকির দরবেশ জুহদ বা আত্মিক সাধনা করে একান্তই নিজের জন্য স্বীয় আত্মিক পরিতৃপ্তি ও পরিশুদ্ধির জন্য।’
সূত্র: বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ পৃষ্ঠা-২৭

দুই.
আত্মারচর্চা নবীজির সা. মিশন নয়:

‘তাসাউফের মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে তাঁর নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া শিক্ষা দেওয়া মোহাম্মদের স: লক্ষ্য নয়। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন আইন, নতুন সমাজ ব্যবস্থা স্থাপন করা, একটা সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।’
সূত্র: বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ পৃষ্ঠা-১৭

তিন.
আত্মারচর্চা করা খ্রিষ্টীয় শিক্ষা:

‘আধ্যাতিক ঘষামাজা খ্রিষ্টানদের শেখানো।’
সূত্র: এসলাম শুধু নাম থাকবে পৃ:১১২

চার.
সুফিরা ইসলামের সবচে বেশি ক্ষতি করেছে.

‘লক্ষ শত্রু বিশ্বনবীর স: জীবনের যে ব্রতকে যে ক্ষতি করতে পারেনি, পন্ডিত  ও সুফিরা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ক্ষতি করলেন। মহানবী স: তার উম্মাহকে যেদিকে চালনা করলেন, সুফিরা চালনা করলেন তার উল্টো দিকে।’
সূত্র: বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ পৃষ্ঠা-৩৫

‘দুর্দান্ত টর্নেডোর মত গতিশীল উম্মতে মোহাম্মদীকে নিঃসাড়, নির্জীব করে অন্তর্মুখিতায় বুঁদ করে দেয় ভারসাম্যহীন সুফিবাদ। যোদ্ধা জাতি অস্ত্র ছেড়ে তসবিজ নেয়, যুদ্ধ ছেড়ে ওজিফা পাঠ করে রিপুজীয় পীর বুজুর্গ হওয়ার সাধনায় আত্মনিয়োগ করে। পরিণতিতে জাতির ভাগ্যে নেমে আসে করুন দাসত্ব।যার ঘানি আমরা আজও টেনে যাচ্ছি।’
সূত্র: বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ পৃষ্ঠা-৫৩

‘অন্যদিকে জাতির মধ্যে জন্ম নিল একটি বিকৃত সুফীবাদী গোষ্ঠী। তারা উম্মতে মোহাম্মদীর সংগ্রামী জীবনটাকে উল্টিয়ে একেবারে অন্তর্মুখী করে দিল। যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী,প্রতিবাদী দুর্দান্ত গতিশীল ইসলামকে তারা সংসারত্যাগী, বৈরাগী সাধু -সন্ন্যাসীর ধর্মে পরিণত করল। সমাজে নিরাপত্তা, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত আছে কি না সে বিষয়ে উদাসীন হয়ে তারা নিজেদের আত্মার উন্নতিকেই জীবনের মূল কাজ বানিয়ে নিল। আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায় নির্দেশ করতে গিয়ে এই আধ্যাত্মিক সাধকগণ শত শত তরিকা সৃষ্টি করলেন। আর বিরাট সংখ্যক সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ হাজারো মতভেদের উপর গড়ে ওঠা ফেরকা-মাযহাব-তরিকায় বিভক্ত হয়ে গেল।’
হলি আর্টিজেনের পর-১৩।

পাঁচ.
প্রচলিত সুফিবাদী ত্বরীকা বিদআত:

‘বিকৃত সুফীবাদের তরীকাগুলোও বেদাত। কারণ বিশ্বনবীর সময় কোনো তরীকা ছিলো না।’
সূত্র: প্রিয় দেশবাসী পৃ:১১৪

উপরোক্ত বক্তব্যগুলো থেকে জানতে পারলাম, হেযবুত তওহীদের দাবি হলো-
১. তাযকিয়া ইসলামের আসল উদ্দ্যেশ্য নয়। ২. তাযকিয়া নবীজির সা. মিশন নয়। ৩. তাযকিয়া খ্রিষ্টানদের আবিস্কার করা। ৪. সুফীরা ইসলামের সবচে ক্ষতি করেছে। ৫. প্রচলিত সুফিবাদী ত্বরীকা বিদআত। নাউযুবিল্লাহ। চলুন নিন্মে তাদের দাবিগুলোর সাথে ইসলামের চেতনা কী আলোচনা করা যাক।

ইসলাম কী বলে?

তাযকিয়া হচ্ছে আত্মোন্নতির নিমিত্তে এমন একটি মানবীয় কাজ এবং অর্জিত প্রচেষ্টা যা অসৎকাজের পরিহার এবং সৎকাজের বাস্তবায়নে সহযোগীতা করে। এর অপর নাম নফসের সাথে জিহাদ কিংবা নফসের যাকাত। এটি একটি বাস্তবমুখী,প্রযোজ্য,এবং ভারসাম্যপূর্ণ প্রক্রিয়া। এটি কুরআন সুন্নাহ্ এবং সাহাবাদের জীবন পদ্ধতি থেকে উৎকলিত। এই আত্মশুদ্ধির বিষয়টি সর্বপ্রথম আবিস্কার করেছেন মহান আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসুল সা.। শয়তান ও নফসকে কন্ট্রোল করার একমাত্র মাধ্যম হিসাবে পরিচয় করানো হয়েছে, ‘নফসের পরিচর্যা’ বা তাযকিয়াতুন নাফস’ নামে। যে ব্যক্তি তার নফসকে পরিশুদ্ধ করবে, সে নফস সফল। আর যে নফসকে পরিশোধন করবে না, সে ব্যর্থ ও হতভাগা। মহান রব বলেন,

قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّى

অর্থ: নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয়
সূরা আ’লা, আয়াত: ১৪

অপর আয়াতে আসছে,

قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا

অর্থ: যে নিজেকে পরিশুদ্ধ (তাযকিয়া) করবে, সে অবশ্যই সফলকাম হবে। আর যে নিজেকে কলুষিত করবে, সে নিশ্চয়ই ব্যর্থ-মনোরথ হবে’।
সূরা শামস, আয়াত: ৯-১০

এজন্য মানব জিবনের বিফলতা ও সফলতার একমাত্র কেন্দ্রস্থল এই নফসকে পরিচ্ছন্ন রাখতে উম্মাহকে উৎসাহ দিয়েছেন খোদ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলে আরাবী সা.। আল্লাহ পাক বলেন,

يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

অর্থ: যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না। কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে (সেই সুস্থ অন্তরই উপকারে আসবে)।
সূরা শু’আরা, আয়াত: ৮৮-৮৯

সুতরাং বুঝা গেলো, অন্তর সুস্থ করে না নিয়ে গেলে সবই বিফল। এজন্য আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের নফসকে পরিশুদ্ধ করার জন্য যুগে যুগে নবী-রাসুলগণকে পাঠিয়েছেন। এমনকি আমাদের নবীজিকে সা. যে কয়েকটি মিশন দিয়ে প্রেরণ করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিলো তাযকিয়া।

আত্মশুদ্ধি কি নবীজির মিশন নয়?

মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল সা. কে কয়েকটি মিশন দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো, ‘তাযকিয়া’ বা আত্মশুদ্ধি করা। মহান আল্লাহ বলেন,

هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ

অর্থ: তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র (তাযকিয়া) করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।
সূরা জুমআ, আয়াত: ২

অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

لَقَدْ مَنَّ اللّهُ عَلَى الْمُؤمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُّبِينٍ

অর্থ: আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন। তাদেরকে পরিশোধন (তাযকিয়া) করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও কাজের কথা শিক্ষা দেন। বস্তুতঃ তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট।
সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৪

বুঝা গেলো, রাসুলুল্লাহ সা. এর মিশনের অন্য অন্যতম মিশন ছিলো মানুষের আত্মার পরিচর্চা করা। যেহেতু মানবজাতির এ আত্মা শুদ্ধ করার জন্য মহান রব তাঁর রাসুল সা. কে পাঠিয়েছেন, এজন্য রাসুল সা. সে দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করে গেছেন। আত্মাশুদ্ধির জন্য রাসুল সা. এক ঐতিহাসিক কথা বলেন,

أَلاَ وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ‏ أَلاَ وَهِيَ الْقَلْبُ

অর্থাৎ জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে গোশতের টুকরোটি হল নফস বা অন্তর।
সূত্র: সহিহ বুখারী, হাদিস নং- ৫২

তাহলে বুঝতে পারলাম, আত্মাশুদ্ধ করাও নবীজির সা. মিশন ছিলো। অথচ হেযবুত তওহীদের দাবী হলো,

‘তাসাউফের মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে তাঁর নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া শিক্ষা দেওয়া মোহাম্মদের স: লক্ষ্য নয়।’
সূত্র: বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ পৃষ্ঠা-১৭

এবং তারা আরও বললেন,

‘আধ্যাত্মিকতা ইসলামের আসল উদ্দেশ্য নয়।’
সূত্র: শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম পৃষ্ঠা-৫৭

এখন আপনিই বলুন, হেযবুত তওহীদের দাবি আর কুরআন শরীফ ও হাদিসে নববীর সা. দাবি কি কখনই এক না ভিন্ন? নিশ্চয় ভিন্ন। শুধু ভিন্নই নয়, বরং তারা নবীজির সা. মিশনের উপর হস্তক্ষেপ করেছে এ দাবি করে।

তাযকিয়া কী খ্রিষ্টানদের আবিস্কার বা বিদ’আত?

উপরোল্লিখিত হেযবুত তওহীদের একটা দাবি ছিলো- তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি খ্রিষ্টানদের আবিস্কার এবং প্রচলিত ত্বরীকাগুলো বিদ’আত। অথচ সকল ত্বরীকাগুলোতে কয়েকটি বিষয়ে বায়’আত করানো হয়। যেমন শিরক না করা, চুরি না করা, যিনা না করা, হত্যা না করা, কাউকে মিথ্যা অপবাদ না দেওয়া, গুনাহ না করা ইত্যাদী। চলুন এ বিষয়টি নতুন আবিস্কার নাকি রাসুলুল্লাহ সা. থেকে এর কোনো অস্তিত্ব প্রমাণিত আছে কি না দেখা যাক। সহিহ বুখারীর একটি হাদিসে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সাহাবায়ে কেরামকে রা. রাসুলুল্লাহ সা. দুই বার বায়’আত করান। প্রথম বায়’আত ছিলো ঈমানের বায়’আত, আর দ্বিতীয় বায়’আত ছিলো তাযকিয়ার বায়’আত। হাদিসটি আগে দেখুন-

عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ قَالَ بَايَعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِي رَهْطٍ فَقَالَ أُبَايِعُكُمْ عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللهِ شَيْئًا وَلاَ تَسْرِقُوا وَلاَ تَزْنُوا وَلاَ تَقْتُلُوا أَوْلاَدَكُمْ وَلاَ تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ وَلاَ تَعْصُونِي فِي مَعْرُوفٍ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَأُخِذَ بِهِ فِي الدُّنْيَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَطَهُورٌ وَمَنْ سَتَرَهُ اللهُ فَذَلِكَ إِلَى اللهِ إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ وَإِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ

অর্থ: উবাদাহ ইবনু সামিত রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একটি দলের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বায়’আত করেছি। তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের এ মর্মে বায়’আত করছি যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, তোমাদের সন্তান হত্যা করবে না, সামনে বা পিছনে কারো অপবাদ দিবে না, শারীয়াত সম্মত কাজে আমার অবাধ্যতা করবে না, তোমাদের মধ্যে যে আপন ওয়াদাগুলো মেনে চলবে তার বিনিময় আল্লাহর নিকট। আর যে এগুলো থেকে কিছু করে ফেলবে আর সে জন্য দুনিয়াতে যদি তার শাস্তি হয়ে যায়, তাহলে এটি হবে তার জন্য গুনাহর কাফ্ফারা এবং গুনাহর পবিত্রতা। আর যার (দোষ) আল্লাহ্ গোপন রেখেছেন তার ব্যাপারটি আল্লাহর উপর। (আল্লাহ্) ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দিতে পারেন। আবার ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন।
সূত্র: সহিহ বুখারী, হাদিস নং- ৬৮০১

প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত হাদিস থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, নবীজি সা. সাহাবায়ে কেরামকে দ্বিতীয়বার বায়’আত করিয়েছিলেন শিরক, চুরি, হত্যা না করতে, অপবাদ না দিতে, ওয়াদা রক্ষা করতে, দোষ গোপন রাখতে ইত্যাদী। আর আপনারা যারা প্রচলিত ত্বরীকাগুলোর বায়’আতে উচ্চারিত বিষয়গুলো সম্পর্কে জানেন, তারা নিশ্চয় জানেন যে, উপরোক্ত বিষয়গুলো উচ্চারণ করেই বায়’আত হতে হয়। তাহলে আপনারাই বলুন, প্রচলিত তাযকিয়ার বিষয়টি কী খ্রিষ্টানদের আবিস্কার? এগুলো কী বিদ’আত? এগুলো কী কোনো ধর্মব্যবসায়ীদের আবিস্কার? নাকি রাসুলুল্লাহ সা. এর আবিস্কার? যারা নবীজির সা. আবিস্কৃত বিষয়গুলোকে খ্রিষ্টান, ধর্মব্যবসায়ীদের আবিস্কার বলে চালিয়ে দিতে চায় তারা কী মুসলিম হতে পারে?

নফসের জিহাদ কী প্রমাণিত নয়?

আত্মার পরিচর্যাকে জিহাদের অন্তুর্ভূক্ত করেছেন খোদা রাসুলুল্লাহ সা.। যা সহিহ হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত। কিন্তু হেযবুত তওহীদ দাবি করেছেন, নফসের পরিচর্যাকে জিহাদ বলে আখ্যায়িত করেছে ধর্মব্যবসায়ী আলেমরা। চলুন তারা কি বলে আগে দেখে নেওয়া যাক। তারা লিখেছেন,

‘এই আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদ বের করেছে পলায়নপর,ভীরু-কাপুরুষ ধর্মজীবী আলেম মোল্লারা নিজেদেরকে সকল প্রকার বিপদ-আপদ থেকে বাঁচিয়ে ধর্মব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য।’
সূত্র: এসলাম শুধু নাম থাকবে পৃ:৫৮

‘এই জাতির পথভ্রষ্ট লোকেরা যখন নীতি হিসাবে জেহাদ ত্যাগ করলেন তখন তাঁরা বুঝলেন না যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দৃষ্টিতে আর তারা মো’মেন রইলেন না। তাদের ঐ দুর্ভাগ্যজনক কাজের ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টায় তারা হাদিস উদ্ভাবন করলেন নফসের সঙ্গে জেহাদই হচ্ছে জেহাদে আকবর, বড় জেহাদ। এই হাদীসের সংকলক ইমাম বায়হাকী নিজেই স্বীকার করেছেন যে এই হাদীসের সনদ ত্রুটিযুক্ত এবং এই দয়িফ হাদিস সম্বন্ধে হাফেজ ইবনে হাজ্জার প্রমুখ মোহাদ্দেসরা বলেছেন এটা কোন হাদিসই না, এটা একটা আরবি প্রবাদ বাক্য মাত্র।’
সূত্র: এসলামের প্রকৃত রুপরেখা, পৃ. ৯-১০

প্রিয় পাঠক, তাদের লেখনী থেকে বুঝতে পারলাম যে, তাদের দাবি হলো-
১. নফসের পরিচর্যাকে জিহাদ বলে আখ্যায়িত করেছে ধর্মব্যবসায়ী আলেম-উলামারা।
২. নফসের জেহাদ সংক্রান্ত হাদিসটি জাল।

তাহলে চলুন হাদিসটির ব্যাপারে একটু পর্যালোচনা করা যাক। এ ব্যাপারে কয়েকটি হাদিস সনদের মানসহ উল্লেখ্য করছি।

এক.
নফসের জিহাদকে বড় জিহাদ বলে আখ্যায়িত করার হাদিসটি সহিহ সনদে প্রমাণিত। বর্ণিত আছে,

عن ابي ذر قال قلت يا رسول الله أي الجهاد أفضل قال أن يجاهد الرجل نفسه وهواه

অর্থ: হযরত আবু যার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম-কোন জিহাদ সর্বোত্তম? তিনি বললেন-নফস ও কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদই উত্তম জিহাদ।
সূত্র: জামিউল আহাদীস, হাদীস নং- ৩৯৭৭ হিলইয়াতুল আউলিয়া খ. ২ পৃ. ২৪৯

সনদ:
উক্ত হাদিসটিকে শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহি. সহিহ বলেছেন।
সূত্র: সহিহ আল জামে, হাদিস নং- ১০৯৯

দুই.
অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে

وأفضل الجهاد من جاهد نفسه فى ذات الله عز وجل

অর্থ: সর্বত্তোম জিহাদ হলো আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে অন্তরের সাথে জিহাদ করা।
সূত্র: কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ৪৩৪২৭

উক্ত হাদসিটিকে পৃথিবীর কোনো মুহাদ্দিস জাল বলেছেন বলে আমার জানা নেই। উপরন্তু তারা ইবনে হাজার আসকালানী রহি. এর ব্যাপারেও একটা মিথ্যা তোহমত দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত হাদিসটিকে নাকি ইবনে হাজার আসকালানী রহি. জাল বলেছেন। অথচ ইবনে হাজার আসকালানী রহি. নিজে এ সংক্রান্ত একটি হাদিস বর্ণনা করেন, নবীজি সা. বলেছেন,

والمجاهدُ من جاهدَ نفسَهُ في طاعةِ اللهِ تعالى

অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে অন্তরের সাথে যে ব্যক্তি জিহাদ করে সে মমুজাহিদ।
সূত্র: মুখতাসারুল বাযযার, খ. ১ পৃ. ৪৬৪

এ হাদিসটি উল্লেখ্য করে খোদ ইবনে হাজার আসকালানী রহি. বলেন, إسناده صحيح  অর্থাৎ হাদিসটির সনদ সহিহ।
সূত্র: মুখতাসারুল বাযযার, খ. ১ পৃ. ৪৬৪

সুতরাং প্রমাণ হলো, হেযবুত তওহীদ মূলত কুরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত ও নির্দেশিত আত্মশুদ্ধির পথ থেকে সরিয়ে মানবজাতিকে নফস ও শয়তানের অনুগামী বানাতে বড় বড় ইসলামিক স্কলারদের নামেও মিথ্যাচার ছড়াতে বদ্ধপরিকর।

স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়ে প্রমাণ:

দ্বীন ইসলাম এমন এক চুড়ান্ত বিজয়ী ধর্ম যার সততার প্রমাণ অনেক সময় বাতিলদের থেকেও প্রমাণিত হয়। এমনটি হয়েছে হেযবুত তওহীদের থেকেও। তারা তাযকিয়ার বিরুদ্ধে শত শত পৃষ্ঠা লিখলেও তাদের যবান থেকে আল্লাহ পাক এই চুড়ান্ত বিষয়ের সততা বের করিয়ে দিয়েছেন। চলুন তার কয়েকটি নমুনা নিচে দেখে নেওয়া যাক।

এক. হেযবুত তওহীদের দাবি ছিলো,

‘জাতির ভাগ্য পরিবর্তন এর চেয়েও আত্মিক পরিবর্তন বেশি জরুরী এটা আল্লাহ রাসুল ভালোভাবে জানতেন।’
সূত্র: ইসলাম কেন আবেদন হারাচ্ছে পৃষ্ঠা-৪৬

অথচ এরাই আবার অন্যত্র বলে বসলেন,

‘নির্জনে বা হুজরায় বসে ব্যক্তিগতভাবে আত্মিক উন্নতি করতে পারে এবং ব্যক্তিগতভাবে তার ফল ভোগ করতে পারে। কিন্তু তাতে জাতি উপকৃত হবে না। পারলেও তা অতি সামান্য।’
সূত্র: বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ পৃষ্ঠা-১৭

দু’টো কথার কোনটা সঠিক? একটা সত্য হলে অপরটা তো নিশ্চয় ভুল। বেলা শেষে তারা মিথ্যুক।

দুই.
তাদের এক স্থানের দাবি-

‘আত্মাই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মানুষকে যদি আত্মিক শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করা হয়, তাদেরকে যদি নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তবে সে নিজেই আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে অপরাধ সংগঠন থেকে নিবৃত্ত থাকবে। অপরাধ প্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য এটাই সর্বোত্তম পন্থা।’
সূত্র: ধর্ম বিশ্বাস পৃষ্ঠা-১৩

তারাই আবার অন্যত্র বলেন,

‘আধ্যাত্মিকতা ইসলামের আসল উদ্দেশ্য নয়।’
সূত্র: শ্রেণীহীন সমাজ সাম্যবাদ প্রকৃত ইসলাম, পৃষ্ঠা: ৫৭

আপনারাই বলুন, যারা নিজেরাই নিজেদের কথার বিরোধীতা করে, তারা কি সুস্থ না অসুস্থ?

তিন.
তারা এক জায়গায় দাবি করলেন,

‘মানুষ এক পায়ে হাঁটতে পারে না। তাকে দু পায়ে ভারসাম্য করতে হয়। দীনের ও দুটি পা। এক পা শরিয়া অন্য পা মারেফত। এই দুই পায়ের সহযোগিতায় একটা মানুষ ভারসাম্য রেখে হাঁটতে পারে। একটা জাতির বেলায়ও তাই। ঐ দুই পায়ের একটা বাদ দিলে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে ঐ জাতি আর হাটতে পারবে না তা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না।’
সূত্র: বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ পৃষ্ঠা-১৬

আবার অন্যত্রে বলেন,

‘তাসাউফের মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে তাঁর নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া শিক্ষা দেওয়া মোহাম্মদের স: লক্ষ্য নয়। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন আইন, নতুন সমাজ ব্যবস্থা স্থাপন করা, একটা সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।’
সূত্র: বর্তমানের বিকৃত সুফিবাদ পৃষ্ঠা-১৭

কী আশ্চর্য দ্বিমুখী আচরণ! এরপরও কী জাতি বুঝবে না তাদের ষড়যন্ত্রের রুপরেখা?

পরিশুদ্ধ নফসের ঠিকানা জান্নাত:

পরিশেষে জেনে রাখুন, তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নফসে আম্মারা উন্নতি হতে হতে যখন পূর্ণতা পায়, তখন সেটা নফসে মুতমায়িন্না হয়ে যায়। আর এ মুতমায়িন্না নফসটা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। এই নফসকে তাঁর মৃত্যুর সময় সু-সংবাদ দিয়ে বলা হবে,

يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً فَادْخُلِي فِي عِبَادِي وَادْخُلِي جَنَّتِي

অর্থ: হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি প্রশান্তচিত্তে তোমার পালনকর্তার দিকে ফিরে চলো। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।
সূরা ফাজর,  আয়াত- ২৭-৩০

আল্লাহ তা’আলা আরও  বলেন,

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى

অর্থ: পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে নফসকে নিবৃত্ত রাখে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত।
সূরা নাযি‘আত, আয়াত: ৪০-৪১

সুতরাং চলুন আমরা সকলেই আত্মার পরিশোধনে এবং আল্লাহর আনুগত্যে নিবিষ্ট হ’তে সর্বদা সচেষ্ট থাকি। মহান আল্লাহ আমাদের হেযবুত তওহীদের ষড়যন্ত্র থেকে হিফাযত করেন। আমীন!

Check Also

নামাজ ইবাদত নয়, জিহাদের ট্রেণিং।

  হেযবুত তওহীদের দাবি হলো, মানব সৃষ্টির মূল টার্গেট হলো হুকুমত বা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.